ধারাবাহিক - মহাপ্রস্থানের পথে - -অয়ন দাস

 

ধারাবাহিক
 
 
 
 মহাপ্রস্থানের পথে
অয়ন দাস


 
|| অষ্টম  পর্ব  ||


 -৪০-

বিপদ কখনো বলে কয়ে, দিন ক্ষন মেনে আসে না। সেটা আসে অতর্কিতে, আচমকা।
ওসলা পৌঁছে, সেখানে তাঁবু ভাড়া করে গোটা রাতটা কাটিয়ে দেবার পরও যখন কোনো সমস্যা হলো না, শ্রীময়ীরা একটু নিশ্চিন্ত ভাবে ব্যাপারটা হাল্কা ভাবে নিয়েছে, তখনই গোলমালটা হলো।

সকালে ওসলাতে বেশ খোঁজখবর করা হলো খানিকটা। কিন্তু শঙ্কর বাবুর কোনো হদিশ পাওয়া গেলো না। কাজেই এর পরবর্তী গন্তব্য, হর কী দুনের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলো ওরা। এপথ আরো বেশি বিপদ সঙ্কুল। যত ওপরে চলেছে ওরা, জঙ্গল যেন আরো বেশি বৈচিত্র্যময় ময় হয়ে ধরা দিচ্ছে। পাইন, সিডার, ওকের বনে মেঘের দল খেলা করছে মাঝে মাঝেই। আজও একদম সামনে গাইড ছেলেটি, আর ওর পেছনে শ্রীময়ী। সবশেষে রাতুল আর ডঃ শর্মা। লোকজনের ভিড় একেবারে নেই বললেই চলে।

শ্রীময়ীর মনে কালকের মতোই খটকাটা যেন বার বার এসে ধাক্কা দিচ্ছে। কোথায় যে গোলমাল টা হচ্ছে কিছুতেই বুঝতে পারছে না। হর কি দুনের প্রায় কাছাকাছি এসে এবারে ধাঁ করে মনে পড়ে গেল। প্রফেসর নন্দীর হত্যা রহস্যের সময় যখন ওনার সেক্রেটারিকে জেরা করছিলো শ্রীময়ী, সেক্রেটারি ছেলেটির ঘাড়ের কাছে একটা বিশেষ উল্কি দেখেছিলো। সূর্যোদয়ের উল্কি আঁকা যেটা হুবহু এখন এই গাইড ছেলেটার ঘাড়ের কাছে দেখতে পাচ্ছে। এবার বুঝতে পারলো কেন ওর সন্দেহ হচ্ছিলো এতক্ষণ। তার মানে কাল থেকে যে গাইড সেজে এতদূর নিয়ে এলো সে বিকাশ ওরফে বৃষকেতু। আর তাই যদি হয় সুশান্ত বাবুর আশেপাশে থাকাটাও আশ্চর্যের নয়।

খানিক এগিয়েই শ্রীময়ী থমকে দাঁড়ালো। রাতুল আর ডঃ শর্মা কে ইশারায় থামতে বললো। ইতিমধ্যে বৃষকেতু খানিকটা এগিয়ে গেছে। কী সন্দেহ হওয়ায়, থমকে পিছন ফিরে তাকালো।

শ্রীময়ী ইস্পাত কঠিন স্বরে জিজ্ঞেস বললো, " ছদ্মবেশে আমার চোখকে ফাঁকি দিতে পারবে না বিকাশ বাবু ওরফে বৃষকেতু সিং। ঠিক কী মতলবে আমাদের সাথে এতটা এলে বলোতো ?"

বৃষকেতু কিছু বলার আগেই দেখতে পেল শ্রীময়ীর হাতে মুহূর্তের মধ্যে একটা পিস্তল এসে পড়েছে। সেটা উঁচিয়ে ধরে কথাগুলো বলছে শ্রীময়ী।

-৪১-

বৃষকেতুর মুখে ক্রূর একটা হাসি খেলা করছে। বুঝতে পারলো আর লুকিয়ে লাভ নেই। এক এক করে নকল দাড়ি গোঁফ পাগড়ি খুলে ধীর কন্ঠে বললো, " সত্যের খোঁজে এসেছি ম্যাডামজী। আমার পরিবারের একটা জিনিস এতদিন ধরে লুকিয়ে রাখা হয়েছে সেটার খোঁজ যে আমার চাই।"
-" শাট আপ", ফোঁস করে ওঠে শ্রীময়ী, " একটা খুনীর মুখে এসব সত্যের কথা মানায় না। এবারে তোমার ভবলীলা সাঙ্গ হবার সময় হয়েছে যে। "

বৃষকেতু নিরুত্তাপ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রয়েছে। পিস্তলের সামনেও সেভাবে ভ্রূক্ষেপ করছে না সে। শ্রীময়ীর পেছনে রাতুল আর ডঃ শর্মা হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

এমন সময় একটা কান ফাটানো শব্দ হলো, মনে হলো যেন কোনো বিস্ফোরণ হলো। শব্দের অভিঘাত এতটাই ছিলো যে বেশ কয়েকটা পাথর পাশের পাহাড়ি ঢাল দিয়ে গড়িয়ে পড়লো।

পরমুহূর্তেই শ্রীময়ী হাত চেপে ধরে বসে পড়লো। একটা গুলি ওর পিস্তল ছুঁয়ে চলে গেল আর পিস্তলটা বেশ কিছুটা দূরে ছিটকে পড়লো। সজোরে একটা প্রতিঘাত নিমেষে শ্রীময়ীকে কাবু করে দিলো।

পাহাড়ের আড়াল থেকে একটা রিভলবার নিয়ে বেরিয়ে এলেন সুশান্ত সেনগুপ্ত। এতক্ষন আড়াল থেকে সবটা প্রত্যক্ষ করছিলেন। এবার মওকা বুঝে আত্মপ্রকাশ করলেন এই গোটা কর্মকান্ডের আসল খলনায়ক।
-" অনেকক্ষণ ধরেই নাটকটা দেখছি ম্যাডাম। এবারে যে আমার হাতেই যবনিকা পড়বে এ নাটকের", চিবিয়ে চিবিয়ে কথা গুলো বললেন সুশান্ত সেনগুপ্ত।

-" স্কাউন্দ্রেল, কী ভেবেছেন এত করে পার পেয়ে যাবেন ? তাহলে আপনার ধারণা ভুল মিঃ সেনগুপ্ত", ব্যথায় অধীর হয়ে গিয়েও শ্রীময়ী নিতান্ত মনের জোরে এখনো কথাগুলো বলার সাহস পাচ্ছে।

রাতুল ক্রমশ পিছিয়ে আসছিলো। গুলির শব্দে যেখানে পাথর গুলো পড়েছিল, সেদিকেই এক পা এক পা এগোচ্ছিল এমনভাবে যাতে কেউ বুঝতে না পারে। অন্তঃত একটা পাথরও এ অবস্থায় সাংঘাতিক কোনো অস্ত্র হতে পারে, এটা ওর মনের কোণে ঘুরছিলো। কোনভাবে যদি কিছু করা যায়....।

বৃষকেতু দাঁড়িয়ে রয়েছে চুপ করে। অপেক্ষা করছে পরবর্তী আদেশের জন্য। সুশান্ত বাবু আরো এগিয়ে এলেন খানিকটা। জিভ দিয়ে চুক চুক করে একটা বিশ্ৰী শব্দ করে বললেন, " তোমার সাহস দেখে আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি শ্রীময়ী ব্যানার্জি। এই অবস্থাতেও তোমার মুখে এত বড় বড় কথা বলতে সাহস পাচ্ছ কী করে ? কিন্তু আর যে সময় দেওয়া যাবে না। বৃষকেতু তোমার ফেলে রাখা কাজ টা এবার সেরেই ফেলো আর দেরি কেন। আগে ওই ছেলে মেয়ে দুটোকে খতম কর। তারপর ডঃ শর্মার কাছ থেকে ফলকটা উদ্ধার করতে হবে যে। ওই ফলকের মধ্যেই লুকিয়ে সেই মহা শক্তিশালী অস্ত্রের বীজমন্ত্র যা ব্যবহার করলে গোটা পৃথিবীকে নিজের পদতলে আনা যায়। কম সাধনা করিনি এই পঁচিশ বছর ধরে। আজ আমার সেটা চাই। খালি হাতে তো আর আমি ফিরবো না।"

-৪২-

ডঃ শর্মা চিৎকার করে বললেন, " আপনি পাগল হয়ে গেছেন। ওভাবে কেউ কোনো বীজমন্ত্র দিয়ে কিছু করতে পারে না। তারজন্য দরকার হয় এক গুহ্য জ্ঞানের, কঠিন তপসাধনার যার কোনটাই আপনার মধ্যে নেই।"
-" আঃ... চুপ একদম। বৃষকেতু দেরি করো না। যা বলছি করো", বলে উদ্ভ্রান্তের মতো শূন্যে গুলি চালালো সুশান্ত বাবু।

গুলির শব্দ আর তার মুহুর্মুহু প্রতিধ্বনি কান যেন ঝালাপালা করে দেয়। বৃষকেতু এগিয়ে আসতেই রাতুল একদম পাহাড়ের গা ঘেঁষে দাঁড়ালো। এরই মধ্যে দুটো পাথর সবার অলক্ষিতে হাতে তুলে নিয়েছে সে। শ্রীময়ীকে দেখে কষ্ট লাগছিলো। বেচারা রীতিমতো কাতরাচ্ছে যন্ত্রণায়।

ডঃ শর্মা বললেন, " বৃষকেতু তোমাকে দেখে আমার ভূদেব সিংয়ের ছেলের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। মুখের আদল কী সাংঘাতিক এক রকম যা এই পঁচিশ বছর পরও বার বার ভাবাচ্ছে আমায়। তুমি যেই হও, জেনে রেখো ভূদেব সিংয়ের মৃত্যু একটা হত্যা কান্ড ছিলো। আর তার জন্য দায়ী এই সুশান্ত সেনগুপ্ত। সেদিন আগুন লাগিয়ে ফলকটা হাতানোর তালে ছিলো কিন্তু পারেনি। আজ আবার সেটা নিতে এত কাঠখড় পুড়িয়ে এখানে এসেছে। কিন্তু জেনে রেখো সেটা সুরক্ষিত আছে। কোনো বিপদের আঁচ এসে লাগেনি।"

বৃষকেতু থমকে দাঁড়ালো। এ কী শুনছে সে। এতদিন যা যা শুনে এসেছে সব বুঝি ভুল। সুশান্ত বাবু তাকে তিলে তিলে গড়ে তুলেছেন মিথ্যার আধারে। এ যে অসম্ভব।

-" থামলে কেন তুমি। ওসব মিথ্যে কথা। রাতুল আর শ্রীময়ী কে হত্যা করো আগে। ওটাই তোমার কর্তব্য। জেনে রেখো এটা আগে থেকেই সুনির্দিষ্ট। এতে তোমার কোনো হাত নেই। এরা সবাই এক একটা দুষ্ট আত্মা মাত্র। এদের মুক্তি তোমার হাতেই। যা করছো তা ধর্ম যুদ্ধের অংশ মাত্র", বলে ক্রুদ্ধ ভঙ্গিতে এগিয়ে আসে সুশান্ত সেনগুপ্ত।

বিচলিত বৃষকেতু অসহায় ভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ডঃ শর্মা বলতে থাকেন, " মহান কর্ণের বংশধর ছিলেন ভূদেব সিং ঢিলোঁ। ওঁর মৃত্যুর জন্য যে দায়ী তার কথায় বিশ্বাস করো না তুমি। এটা পাপ। এতে কখনও মুক্তি হয় না।"

বিকেলের পড়ন্ত রোদ সামনের উপত্যকায় ঠিকরে পড়ছিলো। একটা মেঘের চাদর সামনে যাবার রাস্তাটা ঢেকে দিয়েছিল এতক্ষণ। রোদ পড়তেই আস্তে আস্তে মেঘ কেটে যেতে লাগলো। আর সেই আলো আঁধারী তে একজন মানুষকে দেখতে পেলো সবাই।

মুখে দাড়ি গোঁফের জটলা, পরনে গেরুয়া বসন। আশ্চর্য উজ্জ্বল চোখদুটো দেখে সবার আগে শ্রীময়ী চিৎকার করে উঠলো, " বাবা....!"

-৪৩-

প্রতিদিনের মতোই বৈকালিক ভ্রমণে বেরিয়েছিলেন শঙ্করনাথ। ব্যানার্জি বা বন্দ্যোপাধ্যায়টা কবেই নাম থেকে মুছে গেছে। রোজই হর কি দুন থেকে এই চত্বরটা একটু হাঁটাহাঁটি করেন। ফাঁকাই থাকে জায়গাটা। খুব কম মানুষজন এদিকে আসেন। কিন্তু আজ এত জটলা কেন ? দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেলেন তিনি। আর তখনই দেখলেন দৃশ্যটা- বহুদিনের পুরোনো বন্ধু বিধান শর্মা আর দুটি ছেলে মেয়েকে কব্জা করেছে এক বন্দুকধারী আর তার সহকারী।

মেয়েটাকে খুব চেনা লাগছে যে।

আরো খানিকটা এগিয়ে যেতেই বুকটা ধড়াস করে উঠলো। একি! এ যে তাঁর নিজের সন্তান। তাঁর আদরের শ্রীময়ী।


শঙ্করনাথকে দেখে শ্রীময়ী চিৎকার করে উঠতেই সুশান্ত সেনগুপ্ত একটু হকচকিয়ে গেলো। আর ঠিক এই সুযোগটাই খুঁজছিলো রাতুল। হাতের পাথরটা সবেগে নিক্ষেপ করলো।
অব্যর্থ লক্ষ্য।
সুশান্ত বাবুর হাতের রিভলবারটা ছিটকে পড়ে গেলো। রীতিমতো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন তিনি। দৌড়ে গিয়ে রিভলবারটা হাতে তুলে নিলো রাতুল।

অবাক হয়ে গেছে বৃষকেতু নিজেও। শঙ্কর বাবুকে সে বিলক্ষণ চেনে। তার আপন ফুপরজী। উমা ফুফার স্বামী। ছোটবেলায় কতই না আদরের ছিলো সম্পর্কটা। আজ এতদিন পর এই অবস্থায় তাঁকে দেখে বিস্মিত হয়ে গেলো।

শঙ্কর বাবু বুঝতে পারলেন সবটাই।

-" আজও তুমি ফলকটার জন্য এতটা লোভী। শুধুমাত্র নিজের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য বৃষকেতু কে ব্যবহার করেছ তুমি", গর্জে উঠলেন শঙ্কর বাবু।

সুশান্ত বাবু তখন রাতুলের কব্জায়। তখনও রাগে দুঃখে কাঁপছেন। বৃষকেতুর রক্তচক্ষু যেন তাঁকে ভস্ম করতে চাইছে। এতদিন যাকে অন্ধের মতো বিশ্বাস করে এলো, সে যে এতবড় শয়তান, নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য তাকে এতটা নীচে নামালো, সেসব ভেবে নিজের ওপর ধিক্কার দিতে ইচ্ছে হলো বৃষকেতুর।

সুশান্ত রাগে ফুসছিলেন। শঙ্কর বাবু বলতে লাগলেন, " সেদিন জনার্দন তোমার মতি গতি বুঝে গিয়ে সাবধান করতে ডেকেছিল ভূদেবকে। আমার সাথে ওর সবসময়ই যোগাযোগ ছিলো, সে যতই আমি লোথালে না গিয়ে থাকি। সেই জন্যই তাঁবুতে ওদের ডাকা হয়েছিলো।
আর তুমি কিনা সেই সুযোগে আগুন লাগিয়ে চলে এলে। এত লোভ। কিন্তু এত করেও তো ওটা তুমি পাবে না। পেলেও অবশ্য তুমি কিছুই করতে পারতে না। বীজমন্ত্র বোঝার ক্ষমতা তোমার নেই। ব্রহ্মশির অস্ত্র কি অত সহজে হস্তগত করা যায়"

-" বেশ করেছি। আমি জানি আমি কী করেছি। বৃষকেতু বোকার মতো এমব কথা বলছে....", মাঝপথেই কথা বন্ধ হয়ে গেলো সুশান্ত সেনগুপ্তর।

দু দুটো গুলি ওঁর বুক আর পেট লক্ষ্য করে চালিয়েছে বৃষকেতু। একটা 'আঁক' করে শব্দ হলো আর গুলির প্রতিঘাতে সুশান্ত বাবুর দেহটা ছিটকে পড়ে গেল সুপিন নদীর অতল খাদে।

-" ত্রি-বিধম নরকসিয়েদম দ্বারাম নাসনম আত্মহঃ কামঃ ক্রোধস তথা লোভাস তাসমাদ তত ত্রয়ম তায়জেত", কথা গুলো ছিটকে বেরোলো বৃষকেতুর মুখ থেকে। তারপরই নিজের পিস্তলটা ফেলে দিয়ে ধপ করে বসে পড়লো সে।

অর্থাৎ লালসা, ক্রোধ এবং লোভ এই তিনটি মানুষকে জাহান্নামের দিকে পরিচালিনা করে। প্রত্যেক বুদ্ধিমান লোককে এগুলি ত্যাগ করতে হবে কারণ এগুলো আত্মার অবক্ষয়ের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া বই অন্য কিছু করে না।

-৪৪-

হাঁটু মুড়ে বসে রয়েছে বৃষকেতু সিং ঢিলোঁ। হাউ হাউ করে কাঁদছে সে। সে জানে, যে পাপ করেছে তার কোনো প্রায়শ্চিত্ত হয় না। হয় না কোনো ক্ষমা।

তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে অনেকজন। শ্রীময়ী, রাতুল, ডঃ শর্মা, শঙ্কর বাবু। বহুদিন পর মেয়েকে দেখতে পেয়ে শঙ্কর বাবুর চোখের জল যেন বাঁধ মানতে চায় না। শ্রীময়ীও কাঁদছে অঝোরে। আর বেচারা বৃষকেতু, সে যখন জানলো শ্রীময়ী সম্পর্কে তার বোন হয়, যাকে এতক্ষণ ওই শয়তান সুশান্ত সেনগুপ্তর প্ররোচনায় এতদিন হত্যার পরিকল্পনা করছিল, মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে হচ্ছিল যেন।

ঠিক তখনই সাংঘাতিক একটা কান্ড ঘটে গেলো। এতক্ষণ পরপর গুলির শব্দ হওয়ার পরই আশপাশের পাথর গুলো কেমন যেন নড়বড় করছিলো, মাটি আলগা হয়ে ওপর থেকে গড়িয়ে আসছিলো। এবার হঠাৎ সশব্দে বেশ বড়সড় কিছু পাথরের চাঁই ধেয়ে এলো ওদের দিকে। সে কী গগন বিদারিত করা আওয়াজ। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে ধস নামছে।

যে যেদিকে পারলো ছিটকে গেলো। সরলো না শুধু একজন। বৃষকেতু। নীরবে দাঁড়িয়ে রইলো, আর অচিরেই সেই পাহাড়ি ধস তাকে ঠেলে দিলো অতল খাদের মধ্যে, যেখানে সুশান্ত বাবুও চিরতরে বিলীন হয়ে গেছেন। সকলে চিৎকার করে উঠলেও কেউ কিছুই করতে পারলো না।

একেই বোধহয় নিয়তি বলে। কিছুক্ষণ পর পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক হতেই দেখা গেলো রাস্তার ওপর ধস নেমে সামনে যাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এ পাশে শ্রীময়ী, রাতুল আর ডঃ শর্মা, আর অন্যদিকে শঙ্কর বাবু। তিনি আবারও দূরে চলে গেলেন। মুখে একটা অমায়িক হাসি নিয়ে হাত নাড়লেন তিনি। এর অর্থ বড় কষ্টদায়ক। ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধে উঠে সমাজের জন্য সুরক্ষা প্রদান করা যাতে ভবিষ্যতে আর কোনো সুশান্ত সেনগুপ্ত জন্ম না নিতে পারে।

শ্রীময়ী চিৎকার করে ডাকতে গেলো। কিন্তু শঙ্কর বাবু ফিরলেন না আর। যে দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে এতটা পথ এসেছেন, যে মায়া চিরতরে ত্যাগ করেছেন, আর সে পথে আসতে চাইলেন না। শ্রীময়ী এগোতে গিয়েও পারলো না। স্বয়ং হিমালয় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে যে।

অস্ফুটে একবার ' বাবা' বলে ডেকে উঠলো শ্রীময়ী। কিন্তু না ফিরলেন না তিনি। সব কিছু ত্যাগ করেছেন যে তিনি। নিজের আত্মজার জন্যও ধর্ম থেকে বিচ্যুত হতে পারেন না আর।

-৪৫-

ধীরে ধীরে হর কি দুনের দিকে পা বাড়ালেন শঙ্করনাথ। সামনে দেখা যাচ্ছে এক বিস্তীর্ণ উপত্যকা। আশ্চর্য রঙ্গীন সব পুষ্পের সমাহার। সত্যি যেন ঈশ্বরের বাগান।

শঙ্কর বাবু এগিয়ে যেতে লাগলেন সেই দিকে, যে পথ চলে গেছে স্বর্গরোহিনী শৃঙ্গের দিকে। ডঃ শর্মা মনে মনে প্রণাম জানালেন বন্ধুবরকে। শ্রীময়ী জীবনে দ্বিতীয়বার বাবাকে হারালো এই নিয়ে। রাতুল এসে ওর মাথায় হাত রাখতেই ভেঙে পড়লো ওর বুকে।

ফলকটা সারাজীবনের মতো অলক্ষিতেই থেকে গেলো। সেই বোধহয় ভালো হলো। কিছু জিনিস প্রকাশ্যে না আসাই মঙ্গল। দ্বাপর যুগের স্বাক্ষর নিয়ে কলিযুগ চলে যাচ্ছে নিভৃতে।

দূরে সূর্য ডুবছে বিলম্বিত লয়ে। আর আশিষ মাখিয়ে দিয়ে যাচ্ছে তারই এক বংশধরের সর্বাঙ্গে, শ্রীময়ী আঁকড়ে ধরে থাকে রাতুলকে। বড় ভরসার জায়গা ওর। বাবাকে হারিয়েছে চিরতরে। রাতুলকে যেন হারাতে না হয় কখনও।

বিকেলের পড়ন্ত রোদে স্বর্গরোহিনীর সোনালী চূড়া ঝলমল করছে। এটাই মহাপ্রস্থানের পথ। আর শঙ্কর বাবু যেন স্বার্থক যুধিষ্ঠিরের মতো এগিয়ে যাচ্ছেন সে পথে। তার নীরব সাক্ষী হয়ে তিনটি প্রাণী দাঁড়িয়ে থাকে হিমালয়ের কোলে।


:::::::: সমাপ্ত :::::::::


 

Ayan Das
 

 

Comments

Loading... Logging you in...
  • Logged in as
There are no comments posted yet. Be the first one!

Post a new comment

Comments by