নিশিগন্ধ
বিবেক কুন্ডু
Well, I know it's kind of late
I hope I didn't wake you
But what I gotta say can't wait
I know you'd understand
'Cause ev'ry time I tried to tell you
The words just came out wrong
So I'll have to say I love you in a song
আগের কথা
দিনভর
কাপড় ফেরি করে বেড়ায় দিবাকর। সূর্যাস্তের পর ঘরে যখন ফেরে, সাঁঝ পিদিমের
আলো তখন প্রায় নিবু নিবু। মাটির বাড়ির নিকোন দালানখানায় বসে আপনমনে সে দেখে
মিটমিটে তারাভরা আকাশের চাদর, তারপর হিসেবের খাতাখানার ওপর যত্নে হাত
বুলিয়ে তাকে রেখে দেয় কুলুঙ্গিতে। দিনের ভাগ এখন শেষ, রাতের হিসেব আলাদা।
গাধার পিঠে চাপান বস্তাখানা নামিয়ে রেখে এদিক ওদিক দেখে নেয় একবার। বাড়ির
পেছনের খেতে ঢুকে চুপিসারে চলতে থাকে ঘাসে ঘাসে পা ফেলে। একসময় তার চোখে
ধরা দেয় কন্দমূলের গাছের আড়ালে লুকিয়ে থাকা জাদু চারা কয়েকগাছি। সবুজের
ফাঁকে ফাঁকে মন্দিরের ঘন্টার মত ঝুলে আছে তার সাদা ফুলের গোটান শরীর। যেন
গোসা করে আছে পিরিত ভুলে থাকা সোমত্ত মেয়ের দল। তাদের গালে লজ্জার হাল্কা
গোলাপী আভা চোখ এড়ায় না দিবাকরের। সাদা শরীরগুলোয় আঙ্গুলের ডগা একবার করে
ছুঁয়ে দিতেই সরে যায় লাজ আবরণ। প্রথমে আঁচল, পরে কাঁচুলির বাঁধন খসিয়ে
ক্রমশ স্পষ্ট হতে থাকে ঐশ্বরিক নিরাবরণ রূপ। সেই সংগে বেড়ে চলে মন মাতিয়ে
দেওয়া গন্ধের বাহার। মাটির গন্ধ, পাতার গন্ধ, ছাল বাকল বা লুকিয়ে থাকা
সাপের গন্ধ, কোনটাই নাকে ধরা দেয় না আর। ঝোপের ভেতর বসে নীচু গলায় ভাটিয়ালি
গান ধরে দিবাকর। যেন আকাশ, বাতাস, ধুলো, মাটি, সব ছাপিয়ে নেমে আসছেন
প্রাণের ঈশ্বর। সারাদিন ধকলের পর স্বর্গীয় এই গন্ধের পরশটুকুই তার অবগাহন
স্নান, সঙ্গমসুখের চেয়েও তীব্র এর আশনাই।
রাতটুকুই
যে সম্বল, ভোরাই সুর বাজতে না বাজতেই মিলিয়ে যাবে গন্ধের জাদু। নিজেদের
ঢেকেঢুকে অন্দরমহলে ঢুকে পড়বে বৌ এর সতীনেরা। সবুজ অন্ধকারকে আরও যেন গায়ে
মাথায় মেখে নেয় দিবাকর।
ঠিক এই সময় নুপুরের নিক্কণে সাবধান হয়ে ওঠে কান। আওয়াজটা আসছে বাইরের দিক থেকে। ধীরে ধীরে ঝোপের ভেতর ঢুকে আসছে কেউ।
‘কে?’ – হাঁক পাড়ে দিবাকর।
খিলখিলিয়ে হাসির শব্দ আসে পেছনদিক থেকে।
‘বউ নাকি?’
এবার যেন একেবারে কাছে এসে দাঁড়ায় কেউ।
‘আমায় নিয়ে যাবি? ঘুম আসছে না?’
নুপুরের ঝনঝন শোনা যায় আবার।
‘দে, পান দে। দেখি তোর নতুন জর্দার খ্যামতা।‘
তাম্বুলপত্রের
সংগে মিঠে সুবাস মেশান এক গন্ধ যেন এক মুহূর্ত অনুভব করে দিবাকর। ঠান্ডা
স্পর্শ লাগতেই হাতের তালুতে নরম ফোলা জিনিসটার উপস্থিতি টের পায় সে।
মুখে
পুরে চিবোতে শুরু করে সুস্বাদু মিঠেপান। অনেক সোহাগ মিশিয়ে বানিয়েছে বৌ।
জরদার নতুন সুবাস তার সতীনকে সরিয়ে ফেলবেই এ রাতে। এরপর মাটির সোঁদা ঘ্রাণ
নিতে নিতেই মেঝেতে মিশে যাবে দুটো শরীর। সংসারের সুখ খুঁজতে খুঁজতে হারিয়ে
যাবে দিবাকরের পেয়ারের সুবাস।
বৌ
এর হাত ধরে বাড়ির দিকে চলতে শুরু করে দিবাকর। ওকে বড় কাছে পেতে ইচ্ছে করছে
আজ। ওই ভেজা পিঠ আর কোমরের দুলুনি নাড়িয়ে দিচ্ছে ভেতরটা। ঝোপের ভেতরকার
গন্ধ যেন মিলিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে।
হঠাতই
পায়ে অনুভুত হয় একটা চেনা স্পর্শ। চাঁদনি রাতে কপির চারার মাঝে স্পষ্ট হয়ে
ওঠে জাদু চারার দল। পাশের আলুর খেত থেকেও কুচকাওয়াজ করা সেনাদের মত একে
একে মাথা তুলে দাঁড়াতে থাকে তারা।
ধীরে ধীরে প্রতীয়মান হয় সবজে সাদা কুঁড়িগুলো। ক্রমশ খুলতে খুলতে বিশাল ফুলে পরিণত হচ্ছে তারা।
মুখের ভেতরটা তেতো লাগতে শুরু করে দিবাকরের। জর্দা নয়, যেন বিস্বাদ সুপুরির স্বাদ পাচ্ছে সে।
গন্ধ, পাগল করা গন্ধে ভরে উঠছে বাতাস। আরও, আরও সাদা ফুল দেখা দিচ্ছে সবুজ অন্ধকার ভেদ করে।
‘আজও হল না বৌ। ঘুমিয়ে পড়গে যা।‘ - হাত ছাড়িয়ে নেয় দিবাকর। তীরবেগে ছুটতে থাকে খেতের দিকে।
বৌ
চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে ক্ষণকাল। কিন্তু আজ আর ফেরে না। শুকনো ঠোঁটদুটো
জিভের ছোঁয়ায় ভিজিয়ে নেয় একবার। দিবাকরের পেছন পেছন ধাওয়া করে ঢুকে পড়ে
ঝোপের ভেতর। হাঁপাতে হাঁপাতে দাঁড়িয়ে যায় হঠাত থমকে যাওয়া সোয়ামিকে দেখেই।
ওকে দেখে অবাক হয় দিবাকর।
‘কী রে বউ, ফিরলি না যে বড়?’
‘ভাবছি এইখেনেতেই ঘুম দেব।‘
‘এইখেনে? পারবি?’
‘এস দেখি।‘
সোয়ামির
হাত ধরে টান দেয় মেয়েটা। জাদু চারাগুলো তখন ঘিরে ফেলেছে দুজনকেই। গুটিয়ে
থাকা সোমত্ত কুঁড়িগুলো ধীরে ধীরে খুলতে শুরু করেছে আবরণ, খুলে যাওয়া পাপড়ির
ভাঁজ থেকে ক্রমশ বেরিয়ে আসছে যৌবনগন্ধ।
ধুপ
করে ঝোপের মাঝেই শুয়ে পড়ে বউ। খসে পড়ে ওর সবুজ আঁচল। দু হাত বাড়িয়ে দিতেই
দিবাকরের চোখে পড়ে কোমরের নিখুঁত ডৌল। বুকের ওপর এসে পড়া এলোচুল মনে পড়িয়ে
দেয় জাদুচারার লতাগুচ্ছ।
নিজেকে
আর সামলে রাখতে পারে না দিবাকর। বাতাসে সাঁতার দিয়ে ঝাঁপ দেয় জায়ার বুকে।
ফুটতে থাকা ফুলেরা আড়াল করে ফেলে রাতসঙ্গম। জংগুলে ফিসফাসের মাঝে দুটো
প্রাণের স্পন্দন ধ্বনিত হতে থাকে রাতভর, মায়াবী ঘুমের ভেতর।
-১-
হোটেল
সনেটের লাউঞ্জে বসে খবরের কাগজে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছিল সুবিনয়। মানসিক
অধঃপতনের নিত্যকার নমুনাগুলো সাদাকালো পাতায় দেখবার পর গত কয়েক বছরে কলকাতা
শহরের সার্বিক উন্নতির ছবিটা উল্টে-পালটে দেখছিল রঙ্গীন ট্যাবলয়েডের পাতায়
পাতায়। বিদেশী ধাঁচে তৈরি সেক্টর ফাইভ-নিউ টাউন, বাইপাসের গা বরাবর
দক্ষিণের দিকে বেড়ে চলা হাই ইনকাম গ্রুপ অ্যাপার্টমেন্ট প্রজেক্টের ছড়াছড়ি,
সুপার স্পেশালিটি হসপিটাল, নতুন নতুন পাঁচতারা হোটেল, মেট্রোরেলের নতুন
ইস্ট-ওয়েস্ট রুট, ক্রমশ উচ্চতর লাইফ স্টাইলের স্বপ্ন দেখা কিন্তু অন্য
শহরের তুলনায় কম বাজেটের শিক্ষিত কর্পোরেট জনতা, বাতানুকুল লাল-নীল-সবুজ
ভলভো বাস এবং সুলভ পাবলিক ট্রান্সপোর্ট, হালের কেতাদুরস্ত লাক্সারি
মল-মাল্টিপ্লেক্স থেকে খোলা কিংবা ভাসমান বাজার, ইকো পার্ক, শহর জুড়ে উত্তর
দক্ষিণকে জুড়ে ফেলা নীল সাদা ফ্লাইওভার নিয়ে ঝকঝকে গোটাছয়েক পাওয়ারপয়েন্ট
স্লাইড কল্পনা করে নিল সে। এর সঙ্গে লো ক্রাইম রেট, নতুন এয়ারপোর্ট,
নিউটাউন এর ঝাঁ চকচকে ড্রাইভওয়ে, রাজ্য সরকারের ইনভেস্টমেন্ট ফ্রেন্ডলি
ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল পলিসি এবং গতকাল দেখা লোকেশনগুলোর ছবি জুড়ে দিলেই যে এম
ডি সাহেবের মনের মত প্রেজেন্টেশন তৈরি হয়ে যাবে – এ বিষয়ে সুবিনয়
সুনিশ্চিত। ক্ষমতার নানা রঙে সেজে শহরটা বদলেছে অনেক, বদলেছে একে টায়ার টু
সিটি ভেবে চলা জনতার পার্সেপশনও। একে একে মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানীরা
এদিকটায় আসতে চাইবে বলেই মনে হয়। প্রচ্ছন্ন গর্ববোধে হেসে ওঠে সুবিনয়।
ল্যাপটপ বন্ধ করে হাঁটা দেয় রেস্তোরাঁর দিকে। আর দেরি করলে ব্রেকফাস্ট
বুফেটা নিশ্চিত মিস হয়ে যাবে।
ব্যাঙ্গালোরের
আলট্রাটেক সলিউশনসের পদস্থ কর্মচারী সুবিনয়। বছর বারো আগে জুনিয়র
এক্সিকিউটিভ হিসেবে জয়েন করে ধাপে ধাপে উঠে এসে আজ সে কোম্পানির ডিজিটাল
বিভাগের প্রধান। এবারে কলকাতায় এসেছিল ওদের পূর্বাঞ্চলের অফিসের জন্য
সম্ভাব্য কয়েকটা জায়গা দেখতে। দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার কাজকর্ম সামলাতে কলকাতায়
একটা অফিস থাকা বিশেষ প্রয়োজন – একথা ওদের ভাইস প্রেসিডেন্টকে বহুবার
জানিয়েছে সুবিনয়, কোন ফল হয়নি। কিন্তু গত মাসে ওদের সিঙ্গাপুরের ক্লায়েন্ট
মিস্টার সাইমন লিম প্রসঙ্গটা তোলায় স্বয়ং এম ডি সাহেবও বুঝে গেলেন যে
কলকাতায় এবার একটা অফিস না হলেই নয়। ওদের প্রধান প্রতিযোগী ডিজিটাসও
কলকাতায় অফিস খুলে ফেলেছে – লিম সাহেবের এই সতর্কবানী শোনবার দু দিন পরেই
এম ডি কৃষ্ণাপ্পা সুবিনয়কে ওনার কেবিনে ডেকে স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন, নো ইফস
এন্ড বাটস, আগামী ছ’মাসের মধ্যেই আলট্রাটেকের কলকাতা অফিস চালু করতেই হবে।
অবিলম্বে সেখানের কিছু সম্ভাব্য অফিস স্পেস দেখে ফেলা বিশেষ প্রয়োজন।
দরকারে শেয়ারড অফিস স্পেসেও কাজ শুরু হতে পারে, কিন্তু লোকেশন হতে হবে
একেবারে প্রিমিয়াম, প্রেফারেবলি শহরের পূবদিকে। এমডির মতে এ কাজটা সুবিনয়ই
সবচেয়ে ভাল পারবে, কারণ কলকাতা তার নিজের শহর। সামনের সপ্তাহের মধ্যেই বেশ
কিছু জায়গা দেখে এসে সে যেন অফিসে রিপোর্ট জমা দেয়।
সে
সূত্রেই সুবিনয় কলকাতা এসেছিল দিনদুয়েক আগে। কলকাতায় পা দিয়ে মাসতুতো ভাই
সুমিতের চেনা এক নামকরা রিয়েল এস্টেট এজেন্টকে পাকড়ে প্রথম দিনেই গোটা ছয়েক
জায়গা দেখে ফেলল। ছবিও তুলে নিল প্রয়োজনমত। সারাদিনের কাজ সেরে রাতে চলে
গেল সুমিতদের কালিকাপুরের ফ্ল্যাটে।
সুমিত
আগে থেকেই ডিনারের কথা বলে রেখেছিল। ওর বউ নীনা গুজরাতি, কিন্তু বিয়ের পর
বাঙালী রান্নায় দারুণ হাত পাকিয়ে ফেলেছে। মোচার ঘণ্ট আর চিতল মাছের মুইঠ্যা
- দুটোই রেঁধেছিল চমৎকার। ক্যারামেল কাস্টার্ড এং পায়েসের ডেজার্ট পর্ব
মিটলে নিজে হাতে বানিয়ে খাওয়াল স্পেশাল মিষ্টি পান। এরপর কিছুক্ষন
পারিবারিক গল্পসল্পের পর হোটেলে ফেরার পালা। বেরোবার সময় সুমিতকে ফিসফিস
করে বলেছিল সুবিনয় – ‘গুজরাতি মেয়ে আমীষ রান্না করে ভাসুরকে খাওয়াচ্ছে, এ ত
কল্পনাই করা যায় না রে! তুই খুব লাকি সুমিত। ভাল থাকিস তোরা।‘
সুমিত
অনেক করে সে রাতটা ওদের ওখানে থেকে যেতে বলেছিল, কিন্তু সুবিনয় রাজী হয়নি।
সে জানে,তার মত কাজের মানুষদের অফিসিয়াল ট্রিপে হোটেলে রাত্রিবাস করাই
ভাল। সময়ের শেষ তলানিটুকু অন্ততঃ আড্ডা দিয়ে কাটাতে হবে না।
বেরোবার
আগে সুমিতদের ব্যালকনিটায় একবার গিয়েছিল সুবিনয়। যেতেই সুন্দর একটা গন্ধ
ভেসে এল বাতাসে। বাগানের এককোণে চমৎকার লতানে গাছ, সেখান থেকে ঝুলে আছে
থোকা থোকা সাদা থলের মত ফুল। দূরে দেখা যাচ্ছে পুঁতির মত আলোর মালায় মোড়া
ইস্টার্ন বাইপাস। নীনার নিজে হাতে করা বাগানটাও দেখল একঝলক। সত্যি, ভারী
গোছান মেয়েটা। বেরিয়ে আসার আগে সুমিতকে বলল – ‘ভারী সুন্দর হয়েছে তোদের
ফ্ল্যাট। ছিমছাম ইন্টেরিয়র, বাগানটাও চমৎকার। এবার বাচ্চাকাচ্চা চলে আসুক,
তাহলেই সব কমপ্লিট।‘
‘আরে, গুড নিউজটা তোমাকে দেওয়া হয়নি।‘ – একটু লাজুক হেসে বলল সুমিত – ‘গত সপ্তাহেই কনসিভ করেছে নীনা।‘
‘ওহ, তাই নাকি! দারুণ খবর ত। সবাইকে জানিয়েছিস?’
‘জানাব। দু তরফের বাবা মা ছাড়া আপাতত জানেনা কেউ। আত্মীয়দের মধ্যে তোমাকেই প্রথম বললাম।‘
‘গুড।’
– সুমিতের খুশী খুশী ভাবটা চোখে পড়তেই নীচু গলায় বলল সুবিনয় - ‘হ্যাঁরে
বাবান, প্রেগনেন্সিটা কি প্ল্যানড, নাকি হঠাতই? বললাম বলে কিছু মনে করিস
না।’
‘আরে নানা, মনে
করব কেন?‘ – মাথা চুলকে বলল সুবিনয় – ‘আসলে নরমাল ম্যারেড লাইফ চালিয়ে
গেছি, এসব নিয়ে এত ভাবিনি। গুড নিউজ হবার ছিল, হয়ে গেছে, এই আর কী! আমরা
দুজনেই কিন্তু খুব হ্যাপি।‘
মনে
মনে কৌতুক বোধ করল সুবিনয়। ছোটবেলা থেকেই সব ব্যাপারে সুমিতের কেমন যেন গা
ছাড়া ভাব! মাঝারি মানের স্টুডেন্ট, কেরিয়ার নিয়েও তেমন উচ্চাকাঙ্ক্ষী নয়।
বিয়ের দু বছরের মধ্যেই ইস্যু! ধুস!
সিঁড়ি
দিয়ে নামতে নামতে হঠাতই বলল সুমিত - ‘তোমাদের কী খবর বিনুদা? এবার একটা
ইস্যু করে ফেল। বউদির ত থার্টি টু হল, তাই না? ফেসবুকে দেখলাম বোধহয়।‘
‘হুম, আমরাও ট্রাই করছি। দেখা যাক।‘
কথা
না বাড়িয়ে বেরিয়ে পড়ল সুবিনয়। এসব ব্যক্তিগত প্রসংগ যত কম ওঠে তত ভাল।
প্রেগনেন্সির সংগে বউয়ের বয়েস মিলিয়ে খোঁচাটা সুমিতের থেকে এক্সপেক্ট
করেনি। তবে এড়িয়ে যেতে চাইলেও গলার কাঁটার মত অস্বস্তিকর হয়ে ওঠে কিছু
অনুভব। এও বোধহয় তেমনই। ভাগ্যিস ওদের বাড়িতে থাকেনি আজ!
পরের
দিন সময় ছিল আরো কম। ছটা দেখা জায়গার মধ্যে গোটা তিনেক শর্টলিস্ট করে
এগ্রিমেন্ট সংক্রান্ত কিছু কথাবার্তা সেরে সন্ধের ফ্লাইটেই ব্যাঙ্গালোর
ফিরে যাবার কথা। কিন্তু সেদিন দুপুরে অফিসের এক সিনিয়র ডিরেক্টর হঠাৎই ফোন
করে বললেন, ওকে কয়েকটা ইন্টারভিউ নিতে হবে, কলকাতায় অ্যাসিস্ট্যান্ট
ম্যানেজার পোস্ট এর জন্য। তাই টিকিট পোস্টপোন করে পরের দিন অর্থাৎ আজ
সন্ধের ফ্লাইটে ফিরছে সুবিনয়।
ক্লিক
শব্দ করে উঠল পাশে রাখা সুবিনয়ের ওয়ান প্লাস নাইন। এই স্মার্টফোনগুলো যে
সত্যিই খুব স্মার্ট এ বিষয়ে সে নিঃসন্দেহ। ফেসবুক-ইন্সটাগ্রাম, চ্যাট,
অফিসিয়াল মেল কিংবা স্ট্রিমিং চ্যানেল বা পডকাস্ট - সময় চুরি করতে এদের
জুড়ি নেই।
কাগজটা ভাঁজ করে ফোনটা তুলে নিল সুবিনয়। নীহারিকা হোয়াটসঅ্যাপ করেছে – ‘মিস ইউ’। সংগে একটা কিউট পাপ্পির ছবি।
নীহারিকা সুবিনয়ের স্ত্রী – ব্যাঙ্গালোরে বড়সড় এক ডিজিটাল পেমেন্ট কোম্পানির HR হেড।
‘Me
too, Little Busy now’ - অভ্যস্ত হাতে উত্তরটা টাইপ করে রিপ্লাই দিতে
সুবিনয়ের সময় লাগল চার সেকেন্ড। সুবিনয় জানে এই রুটিন কাজটা সেরে ফেললেই
আপাতত আর ঝামেলা নেই। নইলে মেসেজে মেসেজে জেরবার হতে হবে। ফোন চলে আসাও
বিচিত্র নয়।
সুবিনয়কে
সপ্তাহে প্রায় চারদিন মত ট্যুরে থাকতে হয় – বউয়ের সঙ্গে এক উইক এন্ড ছাড়া
ঠিকমত কথাবার্তা হয় না বললেই চলে। তাছাড়া সোহাগ-ভালবাসা এসব বিয়ের পর বছর
তিনেক ভাল লাগত সুবিনয়ের। তারপর ধীরে ধীরে ব্যাপারটা হয়ে গিয়েছে প্রয়োজন।
নীহারিকা ব্যাঙ্গালোরের আধুনিক মেয়ে , কেরিয়ার সচেতন কিন্তু সংসারধর্মটাও
ভাল বোঝে। সাত-বছর বিয়ের পরেও ও কেমন যেন ভালবাসার কাঙাল, স্বামীকে কাছে
পেলে ছাড়তে চায় না একদম। ফ্যামিলি প্ল্যানিং নিয়ে ওর স্বপ্নের শেষ নেই।
সুবিনয় অবশ্য আরও তিন বছর এসব ভাবতে রাজী নয়। কেরিয়ারে বেড়ে ওঠার এই ত সময়!
তেমন ভাল অফার পেলে আলট্রাটেক ছেড়ে অন্য কথাও জয়েন করবার কথাও ভাবে।
নীহারিকার আর্থিক চাহিদা সাদামাটা, দুজনের ইনকামে স্বচ্ছলভাবে চলে গেলেই সে
সন্তুষ্ট – ঘোড়দৌড়ের ঘোড়া লাগামছাড়া হয়ে যাক, এটা তার একেবারেই পছন্দ নয়।
উইক এন্ডের
সকালগুলো সুবিনয়ের কেটে যায় হর্স রাইডিং অ্যাকাডেমি বা এইচ এস আর ক্লাবে
হাই প্রোফাইল ক্লায়েন্টদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে। সন্ধেবেলা রুটিনমাফিক
শারজাপুর রোডে ওদের কমপ্লেক্সের কাছাকাছি কোন রেস্তরাঁয় খাওয়া, মলে শপিং বা
মাল্টিপ্লেক্সে ছবি দেখা – এর বেশী সময় দিতে পারে না নীহারিকাকে।
রেস্তরাঁয় গিয়েও মনের সুখে চিকেন-মাটন-সি-ফুড খেতে পারে না কারণ নন ভেজ
খাওয়াটা দক্ষিণী ব্রাহ্মণ পরিবারের মেয়ে নীহারিকার একেবারেই ধাতে সয় না!
শপিংটাই যা একটু এনজয় করে সুবিনয়। সেখানে আবার নীহারিকা বেশি কেনে
সুবিনয়ের জন্য – যেটা ওর বিশেষ অপছন্দ। আগে মাঝে মাঝে দুজনে মিলে লং
ড্রাইভে যেত – কুর্গ, ওয়ানাড, ম্যাংগালোর কি চিকমাগালুর। একবার দুজনে পালা
করে ড্রাইভ করে পৌঁছে গিয়েছিল গোয়াতেও! দুজনের আলাদা গাড়ি হওয়ার পর থেকে
সেসবও আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে গেছে। হয়ত এসব কারণেই রাতগুলোতে আজকাল নীহারিকা
একটু বেশী চায় । সুবিনয় অবশ্য এখানেও কৃপণ, তাই পরিমিত সুখের সংজ্ঞা রচনা
করে চুপচাপ পাশ ফিরে শুয়ে পড়ে। নীহারিকা ছাড়তে চায় না, কেজো দিনগুলোর ফাঁকে
সপ্তাহের সেই দামী রাতগুলোয় নিবিড় আলিঙ্গনে স্বামীকে বেঁধে রাখতে চায় সে।
গাইনোকোলজিস্ট
রেশমী চৌধুরীর সংগে বেশ কয়েকবার অ্যাপয়েন্টমেন্ট করেছে নীহারিকা। সুবিনয়ের
ইচ্ছে না থাকলেও যেতে হয়েছে সংগে। ভদ্রমহিলার সাজেশনে তেমন সুবিধে হয়নি।
লাস্ট উইকে গাদাগুচ্ছের টেস্ট করবার পর ভদ্রমহিলা সোজাসুজি সুবিনয়কে বলে
বসলেন – ‘আই ইউ আই অর্থাৎ ইনট্রাইউটিরাইন ইনসেমিনেশন আপনাদের জন্য হেল্পফুল
হতে পারে কারণ অনেক সময় স্পার্মগুলো গন্তব্য অবধি পৌঁছতেই পারে না।
সেক্ষেত্রে এটা ইনসেমিনেশন নিশ্চিত করে। কিন্তু টেস্ট করে আমার যা মনে
হচ্ছে, আপনাদের এমন কোন অসুবিধে নেই। শি হ্যাড বিন অন পিলস ফর লং বাট হার
ওভুলেশন ইজ পারফেক্ট। আপনারও সবকিছু নরমাল। কিন্তু উনি মেন্টালি যতটা
স্বচ্ছন্দ আপনি বোধহয় ততটা নন। একটা অফিস টাস্কের মত ব্যাপারটা সারছেন
আপনি। দিনক্ষণ দেখে, মেপে মেপে, লাইক আ ডিউটি। এভাবে হয় না। নরমালি ট্রাই
করুন। দুজনে মিলে জাস্ট এনজয় ইট। এত স্ট্রেস নিলে আপনার ওয়াইফ কনসিভ করতে
পারবেন না।‘
‘সেজন্যই
বলছি, এটা সঠিক সময় নয়। ‘ – উঠে দাঁড়িয়ে সোজাসুজি বলে দিয়েছিল সুবিনয় –
‘ওকেও বুঝিয়েছি, কেরিয়ারের গ্রোথ ফেস এখন। কাজের চাপ আছে অনেক। স্ট্রেস
ফ্রি লাইফস্টাইল এখনই হয়ত সম্ভব হবে না।‘
শুনে
চুপ করে গিয়েছিল নীহারিকা। বাড়ি এসে এমন ভাব করেছিল, যেন কিছুই হয়নি।
কিন্তু মনে মনে একটা অস্বস্তি রয়েই গিয়েছিল সুবিনয়ের। হয়ত এতটা উগ্রভাবে
কথাটা বলা ঠিক হয়নি। তিরিশ পেরোবার পর বয়স ব্যাপারটাও নীহারিকার মনে
নির্ঘাত পরোক্ষভাবে ফেলছে ছাপ। অবশ্য এ নিয়ে কোন কথা হয়নি দুজনের। এ কদিন
খাওয়াদাওয়া সেরে দুজনেই নেটফ্লিক্স দেখেছে চুটিয়ে, হয়ত ব্যাপারটা ভুলে
থাকতেই।
বিজনেস ট্রিপটা
এই সময় হঠাত করে এসে পড়ায় ভালই হয়েছে সুবিনয়ের। ও জানে, সময় সব ঠিক করে
দেয়। কয়েকদিনের ব্যবধানে ফেরত গিয়ে দেখবে আবার নরমাল হয়ে গেছে নীহারিকা।
তাছাড়া
এক গোলডেন রিট্রিভার ব্রিডারের সংগে কথা বলে রেখেছে সুবিনয়। বাড়িতে একটা
কিউট গোলুমোলু পাপ্পি নিয়ে এলে ফ্যামিলি প্ল্যানিং এর ভূতটা বউয়ের মাথা
থেকে আপাতত নামবে বলেই ওর ধারণা।
ফোনে
আজকের মিটিংগুলো দেখে নিল সুবিনয়। মোট দুজন ক্যান্ডিডেটের ইন্টারভিউ নিতে
হবে তাকে। কাল সন্ধেবেলাতেই দুজনের সাথে কথা বলে নিয়েছে সে। তাদের CV
দেখেও রেখেছে ভালভাবে। একজনকে টাইম দিয়েছে সকাল ১০ টায়, হোটেলের লাউঞ্জে।
আর একজনকে ডেকে নিয়েছে এয়ারপোর্টের বাইরে ফুড শপে – বিকেল ৪ টেয়। ওর
রিটার্ন ফ্লাইট সন্ধে ৭ টায়, কাজেই হাতে যথেষ্ট সময় থাকবে ।
বাইরে আকাশটায় অল্প অল্প মেঘ, সামান্য বৃষ্টি হলেও হতে পারে।
-২-
নিউটাউনের
একটা মলে গাড়ীটাকে পার্ক করতে বলল সুবিনয়। মেজর আর্টারিয়াল রোডের ওপর নতুন
এই মলটার কথা সুমিতের মুখে শোনবার পর থেকেই দেখার খুব ইচ্ছে ছিল সুবিনয়ের।
তাই এই ফাঁকে ঢুকে পড়ল সেখানে। সুমিত মাঝে মাঝেই বলে –‘বিনুদা, নীহারিকা
বৌদিকে নিয়ে একবার চলে এস কলকাতায়। এখন দারুণ দারুণ প্রোজেক্টের ছড়াছড়ি
এখানে – ব্যাঙ্গালোর ব্যাঙ্গালোর বলে নাক উঁচু করতে পারবেনা! এখানেই একটা
ভাল ফ্ল্যাট কিনে সেটল করে যাও। কী আছে ওই সম্বর রসমের দেশে!’
কলকাতার
প্রতি সুমিতের এই ভালবাসা মুগ্ধ করে সুবিনয়কে। মনেপ্রাণে এই শহরটাকে সেও
ভালবাসে খুব। নীহারিকাকেও ঘুরিয়ে দেখাতে চায়, কিন্তু সময় হয় না। এক বিয়ের
সময়টা ছাড়া ওকে নিয়ে আসাই হয়নি এখানে। সেবারেও ছিল ঝটিকা সফর, শুধু সায়েন্স
সিটি আর দক্ষিণেশ্বর-বেলুড় মঠই দেখাতে পেরেছিল। খাইয়েছিল পিটার ক্যাটের
চেলো কাবাব আর সিজলার। পরে অবশ্য নীহারিকা অনেকবার বললেও না করে দিয়েছে
সুবিনয়। নীহারিকাও জোর করেনি, কারণ সুবিনয়ের বাবা-মার যে কন্নড় বউমা বিশেষ
পছন্দ নয়, সেটা ও ভালই বোঝে। শ্বশুর শাশুড়িকে কাছে পেতে বাংলাটা তাড়াতাড়ি
শিখেছিল বটে, কিন্তু মিঠে ভাষার বুলি, সম্পর্কে মিষ্টতা আনতে পারেনি তেমন।
চাকরি নিয়ে
ব্যাঙ্গালোর চলে গেলেও বিয়ের আগে পর্যন্ত সুবিনয় ছুটি নিয়ে মাঝেসাঝেই আসত
কলকাতায়। বিয়ের পর থেকেই ধীরে ধীরে কেমন যেন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল শহরটার
থেকে। বছরদুয়েক ধরে বাবা-মা ভাই সুকিরণের কাছে মুম্বইতেই বেশী থাকেন, তাই
অফিসের কাজে সেখানে গেলে দেখাসাক্ষাৎ হয়ে যায়। ওদের পাইকপাড়ার ফ্ল্যাটটা
বছরে প্রায় আট-দশ মাস তালাবন্ধ থাকে, অনেকে বিক্রী করে দেবার কথা বললেও
বাবা করতে চান না। হয়ত ভিটেমাটির টানেই। তাই কলকাতায় যতবারই কাজে এসেছে,
বেশীরভাগ হোটেলেই থেকেছে বা কোন আত্মীয়ের বাড়ী লাঞ্চ বা ডিনার সেরেছে
কখনও,যেমনটা এবার গিয়েছিল সুমিতদের ফ্ল্যাটে। তবে এর বেশী কলকাতার ছোঁয়া
পায়না সুবিনয় - হয়ত পেতেও চায়না।
সকাল
দশটায় যে ছেলেটির ইন্টারভিউ নেবার কথা, সে হঠাৎই নটা নাগাদ ফোন করে বলে
যে তার পক্ষে ওই সময়টায় আসা সম্ভব হচ্ছে না,কারণ মা অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাকে
ডাক্তারখানায় দৌড়তে হবে এখন। তবে দুপুর ১২ টার পরে যে কোন সময় সে আসতে
পারবে। মনে মনে হিসেব করে দুপুর দেড়টায় এই মলটায় এসে ওকে ফোন করতে বলছে
সুবিনয়। ইন্টারভিউ নিয়ে কোথাও একটা বুফে লাঞ্চ সেরে সোয়া কি সাড়ে তিনটে
নাগাদ এখান থেকে বেড়িয়ে চারটের মধ্যেই এয়ারপোর্ট পৌঁছে যাবে –যেখানে
দ্বিতীয় ছেলেটির আসবার কথা। সময়ের মোড়ক খুলে খুলেই সারাক্ষণ স্বাদ নিতে হয়
তো, তাই সময়ের মাপজোক সুবিনয় ভালই জানে।
মলটা
খুবই সুন্দর। ব্যাঙ্গালোরের বেশ কিছু মলকেও হার মানায়। ঘুরতে ঘুরতে মেগা
বুক স্টোর স্টারমার্ক এর সামনে এসে সুবিনয় দেখল বাইরে খুব ভীড় জমে গিয়েছে।
কৌতুহল বশতঃ একজনকে জিজ্ঞেস করে জানা গেল জনপ্রিয় ব্রিটিশ লেখক হেনরি লি
স্টোরে এসেছেন তাঁর লেটেস্ট থ্রিলার উপন্যাসের রিডিং সেশনে, সঞ্চালকের
ভূমিকায় বলিউডের বিখ্যাত অভিনেত্রী জরিনা কপুর! ভীড় তো জমবেই!
‘নাঃ, কলকাতা সত্যিই হ্যাপেনিং জায়গা হয়ে উঠছে এখন’ – মলের একটা ছবি তুলতে তুলতে স্বগতোক্তি করল সুবিনয়।
‘I
can’t help falling in love with you’ - এলভিসের বিখ্যাত গানটা পকেটের
মধ্যে থেকে বেজে উঠল তখনই। ফোনটা বের করে সুবিনয় দেখল সেই ছেলেটি কল করছে।
সময় একটা পঁচিশ। ওর মুখে সামান্য হাসি একঝলক দেখা দিয়ে মিলিয়ে গেল।
ছেলেটিকে স্টারবাকস কাফেতে আসতে বলে এস্কেলেটরের দিকে এগিয়ে গেল সুবিনয়।
ইন্টারভিউয়ের ক্ষেত্রে কফি শপের বাতাবরণটা বেশ উপযোগী বলে মনে করে সে।
-৩-
সুবিনয়ের
মুখোমুখি বসে আছে ছেলেটা। বছর পঁচিশেক বয়েস, ক্লীন শেভন, চোখে চশমা,ছোট
করে ছাঁটা চুল - একটু ভালছেলে গোছের চেহারা। ফর্ম্যাল ড্রেসেই এসেছে,
সামান্য হেসে চুপচাপ হয়ে গিয়েছে, বোধহয় কিছুটা আড়ষ্ট। পাশের টেবিলে একটা
মেয়ে এসে বসল, বয়স ছেলেটার মতই হবে। ছেলেটিও মাঝে মাঝে তাকে দেখছে।
ছিপছিপে ফরসা মেয়েটির ফিগার চমৎকার, নীল কুর্তি - থ্রি কোয়ার্টার জিনসে
মানিয়েছে দারুণ।
মেয়েটাও
এদিকে তাকাচ্ছে, তবে দুজনের মধ্যে কাকে দেখছে সেটা বলা মুশকিল। বিশেষতঃ
এযুগে অনেক ইয়ং মেয়েকেই বয়স্ক পুরুষকে নিয়ে ফ্যান্টাসাইজ করতে দেখা যায়।
কেউ কেউ ত নিজের চেয়ে আট-দশ বছরের বড় প্রেমিক পেলে সিকিওরড বোধ করে। মনে
মনে কিছুটা কৌতুক বোধ করল সুবিনয়।
‘অভিষেক, তোমার মা কেমন আছেন এখন? অল ওয়েল?’ - আড়ষ্টতা ভাঙতে প্রশ্নটা করল সুবিনয়।
‘মা...বেটার নাউ।‘ – ছেলেটার জবাব এখনও কিছুটা আড়ষ্ট।
আরো মোলায়েম হেসে জবাব দিল সুবিনয় – ‘গুড টু নো। কি নেবে বল? শেক, স্যান্ডউইচ – এনিথিং ইউ লাইক।”
‘শেক ইস ফাইন’ – একটু হেসে উত্তর দিল অভিষেক। এবার বোধহয় কিছুটা সহজ হয়েছে।
দুটো
চকোচিপ ফ্র্যাপুচিনো অর্ডার করে সুবিনয় শুরু করল ইন্টারভিউ। কিছু সাদামাটা
প্রশ্নের পর ধীরে ধীরে এগোল কাজের কথায়, যাতে ছেলেটির মধ্যে চলে আসে
স্বাচ্ছন্দ্যবোধ। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই সাবলীলভাবে কথা বলতে শুরু করল
অভিষেক।
পাশের মেয়েটা
মাঝে মধ্যেই ওদের দিকে চাইছে আর ধীরে ধীরে খাচ্ছে একটা চিকেন নানউইচ। দেখে
মনে হচ্ছে সময় কাটানই ওর উদ্দেশ্য। ইন্টারভিউয়ের পর এর সংগে আলাপ করলে মন্দ
হয় না। নিজের ভাবনায় মনে মনে হেসে উঠল সুবিনয়।
আরও
কিছুক্ষণ প্রশ্নোত্তরের পালা চলবার পর মোক্ষম প্রশ্নে এল সুবিনয় – ‘তুমি
আমাদের কোম্পানীতে কি ভ্যালু অ্যাড করতে পারবে? মানে সোজা কথায়, তোমাকে
আমরা নেব কেন?’ মেয়েটার দিকে একঝলক চেয়ে বলল – ‘এটা পরীক্ষা নয়, তাই
ভেবেচিন্তে আরামসে বল, কোন তাড়া নেই।‘
‘স্যার,
ইস্টার্ন ইন্ডিয়ার মার্কেটটা আমার নখদর্পণে। নানা ইন্ডাস্ট্রি সেগমেন্টের
ক্লায়েন্টকে চিনি আমি। এখানে আল্ট্রাটেকের প্রডাক্ট পজিশনিং এবং সেলস এ
নিশ্চয়ই ইম্পর্ট্যান্ট রোল প্লে করব।‘ - প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই জবাব দিল
ছেলেটা।
‘দেখ অভিষেক’ -
মোবাইলে সেভ করা ছেলেটির CV তে চোখ বোলাতে বোলাতে বলল সুবিনয় – ‘তোমার আছে
চ্যানেল সেলস এর এক্সপেরিয়েন্স, তাও ই কমার্স ফিল্ডে। তোমার বেশ কিছু
প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজ শেখা আছে দেখছিলাম, তাই ভেবেছিলাম টেকনিক্যাল
দিকটাতেও তুমি কিছুটা স্ট্রং। আসলে এই কাজটা ক্লাউড বেসড সফটওয়্যার এর
ডিরেক্ট সেলসের - এখানে বিজনেসের সঙ্গে সঙ্গে টেকনিক্যাল দিকটাও মোটামুটি
বুঝতে হবে, নইলে ক্লায়েন্টকে ম্যানেজ করতে পারবে না। সবসময় তোমার সংগে প্রি
সেলস সলিউশনিং টিম থাকবে,এমনটা নয়। আমার মনে হয়, তোমার একটু অন্য ধরনের
প্রোফাইলে ট্রাই করা উচিত।‘
একটু
ঢোক গিলে পাশে বসা মেয়েটির দিকে তাকাল ছেলেটি। সলজ্জভাবে বলল - ‘আপনারা
তো নিশ্চয়ই প্রডাক্ট ট্রেনিং দেবেন, টেকনিক্যাল ব্যাপারটা আমি ট্রেনিংয়ের
সময় ঠিক বুঝে নেব। তাছাড়া সরাসরি কর্পোরেট ক্লায়েন্টও ডিল করেছি বেশ
কয়েকবার। তাই চ্যানেল অর্থাৎ রিসেলার ছাড়াও ডিরেক্ট সেলস এর অভিজ্ঞতা নেই,
এমনটা নয়।‘
অভিষেকের
আশাভঙ্গ করতে ইচ্ছে করছিল না সুবিনয়ের। যতদূর বোঝা যাচ্ছে, ছেলেটার
উচ্চাকাঙ্খা আছে। একবার তার দিকে, আর একবার পাশের মেয়েটার দিকে পালা করে
দেখছে ছেলেটা। কফিশপে আর কেউ নেই এখন। অবাক কাণ্ড, মেয়েটা কিন্তু একদৃষ্টে
চেয়ে রয়েছে সুবিনয়ের দিকেই। চোখাচোখি হতেই চোখ নামিয়ে নিল। তার খাওয়া শেষ,
কিন্তু বসে আছে এখনও। মনে হয় সত্যিই ওর সাথে আলাপ করতে চায় মেয়েটা। হয়ত মনে
মনে কল্পনা করছে হঠাত ডেটিং এর। মনে মনে বেশ লজ্জা পেল সুবিনয়। এ অবস্থায়
পুরোপুরি নেগেটিভ কিছু বললে অচেনা মেয়েটার সামনে ছেলেটা অপমানিত বোধ করতে
পারে,তাই কিছুক্ষণ চুপ করে রইল সুবিনয়। ছেলেটার দিকে তাকিয়ে শান্তভাবে বলল –
‘চ্যানেল সেলসও আছে আমাদের। সেখানে ভ্যাকেন্সি হলে তোমাকে নিশ্চয়ই জানাব।
It was really nice talking to you.”
তার
শান্ত কথার ফলাফল যে এতটা অশান্ত হতে পারে, সেটা ভেবে দেখেনি সুবিনয়। ওর
কথা শেষ হওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই পাশের টেবিলের মেয়েটা উঠে দাঁড়াল,
ছেলেটার দিকে কটমট করে চেয়ে হনহনিয়ে বেরিয়ে গেল কফিশপ থেকে।
ছেলেটাও
বসল না আর। ‘রিমা দাঁড়াও…’ - বলে প্রায় ছুটেই বেরিয়ে গেল সেখান থেকে।
সুবিনয়ের কথার জবাব দিতে সম্পূর্ণভাবে ভুলে গেল সে।
বাস্তবটা
বোধহয় এভাবেই ধরা দেয়, কল্পনাকে যথাসম্ভব অপমান করেই। মেয়েটা তাহলে
অভিষেকের গার্লফ্রেন্ড, বসে বসে ওর ইন্টারভিউ দেখছিল কৌশল করে। ওদের
সম্পর্কের ভবিষ্যৎ হয়ত এই ইন্টারভিউয়ের ওপরই টিকে ছিল। মনে হয় মেয়েটা
বাড়ীর দিক থেকে বিয়ের জন্য প্রেশারাইজড, তাই ছেলেটাকে তাড়াতাড়ি হাই
প্রোফাইল জবে ঢুকতে বলেছিল। অন্য কিছুও হতে পারে, তবে ওদের সম্পর্কে যে
একটা বড়সড় গোলমাল দেখা দিল, এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।
ব্যাপারটা নিয়ে বেশ কৌতুহল বোধ করল সুবিনয়। পেমেন্ট আগেই হয়ে গেছে, তাই আর দেরী না করে চটপট উঠে পড়ল সে।
বাইরে আকাশ তখন অনেকটাই কালো, আরো বেশ কিছু মেঘ জমেছে সেখানে।
-৪-
কফি
শপ থেকে বেরিয়ে নীচে আসতেই সুবিনয় দেখতে পেল দুজনকে। এক্সিট গেটের কাছে
একটা গারমেন্ট স্টোরের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে ওরা। রিমা কাঁদছে,ওকে কিছু
বোঝাবার চেষ্টা করছে অভিষেক। হঠাৎই ব্যাগ থেকে একটা ছোট বাক্স বের করল
রিমা, সেখান থেকে একটা আংটি বের করে অভিষেকের হাতে দিয়ে জড়িয়ে ধরল ওকে।
বোধহয় শেষবারের মত। চোখের জল মুছে বলল – ‘আমার আর কোন উপায় রইলনা অভি। একটু
বুঝে যদি আগে থেকে ট্রাই করতে...।‘
দাঁড়াল না রিমা। হনহনিয়ে বেরিয়ে পড়ল মল থেকে।
কিছুক্ষণ
হতভম্বের মত দাঁড়িয়ে রইল অভিষেক। পা টেনে টেনে এগিয়ে গেল পেছনের সিঁড়ির
দিকে। সেখানে সম্ভবত বাইক রেখে এসেছে সে। মলের ভেতরে অসংখ্য মানুষের টুকরো
টুকরো সংলাপের ভীড়ে এই ছোট্ট নাটকটা সবার অজানাই থেকে গেল। যে যার শপিং বা
উইন্ডো শপিং এ ব্যস্ত।
ফলো
করে এগিয়ে গেল সুবিনয়। দেখে সিঁড়ি বেয়ে ছেলেটা আস্তে আস্তে নেমে যাচ্ছে
বেসমেন্টের দিকে। সুবিনয়ের মনে হল – ও নিজেই যেন ছেলেটাকে অনেক নীচে নামিয়ে
দিল। ওর হঠাৎই মনে পড়ল টমাস হার্ডির সেই বিখ্যাত কবিতাটার কথা, যেখানে
ভয়াবহ যুদ্ধের মাঝেও বেঁচে থাকে প্রেম - যুদ্ধের দামামাকে থোড়াই কেয়ার করে
প্রেমিক প্রেমিকা হাত ধরাধরি করে ফিসফিসিয়ে কথা বলতে বলতে এগিয়ে চলে।
প্রেমের এই এক টুকরো ছবিটার কথা নীহারিকাকেও বলেছিল সুবিনয়, আট বছর আগের এক
রাতে, নীহারিকার বার্থডে পার্টিতে। মন দেওয়া নেওয়ার পালা চলছিল তখন ওদের
মধ্যে। সে রাতেই লুকিয়ে প্রথমবার রেখেছিল নীহারিকার ঠোঁটে ঠোঁট। বন্ধুদের
ফাঁকি দিয়ে প্রথমবার শারীরিকভাবে ঘনিষ্ঠও হয়েছিল দুজন।
নিয়মের
অজুহাতে ছেলেটাকে ফিরিয়ে দিল বটে, কিন্তু নিয়ম কি সে নিজেও ভাঙ্গেনি? শুধু
ভালবাসার জন্যেই বাড়ির অমতে কন্নড় মেয়েকে বিয়ে করেছিল সে। ‘ভ্যাকেন্সি
সবসময় থাকে না, প্রয়োজনে তৈরী করে নিতে হয়’ – এ কথাটা ত ওদের এম ডি সাহেবের
মুখেই শোনা। বহুবার অনেককে তিনি চাকরি দিয়েছেন এভাবে। সেসব এমপ্লয়িরা
কিন্তু কোম্পানীতে নিজেদের গুরুত্ব প্রমাণ করেছে বারবার।
বাজেটের
ব্যাপারে একটু ভাবল সুবিনয়। তার নিজেরই ত আলট্রাটেকের নতুন প্রডাক্ট
ক্রেডিটাস এর বিজনেস দেখাশোনা করবার জন্য একজন টীম মেম্বার প্রয়োজন। তাকে
একটু আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স নিয়ে ট্রেনিং দিলেই কাজ হয়ে যাবে। অটোমেটিক
লোন রিকভারির এই সলিউশনটা নতুন ক্লায়েন্টদের দেখাতে চাপ যাচ্ছে খুব। টিম
মেম্বার এলে সত্যিই সুবিধে হবে। বছরে অন্তত লাখছয়েকের বাজেট আরামে বের করে
নেওয়া যাবে এর জন্য।
আর ভাবল না সুবিনয়। নির্দ্বিধায় ডায়াল করল অভিষেকের নম্বর।
‘সরি
টু ডিস্টার্ব অভিষেক। আপডেট আছে একটা। ব্যাঙ্গালোরে আমাদের হেড-অফিসে নিউ
ডিজিটাল প্রডাক্ট সেলসে একটা ওপেনিং রয়েছে। ভেবে দেখলাম, ওটা তোমার কারেন্ট
প্রোফাইলের সঙ্গে কিছুটা ম্যাচ করবে, বাকিটা তুমি শিখে নিতে পারবে বলেই
আমার ধারণা। তোমার যদি রিলোকেশনে আপত্তি না থাকে নেক্সট উইকেই অফার লেটার
পাঠাতে পারি আমরা। ইমিডিয়েট জয়েনিং। তাড়াহুড়ো নেই, ভেবেচিন্তে কাল জানিও
আমায়।‘
‘না না,
রিলোকেশনে কোন প্রবলেম নেই আমার। আয়াম ফাইন উইথ ইট।’- ছেলেটির গলায় তখন
প্রবল উচ্ছ্বাস – ‘থ্যাংকস আ টন, দিস জব মিনস এ লট টু মি।‘
‘গুড, এইচ আর উইল কানেক্ট উইথ ইউ।
ফোনটা
রেখে এক্সিট গেট দিয়ে বেরিয়ে এল সুবিনয়। পাশেই ইকো পার্ক, টিকিট কেটে
ভেতরে ঢুকে পড়ল। মলের কৃত্রিম পরিবেশে কেমন যেন দম বন্ধ হয়ে আসছিল ওর।
হাঁটতে
হাঁটতে এগিয়ে এল সেভেন ওয়ান্ডার্স এর স্থাপত্যগুলোর দিকে। ইতিউতি ছড়িয়ে
আছে গিজার পিরামিড, স্ফিংস, তাজমহল কিংবা চীনের প্রাচীর। পিরামিডের ভেতর
ঢুকে বেশ ভাল লাগল সুবিনয়ের। দেওয়ালের পেন্টিং এবং মমির ছবি তুলে বেরিয়ে এল
বাইরে। একটা ব্রিজ পেরিয়ে চলে এল রোমের ভাস্কর্য কলোসিয়ামের রেপ্লিকার
কাছে। ভেতরের অ্যাম্ফিথিয়েটার অংশটায় এক ঘনিষ্ঠ যুগল ওকে দেখতেই
ব্যস্তসমস্ত হয়ে সরে গেল অন্যদিকে। মনে মনে হেসে উঠল সুবিনয়। বেরিয়ে এসে
চীনের প্রাচীরের দিকে এগোবে, এমন সময় চোখে পড়ল একটা গাছ। বড়সড় পাতার মাঝে
ঝুলে আছে সাদা থোকা থোকা ফুল। কেমন যেন চেনা চেনা লাগছে!
একটু ভাবতেই মনে পড়ে গেল সুবিনয়ের। ঠিক এই গাছটাই দেখেছিল সুমিতদের ব্যালকনি গার্ডেনে। গন্ধে ম ম করছিল বাতাস।
এদিক ওদিক চাইল সুবিনয়। উল্টোদিকেই অন্য একটা গাছ পরিচর্যা করছেন একজন। সম্ভবত এখানের মালী।
‘শুনছেন?’ - মালীর কাছে এসে দাঁড়াল সুবিনয়।
‘হ্যাঁ, বলুন বাবু।‘
‘আচ্ছা, ওইটা কী গাছ? ওই যে ওদিকে, থোকা থোকা ফুল ঝুলে আছে।‘
‘ওহ
ওটা’ – একঝলক তাকিয়ে বললেন ভদ্রলোক – ‘কুইন অফ দ্য নাইট, ক্যাকটাস জাতের
গাছ। অনেকে অবিশ্যি ভুল করে ব্রহ্মকমল বলে এক। সেটা আলাদা গাছ, পাহাড়ে হয়।
যেগুলো ঝুলে আছে, সেগুলো কিন্তু ফুল নয়, কুঁড়ি।‘
‘কুঁড়ি! এত বড়?’
খুরপিটা রেখে উঠে দাঁড়ালেন মালীসাহেব। হেসে বললেন – ‘ফুলটা আরও অনেক বড়। তবে এখন দেখতে পাবেন না।‘
‘ওহ, কখন ফুটবে ফুল?’
‘রাতে।
এ ত রাতের রাণী, সারা রাত ধরে একটু একটু করে ফুটবে। অদ্ভুত সুন্দর গন্ধ
ছড়াবে চারপাশে। তবে ভোরের আগেই সব ফুরুত। তখন আবার গুটিয়ে যাবে ফুল। আপনার
চাই?’
‘না। আসলে আমি ত এখানে থাকিনা, এতবড় গাছ...’
ইশারায়
পেছন পেছন আসতে বললেন ভদ্রলোক। গাছটার কাছে গিয়ে কেটে নিলেন কয়েকটা পাতা।
একটা কাগজে মুড়ে বললেন – ‘এইটে রাখুন, পাতাগুলো খাড়া করে ওদের গোড়া পুঁতে
দেবেন মাটিতে। শেকড় বেরিয়ে ওখান থেকেই হবে গাছ। এরপর রাতে রাতে ধরবে ফুল,
সারারাত ছড়াবে গন্ধের ম্যাজিক।‘
‘অনেক ধন্যবাদ।‘ – পাতাগুলো ব্যাগের ভেতর পুরে ফেলল সুবিনয়।
ওর
চোখের সামনে ধীরে ধীরে ফুটে উঠল চাঁদনি আলোয় সেজে ওঠা এক রাত। মিটমিটে
তারার নীচে ব্যালকনির দোলনায় বসে আছে সে আর নীহারিকা। ওদের ঘিরে থাকা রাতের
রাণীর পাপড়িরা খুলে যাচ্ছে একটু একটু করে। অদ্ভুত জাদুগন্ধ ছেয়ে যাচ্ছে
বাতাসে। ভালবাসার মানুষটার বুকে মাথা রেখে আস্তে আস্তে চোখদুটো বুজে আসছে
নীহারিকার। ওকে ডেকে তুলছে সুবিনয়। দোলনার দুলুনি ছেড়ে ধীরপায়ে দুজনে এগিয়ে
যাচ্ছে শোবার ঘরের দিকে।
সারারাত
ওদের আগলে থাকবে ফুটতে থাকা ক্যাকটাস ফুলের দল। মায়া আলিঙ্গনে ঘুমিয়ে
থাকবে দুটো প্রাণ, হয়ত এভাবেই একদিন দুই থেকে তিন হয়ে যাবে তারা।
পার্কের একটা বেঞ্চে বসল সুবিনয়। আস্তে আস্তে ডায়াল করল নীহারিকার নম্বর।
‘হাই ডিয়ার, কেমন কাটল আজ? দুপুরবেলায় ফোন, এনি সারপ্রাইস? আজ ফিরছ ত?’ - চমৎকার বাংলায় জানতে চাইল নীহারিকা।
মনটা
অনুতাপে ভরে গেল সুবিনয়ের। মুখে ফুটে উঠল বহুদিন আগের হারিয়ে যাওয়া
হাসিটা, যেটা নিয়মের রাংতায় মোড়া কর্পোরেট হাসির থেকে অনেক অনেক আলাদা।
ধীরে
জবাব দিল – ‘বড্ড ভাল। শুধু তুমি নেই, এটাই ভাল লাগছে না। এই ত এয়ারপোর্ট
যাব লাঞ্চ সেরেই। আর হ্যাঁ,সারপ্রাইজ গিফট একটা আছে বটে!’
-' ওয়াও! বল বল প্লিজ বল,কি আনছো তুমি কলকাতা থেকে?' নীহারিকার গলায় ছেলেমানুষী উচ্ছ্বাস!
_' ওটা সারপ্রাইজ ই থাক। আজ ফিরে দেখাবো।'
-' না,এখনই বল, প্লিজ প্লিজ প্লিজ।'
একমুহুর্ত চুপ করে থাকলো সুবিনয়। তারপর বলল,' নিশিগন্ধ। কুইনস পারফিউম ফর মাই কুইন।'
আকাশ ভেঙে তখনই নামলো বৃষ্টি।
( কৃতজ্ঞতা-- শুরুর গানের পংক্তি- জিম ক্রোচি)
...............................
অলঙ্করণ :- রিচা দাস