প্রবন্ধ - একশ বছর বাদে কী এই পৃথিবীআদৌ বাসযোগ্য থাকবে? - অভিজ্ঞান রায়চৌধুরী


 

একশ বছর বাদে কী এই পৃথিবীআদৌ বাসযোগ্য থাকবে?
 অভিজ্ঞান রায়চৌধুরী

 
এই বছরে নেদারল্যান্ডস, জার্মানি, বেলজিয়াম ও সুইজারল্যান্ডের একাধিক শহর
বন্যায় যেভাবে বারবার প্লাবিত হয়েছে, তা আগে কখনও ইতিহাসে হয় নি। চীনের ঝেংঝাও -তে মোটে তিনদিনের মধ্যে যা বৃষ্টি হয়েছে, তা সাধারণত একবছরেও হয় না। তুরকীস্থানের সিজরে শহরে উষ্ণতা ৪৯.১ ডিগ্রি হয়েছে, যা কখনই আগে হয় নি।উত্তর আমেরিকার প্রশান্ত মহাসাগরীয় উত্তর উপকূলের পাশ দিয়ে এই বছরে যে তাপপ্রবাহ হয়েছে, তা অতীতে আগে কখনও হয় নি। তাপপ্রবাহের জন্য ফিনল্যান্ডে উষ্ণতা ৩০ ডিগ্রির উপরে চলে গেছে কয়েক মাস আগে, যা আগে কখনও সে এলাকায় হয় নি। এই বছরেই গ্রীনল্যান্ডে বরফের স্তর এতো পাতলা হয়ে গেছে যা লিখিত ইতিহাসে ২০১২ সাল ছাড়া আগে কখনও হয় নি। এই আগে হয় নি, এখন হচ্ছে, নিয়মিত হতে শুরু করেছে- এরকম হাজারটা ঘটনা বলা যায়। এসবের পিছনে কী
তা নিয়ে আজ বিজ্ঞানীদের মধ্যে কোন প্রশ্ন নেই।
গ্লোবাল ওয়ারমিং কথাটা আজ আমাদের সবার কাছেই খুব পরিচিত। এটা যে কত বড় সমস্যা সেটা প্রতি বছর আমরা আরো বেশী করে টের পাচ্ছি। কখনও তার জন্য দাবানলে একের পর এক জঙ্গল ধবংস হয়ে যাচ্ছে, তো কখনও বারবার ধেয়ে আসছে
এমন ঝড় যা আগে খুব কম সময়ই আসত। কিন্তু পনেরো বছর আগেও এই গ্লোবাল ওয়ারমিং নিয়ে তর্ক বিতর্ক হতো। একদল বলত গ্লোবাল ওয়ারমিং হল মিথ্যে প্রচার, চিন্তা করার কিছুই নেই। বাড়তি গ্রীন হাউস গ্যাসের সঙ্গে এর কোন
সম্পর্ক নেই। এসব নিয়ে আমি একটা বই লিখেছিলাম ২০০৬ সাল নাগাদ এ বিষয়ে সবাইকে সচেতন করার জন্য। আসলে তখন আমেরিকার ম্যানুফাকচারিং ও ফসিল ফুয়েল লবি এল নিনো, মিলানকোভিচ এফেক্ট এরকম অন্য নানান কারণ দেখিয়ে প্রশ্ন তুলে সবাইকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছিল, যাতে এসব ইন্ডাস্ট্রির উপরে বাধানিষেধ না আসে। কিন্তু আস্তে আস্তে যখন বারবার এসবের জন্য প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে ইন্সিওরেন্স ইন্ডাস্ট্রির উপরে ক্ষতির বোঝা বাড়তে শুরু হল, তারা সত্যিটাকে সবার সামনে নিয়ে আসার চেষ্টা করল।

এটা এই কারণেই বললাম মিডিয়া বা রাজনীতি বেশীরভাগ সময় পরিচালিত হয় ক্ষুদ্র স্বার্থের দ্বারা। আমরা সেজন্য এখনও পেট্রোলের দাম বাড়লে তার প্রতিবাদে
ঝাঁপিয়ে পড়ি। কিন্তু গ্লোবাল ওয়ারমিং - এর বিরুদ্ধে সেভাবে কোন কিছুই করি না, যেটা আগামীদিনে আমাদের সবার জীবন ও জীবিকাকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করাবে।

এখন অবশ্য যে পর্যায়ে চলে গেছে সেখানে আমরা কেউ একা কিছু পরিবর্তন করতে পারব না। এখন আমাদের এই বিষয়ে সরকার ও বড় সংস্থাগুলোকে প্রভাবিত করতে হবে যাতে সবাই এই বিষয়ে দায়িত্বশীল ভূমিকা গ্রহণ করে।
বিভিন্ন দেশ গ্রীনহাউস নির্গমন কমানোর যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে সেগুলো পুরোপুরি
মানা হলেও ২১০০ সালের মধ্যে ‘ক্লাইমেট অ্যাকশন ট্র্যাকার’ এর মডেল অনুযায়ী পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা প্রাক-শিল্পযুগের থেকে ২.৭ ডিগ্রি বেড়ে যেতে পারে।
প্যারিস এগ্রিমেন্ট অনুযায়ী পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা প্রাকশিল্প যুগের ২ ডিগ্রি
সেলসিয়াসের মধ্যে বেঁধে রাখতেই হবে। তা না হলেই সর্বনাশ। ঝড়, দাবানল, খরা, বন্যা, বারবার তাপপ্রবাহ, চাষযোগ্য জমির অভাব, উধাও হয়ে যাওয়া কোরাল রীফ, সমুদ্রতল উঠে আসার মতো হাজারটা কারণে পৃথিবী কিন্তু বাসযোগ্য নাও থাকতে পারে আগামী একশ বছরে। ২ ডিগ্রির বেশী তাপমাত্রা বাড়লে যে কী হতে পারে সেটা কোন ক্লাইমেট মডেল নির্ভুলভাবে বলতে পারে না। শুধু সমুদ্রতল ১০ সেন্টিমিটার বেশী উঠে আসার জন্যই লক্ষ লক্ষ লোক তাদের জীবিকা ও বাসস্থান হারাবে। এই সমস্যা অনেক আগেই বোঝা যাবে, যদিও মারাত্মক রূপ ধারণ করবে ২০৫০ সালের পর থেকে।
 
উন্নতি ও জিডিপি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ফসিল ফুয়েলের ব্যবহার বাড়ে, গ্রীনহাউস
গ্যাস নির্গমন বাড়ে। এজন্য আগামীদিনে যত উন্নতি হবে, উন্নয়নশীল দেশগুলো যত উন্নত হবে, তত গ্রীনহাউন গ্যাসও বাড়বে।
এর পিছনে দায়ী কার্বনডাইঅক্সাইড ও মিথেনের মতো গ্রীন হাউস গ্যাস।এখন তাই চারদিকে সব জায়গাতেই কার্বন কমানোর আলোচনা হচ্ছে। কিন্তু এই বিষয়টা অতো সহজ নয়। একটা প্রসেসে হয়ত কমানো হল, কিন্তু তার জন্য আরেকটা জায়গায় কার্বন ফুটপ্রিন্ট বেড়ে যেতে পারে। এরকম একটা উদাহরণ দিই। ধরা যাক, আমরা ঠিক করলাম জ্বালানীনির্ভর গাড়ী কিনব না। ইলেক্ট্রিক ভেহিক্যাল ব্যবহার করব।
বিভিন্ন গাড়ীর কোম্পানি এখন এ বিষয়ে পুরোদমে কাজ করছে। কিন্তু এর একটা
সাইডএফেক্ট হবে যে তার জন্য গাড়ীর ব্যবহার অনেক বেড়ে যাবে, কারণ জ্বালানীর খরচ আর লাগবে না। এর জন্য অনেক বেশী সংখ্যক গাড়ী রাস্তায় দেখা যাবে। তার জন্য নতুন রাস্তা তৈরি করতে হবে। তার জন্য আবার কার্বনফুটপ্রিন্ট বেড়ে যাবে, কারণ কংক্রিট-এর রাস্তা মানেই তা তৈরি করার জন্য অনেক বেশী গ্রীনহাউস গ্যাস বেরোবে। একটা কাজের ক্ষেত্রে গ্রীনহাউস গ্যাস কমিয়ে আরেকটা কাজে গ্রীনহাউস গ্যাস বাড়লে, তেমন কিছু লাভ হবে না।

কার্বন ডাই অক্সাইড -এর তুলনায় মিথেন বাতাসে টিঁকে থাকে অনেক কম সময়,
বারো বছর, যেখানে কার্বন ডাই অক্সাইড একশো থেকে হাজার বছর টিঁকে থাকে। সেজন্য মিথেন কমাতে পারলে তা আমাদের তাড়াতাড়ি এই উষ্ণতা বাড়ার হার কমাতে সাহায্য করবে। বিশ্বে কোথায় কী কারণে মিথেন বেরোচ্ছে তা বোঝার জন্য ‘মিথেনস্যাট’ নামক এক স্যাটেলাইট লঞ্ছ করা হয়েছে এই বছরে যা পৃথিবীর চারধারে পাক খেতে খেতে প্রতি বর্গ কিলোমিটারে মিথেন কী কী উৎস থেকে আসছে তা চিনহিত করবে। সেভাবে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে কমানোর।
এর প্রভাব কিন্তু সরলরৈখিকভাবে বাড়বে না। একটা সময়ের পরে অনেক
তাড়াতাড়িও বাড়তে পারে। তাপমাত্রার এই বৃদ্ধি সর্বত্র সমানভাবে হবে না।
দক্ষিণ আমেরিকার কিছু অংশে তাপমাত্রা অপেক্ষাকৃত কম বাড়বে। রাশিয়া, চীন ও ভারতে তাপমাত্রা বাড়তে পারে ৩.৫ ডিগ্রি থেকে ৪.৫ ডিগ্রির মধ্যে। এজন্য কিছু কিছু জায়গায় মানুষ হয়ত আর বাইরে কাজই করতে পারবে না। এক্ষেত্রে ‘Wet Bulb’ তাপমাত্রা বলে একটা তাপমাত্রা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ যা তাপমাত্রা ও সে জায়গার আর্দ্রতার মিলিত প্রভাবে নির্ধারিত হয় ও সেখানে আদৌ কোন মানুষ বাস করতে পারবে কিনা তা ঠিক করে। এই ‘Wet Bulb’ তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রির উপরে গেলে সম্পূর্ণভাবে অবাসযোগ্য হয়ে যায়। বর্তমানে ভারত পাকিস্থানের সীমান্তবর্তী কিছু এলাকায় সে তাপমাত্রা ইতিমধ্যেই কয়েকবার হয়েছে ও আগামীদিনে অনেক জায়গাতেই হবে।
 
এই উষ্ণায়নের জন্য বিভিন্ন দেশে গৃহযুদ্ধ বা দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধের সম্ভাবনাও
বাড়বে। সিরিয়া বা সুদানে গৃহযুদ্ধের পিছনেও কিন্তু উষ্ণায়ন ছিল অন্যতম প্রধান কারণ। আসলে উষ্ণায়নের জন্য বৃষ্টিপাত অনিশ্চিত হয়ে যেতে পারে। বন্যা বা খরার জন্য, অনিয়মিত বৃষ্টিপাত, চাষযোগ্য জমি, পানীয় জল ও খাদ্যের অভাবে অজস্র মানুষ তখন এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতে বাধ্য হবে। আফ্রিকার সোহেলে, ক্যামেরুন, ইয়েমেন- এ আমরা ইতিমধ্যে এধরণের প্রবণতা দেখছি। কী হবে যদি লক্ষ লক্ষ মানুষ বাংলাদেশ বা কোন প্রতিবেশী দেশ থেকে ভারতে আসতে চায়, সেটা সহজেই অনুমেয়। দারিদ্র্যের সঙ্গে যুদ্ধবিগ্রহ অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িয়ে থাকে। সেটাই পুরো মধ্য এশিয়া, আফ্রিকা জুড়ে হতে পারে।
বিভিন্ন দেশ এখন নানা রকম প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে যার উপরে ভিত্তি করে এই
তাপমাত্রার বাড়ার সম্ভাবনার কথা বলা হচ্ছে। যেমন আমেরিকা বলছে ২০৫০ এর মধ্যে ‘নেট জিরো’। চীন বলছে ২০৬০ এর মধ্যে ‘কার্বন নিউট্রাল’। কিন্তু এই প্রতিশ্রুতি গুলো যে পাল্টে যাবে না, তাই বা কে বলতে পারে! আমরা দেখেছি
ট্রাম্পের মতো একজন নেতা এসে কীভাবে পুরো সভ্যতাকে পিছনের দিকে নিয়ে যেতে পারে, কীভাবে প্যারিস চুক্তি অস্বীকার করে নির্দ্বিধায় ফসিল ফুয়েল ব্যবহার করতে পারে।
মাঝে সময় খুব কম। কে বলতে পারে দশ বছর বাদে কোথায় গিয়ে থাকলে বাঁচতে পারব, সেটাই হয়ত ভাবতে হবে। একটা বড় অংশ অপেক্ষাকৃত ঠাণ্ডা জায়গায় চলে যাওয়ার চেষ্টা করবে। অবশ্যই আমরা এমন কিছু নতুন প্রযুক্তি হয়ত পাবো যা দিয়ে বাতাস থেকে কার্বন সরিয়ে নেওয়া যাবে, বা সূর্যরশ্মি কে প্রতিফলিত করে মহাকাশে ফের পাঠানো যাবে যাতে তাপমাত্রা কম বাড়ে। এসব ‘জিও ইঞ্জিনিয়ারিং’ এর সাহায্য উষ্ণায়ন কমানো যাবে যদিও তার উপরে এখনই ভরসা করা যাবে না। এর অন্য কিছু সাইড এফেক্টও হতে পারে, ও একই সঙ্গে বিভিন্ন দেশের উপরে বিভিন্ন ধরণের প্রভাব পড়তে পারে।
আগামী দিনের রাজনীতির কেন্দ্রে থাকবে উষ্ণায়ন ও উষ্ণায়নকে প্রভাবিত করে
এমন প্রযুক্তি। আমাদের মরণ-বাচন সেটাই নির্ধারণ করবে। জুলাই ২০২১ ছিল
বিশ্বের লিখিত ইতিহাসের সবথেকে উষ্ণমাস। পরের বছর আমরা হয়ত আবার সে রেকর্ড ভাঙব।
আপাতত আমাদের কাজ কী? আমাদের কাজ এ বিষয়ে সরকারকে প্রভাবিত করা যাতে তারা দায়িত্বশীলভাবে এবিষয়ে কাজ করে। একই সঙ্গে নিজেদের দিক থেকেও দায়িত্বশীল হওয়া, গ্লোবাল ওয়ারমিং এর ব্যাপারে অন্যদের সচেতন করা। তা না হলে হয়ত একশ বছর কেন, তার অনেক আগেই এ পৃথিবী আর বাসযোগ্য থাকবে না।
.......................
 

 
 

Comments

Loading... Logging you in...
  • Logged in as
There are no comments posted yet. Be the first one!

Post a new comment

Comments by