জ্যাঠামশাই - শুভাঞ্জন চট্টোপাধ্যায়

 

জ্যাঠামশাই
শুভাঞ্জন চট্টোপাধ্যায়
 

 
 

এ যখনকার কথা আজকের শহর কাঁচরাপাড়ার ছবিটা তখন এরকম ছিল না। রেলকারখানা এবং তাকে কেন্দ্র করে জীবিকা সূত্রে মানুষের আসা যাওয়া তখন একটু একটু করে বাড়ছে বটে কিন্তু আজকের মতো গা ঘেঁষা জনবসতি সেদিন ছিল না। অল্প মানুষ, ছাড়া ছাড়া  বাড়ি ঘর, কিছু কিছু দোকান পাট, এক দুজন ব্যাবসায়ী শ্রেণির মৌরুসিপাট্টা, সমাজে স্থানীয় গুণীজনের বিশেষ সমাদর...এই নিয়েই ছিল আমাদের সেদিনকার চোখে দেখা অঞ্চল কাঁচরাপাড়া, যার বেশিরভাগটাই মাঠ ঘাট বন বনানী জলাশয়ে ঘেরা। পূর্বপুরুষের মুখে শোনা পুরোনো গ্রাম কাঁচরাপাড়ার সেই রাঙামাটির ছবি তখন ততটাই অতীত, যতটা বর্তমান পূর্বেকার গ্রামজীবন ছাড়িয়ে নতুন নতুন পথ ধরে আসা যাওয়া মানুষের চলমানতা..আর তারই সাথে একটু একটু করে মফস্বল অঞ্চলের শ্রীবৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাওয়া আমার সে শৈশবের বেড়ে ওঠা জন্মভূমি। 
আমাদের বাড়ির দরজা খুললেই সামনে দিয়ে বয়ে যেত এক প্রকান্ড পুকুর। যেমন গভীর। তেমনই তার টলটলে জল৷ মাছরাঙা খেলা করতো। ভরা বর্ষায় নৌকা থেকে জাল ফেলা হত সে পুকুরে। ঐ জলেই আমাদের ছোটোবেলায় সাঁতার শেখা। পৌরসভার তৈরি ঐ পুকুরের সিঁড়ি  বাঁধানো দুটো ঘাট ইংরেজ আমলে ব্র্যাডলে সিম্পসন নামে রেল কারখানার এক ওয়ার্কস ম্যানেজারের হাতে উদ্বোধন করা হয়েছিল বলে ঘাটের পাশে তারই নামাঙ্কিত সিমেন্টের একটি ফলক স্বযত্নে সেখানে স্থাপন করা হয়। সেই থেকে আম জনতার কাছে পুকুরটি  ব্র্যাডলে ট্যাঙ্কের পুকুর নামে পরিচিত। পুকুরের ধার ঘেঁষে  নতুন পিচ ঢালা রাস্তা পৌরপ্রধানের নিজের উদ্যোগে তৈরি একতলা স্কুল বাড়ি, পৌরভবন, এ অঞ্চলের ভূমিপুত্র বিপ্লবী বিপিন বিহারি গাঙ্গুলির স্মৃতিতে তৈরি বিপিন স্মৃতি পাঠাগার, জনবসতিকে ডান হাতে রেখে সোজাপথ ধরে চলে গেছে বহুদূর। পুকুরের ওধারে সুবিস্তৃত রেল লাইন...বড় বড় কয়লার ইঞ্জিন গুলো যখন যায়, ঝনঝন করে ওঠে আমাদের বাড়িটা যেন। বাইরের বৈঠক খানা ঘরের খোলা দরজা দিয়ে আমি তখন তাকিয়ে থাকি। মিলিয়ে যায় হুইসিলের শব্দ, আকাশের পথে ভাসমান কালো কালো ধোঁয়াগুলো আরো কিছু সময় ভেসে চলে আমার মনোরাজ্যে...একলা দুপুর বেলা 'শিল কাটাও 'বলতে বলতে হেঁকে চলে যায় ফেরীআলা...এক রাস্তা ছাড়িয়ে আর এক রাস্তায় মিলিয়ে যায় সে মানুষ...মন উদাস করা ডাকটুকু রয়ে যায় তারপরেও কোথায় যেন....চৈত্রের নিঃসঙ্গ হাওয়া শনশন শব্দে বয়ে যায় পেয়ারা, নিম, সরকার বাড়ির আম গাছের পাতায়...পাঁচ পয়সার আইসক্রিমআলা ঘন্টি বাজাতে বাজতে এগিয়ে আসে পুকুর পাড়ের রাস্তা ধরে ক্রমশ এদিকে....কুলুঙ্গির ভেতর মায়ের রেখে দেওয়া মরচে ধরা টিনের বাক্স থেকে নয়া পয়সা সরিয়ে নিঃশব্দে  খিড়কি দোর খুলে ছুটে যাই গাড়ির পেছনে.... বেলা ডুবে আসে সূর্যের কোলে...বিচুলি বোঝাই গরুর গাড়ি হেলতে দুলতে অবসন্ন চিত্তে এগিয়ে যায় আমার বাড়ির খিড়কি দরজার সামনে দিয়ে...পুকুরের জলে শেষ বিকেলের আলো আঁক কাটে জলছবি হয়ে....বেলা শেষে বাড়ি ফেরে হাঁসের দল....সন্ধ্যা নামে...বাবা ফিরে আসেন ওকালতির কাজ সেরে...মা তুলসী মঞ্চে শাঁখ বাজিয়ে রান্নাঘরে যান চা বসাতে...আমরা গোল হয়ে বসে ভাই বোনেরা মিলে পড়াশোনা করি...রাত বাড়ে...ঝিঁ ঝিঁ পোকার সুর তত স্পষ্ট হয়...আমাদের বাড়ির পাঁচিল ঘেঁষা দেহাতি বসতির একচালা ঘরে রোজকার মতো রামগানের ভোজপুরী সুর ভেসে আসে...' রঘুপতি রাঘব রাজা রাম...পতিত পাবন...'
এসবকিছুই আমার শৈশবের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়ানো স্মৃতি। সময়ের সাথে ধীরে ধীরে পালটে যায় কত ছবি , কিছু বা ফিকে হয়ে আসে, নতুন রঙের প্রলেপ পড়ে....ফ্যাকাশে অ্যালবাম আলো হয়ে রয়ে যায় কালের বুকে। 
জনবসতি বাড়ে ব্যবসা, রেল কারখানার হাত ধরে। কাজের সুবাদে ভিন রাজ্য থেকে আসা মানুষ, ওপার বাংলার মানুষের আনাগোনায় রেল সংলগ্ন বৃটিশ আমলের বাড়ি, জায়গাগুলো নামের আড়ালে এক এক করে সাধারণের কলোনীতে পরিনত হয়... আর এক ধারে মাথা উঁচু করে দাঁড়ায় পুরোনো কাঁচরাপাড়ার এদেশি, ব্যাবসায়ী বনেদিআনা। আমার বাড়ির পাঁচিলের গায়ে সেই দেহাতি খোট্টা লোকটি এখন আর সন্ধ্যাকালে রামগানের আওয়াজ তোলে না। পঙ্গু স্বামীর পাশে বসে বসে ওর স্ত্রী আকাশের দিকে করুন দৃষ্টিতে তাকিয়ে সুর তোলে...' রঘুপতি রাঘব...'
রাস্তার ধারের ব্র্যাডলে ট্যাঙ্কের পুকুর আমাদের খিড়কি দোর ছাড়িয়ে একটু একটু করে দূরে সরে আসে....পলিমাটির চরাটুকু বড় হতে হতে কবে যেন স্টেশনে যাওয়া আসার নতুন পথ, ছেলেপিলেদের খেলার মাঠে পরিণত হয়...আমার এককালের পড়ে আসা দরমার বেড়া আর টালির ছাউনি দেওয়া স্কুল বাড়ির ঘরগুলো পাকা কংক্রিটের ওপর ভর দিয়ে একদিন মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে শেখে....পৌরসভা, দমকল,শিবানী হাসপাতাল, বিপিন পাঠাগার হয়ে আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে কত নতুন নতুন মানুষ, হামেশাই কত যানবাহন আজকাল চলাচল করে.. দেখি তাই বসে বসে। 
ছেদ পড়ে না গরুর গাড়ির আসা যাওয়ায়...শুধু টা টা করে চলে গিয়েছে বিচুলির গাড়ির পেছন পেছন ধাওয়া করে বেড়ানোর সেই মুহূর্তগুলো....ফিকে হয় না স্নান ঘাটের পাশে সিমেন্ট ফলকের গায়ে কালো রঙে খোদাই করা ব্র্যাডলে সাহেবের নামটুকু,আমাদের ' কমলাবাস' বাড়িটাকে ঘিরে ভাই বোনেদের আনন্দ...ভর দুপুরে আইসক্রিম গাড়ির ঘন্টির আওয়াজ...হারিয়ে গিয়েছে কেবল পাঁচ পয়সার জন্য মায়ের ঘুমোবার অপেক্ষায় চুপটি করে বসে থাকা সেইসব ঘুঘু ডাকা অলস মধ্যাহ্ন....ছিঁচকে চোরের মতো সদর দরজার ছিটকানি খুলে ঘন্টি কাকুর পিছু নেওয়া সেই সব অমূল্য সময়....বাড়ির উল্টোদিকে রাস্তার ধারে হেলে পড়া  সরকারদের আমগাছটায় বোল ফোটে এখনো....নিদাঘ মধ্যাহ্নে বন্ধুরা মিলে তরতাজা আম চুরি করে খাবার সে বয়স অন্তর্হিত হয়েছে কতকাল..! দিনের শেষে শুধু স্বাদটুকুই মুখে লেগে থাকে আজও...। 
এখন আমি প্রি ইউনিভার্সিটিতে পড়ি। বৈঠক খানা ঘরের দরজার সামনে চৌকিতে বসে ইউনিভার্সিটির স্যারের লিখিয়ে দেওয়া নোট চেকোশ্লোভাকিয়ান ক্রাইসিস মুখস্থ করছিলাম। খিড়কি দোর সংলগ্ন ছোট রোয়াকে দাঁড়িয়ে চুল বাঁধছিল আমার থেকে দু বছরের ছোট বোন মিনু। 
' দাদা..দাদা...!'
মিনু ডাকে।
' আঃ! পড়তে দে। একটা শক্ত বিষয় দেখছি। এখন ডিসটার্ব করিস না।'
' দ্যাখ দাদা কিরকম মেঘ করেছে! ঐ ওখানটা কালো হয়ে যেন দৈত্যের মতো এগিয়ে আসছে..!'
 'পরে দেখবো। এখন কথা বলিস না।'
চুল বাঁধা থামিয়ে আকাশের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে মিনু। ' 
খাতার পৃষ্ঠা থেকে ঝলকে মুখটা একটু তুলতে এবার বুঝতে পারলাম। 
' হ্যাঁরে তাইতো! '
রেল লাইনের ওপারে ঈশান কোনে তাল,নারকেল গাছের সারির মাথার ওপর ঘন কালো পাহাড় প্রমান মেঘরাশি আকাশ ময় ক্রমশ যেন তার জাল বিস্তার করতে শুরু করেছে।  শেষ বিকেলের কুসুমরঙা আলোর আভা দক্ষিণ পশ্চিম কোণে কিছুটা হলেও স্পর্শ টুকু ছু্ঁয়ে রেখেছে এখনো। কখন যে সেটুকুও ডুবে যায়...।  এদিক ওদিক তাকালাম। চারিদিক অদ্ভুত রকম থমথমে হয়ে এসেছে। অদূরে ভুটিয়াদের বিচুলির দোকান...সেও খোলেনি এখনো। রাস্তাঘাটে জনপ্রাণী নেই বললেই চলে। সাইকেল চড়ে দুটো লোক আকাশের দিকে তাকাতে তাকাতে সাঁ সাঁ করে বেরিয়ে গেল। তিন চারটে সারস পাখি অকাল আঁধারের আশংকায় হুশ করে উড়ে চলে গেল রেললাইন ছাড়িয়ে বহু দূরে গাছ গাছালীর আড়ালে যেখানে মাঠ, জলাশয়ের প্রান্তসীমা টুকু চোখে ভাসে। 
' দাদা কিরকম কালো হয়ে ঢেকে যাচ্ছে দ্যাখ চারিদিকের আকাশটা! বড় একটা ঝড় উঠবে মনে হচ্ছে!'
 পড়াশোনা বন্ধ করে রোয়াকে এসে দাঁড়িয়ে দেখছি দৃশ্যটা। মিনুর ভাষায় 'দৈত্যাকৃতি'র জটাজুটো ধারী কালবৈশাখির মেঘ প্রায় গোটা আকাশটাকে গ্রাস করে নিয়েছে। রাস্তায় লোক নেই, দোকান পাটগুলোও খোলে নি...বাইরের ঘরের রোয়াকে দাঁড়িয়ে আছি শুধু আমরা দুজন। পুকুর পাড়ের চড়ায় দুতিনটে বাচ্চা ছেলে এতক্ষণ খেলা করছিল। দূর থেকে ওদের চিৎকার শুনতে পাচ্ছিলাম। অন্ধকার হয়ে আসছে দেখে এইমাত্র ধূলো ওড়াতে ওড়াতে পালিয়ে গেল ছেলেগুলো। ওদের চলে যাওয়ার সাথে সাথে কি জানি হঠাৎই মনে হলো আমার...এখন সবে সাড়ে পাঁচটা বাজে...এরই মাঝে দূর্যোগের আশংকায় পাড়াটা যেন অদ্ভুত রকম নিশুতি হয়ে এসেছে...! 
' ঝড়টা হলে ভালোই হয় দাদা। কয়েক দিন ধরে বড্ড গুমোট হয়ে আছে!'
' হ্যাঁ তা অবশ্য...।'
হঠাৎই হাওয়া শুরু হলো। গুমোট থেকে ঠান্ডা ঝোড়ো হাওয়া। গাছ গাছালী লতাপাতাগুলো এ ওর গায়ে এসে পড়তে শুরু করেছে। বাতাসে সোঁ সোঁ শব্দ। শুকনো ধূলো, রাস্তায় পড়ে থাকা খড়কুটো সব যেন ঘূর্ণির মতো পাক খেয়ে খেয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে চোখের সামনে। সামনের দু একটা  বাড়ির জানলার শার্সির ফাঁক ফোঁকর দিয়ে মুখ বাড়িয়ে প্রকৃতির রূপ দেখছিল হয়তো কেউ। দমকা হাওয়ার ধাক্কায় সেই যে পাল্লা বন্ধ হয়ে গেল আর খুললো না।
ততক্ষনে ঝড়ের তীব্র হিল্লোলে রেল লাইনের ওপারের তাল, নারকেল গাছের মাথাগুলো এমন ভাবে হেলে দুলে উঠছে, যেন এই বুঝি মটমট করে ভেঙে পড়ে। সামনে সরকার বাড়ির আমগাছ থেকে টপাটপ হলুদ রঙা হিমসাগর পড়তে শুরু করেছে রাস্তার এদিক ওদিক... থেঁতলে যাচ্ছে শক্ত মাটির আঘাতে। ভাবলাম  দৌড়ে যাই আমি আর মিনু মিলে। পা এগোলো না৷ মেঘ আর ধূলোয় অন্ধকার হয়ে উঠেছে চতুর্দিক। দুটো বলদকে দড়ি বেঁধে কোনোমতে খাটালের দিকে  নিয়ে চলেছে  রাধেশ্যাম গোয়ালা। 
' দাদা, এই দাদা...আমগুলো কিরকম রাস্তায় পড়ে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে দ্যাখ...কয়েকটা আঁচলে ভরে তুলে আনবো? এখন তো কেউ কোত্থাও নেই। সবাই যেন ঘুমিয়ে পড়েছে....! '
' নারে, সরকার বুড়িকে চিনিস না। বাড়ির ভেতর থেকে উঁকি মেরে সব দ্যাখে...এখন এই ঝড়ে বাইরে বেরোলে নির্ঘাত কারো চোখে পড়ে যাবি। বুড়ি চিৎকার করে পাড়া মাথায় করবে। বাবা অফিস থেকে ফিরে এসে যদি জানতে পারে....সে বয়স কি আর আছে রে?' 
কথাগুলো মুখ থেকে বেরিয়ে এলো বটে, কিন্তু চারপাশের প্রকৃতিটাকে অবলোকন করতে করতে হঠাৎ করে হারানো ছেলেবেলাটা যেন টুকটুক করে কড়া নাড়তে শুরু করলো আমার মনেরই কোথাও লুকিয়ে থাকা কোনো এক গহন পথে৷ ভাবলাম দৌড়ে যাই। এরকম আম পড়া ঝোড়ো বেলা কতদিন পর যে এতটা কাছ থেকে, নিজেকে ছোটোবেলার সঙ্গে অদ্ভুত ভাবে মিশিয়ে নিয়ে উপভোগ করছি সত্যিই জানি না। হাওয়ার গর্জন, তার প্রতিটি অভিব্যক্তি, লতা পাতার সোঁ সোঁ শব্দ, কালো মেঘের লুটোপুটি, বাইরের আঁধার ঘেরা নিস্তব্ধতা...এই দৃশ্য ফেলে কিছুতেই যেন মন চাইছে না ঘরে ঢুকে দরজা জানলা বন্ধ করে বসে থাকতে....মন চাইছে আরো কিছু.... বাইরের রোয়াক থেকে সোজা রাস্তায় বেরিয়ে প্রাণ ভরে প্রকৃতির স্বাদ আহরণ করতে। এতদিনের গুমোট করা চারিপাশটা যখন ঠান্ডা হতে শুরু করেছে, তার একবার স্বাদ নেবো না! 
' মিনু চল, আম কুড়োই...তুই শুধু একটু লক্ষ্য রাখিস, এদিক ওদিক থেকে কেউ আবার দেখে ফেলে কিনা...বিশেষ করে ঐ সরকার বুড়ি....।'
' সত্যি যাবি দাদা!'
মিনুর মুখখানা কিরকম যেন অ্যাডভেঞ্চারিস্টের মতো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। 
এক পা বাড়িয়েও আচমকা থমকে যেতে হল আমাদের। 
অনেক দূরে রেললাইনের ওপারে বাঁশগাছের আড়াল থেকে একটা লম্বা আলোর রেখা সাপের গতিতে এঁকেবেঁকে তাল,নারকেল, অশ্বত্থ গাছের মাথার ওপর দিয়ে ব্র্যাডলে ট্যাঙ্কের পুকুরের জলে প্রতিবিম্বিত হয়ে যেন আকাশের বুক চিরে ঠিকরে বেরিয়ে এলো একরাশ জ্বলন্ত আগুনের ফুলকি দিয়ে তৈরি ধনুকের ছিলায় জড়ানো তীরের শানিত ফলার মতো....সে বিদ্যুতের ঝলকের সাথে সাথেই প্রচন্ড জোড়ে একটা বাজ পড়লো...এতটাই জোড়ে যেন মনে হলো রেলব্রিজের ঠিক পেছনটাতে বাঁশ বাগানের জলার ভেতর গিয়ে পড়লো সে অগ্নিকুণ্ড! সাথে সাথে আরো একটা বজ্রপাত। 
সাহস হলো না এই খোলা রাস্তায় গিয়ে আম কুড়োবার। 
মিনু শঙ্কার দৃষ্টিতে আকাশটাকে দেখতে দেখতে বললো,' বাবার আসতে এখনো কত দেরী! ট্রেন যদি বন্ধ হয়ে যায়... কি করে আসবে বল তো?'
কি জানি আমারো এবার বেশ চিন্তা হচ্ছিল বাবার জন্য। ঝড় যে ক্রমশ বাড়ছে! বাড়ছে হাওয়ার ঝাপটা আর তার সঙ্গে এক অদ্ভুত সোঁ সোঁ কালবৈশাখির আওয়াজ...! 
এই দূর্যোগ আরো চলতে থাকলে কত কি হতে পারে। ওভারহেড তার ছিঁড়ে যেতে পারে।  ভাবতে ভাবতেই দেখি একটা প্রকান্ড মালগাড়ী আমাদের বাড়িটাকে থরথর করে কাঁপিয়ে দিয়ে ঘটাং ঘটাং শব্দ তুলে হুস করে বেরিয়ে চলে গেলো ডাউন লাইন দিয়ে। 
তাকিয়ে দেখি বৈঠক খানা ঘরের ভেতরটা অন্ধকার হয়ে উঠেছে। চারিপাশে লোডশেডিং হয়ে গেছে কখন যেন। বাবার আসার সময় এখনো ঢের দেরি। ততক্ষণে  কি আর ঝড় কমবে না?  নিশ্চই কমে যাবে। মিনুকে অযথা চিন্তা করতে নিষেধ করে ভাবলাম মাকে বলে ভেতর ঘর থেকে একটা লম্ফ নিয়ে আসি...নোটটা মুখস্থ করতে শুরু করি আবার....ঠিক সেই সময় বাড়ির ভেতরের কোনো একটা দরজা কিংবা জানলার পাল্লা সজোরে হাওয়ার বারি খেয়ে এতটাই জোরে দরাম করে উঠলো যেন মনে হলো পাল্লাটাই বুঝি খুলে পড়ে গেল...! 
আমি দৌড়ে গিয়ে দেখতে যাবো বাড়ির ভেতরে কি হলো, এমন সময় হঠাৎই বেশ জোরে বলে ওঠে মিনু,' দাদা, দাদা...জ্যাঠামশাই আসছে...ঐ দ্যাখ!'
' এই দূর্যোগে জ্যাঠামশাই? '
' ঐ তো দ্যাখ না পুকুরের পাশ দিয়ে আসছেন...একটা ছায়ামূর্তি... দেখতে পাচ্ছিস? অবিকল জ্যাঠামশাইয়ের মতো চলনভঙ্গি...কতকালের মানুষটা...না চিনে কখনো থাকতে পারি? কিন্তু এই ঝড় বাদলের দিনে উনি এতদূর কি করে আসবেন বল তো দাদা..!'
সত্যিই তো! দূর থেকে দেখি আধো অন্ধকারের মাঝে সেই পুরনো আদ্যিকালের কাঠের হাতলওয়ালা ছাতাটা নিয়ে দূর্যোগ মাথায় করে ফরসা নধরকান্তি চেহারার টাক পড়া এক বৃদ্ধ ভদ্রলোকের ছায়াশরীর  হেলতে দুলতে পুকুর পাড়ের চড়ার ওপর দিয়ে আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছে। সেই হাফহাতা ফতুয়া, চিরাচরিত খেঁটো ধুতি, দমকা হাওয়ায় এলোমেলো করে দিচ্ছে পরনের ধুতি, ফতুয়া খানা, ছাতা হেলে পড়ছে...শত বাধা বিঘ্ন পেরিয়ে এগিয়ে আসছে...এগিয়ে আসছে সেই ছায়ামূর্তি...। আমি আর মিনু অধীর আগ্রহে চেয়ে রয়েছি। যাকে ছোটোবেলা থেকে দেখে আসছি, ছায়ামূর্তির বেশেও তাঁকে চিনতে আমার এতটুকু ভুল হবার কথা নয়। আমি হাত নেড়ে চিৎকার করে উঠলাম,' ও জ্যাঠামশাই... জ্যাঠামশাই..!'
মিনুও আমার দেখাদেখি হাত নাড়ছে। 
বেঁটেখাটো ছায়াশরীরটা আস্তে আস্তে মানব শরীরের অবয়ব হয়ে এগিয়ে আসছে...পুকুর পাড়ের রাস্তা ছাড়িয়ে আমাদের বাড়ির সামনের রাস্তায় এসে পড়লেন মানুষটা। তাকিয়ে আছেন আমার আর মিনুর দিকে। এই আবছায়া অন্ধকারে, তীব্র ঝোড়ো হাওয়ার মাঝেও মুখের হাসিটুকু কি অদ্ভুত ভাবে মিশে রয়েছে তাঁর দু চোখে..! 
' ও জ্যাঠামশাই, বাড়িতে আসবেন না?'
দূর থেকে হাত তুললেন জ্যাঠামশাই।
' আসবো ফেরার পথে। এখন একটু ওদিকে যাচ্ছি। '
' কোথায়? '
' পলাশি।'
' এই দূর্যোগের মধ্যে আপনি অতদূরে পলাশিতে....!'
আবার সেই আলগা হাসি। ঘাড়টা কিছুটা হেলিয়ে একবার আড়চোখে কি যেন দেখলেন আমার দিকে তাকিয়ে... যা আমি আবছায়া আলোতেও বেশ স্পষ্ট বুঝতে পারলাম। 
' তোর বাবা কেমন আছে রে?'
কিছু বলতে পারলাম না। মুখ দিয়ে কথা সরলো না। জ্যাঠামশাই আমার উত্তরের অপেক্ষা না করে ডানদিকের রাস্তা ধরে জোর পায়ে হেঁটে যেতে শুরু করলেন। 
ঠিক সেই সময় কড়াৎ করে আরো একটা বিভৎস জোরে বাজ পড়লো। সেই সঙ্গে নামলো বৃষ্টি। 
আমি আর মিনু রোয়াকে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে মুখ বাড়িয়ে তাকিয়ে রয়েছি জ্যাঠামশাইয়ের চলে যাওয়ার দিকে। মুখে বৃষ্টির ঝাপটা এসে লাগছে। হাওয়ার তোড়ে পাশের বস্তি বাড়ির একটা খড়ের চাল সজোরে উড়ে গিয়ে পুকুর পাড়ে কোথায় গিয়ে যে পড়লো কে জানে।  কিন্তু তখন এসব ভ্রূক্ষেপ করার মতো মন বা মানসিকতা আমার নেই৷ 
একটু একটু করে দেখতে পাচ্ছি, ছাতার আড়ালে একটা কোলকুঁজো কালো ছায়ামূর্তি ছপছপ করে নাগড়াই জুতোর পায়ের আওয়াজ ফেলতে ফেলতে ক্রমশ দূর থেকে আরো দূরে ঝড়, মেঘ, বৃষ্টি  আর হাওয়ার মাঝে মিলিয়ে যাচ্ছে এক রাস্তা থেকে আর এক রাস্তায়...একসময় স্কুল বাড়ির পাশ দিয়ে ঝুপসি অন্ধকারে দৃষ্টি পথের বাইরে অদৃশ্য হয়ে  যায় সেই অবয়ব। 
দরজাটা বন্ধ করে ভেতরে চলে এলাম। মনটা ভারি অন্যমনস্ক হয়ে আছে। 
' কিরে দাদা...জ্যাঠামশাই আমাদের বাড়ি না এসে এই দূর্যোগের মধ্যে পলাশিতে....পায়ে হেঁটে সে কি কমখানিক দূর..! ব্যাপারটা কিরকম যেন লাগছে আমার! এরকমটা তো কোনোদিন হয়নি! কোনোকারণে রাগ টাগ করলেন না তো? '
মিনুও যেন আমার মনের কথাটাই তুলে ধরলো। 
বললাম, ' না না রাগ করবেন কেন। সেরকম তো কিছু হয়নি। ফেরার পথে আসবেন, এটাও তো বললেন। তবু ঠিকই বলেছিস,  যে মানুষ কাঁচরাপাড়ায় এলে সবার আগে আমাদের বাড়ি না এসে কোথাও যান না...সেই মানুষটাই এত কাছ থেকে হাত নাড়িয়ে চলে যেতে পারে..! '

সন্ধ্যা বেলায় বাবা যখন কোর্ট থেকে ফিরলেন, তখন ঝড় বৃষ্টি অনেকটাই থেমে গেছে। প্রকৃতিকে ঠান্ডা করে দিয়ে কয়েক পশলা ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি তখনো হচ্ছিল, সে নেহাৎই ছিটেফোঁটা। নরম, শীতল প্রকৃতির কোলে মাঝে মাঝে হালকা বিদ্যুৎও চমকাচ্ছিল। 
দেখতে ভারি ভালো লাগছিল এই কোমল রূপ। 
 ছাতাটা ঘরের বাইরে একপাশে মেলে রেখে বাবা বললেন, ' ভেবেছিলাম হয়তো ফিরতে আরো অনেক দেরী হবে৷ কোথাও ট্রেন লাইন জলমগ্ন, কোথাও আবার ওভারহেড তার ছিঁড়ে গেছে ঝড়ে, ওদিকে বট গাছের ডাল ভেঙে চিড়িয়া মোড়ের কাছে সেকি যানজট! জায়গায় জায়গায় কত যে গাছ পড়েছে আজ...!  কপালগুণে একটা ভীড় ট্রেন পেয়ে গেলাম তাই। উঠে পড়তে পেরেছি এই ভাগ্যি! তার পরপরই শুনলাম, ডাউন লাইন জলের তলায় বসে গিয়েছে। আপে ও আপাতত আর কোনো গাড়ি চলবে না। ভাগ্যিস কৃষ্ণ নগরটা ধরতে পেরেছি...! কালই খবরের কাগজে জানতে পারবো কোথায় কি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সরকারদের আমগাছটা কি ভেঙে পড়েছে নাকি রে? দেখলাম একটা বিরাট বড় মোটা ডাল রাস্তার ধারে লতাপাতা সমেত  একেবারে নুইয়ে পড়েছে! '
' তা হতে পারে। যেরকম ঝড়টা গেল..! আমরা তো চিন্তা করছিলাম তোমার জন্য..!'

মা রান্নাঘরে ছিলেন। বাবার জন্য চা জলখাবার রেডি করছিলেন। মিনুর সামনে মাধ্যমিকের অঙ্কের বইটা খোলা। তবুও পড়ায় মন দিতে পারছে না ও। হয়তো আমারই মতো ওরও এখনো মাথায় ঘুরছে ছবিটা। 
বাবা আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করলেন,' খোকা আজ আর কলেজে যাস নি তো?'
' না সামনে পরীক্ষা...তাই স্টার্ডি লিভ চলছে।'
' ভালো করে পড়াশোনা করছিস তো? '
' হ্যাঁ। জানো বাবা একটা ঘটনা ঘটেছে আজ। কেমন যেন অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে। এরকমটা তো আজ অবধি কখনো হয়নি...তাই বোধহয়...!'
মিনু আর আমি চোখ চাওয়া চাওয়ি করি। কথাটা মাকেও জানানো হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। 
লুঙ্গি আর স্যান্ডো গেঞ্জি টা পরে সবে চৌকিতে বসতে গিয়েছিলেন বাবা, আমার কথায় ঘাড় ফিরিয়ে তাকালেন।
' কী ঘটনা? '
' তখন পৌনে ছটা বাজে। বাইরে তখন খুব ঝড়। বৃষ্টিও নেমেছে। একটু আগেই লোডশেডিং হয়ে গেছে। হঠাৎ দেখি পুকুর পাড়ের রাস্তাটা দিয়ে জ্যাঠামশাই আসছেন। আমাদের দিকে তাকিয়ে হাত নাড়লেন। বললেন, " পলাশি যাচ্ছি। ফেরার পথে আসবো.."
তোমার কথা একবার জিজ্ঞেস করে সোজা হাঁটা দিলেন ঐ দিকে। ঐরকম দুর্যোগ মাথায় নিয়ে বৃদ্ধ মানুষটা একা একা পলাশি যাচ্ছেন...আমাকে তো কিছু বলারও সময় দিলেন না...মুখে সেই আগের মতো হাসি....ঐরকম ঝড় বৃষ্টি হচ্ছে..মেঘের গর্জন...অথচ সদাহাস্যময় চোখে কিরকম আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে সোজা চলে গেলেন জ্যাঠামশাই...!'
আমার আর মিনুর মুখে ঘটনাটা শুনে বাবাও ভীষণ অবাক হয়ে গেলেন। বাড়ির সকলের তখন একটাই মনের ভাব....' এমনটা তো কখনো হয়নি..'

পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে জ্যাঠামশাইয়ের প্রতি বাবার যে আত্নীক টান জড়িয়ে ছিল,  তা আমি জীবনের বিভিন্ন সময়ে রন্ধ্রে রন্ধ্রে অনুভব করেছি। 
শুনেছিলাম আমাদের বংশের চারপুরুষ আগেকার জনৈক ব্যক্তি  গৌড়হরি চট্টোপাধ্যায় মুর্শিদাবাদ থেকে ভাগ্যান্বেষণে সেকালের কাঞ্চনপল্লীর পলাশি গ্রামে চলে আসেন এবং সেখানেই কয়েক একর জমিতে   বসতভিটা তৈরি করে, আমের বাগান, দেশ বিদেশ থেকে গোলাপের চারা আমদানি করে  চাষআবাদ শুরু করেন। এই ভাবে পলাশি মাঝিপাড়া মৌজার প্রায় অর্ধেকেরও বেশি জমি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জনৈক উদ্যোগপতি গৌড়হরির হস্তগত হয়। চট্টোপাধ্যায় পরিবারের পূর্বপুরুষের বিত্তবৈভবের শুরু হয়তো সেখান থেকেই। 
গৌড়হরির পরবর্তী বংশধর রত্নেশ্বর চট্টোপাধ্যায় ছিলেন নীলকুঠির এক কুখ্যাত দেওয়ান। তাঁর হাতে নাকি ছিল একশোরও বেশি লেঠেল বাহিনী। কত অসহায় মানুষকে চোখের জলে ভাসিয়ে তাদের জমিজমা সম্পত্তি বলপূর্বক হস্তগত করেছিলেন তিনি, তার বুঝি ইয়ত্তা নেই। পুরনো কাঁচরাপাড়ার রেল কারখানার অদূরে যাতায়াতের পথে যে ডাকাতে কালিমন্দির আজও চোখে পড়ে, সেই মন্দির এবং গর্ভগৃহ সংলগ্ন বহুদূরগামী অন্ধকার সূড়ঙ্গপথ রত্নেশ্বরেরই হাতে তৈরি। কপালে এই বড় সিঁদুর দিয়ে রাঙা চেলী পরে ঐ মন্দিরে ডাকাতে কালীর আরাধনা করতেন তিনি।  শোনা যায় সেই সুড়ঙ্গপথ ছিল একেবারে পলাশির বসতভিটা পর্যন্ত বিস্তৃত। শত্রুপক্ষের আসার খবর পেলে ঐ গহন পথই ছিল ভরসা। যার হদিস রত্নেশ্বর এবং তাঁর কয়েকজন পোষা ডাকাত দলের সর্দার ছাড়া আর কেউই জানতো না। গৌরহরি যে বসতভিটার গোড়াপত্তন করে গিয়েছিলেন, রত্নেশ্বরের হাত ধরে তার শ্রীবৃদ্ধি হয় বহুলাংশে। পলাশির সেই বৃহদাকার পরিখা বিশিষ্ট দো মহলা বাড়ি, বাড়ির অন্দরমহলে ঢোকার মুখে প্রকান্ড সিংহদুয়ার, বিশালাকৃতির খিলান,নাটমন্দির, গর্ভগৃহ, আম আর গোলাপের বাগানে মেঘাচ্ছন্ন হয়ে থাকা মাইলের পর মাইল সুবিশাল জমি...রত্নেশ্বরের কল্যানে চট্টোপাধ্যায় পরিবারের নাম, যশ, খ্যাতি, বিত্ত গরিমা মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো সেই সুউচ্চ দো মহলা বাড়ির মতোই মানুষের মুখে মুখে ঘুরে বেড়াতো। শোনা যায় চট্টোপাধ্যায় বংশের এক দুঃসম্পর্কিত আত্নীয় মুর্শিদাবাদ থেকে ঘোড়ায় চড়ে পলাশি গ্রামে আসতে গিয়ে কালী মন্দিরের চারিপাশে ঘন বনাঞ্চলের মধ্যে ডাকাত দলের হাতে গিয়ে পড়েন।  শেষমেশ রত্নেশ্বরের বংশধর হিসেবে নিজের পরিচয় দেওয়ায় সে যাত্রায় প্রাণে রক্ষা পান ঐ ব্যক্তি। ডাকাতের এক সর্দার তাকে নিজে পৌঁছে দেয় পলাশির বাড়িতে। 
পরবর্তী বংশধর যোগেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় ছিলেন তখনকার দিনের এল.এম.এফ ডাক্তার। ঘোড়ায় চড়ে প্র্যাকটিস করতে যেতেন। সেকালের কাঁচরাপাড়ার বেশিরভাগটা জুড়েই  ছিল ঘন বনাঞ্চল..জলাভূমি...কুলকুল করে বয়ে যেত যমুনা নদী...আজ যে নদী পলিমাটি আর চড়া পড়ে মথুরা বিলে পরিণত হয়েছে। ছিল রেললাইন, রেলকারখানা, পূর্বপুরুষের তৈরি ডাকাতে কালী মন্দির আর তার সংলগ্ন কাটাপুকুর...যে জলে কত মানুষের গলা কেটে ফেলে রেখে দিত ডাকাতেরা...সেই শ্বাপদ সংকুল অরন্যাবৃত পথ ধরে ঘোড়ার গাড়ি করে চিকিৎসা করতে যেতেন আমার পিতামহ যোগেন্দ্রনাথ। এতক্ষন ধরে যেসব কাহিনি বলে গেলাম এসবই আমার জ্যাঠামশাইয়ের মুখে শোনা। কিছু কিছু বাবার মুখেও শুনেছি। বাবাও শুনেছিলেন জ্যাঠামশাইয়ের থেকেই। 
বাবার যখন তিন বছর বয়স তখন তাঁর পিতৃবিয়োগ হয়। সেই সময় থেকে সেজো জ্যাঠামশাই বাবার অভিভাবকের দায়িত্ব নেন। যোগেন্দ্রনাথের ছিল পাঁচ সন্তান। দুই  সন্তান আগেই মারা যায়। বাকি তিন সন্তানের মধ্যে সেজো জ্যাঠামশাই খুব ছোট অবস্থায় বাবাকে বিহারের দাড়ভাঙায় নিয়ে যান। 
পলাশির বাড়ির আগের সে জৌলুস তখন আর নেই। ন জ্যাঠামশাই ধার দেনায় বিকিয়ে যাওয়া, মদ্যপান,জুয়াখেলা,  বাঈজী নাচ, ভোগ বিলাসী চরম উচ্ছৃঙ্খল জীবনের পাঁকে পরে শেষ সম্বল হিসেবে পলাশির বাড়ির একটা একটা নবাবি আমলের পুরনো দুষ্প্রাপ্য ইঁট তখন বেচে দিতে শুরু করেছেন। আকাশ ঝাপসা হয়ে থাকা জমি কে জমি সেসব আম,গোলাপের বাগান ন জ্যাঠামশাইয়ের কল্যানে হাত বদল হতে হতে প্রায় শূণ্য হতে বসেছে। 
ঠিক সেইরকম এক পরিস্থিতিতে ক্ষয়ে যাওয়া, নুয়ে পড়া, ভাঙা চোরা, জৌলুসহীন, শ্রী হীন হয়ে পড়া পলাশির সেই ভগ্নপ্রায় বাড়ি থেকে সেজো জ্যাঠামশাই বাবাকে হাত ধরে  নিয়ে চলে গেলেন বিহারে। সেখানে জ্যাঠামশাইয়ের নিজস্ব ব্যবসা ছিল।  জীবনের একটা বিরাট সময় বিহারেই জ্যাঠামশাইয়ের কাছে কেটেছে বাবার। জ্যাঠামশাই লেখাপড়া জানতেন না। লেখাপড়া তেমন একটা ভালোও বাসতেন না। কিন্তু তাঁর জন্মগত কারিগরি মেধা ছিল অসাধারণ। মাথা থেকে নতুন নতুন উদ্ভাবনী ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে কত ব্যবসা ছেড়েছেন আবার কত ব্যবসা নতুন করে গড়েছেন সেসব কাহিনি শুনলে আজকের যুগে জ্যাঠামশাইকে একজন বড় ইঞ্জিনিয়ার ছাড়া আর কিছুই মনে হবে না। সে অর্ডার সাপ্লাইয়ের ব্যবসাই হোক, কিংবা নিজের উদ্যোগে সামান্য পুঁজি নিয়ে দেশলাই কারখানা খোলাই হোক, কিংবা কালোয়াতি ব্যবসাই হোক অথবা দাড় ভাঙার ব্যাবসায়ীদের সঙ্গে একসাথে মিলে মেশিনারি টুলস তৈরির নতুন এক ব্যাবসায়িক উদ্যোগ নেওয়া....সবেতেই যেন জড়িয়ে ছিল জ্যাঠামশাইয়ের সেই অদ্ভুত উদ্ভাবনী প্রতিভা...যা একেবারেই তাঁর সহজাত। হয়তো এই কারণেই নির্দিষ্ট কোনো একটা কাজ কিংবা ব্যাবসায় খুব বেশিদিন টিকে থাকার মানুষ জ্যাঠামশাই ছিলেন না। তাঁর মস্তিষ্ক যেন অবিরত কোনো নতুন কিছুর সন্ধান করে বেড়াতো। 
বিহারের বিভিন্ন জায়গায় কাজের সূত্রে ঘুরে বেড়াতে হত জ্যাঠামশাইকে। বাবাকেও নিয়ে যেতেন সেসব জায়গায় । সেই থেকে বাবা হয়ে গেলেন জ্যাঠামশাইয়ের সর্বক্ষণের সঙ্গী, সহকারী। 
একটু একটু করে জ্যাঠামশাইয়ের সান্নিধ্যে, সাহচর্যে বড় হয়ে উঠলেন বাবা। নিজের ইচ্ছেতে লেখাপড়া করলেন...তারপর স্কুল, কলেজ....চৌত্রিশ সালের বিহারের বিধ্বংসী  ভূমিকম্পের পর বাবা পাকাপাকি ভাবে দাড় ভাঙা ছেড়ে চলে এলেন....তবে পলাশিতে নিজের দেশের বাড়ি নয়...পূর্ব পরিচিত কাঁচরাপাড়ায়। 
পলাশির বাড়ি তখন ভঙ্গুর, প্রায় পরিত্যক্ত এক আবাসস্থল যেন। ন জ্যাঠামশাই তাঁর পরিবার নিয়ে দুটো ছোটো ছোটো ঘরে বসবাস করছেন। বাড়ি সংলগ্ন স্থানে বংশপরম্পরায় প্রাপ্ত কিছু জমি তখনো পড়ে আছে। সেখানে কিছু কিছু করে সবজির চাষ হয়। সবকিছু খুইয়ে ঐ সম্বলটুকু নিয়েই দিন কাটাচ্ছেন ন জ্যাঠামশাই। 
দেশের বাড়ি বাবা আর কখনো ফিরে যান নি। মোক্তারী পাশ করে বারাকপুর কোর্টে চাকরি নিয়ে কাঁচরাপাড়াতেই একদিন পরিবারবর্গ নিয়ে যৎসামান্য উপার্জনের পয়সা জমিয়ে জমি কিনে বাড়ি করে সেটল হলেন বাবা।
 একদিন বি.এল.আর.ও অফিস থেকে একটা চিঠি এলো আমাদের বাড়িতে। পলাশি মাঝিপাড়া মৌজা এলাকায় বাগের খাল সংলগ্ন, শ্রী হরেন চট্টোপাধ্যায় ( ন জ্যাঠামশাইয়ের ভালো নাম) কর্তৃক বেআইনী ভাবে হাত বদল হওয়া বেশ কিছু আবাদি জমি এখনো অবশিষ্ট রয়ে গেছে, যার মূল মালিকানা চট্টোপাধ্যায় পরিবারের চতুর্থ প্রজন্মের কনিষ্ঠতম বংশধর  অতুল কৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়( আমার বাবা) উপযুক্ত প্রমান সহ ওয়ারিশান হিসেবে দাবি করতে পারেন। জরীপ বিভাগের সীদ্ধান্ত অনুযায়ী হস্তান্তরিত হওয়া উক্ত জমি জায়গার ওপর হরেন চট্টোপাধ্যায়ের কোনোরকম অধিকার আজ থেকে অস্বীকৃত বলে গন্য করা হল। 
দ্বিরুক্তি না করে সে চিঠি বাবা ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। বাবার কথায়..' কত অসহায়, আর্ত, সর্বস্বান্ত হয়ে যাওয়া মানুষের হাহাকার জড়িয়ে আছে ঐ জমি জায়গার সাথে....পূর্বপুরুষের ঐ পাপের সম্পত্তি ভোগ দখল করে আমি বেঁচে থাকতে পারবো না....নিজের চেষ্টায় যেটুকু করে উঠতে পেরেছি তাই আমার কাছে অনেক শান্তির...ঠিক যতটুকু শান্তির তিলতিল করে গড়ে তোলা আমার এই ছোট্ট বাড়িখানা...'
সেই থেকে আমরা হয়ে গেলাম রেল স্টেশন সংলগ্ন কাঞ্চনপল্লীর বাসিন্দা। অন্যদিকে সেজো জ্যাঠামশাই নিজের ব্যবসার সূত্রে পাকাপাকি ভাবে দাড়ভাঙাতেই রয়ে গেলেন পরিবার নিয়ে। যদিও পলাশির বাড়ির প্রতি তাঁর টান ছিল অবিচ্ছেদ্য। যেরকম অবিচ্ছেদ্য টান ছিল বাবার প্রতি। মাঝে মধ্যে কাঁচরাপাড়ায় এলেই আমাদের বাড়িতে দু এক দিনের জন্য থেকে যেতেন তিনি। পুকুর পাড়ে বসে অনেক রাত অবধি নিজের মনে কালোয়াতি সুরে গান গাইতেন। গলা খারাপ ছিল না তাঁর। বাড়ির পাশের দেহাতি বস্তির অনেকেই জ্যাঠামশাইয়ের ভক্ত হয়ে গিয়েছিল। ভুটিয়ার বিচুলির দোকানের বেঞ্চে মাঝে মাঝেই গিয়ে বসতেন জ্যাঠামশাই। তারাও বড্ড ভালোবাসতো সাদাসিধে মানুষটিকে। দোকানে বসলে চা না খাইয়ে ছাড়তো না। 
কাজে কর্মে এদিকে এলে বাবার সঙ্গে দেখা করে তবেই পলাশির বাড়ি পাড়ি দিতেন জ্যাঠামশাই। ন জ্যাঠামশাই মারা যাবার পর দেশের বাড়িতে তাঁর নিজস্ব ছোট্ট ঘরখানায় একা একা  দিন কয়েক কাটিয়ে ফেরার পথে আবার একবার বাবার সঙ্গে দেখা করে তবে দাড়ভাঙার ট্রেন ধরতেন। জ্যাঠামশাই বলতেন বাবাকে,' হাড়কঙ্কাল বেরোনো  প্লাস্টারখসা দেওয়ালগুলো, খসে পড়া নবাবি যুগের ছোটো ছোটো চৌকোনা লাল ইঁট, শিশুকালের চোরকুঠুরি, তোর যেখানটাতে জন্ম হয়েছিল..সেই ভাঙা পরিত্যক্ত স্যাঁতসেঁতে ঘরখানা... আপন মনে খেলা করার ঐ নড়বড়ে রেলিং ধ্বসে পড়া অবশিষ্ট ছাদটুকু, কারুকার্যময় ভাঙাচোরা জাফরির অবশেষ, গায়ে গায়ে দূরবীনের মতো ছোট ছোট ঘুলঘুলি, ছাদের ভগ্নাবশেষ হয়ে পড়ে  থাকা দুশো বছরের  সেইসব বিখ্যাত সাবেকি চোরা রন্ধ্রপথ....এ মাটিতে পা দিলেই যেন আঁকড়ে ধরে রাখে...ঠিক তোদের মতো...।'
সেই মানুষ ঝড় বাদলের দিনে আমাদের বাড়ি একটিবার না এসে সামনে দিয়ে চলে যাবেন.... মেনে নিতে পারিনি সেদিন কিছুতেই।

 কপালে দুশ্চিন্তা আর অজানা আশংকার ভাঁজ নিয়ে পরের দিন দুপুর বেলা পলাশির বাড়ি থেকে ঘুরে এসে বাবা খবর দিলেন, জ্যাঠামশাই সেখানে যান নি...। 
' তবে কি হাওয়ায় উবে গেল মানুষটা..!'
 বলতে গিয়ে বাবার কন্ঠ রূদ্ধ হয়ে আসে।
ভেতরকার উদ্বিগ্নতা যেন ঘন কালো ধোঁয়ার মতো গ্রাস করতে শুরু করেছে মনকে। ঝড়ের বিকেলে  যাঁকে যেতে দেখলাম তাঁর সঙ্গে আজকের ঘটনার কোথাও কি সম্পর্ক লুকিয়ে থাকতে পারে? ভেবেও তল পেলাম না! 
সামনের রোয়াকে, বৈঠক খানার খিড়কি দরজা দিয়ে একরাশ রৌদ্রজ্বল আলো এসে খেলা করছে। মেঘমুক্ত আকাশের কোল ঘেঁষে কি পাখি উড়ে চলেছে....চিলেকোঠার কার্ণিশ ভাঙা ছাদের ফাটলে কোথায় ঘুঘুর ডাক....
বাবার চোখের উদাস দৃষ্টি ঘুরে বেড়ায় আকাশের প্রান্তসীমায় যেন। অস্ফুট স্বরে বলেন,' শেষ যেবার দাদার সঙ্গে দেখা হয়েছিল বৌদি তার কয়েকমাস আগে গত হয়েছেন। ঐ রোয়াকে বসে শেষ বিকেলের আলোয় তামাক খেতে খেতে ভারি অদ্ভুত কয়েকটা কথা বলেছিলেন দাদা, যা এর আগে কোনোদিনও বলেন নি..." ভারত বর্ষের অনেক জায়গাতেই তো ঘুরে বেড়ালাম কাজের তাগিদে, পয়সা রোজগারের তাগিদে....যত দিন যাচ্ছে কিরকম একটা অদ্ভুত নিরাসক্ততা চলে আসছে বুঝলি....এই ঘর বাড়ি, বিষয় আশয়...কী হবে এসব দিয়ে...গায়ত্রী         (জ্যাঠামশাইয়ের স্ত্রী) তো আমাকে একা করে দিয়ে নিজেই চলে গেল....মেয়ে দুটোর বিয়ে দিয়ে দিয়েছি...ওরা সব সুখে ছেলে মেয়ে নিয়ে সংসার করছে...ভালো আছে, এটুকুই তো চাওয়ার...এছাড়া আর তো নতুন কিছু পাওয়ার নেই জীবনে...এবার বানপ্রস্থ খোঁজার পালা...একটা বয়সে মানুষকে খুঁজে নিতে হয়....নইলে কষ্ট বাড়ে, বুঝলি না..."
বলতে বলতে আপন মনে চোখ বন্ধ করে মীরার ভজন গেয়ে ওঠেন দাদা। প্রেম, বিরহ, দুঃখ সব যেন ঝরে পড়ছিল সেদিন....গানের মধ্যে নাকি দাদার অন্তস্থল থেকে তা আমি বলতে পারবো না। তামাকের সেই কুন্ডলীপাকানো ধোঁয়াগুলো যেন আজও উড়ে বেড়াচ্ছে আমার চোখের সামনে...এলোমেলো, বিক্ষিপ্ত অবয়ব হয়ে নিরুদ্দেশের পথে....একটা মানুষ কোথায় যে চলে গেল...!'
উত্তর মেলেনি আর।
............................................. 
অলঙ্করণ :-  প্রিয়াঙ্কা সরকার