শিশুসাহিত্য লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
শিশুসাহিত্য লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

উন্মুক্ত স্বর্গদ্বার - শংকর ব্রহ্ম

 

উন্মুক্ত স্বর্গদ্বার

শংকর ব্রহ্ম

 




প্রায় তিন'শ বছর আগে অচিনপুরে এক নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ থাকতেন।তা'র নিজের বলে কেউ ছিল না।নগরের কারও কোন বিপদ আপদ দেখলে তিনি অস্থির হয়ে পড়তেন।তা'কে সকলেই খুব ভালবাসত।

   প্রচন্ড এক শীতের রাতে তার বাড়িতে পাঁচ জন অতিথি এলেন।তারা রাতটা সেখানে কাটাতে চাইলেন।ব্রাহ্মণ তাদের ভিতরে নিয়ে গেলেন।বললেন,আপনারা বিশ্রাম করুন,আপনাদের খাওয়ার ব্যবস্থা করছি।বলে তিনি চিন্তিত হয়ে পড়লেন, তার ঘরে তো পাঁচজনকে খেতে দেবার মতো কিছু নেই।পাঁকশালায় ঢুকে তার বিস্ময়ের অন্ত রইল না।হাঁড়ি ভরা খাবার।তা দিয়েই তিনি অতিথিদের সেবা করলেন।

       পরেরদিন সকালে অতিথিরা বিদায় নিতে চাইলেন।তাদের মধ্যে একজন জানতে চাইল, জানেন আমরা কা'রা?

ব্রাহ্মন বললেন,জানি না,তবে আপনারা সাধারণ কেউ নন।

- হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন।আমরা দেবতা, আপনার উপর খুব খুশি হয়েছি।

আমরা কার্তিক গনেশ বিষ্ণু শিব ব্রহ্মা।

আপনি একটি বর ব্রহ্মার কাছে চেয়ে নিন।

ব্রহ্মা বললেন, 'হে প্রভু আমার বসার যে টুলটি আছে, ওটাতে কেউ বসলে যেন আমি না বলা পর্যন্ত সে না উঠতে পারে।'

- তথাস্তু।

কার্তিত বলল,আপনি এটা কি বর চাইলেন? যান আবার বিষ্ণুর কাছে গিয়ে অন্যরকম বর চান।

ব্রাহ্মণ বিষ্ণুর কাছে এসে বললেন,

'হে প্রভু,আমার বাড়িতে যে আম গাছটা আছে,ওটাতে কেউ উঠলে যেন,আমি না বলা পর্যন্ত নামতে না পারে।'

বিষ্ণু বললেন, তথাস্তু।

বর চেয়ে ফিরে এলে, গনেশ রেগে বলল, আপনি আবার এটা কি বর চাইলেন?

যান এবার শিবের কাছে গিয়ে এমন কিছু বর চান,যাতে আপনার মঙ্গল হয়।

ব্রাহ্মণ শিবের কাছে এসে বললেন, 'হে প্রভু আমি যেন দাবা খেলায় কখনও কারও কাছে না হারি।'

শিব বললেন, তথাস্তু।

ব্রাহ্মণের এই বর চাওয়া দেখে, কার্তিক গনেশ খুব বিরক্ত হলেন।কোথায় নিজের মঙ্গলের জন্য কিছু চাইবেন,তা না করে হাবিজাবি বর চাইলেন ব্রাহ্মণ।তারা ব্রাহ্মণ কে বললেন, আপনি খুবই ভাল মানুষ, তবে বড্ড বোকা।

বলে তারা সকলে বিদায় নিলেন।


        তারপর বহুদিন কেটে গেছে।ব্রাহ্মণের বয়স যখন আশি, হেমন্তের এক পাতাঝরা রাতে, তার দরজায় কে কড়া নাড়ল।ব্রাহ্মণ দরজা খুলে দেখেন,সামনে কালো কদাকার কুৎসিত একজন দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে।

ব্রাহ্মণ বলল,কি চাই?

- আমি যমদূত,আপনার জীবনের মেয়াদ শেষ, আপনাকে নিয়ে যেতে এসেছি।

ব্রাহ্মণ বললেন, বেশ আমি প্রস্তুত হয়ে আসি, আপনি এই টুলে ততক্ষণ বিশ্রাম করুন।

যমদূত বলল, ঠিক আছে, আপনি তাড়াতাড়ি করুন।

ব্রাহ্মণ একটু মুচকি হেসে বললেন, বেশ।

একটু পরেই ভাল জামা কাপড় পরে বেরিয়ে এসে বললেন, চলুন তবে।

যমদূত যেই টুল থেকে উঠতে গেল, কিছুতেই পারল না।

সে খুব রেগে গিয়ে বলল, এ আপনি কি করেছেন?

ব্রাহ্মণ হেসে বললেন, ওটা মন্ত্রপূত টুল।

আমি না বলা পর্যন্ত উঠতে পারবেন না।

রাগে দুঃখে যমদূত বলল, আপনি কি চান?

- আগামী একশ' বছর আপনি আমার ধারে কাছে আসবেন না।

- ঠিক আছে, বলে যমদূত বিদায় নিল।

একশ' বছর পর আবার যমদূত এসে হাজির হল।বলল,আপনি তাড়াতাড়ি প্রস্তুত হয়ে নিন,আমি অপেক্ষা করছি।

- বেশ, আপনি ততক্ষণ বরং গাছের কয়েকটা আম খান,আমি তো চলেই যাব, কে আর এ'সব খাবে?

যমদূত দেখলেন,গাছে আমগুলি পেকে সিঁদুরে রঙ লেগেছে।সে লোভে পড়ে গাছে উঠে কয়েকট আম পেড়ে খেয়ে দেখলেন, 

অপূর্ব স্বাদ,গন্ধে মনটা ভরে যাচ্ছে।

একটু পরেই ব্রাহ্মণ এসে বললেন, চলুন এবার।

যমদূত গাছের থেকে আর নামতে পারে না।সে রাগে দাঁত কিড়মিড় করে বলে উঠল, কি করেছেন আবার?

ব্রাহ্মণ হেসে বলল,এটা মন্ত্রপূত গাছ,আমি না বলা পর্যন্ত নামতে পারবেন না।

যমদূত রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলল,কি চান আপন?

- একশ' বছর যেন আপনার মুখ দেখতে না হয় আমায়।

যমদূত ঠিক আছে বলে, রাগে দুঃখে বিদায় নিলেন।

      একশ' বছর পর আবার যমদূত এসে হাজির।এবার সে সাবধান ও সতর্ক খুব।

এবার সে কোন ভুল করবে না আর।

     ব্রাহ্মণ দাবার ছক আর ঘুটিগুলো নিয়ে বেরিয়ে এলেন।পিছে ফিরে বাড়িটার দিকে তাকালেন।প্রায় তিনশ' বছর এই বাড়িটার সাথে তার নাড়ির টান।বড় মায়াটান অনুভব করলেন,বিষন্ন আবেগ তাকে গ্রাস করল।

     যমদূত দাবার ছকটা দেখিয়ে বললেন, কি ব্যাপার এটা সঙ্গে নিয়েছেন কেন?

- অনেক দূরের পথ,ক্লান্ত হয়ে গেলে, গাছের ছায়ায় জিরিয়ে, একহাত দাবা খেলে নেওয়া যাবে।

যমদূত বলল,আমি তো কোন বাজি ছাড়া দাবা খেলি না।

ব্রাহ্মণ বলল,বেশ তবে তাই হবে।কি বাজি?

যমদূত উপহাসের সুরে বলল,আমি যদি জিতি তবে তোমার আত্মাটা আমাকে দিতে হবে।

ব্রাহ্মণ বললেন,আর যদি আমি জিতি?

- আপনি যা চাইবেন,তাই পাবেন।

- আমাকে নরক থেকে একশ' আত্মা এনে দিতে হবে।

যমদূত ব্যাঙ্গের সুরে বলল,বেশ তাই হবে।

তার আত্মবিশ্বাস উপচে পড়ছিল,তার চেয়ে দক্ষ আর কেউ নেই যে তাকে হারাতে পরে না দাবা খেলায়।

ব্রাহ্মণের কাছে ছিল,শিবের দেওয়া বর।

প্রথমবার যমদূত কিছু বোঝার আগেই হেরে গেল।একশ' আত্মা যমালয় থেকে ছাড়া পেল।আবার খেলা শুরু হল।আবারও হারলেন।আরও একশ' আত্মা ছাড়া পেল।যমদূত যত খেলায় হেরে যেতে লাগল,তত তার রোখ আরও মনে চেপে বসল।এইভাবে হারার পর আর দেবার মতো কোন আত্মা সেখানে রইল না। যমালয় সম্পূর্ণ খালি হয়ে গেল।

ব্রাহ্মণ বলল,তবে এখানেই আমাদের যাত্রা শেষ।যমদূত কোন উত্তর দিল না।

 

          ব্রাহ্মণ সব আত্মা নিয়ে এবার চলল স্বর্গের দিকে।স্বর্গের দ্বারে এসে পৌঁছাতেই দ্বাররক্ষী আটকালো তাকে।

ব্রাহ্মণ নিজের পরিচয় দিলেন।সব শুনে দ্বাররক্ষী বলল,ঠিক আছে,এতজনকে নিয়ে তো আপনি ঢুকতে পারবেন না।

আপনি একা ঢুকতে পারেন।

ব্রাহ্মণ বললেন,ঠিক আছে।আপনি একবার ব্রহ্মার কাছে একটা কথা জিজ্ঞাসা করে আসুন।

দ্বাররক্ষী বললেন, কি?

ব্রাহ্মণ বললেন,এক শীতের রাতে তিনি তার চার সঙ্গী নিয়ে আমার বাড়িতে এসেছিলেন,আমি তাদের আপ্যায়ণের কোন ত্রুটি করিনি,আজ আমি আমার সাথীদের নিয়ে এসেছি বলে,আমাকে একা স্বর্গে ঢুকতে হবে,তা'হলে কি আমি মনে করব,আমি ঈশ্বরের চেয়েও মহান?

দ্বাররক্ষী বলল,ঠিক আছে আমি এক্ষুনি যাচ্ছি।

কিছুক্ষণ পর দ্বাররক্ষী ফিরে এসে স্বর্গের দ্বার খুলে দিয়ে,গম্ভীর স্বরে বললেন,প্রভু আপনাদের সকলকেই ঢুকতে বলেছেন।

ব্রাহ্মণ নিঃস্বার্থ বুদ্ধির জোরে সকলকে নিয়ে সানন্দে স্বর্গে ঢুকলেন।


----------------------------------


অলঙ্করণ :- প্রিয়াঙ্কা সরকার  

এ ভূত সে ভূত নয় - তপাশ্রী ব্যানার্জী

 

এ ভূত সে ভূত নয়

 তপাশ্রী ব্যানার্জী
 

     ছোটবেলা থেকেই আমি ঠাকুমা দাদুর কাছে অনেক গল্প শুনেছি, যেমন পরী,রাজপুত্র আর রাজা রাণীর কত কী ! কিন্তু ভূতের গল্প বলতে বললেই দাদু বলতো ,"না বলবো না ,শুনলে তোদের ভয় লাগবে |" আমরা বলতাম ,"কেন ! ভূত কী আছে নাকী যে ভয় পাব ?" শুনে দাদু বলতো ,"আমি তো দেখেছি ! কী করে বলবো ,নেই | তবে এখানে মানে কোলকাতায় থাকে না মনে হয় ! কারণ এত লোকজন আর চারিদিকে যা বাড়িঘর ভর্তি !" এবার ঠাকুমা শুনে তো খুব রেগে গিয়ে দাদুকে বকতে লাগল ,"ওসব কথা ছেলেপুলেদের বললে এখন রাতদুপুরে ভয় পাবে ,তারপর জ্বরটর না এসে যায় |" একথা শুনে আমরা দুই ভাইবোন আরও উৎসাহের সঙ্গে দাদুকে বলতে লাগলাম ,"বলোই না দাদু ,দেখি আমরা ভয় পাই কিনা !" তবে তখন আর শোনা হল না বটে ,দাদু কথা দিল ; একদিন ঠাকুমা না থাকলে আমাদের বলবে | অগত্যা আমরাও অপেক্ষারত রইলাম |

     এরপর বর্ষাকালে একদিন খুব বৃষ্টির জন্য স্কুল বন্ধ থাকায় আমরা ভাইবোন বাড়িতে | ঠাকুমাও সেদিন রান্নাবান্না নিয়ে ব্যস্ত দেখলাম ,সেই সুযোগে দাদুকে নাছোড়বান্দা হয়ে ধরলাম ,আজ বলতেই হবে | অন্যদিন স্কুল থেকে ফিরতে ফিরতে বিকেল হয়ে যায় ,তারপর সন্ধ্যেবেলা যথারীতি স্কুলের পড়া থাকতো ,আর তা চলতো রাত পর্যন্ত | এরপর দাদু অভ্যাসবশতঃ তাড়াতাড়ি নিদ্রা দিতো ,তাই আর হয়ে উঠতো না গল্প শোনা | আজ যখন সুযোগ পাওয়া গেছে কোন মতে তা ছাড়ার নয় | এদিকে দাদুও ভয় পাচ্ছে ,যে ঠাকুমা পাছে ধরে না ফেলে | তাই আমরা ছাদের চিলেকোঠার ঘরে গিয়ে শুনবো বললাম | কিন্তু দাদু বেশি সিঁড়ি উঠতে চাইতো না বয়স হয়েছে বলে ,তবুও আজ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাদু রাজী হলো আমাদের কথামত |

     এরপর আমরা ছাদে খেলা করবো ,আর দাদু আমাদের পাহারা দেবে যাতে উঁকি ঝুঁকি দিয়ে পড়ে না যাই - এই ফরমাশ মত বিল পেশ হলো ঠাকুমার কাছে | আর পাশ হলো ঘন্টাখানেকের জন্য | কেননা একে বৃষ্টি হচ্ছে ,ছাদ তাতে পিছল হয়ে গেছে | যদিও আমরা চিলেকোঠা ঘরে থাকবো বললাম ,বাইরে বেরোব না | "যথাআজ্ঞা" বলে উপরে উঠলাম | এবার শুরু করলো দাদু গল্প বলা | আসলে দাদু পূর্ববঙ্গের কুমিল্লা জেলার লোক ছিলেন | আর ঠাকুমা ছিলেন ঢাকা জেলার ,ওখানের মহিলাদের রান্নার সুখ্যাতি সারা বাংলাদেশের লোকের মুখেমুখে | দাদুর বাড়ি ছিল মেঘনা নদীর তীরে আর ঠাকুমার বাড়ি ছিল পদ্মা নদীর তীরে - গল্পে শোনা | বাংলাদেশের দুই বিখ্যাত নদীর কথা সবজনজ্ঞাত আর নদীর মাছ ও ছিল তেমনই খ্যাত | এছাড়া ইতিউতি পুকুর খালবিল তো ছিলই | তাই দাদু খুব খেতে ভালোবাসত ,সে সময় জিনিস ছিল সস্তা আর খাবারের স্বাদ ছিল একেবারে অনবদ্য | গ্রামের বাড়িতে জমিতে চাষ করা সবজি আর পুকুর ,নদীর থেকে জালে বা ছিপে তোলা মাছ আসতো প্রচুর | দোকান বাজার বলে তো কিছুই ছিল না তেমন ,যা ছিল একমাএ হাট ,তাও সপ্তাহে যেদিন বসতো ,সেখান থেকে যার যা লাগতো এনে গচ্ছিত রাখতে হতো ঘরে | কিন্তু যারা খেতে ভালবাসতো তাদের কি আর চলে একটু ভাল মন্দ না হলে ! তাই মাঝে মাঝে হাট থেকে এটা ওটা নিয়ে আসতো দাদু খাওয়ার জন্য ,যা রান্না করতে হতো ঠাকুমাকে | যেহেতু তখন অত গাড়ি ছিল না ,তাই হাঁটা পথেই ছিল বেশিরভাগ চলাফেরা |

     বর্ষাকালে মাঝে মাঝে প্রায় টানা বৃষ্টি চলতো | এমন একদিন হাটবারে বৃষ্টি হচ্ছে ,যদিও মাঝে মাঝে থামছে আবার হচ্ছে ,আর তাতে পথঘাট হয়েছে জলে থৈ থৈ | কাজেই কেউ আর বাড়ির বাইরে বের হচ্ছে না বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া | কিন্তু সেদিন হাট বার বলে কিছু দরকার হলে তাকে তো বের হতেই হবে ,যদিও হাটে সেদিন বেশি পসার হবে না জলের জন্য | আর বর্ষাকাল মানেই ইলিশ মাছ ,তার লোভ কি আর ছাড়া যায় ! বিশেষ করে যারা ভোজনরসিক ! এদিকে এত জল জমেছে যা ,সব দিক দিয়ে যাওয়াও যাবে না ,আর ঠাকুমা তাই ঘরের যা ছিল তাই দিয়েই কদিন চালিয়ে নিচ্ছে | বেশি জলে তো জাল ফেলাও যায় না পুকুরে ,তাই মাছ ছাড়াই খাওয়া চলছে | দাদুর হয়েছে শিয়রে সংক্রান্তি | যদিও মেঘ ডাকলে নাকী উঠোনে কই মাছ লাফিয়ে চলে আসতো ,তা ঝুড়ি দিয়ে ধরে নিত | সেটা দৈবাৎ হলে হয়। দাদুর হুঁকোর তামাক শেষ ,তাই সব ভাবনা ফেলে ওটা আনতে হাটে যেতে হবে বলে বেরিয়ে গেল |

      চারিদিক জলমগ্ন ,তাই পথঘাট জনশূন্য ,ওদিকে একটা বাগানের পথ আছে কদাচি কেউ কেউ যায় দরকার পরলে ,নচেৎ নয় | যদিও পথটা বেশ দীর্ঘ কিন্তু বাগান থাকায় বেশ উঁচু, তাই একটু জল কম জমে | দাদু তাই সেই পথটাই ধরলেন | বাগানে প্রায় শ-খানেক আম কাঁঠালের গাছ তাতে চারদিক ঘেরা আর মাঝখান দিয়ে এঁকেবেঁকে সাপের মতো লম্বা লম্বা পথ চলে গেছে দূরে | পাতার ঘনত্বের জন্য আর মেঘলা আকাশ এই দুয়ের মেলবন্ধনে পথ হয়েছে বেশ অন্ধকারাচ্ছন্ন | ঘড়ির সময় না জানলে সেটা দিনেরবেলা বলে বোঝা বেশ শক্ত | বেশ কিছুটা পথ যেতেই দাদু লক্ষ্য করলো কে যেন তার পিছু নিচ্ছে ,কিন্তু বর্ষার জলে আর পায়ের ছপাৎ ছপাৎ আওয়াজে মনে করলো বুঝি নিজে ভুল ভাবছে | কেননা পথটাও বেশি স্পষ্ট নয় ,ভেবেছিল এদিক দিয়ে গেলে তাড়াতাড়ি হাটে পৌছানো যাবে ,আবার ফিরতে হবে তাড়াতাড়ি ,মানে কখন বৃষ্টি শুরু হবে ,তাই আর কি | এ পথে দিনের বেলা হলেও খুব একটা মানুষ ঢোকে না, কারণ এই বাগানের পথ শেষ হলে শুরু হবে আরও একটা বাগান ,তার ওপর দিয়ে গিয়ে তবেই হাটের পথটি পাবে |

     পথটি আছে বট অশ্বত্থ আর বেশ কয়েকটি পাকুড় শিমূল গাছে ভরা | আর আছে একটা বিশাল তেঁতুল গাছ ,তাতে বড় বড় ছড়া ভরা তেঁতুল পেকে মাটিতে পড়ে থাকলেও কেউ বড় একটা তুলতে আসে না | কি জানি সবাই বলে ,এই গাছে নাকী পেত্নীর বাসা | তাই পারতপক্ষে এ পথে মানুষের পা পড়ে না বললেই চলে | আর আজ দাদুকে যেতে হবে সেই পথ ধরেই ,কেননা ঢুকে যখন পরেছে এখন আর উপায় নেই | এদিকে আমরা তো জড়োসড়ো হয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলতে লাগলাম ,"ও দাদু তুমি কি পেত্নীকে দেখেছো নাকী !" যেই না বলা ,অমনি দাদু বলল ,"দেখলি ভয় পাচ্ছিস তো দিদিভাই !এই জন্য বলি শুনতে হবে না | অন্য গল্প বলি |" অমনি ভাই আমার চেয়ে দু বছরের ছোট হলেও বেশ সাহসী ছিল ,তক্ষনি বলে উঠলো ,"না দাদু আমি ভয় পাচ্ছি না ! বলো শুনবো |" আবার গল্প শুরু হলো--এরপর দাদু কি আর করবে যেহেতু ঢুকে পড়েছে ,তাই জল কম থাকায় এই পথ দিয়েই যাবে বলে এগিয়ে গেল | আবার শুনতে পেল সেই পায়ের আওয়াজ ,মনে হচ্ছে কেউ যেন পিছু পিছু হাঁটছে | মন শক্ত করে ঠাকুরের নাম স্মরণ করতে করতে এগিয়ে গেল | এবার তেঁতুল গাছটার কাছে যেতেই ,শুনতে পাচ্ছে, কে যেন হাসছে ! কি আর করবে ,এবার আরও জোর লাগিয়ে এগিয়ে গেল ,যদিও সেদিন একটু ভয় পাচ্ছিল বটে | লোকমুখে শুনেছিল , ঐ তেঁতুল গাছটায় একটা পেত্নী থাকে ,তবে কাউকে কোনদিন তেমন কোন ক্ষতি করে নি | যদিও এর আগে চাক্ষুস করার সৌভাগ্য হয় নি দাদুর ,ভাবল আজই তবে প্রথমদিন | মনে মনে ভাবল ,ফেরার সময় অন্য পথ ধরে ফিরবে |

      এরপর কি আর করা ,ঠাকুরের নাম জপতে জপতে বেশ জোরে জোরে বাকী পথটাও এগিয়ে গিয়ে হাটের পথ ধরল | ততক্ষণে দু একজন লোকের দেখা পেয়েও গেছেন | যাক্ মনে মনে ভাবলেন ,এখনকার মতো ফাঁড়া কেটেছে | এবার হাটে গিয়ে হল একটা মিরাক্কেল ,যেহেতু জলের কারণে লোকজন কম ,তাই বিক্রীবাট্টাও কম ,এদিকে ভয় আবার কখন বৃষ্টি নামবে ,তাই ইলিশের জোগান থাকলেও ক্রেতার অভাবে সেদিন প্রায় অর্ধেক দাম পড়েছে অন্যদিনের তুলনায় | দাদু আর লোভ সম্বরণ করতে না পেরে ,বড় বড় দুখানা ইলিশ কিনে নিলেন | কিন্তু পকেটে পয়সায় টান ধরলো এমন ,যার জন্য আর অন্য কিছুই নিলেন না | দু-হাতে দুখানি ইলিশ ঝোলাতে ঝোলাতে বাড়ি আনবে ভেবে খুব উৎফুল্ল হয়ে উঠল | এমন সময় বাড়ি ফেরার কথা ভাবতেই ,দাদু একটু আতঙ্কিত হয়ে পড়লো |

     কিভাবে ফিরবেন ,অন্য পথ ধরে ! তা আরও খানিক দূর হবে ,সেখানে কতো না জল হয়েছে ! ফিরতে না সন্ধ্যে হয়ে যায় -- এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ পেছন থেকে একজন এসে বলে উঠলো ,"কিরে যোগেশ ,ভালই তো মাছ দুখানা নিয়েছিস ,তা কত আনা পড়ল ?" একথা শুনে, দাদু পিছন ফিরে দেখে তার বন্ধু মহেম ! দেখে যেন দাদু সম্বিত ফিরে পেল | 'এরপর সেও ফিরবে হাটের কেনাকাটা হয়ে গেছে'--শুনে একসঙ্গে রওনা দিল ,আর কিছুটা এগোতেই দাদু বলল বাগানের পথে না গিয়ে অন্য পথে যাবে | কিন্তু মহেম দাদুর বাড়ি বাগানের পথ দিয়ে গেলে আগে পরবে বলে ,সে ঐ পথেই ফিরতে চাইল | যদিও সে পেত্নীর কথাটা জানতো ,তবে বলল "দুজন আছি তো ,চল না !দেখি ,পেত্নী কি করে !" এই বলে হাঁটা লাগালো দুজনে | ক্রমে বাগানের পথ চলতে চলতে বেশ কিছুটা গিয়ে একটা বাঁক নিলেই মহেমে দাদুর বাড়ি কাছেই পড়বে | আর সেখানে জলটাও বেশ কম থাকায় সে বললেন ,"আমি যাই যোগেশ, ওদিক দিয়ে ,আর অনেকটা তো এসে পরেছি ,তুই পারবি তো একলা যেতে !" দাদু কি আর বলবে ,অগত্যা বলেই দিল ,"ঠিক আছে |"

     এরপর একা একাই হাঁটতে লাগল ,সেই বাগানের পথ ধরে | যদিও ততক্ষণে তেঁতুল গাছের পথটা ফেলে রেখে এসে পড়েছে সেই আম কাঁঠালের বাগানের পথে | হঠাৎ একটা সুন্দর গন্ধ অনুভব করল দাদু ,আর মনে মনে ভাবল সামনে বুঝি কোন চাঁপা ফুলের গাছ রয়েছে ,তার থেকে এমন সুমিষ্ট গন্ধ ভেসে আসছে | তারপর আর একটু এগোতেই দাদু শুনতে পেলো কে যেন তার নাম ধরে ডাকছে আর বলছে," কিরে মাছগুলো তো বেশ কিনলি ,তবে কি একাই খাবি !" দাদু এবার বেশ বুঝতে পারল ,কেউ ওনার পিছু নিয়েছে -- তাই আর ভয় করে লাভ নেই ,এখন মনে জোর নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে | কোন উওর না দিয়ে কিছুদূর যেতেই কে আবার বলে উঠল," কি রে ! কত দিয়ে কিনলি মাছগুলো ,বেশ দেখতে হয়েছে |" এবারও দাদু কোন উওর দিল না ,আর বেশ বুঝতে পারল ,ঐ পেত্নীই তার পিছু নিয়েছে | যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাড়ি যেতে পারলে বাঁচে এযাত্রায় আর কী | এদিকে পথটাও বেশ লম্বা ,শেষ হতে এখনো বেশ কিছুটা বাকি | আবার কাউকে ডাকবে তারও উপায় নেই ,কারণ বাড়িঘর কাছাকাছি নেই বললেই চলে | যা আছে তাও অনেক দূরে ,কাজেই ডাকলে কোন সারা পাওয়ার সম্ভাবনা নেই | বিপদ বুঝে দাদু নিজেকে একাই রক্ষা করতে হবে ভেবে ,যতটা সম্ভব জোর লাগিয়ে হাঁটতে লাগল |

      এদিকে মাছগুলোও বেশ বড় আর ভারী ,তাই পিছলে যাচ্ছে ,এতোটা পথ যেতে হবে আগে বুঝতে পারে নি | আর ঠাকুমার ভয়ে তাড়াতাড়ি বেরোতে গিয়ে ব্যাগ বা ঝোলা কিছুই নিয়ে আসতে পারে নি | তাছাড়া ভাবতেই পারে নি আজ এমন সুযোগ পাবে যে দু -দুটো ইলিশ কিনতে পারবে | মনে মনে ভাবল ,"অতি লোভে তাঁতী নষ্ট --- যারে কয়।" আর ভাবতে লাগল ,এবার প্রাণের দায়ে মাছগুলো না পেত্নীর পেটে যায় ! আর কী ! যেমনি ভাবা ! অমনি সামনে কি একটা পড়ে ছিল ,ঠিক ঠাওর করতে না পেরে ,দাদু হোঁচট খেয়ে পড়ে যেতে যেতে নিজেকে সামলালো ঠিকই ,কিন্তু মাছগুলো গেল হাত থেকে পড়ে | আর মাছ গুলো যদি জলে ভেসে যায় দূরে ,তাই ভেবে দাদু তড়িঘড়ি সে দুটিকে খপাৎ করে ধরতে গিয়ে নিজের ধুতির কিছুটা অংশ দিল ভিজিয়ে | আর তা দেখে হি হি করে বিদ্যুতের গতিতে কে যেন হেসে উঠল | এবার দাদুর খুব রাগ হল | ভাবল যদি সামনে পেতাম তাহলে কষিয়ে দিতাম দু-চারটে গালে বসিয়ে | তা তো আর হবার নয় ,তাই মনের আশা মনেই রেখে ,আবার এগিয়ে চলল ,জল কেটে কেটে বাড়ির দিকে |

     এদিকে মেঘলা দিন বলে সূর্যের দেখা পাওয়া যাচ্ছে না ,তাই সময়টাও বুঝতে পারছে না | ভাবল বুঝি বাড়ি ফিরতে আজ সন্ধ্যে গড়িয়ে যাবে ,আর ঠাকুমা এই মাছ দেখে কি না কুরুক্ষেএ শুরু করবে | ভাবনাই সার হল ,ঘড়ি সঙ্গে না থাকায় সময়টাও বোঝা গেল না | এখন মাছগুলোও কাউকে দিতে পারবে না যে রক্ষা পাবে | কাজেই যা আছে কপালে দেখা যাবে ,এই ভেবে এগোতে লাগল বাড়ির দিকে | এবার এগোতেই আবছা আলোতে সামনের দিকে কি যেন একটা সাদা মতো ঝুলছে দেখে কৌতুহল হল ,কোন কাপড় কি উড়ে গাছের ওপর এসে পড়েছে নাকী ! যদিও স্পষ্ট তেমন দেখতে পাচ্ছে না ,আর একটু এগোলে বোঝা যাবে | এদিকে এ পর্যন্ত শুনে আমার তো তখন হাত-পা ঠান্ডা হবার জোগার ,আর ভাই দেখছি আমার গায়ের কাছে এসে বসে আমার হাতটা চেঁপে ধরে রেখেছে | যদিও আমি ভীষণ ভীতু ছিলাম ,ছোট বেলায় ভূতের নামেই ভয় পেতাম | তাই ভাবতে লাগলাম এখন তো দিনের বেলাতেই এই অবস্থা ,আর রাতে না জানি কী হবে আমাদের ! আজ নির্ঘাত একটা কান্ড হবে বাড়িতে ,এই ভেবে মনে মনে ভয় হতে লাগল | ঠাকুমা দাদুকে বারণ করেছিল এ গল্প শোনাতে ,আর যদি তেমন কিছু হয় ,তাহলে বাড়িতে আজ একটা দক্ষযক্ষ বেঁধে যাবে | ভাবলাম ,যা কিছু হয় হোক ! গল্পটা থামানো যাবে না ,শেষটা কি হয় জানতেই হবে | তাই মন শক্ত করে বসে রইলাম দুজনে দাদুর পাশে | আর দাদু যাতে ঘুণাক্ষরেও আমাদের ভয়ের কথা কিছু টের না পায় ,তাই দাদু একটু থামতেই, বলতে লাগলাম ,"তারপর কি হলো দাদু ,বলো !" দাদু বলল ,"ওরে একটু জল খেয়ে নি ,গলা যে শুকিয়ে আসছে ! "

     আসলে দাদু ছিলেন স্বল্পভাষী ,আর গল্প বলতে বেশ বকতে হয় একটানা ,তাই জল খেয়ে নিয়ে বললেন ,"কিরে ভয় লাগছে ,তাহলে আজ থাক এ পর্যন্ত !" আমরা সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলাম দুজনে, - "না ; না ; আজ বলতেই হবে তোমাকে সবটা |" ওদিকে সময় কতো হয়েছে ,তা দেখতে দাদু একবার বাইরে গিয়ে দেখে এলো | তখনকার দিনের মানুষ তো দাদু ,তাই সূর্যের আলোর গতি প্রকৃতি দেখে বুঝতে পারতেন সহজে টাইম কত হয়েছে | যদিও তখন বাইরে বৃষ্টি পড়ছিল অল্প সল্প | আবার কখন নিচের থেকে দুপুরের খাবার জন্য ডাক আসবে ,তা ভেবে দাদু ছট্ পট্ গল্পটা শেষ করতে চাইলো | পাছে ঠাকুমার কাছে না ধরা পরে যান ,তার চিন্তাও রয়েছে | তাই আর দেরী না করে শুরু করলো বলতে | "কোথায় যেন শেষ করেছি ,বলেই --- ও মনে পড়েছে সেই সাদা কাপড়ের মতো কি একটা দেখলাম তাই তো !" আমরা সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলাম ,"হ্যাঁ -- তাই |" --- এবার একটু এগোতেই দাদুর কাছে তা স্পষ্ট হলো ,একজন গাছের মগডালে দুটো পা ঝুলিয়ে বসে আছে ,তবে শরীরটা তেমন দেখা যাচ্ছে না | দাদুকে আবার তার নিচ দিয়েই যেতে হবে ,ভাবল আজ বুঝি পরাণটা এই পেত্নীর হাতে দিতে হবে | এই ছিল কপালে -- শেষে কিনা পেত্নীর খপ্পড়ে পড়া গেল ! মনে মনে ভাবল ,ছেলেবেলা থেকে দাদুও অনেক গল্প শুনেছে ভূতের ,কিন্তু বিশ্বাস করলেও কখনও চাক্ষুষ প্রতক্ষ্য করে নি ,আজ বুঝি সেই দিন এসেছে জীবনে | তাই দেখেও না দেখার ভান করে ,ভাগ্যের উপর প্রাণটা ছেড়ে দিয়ে এগিয়ে চলল জলা পথ ধরে | ভাবল যদি ভগবান সাথ দেয় ,তাহলে আর কিছুটা গেলেই আজকের মতো প্রাণে বেঁচে যান আর কী ! যতটা সম্ভব জোরে চেষ্টা করল এগোতে | আর মাঝে মাঝে শুনতে পাচ্ছিল হি হি করে কে যেন হাসছে ,আর একটু এগিয়ে পিছনে ফিরে দেখলো দূরে দেখা যাচ্ছে পাদুটো তখনও কে যেন গাছের ওপর থেকে দোলাচ্ছে | যদিও ততক্ষণে দাদু অনেকটা পথ এগিয়ে চলে এসেছে বাড়ির কাছে | আর কিছুটা গেলেই বাগানের পথ শেষ হবে ,এই ভেবে যেন গলদঘর্ম অবস্থা থেকে প্রাণে একটু স্বস্তি পেল |

      এরপর আর একটু যেতেই পাশের বাড়ির একজনের সঙ্গে দেখা ,সে বাগানের একদম সামনে থেকে কি যেন তুলতে এসেছে | দূরে ওদিকে কয়েকটি বাচ্চা বাগানের সামনে কি যেন খেলা করছে | আসলে বৃষ্টি যে অনেকক্ষণ বন্ধ আছে ,ঘরে আর কতক্ষণ বন্দি থাকা যায় ! এসব দেখতে দেখতে দাদু বাড়ি পৌঁছালো আর কী | বাড়ি ফিরে দাদু যেন একটু হাঁফাতে লাগলো ,তা দেখে ঠাকুমা কিছুটা ভয় পেল বটে | তবে মাছ দুটো দেখে যেমন রাগ হবার ছিল তেমন কোন প্রভাব দেখালো না - দাদুর হাবভাব দেখে | তড়িঘড়ি ছোট পিসি দাদুকে এক গ্লাস নুন চিনির জল দিয়ে বিশ্রাম নিতে বললো | বেলা দ্বিপ্রহর হয়েছে - মাছগুলোর সদগতি করতে হবে বলে ঠাকুমা উদ্ধত হয়ে পড়লো | কেটেকুটে রাখা ,আবার রান্না করে কিছুটা হলেও পাতে ফেলতে হবে তো ! এতো জলের মধ্যে দিয়ে এতোটা পথ গিয়ে যখন এনেছে ! তাই আর দেরী না করে সেই কাজটা করতে লাগল | ভাবল যা বলার পরে বলবে ,খাওয়া-দাওয়া হয়ে গেলে |

      এদিকে বেলা গড়িয়ে যাবে ,এই ভেবে বড় পিসিকে বললেন উনুনে আর একটু কাঠ গুঁজে দিতে ,যাতে নিভে না যায় | আর ভাবলেন এখনকার মতো কিছুটা ভাজা দিয়েই সারবেন | পরের দিন সর্ষে বাটা আর বেগুন দিয়ে ঝোল যা হয় করবেন | রান্না ঘরটা টালির চালের ছিল ,তাই কাঠের ধোঁয়া বেরোবার জন্য জানালা ছিল | যদিও সবসময় একটা জানালা খোলা থাকে কিন্তু আজ বৃষ্টির জন্য বন্ধ করে রেখেছিল | এখন বেলা হয়ে গেছে আর অন্ধকার হয়েছে বলে বাগানের দিকেরটা ,যেটা দিয়ে দূরে বাগানটা দেখা যায় খানিকটা ,আজ সেটাও খুলে দিতে হল ,কারণ তখন তো ইলেকট্রিক লাইট ছিল না ,যা ছিল কেরোসিনের লম্ফ, কুপী আর প্রদীপের আলো | কেরোসিনের অভাব ছিল যোগানে ,তাই মানুষেরা দিনের আলোয় যতটা কাজ করা যায় ,তা করে রাখতো |

      এদিকে মাছ ভাজতে শুরু করেই ঠাকুমা দেখছে ,কে যেন জানালার সামনে কি একটা ছায়ার মতো আড়াল থেকে দেখছে | প্রথমে অতটা কিছু ভাবল না , কিন্তু ক্রমে ছায়াটা স্পষ্ট হচ্ছে মনে হল | তবু ভাবল গাছের জন্য এমন হতে পারে ,তাই ভেবে কাজে মন দিল | এর পর কে যেন নাকী নাকী সুরে দাদুর নাম ধরে ডাকতে লাগল ,শুনে ঠাকুমা কিছুটা হকচকিয়ে উঠল ,ভাবল এভাবে কে ডাকছে ! আর দরকার পরলে বাড়ির সামনের দিকেই বা কেন গিয়ে ডাকছে না ! এক সময় ছোট পিসিকে ডেকে বলে দিল ,"দেখ তো খুকী ,তোর বাবাকে কে ডাকচ্ছে মনে হচ্ছে !" দাদু এবার কথাটা শুনে মনে ভাবলো ,আবার কি হলো ,বলে বাইরে বেরিয়ে দেখে এলো | কিন্তু কাউকে দেখতে পেলো না | বাধ্য হয়ে ঘরে ফিরে যেতেই আবার ঠাকুমার গলা শুনতে পেলো ,এবার ভাবলেন ,পাঁকঘরে গিয়ে দেখি তো ,ব্যাপারটা কি হয় ! বলে কিছুক্ষণ দাঁড়াতেই লক্ষ্য করলেন একটা ছায়া জানালার ওপারে ঘোরাঘুরি করছে আর মাঝে মাঝে কি যেন নাকী সুরে বলছে | এদিকে গল্প শুনতে শুনতে ভাই দেখলাম চোখ বুঁজে আছে ,মনে হয় ঘুমিয়েই পড়েছে | আর আমি ভয়ে কাচুমাচু মুখ করে উদগ্রীব হয়ে রয়েছি শেষে কি হয় জানার জন্য |

      মাছ যখন প্রায় ভাজা শেষ ,জানালা বন্ধ করতে যাবে ঠাকুমা ,দেখে বন্ধ করতে আর পারছে না | মনে হচ্ছে কে যেন বাইরে থেকে পাল্লাটা চেপে রেখেছে খোলা থাকার জন্য | অনেক টানাটানি করেও যখন কিছু করতে পারল না ,তখন ঠাকুমা তা ছেড়ে দিয়ে ভাজা মাছগুলো নিয়ে ঘরে আসতে যাবে ,দেখে জানালা দিয়ে এই বড় বড় হাত পেতে কে যেন মাছ চাইছে ,আর তা স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে | তাই না দেখে মাছের বাটি ফেলে ঠাকুমা দৌড়ে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করল | এদিকে মাছগুলোর কি হবে ! তা দেখতে দাদু গেল রান্নাঘরে ,গিয়ে দেখে তখনও হাত পেতে আছে জানালার ভিতরে কে যেন ! অগত্যা দাদু দু-পিস মাছ ছুঁড়ে দিল জানালার দিকে | তৎক্ষণাৎ কেউ আর নেই | কোন শব্দও শোনা গেল না আর | এবার ঘরে এসে ঠাকুমার কাছে সব বলল -- হাটে যাওয়া আসার গল্পটা পুরো | ঠাকুমা তা শুনে বলল ,এ মাছ খাবে না আর কাউকে খেতেও দেবে না | দাদুকে নির্ঘাত পেত্নীতে ভর করছে ,ছাড়ফুঁক করাতে হবে |

      এবার দাদু তার বাবার কাছে শোনা এই পেত্নীর গল্পটা বলল ঠাকুমাকে | অনেক বছর আগে বাগানের পাশের পুকুরটায় এখানকার প্রতিবেশি এক বৌ স্নান করতে করতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে |তার মৃগী রোগ ছিল ,জলে এ রোগের ভয় বেশি ,জলে অজ্ঞান হয়ে পড়ায় বাড়ির লোক গিয়ে তুলতে তুলতেই শেষ | তারপর যাইহোক শ্রাদ্ধশান্তি সবই করেছিল তারা ,কিন্তু তার কিছুদিন পর থেকেই এই পেত্নীর আবির্ভাব শুরু হয় | সবাই বলছে নাকী তার কাজকর্ম ঠিকমতো হয় নি তাই এই অবস্থা | কিন্তু ওনার বাড়ির লোক কোনদিন এসব কিছু দেখেনি আর বিশ্বাস করতে চাইতো না | এখন তো ওনারা কেউ আছে কিনা তাই বা কে জানে এই বলে ঠাকুমাকে শেষে বলল ,"এই পেত্নী যদিও কারও তেমন কিছু ক্ষতি করে নি ,তবে মাঝে মাঝে এটা ওটা খেতে চায় | আর বাগানের ঐ তেঁতুল আর পাঁকুড় গাছে নাকী থাকে ,অনেকেই ও পথ দিয়ে গেলে বুঝতে পারে |" এ সব শুনে ঠাকুমা পিসিরা সব তো ততক্ষণে রাম রাম জপতে লেগেছে আর ভয়ে কাঠ হয়ে গেছে |

      এদিকে গল্প শেষ হতেই ,আর এক কান্ড হল ,ভাই ঘুমিয়ে কাঁদা ,কে নামাবে ,দাদুতো পারবে না | অগত্যা মা এসে নিয়ে গেল কোলে করে | তখন ভাই পড়ে ফোরে আর আমি পড়ি সিক্সে ,দুজনে দু-বছরের ছোট বড়ো তাই দু ক্লাস কম বেশি | ওর তখন আট আর আমার দশ ,তাই কোলে ওঠার অভ্যাসটা তখনও মাঝে মাঝে ছিল ওর | এবার নিচে এসে খাওয়া-দাওয়া করে ঘুমিয়ে পড়লাম | আর ঘুম থেকে উঠতেই শুরু হল তান্ডব লীলা | এখনকার ফ্ল্যাটের মতো না বলে বাথরুমটা কাছে ছিল না আমাদের বাড়ির | যেতে হত একটু দূরে মানে কটা ঘর পেরিয়ে একটা করিডোর দিয়ে গিয়ে এক কোণায় | ওখানেই গন্ডগোল ,ভাই ঘুম থেকে উঠল সন্ধ্যেবেলা আর বাথরুমে কিছুতেই যাবে না ,যদিও তখন আমি ভাইকে পাহারা দিয়েই কাজ সারলাম | কিন্তু মাঝরাতে ঘুমের মাঝে ভাই ,"পেত্নী ধরবে গো ,আমায় পেত্নী ধরবে" বলে চিৎকার করে উঠল |

     আর তা শুনে সবাই মাঝরাতে ঘুম থেকে উঠে এক দক্ষযজ্ঞ শুরু করলো -- সবাই ভাইকে ধরে দেখলো ধূম জ্বর উঠেছে | যদিও ভয় যে আমার লাগছিল না তা বলবো না ,তবে ঠাকুমাকে জড়িয়ে শুয়ে পড়েছিলাম বলে অতটা মনে হচ্ছিল না | এদিকে সবাই তখন বলতে লাগল ,আমরা বোধ হয় ছাদে গিয়ে বৃষ্টিতে ভিজেছি | এই বলে দাদুর উপর ঠাকুমা বেশ রাগ দেখাতে লাগল ,অমনি দাদু মুখ ফসকে বলে ফেলল ,"না ; না ; ওরা তো ঘরে আমার কাছে গল্প শুনছিল |" ব্যাস যেই না বলা ,অমনি ঠাকুমা ধরে ফেলল ,নিশ্চয়ই আমরা দাদুর কাছে ভূতের গল্প শুনেছি ,তাই ভয় পেয়ে এসব হয়েছে | তখন দাদু কি আর করবে ,চুপ করে রইল পরিস্থিতি দেখে | তারপর সেই রাতে ঠাকুমা ,অনেক্ষণ ধরে ভাইয়ের কপালে জলপট্টি দিয়ে জ্বর নামালো | আবার পরের কদিন ঠাকুর বাড়ি গিয়ে কি সব ঝাড়ফুঁক করিয়েছিল ভয় কাটানোর জন্য | সবাই অনেক বোঝালো আমাদের ভূত বলে কিছু নেই |তারপর থেকে দাদুও প্রতিজ্ঞা করেছিল ,কোনদিন আমাদের আর ভূতের গল্প বলবে না | পরবর্তীকালে আমি অনেক ভূতের গল্প পড়েছি বা অন্য কাউর থেকে শুনেছি ,কিন্তু দাদুর কাছে শোনা এই গল্পটা আমার কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে আছে আর থাকবে |
 
   ।। সমাপ্ত ।।
 
 
Tapasree Banerjee
 
অলঙ্করণ :- সহিষ্ণু কুড়ি



ব্রহ্মদৈত্যের বিপদ - সংগ্রামী লাহিড়ী

 ব্রহ্মদৈত্যের বিপদ
সংগ্রামী লাহিড়ী

 



হরিশঙ্করের বয়স অল্প, তিনকুলে কেহ নাই, গ্রামে দূরসম্পর্কের মামার বাড়ীতে মানুষ। পিতামাতা নাই, বহুকাল হইল গত হইয়াছেন। মামা-মামী তুতো ভাগিনেয়কে আশ্রয় দিয়াছিলেন নিতান্তই লোকলজ্জায়। অনাথ বালকটিকে দূর দূর করিয়া খেদাইলে গ্রামের আর পাঁচটি লোকে যাহা বলিবে তাহা আর যাহাই হউক, শ্রুতিমধুর হইবে না। অতএব তাঁহারা ঢেঁকি গিলিয়াছিলেন, অর্থাৎ হরিশঙ্করের মোটা ভাত কাপড়ের ব্যবস্থা করিয়াছিলেন, সেইসঙ্গে গ্রামের বিদ্যালয়টিতে ভর্তিও করিয়া দিয়েছিলেন। হরিশঙ্কর দুই মাইল হাঁটিয়া বিদ্যালয়ে যাইতো। পথে যাহার বাগানের ফলপাকুড় যখন যাহা চোখে পড়িত তাহার সদ্ব্যবহার করিত। বিদ্যালয়ে গিয়া সহপাঠীদের সহিত ফুটবল পিটাইতো। মোটের উপর তাহার সময় মন্দ কাটিত না।
 

সমস্যা দেখা দিলো পড়াশোনা লইয়া। হরিশঙ্কর মধ্যমেধার ছাত্র। বিশেষতঃ গণিতশাস্ত্র লইয়া তাহার ভীতির সীমা পরিসীমা ছিল না। ষান্মাসিক ও বাৎসরিক পরীক্ষাগুলি তাহার রাতের ঘুম কাড়িয়া লইত। শয্যায় ঘনঘন পার্শ্ব পরিবর্তন করিয়া বা মেষসংখ্যা গণনা করিয়াও কোনো উপকার হয় না। গণিতশাস্ত্রের বইয়ের পৃষ্ঠা হইতে সংখ্যাগুলি উঠিয়া আসিয়া নৃত্য শুরু করে।
এমনি এক নিদ্রাহীন রজনীতে হরিশঙ্কর শয্যায় টিঁকিতে না পারিয়া বাহিরের খোলা আকাশের তলে আসিয়া দাঁড়াইল। আকাশ অভিমুখে চাহিয়া জানা-অজানা সর্বপ্রকার দেবতার উদ্দেশ্যে পরীক্ষা বৈতরণী পার করিয়া দিবার জন্য আকুল প্রার্থনা নিবেদন করিতে লাগিল। দৈবযোগে সেসময় এক পরোপকারী ব্রহ্মদৈত্য আকাশপথে ভ্রমণ করিতেছিলেন। হরিশঙ্কর তাঁহার নজরে পড়িয়া গেল।
ব্রহ্মদৈত্যটি তাঁহার পূর্বজীবনে গণিতশাস্ত্রজ্ঞ ছিলেন। খোদ কে সি নাগের কাছে অঙ্ক শিখিয়াছেন, মনুষ্য-জীবনে ছাত্র ঠেঙ্গাইয়া সুনাম ও দুর্নাম দুইই কুড়াইয়াছেন।   চৌবাচ্চা হইতে নলযোগে জল ঢোকা ও বাহির হইবার হিসাব তাঁহার কাছে জলের মতোই সোজা। এ হেন গণিতজ্ঞ ভূতপ্রবর হরিশঙ্করের বিলাপ শুনিয়া তাহার সামনে আবির্ভূত হইলেন।
হরিশঙ্কর প্রথমটায় ঘাবড়াইয়াছিল। কিন্তু তাহার উপস্থিত বুদ্ধির কোনো অভাব ছিল না। যত গোল বাধিত অঙ্ক কষিতে বসিলে। সে চোখ পিটপিট করিয়া সামনের অপরূপ আবির্ভাবটিকে একটু মাপিয়া লইলো। লম্বা, সিড়িঙ্গে চেহারা, গলায় ফুটফুটে সাদা উপবীত, হরিশঙ্কর বুঝিল ইনি ব্রহ্মদৈত্য না হইয়া যান না। হরিশঙ্করের মামার বাড়ী কিঞ্চিৎ সাহিত্যরসিক ছিল। বাড়ীতে খুঁজিলে দুই-একখানা পুরাতন পূজাবার্ষিকী পাওয়া যাইত এবং তাহাতে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের লেখনীতে ভূতের গল্পও থাকিত। পাঠ্যবইয়ের বাহিরে অপাঠ্য রসদগুলি আমাদের হরিশঙ্করের সর্বদাই প্রিয়। তাই তাহার অজানা ছিল না বুরুন নামে এক অঙ্কে তেরো পাওয়া ছাত্র কী করিয়া ভূতের কৃপায় একশো পাইয়াছিল। সে মনে মনে ভাবিল, ‘একবার পরখ করিয়া দেখিতে হয়।‘
ব্রহ্মদৈত্য খুবই সহানুভূতির সহিত কথা শুরু করিলেন, “কী বাবা, অঙ্ক নিয়ে সমস্যা?”
হরিশঙ্কর পাল্টা প্রশ্ন করিল, “তা তো বটে কিন্তু আপনি জানলেন কী করে?”
ব্রহ্মদৈত্য হাসিয়া কহিলেন, “আমাদের Zানতি হয়, আকাশপথে যাচ্ছিলুম, তা দেখলুম তোমার চোখে ঘুম নেই।“
হরিশঙ্কর এবার তেরিয়া জবাব দিল, “তা না থাকলেই বা আপনার কী? আমি তো আপনার ঘুমে ব্যাঘাত ঘটাতে যাইনি?”
ভূতসমাজে মনুষ্যজাতির প্রতি সহানুভূতির অভাব নাই। ব্রহ্মদৈত্য ব্যস্ত হইয়া বলিলেন, “আহা, চটো কেন? চটো কেন? আমি কি তাই বললুম নাকি? আমার ঘুমে তুমি ব্যাঘাত ঘটাবেই বা কেন? আমি বলছি কী, আমি তোমায় সাহায্য করতে চাই।“
হরিশঙ্কর দেখিল, এ তো তাহার পড়া গল্পের সঙ্গে মিলিয়া যাইতেছে! অশরীরীগণ তাহা হইলে প্রায়ই মনুষ্যজাতিকে অংকে সাহায্য করিয়া থাকেন! সে এবার পুরোদস্তুর ইন্টারভিউ লইবার জন্য প্রস্তুত হইয়া কহিল, “তাহলে আগে বলুন দেখি আপনার বিদ্যার দৌড় ঠিক কতটা?”
ব্রহ্মদৈত্য তাঁহার অঙ্ক লইয়া যাবতীয় ডিগ্রী, সার্টিফিকেট ইত্যাদির হিসাব দাখিল করিলেন। হরিশঙ্কর তাহাতে খুব যে সন্তুষ্ট হইলো এমন নহে। সে অতঃপর জানিতে চাহিল ব্রহ্মদৈত্যের স্কুল-ছাত্র পড়াইবার অভিজ্ঞতা আছে কিনা। ব্রহ্মদৈত্য তাঁহার কেশবিরল মস্তক চুলকাইলেন। জীবিতাবস্থায় তিনি কলেজে গণিতশাস্ত্রের অধ্যাপক ছিলেন, স্কুলের ছাত্র পড়াইবার সুযোগ কখনো হয় নাই। সে কথা বলিতেই হরিশঙ্কর সজোরে ঘাড় নাড়িল, “নাঃ, আপনাকে দিয়ে হবে না।“
ব্রহ্মদৈত্য ব্যাকুল হইয়া উঠিলেন, তীরে আসিয়া তরী বুঝি ডুবিয়া যায়, “সে কী বাবা? কেন? হবে না কেন?”
হরিশঙ্কর বলিল, “টিউশন না পড়ালে কেউ কখনো অঙ্ক শেখাতে পারে? এই আমাদের অঙ্ক স্যার  তারাপদবাবুর কথাই ধরুন না কেন। তিনি ব্যাচ কে ব্যাচ অঙ্ক করান, সকাল সাতটা থেকে দশটা, তারপর ইস্কুলটা খানিক জিরোবার জায়গা, আমাদের ক্লাসে এসে একটু ঘুমিয়ে নেন। আমাদের বলা থাকে যেন গোল না করি। তা আমরা লক্ষ্মীছেলে, ঐসময় কাটাকুটি খেলি, গোলমাল করি না। ইস্কুলের পর আবার তো স্যারের অঙ্কর ব্যাচ শুরু হবে, তাই একটু ঘুমোতে না পারলে স্যার বাঁচেন কী করে? পারবেন আপনি দিনে এমন আট-দশটা অঙ্কের ব্যাচ পড়াতে? পড়িয়েছেন তো কলেজে, সে তো শুনেছি দিনে দুটো ক্লাস – হুঁহ!”
ব্রহ্মদৈত্য কাকুতিমিনতি করিয়া বলিলেন, “তুমি আমাকে একবার সুযোগ দিয়ে দেখো, কথা দিচ্ছি - তোমায় অঙ্কে একশো পাওয়াবোই। যদি না পারি তাহলে আমার ব্রহ্মদৈত্য নাম তুমি পাল্টে রেখো।“
হরিশঙ্কর নিমরাজী হইল। দেখাই যাক না ব্রহ্মদৈত্যের এলেম কত দূর। সে বলিল, “ঠিক আছে, তাহলে কাল থেকেই শুরু করুন। এইরকম রাতের বেলায়। আমি বইখাতা নিয়ে পা টিপে টিপে বাইরে বেরিয়ে আসবো'খন, কেউ টেরটি পাবে না।“
ব্রহ্মদৈত্য ভারী খুশি, মানুষের উপকার করিবার সুযোগ মিলিয়াছে।
গোল বাধিল প্রথম রাতেই। পাটিগণিতএর বই খোলা হইয়াছে, তৈলাক্ত বাঁশের উপর বাঁদর উঠানামা করিতেছে। হরিশঙ্কর ফস করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “আচ্ছা, বাঁশের ওপর তেল ঢালবার কোনো মানে হয়? এই তো, মামা দুবেলা মামীকে বলে, ‘ওগো অতো তেল নষ্ট কোরো না, তেল কি বিনি পয়সায় আসে’?”
ব্রহ্মদৈত্য অনেক কষ্টে তাহাকে বুঝাইলেন, ইহা অঙ্ক মাত্র, বাস্তবে এমন ঘটিবে না।
দ্বিতীয় ধাক্কা আসিল রাম ও শ্যামের অঙ্কে। তাহারা তাহাদের বয়সের সমানুপাতে কয়েকটি মার্বেলের গুলি নিজেদের মধ্যে ভাগ করিতে চাহে। ব্রহ্মদৈত্য কিছুতেই রামের নাম মুখে আনিতে পারেন না, কেবলই বলেন, “ইয়ে।“ কঠিন অঙ্ক কঠিনতর হইয়া উঠে। ‘ইয়ে’ শুনিয়া শুনিয়া হরিশঙ্করের ধৈর্যচ্যুতি ঘটিল। সে বলিল, “কাল থেকে আর আপনার আসার দরকার নেই।“
ব্রহ্মদৈত্য এইবার সত্যি রাগিলেন। অর্বাচীন বালক বলে কী? ব্রহ্মতেজে মুখমন্ডল রক্তবর্ণ হইলো। রোগা সিড়িঙ্গে চেহারা ফুলিতে লাগিল। দেখিয়া হরিশঙ্করের মতো ডাকাবুকো ছেলেও ভয় পাইল। তবে মুখে প্রকাশ না করিয়া সে উল্টা চাপ দিল, “এহ, নিজে পড়াতে পারেন না আবার রাগ দেখানো হচ্ছে। তবে যে বলেছিলেন আমায় অঙ্কে একশো পাইয়ে দেবেন? আপনার তো দেখছি কথা ও কাজের একেবারেই মিল নেই!”
ব্রহ্মদৈত্য চটিয়া লাল, "সেদিনের ছোকরা, এতবড় তোর সাহস? আমার কথায় কাজে মিল নেই? প্রাণপাত করছি তোকে অঙ্ক শেখাতে, আর সেই তুইই কিনা আমায় গাল দিস? হতভাগা, বিচ্ছু! আজ তোরই একদিন কী আমারই একদিন!"
হরিশঙ্করের দুই কর্ণ লক্ষ্য করিয়া ব্রহ্মদৈত্য দুই হস্ত বাড়াইলেন। ভাঁটার ন্যায় দুই চক্ষু হইতে অগ্নি বর্ষিত হইতেছে। মস্তক তালগাছে ঠেকিয়াছে। ভীত হইয়াও হরিশঙ্কর বুদ্ধি হারায় নাই, শুষ্ককণ্ঠে কোনোমতে বলিল, “রাম-রাম-রাম-রাম।”
ব্রহ্মদৈত্য এইবার মারাত্মক বিষম খাইলেন। তাঁহার সর্বাঙ্গে কেহ যেন বিছুটির পাতা ঘষিয়া দিল। ছোকরা দুষ্টবুদ্ধিতে অতিশয় দড়। গণিতে মাথা না খেলিলেও সঠিক বুঝিয়াছে কোন নাম তাঁহার নিকট বিষবৎ। আর্তনাদ করিলেন, "ওরে থাম, থাম।"
হরিশঙ্কর মওকা পাইয়াছে, ভালোমানুষের মতো মুখ করিয়া বলিল, "মামা বলেন, বিপদে পড়লে রামনাম করতে। আমি মামার সব কথা শুনে চলি। তবে হ্যাঁ, আপনি যদি আমায় অঙ্কে একশো পাওয়াতে পারেন, তাহলে আর আমার ওই নাম করার দরকার নেই। নইলে কিন্তু আমি বলতেই থাকবো, রাম-রাম-রাম-রাম, রাম-রাম-রাম-রাম।"
ব্রহ্মদৈত্য চটিয়া লাল হইলেন, ‘রাম-রাম’ ধ্বনি তাঁহার কাছে পরমাণু বিস্ফোরণের শব্দ হইতেও ভয়াবহ। কিন্তু এক্ষণে তিনি নিজের ফাঁদে নিজেই পড়িয়াছেন। অতএব হরিশঙ্করকে “বিচ্ছু, বদমায়েশ, মিচকে শয়তান” ইত্যাদি বাছা বাছা কিছু বিশেষণ প্রয়োগ করিয়া গালি দিয়া জ্বালা জুড়াইলেন আর বলিলেন, কথার খেলাপ তিনি করিবেন না। হরিশঙ্কর কলম হাতে যখনই কোনো অঙ্ক কষিতে যাইবে, তিনি আসিয়া তাহার কলম চালনা করিয়া অঙ্কটি কষিয়া দিবেন। তাহা হইলেই হরিশঙ্করের অঙ্কে একশোয় একশো বরাবরের মতো নিশ্চিন্ত।
হরিশঙ্কর দেখিল, তাহার কার্যসিদ্ধি হইয়াছে। সে এইবার ঢিপ করিয়া ব্রহ্মদৈত্যকে একটি পেন্নাম ঠুকিল। তবে সেই সঙ্গে বলিতে ছাড়িল না, “দেখবেন কথার খেলাপ যেন না হয়। হলেই কিন্তু আমি আবার মামাভক্ত হনুমান হয়ে গিয়ে রামধুন গাইবো। মনে থাকে যেন - হ্যাঁ।"
ব্রহ্মদৈত্য নাসিকা-কর্ণ মলিয়া বলিলেন, “নিশ্চয় মনে থাকবে বাবা। এ শিক্ষা আমার ভূতজীবনে আর ভুলছি না, মানুষ থেকে দূরে থাকাই ভালো"

..................................

অলঙ্করণ :- সহিষ্ণু কুড়ি 


 

ঝিল-মিল - উর্বী রায়

 

ঝিল-মিল
উর্বী রায় 
 


 


- "মা,ও মা, একটা গল্প বলো না!"
- "গল্প শুনবি? আচ্ছা বেশ, আজ তোকে বরং ঝিলের গল্প শোনাই। "

      কমলাটে-লাল সূয্যিটা লাবডুব লাবডুব করছে, একটু পরেই টুপ করে ডুব দেবে।বিকেলের হাওয়াতে বেশ  একটা শরৎ শরৎ গন্ধ ছড়িয়ে আছে। আউশমাঠটার গায়ে তুলোর মত কুচ্চি কুচ্চি কাশফুলেরা মিঠে হাওয়ায় দোল খাচ্ছে দিব্যি। 
  মাঠের গায়ে,  ঝাপড়া শিউলিগাছের ডালে  টুপড়ি বাসায় টুই টুনটুনি তার মা-টুনির গা ঘেঁষে  ঢুলুঢুলু চোখে বসে আছে। সূয্যিমামা ডুব দিলেই সেও ডুবে যাবে ঘুমনদীতে। কিন্তু তার আগে মায়ের কাছে টুইয়ের গল্প শোনা চাই।
   টুই বলে ওঠে,  
-"ঝিল? ঝিল কে গো?  "
মা-টুনি বলে,
- "ঝিল? ঝিল হলো বড্ড দুষ্টু আর ভীষণ মিষ্টি একটা ঘুড়ি।"
- " ঝিল ঘুড়ি? জানো মা, আমারও একজন ঘুড়িবন্ধু আছে। ও আমাকে বৃষ্টিনাচের বোল শেখাবে বলেছে। 
আচ্ছা , তুমি ঝিলের গল্প শুরু করো।'

   মা-টুনি টুইয়ের মাথায় নরম পালকের আদর বুলিয়ে গল্প শুরু করে,

" ওই যে দূরে, আকাশ জুড়ে রঙবেরঙের ঘুড়িরা উড়ছে,ওদের মধ্যেই ছিলো  দুই ঘুড়িবন্ধু,  একজন নীলঝিলমিল, আর একজন লালজোনাকি। দু'জনের ভারি ভাব ।নীলঝিলমিলের সারা শরীর সাগরনীলরঙা, তারউপর রূপোলী রঙের ঝিকিমিকি তারা। আর লালজোনাকির লালশরীরে রোদ পড়লে জোনাক-আলো ঝলমল করতো। 
   ওদের বয়স ছিলো প্রায় সমান । ঝিল যেদিন বুবকাইদের বাড়ি এলো, তার দু'দিন আগে জোনাকি এসেছিলো শিলুদের বাড়ি। বুবকাই আর শিলুর বাড়ি পাশাপাশি।  তাই ঝিল আর জোনাকিও রোজ একসাথে আকাশে উড়তো। ঝিল হাওয়ায় সাঁতার কাটতো, জোনাকি মেঘেদের সাথে গল্প করতো; আবার জোনাকি চামচিকেদের সাথে ছোঁয়াছুঁয়ি খেলতো, ঝিল আলসে চিলের পিছনে সোঁ করে  ছুটে গিয়ে চমকে দিয়ে আসতো।  
আকাশের বুকে উড়ে বেড়াতে ওদের ভীষণ মজা।ঠিক যেমন আমার টুই উড়তে  মজা পায়। কি তাই তো?"
       টুই জোরে ঘাড় নাড়লো ।বলল,
-" হ্যাঁ,  দারুণ মজা। কি সুন্দর বাতাস বেয়ে আলোয় নেয়ে  যেদিক খুশি ঘুরে বেড়ানো যায়।"
     মা-টুনি কপট  ধমকে বললো,
-" ওরে দুষ্টু!  যেদিক খুশি যাওয়া যায়!আর যেদিক খুশি যেতে গিয়ে হারিয়ে গেলে কি হবে? "
-" না না মা, আমি দূরে যেদিক খুশি যাই না,আমি তো কাছাকাছি যেদিক খুশি যাই। আমি মোট্টেও হারাবো না। তুমি ঝিলের গল্প বলো না...!" 
মা-টুনি হেসে বলে,
-" আচ্ছা বেশ। তো  হাসিতে, আনন্দে, ভালোলাগায় ঝিল- জোনাকির কাটছিলো বেশ দিনগুলো। 
   তারপর তো কাশের বনে শরৎ হাওয়ার দোলা লাগলো, কুমোর ঘরে আলো জ্বললো, দুগ্গামা'র কাঠামোয় মাটির প্রলেপ পড়লো, আর চলে এলো বিশ্বকর্মা পূজো।
      বিশ্বকর্মা পূজো ঘুড়িদের ভারি আনন্দের দিন।  লাল-নীল-বেগনী-গোলাপী বাহারি সব ঘুড়িরা মিলে আকাশখানা ভরে রাখে ।
   ঝিল -জোনাকিও মনের আনন্দে সেদিন আকাশে  উড়ছে, ভাসছে,ছুটছে, সোঁ করে উপরে উঠছে, গোঁত্তা খেয়ে নীচে নামছে, কখনো আবার প্যাঁচ প্যাঁচ খেলছে... সে বেজায় মজার ব্যাপার।
     এমন সময় হলো কি, প্যাঁচ খেলতে গিয়ে হঠাৎ ঝিলের সুতোটা কুট করে গেল কেটে! ব্যাস, ঝিল তখন লাটাই ছেড়ে হাওয়ার ঢেউয়ে উড়ে গেলো।
  জোনাকি প্রথমে বুঝতে পারেনি।যখন বুঝলো,তখন কি লাফালাফি!  ঝিলকে ডেকেই চলেছে,"ঝিল কোথায় যাচ্ছিস? যাস না, আমার জন্য দাঁড়া, আমিও যাবো তোর সাথে..ঝিইইল..."।
  ঝিলের কি আর দাঁড়াবার উপায় আছে? ও তো তখন  হাওয়ায় ভাসছে।  ভাসতে ভাসতে বেশ খানিক দূরেও চলে এসেছে।বুবকাই-জোনাকিরা আবছা হয়ে ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেছে। প্রথম দিকে একটু একটু ভয় করছিলো ঠিকই; কিন্তু এখন ঝিলের বেশ মজা হচ্ছে।
  কি সুন্দর  ইচ্ছেমতো উড়ছে ঝিল। কোনো পিছুটান নেই, কোনো বাঁধন নেই।  

   উড়তে উড়তে ঝিল  ভাবলো, সত্যিই তো, জীবনটা তার সুতোতেই বাঁধা ছিলো এতদিন। সে উড়তো ঠিকই,  কিন্তু ইচ্ছেমতো উড়তে পারতো কই! সে ডানে যেতে চাইলে বুবকাই তাকে বাঁয়ে পাঠাতো,পূবে যেতে চাইলে উড়িয়ে দিতো দক্ষিণে।  যখন  ভাবতো ও  মেঘ পেরিয়ে ওইইইইই দূর আকাশে ভেসে যাবে, তখনই সুতোয় পড়তো  হ্যাঁচকা টান।আবার যখন বনবন করে মাথা ঘুরতো, বেশি উঁচুতে যাবার ইচ্ছে মোট্টে থাকতো না, তখন বুবকাই ঝিলকে উড়িয়ে দিতো দূরে,আরও আরও দূরে।
কখনও আবার তার হলদে পাখির সাথে ঘোরা শেষ হত না,সাদামেঘের সাথে কথা ফুরতো না, তার আগেই ফিরতে হতো ঘরে।
   তারচেয়ে এই বেশ ভালো হলো। এখন ঝিল নিজের খুশি মতো যেদিক ইচ্ছে যাবে, কেউ ওকে বাধা দেবে না।  যেখানে খুশি, যত খুশি উড়বে,কেউ পিছন থেকে টেনে ধরবে না।   কি যে মজা ঝিলের। 
      খুশিমনে ঝিল ভেসে চলেছে। সুপুরি বাগানের উপর দিয়ে একদল বককে  উড়ে যেতে  দেখে ঝিলের  মনে পড়লো,সে তো মাঝেমাঝেই স্বপ্ন দেখতো  বেশ  উড়ে যাচ্ছে  দূর দিগন্তে, ঠিক ওই  সাদা বকেদের মতো।   বুবকাইদের বাড়ি, শিলুদের বাড়ি, চিকাই, পলু,  মন্নিকদের বাড়ি ছাড়িয়ে, পদ্মবিল পেড়িয়ে, বোসপাড়া, বেনেপাড়া,  চিরুণিবাজারের উপর দিয়ে আরও দূরে,অনেক দূরে.......।  ঝিল উড়ছে, শুধু উড়ছে।
   
       আজ নিজের অজান্তেই কেমন করে যেন ঝিলের সে স্বপ্ন সত্যি হয়ে গেছে। দিগন্তে উড়ে যাবার সেই সাধ ঝিল আজ পূরণ করবে।  
   যদিও   জোনাকির কথা মনে পড়লে মনটা খারাপ লাগছে...।হলদে পাখি, সাদা মেঘকেও ভুলতে পারছে না কিছুতেই।  
তবে একটা নিশ্চিন্তি। ও তো এখন স্বাধীন! তাই  যখনই ইচ্ছে হবে,উড়তে উড়তে ঘুরতে ঘুরতে এসে ওদের সাথে দেখা করে যাবে। "

     একঝাঁক চামচিকে শিউলিগাছের সামনেটায় এসে কিচিমিচি করছিলো। টুই ওদের বেশ করে বকে দিয়ে আবার মা-টুনির গল্পে মন দিলো।  মা-টুনি বলছে,

   "ঝিল তো দিব্যি এগোচ্ছে কালো মেঘ ছাড়িয়ে, সাদা মেঘ পেরিয়ে....আকাশের বুকে গা ভাসিয়ে । এরই মাঝে  ঝিলের বাসায় ফেরা চড়ুই, বাবুইদের সাথে দেখা হল, দূর ঠিকানায় পাড়ি দেওয়া পরিযায়ীদের সঙ্গে গল্প হল, ঘরফিরতি ঘুড়িদের সাথে নাচলো খানিক, মেঘের সঙ্গে খেলা  করতে করতে আলতো করে গা ভেজালো, আবার সেই মেঘেদের পিছনে লুকিয়ে থাকা সন্ধ্যাতারাটার সাথে  খুনসুটিও করলো, তারপর আবার উড়ে গেলো।
      হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে ঝিল চিকাই,পলু, মন্নিকদের বাড়ি পেরিয়ে এবার এগিয়ে গেলো পদ্মবিলের দিকে। "

   - ঝিলের কি মজা, তাই না মা? 
টুই বলল। 
  
- "হ্যাঁ  সে তো মজাই। তা, ঝিল তো উড়ছিলো বেশ 
মনের আনন্দে। কিন্তু একটু পরে  আস্তে আস্তে ঝিলের কেমন অস্বস্তি হতে লাগলো। হাওয়াটা যেন কমে আসছে মনে হচ্ছে!"
-"যাহ! হাওয়া কমলে ঝিল উড়বে কি করে?"
  টুই আবার প্রশ্ন করলো। 
-" ঠিক তাই!  সেটা তো ঝিল ভাবেনি আগে! অন্যসময় বুবকাই ওকে নামিয়ে নিতো। কিন্তু এখন কি হবে ?

     এদিকে আবার চারপাশে ছোপ ছোপ অন্ধকার ফুটে উঠছে । আকাশে একটাও ঘুড়ি নেই আর । আবছা আঁধারি আলোয় শুধু সে-ই  ভেসে চলেছে।  একা, একদম একা....।

    ঝিল হঠাৎ খেয়াল করলো, ও আর আগের মতো  তেমন করে উড়তে পারছে না। ধীরে ধীরে নীচের দিকে নেমে আসছে।ঝিলের ভয় করতে লাগলো এবার। 

   সামনেই পদ্মবিল। কৃষ্ণপক্ষের আকাশ তার কালো রঙ পদ্মবিলের জলে  গুলে দিচ্ছে একটু একটু করে ।

সেই কালো জল ইয়াব্বড় হাঁ করে বসে আছে ঝিলের অপেক্ষায়। ঝিল যেইমাত্র ভাসতে ভাসতে বিলের উপর আসবে, ওমনি কপাৎ করে গিলে নেবে সে ঝিলকে।   
   এদিকে বিলের সামনেই ভূতের মতো দাঁড়িয়ে আছে একটা নেড়া সেগুন গাছ। তার শুকিয়ে যাওয়া ডালপালা নিয়ে সেও বুঝি ঝিলকেই দেখছে একদৃষ্টে। ওকে হাতের কাছে পেলেই এফোঁড়ওফোঁড় করে দেবে তার খটখটে  শুকনো ডালগুলো দিয়ে।  
     আর বিলের সামনের ওই কাঁটাঝোপটা ঝিলকে দেখেই কেমন যেন দাঁতকিড়িমিড়ি করছে মনে হচ্ছে! 

   নাহ!এবার বড্ড  ভয় করছে ঝিলের।দিগন্তে ভেসে যাবার স্বপ্ন পালিয়ে গেছে মন থেকে। এখন নিজেকে বাঁচাবে কি করে মন জুড়ে তার সেই ভাবনা ।
ও একবার আকাশের দিকে তাকালো।  অমন ঝকঝকে আকাশখানা এখন শুধুই এক বিশাল ঘুটঘুটে অন্ধকার গর্ত । যে কয়েকটা তারা মিটমিট করছিলো, তারাও সুযোগ পেলেই মেঘের আড়ালে লুকিয়ে পড়ছে।
     ঝিল এখন একা,  এক্কেবারে একা।কেউ নেই ওর পাশে। ওর খুব মনে পড়ছে বুবকাইয়ের কথা, জোনাকির কথা,হলদে পাখি, সাদা মেঘের কথা।ইস, আবার যদি ওদের কাছে ফিরে যাওয়া যেত! 
   কিন্তু তা আর হবে না,কোনও দিন,কক্ষনও হবে না। আর কখনো বুবকাই ওকে ওড়াবে না, আর কোনদিন জোনাকির সাথে দেখা হবে না, পাখিদের সাথে গল্প হবে না, মেঘের সাথে খেলা হবে না.....
    ঝিলের খুব কান্না পেলো। ও খেয়াল করলো, হাওয়া প্রায় থেমেই গেছে।  

কি করবে এবার ঝিল? একদিকে রাক্ষুসে বিলটা যেন হা হা করে  ডাকছে, এদিকে আয়, এদিকে আয়,খাই তোকে কপাৎ  করে.......।আরেকদিকে ভূতুড়ে গাছটা হিঁ হিঁ করে হেসে ওকে বলছে, আঁয় আঁয়, কাছে আঁয়, তোঁকে আজ ফালাফালা কঁরি। " 
  
ছোট্ট টুই মা-টুনির গা ঘেঁষে একটু জড়োসড়ো হয়ে বসলো।ইস, ঝিলের কি হবে এবার!
মা-টুনি বলে চলেছে, 
     " ঝিল দেখলো হালকা  হাওয়ার একটা অদৃশ্য সুতো ঝিলকে সামনের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। আর কোনো উপায় না দেখে ও শেষে হালকা হাওয়ার কাছে মিনতি করলো, সে যেন ঝিলকে ওই ভূতুড়ে গাছ, কালো বিল আর কাঁটাঝোপের হাত থেকে বাঁচিয়ে বিলটার ওপারে পৌঁছে দেয়। 
   ঝিলের মিনতি শুনে হালকা হাওয়া হেসে বললো ,বেশ,  তাই হবে। "

- যাক, কেউ তো ঝিলের পাশে আছে।
   টুই যেন একটু স্বস্তি পেলো।
মা-টুনি বলছে,
   "কিন্তু খানিক বাদেই ঝিল বুঝলো,হালকা হাওয়া তার কথা রাখেনি।সে ঝিলকে ওই ভূতুড়ে গাছের  দিকেই  টেনে নিচ্ছে। 
   আসলে ঝিল তো জানতোই না যে হালকা হাওয়া ভূতুড়ে গাছের বন্ধু ছিলো।"

- ইস, কি দুষ্টু ওরা!  
      টুই বলে উঠলো। 

-"  কিন্তু ভূতুড়ে গাছের দিকে গেলে যে ঝিল কিছুতেই বাঁচাতে পারবে না নিজেকে!  আবার সামনেই কাঁটাঝোপ আর কালো পদ্মবিল। কোনদিকে যাবে ও! 
ঝিল প্রাণপণ  চেষ্টা করলো উল্টো দিকে ফিরে যাবার। কিন্তু চেষ্টা  করলেই তো হল না! ওইটুকু পাতলা পুচকে একটা ঘুড়ি, সে কি আর হালকা হাওয়ার টান এড়াতে পারে! 
  তাই ভাসতে ভাসতে ঝিল ভূতুড়ে গাছের দিকেই এগিয়ে গেলো।আর গাছটার কাছাকাছি আসতেই হলো কি,  সেই গাছ সুযোগ বুঝে একখানা সরু শুকনো ডাল এগিয়ে দিলো ঝিলের দিকে, আর তক্ষুণি কোত্থেকে দমকা শিরশিরে খোনা হাওয়া এসে ঝিলকে এক ঝটকায় আটকে দিলো সেই ডালে।
  আটকানোর সময় শুকনো ডালটা ঝিলের লেজের কাছটাতে  ফড়ফড় করে ছিঁড়ে দিলো খানিকটা। 
ঝিল  যন্ত্রণায় কঁকিয়ে উঠলো । 
    এরইমধ্যে ও দেখলো শিরশিরে খোনা হাওয়ার সাথে তাল মিলিয়ে দুলতে দুলতে ভূতুড়ে গাছের বাকি  ডালগুলোও এগিয়ে আসছে ওর দিকে।সর্বনাশ!  
এখানে আটকে থাকলে তো ওরা এক্ষুণি ঝিলকে ছিঁড়েখুঁড়ে একসা করে দেবে! 
না না,  এভাবে হারলে চলবে না। এই ডালটা থেকে মুক্তি পেতেই হবে ওকে। 
   ঝিল তখন করলো কি, বেজায় ছটফট করতে শুরু করলো। কোনক্রমে যদি লেজের কাছটা ছিঁড়ে দিয়ে বেরিয়ে আসতে পারে,তা সে যতই ব্যথা লাগুক, তবে ভূতুড়ে গাছটার হাত থেকে বেঁচে যাবে ...। 
   বেশ খানিক্ষণের চেষ্টাতে সেরকমটাই হলো । ওর ছটফটানি আর শিরশিরে খোনা হাওয়ার ধাক্কাধাক্কিতে লেজের কাছে যেখানটা আটকে ছিলো, সেখানটা ফুস করে ছিঁড়ে গেলো। ব্যাস একঝটায় ঝিল ছিটকে বেরিয়ে এলো ভূতুড়ে গাছের কবল থেকে। 
  কিন্তু  শিরশিরে খোনা হাওয়া অত সহজেই কি ছাড়ে  ওকে! ঝিল বাইরে আসতেই সে এমন এক জোরসে টান দিলো যে ঝিল টাল সামলাতে না পেরে সোঁওওত করে  ভেসে গেলো  সোজা বিলের  হাঁ করা কালো মুখের দিকে। ততক্ষণে যন্ত্রণার চোটে ওর প্রায় অজ্ঞান হওয়ার অবস্থা।শুধু জলে পড়ার আগে  মনে হল, ঝিলের ছেঁড়া সুতোটায় যেন হালকা টান লাগলো.....।"

   মা-টুনি থামলো। 
টুই দমবন্ধ করে শুনছিলো এতক্ষণ। মা-টুনি থামতেই সে তাড়া দিলো,
-  ও মা থামলে যে! তারপর কি হল বলো না..!
-  তারপর? তারপর অনেক পরে একসময়  ঝিলের জ্ঞান ফিরলো।ও চোখ মেলে চাইলো।
-  যাক বাব্বা! তারমানে ঝিল বেঁচে গেছিলো।
- হ্যাঁ, বেঁচে গেছিলো। আর চোখ মেলে ঝিল কি দেখলো বলতো?
- কি দেখলো? 
- ঝিল দেখলো , ও বুবকাইয়ের বাড়িতে আছে।
-  সে কি! বুবকাইয়ের বাড়ি!ওখানে ঝিল  কি করে গেলো মা? যাদু করে? 
- ধুর বোকা! যাদু করে যাওয়া যায় নাকি! 
- তাহলে? 
- বুবকাই এসে ওকে নিয়ে গেছিলো। 
- বুবকাই কি করে ঝিলকে পেলো? ঝিল তো বিলের জলে পড়ে গেছিলো! 
-  নাহ, পড়েনি। ও যেই বিলের জলে পড়তে যাবে, ঠিক তখনই বিলের পাড়ের কাঁটাঝোপটা ঝিলের ছেঁড়া সুতোটাকে খপ ধরে নিয়েছিলো।
- তারমানে সেই কাঁটাঝোপটাই ঝিলকে বাঁচিয়ে দিলো ? 
- হ্যাঁ রে, ওকে দেখে তো ঝিল বড্ড ভয় পেয়েছিলো। কিন্তু ও-ই ঝিলকে বাঁচালো শেষমেশ। 
- আর ঝিল বুবকাইয়ের কাছে গেলো কি করে?
- আসলে হয়েছিলো কি,ঝিল বুবকাইয়ের বড্ড প্রিয় ছিলো কিনা,তাই  ঝিলের সুতো কেটে যেতে বুবকাই ওর পিছু নিয়েছিলো। সারা বিকেল,সন্ধ্যে ঝিলকে খুঁজতে খুঁজতে  বুবকাই চলে এসেছিলো পদ্মবিলে। সেখানেই ও কাঁটাঝোপে আটকে থাকা ঝিলকে দেখতে পেয়েছিলো।তারপর সুতো ছাড়িয়ে  উদ্ধার করে নিয়ে গিয়েছিলো বাড়িতে। 
- তারপর ? 
- তারপর  বুবকাই ওর শরীরের ছেঁড়া জায়গাগুলোয় আঠা-কাগজ- সেলোটেপ দিয়ে যত্ন করে তাপ্পি মেরে দিয়েছিলো।আর ধীরে ধীরে  ঝিলও সুস্থ হয়ে উঠেছিলো।
- আচ্ছা মা,ঝিল কি এখন বুবকাইয়ের কাছেই আছে?
- আছে তো। তবে বেশি  উড়তে পারে না  , কষ্ট হয়। তাই বুবকাই ওকে মাঝেমধ্যে বাইরে আনে। 
- আর তখন  আবার জোনাকি, হলদে পাখি,সাদা মেঘ সব বন্ধুদের সাথে ঝিলের আবার দেখা হয়, তাই না?
- হ্যাঁ, সব্বার সাথে দেখা হয়।
- তারমানে তো হারিয়ে যাওয়া বন্ধুদের সাথে ঝিলের আবার মিল হয়ে গেছে। কি ভালো না মা? 
   টুইয়ের কথায় মা- টুনি হাসলো। 

- বুবকাইদের বাড়িতে আমাকে একদিন নিয়ে যাবে মা? আমিও বন্ধু পাতাবো ঝিলের সাথে।
- আচ্ছা বেশ, পাতাবি না হয়। ঝিলের গল্প তো শেষ। এখন ঘুমো দেখি।
    মা-টুনি টুইয়ের মাথায় ঠোঁট বুলিয়ে দিলো।

  আকাশের বেগুনীতে কালচে রঙ ধরছে। একটা,দু'টো করে তারা ফুটে উঠছে। 
   ঝিলের কথা ভাবতে ভাবতে  টুইয়ের ঘুমভরা ঢুলুঢুলু চোখদু'খানা  আলতো করে বুজে এলো।
  মা-টুনির আদর খেতে খেতে ছোট্ট টুই ডুব দিলো ঘুমনদীতে।
...........
 
Urbi Roy
 
অলঙ্করণ :-  সহিষ্ণু কুড়ি 
 

 

সমুর অজ্ঞাতবাস - রক্তিম লস্কর

 

সমুর অজ্ঞাতবাস

রক্তিম লস্কর 



***এক***

 

    সেদিন সকাল থেকেই সমু বেশ টেনশনে। তার স্কুলে বার্ষিক পরীক্ষার রেজাল্ট বের হবে। বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগে সে ঠাকুর ঘরের সকল দেবদেবীকে ভালো করে প্রণাম করে নেয়। ঠাকুমা তার প্রিয় নাতির কপালে দিয়ে দেয় দইয়ের ফোঁটা।

সমুর ভালো নাম সুমিত চৌধুরী। সে বনগাঁর সুভাষপল্লীতে থাকে। তার বাবা রঞ্জিত চৌধুরী বনগাঁ কলেজে অঙ্ক পড়ান। আর সমুর দিদি হিমিকা গত বছরই মাধ্যমিকে প্রচুর নম্বর নিয়ে পাশ করেছে। তাই তো বাড়িতে কথায় কথায় দিদির সাথে সমুর রেজাল্ট নিয়ে তুলনা করা হয়।

সমুদের স্কুলের নাম আবার তার দাদু ফণীভূষণ চৌধুরীর নামে। ওনার উদ্যোগেই তাদের স্কুলের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। তাই স্কুলের শিক্ষক থেকে ছাত্র সকলেই তাকে এক ডাকে চেনে।

বাড়ি থেকে বের হয়ে মিনিট দশেক হাঁটা পথে সমু পৌছে যায় স্কুলে। এদিকে স্কুলে এসে সমুর মাথায় হাত। একে তো সে পড়াশোনায় খুব একটা ভালো নয়। তার উপর স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষাও তার ভালো হয়নি। সে ভেবেছিল এবারও ঠাকুর দেবতার আশীর্বাদে সে উতরে যাবে।  

কিন্তু তা আর হল না। রেজাল্ট বের হতে দেখা গেল সমু পরীক্ষায় ফেল করেছে। অর্থাৎ সে পরের ক্লাশে আর উঠতে পারবে না। এদিকে ওর সব বন্ধুরা ভালো ভালো নম্বর পেয়ে পাশ করে গেছে। অথচ যত কৃপণতা সমুর নম্বরের বেলা!   

স্কুল থেকে মার্কশিট নিয়ে মাথা নিচু করে সমু বের হয়ে আসে। এরপর সে কি করবে ভেবে পায়না। সে অঙ্কে পেয়েছে মাত্র পনেরো। বিজ্ঞানের নম্বরও সেই কুড়ির ঘরে। এই মার্কশিট নিয়ে বাড়িতে ঢুকলে বাবার একটা মারও যে নিচে পড়বে না সেই ব্যাপারে সে নিশ্চিত। এর উপরে রয়েছে মা’র বকা ও দিদির দিদিগিরি। বাড়িতে তার প্রাণ প্রায় ওষ্ঠাগত হয়ে উঠবে।

রাস্তায় যেতে যেতে সমু ঠিক করে এই মুখ নিয়ে সে আর বাড়ি ফিরে যাবে না। বরং সে চলে যাবে সোজা অজ্ঞাতবাসে। সেখানে কেউ তাকে চিনবে না, জানবে না। সেখানে গিয়ে ভালো কিছু করে সে বাড়ির সকলকে দেখিয়ে দেবে।

কিন্তু সমু যাবেটা কোথায়? কাছে পিঠে সেরকম যাওয়ার জায়গা বলতে সেই কোলকাতা। তাও ট্রেনে করে যেতে হয়। তার দৌড় আবার সেই দমদমে পিসির বাড়ি অবদি। তাও সেই সময় বাবা, মা ও দিদি সাথে ছিল।

এদিকে সমুর পড়নে স্কুলের পোশাক। পিঠে স্কুলের ব্যাগ। আর পকেটে টিফিনের জন্য মা’র দেওয়া মাত্র পাঁচটা টাকা। তাকে দেখে স্কুলফেরত ছাত্র ছাড়া আর কিছু মনে হয়না। এদিকে সূর্য তখন প্রায় মধ্য গগনে। কিন্তু সমুর সেদিকে বিন্দুমাত্র হুঁশ নেই।

প্রায় মিনিট পনেরো হাঁটা পথে সমু এসে পৌছায় বনগাঁ ষ্টেশনে। সে দেখে একটু বেলা হয়েছে বলে ষ্টেশনে খুব একটা লোকজন নেই। স্টেশনে এসে সে আশপাশটা একটু ভালো করে দেখে নেয়। স্টেশনে চেনাশোনা কেউ থাকলে তার আবার অজ্ঞাতবাসে যাওয়া আটকে যেতে পারে।

ইতিমধ্যে স্টেশনে একটা লোকাল ট্রেন এসে দাড়ায়। আর ট্রেন থামা মাত্রই প্ল্যাটফর্মে দাড়িয়ে থাকা লোকজন উঠতে শুরু করে। সেই সাথে সমুও উঠে পড়ে ট্রেনে। কিছুক্ষণ পরে জোরে হুইসেল বাজিয়ে ট্রেনটা ছেড়ে দেয়। সমু যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে।

 

***দুই***

 

    সমু ট্রেনে উঠে দেখে ভিতরে প্রচুর সিট খালি। সে জানলার ধারে একটা ভালো সিট পেয়ে যায়। সে স্কুলের ব্যাগটা কোলে নিয়ে সেখানেই বসে পড়ে। ট্রেন ছাড়তেই বাইরে থেকে ফুরফুর করে হাওয়া এসে লাগে তার গায়ে। এই প্রথম একা একা ট্রেনে যেতে তার বেশ ভালোই লাগে।

সমু দেখে কামরার ভিতর বিভিন্ন ধরণের লোক বসে রয়েছে। তার ঠিক পাশেই বসেছে এক সাপুড়ে। সে তার সাপের ঝুড়ি রেখেছে ঠিক সিটের নিচে। ট্রেনের ঝাঁকুনিতে এক পিস বের হয়ে পড়লে সমূহ বিপদ। সেই ভয়ে সমু পা নাড়াতেও সাহস পায় না।

আর সমুর ঠিক উল্টোদিকের জানালায় বসেছে একটা মোটামতন লোক। সমুদের কামরায় বাদাম ভাজা থেকে আরম্ভ করে যত খাবার দাবার উঠছে তাদের সকলের কাছ থেকেই লোকটা কিছু না কিছু কিনছে। আর তারপর কপাকপ করে সেগুলো খাচ্ছে।  

চোখের সামনে এসব দেখে সমুরও খুব খেতে ইচ্ছে করে। সেই সাত সকালে সে বাড়ি থেকে বের হয়েছে। ইতিমধ্যে তার বেশ খিদেও পেয়েছে। কিন্তু তার পকেটে পড়ে রয়েছে সবেধন নীলমণি পাঁচ টাকা। এই টাকা কখন কিভাবে লাগবে সে জানে না। তাই সে চুপটি করে বসে থাকে। 

সেই মোটামতন লোকটির পাশে বসেছে এক বয়স্ক ভদ্রলোক। তিনি অনেকক্ষণ ধরে সমুকে দেখে যাচ্ছেন। সমুর পড়নে স্কুলের পোশাক ও সাথে স্কুলের ব্যাগ। আর সে একা একা যাচ্ছে ট্রেনে। তাকে দেখে যে কেউ সন্দেহ করতেই পারে। সমু অবশ্য লোকটির দিকে খুব একটা তাকাচ্ছে না। সে জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখে চলেছে।

এছাড়া সমুদের কামরায় রয়েছে কয়েকজন বিভিন্ন বয়সের মহিলা। তাদের সাথে রয়েছে গোটা দুয়েক বাচ্চা। এছাড়া দরজার সামনে মাল নিয়ে দাড়িয়ে রয়েছে কয়েকজন। তারা হয়তো কোলকাতার দিকে যাবে। চলন্ত ট্রেনের আওয়াজের মাঝে লোকজনের কথাবার্তাও শোনা যাচ্ছে।

সমু এর আগেও বার কয়েক ট্রেনে চড়েছে। অবশ্য প্রতিবারই বাবা ছিল তার সাথে। দমদমে রয়েছে তার এক পিসীর বাড়ি। সেখানেই সে বার কয়েক গিয়েছে বাবা, মা ও দিদির সাথে। সেই সুবাদে এদিকের কিছু কিছু স্টেশনের নাম সে জানে।

একেকটা করে স্টেশন আসছে। ট্রেনটা একটু থেমে আবার চলতে শুরু করছে। আর সেই সাথে পিল পিল করে লোক উঠছে ট্রেনে। দেখতে দেখতে ট্রেনটা গোবরডাঙা স্টেশনে এসে থামে। আর সেই সঙ্গে সমুর পাশে বসা সাপুড়ে লোকটা তার সাপের ঝুড়ি নিয়ে নেমে যায়। আর সমু যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। অবশ্য তখনও সে জানে না তার জন্যে কি অপেক্ষা করে আছে এর পরে।  

এর পরের স্টেশন মসলন্দপুর। পরের স্টেশনে ট্রেনটা দাঁড়াতেই সমুর উল্টোদিকে বসে থাকা মোটামতন লোকটা নেমে যায়। আর সেই সাথে এক দঙ্গল লোক উঠে পড়ে ওই ট্রেনের কামরায়।

পাশে বসা লোকটা নেমে যেতেই উল্টোদিকে বসা বয়স্ক ভদ্রলোকটি জানালার ধারে এসে বসেন। ঠিক সেই মুহূর্তে প্রায় আট দশজন লোক এসে হাজির হয় সমুদের সিটের সামনে। তারা একপ্রকার জোর করে সমুকে সরিয়ে দেয় জানালার ধার থেকে। আর উল্টোদিকের জানালায় বসে থাকা বয়স্ক ভদ্রলোককেও তারা একইভাবে সরিয়ে দেয়। এতগুলো লোকের সামনে কেউ কিছু বলতে সাহস পায় না।

 

***তিন***

 

    সমুদের একপাশে সরিয়ে লোকগুলো বসে যায় সিটে। অবশ্য সবার বসার জায়গা হয়না। বাকিরা ওখানেই দাড়িয়ে পড়ে। আশেপাশের লোকেদের তাতে বেশ অসুবিধা হয়। কিন্তু কেউ কিছু বলে না।  

লোকগুলোকে দেখে সমুর মনে হয় ওদের বয়স ত্রিশের মধ্যেই। সকলের পড়নে প্যান্ট ও টি শার্ট। আর তাদের কথার মাঝে শোনা যায় নানারকম গালাগালি। কামরায় থাকা অন্য লোকেদের তারা বিন্দুমাত্র পাত্তা দেয়না।

এদিকে পাশের লোকগুলোর চাপে সমু একটু ভিতরের দিকে কোনমতে বসেছে। পাশের যাত্রীদেরও সেই একই অবস্থা। কিন্তু ভয়ে সকলে মুখ বন্ধ করে রাখে।

এদিকে লোকগুলো তাস খেলার প্রস্তুতি শুরু করে দেয়। দুই দিকের সিটের মাঝে গামছা বিছিয়ে শুরু হয় তাস খেলা। সমু আগে লোকাল ট্রেনে ভিড়ের মধ্যে অফিস যাত্রীদের তাস খেলার কথা শুনেছিল। এই প্রথম সে ঘটনাটা দেখতে পায়।

এদিকে ট্রেন চলতে থাকে। আর চলন্ত ট্রেনে সমুদের কামরায় চলতে থাকে তাস খেলা। আর সেই সাথে চলে লোকগুলোর হই হুল্লড়

ইতিমধ্যে ট্রেন এসে ঢোকে দত্তপুকুর ষ্টেশনে। যথারীতি লোকজনের ওঠানামা চলতে থাকে। কিন্তু সময় হয়ে গেলেও  ট্রেন আর ছাড়ার নাম করে না। ট্রেনের ভিতরে বসা লোকেরা বিরক্ত হয়ে ওঠে।

এরই মাঝে কয়েকজন লোক ছুটতে ছুটতে জানিয়ে যায় যে দত্তপুকুর ষ্টেশনে চেতনা এসে দাঁড়িয়েছে। মুহূর্তের মধ্যে সমুদের কামরার দরজার সামনে দাড়িয়ে থাকা লোকজন হাওয়া হয়ে যায়।  

সমু চেতনা ট্রেনের কথা আগে শুনেছে। সাধারণত টিটিরা লোকাল ট্রেনে উঠে টিকিট পরীক্ষা করে না। কিন্তু মাঝেমধ্যে চেতনা ট্রেনে করে একদল টিটি এসে হাজির হয় কোন ষ্টেশনে। তারপর তারা সকলের টিকিট পরীক্ষা করে। আর টিকিট না পেলে সেই লোকগুলোকে তারা ধরে নিয়ে চলে যায়।

এদিকে চেতনার খবর পেয়ে ট্রেনের কামরার লোকজনের চেতনা যেন হঠাৎ করে জাগ্রত হয়। সমুদের কামরায় থাকা বেশ কিছু লোক এদিক ওদিক দিয়ে নেমে যায়।

এদিকে চেতনা ট্রেনের কথা শুনে সমুরও টেনশন শুরু হয়ে যায়। সে তাড়াহুড়োয় বনগাঁ থেকে ট্রেনে উঠে পড়েছে। আর সেই সাথে টিকিটও কাটা হয় নি। অবশ্য তার পকেটে ছিল মাত্র পাঁচ টাকা। সেই টাকায় অবশ্য টিকিট কাটাও যেত না।  

এদিকে ট্রেনের জানালা দিয়ে দেখা যায় প্ল্যাটফর্মে কিছু কালো কোট পড়া লোকজন ঘুরে বেড়াচ্ছে। তারা সামনে যাকেই পাচ্ছে তার টিকিট পরীক্ষা করছে। যার টিকিট পাচ্ছে না তাকে ধরে নিয়ে চলে যাচ্ছে।

এরই মধ্যে কালো কোট গায়ে দুইজন টিটি এসে হাজির হয় সমুদের কামরায়। তারা এক এক করে সকলের টিকিট পরীক্ষা শুরু করে। তাই দেখে সমুর প্যালপিটিশন বাড়তে থাকে।  

এরপর এক টিটি এসে হাজির হয় সমুদের সিটের সামনে। পাশের লোকেদের টিকিট দেখে এসে টিটি  ভদ্রলোক সমুকে বলে, “খোকা তোমার টিকিট কোথায়?”

সমু মাথা নেড়ে বলে, “নেই”।

সমুর পোশাক ও ব্যাগ দেখে টিটির সন্দেহ হয়। সে আবার জিজ্ঞাসা করে, “তুমি কার সাথে ট্রেনে যাচ্ছ?”

ঠিক সেই মুহূর্তে সমুর মনে একটা দুষ্টু বুদ্ধি জেগে উঠে। সে ইচ্ছে করে তার পাশে বসা জানালার ধারের লোকগুলোকে দেখিয়ে দেয়।

এরপর টিটি গিয়ে হাজির হয় তাস খেলতে থাকা লোকগুলোর সামনে। সামনে টিটিকে দেখে তাদের খেলা থেমে যায়। লোকগুলোর চেহারায় সামান্য পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়।

টিটি বলে, “আপনাদের টিকিট দেখান?”

একজন জবাব দেয়, “আমাদের তো টিকিট নেই।“

টিটি ভদ্রলোক বলে, “টিকিট নেই মানে? টিকিট দেখান। নাহলে অন্য ব্যবস্থা আছে।“

লোকটি জবাবে বলে, “আমরা এই ভাবেই ট্রেনে যাতায়াত করে থাকি। কিছু করার থাকলে করে নিন।“

ইতিমধ্যে টিটির কথা শুনে অন্য টিটিও চলে এসেছে। এরপর দুই পক্ষের মধ্যে বাক বিতণ্ডা শুরু হয়ে যায়। চেতনার টিটিদের সাথে যে রেল পুলিশ থাকে সেটা বোধহয় লোকগুলোর জানা ছিল না।

কামরার ভিতরে চেঁচামেচি চলতে থাকে। সেই শুনে প্ল্যাটফর্ম থেকে এক দল পুলিশ এসে হাজির হয়। এরপর শুরু হয় দুই পক্ষের মধ্যে ধস্তাধস্তি। এরই মাঝে লোকগুলো পকেট থেকে ছুরি বের করে। কিন্তু পুলিশদের কাছে রয়েছে বন্দুক। তাই পুলিশের সাথে লোকগুলো আর পেরে উঠে না।

ভর দুপুরে দত্তপুকুর ষ্টেশনে দাড়িয়ে থাকা বনগাঁ লোকালের কামরায় চলে এক জমজমাট ঘটনা। রেল পুলিশের হাতে ধরা পড়ে যায় সেই লোকগুলো। তাদের হাতকড়া পড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হয় প্ল্যাটফর্মের দিকে। যাওয়ার সময় সমুকেও সাথে করে নিয়ে যায় একজন টিটি।

 

***চার***

 

    এদিকে সমু না ফেরায় চৌধুরী বাড়িতে হুলুস্থুল পড়ে যায়। সেই সকালবেলা ছেলেটা রেজাল্ট আনতে গেছে স্কুলে। কিন্তু তারপর থেকে তার আর কোন পাত্তা নেই।

সমুকে না দেখে বাড়ির সকলের খাওয়া দাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। সমুর মা ততক্ষণে কাণ্ণা জুড়ে দেন। সাথে তার ঠাকুমা সঙ্গ দেন। এদিকে সকাল থেকে ভাইকে না দেখে দিদি হিমিকাও পাগলের মত করতে থাকে। এমনিতে ভাইয়ের সাথে অল্পবিস্তর খুনসুটি করলেও ভাইকে সে খুবই ভালোবাসে।  

সমুর বাবা রঞ্জিত চৌধুরী গিয়েছিলেন কলেজে। বাড়ি থেকে ফোন পেয়ে তিনিও ঊর্ধ্বশ্বাসে ফিরে এসেছেন বাড়িতে। বাড়ি ফিরেই তিনি একে একে সব জায়গায় ফোন করেছেন।

ছেলের স্কুলের রেজাল্টের খবর তিনি অবশ্য আগেই পেয়ে গিয়েছিলেন। তা নিয়ে বাড়ি ফিরে ছেলেকে একটু বকাঝকা করবেন বলে ঠিক করেছিলেন। তার আগেই যে তার ছেলে এরকম করে বসবে তা তিনি বুঝতে পারেন নি।

দুপুরের মধ্যে সারা সুভাষপল্লীতে সমুর হারিয়ে যাওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়ে। পাড়ার লোকেরাও সমুর খোজে দফায় দফায় বাড়িতে হানা দিতে থাকে।

ইতিমধ্যে সমুর বাবা ছেলের বন্ধুদের বাড়িতে খোঁজ নিয়েছেন। দমদমে সমুর পিসির বাড়িতেও খবর নেওয়া হয়ে গেছে। কিন্তু কোথায় সমুকে খুজে পাওয়া যায় না। 

শেষ পর্যন্ত কোন উপায় না দেখে সন্ধ্যাবেলায় রঞ্জিতবাবু  গিয়ে হাজির হন বনগাঁ থানায়। থানার বড়বাবুর পরামর্শমত মিসিং ডায়েরি করা হয়। কিন্তু সেখান থেকেও কোন খবর পাওয়া যায় না।

এদিকে সারা বনগাঁ চষে রাত ন’টা নাগাদ বাড়ি ফিরে আসেন রঞ্জিতবাবু। কোথাও তিনি ছেলেকে খুজে পাননি। তিনি একপ্রকার পরিশ্রান্ত, বিধ্বস্ত হয়ে তিনি বাড়ি ফিরে এসেছেন। এদিকে বাড়ির পরিস্থিতি বেশ খারাপ। সমুর মা ও ঠাকুমা কাঁদতে কাঁদতে এক প্রকার বিছানা নিয়েছেন। সমুর দিদিরও সেই একই অবস্থা।

এরকম একটা সময় রঞ্জিতবাবুর মোবাইলে একটা ফোন আসে। বনগাঁ থানা থেকে ফোন করে জানায় যে সমুর খবর পাওয়া গেছে। তাকে নিয়ে রেল পুলিশের একটা দল আসছে বনগাঁয় সমুর বাড়িতে। 

সারাদিন পরে বাড়ির ছেলের খবর পেয়ে চৌধুরী বাড়িতে যেন স্বস্তি নেমে আসে। সমুর মা ও ঠাকুমা এসে বসেন বাইরের ঘরে। তার দিদিও চলে আসে সেখানে। খবর পেয়ে যায় পাড়ার লোকেরাও। তারাও দলে দলে এসে  ভিড় জমায় সমুদের বাড়ির সামনে।  

প্রায় ঘণ্টা খানেক পরে পুলিশের একটা গাড়ি এসে দাড়ায় সমুদের বাড়ির সামনে। গাড়ি থেকে নামতে দেখা যায় সমুকে। সারাদিন পরে সমুকে দেখে বাড়ির সকলে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে।

সমুকে সাথে করে এক পুলিশ অফিসার এসে ঢোকেন সমুদের বাড়ির ভিতরে। ছেলেকে দেখে রঞ্জিতবাবু পুলিশ অফিসারকে জিজ্ঞাসা করেন,

“সমুকে পেলেন কোথায়?”

“ওকে পাওয়া গেছে দত্তপুকুর স্টেশনে। ডাউন বনগাঁ লোকালের কামরায়।”

“বনগাঁ লোকাল! ট্রেনে ও কি করছিল?”

“কি করেনি সেটা বলুন? আপনার ছেলের জন্যে আজকে আমরা এক দল দাগি দুষ্কৃতীকে ধরতে পেরেছি।”

“বলেন কি?”

“হ্যাঁ, মিস্টার চৌধুরী। এরকম স্মার্ট সাহসী ছেলে আজকের দিনে দেখাই যায় না।”

“সমু কিনা শেষে...”

রঞ্জিতবাবু আর কথা শেষ করতে পারেন না। ইতিমধ্যে ভিতরের সমস্ত কথা বাইরে থেকে শুনে নিয়েছে পাড়ার লোকেরা। তারা বলতে শুরু করে, “থ্রি চিয়ার্স ফর সমু, হিপ হিপ হুররে।“

এই সময় সমুর আর এসব ভালো লাগে না। সে ছুটে গিয়ে তার মাকে জড়িয়ে ধরে।  
 
 *** সমাপ্ত ***
 
 Raktim laskar