উন্মুক্ত স্বর্গদ্বার
শংকর ব্রহ্ম
প্রায় তিন'শ বছর আগে অচিনপুরে এক নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ থাকতেন।তা'র নিজের বলে কেউ ছিল না।নগরের কারও কোন বিপদ আপদ দেখলে তিনি অস্থির হয়ে পড়তেন।তা'কে সকলেই খুব ভালবাসত।
প্রচন্ড এক শীতের রাতে তার বাড়িতে পাঁচ জন অতিথি এলেন।তারা রাতটা সেখানে কাটাতে চাইলেন।ব্রাহ্মণ তাদের ভিতরে নিয়ে গেলেন।বললেন,আপনারা বিশ্রাম করুন,আপনাদের খাওয়ার ব্যবস্থা করছি।বলে তিনি চিন্তিত হয়ে পড়লেন, তার ঘরে তো পাঁচজনকে খেতে দেবার মতো কিছু নেই।পাঁকশালায় ঢুকে তার বিস্ময়ের অন্ত রইল না।হাঁড়ি ভরা খাবার।তা দিয়েই তিনি অতিথিদের সেবা করলেন।
পরেরদিন সকালে অতিথিরা বিদায় নিতে চাইলেন।তাদের মধ্যে একজন জানতে চাইল, জানেন আমরা কা'রা?
ব্রাহ্মন বললেন,জানি না,তবে আপনারা সাধারণ কেউ নন।
- হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন।আমরা দেবতা, আপনার উপর খুব খুশি হয়েছি।
আমরা কার্তিক গনেশ বিষ্ণু শিব ব্রহ্মা।
আপনি একটি বর ব্রহ্মার কাছে চেয়ে নিন।
ব্রহ্মা বললেন, 'হে প্রভু আমার বসার যে টুলটি আছে, ওটাতে কেউ বসলে যেন আমি না বলা পর্যন্ত সে না উঠতে পারে।'
- তথাস্তু।
কার্তিত বলল,আপনি এটা কি বর চাইলেন? যান আবার বিষ্ণুর কাছে গিয়ে অন্যরকম বর চান।
ব্রাহ্মণ বিষ্ণুর কাছে এসে বললেন,
'হে প্রভু,আমার বাড়িতে যে আম গাছটা আছে,ওটাতে কেউ উঠলে যেন,আমি না বলা পর্যন্ত নামতে না পারে।'
বিষ্ণু বললেন, তথাস্তু।
বর চেয়ে ফিরে এলে, গনেশ রেগে বলল, আপনি আবার এটা কি বর চাইলেন?
যান এবার শিবের কাছে গিয়ে এমন কিছু বর চান,যাতে আপনার মঙ্গল হয়।
ব্রাহ্মণ শিবের কাছে এসে বললেন, 'হে প্রভু আমি যেন দাবা খেলায় কখনও কারও কাছে না হারি।'
শিব বললেন, তথাস্তু।
ব্রাহ্মণের এই বর চাওয়া দেখে, কার্তিক গনেশ খুব বিরক্ত হলেন।কোথায় নিজের মঙ্গলের জন্য কিছু চাইবেন,তা না করে হাবিজাবি বর চাইলেন ব্রাহ্মণ।তারা ব্রাহ্মণ কে বললেন, আপনি খুবই ভাল মানুষ, তবে বড্ড বোকা।
বলে তারা সকলে বিদায় নিলেন।
তারপর বহুদিন কেটে গেছে।ব্রাহ্মণের বয়স যখন আশি, হেমন্তের এক পাতাঝরা রাতে, তার দরজায় কে কড়া নাড়ল।ব্রাহ্মণ দরজা খুলে দেখেন,সামনে কালো কদাকার কুৎসিত একজন দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে।
ব্রাহ্মণ বলল,কি চাই?
- আমি যমদূত,আপনার জীবনের মেয়াদ শেষ, আপনাকে নিয়ে যেতে এসেছি।
ব্রাহ্মণ বললেন, বেশ আমি প্রস্তুত হয়ে আসি, আপনি এই টুলে ততক্ষণ বিশ্রাম করুন।
যমদূত বলল, ঠিক আছে, আপনি তাড়াতাড়ি করুন।
ব্রাহ্মণ একটু মুচকি হেসে বললেন, বেশ।
একটু পরেই ভাল জামা কাপড় পরে বেরিয়ে এসে বললেন, চলুন তবে।
যমদূত যেই টুল থেকে উঠতে গেল, কিছুতেই পারল না।
সে খুব রেগে গিয়ে বলল, এ আপনি কি করেছেন?
ব্রাহ্মণ হেসে বললেন, ওটা মন্ত্রপূত টুল।
আমি না বলা পর্যন্ত উঠতে পারবেন না।
রাগে দুঃখে যমদূত বলল, আপনি কি চান?
- আগামী একশ' বছর আপনি আমার ধারে কাছে আসবেন না।
- ঠিক আছে, বলে যমদূত বিদায় নিল।
একশ' বছর পর আবার যমদূত এসে হাজির হল।বলল,আপনি তাড়াতাড়ি প্রস্তুত হয়ে নিন,আমি অপেক্ষা করছি।
- বেশ, আপনি ততক্ষণ বরং গাছের কয়েকটা আম খান,আমি তো চলেই যাব, কে আর এ'সব খাবে?
যমদূত দেখলেন,গাছে আমগুলি পেকে সিঁদুরে রঙ লেগেছে।সে লোভে পড়ে গাছে উঠে কয়েকট আম পেড়ে খেয়ে দেখলেন,
অপূর্ব স্বাদ,গন্ধে মনটা ভরে যাচ্ছে।
একটু পরেই ব্রাহ্মণ এসে বললেন, চলুন এবার।
যমদূত গাছের থেকে আর নামতে পারে না।সে রাগে দাঁত কিড়মিড় করে বলে উঠল, কি করেছেন আবার?
ব্রাহ্মণ হেসে বলল,এটা মন্ত্রপূত গাছ,আমি না বলা পর্যন্ত নামতে পারবেন না।
যমদূত রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলল,কি চান আপন?
- একশ' বছর যেন আপনার মুখ দেখতে না হয় আমায়।
যমদূত ঠিক আছে বলে, রাগে দুঃখে বিদায় নিলেন।
একশ' বছর পর আবার যমদূত এসে হাজির।এবার সে সাবধান ও সতর্ক খুব।
এবার সে কোন ভুল করবে না আর।
ব্রাহ্মণ দাবার ছক আর ঘুটিগুলো নিয়ে বেরিয়ে এলেন।পিছে ফিরে বাড়িটার দিকে তাকালেন।প্রায় তিনশ' বছর এই বাড়িটার সাথে তার নাড়ির টান।বড় মায়াটান অনুভব করলেন,বিষন্ন আবেগ তাকে গ্রাস করল।
যমদূত দাবার ছকটা দেখিয়ে বললেন, কি ব্যাপার এটা সঙ্গে নিয়েছেন কেন?
- অনেক দূরের পথ,ক্লান্ত হয়ে গেলে, গাছের ছায়ায় জিরিয়ে, একহাত দাবা খেলে নেওয়া যাবে।
যমদূত বলল,আমি তো কোন বাজি ছাড়া দাবা খেলি না।
ব্রাহ্মণ বলল,বেশ তবে তাই হবে।কি বাজি?
যমদূত উপহাসের সুরে বলল,আমি যদি জিতি তবে তোমার আত্মাটা আমাকে দিতে হবে।
ব্রাহ্মণ বললেন,আর যদি আমি জিতি?
- আপনি যা চাইবেন,তাই পাবেন।
- আমাকে নরক থেকে একশ' আত্মা এনে দিতে হবে।
যমদূত ব্যাঙ্গের সুরে বলল,বেশ তাই হবে।
তার আত্মবিশ্বাস উপচে পড়ছিল,তার চেয়ে দক্ষ আর কেউ নেই যে তাকে হারাতে পরে না দাবা খেলায়।
ব্রাহ্মণের কাছে ছিল,শিবের দেওয়া বর।
প্রথমবার যমদূত কিছু বোঝার আগেই হেরে গেল।একশ' আত্মা যমালয় থেকে ছাড়া পেল।আবার খেলা শুরু হল।আবারও হারলেন।আরও একশ' আত্মা ছাড়া পেল।যমদূত যত খেলায় হেরে যেতে লাগল,তত তার রোখ আরও মনে চেপে বসল।এইভাবে হারার পর আর দেবার মতো কোন আত্মা সেখানে রইল না। যমালয় সম্পূর্ণ খালি হয়ে গেল।
ব্রাহ্মণ বলল,তবে এখানেই আমাদের যাত্রা শেষ।যমদূত কোন উত্তর দিল না।
ব্রাহ্মণ সব আত্মা নিয়ে এবার চলল স্বর্গের দিকে।স্বর্গের দ্বারে এসে পৌঁছাতেই দ্বাররক্ষী আটকালো তাকে।
ব্রাহ্মণ নিজের পরিচয় দিলেন।সব শুনে দ্বাররক্ষী বলল,ঠিক আছে,এতজনকে নিয়ে তো আপনি ঢুকতে পারবেন না।
আপনি একা ঢুকতে পারেন।
ব্রাহ্মণ বললেন,ঠিক আছে।আপনি একবার ব্রহ্মার কাছে একটা কথা জিজ্ঞাসা করে আসুন।
দ্বাররক্ষী বললেন, কি?
ব্রাহ্মণ বললেন,এক শীতের রাতে তিনি তার চার সঙ্গী নিয়ে আমার বাড়িতে এসেছিলেন,আমি তাদের আপ্যায়ণের কোন ত্রুটি করিনি,আজ আমি আমার সাথীদের নিয়ে এসেছি বলে,আমাকে একা স্বর্গে ঢুকতে হবে,তা'হলে কি আমি মনে করব,আমি ঈশ্বরের চেয়েও মহান?
দ্বাররক্ষী বলল,ঠিক আছে আমি এক্ষুনি যাচ্ছি।
কিছুক্ষণ পর দ্বাররক্ষী ফিরে এসে স্বর্গের দ্বার খুলে দিয়ে,গম্ভীর স্বরে বললেন,প্রভু আপনাদের সকলকেই ঢুকতে বলেছেন।
ব্রাহ্মণ নিঃস্বার্থ বুদ্ধির জোরে সকলকে নিয়ে সানন্দে স্বর্গে ঢুকলেন।
------------------------------
অলঙ্করণ :- প্রিয়াঙ্কা সরকার