বৃষ্টি এলো - রাণু শীল

 

বৃষ্টি এলো
 রাণু শীল
 

 




প্রায় চলন্ত বাসে উঠে পড়লো শঙ্কর। বেশি ভিড় নেই আজ। গরমটা খুব পড়েছে, এ বছর। একেবারে পিছনের সিটে বসা মহিলার দিকে চোখ চলে গেল। একভাবে জানলার দিকে মুখ করে বসে আছেন। বোঝা যাচ্ছে, দেহটা এখানে থাকলেও মনটা নেই। এরকম মানুষই তো চাই ওর। 
            একটা সিট ফাঁকা হতেই বসে পড়লো। ও সচরাচর বসেনা। পাশের সিটে লোক থাকলে তো নয়ই। আজ বসলো।পা টা মুচকেছে। ব্যথাও করছে একটু। যদিও ওদের প্রফেশনে এসব ব্যথাট্যাথা পাত্তা দিলে চলেনা। শঙ্কর এবার ভালোভাবে লক্ষ্য করলো মহিলাকে। 
              দামী শার্ট আর ফরম্যাল প্যান্ট পরা, বয়স সাঁইত্রিশ-আটত্রিশ হবে বলে মনে হলো। ব্যাগটা কোলের ওপর রাখা। ওটাও বেশ দামী। কিন্তু সাধারণতঃ এই ধরনের ব্যাগ নিয়ে অফিসে যায় না কেউ। এঁরা বাসে ওঠেন না। নিশ্চয়ই কোনোও সমস্যায় আছেন। কোনোও প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করেন সম্ভবতঃ। কিন্তু গলায় কোনো আই কার্ড নেই। তার মানে সরাসরি অফিস থেকে নাও ফিরতে পারেন। অথচ আজ বৃহস্পতিবার। শঙ্কর ওর সস্তা ডিজিটাল ঘড়িতে দেখলো, আটটা বেজে তিরিশ। ওর অভিজ্ঞতা থেকে ও জানে , ইনি নিশ্চয়ই অফিস থেকে অন্য কোথাও গিয়েছিলেন। অর্থাৎ ঐ ব্যাগে, শুধুই অফিসিয়াল কাগজপত্র নেই। 
****************
চয়নিকা বেছে বেছে সবচাইতে পিছনের সিটেই বসেছে। একটু  নির্জনতা দরকার ওর। ভালো লাগছেনা মানুষ । গাড়িটাও বেছে-বেছে এখনই বিগড়োতে হলো। কোনোও ট্যাক্সিতে যেতে গেলে বেশ ভাড়া লেগে যেতো। অফিস থেকে পাওয়া, তাই গাড়ি চড়া। নাহলে, এখন বাড়তি খরচের সময় নয় ওর। বেশকিছু ই.এম.আই. দিতে হয় তাকে।একা হলেও, বাসস্থান তো চাই একটা.…তাছাড়া এতদিন তো......

অফিসে ওর বন্ধু বিশেষ কেউ নেই। ও নিজেই ওর চারিদিকে, একটা কাচের পাঁচিল তুলে রাখে। চেনা লোক তবু সহ্য হয়। কিন্তু বন্ধুবেশীরা বেশ বিপজ্জনক। ওর একেবারে মনের মত না হলে, ও বন্ধুত্ব করেনা।

এই তো সেদিন, ছুটির পর, বেরিয়ে রোজকার মত গিয়েছিল, সামনের দোকানে, চা আর টোস্ট খেতে। এমন সময়, গম্ভীর একটা গলা বলেছিল,
----- বড় অশান্তি আপনার মনে, তাইনা ?
চমকে উঠেছিল, চয়নিকা। বলেছিল,
----- কেন বলুন তো !
----- এক কাপ চা খাওয়াবেন ? কথা ছিল।

চয়নিকা মনে মনে শঙ্কিত হয়েছিল। লোকটার চেহারায় যেটা আছে, সেটা বেশ সংযত ভদ্রতা।ডোরাকাটা পাঞ্জাবী আর একমুখ কাঁচাপাকা দাড়িতে, বেশ একটা ইন্টালেকচুয়াল লুক। চোখদুটো অসম্ভব উজ্জ্বল। কেন কে জানে চয়নিকা না করতে পারেনি। না করার কারণও ছিল না, খুব একটা। বলল,
---- নিশ্চয়ই, আসুন।
দুকাপ চায়ের সাথে এক প্লেট ভেজ পকোড়া অর্ডার করেছিল।
টেবিলের উল্টোদিকে বসেছিল লোকটা। যেন বেশ অন্যমনস্ক হয়েই বলেছিল,
---- বড় একা আপনি। জানেন, আমি একাকীত্বের গন্ধ পাই। সব কষ্ট কমে যায়, যদি ঠিকঠাক কারোর সাথে, ভাগ করে নেওয়া যায়। একটা জিনিস সঙ্গে রাখবেন? 
----- কী বলুন তো !
একটা ছোট্ট লাল ভেলভেটের থলি বার করে, এদিক ওদিক দেখে, ওটা উপুড় করতেই, টেবিলে একটা ঘষা ঘষা নীল পাথরের আংটি.... সাইজে একটা মটরদানার মতো পাথরটা। বলেছিল,
----- এটা সাথে রাখুন। পরে থাকুন।  সব ঠিক হয়ে যাবে।

ওটা দেখে মনে হয়েছিল বেশ অদ্ভুত পাথর।যদি হতাশাটাও একটু কাটানো যেতো..... দেখাই যাক, আর কী বা খারাপ হবে!!

এরপর ওর অতীতের অনেক কথা ঠিকঠাক বলেছিল লোকটা। বলেছিল, এ নাকি ওর ঈশ্বর প্রদত্ত বিশেষ ক্ষমতা। গুরুর আদেশ, অন্তত চারজনের দুঃখ কমাতে পারলে, ওকে নাকি একটা গুঢ় বিদ্যা দেবেন, তাই সত্যিকারের দুঃখী মানুষ খুঁজছেন । ইত্যাদি ইত্যাদি....

সত্যিই কী ঐ পাথরের এতোটাই ক্ষমতা ? নাকি সবটাই জোচ্চুরি ? সত্যিই কী অতীত ভবিষ্যৎ দেখতে পাওয়ার মতো ক্ষমতা কারোর থাকতে পারে ? কিন্তু কীকরে ঐ লোকটা ওর সব কথা ঠিকঠাক বলে দিলেন !! বলেছেন, কাজ হলে, তবেই দাম নেবেন। চয়নিকা যেখানেই থাকুক, ওকে ঠিক খুঁজে নেবেন। এ ও কি ঐশ্বরিক ক্ষমতা !! হবেও বা। কিছুই আর অবাক করেনা আজকাল। চয়নিকা চায়ের দাম মিটিয়ে দোকান থেকে বেরিয়ে আর দেখতে পায়নি লোকটাকে। যেন ভোজবাজির মতো উবে গিয়েছিল সে। 

আজ আর এটার প্রয়োজন নেই। যার জন্য কষ্ট ছিল, সেই শায়ন আর নেই। যেদিন শায়ন দুটো পা খুইয়ে, হাসপাতাল থেকে বাড়ি এসেছিল, সেদিন চয়নিকার সাহস ছিল, দুর্ভাগ্যের সাথে লড়বার। শায়নের ধ্বংস হয়ে যাওয়া মনকে আবার গড়ে তোলার। কিন্তু, ঐ এক্সিডেন্ট শুধু পাদুটো নয়,নিয়েছিল ওর আত্মবিশ্বাসও। ধীরে ধীরে, শায়নের সাথে গভীর হতাশায় ডুবে যেতে যেতে শেষ হয়ে যাচ্ছিল চয়নিকাও। 

সেদিন, পরে নিয়েছিল চয়নিকা আংটিটা। দেখিয়েওছিল শায়নকে। অন্তত ও বুঝুক, চয়নিকা ওর জন্য আগের মতোই ভাবে। নাহলে, সায়নিকা পাথর ফাথরে কোনোও দিন বিশ্বাস করেনা। এরপর, দ্রুত, অতি দ্রুত , অসুস্থ হয়ে পড়তে থাকে, শায়ন। ভেবেছিল, ওটা খুলে ফেলে দেবে। কিন্তু কী আশ্চর্য.....
কে যেন ভেতর থেকে বলেছিল,
------ কিসের আশায়, ফেলে দেবে ? 
সহসা মুক্তির স্বাদ চেয়েছিল মনটা। এখন লজ্জা হয় ভাবলে, লজ্জা হয়। তাকাতে পারেনা আয়নায়। ও কি সত্যি খুনী ? মাত্র পনের দিনের মধ্যেই চলে গেল শায়ন....….

তাই আজ ফেলেই দেবে আংটিটা। সঙ্গে নিয়েই বেরিয়েছে। কেন কেজানে একবার ঐ দোকানটায় যেতে ইচ্ছে করল। যদি লোকটি আসে ? তাই অফিস থেকে বেরিয়ে অনেকক্ষণ বসেছিল, সেখানে। ফেলতে পারেনি ওটা।
**************
 
বাসটা যতগুলো স্টপেজে দাঁড়াচ্ছিল, শঙ্কর লক্ষ্য রাখছিল। মহিলা ব্যাগটা বেশ যত্ন করে ধরে আছেন।
বোঝা যাচ্ছে, কিছু রয়েছে তাতে। অনেক সময় ভুলও হয়। তবু ঝুঁকি তো নিতেই হয়। এসব শেখা আছে শঙ্করের। ওদের শেখানো হয়, কিভাবে না মরে, মার খেতে হয়। কিভাবে ঝরে পড়া রক্তটা শক্ত করে রুমাল বেঁধে বন্ধ করতে হয়। কিভাবে দিনের শেষে ব্যথা চেপে,গভীর ঘুমে তলিয়ে যেতে হয়। 

মহিলাকে উঠতে দেখে, শঙ্কর সচেতন হলো। দরজার কাছ অবধি যেতে দিল। উঠে মহিলার গা ঘেঁষে দাঁড়ালো। অস্বস্তিতে একটু অন্যমনস্ক হবেনই। আর তখনই.....

***********
 
চয়নিকার সিক্সথ্ সেন্স বলল, কিছু একটা গন্ডগোল।  ভিড় এমন কিছু নেই, অতএব ছেলেটির গা ঘেঁষে দাঁড়ানোটা ইচ্ছাকৃত। ও একটু সরে গিয়ে, বাঁ কাঁধে ব্যাগটা নিয়ে, হাতটা ওপরে তুলে রড ধরলো। মোবাইলটা সামলাবার জন্য ডান হাত পকেটে দেওয়া মাত্রই ছেলেটা আচমকা টান মারলো ব্যাগ ধরে, হাতটা রড থেকে খসে যেতেই, চলন্ত বাস থেকে ব্যাগটা নিয়ে নেমে গেল..…

সবাই চেঁচিয়ে উঠলো, পকেটমার!! পকেটমার!! বাস থেমে গেল। সবাই চয়নিকাকে জিগ্যেস করতে লাগলো, 
----- কী কী ছিল ব্যাগে ? 
----- পুলিশে রিপোর্ট লেখান.…
----- দূরমশাই !! পুলিশ কী করবে ?
----- হ্যাঁ, নিজের জিনিস নিজে ঠিক করে সামলাতে পারেননা ?
----- ছেলেটা কোথা থেকে উঠেছিলো !!

চয়নিকার কোনোও কথা মাথায় ঢুকছিলনা। ও নেমে, পথ চলতি একটা অটো পেয়ে গেল।  তাকেই সব বলতে, ঝালমুড়ি ওয়ালার দেখানো পথে দ্রুতগতিতে ছুটলো। 

**************

শঙ্কর  আজ  ছুটতে পারছেনা ভালো। কেজানে, ওরা ধাওয়া করে আসছে কিনা !!  একটা অটোর শব্দ যেন। ও একটা সরু গলিতে ঢুকে, দেওয়াল ঘেঁষে দাঁড়ালো। এখান থেকে লক্ষ্য করতে পারবে, কে এলো !!

চয়নিকার অটো এসে যেখানে দাঁড়ালো, সেখান থেকে তিনটে সরু গলি চলে গেছে তিন দিকে। অটোওয়ালা বলল,
------ দিদি, আর কোথাও যাওয়া যাবেনা। বেশিক্ষণ দাঁড়াব না। আমি এসব জায়গায় আসিনা। 

চয়নিকা নামলো। ও ঠিক দেখেছে, ছেলেটা এখানেই এসেছে। একটা পা টেনে টেনে ছুটছিল যেন। এখানেই এসেছে। এদিকেই.....অটোটাকে ছেড়ে দিল। ভাবলো, কী বা হবে ! গেছে যাক। কিন্তু ব্যাগটাতে কিছু ডক্যুমেন্টের জে়রক্স ছিল।

বস্তি এলাকায় এর মধ্যেই পানের আসর বসে গেছে। হলুদ আলোয় , এ যেন অন্য জগৎ। টিন, বেড়ার ছোটো ছোটো ঘরে, বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে ভরপুর সংসার। হাসাহাসিও করছে কেউ কেউ নিজেদের মধ্যে। টিউব ওয়েলে জল নিতে নিতে এক বৃদ্ধা গজগজ করছিল, 
------ রাত হলো কি! মুখপোড়ারা যেন সগ্যে উঠে যায়। আরেবাবা! পয়সা থাকলে দুটো মিষ্টি কিনে খা!! তা নয়......

একটা ঘর থেকে গুনগুন করে পড়া মুখস্থের শব্দ আসছে।  উল্টোদিকের ঘরে, বাজারচলতি হিন্দি সিনেমার গান। দেওয়ালের আড়ালে প্রেম, একাকী বৃদ্ধ, পরেরদিনের ফুচকা তৈরিতে ব্যস্ত মাসি.....

ফিরে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই, চোখে পড়লো, দেওয়ালের পাশ থেকে, একটা চোখ ওকে লক্ষ্য করছে। না দেখার ভান করে পিছন ফিরল, চয়নিকা। 
*************
 
শঙ্কর মনে মনে খুশি হলো। মনে হচ্ছে, আজ তার কপাল ভালো। হ্যাঁ ভালো, যদি না ডুডুদা আসে। অনেকদিন দেখা নেই। কবে যে উদয় হবে, আর সবকিছু কেড়ে নেবে, ঠিক কী ? ভাবতে ভাবতে ঘরের দিকে চলল শঙ্কর। বেশ খোঁড়াচ্ছে এখন।

চয়নিকার মনে হলো, পাথরটা যদি, এ ছেলেটার কোনোও ক্ষতি করে ? ও শঙ্করকে অনুসরণ করল। শঙ্কর একটা ঘরের শিকল তোলা দরজার সামনে দাঁড়াল। শিকল খোলা মাত্রই, একটা ক্ষীণ পুরুষ কণ্ঠ বলল, 
------ কি রে, এলি বাবা !!
চয়নিকা পা টিপে টিপে গিয়ে উঁকি দিলো ঘরে।
শঙ্কর নরম গলার বলল, 
----- এখনও বেঁচে আছো ? কি এতো প্রাণশক্তি তোমার বাবা ! প্রতিদিন মনে হয়, এসে দেখবো, তুমি মরে গেছো। 
বলে পরম স্নেহে হাত বুলিয়ে দিল রহিতকেশ বৃদ্ধের মাথায়। 

চয়নিকার ঘাড়ে একটা ঠান্ডা ধাতব স্পর্শ। একটা বিশাল দেহী মানুষ, ওর হাতদুটো পিছনে বেঁধে দিল, যেন দড়ি কেটে বসে গেল, কব্জিতে। ঠেলে ঢুকিয়ে দিল ঘরে। বলল,
----- এই শালীটা তোর দরজার বাইরে কি করছে রে !! পুলিশের ইনফরমার নাকি!! হ্যাঃ হ্যাঃ হ্যাঃ
—— না, ও আমার ব্যাগ নিয়ে এসেছে—— ঠান্ডা গলায় বলে চয়নিকা। 
---- তাই নাকি !!
---- ওকে ছেড়ে দাও ডুডুদা। আমি সব দিয়ে দিচ্ছি। 
শুধু বাবাকে খাওয়াতে দাও। 

চয়নিকার দিকে তাকিয়ে, ডুডু নামক বস্তুটার কি মনে হলো কে জানে! জোরে একটা ধাক্কা দিয়ে বসিয়ে দিল একমাত্র টুলটায়। দড়ি খুলে দিল।
টাকাপয়সা নিয়ে ব্যাগটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে,
ওরা বেরিয়ে গেল।
চয়নিকা ঘুরে দাঁড়িয়ে তাকালো,সোজা শঙ্করের চোখের দিকে। হাসলো একটু। ভালো কাজ পেলে, করবে ? শঙ্কর ঘাড় নাড়ে, ---- ডুডুদা যেতে দেবেনা----
------ তোমার কষ্টের কারণ কে ?
------ ঐ শালা শয়তান ডুডু !! না বাঁচতে দেয়, না মরতে.....

চয়নিকা ব্যাগের ভেতরের ছোট্টো পকেট থেকে আংটিটা বার করল। শঙ্করকে বলল, 
------ পরে নাও। হাজার অভাবেও বিক্রি করোনা। এটা আমি ফেরৎ নেব। তোমার জন্য ভালো সময় অপেক্ষা করছে।

একটু হেসে পা বাড়ায় চয়নিকা। দেখাই যাক পাথরের কত শক্তি !...…ওদের অফিসে একটা দারোয়ানের টুল ফাঁকা হয়েছে । ওটা রেখে দেবে শঙ্করের জন্য....বড়ো আরাম লাগে ফাঁকা হাওয়ায়,
একফোঁটা জল পড়লো যেন! আকাশ আজ আদর পাঠাচ্ছে ফোঁটায় ফোঁটায়!....ফাঁকা রাস্তায় অঝোর বৃষ্টিতে ভিজে হাঁটতে ভালো লাগছে চয়নিকার।
...................................
 অলঙ্করণ :- সহিষ্ণু কুড়ি