ফরেস্ট গার্ড - তপন বন্দ্যোপাধ্যায়

 ফরেস্ট গার্ড
তপন বন্দ্যোপাধ্যায়


 


চোখদুটো ঢুকে গেছে কোটরের মধ্যে, মণিদুটা দেখাই যায় না প্রায়, মুখের চামড়া শুকিয়ে কিসমিস, গলার হনু বেরিয়ে আছে টিয়াপাখির ঠোঁটের মতো, হাঁটাচলার সময় শরীর বেঁকে থাকে সামনের দিকে। গায়ে ছেঁড়াখোঁড়া একটা চেক-চেকশার্ট, কয়েক খণ্ড হাড়ের উপর চলচन করে ঝুলছে শার্টটা। পরনে হাঁটুসাের ময়লা ধুতি। ধুতির বাইরে সরু লিকলিকে দুটি পা। পা, না কি পাটকাঠি!
তবে হাতের মুঠোয় একটা লাঠি। সেটা বেশ জবরদন্ত চেহারার। হাঁটার সময় তৃতীয় পায়ের মতো। আবার কখনও উঁচু করে ধরে কাকে যেন শাসায়।

লােকটি অশীতিপর, না নবতিপর তা এক্স-রে চোখে দেখেও ঠিক প্রত্যয় হল না। জঙ্গলের মধ্যে সুঁড়িপথ বেয়ে চলেছি তো চলেইছি। উত্তরবঙ্গের রিজার্ভ ফরেস্ট-ভার ভিতরে কিছু দুর্লভ গাছ আছে, কিছু বহু পুরোনাে গাছ- তাদের খবর নিতে আমার এই খেয়ালিযাত্রা।
ডিভিশনাল ফরেস্ট অফিসারকে ফোন করতে তিনিই সুলুকসন্ধান দিলেন এই আশ্চর্য চরিত্রটির।বললেন, রাজাকে বলে দিচ্ছি। রাজার সঙ্গে জঙ্গল দেখার মজাই আলাদা।
 রাজা একজন ফরেস্ট গার্ড। বললেন, পুরােনো দিনের মানুষ। গাছের ঠিকুজিকুষ্টি মুখস্থ।

রাজা নাম শুনে তখনই কৌতূহল হয়েছিল, দেখার পর আরও। ফরেস্ট গার্ডটির সঙ্গে আলাপ জলপাইগুড়ির এক সংরতি জঙ্গলে বেড়াতে গিয়ে। যৌবনকালে কেমন দেখতে ছিল তা টাইম মেশিনে  গিয়েও উদ্ধার করতে পারল না আমার মগজ। তার পিছু পিছু হাঁটছি। ওর হাঁটা মানে খুরখুর করে ইঁদুরের পায়ে হাঁটা। আমি তার পাশে লম্বা লম্বা পায়ে।

-"এই যে গাছটা দ্যাখছেন শিশু। শিশুর বয়স কিন্তু চার কুড়ির কম না। চার কুড়িতেও শিশু। রগড় কম না। কী বলেন? আমারও তাে চার কুড়ি, না পাঁচ কুড়ি কে জানে। আমারে লােকে শিশু বলবে? বলবে বুড়াের হদ্দ।"

বলে খকখক করে হাসিহাসি। তাকে উৎসাহ দিতে বলি, মানুষর বয়স তার মনে, শরীরে নয়। আমার তাে আপনাকে দেখে শিশুর মতোই সরল মনে হচ্ছে।

শুনে রাজার মুখে আবার  খকখক করে হাসি। মুখগহরে একটিও দাঁত নেই। ফোকলা মুখের হাসির কি  তুলনা হতে পারে ভাবছিলাম। কৃষ্ণগহবর শব্দটা  উঁকি দিয়ে গেল এক ঝলক।

তার নাম রাজা রায়। আসল নাম কি ছিল তা সেই গার্ডটিও মনে করতে পারলেন না। শতায়ু হওয়ার  লক্ষ্যে ধাবমান এই মানুষটি উত্তরবঙ্গের এই জঙ্গলে কাজে ব্যস্ত আছেন তিন কুড়ি বছরের উপর। সেই যেবার তার বাবা দশরথ রায় মারা গেলেন সাপের ছোবল খেয়ে, তার পদে 'ডেথ ইন হারনেস' কোটায়। অনেকেই দশরথকে বারণ করেছিল, 'দশরথ,ওই শিশুগাছটার চারপাশে যে ঝোপ-জঙ্গল টা বেশি ঝুপসি হয়ে আছে, ওখানে তুমি একা পরিষ্কার করতে যেয়াে না। কদিন আগেই সাপ দেখা গেছে ওখানে,আগে কার্বলিক অ্যাসিড আসুক, শহর থেকে দু'একদিনের মধ্যে এসে পৌঁছাবে, তারপর সবাই মিলে লেগে পড়ব'কনে।'  কথা না শোনার মাশুল দিয়েছিলেন দিয়েছিলেন দশরথ প্রাণ দিয়ে। তার জায়গায় বহাল হয়েছিল রাজা। রাজা নামটা তাকে দিয়েছিলেন তখনকার  বিট অফিসার দুর্লভ বাবু। তিনি বেশ দিলদার স্বভাবের মানুষ ছিলেন। রাজাকে দেখলে অনেক ছোট বয়স থেকেই। বেশ ফুটফুটে চেহারা ছিল রাজার। সাহসও ছিল খুব। বাবার সঙ্গেয় জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতো এতাল বেতাল। তাই রাজা।

দুজনে হাঁটতে হাঁটতে আরো একটা বিশাল গাছের সামনে।
ছার, এই গাছটা দ্যাখছেন, এটা মাদার। দ্যাখছেন সারা শরীরে শয়ে শয়ে লাল ছানাপোনা। কোলে- কাঁখে-ঘাড়ে- মাথায় এমনকি হেঁটো ভর্তি ছানাপােনা। সব শরীলে ধরি রেখেছে। কারুক্কে ফেলতি পারে না। মায়ের মন তো।

আশ্চর্য হচ্ছিলাম ফুলন্ত মাদারের এহেন উপমা শুনে। স্টে মন্দার বলে, কেন মান্দার। মগডাল থেকে প্রায় গুঁড়ি পর্যন্ত লাল ফুলের সম্ভাবে অত বড়াে শরীরটা অস্থির। ফুলগুলি সত্যিই যেন ঝুলে আছে বাচ্চাদের মতো।

আবারও হাঁটছি। সামনে পিছনে ডাইনে বাঁয়ে সর্বত্রই শুধু সবুজ আর সবুজ।

কত চারা গাছ। কত গুল্মলতা।
-ছার, এই যে ছােটো ছোটো গাছগুলাে দ্যাখছেন, এগুলাের কোনও নাম নেই। শয়ে শয়ে হয়ে আছে জঙ্গল ভর্তি।এরা হলেন বাবুর বাড়ির রাঁড়ের মতো। এরা না থাকলি বড় গাছগুলাের মহিমা থাকে না।

বাহ, রাজা রায়ের বর্ণনার মহিমাও কম নয়। চারাগাছগুলাের দিকে চোখ রাখি। বড়ো গাছগুলাের
মধ্যে এগুলাে ঝোপ-ঝােপ হয়ে জঙ্গলের সবুজকে এক অন্য মাত্রা দিয়েছে। এগুলাে না থাকলে কীরকম
ন্যাড়া ন্যাড়া লাগত এত বড়াে জঙ্গল।
আবারও ঘুরছি জঙ্গলের এ পথে ও পথে। কত রকম ঘাস, গুল্মলতা।

এই যে শিরীষ গাছটা দ্যাখছেন, স্যার, এর বয়স আট কুড়ি। কী বে আক্কেলে গাছ দেখুন, তার ঝাঁকড়া শরীর আকাশমুখাে উঠে গিয়ে সারাদিন আকাশই দেখে, নীচের দিকে কী ঘটে গেল না গেল সেদিকে তাকানাের ফুরসত নেই।

-কেন,কি হয়েছে। নীচের দিকে কী? ফরেস্ট গার্ডটির কথায় বেশ রগড় অনুভব করি। ফরেস্ট গার্ডটি আমাকে নিয়ে গেলেন গাছটার নীচের দিকে। সেখানে চোখ পাততেই আমার রীতিমতাে চমকানাের পালা। কয়েকহাজার কিংবা কয়েক লক্ষ লাল পিঁপড়ে বাসা বেঁধে আছে কতকাল কে জানে,হয়তো দীর্ঘকাল। দৃশ্যটি প্রথম দর্শনে বেশ চমকপ্রদ। একটা বিশাল আকারের অমৃতি যেন  কিংবা সমুদ্রপারে  বালুর উপর মেলে রাখা  বিশাল একটা কমলা- লালে মেশানাে ছাতার মতো। গাছটার নীচে চারপাশে বিছিয়ে তাে আছেই, কাণ্ড বেয়ে উঠেছে ফুট দুয়েক। পিঁপড়েদের শৃঙ্খলাপরায়নতা গিনেসবুকে উঠেছে নিশ্চয়ই। সেভাবেই সার দিয়ে ঝাঁক বেঁধে আছে গােটা কান্ড ঘিরে। চলাফেরাও করছে সার দিয়ে।

জিজ্ঞাসা করি, তা এতে গাছের কান্ড নষ্ট হবে না?

-কেন হবে না ছার, নেহাত গাছ বলে,মানুষ হলে এতক্ষণ চ্যাঁচাতো হিক্কার ছেড়ে।

-তা আপনারা কোন  ব্যবস্থা নিচ্ছেন না?

-কেন নেব না, ছার। এখন তো গ্রীষ্মকাল। এ সময় প্রত্যেক বছর হয়। পেস্টিড আনতে দিয়েছি। এলেই...

পেস্টিড নানে পেস্টিসাইড। যতদিন না আসে ততদিন এই পিঁপড়েরা সুখে ঘরসংসার করবে শিরীষগাছকে জড়িয়ে ধরে, ততদিন রাজা রায়ের  ভাবনাও যন্ত্রণায় পিষ্ট হবে।

সেই রাজার বয়সও  হয়ে গেল অনেক। ঠিক কত তা মনে করতে পারেন না রাজা রায়। ছোট থেকে এই জঙ্গলে তার বসবাস। জঙ্গলে তন্নতন্ন ঘুরে জঙ্গলের প্রতিটি গাছই তার চেনা। প্রতিটি ঝোপ জঙ্গল উল্টে-পাল্টে দেখেন হাতের লাঠিটা দিয়ে। কিছু  বেকায়দা দেখলে উবু হয়ে বসে দেখতে থাকেন জায়গাটা। অঘটন ঘটলে খবর দেন বিট অফিসারকে। বাবার মতই রাজারও জঙ্গল অন্ত প্রাণ। এরকমই চলছে আজ কত বছর।

বয়সের প্রসঙ্গ তুলতেই মুখ কাঁচুমাচু করে বলে ওঠেন, আসলে কী হয়েছে ছার। সেবার সার্ভিস বুক খোলা হল  অফিসে। তা বড়বাবু বললেন, 'তাের বয়স কত রাজা?'
তো বললাম, 'কোনও  সার্টিফিজ তো নেই। যা হােক লিখে দ্যান।লিখুন কুড়ি।' ব্যস লেখা হয়ে গেল বয়স। আমার বয়স যে ঠিক কত আমিও তাে লিখে রাখিনি কোথাও।

-"তাহলে আপনার রিটায়ার হতে ঢের দেরি?"

-"কী জানি, ছার। অফিসের বাবুরা জানে ঠিক কত, খাতায় লেখা আছে।" বলে মিটিমিটি হাসে একমাথা শননুড়ির মতো চুলওয়ালা ফরেস্ট গার্ড টি।

-তবু? আমি নাছোড়বান্দা হই।

রাজা রায়  হঠাৎ হেসে বললেন, ছাট হয়নি বােধহয়, ছার। ছাটে তো রিটায়ার।
একটু অবাক হই, এখনও ষাট হয়নি?

-"ছাট হতে এখনও অনেক দেরি ছার। আগের বড়বাবু ছিলেন আমার চেয়ে ঢের কম বয়সের। তিনি রিটারায়  হয়ে গেছেন। নতুন বড়বাবুও  বললেন, কি রাজাবাবু আপনি তো আমারও পরে রিটারায় করবেন।"
-"তাই নাকি!! তাহলে তো আপনার অখন্ড পরমায়ু প্রয়োজন। নইলে তো রিটায়ার  হবেনই না।
রাজা রায় হাসলেন।কি অদ্ভুত সেই হাসি।বললেন," ছার, আমি রিটারায় করলে এই গাছগুলোর কি হবে? নতুন গার্ডরা তো পড়ে পড়ে ঘুমায়। তখন কেউ দেখবার থাকবে না এদের। এই যে দেখছেন শিরীষ, শিশু, অর্জুন, শাল সেগুন, এদের কী হবে তখন! সব বেঘোরে পড়ে মারা যাবে যে!"

সত্যিই তো! কি হবে এত সব গাছের!!

-"জানেন বাইরে থেকে গাছ চোররা প্রায়ই  বেড়া টপকে ভিতরে ঢুকতি চেষ্টা করে। এই যে দ্যাখছেন লাঠি, একবার উচোয় ধরলি সব পলায়ে পথ পায় না। বড়াে সাহেবরা বলে, রাজা, তুমি আছাে বলে জঙ্গলটা এখুনাে জ্যান্ত আছে। নইলে কবে ভােগে চলে যেত। চারদিকের বিশাল জঙ্গলে চোখ ঘােরাহ। মুহূর্তের মধ্যে উপলব্ধি করলাম যাবতীয় মহিরুহ, চারাগাছি,ঝােপঝাড়, ঘাসঘাসালি, গুল্মলতা সবাই যেন তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। একশাে-দেড়শাে বছরের
সাথী তারা। যদ্দিন রাজা রায় আছে, তারা নিশ্চিন্ত।

রাজা রায়ের মুখের কোঁচকানাের চামড়ার দিকে চোখ পাতি। জন্মের পর থেকেই এই জঙ্গলে তার বেড়ে ওঠা, কাজ করা। তার জীবনযাপনের সবটাই এই জঙ্গলে জঙ্গলে। এই জঙ্গল ছেড়ে চলে গেলে সেই বা থাকবে কী কবে, গাছগুলােই বা থাকবে কী করে! যতদিন সে বেঁচে থাকবে পাহারাদার হয়ে আগলে রাখবে এই বিশাল রাজত্ব।

...............................

 অলঙ্করণ :-  সহিষ্ণু কুড়ি