দ্য গ্রেট ইটালিয়ন জাকুজি - বৈশাখী রায়

 দ্য গ্রেট ইটালিয়ন জাকুজি

বৈশাখী রায়

 


 


সুজনের গায়ের সাথে প্রায় লেপ্টে গিয়ে খানিকটা নাক টেনে বকুল বললো,
"আঁশটে গন্ধ পাচ্ছো গো তুমি; আঁশটে গন্ধ? কোনদিক থেকে আসছে বলো তো?" সুজন বিরক্তই হলো একটু। তবে দ্বিতীয়পক্ষের সদ্য-বিবাহিত এবং কচি বৌয়ের ওপর রাগ দেখানো বারণ। সুজন তাই একটু নড়েচড়ে, ওপাশে ফিরে, নিতান্তই কেজো 
 সুজনের আনা বাটা অথবা ফুলকপি দিয়ে চারাপোনার ঝোল নামানো, রুটি আর মাখা আলুর সবজি ইত্যাদির চাপে সকালটুকু কোথায় যেনো হারিয়ে যায়। অথচ সরষের তেলে মাছ সাঁতলানোর সময় অথবা পিতলের থালায় ডাল, একটু আলুমাখা বা কাঁচা লঙ্কা রাখতে রাখতে বকুল বেশ টের পায় তার বুকের খাঁজে, বগলের নীচে, ঘাড়ে , গলায় তিরতির করছে কুচি কুচি ঘামের বিন্দু, টাকরা শুকিয়ে যাচ্ছে, শ্বাস আটকে আসছে বারবার!

সুজন তাই আঁচিয়ে নিয়ে , একটু মৌরি-মিছরি গলায় ফেলে, আলগোছে তাকে একটা চুমু দিয়ে যেই দরজার বাইরে পা দেয়, আর এক মূহুর্তও সময় নষ্ট করে না বকুল। নইলে পাশের বাসার নিমাইয়ের মা বহুবার বলেছে,
"ও কি অলুক্ষুণে কান্ড করো বৌ? সোয়ামী বেরোনোর সময় একটু পথের দিকে তাকাতে হয়, ঠাকুর দ্যাবতার নাম নিতে হয়, কত হাটঘাট পেরিয়ে যাচ্ছে বাছারা বলো দিকি! তা না, ঘরে সেঁধিয়ে থাকবে! " তবুও রা কাড়ে না বকুল। বরং তাড়াতাড়ি করে রান্নাঘরে এসে একটা এনামেলের বাটিতে খানিকটা খাবার সোডা, একটু মধু, ফুলেল তেল একটু আর সস্তার জোরালু শ্যাম্পু ভালো করে গুলে নেয়। দরজা বন্ধ করে জানালার পর্দা টেনে দেয়। ঠাকুরের আসনের পাশে রাখা ধুপকাঠির প্যাকেট থেকে টেনে বের‌ করে অনেকগুলো ধুপকাঠি জ্বালায় রোজ। তারপর শাড়ি ব্লাউজ খুলে, সায়াটা বুকের ওপর টেনে , দাঁতে কামড়ে ঢুকে পড়ে স্নানঘরে। প্রতিবার ঢোকার সাথে সাথেই একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়ে বকুলের, চোখ জুড়িয়ে আসে আবেশে। স্নানঘরের অর্ধেক জায়গা জুড়ে একটা সাদা রঙের স্নান করার গামলা, বকুল শুনেছে, সাহেবসুবোরা নাকি একে জাকুজি না কি একটা বলে। বহুকালের পুরানো গামলাটার গা থেকে এখনো ঠিকরে পড়ে আলো, গায়ে সোনালী রঙের লতাপাতার কারুকাজে ঝলসে যায় চোখ। বাকি হতকুচ্ছিত জংধরা বালতি, শ্যাওলা জমা মেঝে অগ্রাহ্য করে গামলাটার মধ্যে বালতি ভরে জল ঢালে সে। আগে বোধহয় কল ছাড়লেই চলতো, এখন তাতে জং ধরে অকেজো দশা। তবে অসুবিধা হয় না বকুলের। একটু জল ভরে উঠলে তাতে ছড়িয়ে দেয় পুজোর জন্য তোলা দোপাটি, টগর বা বেলিফুলগুলো। এনামেলের বাটির মিশ্রণটা মেশায় জলে, একটু হাত দিয়ে নাড়লেই ফ্যানা ফ্যানা হয়ে যায় পুরো। আদুরে বাচ্চার মতো খিলখিল করে হেসে ওঠে বকুল। ধুপদানিটা পাশে রেখে দাঁত থেকে সায়াটা ছেড়ে দেয় সে, তারপর সম্পূর্ণ নগ্নদেহে প্রবেশ করে জলের মধ্যে। এই এতক্ষণে একটা বড়ো করে শ্বাস টানতে পারে বকুল। তারপর শুয়ে পড়ে ধীরে ধীরে, গোটা গায়ে একটু একটু করে মেখে নেয় জল অথবা ফ্যানা। বকুলের জগত সংসার মুছে যায়। রান্না করা ভাত-ডাল-তরকারি কখন যেন খাওয়ার অযুগ্যি হয়ে ভেপসে ওঠে। ঢেকে রাখা বাটি উলটে দুটো ভাজা মাছ নিয়ে হীরু বিড়ালটা পালায়, বকুল তবুও নির্বিকার। 

দিনশেষে যখন বেরিয়ে আসে জল থেকে তখন বকুল তরতাজা গোলাপের মতো, প্রসাধন করে হালকা, অল্প সিঁদুর ছোওয়ায় সিঁথিতে। ছাদে ভেজা কাপড় মেলতে গেলে নিমাইয়ের মা অবাক গলায় বলে,
"ওমা বৌ! এই অবেলায় স্নান করলে অসুক করবে লা! জলে ভিজে ভিজে হাত-পা কেমন কুঁচকে গ্যাছে দেখো! বলি সারা দিনমান‌ করোটা কি?"
বকুল মৃদু হাসে শুধু, উত্তর দেয় না কোনো। বরং ঘরে এসে কোনোমতে ফুল-,ধুপ ছাড়াই পুজো করে একটু। তারপর অল্প ভাত ডাল তরকারি নিয়ে খেতে বসে! যদিও প্রতিদিনই বমি ঠেলে আসে তার, পাতের বাকি ভাতটুকু থালা কাচিয়ে ফেলতে ফেলতে ভাবে;
"চাদ্দিকে এতো আঁশটে গন্ধ কেনো বাবা? আর কি কারো নাক নেই নাকি? উফ্! "
                               *****

ভাড়ার ঘরটা দেখতে এসে স্নানঘরেই চোখ আটকে গিয়েছিলো বকুলের। মোটামুটি সাধারণ কল-বালতি-মগ রাখা স্নানঘরটার খোলনলচে বদলে দিয়েছে একপাশে রাখা বিরাট বড়ো সাদা পাথরের গামলাটা! বকুলকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকতে দেখেই বোধহয় বাড়ির মালিক হালকা হেসে বলেছিলো,
"ওটাকে জাকুজি বলে মা। আসল ইতালির থেকে আনা সাদা পাতর দিয়ে বানানো। ওই সাহেবসুবো, মেমবউরা ওতে বসে ফষ্টিনষ্টি করতো। এই ঘরদোর তো সব কোম্পানির আমলেই বানানো। তবে এদিকে কল পায়খানা সব আছে, ওসবে আর আমাদের কি দরকার, বাঙ্গালী মানুষের বালতি-কলসীই ঢের! " বলে সামনের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসেছিলেন তিনি। বকুলের চোখ তখনো গেঁথে আছে সেই জাকুজিটাতে! সুজন অবশ্য দোনামনা করছিলো খুব, এই একটা ঘর-বারান্দা, একফালি রান্নাঘর আর বাথরুমের ভাড়া পাঁচহাজার টাকা! বকুল পাশে সরে এসে ফিসফিসিয়ে বলেছিলো, 

"নাও না গো, কেমন সুন্দর দক্ষিণখোলা, লাল সিমেন্টের মেঝে , আর আর চাদ্দিকে কেমন সবুজ, সামনে টানা রেলিংও আছে। আমি নয় একবছর শাড়িগয়না কিনবো না তেমন, খরচা বাঁচিয়ে দেবো। নাও না গো!" বকুলের একচোখে আকুতি আর একচোখে ভাসছিলো সাদা ধবধবে লতাপাতার কারুকাজ করা বিরাট একটা গামলা... নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিলো ওর; সেই প্রথম তীব্র আঁশটে গন্ধটা পায় বকুল।

 সুজন রাজি হয়ে গিয়েছিল ঘরটা ভাড়া নিতে। ওই, সদ্য বিবাহিত আর‌ দ্বিতীয় পক্ষের কচি বৌয়ের আবদার‌ ফেলতে পারেনি! আর তাছাড়া বকুলের দপ্ করে জ্বলে ওঠা চোখদুটো, হাপরের মতো ওঠানামা করতে থাকা ভারি বুকের কাঁপনটুকু বা কল্পনায় রাতের অধৈর্য্য সোহাগটুকু অগ্রাহ্য করতে পারেনি সে।‌ প্রথম যেদিন এখানে পাকাপোক্তভাবে থাকতে চলে আসে, সুজনের মনে আছে, একবার বকুল বলেছিলো,
"হ্যাঁ গা! চাদ্দিকে এতো গাছপালা, তাও বাতাস কম নাকি? কেমন বুক ধড়ফড় করচে দেখো!" 
সুজন অবাক হয়ে বকুলের দ্রুত ওঠানামা করতে থাকা ভরাট বুক, কন্ঠার হাড়, নিটোল খাঁজ, তিরতির করে কাঁপতে থাকা ঠোঁট....দেখছিলো, একমনে। সেদিন আর অফিস যাওয়া হয়নি তাঁর। সদ্য চুনকাম করা দেওয়ালের গন্ধ, খোলা সুটকেসে নতুন শাড়ির ভাঁজে রাখা ন্যাপথলিনের গন্ধ, বকুলের শ্যাম্পু করে ঘষা মাথার সুগন্ধ, খাটের পাশে তামার থালায় রাখা কটা যুঁইফুলের সুবাস, সবকিছুর সাথে মিশে গিয়েছিলো আরেকটা আদিম বুনো গন্ধ, নর-নারীর যৌথ সুখানুভূতি আশ্লেষ মিশে ছিলো সেই গন্ধে, অন্ততঃ সুজন তো সেটুকুই পাচ্ছিলো। আর হারিয়েও যাচ্ছিলো সেই গন্ধে, বারবার করে বকুলের জঙ্ঘা, তলপেট , ঊরুসন্ধিতে মুখ ডুবিয়ে আকন্ঠ পান করতে চাইছিলো সেই গন্ধটা। তখনি প্রথমবারের মতো বকুল বলে ওঠেছিলো,
"হ্যাঁ, তুমি গন্ধ পাচ্ছো কোনো? আঁশটে গন্ধ? কোত্থেকে আসছে বলো তো?"

                                *****

জানালার এই দিকটায় দাঁড়ালে গঙ্গার পাড়টা পরিস্কার দেখতে পাওয়া যায়। ভোর ভোর কথক ঠাকুর তিলক-চন্দনের রসকলি এঁকে নামাবলী জড়িয়ে পাড়ের দিকে এসে বসে , একে একে দুই-একজন করে প্রবীণা বা প্রৌঢ়া সিক্তবসন গায়ে জড়িয়ে কপালে , কন্ঠিতে বা বাহুমূলে ফোঁটা কেটে যায়, দূরে আজানের সুর ভেসে আসে, একটু পরেই বাজবে গির্জার ঘন্টাধ্বনি। 

             রোজ এইসময় অতিকষ্টে খাট থেকে নেমে জানালার পাল্লাটা অল্প খুলে একখানা কেদারা বা মোড়া টেনে বসে পড়ে বকুল। আজকাল‌ দাঁড়িয়ে থাকতেও বড়ো কষ্ট হয়, কোমরের নীচটা খুলে আসে যেনো, দিনদিন থাইদুটো এতো মাংসল হয়ে উঠছে, চামড়ায় ঘষা খেয়ে খেয়ে ঘা হয়ে যায় বকুলের।‌ বকুল তাই হাঁটে কম, চুপ করে শুয়ে থাকে, অথবা জানালা দিয়ে বাচ্চাদের খিলখিল হাসি, ডুবসাঁতার চিতসাঁতারের দৃশ্য বা ভেজা গামছা বুকে জড়িয়ে পাশের সাঁওতাল বস্তির মেয়েদের একে অপরের গায়ে ঢলে পড়াটুকু নিপাট দেখে নেয়। তারপর যখন বেলা বাড়ে , জানালা দিয়ে গরম রোদ সরু হয়ে বিছানায় পড়ে, আর সুজনের আড়মোড়া ভাঙ্গার শব্দ কানে আসে, তখন বকুল আস্তে আস্তে বিছানায় এসে, একটুখানি "আহ্" শব্দ করে বসে পড়ে বলে,

"আমরা আগের বাসাতেই ভালো ছিলাম নাগো? বলচি শোনো না, এই বাড়িটা বদল করলে হয় না?"

                            সদ্য ঘুম ভাঙ্গলে এমনিতেই সুজনের মেজাজ খিচড়ে থাকে, কাপ দুই লেবু-চা পেটে না পড়লে তাঁর বাহ্যি বেরোয় না, অথচ আজকাল রান্নাঘরের কৌটৌবাটা সব নিজেকেই নাড়াতে হয় সকালে, বকুল পারে না তেমন। দিনের দিকে জুলি বলে একটা মেয়ে এসে রান্না, ঘরমোছা, বাসনমাজার কাজটুকু করে দিয়ে যায়, বাদবাকি সব সুজনই সামলায়। চারিদিকে ধারদেনা, ওষুধ বিষুধের খরচ, ঘড়ভাড়া, দোকান বাজার সামলে পাগল হয়ে যাচ্ছে সুজন। খানিকটা কড়া গলাতেই তাই বলে...
"তিরিশ হাজার সেলামি দিয়ে ঘরখানা নেওয়ার বুদ্ধি তো তোমারি ছিলো; টাকা গাছে ফলে নাকি, রোজ রোজ ঝাড়া দেবো আর পড়বে....!"
বকুল চুপ করে যায়, কিই বা বলবে। সত্যিই তো, সেই তো বলেছিলো সেদিন, জেদ ধরেছিলো ঘরটা নেওয়ার। অথচ প্রতিদিন একটু একটু করে খেয়ে ফেলছে জাকুজিটা তাকে, পরিত্রাণের কি কোনো উপায় নেই? বকুলের চোখে জল আসে, কোনোমতে চেপে রান্নাঘরে আসে সে। গ্যাসে সসপ্যান চড়ায়, জল দেয় , চিনি চা-পাতা নামায়, লেবু কাটে। তারপর হঠাৎ করে অবশ অসাড় নিন্মাঙ্গ নিয়ে পড়ে যায় ধপ্ করে, পায়ে সাড় নেই তো কোনো; সে খালি চেয়ে চেয়ে দেখে জল ফুটছে, চাইলেই তাতে চা-চিনি মেশাতে পারছে না আগের মতো। নিষ্ফল হতাশায় হাতটা বাড়িয়ে দেয় বকুল, ওর পাতাবিহীন চোখের কোণা দিয়ে গড়িয়ে পড়ে মুক্তোকুচির মতো ঠিক দু'দানা জল। সুজন ছুটে আসে শব্দ শুনে, আলতো করে বকে একটু হয়তো,
"ছিঃ বকুল, একটু নয় রেগেই কথা বলেছি, তা বলে এভাবে একা রান্নাঘরে আসবে? কিছু হয়ে গেলে কি হতো বলো তো?"

সুজনের চেক চেক লুঙ্গি দিয়ে ঢাকা পায়ের ওপর ডানগালটা রেখে, খুউব আস্তে করে, খুউব ধরা গলায় বকুল বলে,
"আমার কি খুব কঠিন অসুক করেচে গো? খুব কঠিন? কোনোদিনো সারবো না?"

                             *****
. আজকাল বকুল খুব চেষ্টা করে সাদা মার্বেলের ওই বিরাট গামলাটার থেকে একটু দূরেই থাকতে। সকালটা তবু জুলির সাথে সাথে কেটে যায়, মেয়েটা ঘর মোছে, বাসন মাজে আর বকুল সমানে একটু গলাটা উঁচিয়ে বলে যায়; 
"আজ দাদাবাবুর জন্য একটু পোস্তোর বড়া করিস তো; কুঁচি কুঁচি লঙ্কা দিস আর একটু মুচমুচে করে নামাস। আর গতকালের সিম পাতুরি ওমন তিতকুটে কেনো ছিলো রে? পাতুরি হবে মাখনের মতো; মুখে দিলেই গলে যাবে...." 
জুলি কুটনো কুটতে কুটতে উত্তর দেয় কিছু, কিছু হয়তো শুনতে পায় না কাজের তালে, বকুল‌ তবুও বলেই যায়। বেলা বাড়ে, ঘন ঘন শ্বাস ওঠে ওর, বুক ধড়ফড় করে, টাকরা শুকিয়ে যায়, খটখটে জিভটা শুষ্ক ঠোঁটের ওপর একবার বুলিয়ে নিয়ে বকুল বলতেই থাকে,
"দাদাবাবুর বুঝলি খুব খাওয়ার শখ। যখন শরীরগতিক সুবিধার ছিলো, রোজ বায়না করতো; আমিও তেমনি, এটা সেটা করতেই থাকতুম; ওকি, ও মেয়ে, তোর হোলো নাকি? বলি এরমধ্যে সব কাজ হয়ে গেলো? ফাঁকি দিচ্চিস তো প্রাণভরে...."
অথচ বকুল দেখতে পাচ্ছে, ঘর-বারান্দা মোছা সারা, ঢাকা বাটিতে ডাল-তরকারি, উপুর দেওয়া ধোয়া বাসন; তাও দুটো কথা বলে আটকাতে চায় জুলিকে, চোখ নইলে বারবার স্নানঘরের‌ দিকে চলে যায় যে‌। তবুও একসময় জুলি বেরিয়ে যায়, আর একা ঘরে বকুলের প্রাণটা আবার আনচান করতে থাকে। একবার হয়তো না পেরে ঘষটে ঘষটে বাথরুমের দরজায় পৌঁছেই যায়, পরক্ষণেই নিজের প্রায় সাদাটে ত্বক, আঙ্গুলের ফাঁকফোকর ভর্তি হাজা, পাতাহীন চোখ, ভারী থাই আর ফুলতে থাকা শ্বাসের কথা মনে পড়ে যায়, মনে পড়ে কিছুদিন আগেই, বস্তির সেই একটেরে ঘরটায় কেমন সবুজ সতেজ লাউডগার মতো ছিলো সে; অথচ এখানে এতো আলো , এতো বাতাস, তবুও বকুল‌ প্রাণ পায় না কেনো? কেনো বারবার মনে হয়, ওই সাদাটে জাকুজিটা প্রবল আশ্লেষে জড়িয়ে ধরে শেষ প্রাণবায়ুটুকু নিংড়ে নিতে চায় তার। বকুল আঁতকে ওঠে, পিছিয়ে আসে, ঠিক করে, আঁশটে গন্ধে বা শ্বাসের টানে মরে গেলেও ওই স্নানঘরে ঢুকবে না সে। বরং একটু কষ্ট করে যদি গঙ্গায় যাওয়া যায়? পারবে না, নাকি? ওই তো সামনেই।

তখনি হয়তো কানাইয়ের মা হাতে একবাটি ক্যাস্টর অয়েল নিয়ে ঢোকে, বকুলের চোখের পাতা, ভ্রূ, সবেতে ঘষতে ঘষতে বলে,
"অমন পিতিমের মতো বন্ন ছিলো বৌ তোর, কি ছিরি করলি রে, দেখে আমারি বুকটা হুঁ হুঁ করে ওঠে। তবে সোয়ামী তুমি ভাগ্য করে পেয়েচো মা, এ আমি একশো বাক্যে বলতি পারি। কি সেবাটাই না করচে দেকো! " তারপর গলাটা একটু খাদে নামিয়ে আবার বলে,
"তুই আসার আগে যেই বৌটা ছিলো, তারও তো কি অসুক ম্যাগো! কি দূর্গন্ধ বেরুতো এই ঘর দিয়ে, য্যান জেলেপাড়া! তার সোয়ামী তো রেখেই পালালো! আমরাই নাকে কাপড় চাপা দিয়ে খাবার দাবার দিতুম কদিন। তাপ্পর সে মোলো, না না, মরে বাঁচলো অবাগী!" কানাইয়ের মা আঁচল চাপা দিলো চোখে, বকুল‌ পাতাবিহীন বড়ো বড়ো চোখ করে শুনছিলো সবটা, আচমকা কানাইয়ের মা কাপড় খিমচে ধরে বললো,
"তারও কি শ্বাস টানতে কষ্ট হতো কাকি, আর এমনি সাদাটে হয়ে যেতো নাকি?" 

কানাইয়ের মা নাক কোঁচকালো একটু, 
"তার ধারেপাশে গন্দে যাওয়া যেতনি বাপু, সাদা না কালো কি করে দেখবো। তবে সুজন কিন্তু আমাদের সোনার টুকরো ছেলে, রোগতাপের‌ বৌকে ক্যামুন টানছে দেকো; রা টি কাড়ছে না। শাঁখা-নোয়ার কদর করিস বৌ!"

কানাইয়ের‌ মা উঠে পড়ে, বকুল‌ চায় আরেকটু বসুক, তবে গেরস্ত সংসারে গিন্নি বসলে চলে না, নিজেও জানে সে, তাই জোর করে না। বরং কানাইয়ের মা চলে গেলে অনেকক্ষণ নিজের শাঁখা-নোয়া ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে, দেখতেই থাকে, তারপর একটু সিঁথিতে ছুঁইয়ে নিতান্তই নির্লিপ্ত গলায় বলে,
"ওনার অসুক কল্লে আমি যেনো দেকতাম না ? বাঃ! "                        

                             *****

"আচ্ছা, মৎস্যকন্যা কি সত্যিই মানুষ হয়ে যায় গো?"
আচমকা বকুলের এমন খাপছাড়া প্রশ্নে হতচকিত হয়ে গেলো সুজন। একগাদা রসিদ নিয়ে হিসাবে বসেছিলো সে। খেই হারিয়ে নিতান্তই বেকুবের মতো তাকিয়ে রইলো খানিক। তারপর খানিকটা রেগেই বললো, 
"ভর সন্ধেতে এসব কি অলুক্ষুণে কথা বলছো বকুল? কে আবার মৎস্যকন্যা থেকে মানুষ হলো?"

বকুল হাসলো একটু, মেঘ সরে গিয়ে চাঁদ উঠলে যেমন আলো ছড়ায়, তেমন আলো ছড়িয়ে হাসলো, তারপর বললো,
"আরে নিমাইয়ের মা রোজ কথক ঠাকুরের‌ পাঠ শুনতে যায় তো, কাল নাকি এক ছোকরা কথক এসে এসব বলছিলো। ওই যে গো, সত্যবতীর তো গায়ে খুব আঁশটে গন্ধ ছিলো, পরাশর মুনির বরে পদ্মগন্ধ পেলো। ওই বলছিলো, মুনি নাকি ওষুধ দিয়ে সারিয়ে দেয়! হ্যাঁ গা; সেই যুগে রোগ হলেও সেরে যেতো, এখন তো শুনি কত উন্নতি হয়েচে, আমি কি সারবো না গো?"

সুজন হাই তুলতে তুলতে মুখের সামনে দুই আঙ্গুল দিয়ে তুড়ি মারলো কয়েকটা, তারপর নিতান্তই কেজো গলায় বললে,
"সারবে না কেনো, ঠিক সারবে। এমন তো আহামরি কিছু হয়নি তোমার। ডাক্তার বললো ফুসফুসের কি একটা রোগ হয়েছে, আর একটু চর্মরোগ, ও কদিন পরেই সেরে যাবে। শুধু জলটা ঘেঁটো না! যাই; আমি একটু রান্নাঘরে গেলুম গো; রুটি বড়ো শক্ত হচ্ছে রোজদিন, দেখি একটু...."

উঠে গেলো সুজন। বকুল চুপ করে বসে থাকলো অনেকক্ষণ। তারমধ্যে একটু সময় অকাজের মনখারাপে বরাদ্দ করলো। একটু অভিমানের সাথে ভাবলো, সুজন তাকে আজকাল তাকিয়েই দেখে না, নইলে এই প্রায় জোড়া লাগা থাই, লম্বা হতে থাকা পায়ের পাতা আর পাতাবিহীন চোখ কি শুধুই চর্মরোগ। আর আর‌ সেদিন থেকে যে হাঁটুর নীচে একটু নীলচে সোনালী আঁশের মতো দেখছে, সেটাও কি কিছুই না? আর ওই তীব্র আঁশটে গন্ধ? আর জাকুজিটাই বা কেনো এমন আষ্টেপিষ্টে ধরছে তাকে?

ঘরে একটামাত্র হ্যারিকেনই জ্বালিয়ে গ্যাছে সুজন, তাও প্রায় নিভু নিভু সেটা, সেই আবছা অন্ধকারেই হঠাৎ চাপা গলায় ডুকরে ওঠে বকুল,
"ওগো আমি বাঁচতে চাই গো; এই বাড়িটা, ওই সাদা মার্বেলের পাত্তরটা, গিলে খাচ্ছে আমাকে, বুঝছো না কেনো; চলো না; চলে যাই এখান থেকে! কই গেলে গো?"

                                ******
আজ অনেকদিন পর বড়ো ভালো লাগছিলো বকুলের, সবকিছু নতুন লাগছিলো বেশ। আজ তাই পাটভাঙ্গা হলদে জমি, সবুজ কল্কাপেড়ে একটা শাড়ি পরেছে সে, সিঁথিতে অল্প সিঁদুর, একটা ছোট্ট টিপ আর অল্প কাজল। আয়নাটার সামনে কতদিন দাঁড়ায়নি এসে, আজ দেখছে গর্তে ঢোকা চোখ, তার নীচে একপোচ কালি, কন্ঠার হাড় জাগানো.... তবুও ভালো লাগছে সবকিছু। টানা এক সপ্তাহ স্নান করেনি বকুল, জলটুকুও গিলেছে কোনোমতে। একা ঘরে পাগলের মতো চুল ছিঁড়েছে, তবুও জাকুজির ধার মাড়ায়নি। তারপর আজ কানাইয়ের মা ধরে ধরে গঙ্গায় নিয়ে গেলো, কতদিন পর চার দেয়ালের বাইরে; অসুখ যেনো হাওয়াই হয়ে গেলো ফিরে। বকুল ঠিক করেছে, ওই স্নানঘরে ও পেল্লাই তালা বসাবেই বসাবে, দেখা যাক কত ক্ষ্যামতা ওটার। জুলি এসে গ্যাছে, এটা ওটা কাজ করছে রান্নাঘরে, সুজনও উঠেছে। গুণগুণ গান করতে করতে হঠাৎ বকুল ভাবলো, আজ সুজনের জন্য একটু লুচি-আলুর চচ্চড়ি বানালে কেমন হয়? অনেকদিন বাদে পায়ে সাড় পাচ্ছে একটু, কতদিন গরম গরম লুচি সুজনের পাতে দেয়নি তুলে.... ! জুলি নয় কেটেবেটে দেবে।একটু ভেজে নিতে ঠিক পারবে সে। রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালো বকুল। কাছে আসতেই শুনতে পেলো জুলির গলা,

---"দিয়েন না দাবাবু, ও ট্যাকা লাগবেনি, বৌদিদি কত ভক্তিছেদ্দা করে আপনাকে, ও আমি পারবুনি....;"
সুজন আক্রোশে ফেটে পড়লো যেনো; 
"সতীপনা দেখাস নে মাগী; বলবো সবাইকে তোর কুকীর্তি? রাতে দরজা খোলা থাকবে, চলে আসিস।"
তারপর একটু থেমে, খানিকটা হতাশা মেশানো গলায় বললো,
"রাতদিন তোর অসুস্থ বৌদিদির খিদমত খেটে খেটে আমি কি হয়ে গেছিস জানিস? একটা জীবন্ত মড়া রে, মড়া! আমার কি শখ-আহ্লাদ নেই কিছু....শরীর নেই নাকি?"

বকুল সরে এলো রান্নাঘর থেকে , বরং পায়ে পায়ে স্নানঘরে এসে দাঁড়ালো। কল খুলে বালতি বালতি জল ভরতে লাগলো জাকুজিটায়। একসপ্তাহের‌ অব্যবহৃত জাকুজিটা চকচক করছে আরো, সাদাটে মার্বেলটা আরো বেশি নিষ্ঠুর লাগছে আজ। বকুলের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিলো আবার, হাঁপরের মতো ওঠানামা করছিলো বুকটা আবার, চারিদিকে আবার সেই তীব্র আঁশটে গন্ধ। বকুল দাঁড়াতে পারছিলো না আর, বরং দ্রুত জাকুজিটায় গা এলিয়েই অসম্ভব নিশ্চিন্ত লাগছিলো তার। ভেজা ভেজা গলা থেকে কখন যেনো আলতো করে বেরিয়ে এলো....

"আহ্! শান্তি!"

                               ******
সপ্তাখানেক পর; সুজন অফিস থেকে ফিরে দেখে কোথাও বকুল নেই। ঘর, টানা বারান্দা, রান্নাঘর, স্নানঘর, ছাদ কোথাও না। আলনায় ঝুলছে বকুলের সবজে কল্কেপাড় শাড়ি, এদিকওদিক পাউডার, সিঁদুর, আলতার পাতা, আর একটা তীব্র আঁশটে গন্ধ, ঠিক যেমনটা বকুল বলতো, অথচ বকুল কোথাও নেই। নিমাইয়ের মা ডুকরে বললো,
"অবাগী নির্ঘাত গঙ্গায় ডুবে মরেচে...."
অথচ তিনদিন পরেও কোনো মরা ভেসে উঠলো না যে.....!

বকুলকে আসলে ভালো করে খুঁজে দেখলো কেউই। নইলে স্নানঘরের ওই ঝকঝকে গ্রেট ইটালিয়ান জাকুজিটার গায়ে লেগে থাকা গোলা সিঁদুর আর নীলচে সোনালী আঁশটুকুও নজরে পড়তো সবার।

..............................
 
Baisakhi Roy
 
অলঙ্করণ :-  সহিষ্ণু কুড়ি