শঙ্খচিল
অনির্বাণ মজুমদার
-জামায় কালি ছেটানোর কথাটা সেই গাপিয়ে দিয়েছিস মাকে!
-ককই নাতো! বলিনিতো।
-বলিসনি! নেকুপুষু! এই রবি ওকে ধরতো।
-ছেড়ে দাও আমায়! এহ! ইশশ!
-নে হিসি দিলাম, কাউকে যদি বলেছিস তো দেখিস এরপরে কি হাল করি তোর।
ওরা
চলে যেতে অনিকেত বমি করে ফেলে ঘেন্নায়। অনিকেতের এটাই রোজনামচার জীবন। ওরা
রোজ ওর পিছনে লাগে। ওর জামায় কালি ছিটিয়ে দেয়, টিফিন খেয়ে নেয়, স্কুলব্যাগ
কেড়ে নেয়, বইএর পাতা ছিঁড়ে দেয়, একপ্রকার অত্যাচার করে ওর সাথে। ও যেন
ওদের কাছে মজার খোরাক। আজকের মাত্রাটা বেশি হবার কারণ মায়ের কাছে জামার
দাগের জন্য জবাবদিহি করতে গিয়ে ওদের নাম বলে ফেলেছিলো ও। মা এরপর স্কুলে
কমপ্লেন করেছিলো। ও বারণ করেছিলো মাকে। মা কিছুতেই বারণ শুনলোনা।
ছেলেগুলোকে খুব ভয় পায় অনিকেত। সবকটা মার্কামারা। দুই তিনবার ফেল করে ওরা
এখনও ক্লাস ফাইভের গন্ডি ডিঙোতে পারেনি। ওরা ক্লাসের বাকিদের কাছেও ত্রাস,
কেউ ঘাঁটায়না ওদের। অনিকেতও ঘাঁটায়না। ওরাই আগবাড়িয়ে অনিকেতের পিছনে লাগে
অনিকেতের ভীতু এবং বোকাসোকা স্বভাবের জন্য। তবে এতোটা ভীতু ছিলোনা ও। বছর
দুয়েক হলো ভয় গুলো ওকে বেশ জাঁকিয়ে ধরেছে। বছর দুয়েক আগের একটা ঘটে যাওয়া
ঘটনা এর জন্য দায়ী।
ছোটবেলা থেকেই ও ওরকম। একটু ভীতুপ্রকৃতির।
রোজ রাত্রে বাবা মাএর মধ্যেখানটিতে ঠিক ও গুঁজে যেতো। খুব নিরাপদ লাগতো তখন
ওর। দুজনের বাহুবেষ্টনিতে পরম নিশ্চিন্তে অকাতরে ঘুমিয়ে পড়তো ও। ছুটির
দিনে ঘুম থেকে ও দেরি করে উঠতো। বিছানায় বসে বসে ও বালিশগুলোকে দিয়ে
চারপাশে একটা দেওয়াল তুলতো। যেন ওটা ওর দুর্গ। সেই দুর্গের ভিতরে ও খেলনা
নিয়ে খেলতো। ওর বেশিরভাগ খেলনাই ছিলো পাখি। অনিকেত পাখি ভালোবাসতো।
-বাবাই এখনও উঠিসনি! আমার লুচি ভাজা কমপ্লিট।
-ফর্সা লুচিতো মা? নইলে খাবোনা কিন্তু।
-হ্যারে বাবা, ফর্সা লুচি, সাথে তিনকোণা আলুর তরকারি।
-হুররে! বাবা কোথায় মা?
-বাজার বেরোলো, তুই মুখ ধুতে ধুতে চলে আসবে।
অনিকেত
ওর দুর্গ থেকে ঝেড়েমেরে উঠে পরে। এই ছুটির দিনগুলোতে অনিকেত বাবার সাথে
চিটে থাকে। বাবা ওকে দেশবিদেশের গল্প শোনায়, বাগানে নিয়ে গিয়ে গাছ চেনায়,
পাখি চেনায়। বাবা খুব সুন্দর বাঁশি বাজাতে পারে। কোন কোন রাত্রে বাবা বাঁশি
নিয়ে বসে। সুরের মুর্ছনায় তখন চারিদিক বিভোর হয়ে যায়। মা আর অনিকেত তখন
তাকিয়ে থাকে তাদের সবচাইতে প্রিয় মানুষটির দিকে।
-বাবা এটা কি বাজালে?
-এটা বাগেশ্রী বেটা। তুই আর একটু বড় হ, তোকে শিখিয়ে দেবো।
-বাবা কাল লক্ষী দিদিমনি বলছিলো ম্যান ইস মর্টাল মানে মানুষ মরণশীল! এর মানে কি বাবা?
-মানুষ ছোট থেকে আস্তে আস্তে বড় হয়, তারপর বুড়ো হয়ে পড়ে। তখন তাদের খুব কষ্ট হয়। তাই ভগবান তাকে কাছে টেনে নেয়।
-তুমিও বুড়ো হবে বাবা? মা ও হবে? আর আমিও?
-হ্যা বেটা, সবাইকে একদিন না একদিন বুড়ো হতে হয়। প্রকৃতির নিয়ম।
-না বাবা, আমরা বুড়ো হবোনা কোনদিন।
-বেশ আমরা মৃতসজ্ঞিবনী সুধা খেয়ে অমর হব। চল এবার শুতে যাই। রাত হল।
সেই
রাতে মা বাবার মাঝখানে থেকেও ঘুম আসছিলোনা অনিকেতের। বাবা মা থাকবেনা
একসময়! সে তবে কি করে থাকবে। কেমন একটা তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছিলো সবকিছু।
অনেক রাতে ঘুম এলো অনিকেতের। স্বপ্ন দেখলো একটা। কতগুলো চোখ ওকে তাড়া
করেছে। ও পালাচ্ছে। কিন্তু রাস্তার বাঁক আসতেই আবার ওই চোখগুলো ধেয়ে আসছে। ও
একটা ছোট গলি দিয়ে ছুটতে থাকে। গলিটা একসময় শেষ হয়ে যায়। সামনের রাস্তা
বন্ধ। চোখগুলো এগিয়ে আসে ওর দিকে।
-কি হয়েছে তোর অমন করছিস কেন? বাবা ঠেলে অনিকেতকে, মা ঘুম ভাঙা চোখে তাকায়।
-ভয়ের স্বপ্ন দেখেছিস নাকি?
-তোমরা আমার দিকে ফিরে শোও।
‘মানুষ
মরণশীল’ কথাটি অনিকেত খুব তাড়াতাড়ি উপলব্ধি করতে পারলো। বাবা হঠাৎ
দুর্ঘটনায় মারা গেল। ছয়ফুটের শরীরটা দুমড়ে মুচড়ে যখন পোষ্টমর্টেম হয়ে ঘরে
ফিরেছিলো অতসী আঁছড়ে পড়েছিলো শরীরটির উপর। অনিকেতের কষ্ট হচ্ছিলো, তবে
কষ্টের থেকে ভয় বেশি লাগছিলো ওর। ও ঘরের এক কোণায় সেঁধিয়ে গেছিলো। অতসী
নিজেকে সামলে অনিকেতকে খুঁজে বের করে ওকে বুকের মধ্যে টেনে নিয়েছিলো।
অনিকেত পরজীবীর মত মাকে আঁকড়ে ধরেছিলো সেদিন।
কারখানার ভিতরে
দুর্ঘটনাটি ঘটেছিলো বলে অতসী কমপেনসেনারি বেনিফিটে চাকরি পেলো। দরকার ছিলো
ওর। কারণ অতসীর বাবা গ্রুপ ডির রিটায়ার্ড সরকারী কর্মী। তিন মেয়েকে বিয়ে
দিয়ে সর্বঃশান্ত হবার জাবর কাটতেন অষ্টপ্রহর। অম্লানের ডিপার্টমেন্টের
কলিগেরা চাকরির ব্যাপারে সাহায্য করেছিলো অতসীকে। তাই চাকরিটা সে তাড়াতাড়ি
পেয়েছিলো। অম্লানের প্রভিডেন্ট ফান্ড আর গ্র্যাচুইটির জমা টাকা দিয়ে
বসুন্ধরা অ্যাপার্টমেন্টের দুইকামরার পায়রার খোপটি কিনে ফেলেছিলো অতসী। মা
ছেলের সংসার। বেশি ঘরের প্রয়োজনও ছিলোনা ওদের।
বাবা মারা যাবার
পর থেকে অনিকেতের ভয়টা বেড়ে গেছিলো। তাই ওর স্বভাবের জন্য রবিরা পিছনে
লাগতো সবসময়, ওকে বুঝতো শুধু ওর মা। আর একজন বন্ধু হয়েছিলো অনিকেতের। গয়লা
পাড়ার সন্তোষ। সন্তোষ ছিলো ওর প্রায় সমবয়সী, দুধ দিতে আসতো ও। অনিকেতের
সাথে ওর খুব জমতো, কারণ ওর ‘ভেলকিগুলো’ অনিকেতের ভালো লাগতো। এবং বন্ধুর
জন্য ওর গর্বও হত। আসলে অনিকেত সাহসের অভাবে যে কাজ গুলো করতে পারতোনা, সেই
কাজগুলো অবলীলায় করে ফেলতো সন্তোষ। পেয়ারা গাছে উঠে পেয়ারা পাড়া, গুলতির
অব্যর্থ লক্ষ্যে গাছের আম নিমেষে মাটিতে নামানো, সাইকেলের পুরোন টায়ার
লাঠির অবলম্বনে গড়িয়ে নিয়ে যাওয়া, লাটাই, ঘুড়ি, কাঁচের গুঁড়োর মাঞ্জা দেওয়া
সুতো, লেত্তির প্যাঁচে লাট্টু ঘোরানো এসব ছিলো সন্তোষের কাছে মামুলি
ব্যাপার।
-মিনারে চড়বি? মিনারের ছাতের আলসেতে শঙ্খচিলের বাসা আছে। ওখান থেকে পালক নিয়ে আসতে হবে।
-কি হয় তাতে?
-ধ্যুর! ল্যালক্যাবলা! কিচ্ছু জানিসনা তুই। ওর পালক নিয়ে নীচের পুকুরে ডুব লাগালে উড়তে পারবি ওর মত!
-সত্যি!
-হ্যা।
সন্তোষের
উৎসাহ অনিকেতকে স্পর্শ করেছিলো। সন্তোষ পাখি খুব ভালোবাসতো। অনিকেতও। তাই
এক ছুটির দুপুরে মায়ের অনুমতি নিয়ে অনিকেত সন্তোষের সাথে গিয়েছিলো সেখানে।
ওদের বাড়ি থেকে কিলোমিটার দেড়েক দূরে ছিলো ঐ ভাঙাচোরা মিনারটি, হতে পারে
কয়েক শতাব্দীর পুরোন সেটা, মিনারটিকে নিয়ে স্থানীয় লোকেরা একটা গল্প
ভাসিয়েছিলো। নাকি ‘কোন এক রানীর জন্য সেটা ছিলো সূর্যাস্ত দেখার নিবাস’,
রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে তা ধ্বংসপ্রাপ্ত প্রায়, গা থেকে ছাল চামড়া যেন খসে
খসে পড়ছে। তবে উপরে ওঠার ঘোরানো সিঁড়িটি টিকে ছিলো। সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে
গেছিলো সন্তোষ। অনিকেত নীচে দাঁড়িয়েছিলো। সুদীর্ঘ মিনারটিকে দেখে ওর ওপরে
ওঠার উৎসাহ নিভে গিয়েছিলো তখন। গোলগোল ভীতু চোখে ও সন্তোষকে ছাতের আলসেতে
চড়তে দেখছিলো। ভিজে আলসেতে পা পিছলে পঞ্চাশ ফুট উঁচু থেকে পড়তেও দেখেছিলো
সন্তোষকে।
ভেজানো দরজা খুলে বাড়ি ফিরে দুই হাঁটু বুকে ঠেকিয়ে
বিছানায় শুয়ে শুয়ে থরথর করে কাঁপছিলো অনিকেত সেদিন। মাকে ডেকেছিলো ও চিৎকার
করে। মা দৌড়ে অনিকেতের কাছে এসেছিলো।
-কি হয়েছে? এমন করছিস কেন?
মায়ের
প্রশ্নের জবাবে সে মায়ের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো। সেদিন প্রথম ও মায়ের পিছনে
লোকটিকে দেখেছিলো। পরে মায়ের কাছে শুনেছিলো ওর নাম রেশম। রেশম কাকু। মুখটা
খুব নিষ্ঠুরের মত লাগছিলো সেইসময় রেশমকাকুর। চোখের দৃষ্টিটা ছিলো
নিস্প্রাণ। মুখের মধ্যে অজস্র বাসি হয়ে যাওয়া ক্ষতচিহ্ন মুখটিকে আরও ভয়ঙ্কর
করে তুলেছিলো।
-অতসী আমি তাহলে চলি।
-হ্যা যাও।
লোকটি মাথা ঝুঁকিয়ে অনিকেতের দিকে তাকিয়েছিলো। চোখটা যেন দপদপ করে জ্বলছিলো ওর। অনিকেত চোখ বুজে ফেলেছিলো সেইসময়।
এরপর
থেকে লোকটা মাঝে মধ্যেই আসতে শুরু করলো। সঙ্গে নিয়ে আসতো খেলনা, বিস্কুট,
লজেন্স আরো কত কি। সবই অনিকেতের জন্য। অনিকেত সরিয়ে রাখতো সেসব উপহার।
লোকটাকে ভয় পেতো অনিকেত, তাই লোকটাকে ওর ভালো লাগতোনা। মা ওকে বোঝাতো।
-রেশম কাকু তোকে কত ভালোবাসে, তুই অমন করিস কেন?
-মা আমার ওকে ভালো লাগেনা।
অনিকেত
বুঝেছিলো মায়ের ভালোবাসায় দখলদার এসেছে দখলদারী নিতে। মায়ের ভালোবাসার
সূচাগ্র অংশ ছাড়তে চায়নি অনিকেত। কারণ একমাত্র মা তাকে বুঝতো। আর কেউ না।
মা কাছে থাকলে ভয়টা কেমন যেন ওর কাছ থেকে দূরে পালাতো, সন্তোষ পাশে থাকলেও
হত। মায়ের ভালোবাসাকে ভাগ করতে চায়নি অনিকেত। এটা ওর একান্ত ভাবেই আপনার।
আর কারো নয়।
এক নির্জন দুপুরে লোকটা এসেছিলো। মা ছিলোনা তখন।
হয়তো আসেপাশের কোন ফ্ল্যাটে গেছিলো। ওদের ফ্ল্যাটের দরজাটা আবজানো ছিলো।
ডোরলকের হ্যান্ডেলটা ঘুরিয়ে দরজা খুলে রেশম সোজা ঢুকে গিয়েছিলো অন্দরমহলে।
অনিকেতের কাছে। দুই হাতের দোলনায় রেশম অনিকেতকে উঠিয়ে বাড়ির ছাতে উঠতে উঠতে
বলেছিলো ‘দোল দোল দুলুনি, খোকা ঘুমাবে এখনই’। ওইসময় সাধারণত বসুন্ধরা
অ্যাপার্টমেন্টের আনাচে কানাচে নির্জনতা ছুঁয়ে থাকে। ওই নির্জনতার সুযোগ
নিয়ে শিকারী এসেছিলো তার শিকারে। রেশমের হাসিতে ছিলো ক্রুড়তা। ছদ্মবেশী
আততায়ীকে অনিকেত চিনে ফেলেছিলো। কিন্তু ও রেশমের সাথে জুঝে উঠতে পারছিলোনা।
একজন কিন্তু শিকারী আর শিকারকে দেখে ফেলেছিলো সে সময়। ভারতী। অনিকেতের
ভারতী মাসি। অনিকেতদের বাড়ি সে কাজ করতো।
ছাতে উঠে ভয়ে
অনিকেতের গলা দিয়ে স্বর বেরোয়নি সেইসময়। দশতলা ফ্ল্যাটের ছাতের দশ ইঞ্চির
আলসেতে অনিকেতকে উঠিয়ে দিয়ে রেশম বলেছিলো ‘হাঁটি হাঁটি পা পা! খোকা বলে
দেখে যা’। অনিকেত প্রচন্ড ভয়ে আর্তনাদ করে উঠেছিলো, লাফিয়ে নামতে গিয়েছিলো
সে। বাঁধা পেয়েছিলো রেশমের কাছে।
-ভয় কিসের? আমি তো আছি নাকি? এতো ভীতু হলে চলবে। দেখো নীচটা তাকিয়ে দেখো, উপর থেকে নীচটাকে কি সুন্দর লাগছে, নীচে যাবে তুমি?’।
অনিকেত
রেশমের পিঠটা খামচে ওর ঘাড়ে মুখ গুঁজে দিয়েছিলো ভয়ে। এমন সময় মাকে দেখতে
পেয়েছিলো অনিকেত। মাকে দেখে যেন ধড়ে প্রাণ ফিরে আসে অনিকেতের। অনিকেত ভয়
লাগা কন্ঠস্বরে চেঁচিয়ে উঠেছিলো ‘মাআআ’। অতসীর অগ্নিদৃষ্টির সামনে পড়ে
অনিকেতকে ওখান থেকে নামিয়ে দিয়েছিলো রেশম।
-খুব ভীতু তোমার ছেলে, তবে আমার সাথে কিছুদিন থাকলে ডাকাবুকো তৈরী হয়ে যাবে।
-তুমি যাও এখান থেকে।
অতসীর
শীতল কন্ঠে জোঁকের মুখে নুন পড়েছিলো যেন রেশমের। চলে গেছিলো রেশম। মায়ের
বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে শান্তি পেয়েছিলো অনিকেত। মায়ের বুকে মুখ ডুবিয়ে দিয়েছিলো
ও।
-ওই লোকটা বাজে, ও খারাপ লোক মা।
-আর আসবেনা ওই লোকটা।
রেশম
হঠাৎই অতসীর জীবনে প্রবেশ করেছিলো আচমকা। ক্যাস সেকসনে কাজ করতো ও। অতসী
ছিলো পারচেসে। দীর্ঘদিন একই অফিসে কাজ করার সুবাদে ওদের মধ্যে পরিচয় গড়ে
ওঠে। রেশম বিয়ে করেনি। অতসী রেশমের বিয়ে না করার কারণ জানতে চেয়েছিলো।
-আমি কুৎসিত তাই আমায় মেয়েরা ভয় করে হয়তো, কিম্বা ঘৃণা!
-বাহ্যিক রূপটাই সবাই দেখে? মেয়েদের প্রতি এ আপনার ভুল ধারনা কিন্তু।
-কথাগুলো সাহিত্য হিসেবে শুনতে বেশ লাগে, পারবেন আপনি?
-কি?
-আমার সাথে থাকতে।
অতসী
উত্তর দেয়নি। তারপর থেকে রেশম তার দুঃখ গুলোকে ইনিয়ে বিনিয়ে অতসীর সামনে
উপস্থাপন করে অতসীর সহানুভূতি আদায়ের চেষ্টায় আদাজল খেয়ে নামে। ধীরে ধীরে
সম্পর্কটাকে পাক দিয়ে রেশম অতসীর সহানুভূতি আদায় করে ফেলে একসময়। রেশমের
কাছে এটাই বড় পাওয়া। সহানুভূতির আঁচে সেঁকে সম্পর্ককে পাকা করতে চেয়েছিলো
রেশম। অতসী অবশ্য শর্তসাপেক্ষে রেশমের প্রস্তাবে রাজি হয়েছিলো। রেশমের কাছে
শর্ত ছিলো অনিকেতের মন জেতা। সম্বোধনটা ‘আপনি’ থেকে ‘তুমিতে’ পরিবর্তিত
হয়েছিলো ততদিনে দুজনের মধ্যে। রেশম চেষ্টার কসুর করেনি। অনিকেতের মন জেতার
জন্য নিজের স্বভাববিরোধি সবরকম কাজ ও করেছিলো। সবরকম চেষ্টা করেও যখন সে
অসফল হল তখন ওর হতাশা ক্রোধের রূপ নিলো। অনিকেতকে ওর প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবতে
শুরু করলো রেশম। কারণ ওর আর অতসীর মিলনের মাঝে একটাই কাঁটা। সে অনিকেত।
রেশমের ইচ্ছেটি অনিকেতের জন্য গুটিপোকাই থেকে যাচ্ছিলো। প্রজাপতি হয়ে ডানা
মেলছিলোনা। পথের কাঁটাকে সরাতে হবে। রেশম সুযোগ খুঁজছিলো। সুযোগ মিলেছিলো
সেদিন, কিন্তু ভারতীর জন্য ওর পরিকল্পনা সফল হলনা। রেশম জানতো ওইসময় অনিকেত
একা থাকে। অতসী উপরতলায় যায় গল্প করতে। সুবর্ণ সুযোগকে রেশম হাতছাড়া করতে
চায়নি। কিন্তু রেশমের বিধি বাম! ভারতী সেদিন আগে এসে পড়েছিলো। ও অতসীকে
খবরটি দিয়েছিলো। কারণ সচরাচর এটি ঘটেনা। অনিকেত যে রেশমকে পছন্দ করেনা তা
ভারতীও জানে। ভারতীর মুখে শুনে অতসী ছুটে গিয়েছিলো ছাতে, রেশমেরর অভিসন্ধি
সেদিন অতসী ধরে ফেলেছিলো। রেশমকে আর জলহাওয়া দেয়নি অতসী এরপর থেকে। ও
এসেছিলো এরপরও, অতসীকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলো যে সেদিন ও অনিকেতের ভয়
কাটানোর জন্যই অমন করেছিলো। অতসী ওকে প্রত্যাখ্যান করেছিলো। অতসী
ডিপার্টমেন্টে কমপ্লেন করার হুমকি দিয়েছিলো রেশমকে। তারপর থেকে আর সাহস
দেখায়নি রেশম অতসীর কাছে।
এইভাবেই অনিকেতের বেড়ে ওঠা, তার সাথে
তার ভয়গুলোও, সবসময় যেন কিছু হারানোর আতঙ্ক অনিকেতকে তাড়া করে ফিরতো। মা
ছিলো তার অবলম্বন। পরজীবী হয়ে পড়েছিলো অনিকেত। এইভাবেই তার আহ্নিক গতি আর
বার্ষিক গতি কাটছিলো। অনিকেত স্কুলটিচারের চাকরি পাওয়ার পর অতসী সংসারী
দেখতে চেয়েছিলো অনিকেতকে। অতসী ভেবেছিলো বিয়ে হলে অনিকেতের এই ভীতি ভাব
কেটে যাবে। উষা এসেছিলো তাই অনিকেতের জীবনে। পঁচিশের অনিকেত আর বাইশের উষা।
দুই কামরার বাসায় যেন প্রাণ ফিরে এলো। শ্বাশুড়ি কিম্বা স্বামীর ভালোবাসায়
কোন খামতি খুঁজে পায়নি উষা। পরিবারটি কখন যেন ওর কাছে আপনার হয়ে ওঠে।
অনিকেতও উষাকে পেয়ে নতুন এক পৃথিবীর স্বাদ পায়। ভয়গুলো যেন বড় একটা বিব্রত
করছিলোনা অনিকেতকে সে সময়। অনিকেতের জীবনে সুখের মেয়াদ সর্বদাই সংক্ষিপ্ত
ছিলো। এবার মাতৃহারা হল সে। কেউই বোঝেনি বিয়ের তিন মাসের মধ্যে অতসী চলে
যাবে। অতসীও। ঘুমের মধ্যে সে চলে গেল। উষা শ্মশাণঘাটে গেছিলো। মুখাগ্নি
করার পর অনিকেত থরথর করে কাঁপছিলো, পরজীবী অবলম্বনহীন হয়ে পড়েছিলো, আশ্রয়
খুঁজছিলো। উষা ঠান্ডা হয়ে যাওয়া অনিকেতের হাতটা শক্ত করে ধরে নির্ভরতা
জুগিয়েছিলো। অনিকেত সেদিন উষার মধ্যে অবলম্বন খুঁছে পেয়েছিলো। নিরাশ্রয়
পরজীবী লতিয়ে ওঠার চেষ্টা করেছিলো, আবার, নতুন করে।
সংসার তিন থেকে কমে আবার দুইয়ে নামলো। উষাকে আস্টেপিষ্টে জড়িয়ে শুরু হল অনিকেতের দিনরাত্রি। ঠিক সেইসময় উষা হঠাৎ চাকরি পেলো।
-এই জানো আমি চাকরি পেয়েছি, ব্যাঙ্কের চাকরি। ঘরের কাছেই।
-সেকি? হঠাৎ! কি করে হল?
-উফ! কোনটার জবাব আগে দিই বলতো?
-কেন? চাকরি করতে হবে কেন তোমায়? আমি নেই?
-তাতে কি? সরকারি চাকরি, আর এখন ডবল ইনকাম না হলে সংসার চালানো খুব মুশকিল।
-কিসের অভাব তোমার? আমিতো মাইনের সব টাকা তোমায় দিয়ে দিই, কেন তুমি চাকরি করবে?
-তুমি বুঝছোনা।
-কি বুঝছিনা আমি, না তুমি যাবেনা কোথাও প্লিস!
-আরেবাবা তুমি চলে গেলে আমারও তো সময় কাটতে চায়না, সময় কাটবে চাকরিটা করলে।
-না তুমি যাবেনা। ব্যাস!
-পাগলামো কোরনা। আর তাছাড়া তুমি ফিরতে ফিরতে আমি চলে আসবো।
-না সবসময় পারবেনা।
-হি হি, তুমি তাহলে আমায় নিয়ে আসবে তোমার ছুটি হবার পর। আমরা দেরি করে ফিরবো।
-কেন? দেরি হবে কেন?
-ঘুরে বেড়িয়ে, রাত্রের খাবার নিয়ে ফিরবো বলে।
বিয়ের
আগে পরীক্ষাটা দিয়েছিলো উষা। ওরা কাল চিঠিটা পাঠিয়েছিলো। উষার বাবা চিঠিটা
পেয়ে উষাকে ফোনে জানায়। অনিকেত ভয় পেয়েছিলো শুনে। কারণ যদি কিছু হয় উষার
ওইসময়ে। যদি রেশমের মত কেউ অতর্কিতে প্রবেশ করে ওদের জীবনে, উষার অগোচরে,
বন্ধু বেশে! আততায়ীর ছদ্মবেশী রূপটি ভোলেনি অনিকেত। সেই হানাদার এখনও ওর
মস্তিষ্কের অণু পরমাণুতে গেঁথে আছে। সুড়ঙ্গের মাঝে বাদামী রঙের একটা কফিন ও
মাঝে মধ্যেই দেখে। ও যখনই ওই কফিনের সামনে যায় তখনই কফিনের ঢাকনা খুলে
বেরিয়ে আসে অবিকল ওর মত দেখতে একটা মানুষ। ওর থেকে শক্তপোক্ত। ও পালাতে
চায়। পারেনা। পাদুটো যেন মাটিতে এঁটুলির মত এঁটে থাকে। ওই মানুষটা ওর শরীরে
এসে মিলিয়ে যায়। খুব কষ্ট হয় তখন অনিকেতের। ঘুম ভেঙে যাবার পরও কষ্টটা ওর
বুকে লেগে থাকে। ও তখন উষার বুকের মাঝখানে ওর নিরাপত্তা খোঁজে। মুখ ডুবিয়ে
ঘণ ঘন শ্বাস ফেলে ও। উষা ঘুম ভাঙা চোখে অনিকেতের মাথাটা শক্ত করে ওর বুকে
চেপে ধরে। অনিকেত ঘুমিয়ে পড়ে আস্তে আস্তে।
অনিকেতের আপত্তি
সত্বেও উষা চাকরিতে জয়েন করলো শেষমেশ। শুরু হল অনিকেতের আগবাড়ানো ভাবনা।
যার শুরু আছে শেষ নেই। উষা ততদিনে বুঝে গেছিলো অনিকেতকে। সাইকিয়াট্রিস্টের
সাথে পরামর্শ করার কথা বলতো অনিকেতকে।
-আমাকে পাগল মনে কর নাকি! আসলে আমার খুব চিন্তা হয়, তুমি পাশে থাকলে আমি ভালো থাকি।
-আমায় কিছু লুকোচ্ছ তুমি, খুলে বলোনা আমায়, কি হয় তোমার একেকসময়!
-একটা পুতুল দেবে? খেলবো।
-দেবো সবুর কর।
-বেশ ছেলে হলে নাম রাখবো ‘সবুর কর’ আর মেয়ে হলে কি রাখবে?
-উঁহু। ছেলেই হবে। অভিমন্যু, সপ্তরথীও যাকে দমিয়ে রাখতে পারেনি।
উষা জ্বলজ্বলে চোখে চেয়েছিলো অনিকেতের দিকে। অনিকেত শুনছিলো উষাকে। ওর রোমকুপে তখন কথাগুলো বসে গেছিলো।
অভিমন্যু
এলো। ওদের অভিমন্যু। অনিকেত আর উষার দুই কামরার বাসায় খুশি বসত গড়লো। দুই
থেকে সংসার আবার তিনে। অনিকেতের খুশির সীমা নেই। উষারও। অনিকেতের মনে পড়ে
অভিমন্যুকে যখন স্কুলে ভর্তি করা হল, সেদিন সে খুব কাঁদছিলো, কিছুতেই
যাবেনা সে। অনিকেতের কোলে উঠে তার বুকে মুখ গুঁজেছিলো অভিমন্যু।
-বাবা আমি তোমার কাছে পড়বো, স্কুলে যাবোনা।
-আচ্ছা ঠিক আছে, তাই হবে সোনা।
উষা
অনিকেতের কোল থেকে ছিনিয়ে নিয়ে কারপুলারের হাতে সঁপে দিয়েছিলো অভিমন্যুকে।
অনিকেতের বড়ই নিষ্ঠুর মনে হয়েছিলো উষাকে সেইসময়, কিন্তু কিছু বলতে সাহসে
কুলায়নি ওর।
অভিমন্যুর লেখাপড়া, খেলাধুলো সব কিছুই অনিকেত নিজের
কাঁধে তুলে নিয়েছিলো। সারাটাক্ষণ শুধু তখন ছেলের সাথে খুনসুটি, ওরা মিশতো
ঠিক যেন বন্ধু। উষা দেখতো আর হাসতো। ‘তোমার বন্ধুটি বেশ হয়েছে’। উষার কথা
ওদের কানে ঢুকতোনা তখন। অনিকেত ঘোড়া হয়ে বীর অভিমন্যুকে তখন নিয়ে যাচ্ছে
যুদ্ধক্ষেত্রে। অভিমন্যুও জাঁকিয়ে বসেছে তার ঘোড়ায়, ছোট ছোট হাতদুটি দিয়ে
ঘোড়ার কেশর মুঠো করে চেপে ধরেছে।
অভিমন্যু তখন ক্লাস সিক্সে
পড়ে। সেইসময় একটা ঘটনা ঘটলো। অভিমন্যুকে বাপেরবাড়িতে রেখে ও অনিকেতকে নিয়ে
সিনেমা দেখতে গেছিলো। সিনেমাহলের অন্ধকারে পিছনের সিট থেকে বাড়ানো লালসা
ভরা হাত যখন উষাকে স্পর্শ করেছিলো, অনিকেত দেখেও না দেখার ভান করে সিঁটিয়ে
ছিলো সিটের এককোণে। উষা চেঁচিয়ে উঠেছিলো, প্রতিবাদ করেছিলো, পুলিশ ডেকে
ধরিয়ে দিতে চেয়েছিলো সেই কামুক ব্যক্তিটিকে। সারা শরীর ঘিনঘিন করে উঠেছিলো
লোকটিকে দেখে। হলের মধ্যে একটা শোরগোল পড়ে গেছিলো তখন। কিন্তু অনিকেত পুলিশ
ডেকে ঝামেলা বাড়াতে চায়নি। লোকটির মরা মাছের মত চোখ আর মুখে বসন্তের দাগ
অনিকেতকে ভয় পাইয়ে দিয়েছিলো সেইসময়। লোকটির চেহারা রেশমকে মনে পড়িয়ে
দিয়েছিলো ওকে। উষাকে নিয়ে সে চলে এসেছিলো ওখান থেকে। উষা যেতে যেতে রাগে
ফোঁসফোঁস করছিলো।
-কাপুরুষ কোথাকার!
পরদিন ছেলের হাত ধরে বাপের বাড়ি চলে এসেছিলো উষা। অনিকেতের ভয় জড়ানো আকুতিকে উপেক্ষা করে।অনিকেত ফোন করেছিলো উষাকে।
-প্লিস উষা, আমায় ভুল বুঝোনা!
-আমি তোমায় বুঝে গেছি। তুমি কাপুরুষ। তোমার সাথে ছেলে থাকলে ছেলেও এমন হবে। আমি চাইনা ও এমন হোক।
-তোমরা ফিরে এসো, আমি নিজেকে ঠিক করে নেবো। দেখো তুমি।
-না পারবেনা। তোমার অবলম্বন চাই। তাই আমাদের দরকার। তুমি কিছুদিন একা থাকো। হয়তো তুমি সেরে উঠবে। এটাই তোমার ওষুধ।
-পারবোনা আমি তোমাদের ছাড়া থাকতে। প্লিস ফিরে এসো একবারটি।
ফোনটা কেটে দিয়েছিলো উষা।
ঠিক
হয়েছিলো প্র্রতি শনিবার বিকেলে অভিমন্যু বাবার কাছে আসবে। সোমবার সকালে
ফিরে যাবে। উষার এই ব্যবস্থা মেনে নেওয়া ছাড়া আর কোন উপায় ছিলোনা অনিকেতের
কাছে। রাত্রে একা শোয়ার অভ্যেস কোনকালেই ছিলোনা অনিকেতের। খুব অস্বস্তি হত
ওর। ভূতের ভয় ছিলোনা ওর, কিন্তু চোখ বুজলে কিছু দুঃস্বপ্ন ওকে তাড়া করতো।
এর আগে উষার বুকে মাথা গুঁজে ও ওগুলোকে তাড়াতো। কিন্তু এখন ও সম্পূর্ণ একা।
রাত্রিবেলায় বেডরুমে লাইট জ্বালিয়ে ঘুমাতো ও। তাও ওত পেতে থাকা
দুঃস্বপ্নগুলো ঘুমের ভিতর তাড়া করতো ওকে। সপ্তাহের শেষদুটি দিনের জন্য অধীর
আগ্রহে অপেক্ষা করতো অনিকেত। ওই দুটি দিন ওকে বেঁচে থাকার রসদ যোগাতো।
অভিমানের পাহাড় জমছিলো অনিকেতের। উষারও। পাহাড় ডিঙিয়ে কেউ কারোর কাছে
পৌঁছোতে পারলোনা।
আগবাড়ানো চিন্তাগুলো একাকিত্বের সুযোগ নিয়ে
অনিকেতকে কুরে কুরে খেতে থাকলো। অভিমন্যুর আসতে দেরি হলেই চিন্তা হত
অনিকেতের। যেমন আজ ওর আসতে একটু দেরি হচ্ছিলো, ফোনেও পাওয়া যাচ্ছিলোনা
উষাকে, কোথায় গেল? তবে কি কিছু হয়েছে ওদের? অনিকেত চাপা টেনসনে ঘর থেকে
বেরিয়ে গেট খুলে সামনের রাস্তায় এসে দাঁড়ালো, দূর থেকে একটা অস্পষ্ট অবয়ব
দেখতে পেলো সে, কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ, পরিচিত হাঁটা, স্বস্তি বোধ করলো
অনিকেত। ভুল ভাঙলো একটু কাছে আসার পর। ও নয়। আবার শুরু হল উৎকন্ঠা। কেন
দেরি হচ্ছে? অনিকেতের ভয়কে চর্তুগুণ বাড়িয়ে ঝুপ করে হঠাৎ সন্ধে নামে।
স্ট্রিটলাইটগুলো তখনও জ্বলে ওঠেনি। তাই দূরের রাস্তায় ছায়াময় কিছু শরীরের
আনাগোনাই সে লক্ষ্য করে, যেগুলো তার বাড়ির আগে এসেই মিলিয়ে যাচ্ছিলো। ও ঘরে
ঢুকে চা বানাতে যায় ইনডাকসনে। ইনডাকসনের অন বাটনটিতে আঙুলের স্পর্শ দিয়ে
মেনু বাটনটি টিপে চায়ের জল চাপায়। আপ ডাউনের বাটন এডজাস্ট করে টেম্পারেচার
সারে তিনশোতে রাখে ও। কিছুটা সময় কাটে অনিকেতের এইভাবে। জলটা যখন টগবগ করে
ফুটে উঠে বুদবুদ তৈরী করছিলো ঠিক সেই সময় অনিকেত দুচামচ চাপাতা ওতে ঢেলে
কানটা খাঁড়া করে, খুট করে যেন গেটের শব্দ হল! ও দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে আসে,
না গেট যেমন কার তেমনই। বন্ধ। নিঃশব্দের আওয়াজ হয়তো, বা ভ্রম। অনিকেত ফিরে
আসে আবার কিচেনে। চায়ের পাতা তখন ফুটতে শুরু করেছে। ও ইনডাকসন অফ করে
সসপেনে ঢাকনাটা চাপিয়ে দেয়। সেদিনের খবরের কাগজটা বের করে পড়তে থাকে ও।
অক্ষর গুলো কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছিলো সেইসময়। হঠাৎ কলিংবেলের আওয়াজ
পেয়ে অনিকেত চমকে ওঠে। এসেছে এতক্ষণে! ভাবে ও। অনিকেত দরজার আগলটি খুলতেই
কেবলওয়ালার হাসি মুখ দেখতে পায়। ‘দাদা চ্যানেলগুলো সব ঠিকঠাক চলছেতো?’
অনিকেত মানিব্যাগ বের করে প্রশ্নকর্তার হাতে ওর মাসিক প্রাপ্যটি বুঝিয়ে
দিয়ে দরজাটা বন্ধ করতে গিয়ে দেখে হন্তদন্ত হয়ে অভিমন্যু গেট খুলছে। বুকের
মধ্যে জমে থাকা পাহাড়প্রমাণ দুঃশ্চিন্তা বেরিয়ে যাওয়ার শব্দ শোনে অনিকেত-
‘উফ’।
পরদিন অভিমন্যুকে পইপই করে বাইরে বেরোতে বারণ করেছিলো অনিকেত।
-আজ যাসনা ওখানে, আকাশটা কেমন ঘোর হয়ে এসেছে।
-উফ! তুমি! আর তোমার ভয়!
অনিকেতকে
এক ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে অভিমন্যু বেরিয়ে গেছিলো মিনারের মাঠে। ওখানে ওর
বন্ধুরা প্রতি রবিবার সকালে ফুটবল খেলে, কোনদিন পুকুরটাতে সাঁতরায়।
অভিমন্যু সাঁতার শিখে ফেলেছিলো ওদের সাথে থেকে। তাই প্রতি রবিবারের আকর্ষণ
অভিমন্যুকে টানছিলো মিনারের মাঠে। অনিকেত কেবল ভীরু দৃষ্টি মেলে চেয়ে থাকে
অপস্রিয়মাণ অভিমন্যুর দিকে।
হঠাৎ কড়কড় শব্দে অনিকেতকে কাঁপিয়ে
দিয়ে একটা বাজ কিছুদূরে এসে পড়লো আর সাথে নামলো বড় বড় ফোটায় বৃষ্টি। এই
ভয়টাই করছিলো সে। সকাল থেকে ভবঘুরে মেঘেদের আনাগোনায় অনিকেতের মনে হচ্ছিলো
আজ বৃষ্টি হবে, প্রকৃতি বহুদিন পর তান্ডব করবে। অনিকেত সাইকেল বের করে চোখ
বন্ধ করে প্যাডেল করতে থাকে। বৃষ্টির ঝাপটা আর মেঘেদের সংঘর্ষ ওকে কাহিল
করে দিচ্ছিলো একেকসময়। চোয়াল চাপা লড়াইএ অনিকেত তখন পার হচ্ছিলো দূরত্ব।
বৃষ্টিতে ঝাপসা হয়ে আসছিলো চারিপাশ। দুহাত দূরত্বের কিছু আর দেখা
যাচ্ছিলোনা বৃষ্টির ঝাপটায়। অনিকেতের পরিচিত রাস্তা এটা, খানা খন্দগুলো
পর্যন্ত ওর চেনা। তাই সে দ্রুত সাইকেল চালিয়ে চলে আসতে পারছিলো। সামনের মাঠ
থেকে কিছু উন্মত্ত কোলাহল শুনে চলার বেগ কমে যায় অনিকেতের। সেইসময়
উপর্যুপরি আরো দুটো বাজ পড়ে দূরে, সাইকেলটা দাঁড় করিয়ে দুহাতে চোখদুটিকে
কচলে সামনেটা দেখার চেষ্টা করে। কারণ বৃষ্টির ঝাপটায় চোখ খুলতে পারছিলোনা
ও। কিছুটা পরিষ্কার হতে ও দেখতে পায় মুষ্টিবদ্ধ কিছু হাতের দাপট। মাঠের এ
কোণা থেকে ও কোণা ঘুরতে ফিরতে থাকে ওই হাতের দঙ্গল, ওই ভীড় থেকে ও দেখতে
পায় অভিমন্যুকে, খালি গা, খালি পা। যেন অনিকেতের অনাস্বাদিত কৈশোর। পাশের
পুকুরটায় ওরা তখন ডিগবাজি খেয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। আতঙ্কে অনিকেতের বুকটা হাপর
টানছিলো তখন। দেখা যাচ্ছিলোনা ওদের। ও দ্রুত পুকুরের ধারে গিয়ে জলের দিকে
তাকিয়ে থাকে। হঠাৎ পুকুরের অপর পাড়ে ছেলেগুলো ভেসে ওঠে। ডুবসাঁতারে। বুকের
খাঁচা থেকে অনিকেতের প্রাণটা যেন বেরিয়ে আসছিলো। ওদের দেখে ও যেন প্রাণ
ফিরে পেলো। সাহসটাও বোধহয়। মনটা ভীষণ হাল্কা হয়ে গেছিলো ওর সেইসময়,
অভিমন্যুর মধ্যে সন্তোষকে খুঁজে পায় ও। ভয়টা সেইসময় অনিকেতকে ছেড়ে চলে
গেছিলো। অনিকেতকে দেখে অপর পাড় থেকে হাসির রোল ওঠে। অভিমন্যু সাঁতরে এপাড়ে
এসে অনিকেতের কাছে দাঁড়ায়। ওর সারা শরীর থেকে তখন জল ঝড়ে পড়ছিলো। বৃষ্টির
জল আর পুকুরের জল তখন একাকার হয়ে গেছিলো অভিমন্যুর শরীরে।
-ওরা কি বলছে শুনতে পাচ্ছো।
-কি বলছে ওরা?
-ভীতু! আমি তোমার মত হতে চাইনা বাবা। আমি ভয় পাইনা তোমার মত।
-কে বলেছে আমি ভয় পাই? আর তোকেই বা কে ভয় পেতে বলেছে?
-তুমি। তুমি এসে জানান দাও ভয় বলে কিছু আছে, আমি জানতে চাইনা।
-তুই ভুল বুঝছিস আমায়, বিশ্বাস কর। আমার আর ভয় নেই।
-না। ভুল বুঝিনি। তুমি সবকিছুতে ভয় পাও, আমি দেখেছি তোমায়।
-নারে, এ তোর বোঝার ভুল।
-ভুল নয়। বাবা প্লিস তুমি চলে যাও, ওরা হাসাহাসি করছে তোমাকে নিয়ে’।
কথাগুলি
চাবুকের মত শরীরে আছড়ে পড়ে অনিকেতের। অনিকেত আর ভাবতে পারেনা। পাগলের মত
দৌড়ে যায় সে মিনারের দিকে। তার অনাস্বাদিত কিশোরবেলাকে সে কিছুতেই নষ্ট হতে
দেবেনা। অভিমন্যু অবাক হয়ে চেয়ে থাকে বাবার দিকে। অনিকেত ঘোরানো সিঁড়ি
দিয়ে মিনারের উপরে উঠতে থাকে। পরিত্যক্ত মিনারটির ভিতরে জমে থাকা পাতলা
অন্ধকারের আস্তরন ভেদ করে সে উঠতে থাকে। ঘুলঘুলিতে থাকা চামচিকে গুলো উড়তে
থাকে ওর সামনে দিয়ে, পায়ের উপর দিয়ে কি যেন সরসর করে চলে যায়। আজ অনিকেতের
ভয় যেন অনিকেতকে ত্যগ করেছে। দুচোখে তার প্রত্যয়। সে পারবে। মিনারের ছাতের
আলসেতে সে ওঠে। বাসা থেকে দুটো পালক দুহাতে নিয়ে সে দুহাত ছড়িয়ে দেয়। নীচ
থেকে অভিমন্যুকে পিঁপড়ের মত লাগে অনিকেতের। আকাশে তখন মেঘেরা খেলা করছিলো,
যেন ওরা ভাসমান মাইন। গোটা প্রকৃতিকে এফোঁড় ওফোঁড় করছিলো ওরা তখন। অনিকেত
ওদের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে ‘আজ তোরা হারবি আর আমি জিতবো, পারলে জেত
আমার কাছ থেকে’।
অনিকেত মেঘেদের চিড়ে উঠে পড়ে অনেক অনেক উঁচুতে।
নীচে পড়ে থাকে অনিকেতের খোলসটা। আর অভিমন্যু। অনিকেতের অনাস্বাদিত
কিশোরবেলা। অনিকেত উড়ে চলে দ্বিধা দ্বন্দ্বহীন হয়ে। মনে আর তার কোন ভয় নেই।
ও আজ মুক্ত। ওযে শঙ্খচিল হতে পেরেছে শেষমেশ।
সমাপ্তঃ
Anirban Majumdar