ধারাবাহিক - মহাপ্রস্থানের পথে- অয়ন দাস

 

ধারাবাহিক

 মহাপ্রস্থানের পথে
অয়ন দাস


  দ্বিতীয় পর্ব পড়তে ক্লিক করুন এইখানে 

 
|| তৃতীয়  পর্ব  ||


১৩.

    প্রফেসরের ব্যক্তিগত ডাইরিগুলো শ্রীময়ী এক এক করে দেখছিলো থানায় বসে। বেশির ভাগেই রোজনামচা ছাড়া আর কিছুই নেই। আসলে প্রফেসর নন্দী যে নিয়মিতভাবে লেখালেখি করতেন তা নয়। দেখা যাচ্ছে, কোনো মাসে হয়তো একটাই এন্ট্রি। আবার কখনও সপ্তাহে তিন চারদিনের ঘটনাও একটানা নথিবদ্ধ করেছেন। তেমন উল্লেখযোগ্য ঘটনা না হলে ডায়রিতে তার উল্লেখ নেই।

    শ্রীময়ী খুঁজে দেখলো সর্বমোট বাইশটা ডাইরি রয়েছে। এগুলো সবকটা খুঁটিয়ে দেখতে হলে রাত হয়ে যাবে। কিন্তু তাও সবকটাই দেখতে হবে। বলা যায় না যদি কোনো সূত্র মিলে যায়।। ওই যে কোথায় আছে না-
" যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখ তাই; পাইলেও পাইতে পারো অমূল্য রতন।" 
তাই যতই রাত হোক ডাইরিগুলো আগে শেষ করা দরকার।

    তবে এতগুলো ডাইরি একটানা পড়া বেশ ধৈর্যের পরীক্ষাও বটে। কখন যে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে সন্ধ্যা নেমে গেছে টেরই পায় নি শ্রীময়ী। হুঁশ ফিরলো যখন থানার ওসি বললেন, " ম্যাডাম বাড়ি যাবেন না ?"
-" হ্যাঁ, যাবো, কটা বাজলো বলুন তো?", ডায়রিতে বুঁদ হয়ে রয়েছে শ্রীময়ী; সেই অবস্থাতেই জিজ্ঞেস করলো ওসি কে।
-" রাত আটটা হতে চললো", বললেন ওসি।
-" সেকি এত রাত হয়ে গেলো ?"
-" আসলে আপনি কাজ করছিলেন দেখে আমি আর ডাকিনি।"
-" হুম এবার আমিও উঠবো। এক কাজ করুন আধঘন্টার মধ্যে একটা গাড়ি রেডি করুন। আমি বেরোবো।"
-" ওকে ম্যাডাম।"
-" ও ভালো কথা অনির্বাণ বাবু ফিরেছেন ?"
-" না উনি তো আসেননি এখনো। কিছু বলতে হবে ?"
-" না ঠিক আছে, আমি ফোন করে নিচ্ছি। আপনি গাড়ির ব্যবস্থাটা একটু করে দিন কাইন্ডলি।"
-" ঠিক আছে ম্যাডাম", বলে ওসি চলে যেতেই চেয়ার ছেড়ে উঠলো শ্রীময়ী। একটানা বসে কাজ করে কেমন যেন একটা আড়ষ্টতা এসে গেছে। এবার একটু বিশ্রাম দরকার। নইলে মাথাটা খেলবে না। এই কেসটায় একটু বেশিই মাথার ব্যায়াম দরকার। এমন একটা চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে খুনি, যে বিষয়টার সমাধান না হওয়া অব্দি শান্তি নেই।

    হঠাৎ শ্রীময়ীর রাতুলের কথা মনে পড়লো। ইশ ওকে একটা ফোন করা উচিত ছিলো। ও কতদূর অগ্রসর হলো জানা দরকার ? অবশ্য কিছু বার করতে পারলে নিজেই জানাতো। তাও একবার ফোন করা উচিত ভেবে মোবাইলটা বার করতে যাবে, দেখলো অনির্বাণ কল করছে।

    ফোনটা ধরতেই অনির্বাণ বলে উঠলো,
-" ম্যাডাম প্রফেসরের কল রেকর্ডটা পাওয়া গেছে। লাস্ট কল দেখাচ্ছে রাত এগারোটা নাগাদ। ভদ্রলোক কোনো এক মুকেশ কুমার কে ফোন করেছিলেন। মিনিট খানেক কথা হয়।"
-" বলে যান"
-" এছাড়া অন্য যা যা কল করেছেন তার মধ্যে সেক্রেটারির নম্বর রয়েছে আর তেমন একটা ফোন বিশেষ করতেন না মনে হলো। শুধু এই মুকেশ কুমারের সাথেই বার কয়েক কথা হয়েছে।
-" আচ্ছা এই মুকেশ কুমারের লোকেশনটা কোথায় দেখাচ্ছে ?"
-" ঠিকানাটা পাটনার কোনো একটা জায়গা দেখাচ্ছে।"
-" আই সী। শুনুন, ওখানকার লোকাল থানার সাথে যোগাযোগ করুন। যেভাবেই হোক এই মুকেশ কুমারের ডিটেলস চাই আমার। মনে হচ্ছে কোনো না কোনো সূত্র ঠিক পাবো।"
-" একদম ম্যাডাম। আমি সেটাই করছি।"
-" সময়মতো আপডেট দেবেন আমায়", বলে ফোনটা ছেড়ে দিলো।

১৪.

    লোথাল, নামটা খুবই পরিচিত রাতুলের। গুজরাটে অবস্থিত একটি শহর, আমেদাবাদ থেকে প্রায় পঞ্চাশ মাইল দূরে ভারতের অন্যতম হেরিটেজ অঞ্চল। দেখতে গেলে লোথালের ঐতিহাসিক গুরুত্ব অসীম। সিন্ধু সভ্যতার অন্যতম শহর মহেঞ্জোদারোর বেশ কিছু প্রাচীন নিদর্শন স্বরূপ আজও গুজরাটের এই অঞ্চল এক গৌরবগাথার সাক্ষ্য বহন করে চলেছে।

    সেই লোথালের সাথে প্রফেসর নন্দীর জীবনের একটা ঘটনা জড়িয়ে রয়েছে দেখে রাতুল আর একটু গভীর ভাবেই শুরু করলো ইন্টারনেটে। কিন্তু শেষমেশ হতাশ হলো অবশ্য। ওই একটা সংবাদ ছাড়া তেমন কোনো কিছুই পাওয়া পাওয়া গেলো না। তাও কেমন যেন খাপছাড়া ভাবে নিউজটা কভার করা হয়েছে। কিভাবে আগুন লেগেছিলো, তার পর কী হলো এসবের কোন উল্লেখ সেভাবে নেই। তার মানে কি ঘটনাটা চেপে দেওয়া হয়েছিলো, নাকি সেরকম গুরুত্বপূর্ণ কিছু ব্যাপার আদপেই ছিল না। 

    যে তিনজন লোক আজ থেকে প্রায় পঁচিশ বছর আগে লোথালে কোনো একটা খননকার্যের স্বাক্ষী হতে গিয়ে এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের মুখে পড়েন- প্রফেসর ছাড়া বাকিরা হলেন ডঃ বিধান চন্দ্র শর্মা এবং প্রফেসর মুকেশ কুমার। এঁদের মধ্যে ডঃ বিধান শর্মা একজন আর্কিওলজিস্ট, যিনি বিগত কয়েক বছর ধরেই কালিবঙ্গান এবং হিসারে রীতিমতো দাপটের সাথে কাজ করে চলেছেন সিন্ধু সভ্যতার বিভিন্ন সাইট গুলোতে যেখানে আবার নতুন করে খনন কার্য শুরু হয়েছে, প্রফেসর মুকেশ কুমার পাটনা ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক। এবং এনারও ইতিহাস সম্বন্ধে প্রগাঢ় জ্ঞান রয়েছে। নিজ ক্ষেত্রে ইনিও কম বিখ্যাত নন।

    এখন প্রশ্ন হচ্ছে তিন তিনজন বিখ্যাত ব্যক্তি কোনো একটা বিপদে পড়লেন, যদি ইন্টারনেটের খবর সত্যি বলে ধরে নেওয়া যায় তবে এর সাথে একটা ভয়ঙ্কর অগ্নিকাণ্ডেরও সংযোগ রয়েছে, অথচ এতবড় খবরখানা চেপে দেওয়া হলো কেন ?

    এসব ভাবতে ভাবতেই রাতুল একবার ফোন করলো শ্রীময়ীকে।
-" ফিরেছিস নাকি এখনো কাজেই ?"
-" না না এই বেরোচ্ছি। বাই দি ওয়ে, সরি রাতুল আমার একটা ফোন করা উচিত ছিলো তোকে", বললো শ্রীময়ী।
-" ওসব কথা ছাড়। তুই ওদিকে কোনো ক্লু পেলি কি ?"
-" ডাইরি থেকে তো নাথিং। অবশ্য সবগুলো এখনো পড়ে উঠতে পারিনি। প্রফেসরের কল রেকর্ড চেক করা হয়েছে। লাস্ট কল কোনো এক মুকেশ কুমারকে করেছিলেন। পাটনায় থাকে, প্রফেসর নন্দীর মতোই ইতিহাসের অধ্যাপক। ব্যাস এইটুকুই।"
-" কি নাম বললি- মুকেশ কুমার !!!"
-" হ্যাঁ, কেন বলতো ? কোনো সূত্র পেয়েছিস নাকি ?"

    রাতুল হঠাৎ চুপ করে গেলো দেখে শ্রীময়ী অধৈর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলো আবার, " কীরে বল, কিছু জানতে পেরেছিস ?"
-" শোন শ্রীময়ী, ব্যাপারটা যা ভেবেছিলাম তার চেয়েও বেশি জটিল। তুই এক কাজ কর, ফেরার পথে কফি লাউঞ্জ হয়ে যা। আমি ওখানেই তোর সাথে মিট করছি। "
-" কী ব্যাপার বলতো রাতুল?", সন্দিগ্ধ ভাবে জানতে চাইলো শ্রীময়ী।
রাতুল শুধু বললো, " দেখা করে সবটা বলছি।"

১৫.

    মোক্ষ। সেকি সহজে মেলে ! তার জন্য সাধনা করতে হয়। আত্মার সাথে যোগক্রিয়া যখন একাত্ম হয়ে ভক্তিযোগ, জ্ঞানযোগ আর কর্মযোগের সমন্বয় ঘটে, মোক্ষলাভের পথ উন্মুক্ত হয়। এই ত্রহ্যমার্গ মানুষকে মোক্ষলাভের পথে চালিত করতে সহায়তা করতে শেখায়। নিষ্কাম কর্মের মাধ্যমে নিজেকে সমর্পণ করার মহান দর্শন যখন নিজের মধ্যে উপলব্ধ হয় তখনই প্রকৃত মোক্ষলাভ হবার সুবর্ণ সুযোগ আসে-
" সাংখ্যযোগৌ পৃথগ্বালাঃ, প্রবদন্তি ন পন্ডিতাঃ" ,

    অর্থাৎ কিনা অজ্ঞ ব্যক্তিই শুধু কর্ম আর জ্ঞান কে পৃথক করে দেখে, যে প্রকৃত জ্ঞানী সে এমন ভুল কখনো করে না যা তার মোক্ষলাভের অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়।

    এসব তত্ত্ব কথা বৃষকেতুকে ছোট থেকেই বড় প্রভাবিত করে। একা এই বিষম জীবনের ভার নিয়ে দশ বছর বয়স থেকে আজ এতগুলো দিন পার করেছে। তার জীবনের মোক্ষ শুধু একটাই। যাঁরা তার দিনগুলোকে নরকযন্ত্রনায় পরিপূর্ণ করে তুলেছে তাদের উপযুক্ত শাস্তি দেওয়া এবং তার পারিবারিক অভিজ্ঞানটিকে পুনরায় হস্তগত করে সেটাকে পুনরায় সুরক্ষা প্রদান করা যাতে ভবিষ্যতে আর কেউ সেটাকে কুক্ষিগত করে পৃথিবীতে বিধ্বংস সৃষ্টি করার উন্মত্ততায় মেতে উঠতে না পারে। তাই এই ধর্মযুদ্ধ। তবে সে একা নয়। সারথি আছেন একজন, যিনি নেপথ্যে থেকে চালনা করছেন। তিনি বা থাকলে হয়তো এই যুদ্ধে সফল হতে পারতো না বৃষকেতু। প্রতিটি পদক্ষেপে তিনি সাহায্য করে এসেছেন। তিনিই হলেন বৃষকেতুর এই রণক্ষেত্রের মধুসূদন।

    টুং করে একটা শব্দ হতেই যেন একটা ঘোরলাগা ভাব থেকে বাস্তবে অবতীর্ণ হলো বৃষকেতু। একটা মেসেজ ঢুকেছে। সেখানে একজনের ছবি। মধ্যবয়স্ক এক ভদ্রলোক। দেখে মনে হয় সমাজের উচ্চশ্রেণীর কোনো ব্যক্তি। ঠিকানাটা পাটনার এক অঞ্চলের।
নাম প্রফেসর মুকেশ কুমার। সঙ্গে আরও কিছু বিস্তারিত তথ্য।

    আবার পাঞ্চজন্য বাজতে শুরু করে দিয়েছে, নতুন এক লক্ষ্য সামনে। আবারো এক খোঁজ শুরু হবে। যজ্ঞের আগুনে ঘৃত দান করে বৃষকেতু তৈরি হতে থাকে। সে যে এই যজ্ঞের ঋত্বিক। সফল তাকে হতে হবেই। নচেৎ মৃত্যুও তার চেয়ে বরং বেশি গর্বের।

    মোবাইলটা ঠিক সেই মুহূর্তেই বেজে উঠলো বৃষকেতুর। 'হ্যালো' বলতেই অপর প্রান্তে একটা ভারী গলা হিন্দিতে উত্তর দিলো, " রাতুল দেব বর্মন। ইহি নাম বাতায়া থা না।"
-" ক্যারি অন"
-" কফি লাউঞ্জে আই.পি.এস. শ্রীময়ী ব্যানার্জির সাথে কোনো ব্যাপারে মিটিং করছে। মনে হচ্ছে সিরিয়াস ম্যাটার।"
-" তুমি শুধু নজর রাখো আর আমায় জানাতে থাকো। তারপর আমি দেখে নেবো বাকিটা।"
-" ওকে বস"

    ফোনটা ছেড়ে দিয়ে বৃষকেতু হাল্কা সুরে মিউজিক প্লেয়ারটা চালিয়ে দিলো-
            " .... ফির ভি জাগে ইয়ে দো ন্যায়না
                          স্বপ্নোও কা বোঝ সংযোতে হ্যায়
              কুছ এইসে ভি পল হোতে হ্যায়
কুছ এইসে ভি পল হোতে হ্যায় ... "

১৬.

    রাতুল আর শ্রীময়ী, দুজনেরই খুব প্রিয় একটা জায়গা এই কফি লাউঞ্জ। প্রথম জীবনের অনেকগুলো দিন, অনেক মুহূর্ত এই বেঞ্চ গুলোতে কাটিয়েছে ওরা। মনে পড়ে যাচ্ছে ইউনিভার্সিটির দিনগুলোর কথা। কতবার কোণের দিকের বেঞ্চিটায় বসে রাতুল আর শ্রীময়ী ঘণ্টার পর ঘন্টা গল্প করে যেতো। তখন যেন কিছুতেই একে অপরকে ছাড়তে ইচ্ছে করতো না। কত দিন হবে তাও বছর দশেক আগে তো বটেই। মনে আছে রাতুল একদিন একটা মোবাইল ফোন কিনে এনে দেখিয়েছিল। আজকালকার স্মার্ট ফোনের কাছে সে জিনিস তখন নেহাৎই শিশু। ছবি তোলা ইন্টারনেট করা এসব ভাবনারও বাইরে ছিলো। শ্রীময়ীও পরে পরে একটা ফোন কিনেছিলো। তারপর রোজ রাতে গল্প আড্ডা যেন ফুরোতেই চাইতো না। দিনে একশটার বেশি মেসেজ করা যেতো না। তাও মুহূর্তে শেষ হয়ে যেত। আসলে কথার স্টক ছিলো অফুরন্ত। কী ভালোই না ছিলো সেসব দিন।

    এতদিন পর এখানে আবার ফিরে এসে কেমন একটা অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছিলো শ্রীময়ীর। সেই পুরোনো জায়গা। সেই একই রকম হালকা সুরে পুরোনো দিনের গান বাজছে দেওয়ালে টাঙ্গানো ছোট ছোট মিউজিক বক্স গুলো থেকে-

" ...ওও শাম কুছ আজীব থি, ইয়ে শাম ভি আজীব হে;
ও কাল ভি পাস পাস থি, ও আজ ভি করীব হ্যায়...." ।

এই নস্টালজিয়া ব্যক্ত করবার নয়, শুধুই অনুভব করার।

শ্রীময়ীকে দেখে রাতুল হাত নাড়লো। ও অনেক আগেই এসে বসে আছে।

" হাই", বলে শ্রীময়ী এসে বসতে না বসতেই বললো, " একটু লেট হয়ে গেলো।"
-" আরে ইটস ওকে। তোর লেট হবে না তো কি আমার হবে। এত বড় অফিসার তুই।"
-" এই বাজে কথা রাখ তো। নিশ্চই খিদে পেয়েছে তোর? "
-" তা পেয়েছে বৈকি। তবে তুই না, আমি যখন ডেকে এনেছি, আমিই খাওয়াবো।"
-" আরে... কেন ?"
-" আহ বলছি তো। আগে বোস শান্তি করে", বলেই ওয়েটারকে ডাকলো রাতুল।

রাতুলটা একটুও বদলায় নি। ঠিক আগের মতোই আছে যেন।

রাতুল আবার জিজ্ঞেস করলো, " দুটো এগ চিকেন রোল আর কোল্ড ড্রিংকস বলি? "
-" আরে তুই এত ব্যস্ত হচ্ছিস কেন ? আগে কেন ডেকেছিস বল তো", শ্রীময়ী জিজ্ঞেস করে রাতুলকে।

রাতুল খাবারের অর্ডার দিয়ে বলতে শুরু করে,
-" শোন শ্রী, এই কেসটা মোটেও আর পাঁচটা কেসের মতো নয়। এটার রেশ কোথাও একটা অনেক পুরোনো কোনো ঘটনার সাথে জড়িয়ে আছে বলে আমার মনে হয়। আর সেটা প্রফেসরের রিসার্চ সংক্রান্ত।"
-" এটা কী ভাবে মনে হলো তোর?", প্রশ্ন করলো শ্রীময়ী।
-" ওই শ্লোকটার একটা ব্যাখা আমার মনে হয়েছে অতীতের কোনো কর্মফল সংক্রান্ত হতে পারে।"
-" হুম, কিন্তু কর্মটা কী সেটাই তো জানা যাচ্ছে না।"
-" তার আগে বলি ওনার রিসার্চের বিষয় নিয়ে, যেটা হলো মহাভারত। অবশ্য শুধু মহাভারত বললে ভুল হবে, আমাদের প্রাচীন সভ্যতার সাথে, এই যেমন ধর- মোহেঞ্জোদারো; তার সাথে মহাভারতের একটা যোগসূত্র খুঁজে বার করাই ছিলো প্রফেসরের রিসার্চের প্রধান বিষয়।"
-" হোয়াট! কীসব বলছিস ? মোহেঞ্জোদারো আর মহাভারত কি এক হলো ? এর মানে কী ?"

রাতুল মৃদু হাসলো মাত্র। অত্যন্ত রহস্যময় সে হাসি।

১৭.

    " শোন, শ্রী মহাভারতের যেকোনো ব্যখাই বৈজ্ঞানিক ভাবে প্রমাণ করা সম্ভব", রাতুল শ্রীময়ীকে বুঝিয়ে বলতে শুরু করলো, " সিন্ধু সভ্যতার প্রমাণ হিসেবে যে দলিল গুলো আমরা দেখে থাকি, যে শীলমোহর, ফলক প্রভৃতি আমরা সেই সময়কার ইতিহাসের সাক্ষী মনে করে থাকি সেগুলোর মধ্যেই মহাভারতের এমন অনেক ঘটনা লুকিয়ে রয়েছে যা দেখলে বিস্মিত হতে হয়। প্রফেসর নন্দী এসব নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা করেছেন। আমি নিজেও খানিকটা ওনার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছি। তাই বলছি তোকে, পৌরাণিক বলে সবকিছু উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এই যেমন এই ছবিটা, এটা দেখ ভালো করে।"

    রাতুল একটা ছবি ইন্টারনেট থেকে ডাউনলোড করে মোবাইলে দেখালো শ্রীময়ীকে। একটা ইউনিকর্ণের ছবি খোদাই করা শীল মোহর।
-" এরকম শীলমোহর তো মোহেঞ্জোদারোর বিভিন্ন সাইটে পাওয়া গেছে। ইতিহাস বইতেও পড়েছি", বললো শ্রীময়ী।
-" একস্যাক্টলি। তুই জেনে আশ্চর্য হবি মহাভারতে এবং পুরাণে দেবাদিদেব শিবকে অনেক সময় একশৃঙ্গ নামে সম্বোধন করা হয়েছে। তৃতীয় নেত্রর সাথে সামঞ্জস্য রেখেই এই নামকরণ। ইউনিকর্ণ আর একশৃঙ্গ আদপে কিন্তু একই।

    আচ্ছা, এবার এইটা দেখ। এই পাথরের অংশটায় তিনটি কুঁজ যুক্ত একটি শূকরের ছবি খোদাই করা হয়েছে। মহাভারতের শান্তিপর্বে বিষ্ণুর তৃতীয় অবতার, বরাহের প্রসঙ্গ আনা হয়েছে, যা ধরিত্রীকে ধারণ করতে সক্ষম হয়েছিল প্রলয়কালে। এই বরাহটিও তিনটি কুঁজ যুক্ত এবং হুবহু ওই শীল মোহরে খোদাই করা পশুটির ন্যায় দেখতে। তাহলে এইসমস্ত মিল গুলো কি করে আসছে ? সে যুগে তো আর কেউ গপ্প লিখে যায় নি ! মানুষ খোদাই করবার সময় আদপে কিছু প্রাচীন ঘটনাবলী মাথায় নিয়েই এসব কাজ করেছে। তাহলে এটা অস্বীকার করতে পারিস কি, যে মহাভারতের ঘটনাবলীর সবকিছুই গাঁজাখুরি। কোথাও গিয়ে একটা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা বহন করছে সব বর্ণনাই।"

-" মাই গড, এভাবে সত্যি কোনোদিন ভেবে দেখিনি রে রাতুল।"

    ইতিমধ্যে ওদের চিকেন রোল এসে গেছে। রাতুলের বোধহয় একটু বেশিই খিদে পেয়েছিলো। আসতে না আসতেই রোলে একটা বড়সড় কামড় বসিয়ে আবার বলতে শুরু করলো,
-" খ্রিস্টপূর্ব চার হাজার থেকে তিনহাজার বছর আগে একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে। শতদ্রু নদী, মানে আজকের সুতলেজ নাম যার, বিভিন্ন ভাগে ভাগ হয়ে যায়। এই ঘটনা কিন্তু জিওলজিস্টরা প্রমাণ করে দেখিয়েছে।
এবারে মহাভারতের বশিষ্ঠ মুনির আত্মাহুতির গল্পটা মনে কর।
উনি যখন নিজের প্রাণ দিতে গেলেন হৈমবতী নদীতে, সে নদী শত ধারায় বিভক্ত হয়ে শুতুদ্রি নাম পেলো আমাদের মহাকাব্যে। শুতুদ্রি আর শতদ্রু যে একই সেটা নিশ্চয় বুঝতে পারছিস। মহাকাশের নক্ষত্রের অবস্থানবলী মহাভারতের অনেক পর্বেই ডিটেইলসে দেওয়া আছে। সেগুলোর বিশ্লেষণ করলে এটা প্রমাণ করা গেছে যে বশিষ্ঠ মুনির ঘটনাও খ্রিস্টপূর্ব চার হাজার থেকে তিনহাজার বছর আগে ঘটেছে। আরো স্পেসিফিক করে বললে সময়কালটা দাঁড়ায় খ্রিস্টপূর্ব তিন হাজার একশোর কিছু কাছাকছি সময়।

এবারে হিসেবটা মিলছে তো ?

    এরকম হাজারো প্রমাণ রয়েছে আর সেই সাথে ব্যাখ্যা যা প্রমাণ করে মহাভারত নিছক গল্পগাথা নয়। তাহলে এভাবে এতকিছুর উল্লেখ থাকতে পারে না। প্রফেসর নন্দী এসব নিয়ে গবেষণা করতেই গুজরাট গিয়েছিলেন। তাই ওনার রিসার্চে মহাভারত, সিন্ধু সভ্যতা সব মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে। তিনি তো কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধকেও একটা বিশাল নিউক্লিয়ার যুদ্ধ বলেছেন। সে যুদ্ধ, ব্যবহৃত অস্ত্রসমূহ নিয়েও ডিটেলে রিসার্চ করেছেন। "

    শ্রীময়ী এতক্ষণ খেতে খেতে তন্ময় হয়ে শুনছিলো রাতুলের থিওরী। এবার জিজ্ঞেস করলো, " কিন্তু এসবের সাথে প্রফেসরের খুনের কি সম্পর্ক রাতুল ?"
-" সম্পর্ক আছে শ্রী। গুজরাটের লোথাল শহরে উনি বেশ কিছুটা সময় কাটিয়েছিলেন। সেখানে মোহেঞ্জোদারোর অনেক অবশেষ দেখতে পাওয়া যায়। এসব নিয়ে রিসার্চ করতেই ওনার সেখানে যাওয়া। কিন্তু লোথালে এমন কোনো ঘটনা ঘটে যেটা পরবর্তী কালে ধামাচাপা দেওয়া হয়। আমি ইন্টারনেটে শুধু এইটুকু শিরোনাম আর কিছু অল্প স্বল্প ঘটনাই জানতে পেরেছি মাত্র", রাতুল ইন্টারনেট লিংকটা শ্রীময়ীকে দেখায়।

শ্রীময়ী বেশ অবাকই হয় পুরোটা জানতে পেরে।

    রাতুল স্ট্র দিয়ে কোল্ড ড্রিংকসের বোতল থেকে শেষ চুমুক দিয়ে পুরোটা শেষ করে বললো, "তোর মুখে যখন শুনলাম প্রফেসর নন্দী মুকেশ কুমারকে মারা যাবার আগে ফোন করেছিলেন, তখনই আরো বেশি করে মনে হলো ওনার মৃত্যুর সাথে এই ঘটনাটার একটা যোগাযোগ থাকলেও থাকতে পারে"
-" কেন বলতো ?", জিজ্ঞেস করলো শ্রীময়ী।
-" লোথালের ঘটনায় প্রফেসরের সাথে আরো দুজন প্রত্যক্ষ ভাবে যুক্ত ছিলেন। তার মধ্যে একজনের নাম ডঃ বিধান শর্মা আর অপরজন কে ছিলো জানিস ?"
-" কে ?"
-" প্রফেসর মুকেশ কুমার। কাজেই একটা খটকা তো থেকেই যায় রে শ্রী।"
-" হুম, বেশ কিছু তথ্য জানা গেলো। আচ্ছা, রাতুল এই রিপোর্টটা যিনি করেছেন, তাঁর সম্বন্ধে কিছু দিয়েছে।"
-" নাঃ, তেমন কিছু নয়। বাঙালি এক রিপোর্টারের নাম রয়েছে দেখছি। সুশান্ত সেনগুপ্ত,  'দি ডেইলি নিউজ' পত্রিকার সাংবাদিক, যে ওই রিপোর্ট টা করেছিলো। ব্যাস এটুকুই।"
-" এতেই হবে। আমি সোর্স লাগাচ্ছি। এই সুশান্ত সেনগুপ্তর লোকটার সাথে কথা বলাটা জরুরি। যদি আরো কোনো সূত্র পাওয়া যায়। থ্যাংক ইউ রাতুল। এতটা তথ্য দিলি সত্যি তোর জবাব নেই।"
-" অলওয়েজ এট ইওর সার্ভিস ম্যাডাম", বলেই পকেটে দেশলাইটা হাতড়াল রাতুল। এই সময়ের মধ্যেই গোটা তিনেক সিগারেট ধ্বংস করে রাতুল নিজের চারদিকে একটা ধোঁয়ার আস্তরণ তৈরি করে ফেলেছে, ঠিক যেমনটা হয়ে রয়েছে শ্রীময়ীর মনটা, পুরোপুরি ধোঁয়াশাচ্ছন্ন।

    ঠোঁটের কোণে আবার একটা সিগারেট নিয়ে, রাতুল দেশলাই দিয়ে তাতে আগুন ধরালো। ধোঁয়াশাময় কফি লাউঞ্জে ওই একটুকরো আগুনের রেখা, মিউজিক বক্স গুলো থেকে এখন যে গানটা বাজছে তার যেন স্বার্থক রূপক হয়ে দাঁড়ায়-
    " ... চিঙ্গারি কোই ভড়কে
                   তো শাওন উসে বুঝায়ে
      শাওন যো আগন লাগায়ে
                    উসে কউন বুঝায়ে .... "

ক্রমশ...



Ayan Das



 

Comments

Loading... Logging you in...
  • Logged in as
There are no comments posted yet. Be the first one!

Post a new comment

Comments by