বড় বাবুর বাড়ি - শুভাঞ্জন চট্টোপাধ্যায়

 

বড় বাবুর বাড়ি
শুভাঞ্জন চট্টোপাধ্যায়
 

     সরু ড্রেনটার পাশ দিয়ে গিয়ে একেবারে পেছন দিকে মামাবাড়ির সীমানা লাগোয়া ভাঙা পাঁচিলটার কাছে এসে জঙ্গল ঘেরা পোড়ো বাড়িটার দিকে তাকিয়ে  থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম। ছোটো থেকেই দেখে আসছি  নীরালা, নিস্তব্ধ, বন বাদারের আড়ালে লুকিয়ে থাকা এই ঘুপচি বাড়িটাকে। শুনেছি, বহুকাল হয়ে গেল এ বাড়িতে কোনো লোক বাস করে না। পাশের ফায়ার ব্রিগেডের কোন এক অফিসার বড়বাবুর নাকি কোয়ার্টার ছিল এটা৷ উনি এখান থেকে চলে যাবার পর আর কোনো মানুষের পা পড়ে নি এ বাড়িতে। সেই থেকে বন জঙ্গলে ঘেরা,ভাঙা চোরা এমন হয়েই পড়ে আছে..সকলের কাছে পরিচিত ' বড়বাবুর বাড়ি '। এটুকুই জানি। 
 
    মামাবাড়ির একেবারে সীমানা সংলগ্ন বলে ছাদে দাঁড়ালেই চোখে পড়ে বাড়িটা৷ একবার আমার সমবয়সী মামাতো ভাইয়ের সঙ্গে শলাপরামর্শ করে ঠিকও করে ফেলেছিলাম ভরদুপুরে বাড়িটার ভেতরে হানা দেবো। রহস্য রোমাঞ্চ গল্পগুলো গিলে যে অ্যাডভেঞ্চারীস্ট মন উঁকিঝুকি মারতে শুরু করেছিল জানলা দিয়ে...হয়তো তারই টানে। কে জানতো দুপুরবেলা আমাদের পেছন পেছন ছোটোমামা এসে ধাওয়া করবে। প্ল্যানিং শুধু ভেস্তেই গেল না, সবার কাছে খুব বকুনিও জুটেছিল সেদিন। 
 
    মামা চোখ বড় বড় করে বলেছিলেন,' সাহস তো কম নয় তোদের! ফের যদি বড় বাবুর জঙ্গলের ত্রিসীমানায় দেখি,দু'জনকে ঐ ভুতুড়ে বাড়িতেই রেখে দিয়ে আসবো। যত সাপখোপের আড্ডা...ভাম,বনবিড়াল কি নেই..কিছু হয়ে গেলে তখন...কেউ যায় না ওখানে..! '
 
    খুব খারাপ লেগেছিল, আমার জন্য বেচারি বুবাই(মামাতো ভাই)কেও বেঘোরে বকুনি হজম করতে হলো। ও একটু ভীতু স্বভাবের। যেতে চায় নি কিছুতে। আমিই জোর করে ভুলিয়ে ভালিয়ে...। কিন্তু এরই পাশাপাশি ছোটো মামার মুখ থেকে উড়ে আসা দুটো শব্দ যেন কানের ভেতর দিয়ে গিয়ে আমার মনের কৌতুহলটাকে  এক ধাক্কায় বেশ খানিকটা  নাড়িয়ে দিয়ে গেল । ছোট্ট দুটো শব্দ.. 'ভুতুড়ে বাড়ি।'
 
    কেন যে বুবাই ঢুকতে চাইছিল না ঐ  বাড়িটাতে..এবার বুঝতে পারলাম। মামাবাড়িতে সবাই বলে ওটা নাকি ' ' 'বড়বাবুর বাড়ি'। ওটা যে ভুতের বাড়িও বটে,তা তো কেউ বলে নি এতদিন! হয়তো বুবাই ব্যাপারটা জানে।আর জানে বলেই ঐ বাড়িটাকে নিয়ে কি একটা কথা বলতে গিয়ে তখন বারবার তোতলাচ্ছিল। পরে নতুন করে এ নিয়ে ওকে আর কিছু জিজ্ঞেস করিনি। একেই বকাঝকা খেয়ে বেচারি..। 

    সন্ধ্যা বেলায় দিদিমা তখন জপ আহ্নিক সেরে সবে ঘরে এসে বসেছেন। কেউ ছিল না। এই সুযোগে চুপিচুপি তাঁর পাশে এসে বসলাম। জানি দিদা আমায় খুব ভালোবাসে। মাও এতো ভালোবাসে না। তাই মাকে যা জিজ্ঞেস করা যায় না, কিংবা জিজ্ঞেস করার আগে তিন বার ভাবতে হয়..দিদাকে সেটাই অবলীলায় জিজ্ঞেস করে ফেলা যায়।
' কিছু বলবি ভাই?'
হাসলেন দিদা।
চুপিচুপি লুকোনো প্রশ্নটা করেই ফেললাম দিদাকে।
' ও দিদা, বড়বাবুর বাড়িটাতে সত্যিই ভুত আছে..বলো না? তোমরা কেউ দেখেছো?'
শুনে দিদার চোখগুলো কিরকম গোল গোল হয়ে গেল। 
' আবার গোপনে কী মতলব এঁটেছিস বল তো দাদাভাই? খবরদার ওখানে যাবে না বলে দিচ্ছি! ভুত,বেম্হদত্যি সব লুকিয়ে আছে... তোমাদের মতো ছোটোদের দেখলেই..! '
দিদা কিংবা মামার কথাগুলো নেহাৎই যাওয়া থেকে নিরস্ত করার জন্য নাকি সত্যি সত্যিই এমন কিছু বাড়িটাতে রয়েছে যা...।
সে প্রশ্নের উত্তর অধরা রেখেই সে যাত্রায় মামাবাড়ি ছেড়ে চলে আসতে হলো আমায়।

     স্কুলের পরীক্ষা শেষ করে প্রায় ছমাস পর পুনরায় মামাবাড়ি বেড়াতে এসে দুপুর বেলায় সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়েছে, তখন আমি আর আমার সেই মামাতো ভাই বুবাই খোলা ছাদে লোফালুফি খেলতে গিয়ে হঠাৎই আমার ধেয়ে আসা বলটা লুফতে না পারায় ওর হাতের পাশ দিয়ে ক্যাম্বিসের সে বল একেবারে সোজা গিয়ে পড়লো ছাদ টপকে ঐ পেছনের জঙ্গলে। অত ছোটো বল। কোথায় যে গিয়ে পড়লো বুঝলাম না। শুধু নিস্তব্ধ দুপুরে ঝুপ করে একটা শব্দ হলো মাত্র। তাড়াতাড়ি ছাদের পেছনের রেলিংয়ের ধারে এসে দাঁড়িয়ে দেখতে গেছি বলটার হদিশ,  আমার চোখ দুটো যেন আপনা থেকে  আটকে গেল ঝোপ জঙ্গলের আড়ালে লুকিয়ে থাকা সেই বাড়িটার দিকে। 
আশ্চর্যের ব্যাপার এটাই, একটু দূরে আশেপাশে ততদিনে বেশ কিছু নতুন নতুন বাড়িও গজিয়ে উঠেছে। ফায়ার ব্রিগেডের পুরনো স্টাফ কোয়ার্টারটা আগের চেয়েও এখন আরো বড়..নতুন করে রিপেয়ারিংয়ের পর। এগুলো সব কত আর দূরত্বে...ছাদে দাঁড়ালেই চোখে পড়বে। কিন্তু তারই মাঝে  অযত্নে অবহেলায় পড়ে থাকা এই জঙ্গলাকীর্ণ বাড়িখানা সত্যিই যেন এক...স্মৃতি থেকে হারিয়েই গিয়েছিল প্রায়। মূহুর্তে কে যেন মনে করিয়ে দিল কথাটা..'ভুতুড়ে বাড়ি..'।
এই সুযোগ। কৌতুহলটাকে এবার আর কিছুতেই নিবৃত্ত করতে পারলাম না। 
 সিঁড়ি দিয়ে নেমে সদর দরজার ছিটকানিটা সন্তর্পণে খুলে সীমানার পাঁচিল ঘেরা ড্রেনের পাশ দিয়ে চুপিচুপি গিয়ে যখন পেছন দিকে পায়খানার চেম্বারের পাশে ভাঙা পাঁচিলটা টপকাতে যাবো, গায়ের জামাটা টেনে ধরলো বুবাই..' ভয় করছে রে দাদা! আমি আর যাবো না ওখানে।বাবা যদি জানতে পারে,ঘরের মধ্যে আটকে রেখে দেবে।'
 
    বুবাইকে এসবের মধ্যে আর না টেনে ' বলটা তাড়াতাড়ি খুঁজে আনছি' বলে ওকে ভেতরে পাঠিয়ে একা একা এগিয়ে গেলাম পাঁচিলের দিকে। 
আমি তখন ছোট মানুষ। পাঁচিলটা আমার মাথার কয়েক হাত ওপর দিয়ে চলে গেছে। মামাবাড়ির পেছনের সীমানার পাঁচিল এটা। ভাঙা বলেই খানিকটা নীচু লাগছে। 
 
    এদিক ওদিক তাকালাম। কেউ দেখছে নাতো? সামনে বেশ ঘন জঙ্গল। ঝোপঝাড়ের আড়াল থেকে বাড়িটা যেন উঁকি মেরে তাকাচ্ছে আমারই দিকে। চেম্বারের ম্যানহোলের ওপর দাঁড়িয়ে দুটো হাতে ভর দিয়ে পাঁচিল ডিঙিয়ে দিলাম এক লাফ। আমার ছোট্ট হাওয়াই চটি পরা পা দুখানা ধপকরে একেবারে ঝোপের মধ্যে গিয়ে পড়লো। 
 
    সামনে ছোটো বড় গাছপালায় ঘেরা  ঘন বনবাদার। বড় লতানে গাছ, কচু গাছের সারি, বিচুটিপাতা, বুনো ফুলগাছের সারি, ছড়িয়ে থাকা কাঁটা,আঁশ শ্যাওড়ার ঝোপ, পথ আগলে দাঁড়িয়ে থাকা একটা বহুদিনের ন্যাড়া নিম গাছ, কাট বাদাম গাছ...যত ভেতরে ঢুকছি একটা অদ্ভুত বুনো গন্ধ যেন নাকে এসে লাগছে ততোই...। এই সব কিছুর আড়ালে লুকিয়ে আছে একটা পোড়ো বাড়ি..যার বেশ খানিকটা অংশ দেখতে পাচ্ছি। আমার চোখ একবার বলটাকে খোঁজার চেষ্টা করছে,আর একবার শ্যেনদৃষ্টিতে খুঁজে বেড়াচ্ছে লুকিয়ে থাকা বাড়িটার কাছে যাবার নিরাপদ রাস্তা....।  পেছনে ফেলে আসা মামাবাড়ি। দিদিমার ঘর..জানলা বন্ধ করা...তার ওপরে দোতলা, আরো ওপরে ঐ যে ছাদটা..চিলেকোঠা...যে ছাদে দাঁড়িয়ে একটু আগেই তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিলাম বলটা কোথায় পড়েছে..।এই ঘন বনবাদাড়ে সে বল কোথায় খুঁজে পাবো জানি না..কিন্তু বেশ বুঝতে পারছি, বল খোঁজার উদ্দেশ্যের চেয়েও আসলে যে প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্যে হঠাৎ করে ঝোঁকের বশে এখানে চলে এসেছি, আসার পর যেন মনে হচ্ছে আচমকা একটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মধ্যে গিয়ে পৌঁছেছি..যেখানে এক পাশে তাকালে শুধু মানুষ সমান পাঁচিল, পাঁচিলের ওপারে অবাঙালী দেহাতি লোকেদের নীচু বসতি..টালির ঘর, ঝুপরির মাথাগুলো শুধু দেখা যাচ্ছে... প্রথম বর্ষার জল পড়ে ওপাশের ঝোপজঙ্গল এতটাই ঘন আর বড় হয়ে উঠেছে যে একটু দূরে ফায়ার ব্রিগেডের মাঠ, স্টাফ কোয়ার্টার.. সব যেন ঢাকা পড়ে গিয়েছে এই জঙ্গুলে গাছপালার আড়ালে....কোথায় কি আছে, কিচ্ছুটি বোঝার উপায় নেই.. শুধু বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মধ্যে দিয়ে  একাকি আমি এগিয়ে চলেছি বন বাদাড় ডিঙিয়ে কাঁটাঝোপ ধরে সন্তর্পণে পা ফেলে ফেলে...এই ঘন জঙ্গলে কোথাও কোনো বলের হদিশ এখনো করে উঠতে পারি নি। কিন্তু যে পথে হেঁটে চলেছি, তা যেন অনেক বড় আর মূল্যবাণ কোনো গুপ্তধনের খোঁজে... মামাবাড়ির এত কাছে এরকম একটা রহস্য গল্পের থ্রিলার যে তৈরি হতে পারে..এসে না পড়লে হয়তো..! যে বাড়িটাকে এতদিন দূর থেকে শুধু পরখ করেই এসেছি...সেই হানা বাড়ি ক্রমশ যেন বনঝোপের আড়াল থেকে একপা করে সামনে আসছে আমার..একটা পোড়ো ভাঙা ইটের অন্ধকার ঘর..জানলার মরচে ধরা লোহার শিক...কপাট বিহীন হাঁ মুখ দরজা....পেছনে আরো দু একটা পরিত্যক্ত দাঁত মুখ বের করা ইটের ঘর...নজরে পড়লো আমার। দু পা দু পা করে কখন চলে এলাম বাড়িটার কাছে!  
 
    বুকের ভেতরে স্বযত্নে লালিত শার্লক হোমস আর এরকুল পোয়ারো যেন পথ দেখিয়ে নিয়ে চলেছে আমায়...আচমকা কালো মতো কি একটা চোখের নিমেষে সরাৎ করে ঘাস, লতাপাতার বুক চিড়ে কোথায় হাওয়া হয়ে গেল...!
থেমে গেলাম। বুকের ভেতরটা ছ্যাৎ করে উঠলো। মামা বলেছিল,' জায়গাটা সাপ খোপের আড্ডাখানা.. '
 
    বিচিত্র কিছু নয়। যদি সেরকমই কিছু হয়, তাহলে এই নিস্তব্ধ পরিবেশে কোন শার্লক হোমস অস্ত্রহীণ আমায় রক্ষা করবে? বুবাই টাও সাথে নেই। মা এখানে এসেছি জানতে পারলে মামাবাড়ি আসাই বন্ধ করে দেবে..! কিন্তু বল খোঁজার নাম করে এসে এতটা কাছে গিয়েও ভালো করে দেখাই হলো না যে বাড়িটাকে...এদিকে আকাশ কালো হয়ে আসছে ক্রমেই। একটু একটু করে জমে ওঠা ঘন বর্ষার মেঘের মতোই আমার মনের মধ্যে কি যেন কু ডাকতে শুরু করেছে.. ফিরে যাবো? 
 
    একটা কাঠবিড়ালি পাঁচিল দিয়ে এসে কাঠবাদাম গাছটায় তরতর করে উঠে পাতার ফাঁকে কোথায় মিলিয়ে গেল।  বড় সাইজের একটা বেঁজি কোত্থেকে এসে সাঁ সাঁ করে সোজা চলে গেল সামনে দিয়ে..মনে হলো কাউকে ধাওয়া করেছে। বাড়িটার দিকেই তো ঢুকলো..! তার মানে ঐ ঘরের ভেতরেই লুকিয়ে রয়েছে এক বা একাধিক বিষধর..! আকাশে মেঘ গুড়গুড় করে ডাকতে শুরু করেছে। হাওয়া দিচ্ছে। গাছগাছালীর পাতায় সোঁ সোঁ শব্দ শুরু হয়েছে।চারিপাশে তাকালাম। আরো ঘন ঝোপের মধ্যে চলে এসেছি। আমার ছোট্ট শরীরটাকে ছাড়িয়ে এতই বড় বড় সব গাছপালা যে তার আড়ালে মামাবাড়িটা প্রায় ঢাকাই পড়ে গিয়েছে...শুধু দূরে চিলেকোঠার একটুকু অংশ...কেউ কোথাও নেই। কেবল হাত কয়েক দূরে একটা হানাবাড়ি চেয়ে চেয়ে দেখছে আমাকে আর যেন ফিসফিস করে বলছে,' দ্যাখ একবার কোথায় এসে পড়েছিস! বিপদে পড়লে এখানে কে বাঁচাবে তোকে?'
   না না আর নয়...! এক অজানা আশংকা যেন ঘিরে ধরতে শুরু করেছে একাকি আমায়..!

 
    ফিরে যাবার জন্য পা বাড়িয়েছি, হঠাৎ পিছন থেকে একটা রিণরিণে সুরেলা কণ্ঠে আওয়াজ ভেসে আসে, ' কে গো তুমি? কিছু খুঁজছো বুঝি?'
চমকে ফিরে তাকালাম।
 আবার সেই কন্ঠস্বর..' আমায় দেখতে পাচ্ছো না? এই  তো আমি..তোমার হাত কয়েক দূরে..। '
আওয়াজটা যেন ঐ হানাবাড়ির সামনে থেকে এলো বলে আমার মনে হলো। 
' একবারটি এসো। এসোই না..।'
কেন জানি না, কন্ঠস্বরটা উপেক্ষা করতে পারলাম না।
সামনে এগিয়ে গেলাম। 
 
    কয়েক পা এগোতেই গাছগাছালির যাবতীয় আড়াল সরিয়ে কে যেন আমার চোখের সামনে মেলে ধরলো একটা হানাবাড়ির বহিরঙ্গের পরিষ্কার চেহারাটাকে।
আরো হতবাক হয়ে গেলাম বাড়ির ভাঙা দরজাটার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা আমার থেকে খানিকটা ছোটো একটি দশ বারো বছরের ফ্রক পরা(যে ফ্রকের ওপরকার জামার হাতাটা এতটাই ঢোলা যে হাতের আঙুলও দেখা যায় না), বিনুনি বাঁধা ফুটফুটে মেয়েকে দেখে। মেয়েটি আমার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে খিলখিল করে হাসছে। 
' হ্যাঁ তোমাকেই ডাকছি...কিছু খুঁজছো বুঝি?'
আমতা আমতা করে বললাম, ' একটা ক্যাম্বিস বল..কোথায় যে পড়লো..।'
মেয়েটি পান পাতার মতো, ফরসা টোল পড়া গালে মিষ্টি হাসি হেসে ডান হাতখানা বাড়িয়ে দিয়ে  বললো, 'এই বলটা? ঐ দূরে ঐখানটায় পড়েছিল..।'
' হ্যাঁ এই.. এইটাই তো!'
 বলটা আমার হাতে আলতো করে ছুঁড়ে দেয় মেয়েটি। তারপর বেশ অদ্ভুত ভাবে অবাক চোখে বলে,' এখানে তো কেউ আসে না...কেউ আসে না জানো..!'
আমিও অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বলি,' কে তুমি? একা একা এখানে কী করছো? তোমার সঙ্গে কেউ আসে নি? '
মেয়েটি ঘাড় নেড়ে বলে,' আমি তো রোজ এখানে খেলা করি। দুপুর হলেই। মা আবার বিকেল বেলায় ডাকতে আসে। তখন চলে যাই..।'
' এই বনজঙ্গলের মধ্যে একা একা খেলতে আসো!বাড়ি কোথায় তোমার?'
' ঐ তো..।'
বনের কোথায়,কোন দিকে আঙুল দেখিয়ে সে তার বাড়ির ঈঙ্গিত করলো, ভালো বুঝলাম না।
ভয় করে না একা একা এখানে? '
' ভয়..?'
কথাটা বলেই আবার খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে সে। চারপাশে তাকায়। 
' আমি তো রোজ আসি। এই গাছপালা,বনের খরগোশ, কাঠবিড়ালি, বেঁজি, এরা সবাই আমাকে চেনে...এই যে বাড়িটা দেখছো, এটা তো আমার খেলাঘর...হ্যাঁ গো, আমার সব খেলনা পাতি এখানে সাজানো থাকে, কেউ হাত দেয় না...কেউ তো আসে না, তাই হাতও দেয় না। এটা আমার আর একটা বাড়ি। খেলবে আমার সাথে একটু? '
 
    যত দেখছি মেয়েটিকে ততোই যেন বেশি বেশি করে অবাক হয়ে যাচ্ছি! বল খোঁজার নাম করে বন বাদাড় পেরিয়ে ছুটে এসেছি যে হানাবাড়িটাকে দেখবো বলে..সেই বাড়িটা কিনা ওর খেলাঘর! ভুতের ভয়ের কথা ছেড়েই দিলাম, সাপ খোপের ভয়ও কি...? নাকি ওরাও ওর বন্ধু? 
আকাশের দিকে তাকালাম আবার। মেঘ বেশ জাঁকিয়ে বসেছে। বৃষ্টি নামলো বলে। এক বাড়ি দেখতে এসে আর এক বাড়ি তখন রীতিমতো পিছু টানছে আমায়।
মেয়েটি অধীর আগ্রহে আমার উত্তরের অপেক্ষায়।
বললাম, ' আজ যাই। বৃষ্টি নামবে। এখানে চলে এসেছি জানতে পারলে কেলেঙ্কারি পড়ে যাবে বাড়িতে..।'
এবার যেন কেমন মিইয়ে গেল সে।
' ও। তোমার বাড়ি কোথায়?'
' ঐ যে দূরে..ওটা আমার মামাবাড়ি। এখান থেকে ভালো দেখতে পাবে না। বনঝোপের আড়ালে ঢাকা পড়ে গেছে। ঐযে ছাদের চিলেকোঠা দেখা যাচ্ছে, ওটা। আমি যাই..। সবাই হয়তো খোঁজ করছে..। তুমি বলটা খুঁজে দিলে..তোমার কথা মনে থাকবে...।'
সবেমাত্র ছুট লাগাতে যাবো, হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। 
বেশ মুষলধারে। 
 
    হাজার আপত্তি স্বত্তেও মেয়েটি আমায় তাড়াতাড়ি করে বাড়িটার ভেতরে নিয়ে গেল। এই বৃষ্টি ভিজলে শরীর খারাপ হতে পারে, ঝোপঝাড় কাদাজলে পা বেধে পড়ে গেলে বিপদও ঘটে যেতে পারে.. এই যুক্তিতে।
 
    জীবনে প্রথম ঢোকা আমার সেই বহু কৌতুহলের হানাবাড়ি। সিমেন্ট উঠে যাওয়া,হাড় কংকাল বের করা, ঘরটাকে বাইরে থেকে আগেই দেখেছি...আর ভেবেছি কতকালের বাড়ি এ? বাড়ি তো নয়,শুধু একটা দুটো ঘরই পড়ে রয়েছে। যে বড়বাবু এখানে থাকতো, তিনি চলে যাবার পর আর কেন মেরামত হলো না? তবে কি ছোটমামার কথাটিই ঠিক? ভুতের ভয়ই যদি থেকে থাকে, তাহলে মেয়েটি দিনের পর দিন একা একা কিকরে এরকম একটা বাড়িতে..! 
কপাটহীণ ভাঙা দরজাটা দিয়ে ঢোকার মুখে নতুন করে মনে আসা কথাগুলো যেন কেমন একটা খটকা জাগিয়ে তুললো আমার ভেতরে! 
যাই হোক, এ নিয়ে আর সাতপাঁচ না ভেবে, এ অবস্থায় বৃষ্টি ভেজা গায়ে মামাবাড়ি ঢুকলে অবধারিত জেরার মুখে পড়তে হবে.. এই ভেবে মেয়েটার কথামতো সবে ঘরের চৌকাঠটাতে পা রেখেছি, এমন সময় দেখি ভেতরে অন্ধকারের মধ্যে থেকে দু’জোড়া লাল লাল চোখ ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে সোজা আমার দিকে। কী ওটা? ক্রমশ এগিয়ে আসছে চোখ দুটো...ধীরে, সন্তর্পণে..! মণিগুলো ভাটার মতো জ্বলছে। যাবতীয় দৃষ্টি কেবল আমার ওপর। বেরিয়ে আসছে থাবা। বড় বড় নখ...। হঠাৎই 'ঘ্যাঁক' করে একটা শব্দ হলো। আমার আগে আগে যাচ্ছিল মেয়েটি। ও হঠাৎ বলে উঠলো, ' আবার দুষ্টুমি শুরু করলি? যা বলছি, যা..।'
 
    ওর বলার সাথে সাথে দেখতে পেলাম অন্ধকারের ভেতর থেকে একটা নিকষ কালো বন বেড়াল আস্তে আস্তে  বেরিয়ে এসে আমারই পাশ দিয়ে গিয়ে এক দৌড়ে জঙ্গলের ওদিকটায় মিলিয়ে গেল।
বুকের ভেতরটা ধক করে উঠেছিল ঐ রক্তবর্ণের চোখ আর জ্বলজ্বল করতে থাকা মণিদুটোর দিকে চেয়ে। 
পেছন ফিরে মিষ্টি করে হাসে মেয়েটি। 
' ভয় পেলে নাকি?'
' এত বড় বন বিড়াল আমি জীবনেও দেখিনি!'
'  আর কোনো ভয় নেই। আমি বলে দিয়েছি। কিছু করবে না। ও আমার আর এক বন্ধু। নতুন লোক দেখেছে তো তাই ওরকম করছিল...এই আমার আর একটা বাড়ি। এখানটাতে বসো। আমি জানলা খুলে দিচ্ছি..। '
 ভেতরে ঢোকার পর মনে হলো গাছপালা, ঘন মেঘের ছায়ায় ঘেরা যেন কোন একটা নিরালা নির্জন অন্ধকার গুহার মধ্যে এসে পড়েছি। যে ঘরটার খানিকটা অংশ মামাবাড়ির ছাদে দাঁড়ালেই চোখে ভেসে ওঠে, যাকে কেন্দ্র করে এই বিস্তৃত জঙ্গলাকীর্ণ জায়গা আমার শিশু মনের অনেকটা অংশ জুড়ে বাসা বেঁধে রয়েছে..আজ সেই ঘরেরই একটা ছোট্ট আধভাঙ্গা সিমেন্টের বেদিতে বসে কি এক অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে আছি আমি! পচা পাতা,ডালপালার স্যাঁতসেঁতে গন্ধ ছড়িয়ে আছে চারিদিকে। 
 
    মেয়েটি জানলাটা টেনে খুলে দিতে চিলতে আলো এসে পড়লো ভেতরে। ভাঙা,ক্ষয়ে যাওয়া, ঘুণ ধরা কাঠের হলহলে পাটাতন, বহু পুরোনো কালের মরচে পরা শিক,সিমেন্ট ওঠা ফাটল ধরা শ্যাওলা পরা দেওয়াল...গাছের শিকড় গজিয়ে উঠেছে দেওয়াল ফুঁড়ে, ছাদের একটা দিক ভেঙে পাথরের চাঙর খসে ঝুলে পরেছে মাটির কাছাকাছি.. দেখামাত্র শিউরে উঠলাম আমি..!
' এই ঘরে তুমি আসো বুঝি! তোমার ভয় করে না? দ্যাখো কত বড় পাথর ভেঙে পড়েছে..! '
মেয়েটি কেমন অবাক চোখে উত্তর দিল,' ভয়? কিসের ভয়? ও..ঐটার...? ওখানে না গেলেই হলো...নিজের বাড়িতে আবার ভয় কিসের...এখানে একদিন না এলে আমার যে খুব মন কেমন করে গো..!'
' এই এতো জঙ্গলে খেলতে আসো..তোমার বাবা মা কিচ্ছু বলেন না?'
 আবার সেই আগের মতো হাসি।
' মা তো জানে এখানে আমায় কেউ কিছু করবে না। তাই কিছু বলেও না..সারা দুপুর নিজে নিজেই খেলি..কখনো দোলনায় দোল খাই...স্লিপে চড়ি..ঘুরে বেড়াই...কিতকিত খেলি...রান্নাঘরে বসে রান্না করি...কতো কি করি..মন খারাপ লাগলে এই ঘরে এইখানটাতে বসে আকাশ আর গাছগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকি চুপচাপ.. মন আপনিই ভালো হয়ে যায়.. এটা আমার মন ভালো করার ঘর...ঐ যে ঐ পেছনের ঘরটা দেখছো ওটা আমার রান্নাঘর... এসো দেখবে?'
ওর ঐ টানাটানা কাজল পরা চোখ দুটো, টোল পরা মিষ্টি হাসি, আদো আদো সুরে কথা...কি জানি বড় ভালো লাগছিল আমার। পাশাপাশি এক অদ্ভুত রোমাঞ্চকর অণুভুতিও যেন গ্রাস করতে শুরু করেছে আমায়...এই ঘরেরই গায়ে লাগানো একটা ছোটো বারান্দা.. তার পাশে আরো দুটো ঘর..কী আছে ঐ ঘরগুলোয়? অঝোরে বৃষ্টি এখনো থামে নি। জল না কমলে যাওয়াও যাবে না..কি জানি কি অপেক্ষা করে আছে বাড়িতে... তবু ফেরার চিন্তাটাকে আপাতত শিকেয় তুলে মেয়েটির পেছন পেছন এগিয়ে গেলাম ওর খেলার সাথী সেই রান্নাঘরের দিকে... আচ্ছা এতটা সময় দুজনে কথা বলছি,ওর নামটা তো জানা হলো না! জানতে হবে..।

    এক চিলতে ফাটল ধরা বারান্দায় চকখড়ি দিয়ে আঁকা কিতকিত, এক্কা দোক্কার ছক...  ঘরের ভাঙা সানসেটের ওপর দিয়ে বৃষ্টির ছাট এসে ধুয়ে মুছে যাচ্ছে  আঁকাগুলো...সানসেট এর ঠিক নীচে ঘরের দেওয়ালের ঘুলঘুলির ভেতর দুটো শালিক ভিজে জড়োসড়ো হয়ে বসে রয়েছে।  পাশে একটা ছোটো মতো বাগান গোছের জায়গা...বড় বড় আম পেকে ঝুলে রয়েছে গাছে...আছে কাঁঠাল,জামরুল গাছও...। এতক্ষণ যে স্যাঁতসেঁতে,ভ্যাপসা গন্ধের মধ্যে বাস করছিলাম, অদ্ভুত মুকুলিত এক প্রাণ ভরা সুবাসে সেটা যেন অনেকটাই দূর হয়ে গেল। বাগানের এককোণে একটা লোহার শিকল লাগানো কাঠের দোলনা ঝুলছে, তার পাশে একটা বাচ্চাদের খেলার স্লিপ বা সুরসুরি,বাকি চতুর্দিক জঙ্গলে ঘেরা,দূরে বাড়ির সীমানার ভাঙা পাঁচিল... পাঁচিল টপকালে ওপাশে হয়তো ফায়ার ব্রিগেডের মাঠটাই পড়বে...চারিদিক যেন কেমন ঘুমন্ত, চুপচাপ। বৃষ্টি, বাদলা যেন আরো ঘুম পারিয়ে দিয়েছে প্রকৃতিকে। শুধু জেগে আছি আমরা দুটি প্রানী। এখান থেকে দাঁড়িয়ে চিৎকার করলেও হয়তো কেউ শুনতে পাবে না সে চিৎকার! মামাবাড়িকে কতো দূরে ফেলে চলে এসেছি, তাই ভাবছিলাম...শার্লক হোমসকে পাশে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমার রূপকথার বইয়ের তেপান্তরের মাঠে চলে এসেছি যেন..।
 
    আর একটা ছোটো ভাঙাচোরা ঘরের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পরলাম।
'এই যে আমার রান্নাঘর। '
মেয়েটি আঙুল দেখালো। 
দেওয়ালের একদিক ভেঙে পড়ে ইটগুলো সব স্তূপাকার ছড়িয়ে আছে ঘরের চারিপাশে..গাছপালা, জঙলায় ভরে রয়েছে আর একটা দিক..প্লাস্টার খসা,ইট বের করা সিলিংয়ের মাথা থেকে দু দুটো বাদুড় ঝুলছে.. মেয়েটি ' এই যা' বলে উঠতেই আমার মাথার প্রায় পাশ দিয়ে হুশ করে উড়ে বেরিয়ে গেল ওরা...। দেওয়ালের আর এক পাশে একটা কতকালের ভাঙা সিমেন্টের উনুন. পরপর বসানো তিন তিনটে চুলা... উনানের ধারে ইতিউতি পড়ে থাকা ভাঙা কাঠকুটো,একপাশে সাজানো লোহার হাতা,মরচে ধরা খুন্তি, ঝুলকালি পরা ভাতের হাঁড়ি, আংটা ভাঙা কড়াই... আশ্চর্য হয়ে গেলাম ঘরটাকে দেখে! এসব কার জিনিস? 
' এটাই তোমার রান্নাঘর? মানে তুমি এখানে রান্না করো?'
অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম ওকে। 
' হ্যাঁ, এখানেই তো কত বেলা কাটিয়ে দিই..যা মন চায় রান্না করি..মা যেমন করে খুন্তি নেড়ে রান্না করে... অতো ভারী কড়াই উনুনে বসাতে তো পারি না...এখানটাতে বসে বসেই কাজ করি...এগুলো অনেকদিনের...শুনেছি আমার জন্মেরও আগে থেকে এখানে রাখা... এখন সব আমার...কখনো ঘাস,লতাপাতা ছিঁড়ে এনে শাকভাজা রাঁধি..ইটের গুঁড়ো দিয়ে মাছের ঝোল, বালির গুঁড়ো দিয়ে  সুন্দর করে ডাল,আবার কখনো...ওকি তুমি হাসছো?'
না হেসে আর পারলাম না। 
' ওগুলো দিয়ে তুমি রান্না করো? আচ্ছা আজকে কী রান্না করলে?'
কিরকম যেন বিমর্ষ হয়ে যায় ওর মুখখানা। বলে,' আজ আর কিছু রাঁধিনি জানো...মনটা ভালো লাগছিল না....।'
' কেন? '
' কি জানি। আকাশটা কেমন মেঘলা..কত বৃষ্টি... সব কেমন অন্ধকার হয়ে আসছে...বৃষ্টি থেমে গেলে তুমিও বাড়ি চলে যাবে... আমার কোনো খেলার সাথী নেই জানো...।'
'আমি যদি সত্যি সত্যি তোমার খেলার সাথী হই...?'
'হবে? ঠিক বলছো?'
সূর্যের একরাশ আলোর মতো ঝলমল করে ওঠে ওর মুখখানা যেন।
' এসো এদিকে এসো..।' মেয়েটি শুধোলো আমায়।
আমরা দুজনে  ঘরের বাইরে বেরিয়ে এলাম।
বৃষ্টি কমছে। 
' এবার আমাকে যেতে হবে। নয়তো সবাই খুঁজতে বেরোবে। আবার কাল আসবো।' আমি বললাম ওকে।
' হ্যাঁ আমারো যাবার সময় হয়েছে। মা ডাকবে এক্ষুণি। আসবে তো কালকে ঠিক? অনেক গল্প করবো... অনেক কথা। বলো আসবে?'
মনে মনে ভাবলাম, আমারও তো কত কিছু জিজ্ঞেস করার আছে, কত কিছু জানার আছে তোমার থেকে... এখন আর সেসব বলা হবে না। বৃষ্টি কমে গেছে। 

    চলে যাবার জন্য এক পা সবে বাড়িয়েছি, মেয়েটি ডাকলো, ' একটু দাঁড়াও।'
তাকালাম।
' তুমি আম খাও?'
' ওরে বাবা, আমার খুব প্রিয়!'
' একটু এসো।'
রান্নাঘরের পাশ দিয়ে আর একটা ছোট্ট ভাঙা ইটের ঘর,যেটা আগেই চোখে পড়েছে আমার। মেয়েটি সেখানেই ডেকে নিয়ে গেল আমায়। দেওয়ালের ফাটল বেয়ে, ভাঙাকার্ণিশ বেয়ে নেমে আসা ডালপালা, লতাপাতা বহুদিন ধরে জমতে জমতে জঙ্গল হয়ে রয়েছে ঘরের চারিধার। দেওয়ালের গায়ে এক কোণে ডাঁই করে রাখা আম আর কিছু জামরুল।
' ঝড়ে,হাওয়ায় কত আম, জামরুল গাছগুলো থেকে পড়ে যায়...আমি সব কুড়িয়ে কুড়িয়ে এনে রাখি...। এগুলো সব তোমার। তুমি নিয়ে যাও সঙ্গে করে ..। '
অবাক হয়ে গেলাম।
হেসে বললাম, ' তুমি খাবে না?'
' খাই তো। লুকিয়ে লুকিয়ে খাই। '
' কেন?'
 
    মেয়েটি মাথা নীচু করে একটুক্ষন  চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর কাঁদো কাঁদো স্বরে বলে,' আমি আম কুড়িয়েছি শুনতে পেলে মা রাগ করবে খুব! আর কোনোদিন খেলতে আসতে দেবে না আমাকে আমার খেলাঘরে...বাবা,মা আমাকে আগলে আগলে রাখে সবসময়...একদম ঘেঁষতে দেয় না বড় বড় গাছের ধারে..।'
' কিন্তু কেন?'
' জানি না। দাঁড়াও আমি তোমাকে আম,জামরুলগুলো দিয়ে দিচ্ছি। '
এই সময়ে, এই পরিস্থিতিতে এত ফলআমি কেমন করে নিয়ে যাবো? বাড়িতে সবাই নানা কথা জিজ্ঞেস করতে শুরু করলে তখন কীই বা বলবো? 
ওকে বাধা দিয়ে বললাম, ' আজ থাক। এতগুলো আম আমি একসাথে নিয়ে যেতে পারবো না। আমি কিছু নিয়ে আসিনি।'
'ও তাও তো বটে..তবে কাল এসে বরং...তুমি আবার আসবে তো কাল?'
কেমন একটা করুন মুখে যেন চেয়ে আছে ও আমার দিকে। আমারও কেন জানি না হঠাৎই খুব মন কেমন করছিল ওকে ছেড়ে যেতে।
বললাম, ' কেন আসবো না? ঠিক আসবো। ঐ দ্যাখো তোমার নামটা জানা হয়নি..।'
' ঝিনুক। আর তোমার নাম?'
' রিন্টু। এটা আমার মামাবাড়ির নাম। তুমি এই নামেই আমাকে....।'
' আচ্ছা রিন্টু, এখন একটা আম তুমি রাখো। এটা খেতে খেতে বাড়ি যাও..দেখো কি মিষ্টি! '
ঝিনুক দেওয়ালের গায়ে রাখা আমগুলোর ভেতর থেকে একটা আম তুলে আমার হাতে দিতে গেল আর ঠিক তখনি হাত কয়েক দূরে শিকড় গজিয়ে ওঠা গাছগাছালি, জঙলার ভেতর থেকে ফোঁস করে উঠলো ইয়া বড়ো,  মিশকালো, মোটা সোটা একটা সাপ..একেবারে আমার হাঁটুর কাছে ফণা তুলে...!
' না..!' বলে তীরবেগে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো ঝিনুক। 
' আমি থাকতে কেউ তোমার কোনো ক্ষতি করবে না..!'
 
    সাপটা আস্তে আস্তে চলে যাচ্ছে দেওয়ালের গা বেয়ে বাইরে জঙ্গলের ওদিকটায়...। 
আমি স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে আছি। আমার সর্বাঙ্গে, শিরা উপশিরায় যেন তীব্র রক্তের স্রোত বয়ে যাচ্ছে! সাপের দিকে তাকিয়ে নয়..একটা অন্য, হাড়হিম করা দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে! 
আমাকে জড়িয়ে ধরতে গিয়ে ফ্রকের জামার হাতা বেশ খানিকটা উঠে এসেছে মেয়েটির। না,সেই  হাত দুখানা কোনো নরম, তুলতুলে মেয়েলি হাত নয়...হাড়মজ্জা বের করা একটা আস্ত কঙ্কালের হাত। জলজ্যান্ত...চোখের সামনে!
সেই মূহুর্তে আমার ছোট্ট শরীরে যতটুকু শক্তি সঞ্চয় করা সম্ভব, প্রাণপণে তার সবটুকু দিয়ে একঝটকায় নিজেকে ছাড়িয়ে উর্ধশ্বাসে দৌড়াতে লাগলাম...। পেছন থেকে একটা ক্ষীণ গলায় ডাক শুনতে পাচ্ছি.. ''রিন্টু, রিন্টু একবারটি শোনো..শুনে যাও...এই আমটা তোমার জন্যে..।'
যে হাত দিয়ে ডাকা, সে হাতেই আম ধরা..!
 ঝোপঝাড়, জঙ্গল ডিঙিয়ে,দিক্বিদিক গ্যান হারিয়ে, হাঁপাতে হাঁপাতে তখন আমি কোথায় কোন দিকে চলেছি কিছুই জানি না...! হঠাৎই একটা গর্তের ভেতর আটকে গেল বাঁ পাটা..।
'আঃ' শব্দে চিৎকার করে উঠলাম আমি আর ঠিক তক্ষুনি ঘুমটা ভেঙে গেল।
তাকিয়ে দেখি দিদিমার পাশে শুয়ে আছি। নিঃশ্বাস ওঠাপড়া করছে তখনো।
' কী রে রিন্টু, কী হয়েছে? স্বপ্ন দেখেছিস? হঠাৎ ওভাবে চিৎকার করে উঠলি.! এই জন্যে আমি ওসব গল্প করতে চাই নি! দাঁড়া দাঁড়া, একটু বুকে হাত দিয়ে ডলে দিই। ঠিক হয়ে যাবে...।'
চারিপাশটা একবার ফিরে তাকালাম। ভোরের আবছা আলোর একটা ক্ষীণ রেখা দেখা যাচ্ছে জানলা দিয়ে। সবটাই যেন ঘোরের মতো লাগছে এখনো।
গতকালই দুপুর বেলায় এই চৌকিতে বসে দিদিমার মুখে প্রথম শুনি সে কাহিনী..... 
' এতকরে বলছিস যখন দাদাভাই..ঠিক আছে যতটা জানি শোন...তবে কথা দে, কখনো কোনোদিন ঐ ঝোপজঙ্গলে যাবি না?'
' কথা দিলাম দিদিমা, কখনো কোনোদিন..। '
'বেশ তাহলে শোন। অনেক দিন আগেকার কথা সেসব...কত বছর আগের বলতে পারবো না...ঐ অফিসার বড়বাবুর ছোট্ট একটি মেয়ে ছিল। নামটা কি যেন..হ্যাঁ, ঝিনুক..। একদিন হঠাৎ দুপুরে সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়েছে, বাড়িটার সামনে বড় আমগাছের ডালে উঠে আম পাড়তে গিয়ে মেয়েটি তৎক্ষনাৎ পড়ে যায় এবং মাথায় প্রচন্ড আঘাত পেয়ে ঐ জায়গাতেই মারা যায়। ঝিনুকের মা ঐ কষ্ট সহ্য করতে না পেরে মাস কয়েক পর তিনিও মারা যান। তবে কী কারণে মারা যান তা জানি না.. বড়বাবু তারপর আর বেশিদিন ঐ কোয়ার্টারে ছিলেন না। নিজে থেকেই বদলি নিয়ে একদিন ঐ কোয়ার্টার ছেড়ে চলে গেলেন। 
সেই থেকে ঐ বাড়ি হানাবাড়ি হয়েই পড়ে আছে। এর আগে ফায়ার ব্রিগেড থেকে দুজন মিস্ত্রী গোছের লোককে পাঠানো হয়েছিল,ঘরদোর গুলো ভেঙে জঙ্গল সাফাই করে জায়গাটা পরিষ্কার করার জন্য। ওদেরই তো জায়গা। সন্ধ্যার দিকে দুজনকেই বাড়ির বাগানে চোখ উল্টে মরে পড়ে থাকতে দেখা যায়।
কী করে কী হলো জানি না রে ভাই...সেই থেকে সকলের মুখে একটাই কথা ' ভুতের বাড়ি।' 

    আমার স্বপ্নে দেখা সে অভিজ্ঞতা কেউ বিশ্বাস করবে কিনা জানি না। অনেক বছর হয়ে গেছে। বড়বাবুর বাড়ি শেষমেশ যাবতীয় ভয়ভীতি কাটিয়ে উঠে নতুন সাজে সাজিয়ে তুলেছে নিজেকে। ফায়ার ব্রিগেডের নতুন হাউজিং এস্টেট  হয়েছে সে জায়গা। যার নাম হয়েছে ' নিউ বিল্ডিং।' 
 সব প্রশ্নের মীমাংসা হয়ে গেলেও, তবু কেন জানি না, আমি কিন্তু আজও মাঝে মাঝেই চোখ বুজলে দেখতে পাই জঙ্গল ঘেরা, পরিত্যক্ত, ভাঙাচোরা সেই বাড়িটার বারান্দায় দাঁড়িয়ে কেউ একজন এখনো একাকি অধীরভাবে প্রতীক্ষা করে আছে হাতে আম নিয়ে... যে হাতে ডাকা,সে হাতেই আম ধরা।। 
 
সমাপ্ত


Subhanjan Chatterjee