নীল রঙে মিশে গেছে লাল - সিদ্ধার্থ পাল

 

 নীল রঙে মিশে গেছে লাল  

 

সিদ্ধার্থ পাল



    ফটফটে চাদের আলোয় রুপালি কুয়াশার কাঁথায় ঢাকা পড়ে আছে জয়ন্তীর বিস্তীর্ণ শুষ্ক চরা। পাহাড়ের চুড়ায় শিব মন্দিরের টিমটিমে আলো এত দূর থেকেও দেখা যাচ্ছে। অনেকটা সমুদ্রের মাঝখানে লাইট হাউসের মতন। দুঃস্বপ্ন দেখে চমকে ওঠা নাম না জানা পাখিদের কর্কশ আর্তনাদ, চারিদিকের নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে, পাথরের গায়ে ধাক্কা খেয়ে প্রতিধ্বনি সৃষ্টি করছে থেকে-থেকে। শোনা যাচ্ছে ফেউয়ের ডাকও। উত্তরের পাহাড়গুলো পেরিয়ে আরও কিছুদূর গেলেই বক্সা রিজার্ভ ফরেস্ট। এমন নিশ্চল রাতে কখনও সখনও সেখানকার বাঘের গর্জন উপত্যকার বাতাসে তরঙ্গ তুলে কানে এসে পৌছায়। বালিতে সর্সর্শব্দ বুঝিয়ে দেয় নিশাচরদের উপস্থিতি। বোধহয় তেমনই কিছু উপলব্ধি করার জন্যে কানের কাছে হাত নিয়ে স্থির হয়ে ছিলেন আদিত্য। নাহ্, বাঘ বা নেকড়ের উপস্থিতি টের পাওয়ার জন্যে নয়। তিনি ঠাহর করতে চাইছেন তাদের থেকেও ভয়ংকর কিছুকে। আলো-আঁধারির অন্তরালে লুকিয়ে থাকা সেই ছায়াময় অবয়ব, যার সুরেলা গলার গুনগুন গান বৃত্তাকারে ঘুরে চলেছে তাঁকে। জ্যোৎস্না ভেজা রাতে তরাইয়ের ঘন জঙ্গলে, শিমূল আর গামারের ভিড়ে কিভাবে এলেন আদিত্য? অজ্ঞান ছিলেন, হঠাৎ জ্ঞান ফিরল এমন কোনো ব্যাপার নয়। খুব স্বভাবিক ভাবে, চোরকাঁটার আঁচড় বাঁচিয়ে, শিশিরসিক্ত ফার্ন পাতাগুলোকে লাল হাতে সিঁদুর লেপে দিচ্ছিলেন তিনি। আচমকা সব ভালো লাগার অনুভূতি মুছে গিয়ে জমাট অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়ার ভয় চেপে ধরল তাঁকে। খেয়াল হল, তিনি ভীষণ একা। না না, ঠিক একা নন। ওই আকর্ষণীয় স্বরের গুঞ্জন ঘিরে রেখেছে তাঁকে। মনে আসছেঅবকাশগেস্ট হাউসের কড়ি-কাঠ। জানালার কাছে তার মায়াময় হাতছানি, যাকে উপেক্ষা করা যায়না। ব্যস, তারপরে এই

    পায়ে-পায়ে লতা, গুল্ম এড়িয়ে চরার বালিতে এসে দাঁড়ালেন আদিত্য। বরফ শীতল কুয়াশার ছোঁয়ায় রোমকূপ কেঁপে উঠল। গায়ের লাল চাদর ভালো করে জড়িয়ে নিলেন। লাল রঙ তাঁর পছন্দ নয়। চোখ ভরা বিস্ময় আর বিতৃষ্ণা নিয়ে চিনতে চাইলেন ঘরে ফেরার পথ। অনেক দূরে পাহাড়ের কোলে লেপচা বস্তির কাঁপা আলো নজরে এল। সেটাকে ডান হাতে রেখে, নদীখাতের বালির ওপর দিয়ে সোজা উত্তরে হাঁটতে থাকলে নিশ্চয়ই জয়ন্তী ব্রিজ আসবে। ব্যস, ওখানে একবার পৌছতে পারলেই নিশ্চিন্ত। বাকি পথটুকু ওঁর খুব ভালো করে চেনা হয়ে গেছে এই দিনে। হিমাংশুর সাথে দেখা হয়ে গেলে অনেক কৈফিয়ত দিতে হবে। কিন্তু আদিত্যকে সে চেনে। বন্ধুকে অবশ্যই বিশ্বাস করবে। ছোটবেলায় এমন হয়েছে আদিত্যর সাথে দু-একবার। গভীর রাতে নিজেকে আচমকা খুঁজে পেত কোলকাতার বাড়ির ছাদে শ্যাওলা ধরা জলের ট্যাঙ্কের পাশে। আবার কখনও পেয়ারা তলার দোলনায় দুলতে-দুলতে দুরন্ত উল্লাসে খান-খান করে দিত মধ্যরাতের নৈঃশব্দ্য। ডাক্তার বলেছিল নক্টাম্বুলিজম্বা স্লিপ ওয়াকিং। ঠাকুমা বলত নিশির ডাক। মা রাত জেগে আদিত্যর দুহাত আঁকড়ে বসে থাকত রাত্রির গ্রাস থেকে ছেলেকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যে। সেসব এখন অতীত। অন্তুতপক্ষে বছর দেড়েক আগে পর্যন্ত তাই ছিল। সর্বশেষ বইয়ের ওপরে কাজ করতে বসেই সব এলোমেলো হয়ে গেল

    চাপা গুনগুন গান আবার ফিরে এল। এবারে অনেক কাছের থেকে। একা সে ছাড়তে চায় না আদিত্যকে। কখনও পরম মমতায় জড়িয়ে থাকে আবার মুহূর্তেই তাঁর অস্তিত্বকে প্রবল ঘৃণায় গুঁড়িয়ে ফেলতে উদ্দাম হয়ে ওঠে। এই সংসর্গ আদিত্যের অকাঙ্খিত। কাতর প্রার্থনায় নিস্তার চেয়েছেন। কোনো ফল হয়নি। হামিং শব্দটাই এখন তাঁর ঘুমপাড়ানি গান

    প্রবল অস্বস্তিতে দুচোখ বুজে এল আদিত্যর। এই অশরীরী উপস্থিতির কথাই কি গেস্ট হাউসে স্থানীয় ভুটিয়া লোকগুলো আলোচনা করছিল? ছোট এলাকায় খুব সামান্য ঘটনাই বড়সড় ঢেউ তোলে। সেখানে এক মাসের মধ্যে তিনটে অপঘাতে মৃত্যু সবার সাহসের ভিত নড়িয়ে দিয়েছে। গরীব-গুর্বো মানুষগুলোর সহজ ব্যাখ্যা হল, পাহাড়ি যক্ষীইদ্যাগ, কোনো অজানা পাপের সাজা হিসেবে হতভাগ্য লোকেদের প্রাণবায়ু শুষে খিদে মেটাচ্ছে শহুরে লোকেরা সেসব মানে না। তারা পুলিশি বিশ্লেষণের ভরসায় বসে থাকে। সেদিন কুমারগ্রাম থানার অফিসার ইনচার্জের সাথে দেখা হয়েছিল। আদিত্যকে বারবার রাতে কোথাও বেরোতে বারণ করেন তিনি। গল্প শোনালেন এক ভয়ানক সিরিয়াল কিলারের যে তার শিকারকে শুধু হত্যাই করে না, ছিন্নভিন্ন করে দেয় অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। ওসি সাহেব কিভাবে আর জানবেন, অসময়ে বাইরে যাওয়া-না যাওয়া আদিত্যর নিজের হাতে নেই

‘♫ ♫ রাজকুমারের একলা থাকা, ঘুমের ঘোরে বদ্যি ডাকা ♫ ♫’

    কানের কাছে সুর করে বলা শব্দগুলো বুকের হৃৎপিণ্ডের ধুকপুকানিকে ছাপিয়ে গেল। খুব চেনা লাইন আর খুব পরিচিত সেই গলা। চোখের পাতা জোরে বন্ধ রেখে নিজেকে দুনিয়া থেকে আলাদা করে দিতে চাইলেন আদিত্য। বোঝা আর তিনি বইতে পারছেন না। এখনতো আর মা নেই, যে দরজা আগলে তাঁকে ঘরে আটকে রাখবে

আদি টুকি! চোখ খুলবে না? আমার ওপরে এত রাগ

মনে পড়ল ছোটবেলায় মা আদর করে বলত, ‘আদি, খেতে আয় সোহাগ মাখা রমণীয় এই ডাক উপেক্ষা করার শক্তি আদিত্যর নেই। শাসন শিথিল করে চোখ মেললেন তিনি

রূপসা! তুমি আবার…’

    তীক্ষ্ণ খিলখিল অট্টহাসি ভরিয়ে তুলল চরাচর। গাছের পাখিগুলো আতঙ্কে ঝাপটে উঠল ডানা। হাসির দমকে রূপসার সর্বাঙ্গ কাঁপছে। কাঁপছে আদিত্যর মেরুদণ্ডও। হামাগুড়ি দিয়ে বসে পড়তে ইচ্ছে করছে। গায়ে চিমটি কেটে জাগতে চাইছে এই ভয়ানক দুঃস্বপ্ন থেকে। চাঁদের আলোয় কি বীভৎসই না লাগছে রূপসার কৌতুক। হাতের চেটো আর কষ লাল টুকটুকে, যেন আঁজলা ভরে রক্তপান করেছে। আর নিতে পারলেন না আদিত্য। উদ্ভ্রান্তের মতন ছুটতে লাগলেন বালি পাথরের ওপর দিয়ে। কিছুদূর এগোতে পারলেই দেখতে পাবেন ব্রিজটা। সারারাত সেখানে গাড়ি চলে। মানুষ দেখা যায়। গেস্ট হাউসে পৌঁছে হিমাংশুকে খবর দিতে হবে। ছেলেবেলার বন্ধুটিকে তাঁর একান্ত প্রয়োজন। ওঁর সাথে গল্প কথায় মেতে থাকলে মন ভালো থাকে আদিত্যর

    হঠাৎ হোঁচট খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়লেন তিনি। কাঁধের ঝোলা ছিটকে পড়েছে বালিতে। তিনি ঝোলা নিয়ে নিশি ভ্রমনে বেরিয়েছিলেন? নিজের পরনের কাপড় দেখে আবার হতবাক হয়ে গেলেন। গায়ে জড়ান লাল শাড়ি, রূপসার মতন। মেয়েটার দুরভিসন্ধি দিনের পর দিন ছত্রখান করে ফেলছে আদিত্যর অস্তিত্বকে। ওর ওপরে প্রবল রাগে, পাগলের মতন অস্ত্র খুঁজে বেড়ালেন হামাগুড়ি দিয়ে। তেমন কিছু কুড়িয়ে না পেয়ে ফেরত এলেন ঝোলার কাছে। হাতড়ে পেলেন টর্চ। আর পেলেন, একটা রক্তস্নাত ভোজালি। কোথা থেকে এল এটা এখানে? নিজের ভাবনাকে চাপা দিয়ে তৈরি হলেন আত্মরক্ষার জন্যে। হাতের মুঠোয় অস্ত্র বাগিয়ে ধরে পিছনে ফিরলেন। ওঁনার জীবন যে দুর্বিষহ করে রেখেছে, তাকে আজকেই নিকেশ করতে পিছপা হবেন না। কিন্তু কোথায় রূপসা? টর্চের আলোয় শুধু কুয়াশার মেঘ চোখে পড়ছে। আর কারো চিহ্নমাত্র নেই। অথচ ওর গলা এখনও মাথার ভিতরে অনুরণিত হচ্ছে। মেয়েটা থেকেও নেই আবার না থেকেও সর্বক্ষণ জানান দিচ্ছে উপস্থিতি

    টর্চ মাটিতে ফেলেই দুপা পিছিয়ে গেলেন আদিত্য। দেহটাতে এখনও প্রাণ আছে। আলোর দিকে হাত বাড়িয়ে সাহায্য চাইছে নিঃশব্দে। প্রতিটা প্রচেষ্টায় দলা-দলা রক্ত উঠে আসছে ওর মুখ দিয়ে। কাছে গিয়ে চিনতে পারলেন তাকে আদিত্য। জিমসান দোরজে।অবকাশগেস্ট হাউসে হিমাংশুর সর্বক্ষণের সহায়ক। রান্নার হাত দারুণ। ওর হাতে দো-পেঁয়াজা খেয়ে প্রাণভরে প্রশংসা করেছেন কতবার। তারও এমন নির্মম পরিণতি হল?

কে মেরেছে তোমায় জিমসান? বল আমাকে। রূপসা? লাল শাড়ি পড়া কোনো মেয়ে?’

    আদিত্যর প্রশ্নে অবসন্ন জিমসানের চোখে বিহ্বলতা ফুটে উঠল। অবিরাম রক্তক্ষরণে বাকশক্তি হারিয়েছে তার। একটু যদি জল দেওয়া যেত ওকে। বালি খুঁড়লে, তলায় লুকনো জয়ন্তীর ধারা পাওয়া যাবে হয়তো। কিন্তু একি! জিমসানের ঘোলাটে দৃষ্টিতে চূড়ান্ত হিংস্রতা জেগে উঠেছে। রক্তাক্ত আঙ্গুলগুলো দিয়ে টিপে ধরতে চাইছে আদিত্যর গলা। মৃতপ্রায় মানুষটা সর্বশক্তি দিয়ে ছিঁড়ে ফেলতে চাইছে ওঁর টুঁটি। নিরুপায় আদিত্য মাটি থেকে ভোজালি তুলে নিয়ে কোপ বসাতে লাগলেন জিমসানের হাতে, গায়ে। মাংসের মধ্যে ধারালো ধাতু প্রবেশের চপ্চপ্শব্দ আর জিমসানের গোঙানি ছাড়া জয়ন্তী তখন শান্ত। ধীরে-ধীরে জিমসান নিঃসাড় হয়ে গেল। তার প্রাণহীন দেহ পিছনে ফেলে রেখে আবার ছুটতে শুরু করলেন বাংলা সাহিত্যের প্রথিতযশা লেখক আদিত্য বসু

    বছর খানেক আগে, সাহিত্য অ্যাকাডেমির পুরষ্কার নেওয়ার সময় কোনো এক হাল্কা মুহূর্তে জ্যোতির্ময়কে কথাটা বলে ফেলেছিলেন। চিরকাল হাস্যরস এবং সামাজিক বিষয়ে লিখে প্রবল জনপ্রিয়তা পেয়ে তিনি এবারে নতুন চ্যালেঞ্জ নিতে চান। নিজের স্বচ্ছন্দ্য পরিসরের বাইরে বেরিয়ে অন্য কোনো জ্যঁরের সাথে এক্সপেরিমেন্ট করবেন। জ্যোতির্ময় লুফে নিয়েছিল প্রস্তাব। সেই থেকে এঁটুলি পোকার মতন পিছনে লেগে ছিল প্রকাশক বন্ধুটি। তাঁর তাড়নাতেইমনস্ত্বাত্তিক রোমাঞ্চনিয়ে রিসার্চের গভীরে ডুবে যান আদিত্য। পড়ে ফেলেন গাদা-গাদা বই। বিশ্বের তাবড়-তাবড় বৈজ্ঞানিক, গবেষকদের লেখা পড়ে বুঝতে পারেন, মনের রহস্যের গোলকধাঁধা মহাকাশের নক্ষত্রপুঞ্জের থেকেও সীমাহীন। ফোটন কণার থেকেও দ্রুতগামী এই শক্তি কোয়ান্টাম মেকানিক্স ত্বত্তের সংজ্ঞা অনুসারে একই সাথে সর্বত্র বিরাজ করতে পারে। ওয়ার্মহোলের সাহায্য ছাড়াই সমান্তরাল মহাবিশ্বে তার অবাধ বিচরণ। অবলীলায় খণ্ড-বিখণ্ড করে ফেলে সত্তাকে। আবার জুড়ে ফেলে প্রয়োজন মত। কত অদ্ভুত ঘটনার বিবরণ পড়ে ধাপে-ধাপে লেখার পটভূমি তৈরি করেছিলেন আদিত্য। তারপরে বাস্তবতার ছোঁয়া পেতে উপন্যাসের চরিত্রগুলোর মধ্যে সমাহিত করে ফেলেন নিজেকে। লোকচক্ষুর আড়ালে চলে গিয়ে দিন-রাত এক করে লিখতে থাকেন একের পর এক অধ্যায়। মনঃসংযোগ বজায় রাখার জন্যে এক জ্যোতির্ময় ছাড়া বাইরের কারোর সাথে দেখা পর্যন্ত করতেন না। দিনের পর দিন এমন কঠোর অধ্যবসায়ে পাণ্ডুলিপি শেষ হলেও অবসাদে আচ্ছন্ন হয়ে যায় তাঁর চেতনা। গল্পের গবেষণার কাজে জানতে পেরেছিলেন কিছু উদ্ভিদের সাইকেডেলিক ক্ষমতার কথা। সেই থেকে মানসিক দুরবস্থার ওষুধ হয়ে দাঁড়ায় নেশা। আদিত্যর সামাজিক সংযোগের দ্রুত অবনতি ঘটায় চূড়ান্ত উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে জ্যোতির্ময়। জানা পরিচয়ের মধ্যে কোনো আত্মীয়স্বজন নেই তাঁর। অ্যাডাল্ লাইফ একলাই কাটিয়ে আসা লোকটার সাহায্যে শেষ পর্যন্ত এগিয়ে আসে ছেলেবেলার বন্ধু হিমাংশু। ওর আমন্ত্রনে এবং জ্যোতির্ময়ের পরামর্শে জয়ন্তীর পাড়ে গেস্ট হাউসে মাস দেড়েক কাটিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন আদিত্য। হিমাংশু থাকলে রূপসা আসতে পারে না কাছে। দূর থেকে চাপা রাগে ফুঁসতে থাকে। আদিত্যর বন্ধুরা রূপসার চোখের বালি

    গেস্ট হাউসের কাছাকাছি পৌঁছে আবার পিছনে ফিরে দেখলেন আদিত্য। নাহ্কেউ নেই। দূরে কোথাও বালির ওপরে এখনও পড়ে আছে দোরজের নিষ্প্রাণ দেহ। আদিত্য কি আজকে নরহত্যা করলেন? না না ছেলেটা এমনিতেই বাঁচত না। রূপসা ওঁর ফুস্ফুস ফুটো করে দিয়েছিল যে। কত কষ্ট পাচ্ছিল। আদিত্য বরং সেই যন্ত্রণার অবসান ঘটিয়েছেন। এক প্রকার মার্সি কিলিং। দোরজেকে বেশ ভালোবাসতেন আদিত্য। সুন্দর ভাব জমে উঠেছিল। দুদিন আগে আড়াল থেকে কিছ কথা শুনে ফেললেন তিনি। কোলকাতার লেখকের অদ্ভুত স্বভাব নিয়ে দারোয়ান গুরুঙ্গের সাথে নিষ্পাপ মস্করায় মেতেছিল দোরজে। রাতে দোতলায় কাজে গিয়ে লুকিয়ে পুরুষ মানুষের লিপস্টিক পড়া দেখেছে। দমফাটা হাসিতে ফেটে পড়ছিল ওরা। উল্লাসের প্রতিটা দমকে চুরমার হয়ে যাচ্ছিল আদিত্যর অন্তরাত্মা। জীবনে প্রতিষ্ঠিত সে। সাহিত্য চর্চার পুরস্কারে ওঁর বালিগঞ্জের ফ্ল্যাট সাজানো। পাহাড়ি তরুণের ঠাট্টা তাঁর অবজ্ঞা করাই উচিত। তারপরে আদিত্য ভয়ও পেলেন খুব। মুখ লুকিয়ে পালিয়ে আসলে রূপসা রেগে যায়। হিমাংশু এসেছিল আদিত্যর মনখারাপ দূর করতে। কিন্তু গ্লাসের টুংটাং আর প্রাণ খোলা খুশির খেয়ালে লক্ষ্য করেনি ঘরে এসেছে রূপসাও

    ধূলিধূসরিত আদিত্য গেটের কাছে এসে শিউরে উঠলেন। চেয়ারে ঘুমন্ত গুরুং এর পাশে এলোকেশী হয়ে মিটিমিটি হাসছে মেয়েটা। আবার সেই অস্ফুট হামিং। মন্ত্রমুগ্ধের মতন এগিয়ে গেলেন আদিত্য। অনেক কাজ বাকি রয়ে গেছে

 

♫♫♫♫♫♫♫♫♫♫♫♫♫♫♫♫♫♫

 

    গেস্ট হাউসের সামনে জ্যোতির্ময় যখন গাড়ি থেকে নামল, তখন ঘড়ির কাঁটা রাত দুটো ছুঁই-ছুঁই। ভাড়া মিটিয়ে দিতেই ড্রাইভার দ্রুত গাড়ি ঘুরিয়ে চলে গেল। ড্রাইভারের বাড়ি এখান থেকে কুড়ি কিলোমিটারের মধ্যে। মোটরগাড়িতে এই দূরত্ব তাড়াহুড়ো করার মতন নয় একেবারেই। তবে পথে আসার সময় জ্যোতির্ময় শুনেছিল এক খুনি যক্ষীর কাহিনী। সবাই তার ভয়ে কাঁটা। নৃশংস হত্যালীলার বিবরণে কপালের দুশ্চিন্তার ভাঁজ আরও গভীর হয়েছে জ্যোতির্ময়ের। এখন টিমটিমে বাল্বের আলোতে, সাইনবোর্ডেঅবকাশগেস্ট হাউসের নাম পড়তে গিয়ে ওর একবার মনে হল, হয়তো রাতটা আলিপুরদুয়ার সদরে কাটিয়ে এলেই ভালো হতো

    দারোয়ানের খালি ঘরে ছোট টিউবের আলোয় একলা টেবিল ফ্যান আপন খেয়ালে এদিক-ওদিক হাওয়া দিয়ে যাচ্ছে। জ্যোতির্ময় গলা খাঁকারি দিয়েও কারো সাড়া শব্দ পেল না। রিসেপ্শনেও একই অবস্থা। হিমাংশুর সাথে আগে দেখা হওয়া ভীষণ জরুরী। গতকাল ডক্টর কনক চৌধুরী শিয়ালদহ স্টেশনে বিদায় জানাতে এসেছিলেন। জ্যোতির্ময়কে বুঝিয়েছিলেন তিনি, আদিত্যর বর্তমান মানসিক অবস্থায় চমক অনিশ্চিত প্রতিক্রিয়া উদ্রেক করতে পারে। তাই আগে-ভাগে বলে কয়ে যাওয়াই উচিত। সেরকমই করবে ভেবেছিল জ্যোতির্ময়। আদিত্য সেল ফোন ব্যবহার করে না। হিমাংশুর সাথেও কিছুতেই যোগাযোগ করা যায়নি মোবাইলে। কোনো কর্মচারী ল্যান্ড লাইনটা তুলেছিল একদিন। ভাঙ্গা বাংলা আর হিন্দি মিশিয়ে বলেছিলবাবু পতাহ্নাই অমঙ্গলের কালো ছায়া দেখেছিল জ্যোতির্ময়

    আদিত্যর পরিস্থিতির জন্যে জ্যোতির্ময় নিজেকেই দায়ী করে কিছুটা। সর্বকালের সেরা ক্ল্যাসিক সৃষ্টির উল্লাস, নেশার মাদকতা ছড়িয়েছিল। আদিত্যকে লেখার সাহায্যার্থে বই-পত্তর, ম্যাগাজিন সব ওই জোগাড় করে এনে দিত। সময় সুযোগ পেলেই ছুটে যেত বন্ধুর ফ্ল্যাটে। মন দিয়ে শুনত প্লট। দিত নানা রকম সাজেশন্স। তবুও চোখের সামনে আদিত্যকে ডুবে যেতে দেখে হাত বাড়িয়ে দেয়নি। ভেবেছিল, স্রষ্টারা একটু পাগলাটে তো হয়ই। সাইকেডেলিকের প্রভাবে মোহাচ্ছন্ন আদিত্যর হাত থেকে পাণ্ডুলিপি নেওয়ার সময় জ্যোতির্ময় বুঝেছিল ওঁর অবস্থা নিয়ন্ত্রণের বাইরে বেরিয়ে গেছে

    অ্যাকিউট কেস অফ ডিসোসিয়েটিভ পারসোনালিটি ডিজ-অর্ডার, ডক্টর চৌধুরী আদিত্যর মনস্তাত্বিক মূল্যায়ন করে বলেছিলেন। নিজের ব্যক্তিসত্তাকে অন্য কোনো ইমাজিনারি পারসোনালিটির কাছে হারিয়ে ফেলছেন ওঁ ক্রমশ। খুব সম্ভবত ছেলেবেলায় বেশ কিছু এপিসোড্ হয়েছিল। মা মরা ছেলের ঠিক মতন চিকিৎসা হয়নি। বয়স বাড়লে আদিত্য আপাত সুস্থ জীবনে ফিরে আসলেও উপসর্গগুলো অন্তঃসলিলা নদীর মতন লুকিয়ে ছিল। স্বভাব তেমন পুরুষালী না হওয়ায় আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব বা অচেনা আগন্তুকের কাছ থেকে বক্রোক্তি শুনলেও প্রতিবাদ করতে পারতেন না। মনের কষ্ট চেপে রেখে একের পর এক মজার সামাজিক গল্প লিখে সবাইকে হাসানোর চেষ্টা করে গেছেন। ভুলতে চেয়েছেন কাপুরুষ দুর্বল আদিত্যকে। অবশেষে নিজের সৃষ্টিতে, দৃঢ়চেতা নায়ক বা নায়িকার চরিত্র চিত্রণের প্রয়াসে, তাদেরই কারোর মধ্যে মিশে গেছেন। হ্যালুসিনেট করছেন তিনি দিন রাত। গুলিয়ে ফেলছেন বাস্তব আর অপার্থিব জগতের মধ্যে ভেদাভেদ। ওঁর অবিলম্বে চিকিৎসা আরম্ভ হওয়া দরকার। প্রতি দিন, প্রতি মুহূর্তের অপচয়ে ভয়ংকর ক্ষতি হতে পারে

    হিমাংশুর সাথে শেষবারের কথায় বিপদের ইঙ্গিত পেয়েছিল জ্যোতির্ময়। ডক্টর চৌধুরীর রিপোর্ট পেয়ে তাই নিজেই চলে আসার প্ল্যান করে। আদিত্যকে বাড়ি ফেরার জন্যে বুঝিয়ে সুঝিয়ে রাজি করাতেই হবে। ঘটনা আরও জটিল হয়ে গেছে গত পরশু থেকে। ভবানীভবন থেকে সিআইডি অফিসার কৌশিক, জ্যোতির্ময়কে ফোন করে আদিত্যর খবরাখবর নিয়েছেন। গোয়েন্দাটি আদিত্যর সাথে কথা বলতে চান। তাঁর বইতে বর্ণিত কিছু ঘটনার সাথে ইদানিংকালে ঘটে যাওয়া দুয়েকটি চাঞ্চল্যকর অপরাধের গুরুত্বপূর্ণ মিল পাওয়া গেছে। আদিত্যর হদিস সে জানে না বলে ফোন রেখে দিলেও জ্যোতির্ময় বুঝতে পেরেছে, তাঁর পিছনে ফেউ লেগেছে। অনেক ঘুরপথে, পুলিশের চরকে কাটিয়ে এখানে পৌছতে তাই দেরি হয়ে গেল

    হিমাংশুর খোঁজ না পেয়ে আদিত্যর ঘরের দিকে পা বাড়াল জ্যোতির্ময়। রুম নম্বর আগেই জানত। হাতে ভারি বইয়ের ব্যাগ নিয়ে, কাঠের সিঁড়িতে মচ্মচ্শব্দ তুলে দোতলায় আদিত্যের ঘরে নক করল সে। দরজার তলা দিয়ে আলো আসছে। সম্ভবত জেগেই আছে

    এলে তাহলে?’, দরজা খুলেই বলল আদিত্য। ওঁর মুখের অভিব্যক্তিতে কোনো বিস্ময় লক্ষ্য করল না জ্যোতির্ময়। আদিত্য যেন জানতো যে জ্যোতির্ময় আসবে। আজকেই আসবে। কোনো-কোনো সময় ওঁর মানসিক ক্ষমতা বেড়ে যায় ভয়ানক ভাবে। তাকে সিক্সথ সেন্স, টেলিপ্যাথি না ইএসপি কি বলে জ্যোতির্ময় জানে না। নিজের বুকের ধুকপুকানি লুকিয়ে সহাস্যে ঘরে ঢুকল সে। পাহাড়ি রহস্যঘেরা জয়ন্তীর কোলে, নিজের এতদিনের সুহৃদকে দেখে খুব ভয় হল তার

    হ্যাঁ, সারপ্রাইজ দিতে মাঝ রাতেই চলে এলাম। তুমি তো একেবারেই অবাক হওনি দেখছি, জ্যোতির্ময় নিজেকে সাহস দেওয়ার জন্যেই যেন হইচই করে উঠল। গেস্ট হাউসে কি আর কোনো অতিথি নেই? তাঁদের কেউও যদি শব্দে বিরক্ত হয়ে কমপ্লেন করতে আসত তাহলে বুকে বল পাওয়া যেত

    শশ্শ্শ্‌…’, আঙ্গুল দিয়ে ঠোঁট ছুঁয়ে জ্যোতির্ময়কে চুপ করতে বললেন আদিত্য, ‘আওয়াজ কোরো না। রূপসা আছে

    জ্যোতির্ময়ের শিরদাঁড়া দিয়ে ঠাণ্ডা স্রোত নেমে গেল। আদিত্যর এপিসোড চলছে। কথাবার্তা অসংলগ্ন হলেও চোখের দৃষ্টি অস্বাভাবিক রকম উজ্জ্বল। তীক্ষ্ণ নজরে এফোঁড় -ওফোঁড় করে ফেলছে জ্যোতির্ময়ের মগজ। শুরু থেকেই অদ্ভুত লেগেছে ওঁকে। চোখে সরু করে কাজল লাগানো। গালে রঙিন প্রসাধন

    রূপসা তো থাকবেই। তাকে সঙ্গে করেই নিয়ে এলাম আমি। এই তোমার পাঁচ কপি, আদিত্যর চোখ থেকে বাঁচতে জ্যোতির্ময় শশব্যস্ত হয়ে ব্যাগ থেকে বের করলেন তাঁর এযাবৎ শ্রেষ্ঠ লেখা। রূপসা নামের এক নারী সিরিয়াল কিলারের অভাবনীয় মনস্তাত্ত্বিক উপাখ্যাননীল রঙে মিশে গেছে লাল রূপসা যেমন সাহসী তেমনই হিংস্র। ঠিক যেমনটি আদিত্য হতে চেয়েছিল মনের গোপন স্তরে। বইটির আকাশছোঁয়া চাহিদা ইতিমধ্যেই ছাপিয়ে গেছে প্রিন্টেড কপির সংখ্যা

    আলাপ করবে ওর সাথে? দাঁড়াও ডেকে আনি, দৃশ্যতই উচ্ছ্বসিত আদিত্য বই হাতে শোয়ার ঘরের দিকে যেতে যেতে বলল, ‘কোথাও যেওনা যেন। এক্ষুনি আসছি।

    কাকে নিয়ে আসবে ঘর থেকে? মনের অলীক কল্পনাকে কি আর মাটিতে নামানো যায়। আদিত্যর কাজকর্মে দুশ্চিন্তার মধ্যেও হাসি পেল জ্যোতির্ময়ের। মনের ভুলে একটা মেয়ের গলাও শুনতে পেল যেন। কে জানে কেন আদিত্যের এত দেরি হচ্ছে। অস্থিরতা কমাতে পর্যবেক্ষণ করতে লাগল ঘরের খুঁটিনাটি। ভিতরে একটা বাসি, থমথমে গন্ধ আছে না? এঁটোকাঁটা জমিয়ে রাখার অভ্যেস আছে ওঁর। বালিগঞ্জের বাড়িতেও একই জিনিস হত। জ্যোতির্ময় গিয়ে সপ্তাহান্তে সব পরিস্কার করে আসত, নইলে দুর্গন্ধে টেকা যেত না। এদিক সেদিক ভালো করে দেখে জ্যোতির্ময় অনুমান করল কাপবোর্ডের আড়ালেই জমে আছে কিছু

    কাপবোর্ডের পাল্লা খুলে নিশ্চল হয়ে গেল সে। স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা, দলা পাকানো, খুবলানো শরীরটা কদিন আগেও ভিডিও কলে জ্যোতির্ময়কে বলেছিলসব ভালো নেই। আপনি শিগগির আসুন মনে পড়ল লেখাতে আদিত্যকে এমন কিছু নারকীয়তা যোগ করার পরামর্শ জ্যোতির্ময়ই দিয়েছিল। বইয়ের কাটতি বেশি হওয়ার আশায়

স্থূল হাতে পাল্লা বন্ধ করতেই নারী কণ্ঠের গুনগুন কানে আরও স্পষ্ট হল,

‘♫ একলা ঘরে এক, ফন্দি করে দেখ,

পিঠে এল দুই, মাদুর পেতে শুই,

নিশির ডাকে তিন, বাঁচার আশা ক্ষীণ ♫’

    চুড়ির আওয়াজ রিনরিন করছে জ্যোতির্ময়ের পিছনে। উগ্র আতরের সুবাস বিবস করছে ওর চেতনা। নিঃসীম আতঙ্কে দিশেহারা হয়ে চোখ বুজল সে

    খিলখিল করে হেসে উঠে রূপসা। আজ থেকে সম্পূর্ণ মালিকানা পেয়ে যাবে আদিত্যর শরীরের। শুধু একটা কাজ বাকি

টুকি জ্যোতির্ময়। আমার দিকে তাকাও

 

 ...........


Siddhartha Pal