উপচ্ছায়া
অনন্যা দাশ
শেখরের বাড়িতে ঢুকেই আমার বুকটা কেমন জানি কেঁপে উঠল। প্রকান্ড বাড়ি, একেবারে রাজবাড়ির মতন কিন্তু ভিতরটা কেমন যেন অন্ধকার অন্ধকার মতন। শেখরের সঙ্গে কাজের সূত্রে কলকাতাতেই আলাপ। সেই আলাপ এখন কিছুটা ঘনিষ্টারে পরিণত হয়েছে। কলকাতায় কাজের জন্যে একটা এক কামরার ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে থাকে শেখর। কথা প্রসঙ্গে বলেছিল, “আমাদের গ্রামের বাড়িতে গেলে বুঝতে পারবি বাড়ি কাকে বলে। এখন আর কাজের চাপে তেমন যাওয়া হয়ে ওঠে না। এই শুক্রবার যাবো, তুমি যাবে আমার সঙ্গে?”
আমি তো কোথাও যাওয়ার সুযোগ পেলে সব সময় এক পায়ে খাড়া তাই সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেলাম। শুক্রবারদিন কাজের চাপ এমনিতেও একটু কম থাকে তাই আমরা দুজন অফিস থেকে একটু আগে ছুটি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। শেখরই গাড়ি চালিয়ে নিয়ে গেল। সে দেখলাম একেবারে ওস্তাদ ড্রাইভার।
গান শুনতে শুনতে, গল্প করতে করতে দিব্যি যাচ্ছিলাম।
শেখর হঠাৎ বলল, “প্রায় পৌঁছে গেছি আর মিনিট পনেরো। আচ্ছা শোনো তুহিনদা, তোমাক একটা কথা বলে দিই। আগেই বলা উচিত ছিল কিন্তু শুনলে তুমি হয়তো আর আমাদের বাড়িতে যেতে চাইতে না। অনেকেই ওই কারণে যেতে চায় না, তাই বলি না।“
আমি একটু ঘাবড়ে গিয়ে জিগ্যেস করলাম, “কী ব্যাপার? বলেই ফেল, এখন তো ফিরে যাওয়ার প্রশ্ন নেই। তোর সঙ্গে এসেছি আবার তোর গাড়ি করেই ফিরে যাব।“
শেখর বলল, “ আমার দাদার যখন কুড়ি বছর বয়স তখন কয়েকজন বন্ধুদের সঙ্গে বেড়াতে গিয়ে গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা যায়। মা-বাবা সেই শোকে প্রায় পাগল হয়ে যান। মা তো কিছুদিন পর মারাই গেলেন। বাবা এখনও আছেন তবে ওই ঘটনাটার পর থেকে একটা অদ্ভুত শখ বাবাকে পেয়ে বসে। প্রতি শুক্রবার করে বাড়িতে আত্মা নামানোর আসর বসে! আজ শুক্রবার তাই…”
“আত্মা নামানোর আসর? মানে প্ল্যানচেট?”
“সে যা কিছু হতে পারে। যে যা বলে বাবা তাতেই বিশ্বাস করেন। কত লোক যে বাবাকে ঠকিয়ে টাকা নিয়ে গেছে তার কোন হিসেব নেই। আত্মা নামাতে পারে বললেই হল। কারো কোন কথা শুনবে না! সবাই বিরক্ত। সেটাও আরেকটা কারণ যে জন্যে আমার বাড়ি আসতে ইচ্ছে করে না,” শেখর বেশ রাগের সঙ্গে বলল।
“ও আচ্ছা। ওই ব্যাপারটা খুব স্বাভাবিক। উনি মনে করছেন তোর দাদার সঙ্গে যোগাযোগ করছেন তাই,” আমি সান্ত্বনা দেওয়ার জন্যে বললাম।
“আরে ব্যাপারটা কুড়ি বছর আগে ঘটেছিল, কিন্তু বাবা এখনও সেটাকে ভুলতে পারলেন না। যারা বেঁচে রয়েছে তাদের প্রতি কোন ভ্রুক্ষেপ নেই! অন্য কোন ব্যাপারে কোন ইন্টারেস্ট নেই। অন্য সব ব্যাপারে বরং বেশ কিপটে খুব। মাথা গরম হয়ে যায় আমার। তুমি তো যাচ্ছ, সব দেখবে। মানে তোমার ইচ্ছে হলে থাকতে পারো, না চাইলে থাকতে হবে না।“
“আরে কী বলছিস রে! এই সু্যোগ কেউ ছাড়ে নাকি আবার! ওগুলো তো সব লস্ট আর্ট প্রায়!” আমি বললাম।
এই সব কথা বলতে বলতেই আমরা শেখরদের বাড়ি পৌঁছে গেলাম। ওর ঠাকুরদার বাবা এলাকার জমিদার ছিলেন। তাই বাড়িটা প্রকান্ড। সামনের গেটে বড়োবড় করে লেখা ‘কাঞ্চনমহল’। আমরা যেতে যে দরজা খুলে দিল তার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিতে দিতে শেখর বলল, “সহদেবদা, অনেক দিন থেকে আমাদের বাড়িতে আছে। বাজারহাট থেকে শুরু করে বাড়ির সব কিছুই সহদেবদা সামলায়। সহদেবদার বাবাও আমাদের সঙ্গে থাকতেন,”বিশ্ব কেমন আছে?”
সহদেবদা বলল, “হ্যাঁ, ভালোই আছে। তুমি আসবে বলে খুব খুশি। ও থাকবে তো আজকের ওই আসরে।“
“আচ্ছা তা ভালো তখন তাহলে তুহিনদার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেব। এখন কিছু খেতে টেতে দেবে গো?”
“ও বাবা টেবিল সাজিয়েছি তো ওই ঘরটার পাশের ঘরে। চলো চলো তাড়াতাড়ি নাহলে ওরা সব শেষ করে দেবে!”
শেখর আমাকে অন্ধকার ঘরগুলো দিয়ে টেনে টেনে একটা ঘরে নিয়ে গেল। এই ঘরটায় মোটামুটি আলো রয়েছে। ঘরের মাঝখানে বেশ বড়োসড়ো একটা টেবিল আর সেটাতে অনেক রকমের রকমারি নোনতা মিষ্টি খাবার সাজানো। সত্যি আমাদের খুব খিদে পেয়েছিল। সেই সকালবেলার পর আর কিছু খাওয়ার সুযোগও হয়নি। সহদেব্দা প্লেটে করে সব কিছু তুলে তুলে দিতে লাগল। আমরাও প্লেট নিয়ে খেতে শুরু করে দিলাম। ঠিক তখুনি গরদের পাঞ্জাবি পরে এক ভদ্রলোক আমাদের দিয়ে এগিয়ে এসে শেখরকে বকতে লাগলেন, “বাবু কী বিশ্রী স্বভাব হয়েছে। বাড়িতে অতিথিরা রয়েছেন তাঁদের সঙ্গে আলাপ না করেই খেতে শুরু করে দেওয়া!”
শেখর খেতে খেতেই অম্লানবদনে উত্তর দিল, “আমার সঙ্গেই একজন এসেছে বাড়িতে সে খেয়াল তোমার আছে? আমরা সেই কখন অফিস থেকে বেরিয়েছি, খিদে পেয়েছে তাই খাচ্ছি। কোথায় তোমার অতিথি, ভূত ধরার লোকজন তো? তা আলাপ করিয়ে দাও। তুহিনদা তুমি তো নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছ এই অসম্ভব অভদ্র মানুষটি আর কেউ নয় আমার বাবা, সুধাবিন্দু চৌধুরী।“
ওর বাবা রক্তচক্ষু দিয়ে আমাদের দুজনকে দেখলেন, কিন্তু আর খাওয়া নিয়ে কিছু বললেন না। মাংসের শিঙ্গাড়াটা অসাধারণ খেতে, কামড় দিয়ে শেখরের বাবার অতিথিদের দেখতে মন দিলাম।
মিস্টার আর মিসেস সামন্ত, আর মিসেস সামন্তর ভাই বাদল। মিস্টার সামন্তর পায়ে কিছু একটা সমস্যা আছে মনে হয়। উনি লাঠি নিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁঠছেন। মিসেস সামন্ত নাকি মিডিয়াম। খুব ঝলমলে একটা শাড়ি পরেছেন তিনি আর হাত ভর্তি চুড়ি। উনি হাত নাড়ালেই সেগুলো টিং টিং করে নড়ছে। বাদল মনে হয় খেতে খুব ভালোবাসে, সে খুব মন দিয়ে খেয়েই চলেছে। কিছু শেষ হলেই আবার গিয়ে প্লেট ভর্তি করে আনছে। খাওয়া যেন আর শেষ হচ্ছে না।
একটু পরেই সহদেবদার ছেলে বিশ্ব একটা ট্রেতে করে চা নিয়ে এলো। সহদেবদা আরথারাইটিসে কাবু তাই ভারি ট্রে তুলতে পারে না। ছেলেটা বেশ ভালো, হাসিখুশি। আমার সঙ্গে দিব্যি আলাপ হয়ে গেল।
এদিকে শেখরের বাবা ব্যস্ত হয়ে পড়ছিলেন আসল কাজ শুরু করার জন্যে। তিনিই সবাইকে ঠেলেঠুলে পাশের ঘরে নিয়ে গেলেন। ঘরটা খুব একটা বড়ো নয়। এমনিতে সাদামাটাই। ঘরের জানালাগুলো ওপর থেকে নিচ অবধি ভারী পর্দা দিয়ে ঢাকা যাতে এক চিলতে আলোও না ঢুকতে পারে। ঘরের মাঝখানে একটা গোল টেবিল আর সেটাকে ঘিরে আটটা চেয়ার। দেওয়ালের সঙ্গে লাগানো কয়েকটা চেয়ারও রয়েছে, দর্শকদের জন্যে মনে হয়। ঘরের একবারে শেষ প্রান্তে একটা বাহারি টেবিলের ওপর একটা বেশ বড়ো ফ্রেমে বাঁধানো ছবি। যার ছবি তার সঙ্গে শেখরের মুখের মিল আছে তাই বুঝতে অসুবধা হল না যে ওটা ওর দাদার ছবি। শেখর ফিসফিস করে বলল, “ও বাবা! ওই ছবিটা তো দেখছি নতুন সংযোজন, আগে তো দেখিনি। আগে তো একটা চার বাই ছয় ফ্রেম দিয়েই কাজ চলে যেত।“
সহদেব কাছেই ছিল সে কথাটা শুনতে পেয়ে বলল, “ওটা ইদানীং কয়েক মাস হল এসেছে। এই ঘরের ওই কোণটাতে ওটা রাখা থাকে। কে একজন বুদ্ধি দিয়েছে বড়ো ছবি থাকলে আত্মা নামাতে নাকি সুবিধা হয়। রোজ ঝারপোঁছ করে ছন্দা। ওই ফ্রেমটারও তো দাম অনেক!“
শেখরের চোখ ছোট হয়ে গেল, “ও তাই নাকি? তা কত দাম জানো?”
সহদেব গলা নামিয়ে রেখেই বলল, “শুনেছি তিন লাখ। দাদাবাবুই বলছিলেন কাকে একটা।“
“বাহ! অসাধারণ!”
আমরা সবাই গোল টেবিলটাকে ঘিরে বসলাম। আমার এক পাশে বিশ্ব বসল। অন্য পাশের চেয়ারটা খালিই ছিল। সহদেব দরজার একেবারে কাছে দাঁড়িয়ে রইল লাইট সুইচটা সেখানে বলে। এদিকে বাদল খাবার প্লেটটাকে ভর্তি করে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে এই ঘরে। শেখরের বাবার খুব একটা পছন্দ হল না অবশ্যই কিন্তু মনে হয় মিডিয়ামের ভাই বলে কিছু বললেন না। বাদল এদিক ওদিক দেখে আমার পাশের খালি চেয়ারটাতে এসে বসল আর ওর চাকুম চুকুম চলতে থাকল ক্রমাগত। কী আপদ রে বাবা!
ঘরের সব আলো নিভিয়ে দিতে বলা হল সহদেবদাকে। একেবারে ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে গেল চারিদিক। ঘর অন্ধকার হয়ে যেতেই মিসেস সামন্তর কথা শোনা গেল, “আপনারা সবাই নিহারের কথা ভাবুন, ভাবুন, ভাবুন।“ বিশ্ব আমার পাশে টানটান হয়ে বসেছে বুঝতে পারলাম। ওর কী ভয় করছে নাকি?
“নিহার? নিহার? তুমি এসেছো বাবা? তুমি এসেছো?” মিসেস সামন্ত বলেই চলেছেন।
হঠাৎ একদম ভারি পুরুষের কণ্ঠে ঘরের কোন থেকে কেউ বলে উঠল, “হ্যাঁ, আমি এসেছি! কিন্তু আমি এটাই বুঝতে পারি না যে আমাকে কেন এত ঘন ঘন ডাকা হয়! কী হবে আমাকে এখানে এনে? আমি তো আর পৃথিবীর মানুষদের মতন আপনাদের সবার সঙ্গে থাকতে পারব না! আমাকে না ডাকলেই কী নয়?”
“নিহার, বাবা নিহার তুমি ওই রকম বলছ কেন?” শেখরের বাবা কাতর ভাবে বললেন।
“আর কী বলব? সবাই তো আর সত্যি কথাটা জানে না!” গলার স্বরটা গমগম করছে যেন। এটা তো কিছুতেই মিসেস সামন্তর গলা হতে পারে না। আর কথাগুলো আসছে ওই ছবিটার কাছ থেকে যেন। কী হচ্ছে রে বাবা?
“কী সত্যি কথা?” আবার শেখরের বাবার গলা, গলার স্বর কাঁপছে মনে হল।
“যে তুমিই আমাকে খুন করেছো! তোমার জেদ, তোমার উচ্চাকাঙক্ষা, তোমার লোভ, সব কিছু দিয়ে খুন করেছো তুমি আমাকে! আমি তো বেঁচে থাকতে চেয়েছিলাম, কিন্তু তুমি শুনলে না।”
এবার সবাইকে ভীষণ রকম চমকে দিয়ে একটা অমানুষিক চিৎকার শোনা গেল এবং সেটা আসছিল সুধাবিন্দুবাবুর গলা থেকে। সহদেব সেটা শুনে আলোটা জ্বালিয়ে দিল। সে দরজার আলোর সুইচের কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল।
আলো জ্বলে উঠতে দেখা গেল মিস্টার আর মিসেস সামন্ত মুখ হাঁ করে বসে রয়েছেন। বাদলের তখনও খাওয়াতে মন। শেখর চুপ করে গালে হাত দিয়ে বসে রয়েছে আর সুধাবিন্দুবাবু হাউহাউ করে কাঁদছেন। সহদেব ছুটে গিয়ে সুধাবিন্দুবাবুর জন্যে জল নিয়ে এল। হঠাৎ বাদল আমাকে বলল, “ছবিটা? ছবিটা কোথায় গেল?”
আমি তাকিয়ে দেখলাম সত্যিই তো! তিন লাখের ফ্রেম সহ ছবি হাওয়া! জল খেয়ে শান্ত হয়ে সুধাবিন্দুবাবু মিসেস সামন্তকে বললেন, “কী হল বলুন তো? কার আত্মা নামিয়েছিলেন আপনি?”
মিসেস সামন্ত হাঁউমাঁউ করে বলে উঠলেন, “আমি কিছু জানি না! আমি কারো আত্মা নামাইনি। আমি তো মিডিয়াম, আমি যদি আত্মা নামাই তারা তো আমার গলা দিয়েই কথা বলে! আর এ তো একেবারে পুরুষের কন্ঠস্বর! আর ওই দিক থেকে আসছিল। ওখানে কেউ দাঁড়িয়ে ছিল মনে হয়! ওমা ছবিটা? নিহারের ছবিটা কোথায় গেল?”
সুধাবিন্দুবাবুর চোখ আমার দিকে ঘুরে গেল, “বুঝেছি! এটা তোমার কারসাজি! তুমি এই সব করেছো! গলা ভাঁড়িয়ে কথা বলেছো আর ছবি সরিয়েছো!”
শেখর চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে, “বাবা কী বলছো তুমি! তুহিনদা আমার বস হয়, আমি দাদার মতন সম্মান করি! এমনিতেই আমার যথেষ্ট লজ্জা করছিল এই সব ব্যাপার চলছে বলে তার ওপর তুমি আবার তুহিনদাকে...”
আমি শেখরকে মাঝ পথে থামিয়ে দিয়ে বললাম, “অত ঘাবড়াস না শেখর! তুই আমার অফিসের পরিচয়টা জানিস। তোকে যেটা বলিনি কারণ সচরাচর কাউকেই বলি না সেটা হল আমার আরেকটা পরিচয় আছে। আমি একটু আধটু শখের গোয়েন্দাগিরিও করি। ডিটেকটিভ ধ্রুবজ্যোতি সেনের আন্ডারে কিছুটা ট্রেনিং ও নিয়েছি। আজ আমার নিজেকে আর নিজের গুরুর খ্যাতিকে প্রমাণ করার দিন। এর চেয়ে আনন্দের আর কী হতে পারে? দেখুন সুধাবিন্দুবাবু, ছবি যদি আপনি না সরিয়ে থাকেন তাহলে ছবি একজনই সরাতে পারে?”
“কে?” সুধাবিন্দুবাবু একেবারে বাংলার পাঁচের মতন মুখ করে বললেন।
“এলিমিনেশান পদ্ধতি ব্যবহার করলেই বুঝতে পারবেন। আচ্ছা আমিই না হয় বুঝিয়ে দিচ্ছি। মিসেস সামন্ত করেননি, কারণ ওঁর ওই চুড়ির টিং টং আমরা শুনতে পাইনি। মিস্টার সামন্ত লাঠি নিয়ে হাঁটেন ওঁর পক্ষে ওই অত বড়ো ছবি নিয়ে নড়াচড়া করা সম্ভব নয়। বাদল পুরো সময়টা আমার পাশেই বসে ছিল। ও নড়লে আমি বুঝতে পারতাম, দেখেতে না পেলেও। একই ব্যাপার বিশ্বর জন্যেই প্রযোজ্য। সহদেবদা দরজার কাছে ছিল। ছবিটা নিতে হলে তাকে আমার সামনে দিয়ে হেঁটে যেতে হত, এবং আমি বুঝতে পারতাম, তাছাড়া সহদেবদার আর্থারাটিস আছে। অত ভারী আর বড়ো ছবি সে তুলতেও পারবে না। আপনি বলছেন আপনি করেননি, তাহলে একজনই থাকে আর!”
“শেখর!” সুধাবিন্দুবাবু যেন আকাশ থেকে পড়লেন!
আমি বললাম, “ঠিক ধরেছেন! আর ছবিটা কোথায় আছে সেটা বলাও কঠিন নয়। এত তাড়াতাড়িতে আর কোথায় লুকোবে!” বলে আমি উঠে গিয়ে পর্দাগুলোকে তুলে তুলে দেখতে লাগলাম। একটা পর্দার পিছন থেকেই বেরিয়ে পড়ল ছবিটা।
শেখর বলল, “ধরাই যখন পড়ে গেছি তখন বলেই দিই। এই সব কথা আমি এক বাড়ি ভর্তি লোকের সামনে বলতে চাইনি কিন্তু বাবা তুমিই বাধ্য করলে তোমার আচরণ দিয়ে। যারা চলে গেছে তাদের আঁকড়ে ধরে থাকা যায় না! যারা রয়েছে তাদের দিকেও তাকাতে হয়। আমি দাদার স্মৃতিকে তুচ্ছ করতে চাই না মোটেই। কিন্তু দাদার জন্যে তুমি অজস্র টাকা এই সব বুজুরুকদের পিছনে খরচ করছ অথচ বিশ্ব ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে চান্স পেয়েছে সেই জন্যে সহদেবদা তোমার কাছে এক লাখ টাকা চেয়েছিল সেটা তুমি দিতে চাওনি! এদিকে মৃত ব্যক্তির ছবির জন্যে তিনলাখের ফ্রেম চলে আসছে!”
“কিন্তু ওই কথা? ওই কথাগুলো কে বলল?” সুধাবিন্দুবাবু বলে উঠলেন।
“আমি, কথাগুলো আমি বলেছিলাম জেঠু!” বিশ্ব উঠে দাঁড়িয়ে বলল।
আমি ছবিটা ধরে পর্দার কাছে দাঁড়িয়ে ছিলাম, কথাগুলো বিশ্ব বলছিল কিন্তু মনে হল আমার হাতে ধরা ওই ছবি থেকেই যেন কথাগুলো বেরোলো!
বিশ্ব দাঁড়িয়ে থেকেই বলতে থাকল, “আপনার কী মনে হয়েছিল এরা আত্মা নামাতে পারবে? আমার মনে হয়নি, তাই আমি একটু আমার নতুন শেখা ভেন্ট্রিলোকুইজম বিদ্যাটা পরীক্ষা করে দেখলাম। শেখরদা জানতেন। আমি ওঁকে জিগ্যেস করেই সব করেছি। ডায়ালগগুলোও শেখরদারই লেখা। এটা আমরা এমনিতেই করতাম শুধু ছবিটা দেখে আর ফ্রেমের দামের কথা শুনে মনে হয় শেখদার রাগ হয়ে গিয়েছিল তাই ওটাকে সরিয়ে ফেলেছিল।“
এর পর কী হয়েছিল আমি জানি না কারণ আমরা সবাই ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলাম। মানে আমাদের বার করে দেওয়া হয়েছিল। শুধু শেখর আর সুধাবিন্দুবাবু ঘরে থেকে গিয়েছিলেন।
মিস্টার আর মিসেস সামন্ত পাততারি গুটিয়ে রওনা দিয়েছিলেন তখনই, বাদল অবশ্য অবশিষ্ট বেশ কিছু খাবার বেঁধে নিয়েছিল সঙ্গে, লম্বা পথ যেতে হবে বলে। সহদেবদা তাতে আর কিছু বলেনি।
শনিবার দিনটা শেখর আমাকে ওদের বাড়ির আশপাশের সব দ্রষ্টব্যগুলো দেখিয়েছিল প্ল্যানমাফিক। শুক্রবারের ঘটনা নিয়ে আর কথা হয়নি আমাদের মধ্যে।
রবিবার বিকেলে কলকাতা ফিরে এসেছিলাম আমরা। মাসখানেক পর শেখর একদিন বিকেলে আমার বাড়িতে এসে হাজির। চা খেতে খেতে বলল, “তুহিনদা, তুমি তো সব দেখেছিলে তাই এই কথাগুলো তোমাকে বলাটার প্রয়োজন অনুভব করলাম। জানো তো বাবা না এখন অনেকটাই বদলে গেছেন। ওই তিন লাখের ফ্রেমটা বিক্রি করে সাধারণ একটা ফ্রেম লাগিয়েছেন দাদার ফটোটায়। সব টাকাটা ফেরত পাননি তবে যা পেয়েছেন তাই দিয়ে বিশ্বর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের খরচ অনেক দূর অবধি চলে যাবে। সবচেয়ে বড়ো কথা হল শুক্রবারের প্ল্যানচেট, আত্মা নামানো ওই সব কারবার শেষ হয়েছে। তার বদলে কথাবলা পুতুলের শো চলে ওই সময়টায় পাড়ার বাচ্চাদের জন্যে। বাবাই করেন। বিশ্বর কাছ থেকে শিখছেন!”
তাই শুনে আমি খুশি হয়ে বললাম, “আরে এ তো দারুণ খবর! তার মানে আমাকে আরেকবার যেতে হবে তোদের ওখানে সুধাবিন্দুবাবুর ভেন্ট্রিলোকুইজম শো দেখতে। গতবার ওঁর সঙ্গে আলাপটা ঠিক মতন করা হয়নি!”