পৃথিবীতে ঘুম নেই - অভিষেক গুহ রায়

 পৃথিবীতে ঘুম নেই
অভিষেক গুহ রায়


ভিডিও ১ঃ
জার্মানি, বাভারিয়া, বামবার্গ, রাত ১:৩০

“কনরাড, কনরাড, দোষ তোমার। নিজের মেয়েটার কথাও ভাবলে না? তোমার মরে যাওয়াই ভালো।”

কিছুক্ষণ চুপ...

“কনরাড, সাড়া দিচ্ছো না কেন? ঠিক আছে, ঘরে এস। কাল সকাল সকাল আমাকে বেরোতে হবে, মার্টিনেজদের মেয়ের বার্থডে পার্টির ফুলের ডেকরেশনের বড় অর্ডার আছে। অ্যালিসন কালকে কাজে আসবে না, মেয়েকে তোমাকেই দেখতে হবে। কনরাড, কি হোল? উত্তর দাও... কনরাড, কনরাড!”

    নিস্তেজ দেহটার পাশে মোবাইল থেকে কথাগুলো ক্রমাগত ভেসে আসছে। মাথা গুঁজে লোকটা পড়ে আছে রাস্তায়...নিঝুম একটা গলি। দেহটার তলা থেকে রক্ত গড়িয়ে যাচ্ছে, প্রাণ আছে না নেই বোঝা শক্ত......

ভিডিও ২ঃ
ভারত, ন্যাশনাল হাইওয়ে ১০, ভোর ৪ টে

    রোজ এসময়ে ঘুমটা ভেঙ্গে যায় যুগলের। অভ্যাস হয়ে গেছে, ৫ টা থেকে পেট্রল পাম্পে তার ডিউটি শুরু...... তার আগে একটু হাত পা ছাড়িয়ে নিতে লাগে। দরজাটা খুলে বের হল সে, এখনো চারদিক বেশ অন্ধকার, সূর্্যেুর আলো তেমন ফোটেনি... এসময়ে গাড়িও খুব একটা যায়না হাইওয়ে দিয়ে। কিন্তু ঐ যে ডিউটি, কি আর করা যাবে? একরাশ বিরক্তি নিয়ে চোখ কচলে চারিদিকে তাকিয়ে পেট্রল পাম্পটার দিকটায় এগোল সে, একটা গাড়ি এসে দাঁড়িয়ে আছে। বনেট খুলে একটা লোক মাথা গুঁজে কি যেন করছে, জাহিদ কই গেল? গাড়িটার ধারেকাছে কেউ নেই। গাড়িটা কি পেট্রল নিতে এসেছে নাকি বিগড়েছে?

    দ্রুতপায়ে গাড়িটার কাছাকাছি গেল যুগল। বনেটের পাশ দিয়ে উঁকি মেরে যা দেখল, গায়ের রক্ত হিম হয়ে গেল তার, লোকটার কোনও সাড়া নেই, মাথা গুঁজে পড়ে আছে ইঞ্জিনের ওপরে। কাঁপা হাতে যুগল হাত বাড়ালো......

মাথায় একটা ঘা লাগার সাথে সাথে চোখে অন্ধকার নেমে এল তার......        

ভিডিও ৩ঃ
কাজাখাস্তান, সুপ্রিম কোর্ট

    রেডি...ওয়ান, টু, থ্রি...
চিফ জাজ এরকিন ইভানোভ ঘাম মুছতে মুছতে কাজাক টিভির ক্যামেরায় বলে চললেন, “এটা অভাবনীয়, আনপ্রেসিডেন্টেড। একের পর এক কেস......আস্তানা, আলমাতি, সিমকেনট, তারাজ, ওসকেমেন ছোটবড় কোনও শহর বাদ নেই। সব জায়গায় গুচ্ছ গুচ্ছ কেস জমা পড়ছে......খুন, জখম, রাহাজানি কিচ্ছু বাদ নেই। এভাবে চললে লিগ্যাল সিস্টেম ভেঙে যাবে, এত কোর্ট কোথায় সামলানোর মত? পুলিশ কি করছে?”
..............................
..........................................
    দেওয়ালটা টপকাতে হবে, না হলে আর কিছু করার থাকবে না। শেষ চেষ্টা, কিন্তু শরীরে জোর বলে আর কিছু অবশিষ্ট নেই। পারব কি পারব না......
পাবলোর মাথা ঝিমঝিম করছে, কেমন অবশ লাগছে। অথচ এত কাছে তীরে এসে তরী ডুববে? না তাকে দেওয়ালটা টপকাতেই হবে, এসপার নয় ওসপার...
বাঁ হাতটা তুলে ওপরের পাথরটা ধরার চেষ্টা করল সে...কিন্তু......
অবসন্ন দেহটা যখন এলিয়ে পড়ছিল, পাবলোর মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল। আহ্‌! কি আরাম, ঘুম! অবশেষে গভীর ঘুম নেমে আসছে তার চোখে...শান্তির ঘুম।
..............................
..........................................

    গোপন কক্ষ, লিও, ফ্রান্স

“কি জানো গ্যাব্রিয়েল, আজকে যে চরম সমস্যা নিয়ে আমরা আলোচনা করতে চলেছি সেই সমস্যার সমাধান এখানেই এই টেবিলের ওপরেই রয়েছে।”

“মানে?”, অবাক চোখে রনের সামনে রাখা সুদৃশ্য কালচে গ্রীণগ্লাস দিয়ে তৈরী টেবিলটার দিকে তাকাল গ্যাব্রিয়েল।

এক চিলতে হাসির সাথে রন তর্জনী দিয়ে নির্দেশ করল,“টেবিলের ওপরে এটা কি দেখছ?”

গ্যাব্রিয়েল তর্জনীর দিশায় তাকিয়ে বিস্মিত কন্ঠে বলল, “গ্লোব?”

“হ্যাঁ, তবে ঠিক গ্লোব নয়, ওটা হাতে নিয়ে দেখোতো কোনও লাল ফুটকি দেওয়া দাগ দেখতে পাচ্ছো কিনা?”, রন ধীরস্বরে বলল।

“টাইম হয়ে গেছে, সবাইকে আসতে বলি স্যার?”, দরজা খুলে কেতাদুরস্ত পোষাক পরা সিকিউরিটি গার্ড জানাল, স্টার গ্রেড, দেশের সবচেয়ে উচ্চমানের সিকিউরিটি টিম।

“হ্যাঁ, আসতে বল।”, রন সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে গ্যাব্রিয়েলের দিকে তাকাল।

দরজা দিয়ে একে একে লোকে ঢুকতে শুরু করেছে। তারই মাঝখানে অস্ফুটস্বরে গ্যাব্রিয়েল বলে উঠল, “সুইজারল্যান্ড।”

রনের কানে কথাটা গেছে কি? গ্যাব্রিয়েল তাকিয়ে দেখল, একচিলতে হাসি মুখে নিয়ে রন সবাইকে বসার জন্য সম্বোধন করছে। সে হাসিতে শুধুই সৌজন্য মিশ্রিত নেই, একটু যেন তারিফের ছোঁয়াও লেগে আছে।

“সবাইকে আসার জন্য ধন্যবাদ। শুরুতেই জানিয়ে রাখি, সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় আজকের এই বৈঠক আয়োজন করা হলেও আমরা কেউই সরকারের লোক হিসেবে আজ এখানে নেই। কাজেই আলাপ আলোচনা সিদ্ধান্ত সব কিছুতেই আমাদের বক্তব্যই শেষ কথা। অবশ্য এই স্বাধীনতা না থাকলে আমরা মানে আমি অন্তত আজকে...যাকগে...

    আলোচনা শুরুর আগে সবাইকে সবার সাথে আলাপ করিয়ে দিই। প্রফেসর সুব্রত বাগচী, ফরেনসিক সায়েন্স অ্যান্ড ক্রিমিনোলজি জগতের বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব; লিও ফার্নান্ডেজ, সেন্ট্রাল পুলিশ ডিপার্টমেন্টের প্রধান; স্টানা লি, দ্য ইউরোপিয়ান সোসাইটি ফর বায়োকেমিস্ট্রি এবং মলিকিউলার বায়োলজি সংস্থার অন্যতম মাথা।”, রন একটু থামল, তারপরে গ্যাব্রিয়েলের দিকে তাকিয়ে বলল, “আর এ হচ্ছে গ্যাব্রিয়েল রে, আমার সেরা ছাত্র এই মুহুর্তে”, রন আব্রাহাম, ব্যুরো অফ ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টের প্রাক্তন প্রধান, থামলেন।

    গ্যাব্রিয়েল একদৃষ্টিতে স্টানার দিকে তাকিয়ে আছে। ইউরোপিয়ান আর চিনা রক্তের মিশ্রণ... তার মতোই, তারটা ভারতীয় আর জার্মান। রক্তের গুণে কিনা ঠিক সে জানেনা, কিন্তু একইসাথে স্থৈর্্য্য  আর অদম্য ইচ্ছাশক্তি দুটো গুণই আছে তার মধ্যে, তার প্রমাণও সে দিয়েছে কাজের মধ্যে দিয়ে...নয়তো রনের মুখ থেকে এতবড়ো প্রশংসা নাইটহুড পাওয়ারই সমান। স্টানা মেয়েটার মধ্যেও এরকম একটা কিছু ব্যাপার আছে। কতই বা বয়েস হবে? তিরিশের শেষের দিকে, কিন্তু কপালের ভাঁজ আর চোয়ালের দৃঢ়তা থেকে আন্দাজ করা যায়, এ মেয়ে সাধারণ নয়...চোখেমুখে এক অদ্ভুত সতর্কভাব, যেন সবকিছুকেই পরখ করে নিতে চায়...    

    “কিছুদিন আগেই রাষ্ট্রপুঞ্জের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যে ব্যাপারটা নিয়ে খুব শোরগোল হচ্ছিল, তা হচ্ছে পৃথিবীর জনসংখ্যা। এই বহুল জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রভাবে আজকে এই ২০৭০ সালে দাঁড়িয়ে আমরা খাদ্য, বাসস্থান নিয়ে যে বহুল সঙ্কটে পড়েছি, তার সমাধানের যে চেষ্টা গত পঞ্চাশ বছর ধরে চলে এসেছে তা যে যথেষ্ট নয়, তা আমরা সকলেই বুঝতে পেরেছি। কিন্তু এর সাথে সাথে আরেকটা যে বিশাল সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে, সে ব্যাপারে কথা বলতেই আজ আমাদের এখানে আসা।”, গ্যাব্রিয়েলের চিন্তার স্রোত ভেঙে গেল, রন তার বক্তব্য রাখতে শুরু করে দিয়েছে, “অপরাধ! চাহিদা ও জোগাড়ের এই বিশাল তফাতের ফলে যা ছিল অবশ্যম্ভাবী।”

    রন বলে চলল, “যে ভিডিওগুলো কিছুক্ষণ আগে আপনারা সবাই দেখলেন, সেগুলো স্ট্রীট ক্যামেরা, মিডিয়া ফুটেজ ইত্যাদি থেকে জোগাড় করা। আরো আছে, কিন্তু সেটা দরকারি নয়। চিন্তার জায়গাটা হচ্ছে, এই সমস্ত কটা অপরাধ হয়েছে, তা অত্যন্ত কম সময়ের ব্যবধানে, প্রায় একই দিনে। এই মুহুর্তে দাঁড়িয়ে যদি আমরা সমস্ত পৃথিবীর প্রতি একঘণ্টায় ঘটে চলা অপরাধের পরিসংখ্যান নেই, তাহলে সে সংখ্যাটা মারাত্মক, প্রায় ৬৩,৭৫৪।”

    রন থেমে সকলের মুখের দিকে তাকাল। ভাবলেশহীন, প্রস্তরকঠিন মুখ সকলের, কোনও অভিব্যক্তি নেই। অথচ বেশ বোঝা যাচ্ছে, এই নিদারুণ সমস্যাটা সম্পর্কে সকলেই কিন্তু ওয়াকিবহাল, খুব বেশী আশ্চর্য কেউ হয়নি।

    রন সকলের মনের অবস্থা আন্দাজ করে একটু মৃদু হাসল, “আমরা গত আট মাস ধরে এই অপরাধগুলোর স্ট্যাটিস্টিক্যাল সার্ভে করে দেখেছি, গুরুত্বের দিক থেকে এই সমস্ত অপরাধের প্রায় ৮৭% হচ্ছে অত্যন্ত সাধারণ মাপের অপরাধ।”

“যাক্‌! সেটা একদিক দিয়ে তাহলে কিছুটা বাঁচোয়া।”, সুব্রত প্রথমবার মুখ খুললেন।
রন ভ্রু কুঁচকে মাথা নাড়ল, “উঁহু, অত সহজ হলে আমাদের আজ এখানে দেখা করতে হত না। আরেকটা অদ্ভুত তথ্য ধরা পড়েছে, যেটা অত্যন্ত চিন্তার বিষয়।”

    সকলে একদৃষ্টিতে রনের দিকে তাকিয়ে আছে, খালি স্টান মাথা নীচু করে একটা কাগজে আঁকিবুঁকি কাটছে।

“এই অপরাধীদের ৯০% শতাংশের উপরে কোনও ক্রিমিনাল রেকর্ড নেই...অর্থাৎ...”, রন শেষ করতে পারল না, তার আগেই লিও হাত দেখিয়ে তাকে থামিয়ে দিল।

“...অর্থাৎ কিনা এরা সব নতুন অপরাধী। ব্যাপারটা সত্যিই গুরুতর, কারণ গত এক বছরে আমাদের ক্রিমিনাল ডাটাবেস প্রায় চারগুণ হয়ে গেছে, আর আমি বলছি শুধু ফ্রান্সের কথা।”, লিও এক নিঃশ্বাসে বলে থেমে রনের দিকে তাকাল।

    রন সম্মতিসূচক মাথা নেড়ে বলে চলল, “এভাবে চলতে থাকলে, কোনও শহরে আর কোনও জেলখানা থাকবে না, শহরটাই জেল হয়ে যাবে। এ এক অদ্ভুত অরাজকতা চলছে, এদের ভয়ডর, মায়াদয়া কিচ্ছু নেই। এরা শাস্তির তোয়াক্কা করছে না, নিয়ম কানুন আদালত কিচ্ছু মানছে না। এছাড়া যে ব্যাপারটা হচ্ছে সবচেয়ে মারাত্মক, আমাদের দৃঢ় সন্দেহ, এরা সকলেই জানে যে ধরণের অপরাধ এরা করছে, তাতে ধরা পড়লেও শাস্তির পরিমাণ নগণ্য। তাই কোনও বড় অপরাধ ঘটছে না। আমি বিন্দুমাত্র অবাক হব না, যদি ভবিষ্যতে জানা যায়, কোনও সংঘটিত দল এইভাবে প্ল্যান করে জঙ্গি ট্রেনিং দিয়ে এই ঘটনাগুলো লোকেদের মধ্যে ছড়াচ্ছে।”

“আমাদের কর্তব্য কি?”, স্টানা জিজ্ঞেস করল।

    রন সকলের মুখের দিকে বেশ কয়েক সেকেন্ড তাকাল, তারপর কিছুটা আস্তে আস্তে বলল, “ভয়! আমাদের এদের ভয় পাওয়াতে হবে... এমনভাবে যাতে আর অপরাধ করতে সাহস না পায়। এটাই এখন একমাত্র শেষ উপায়, আর কিছু করার নেই। নয়তো সব শেষ হয়ে যাবে।”

“কিন্তু কিভাবে? সাধারণ পুলিশী শাস্তিব্যবস্থার যে এরা তোয়াক্কা করছে না সেতো বোঝাই যাচ্ছে। আর কিভাবে এদের শায়েস্তা করা সম্ভব? একমাত্র উপায় রক্তপাত, কিন্তু তাতে রায়ট লেগে যাবে। হিংসা দিয়ে এই অপরাধের জাল আটকানো অসম্ভব।”, সুব্রত চিন্তিত কণ্ঠে মন্তব্য করলেন।

“উপায় আছে, নিশ্চয়ই আছে। আর রন তা বলবে বলেই আমাদের এখানে ডেকে পাঠিয়েছে। নইলে এই আলোচনায় অন্তত আমার জায়গা হওয়ার কথা নয়।”, সবাই ঘুরে তাকাল স্টানার দিকে, সে তীক্ষ্ণ অথচ কৌতুকপূর্ণদৃষ্টিতে রনের দিকে তাকিয়ে আছে, “খালি একটাই প্রশ্ন আমার মনে খেলা করে চলেছে, সে সমাধানের মূল্য কি দিতে হবে?”
গ্যাব্রিয়েল মনে মনে হাসল, তার লোক চিনতে ভুল হয়নি।

    রন মৃদু হেসে শুরু করল, “যে সমস্যাটা নিয়ে আমরা আলোচনা করে চলেছি, তা মোটামুটি বিশ্বব্যাপী হয়ে থাকলেও কেবলমাত্র একটা দেশে অপরাধের খতিয়ান গত কয়েক দশক জুড়ে শুধু অবিশ্বাস্য কমই নয়, প্রায় নেই বললেই চলে। আমরা রাষ্ট্রপুঞ্জ, রেডক্রস, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন সবদিক থেকে এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিকভাবে যতরকম ভাবে চেষ্টা চালানো যায়, সবভাবে তাদের কাছ থেকে এ ব্যাপারে পরামর্শের জন্য সাহায্য চেয়েছি...কিন্তু কোনও অদ্ভুত কারণে তারা কোনওরকমভাবেই কোনও সাহায্য করছে না।”

“আর সে কারণেই মনে করা হচ্ছে, সে দেশ অপরাধীদের বিরুদ্ধে নাজিদের মতো কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প বা কোনও ভয়াবহ গুপ্ত কার্যকলাপ চালাচ্ছে যেটা কিনা প্রকাশ্যে আনা সম্ভব নয়। সেটাই খুঁজে বের করতে হবে......বুঝেছি, আমরা তার মানে কোনও আলোচনা করতে আসিনি, কোনও গোপন মিশনের টাস্ক ফোর্স হয়ে কাজ করতে চলেছি।”, স্টানা প্রায় রনের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে শেষ করল।

ব্রিলিয়ান্ট, গ্যাব্রিয়েল এতটাও আশা করেনি।

    গ্লোবের লাল ফুটকিটা যে আসলে আজকের অপরাধসঙ্কুল পৃথিবীর প্রাণসঞ্চারের রক্তবিন্দু হিসেবে চিহ্নিত এতক্ষণে সে তার মর্ম বুঝতে পারল।

    রন কফির কাপ হাতে নিয়ে উঠে জানলার দিকে এগিয়ে গেল, এখান থেকে লিও শহরের প্রায় দেড়শ বছরের পুরোনো বিখ্যাত জার্ডিন চিড়িয়াখানার সুন্দর একটা ভিউ পাওয়া যায়; রন কিছুটা অন্যমনস্কস্বরে সেদিকে তাকিয়ে মৃদুভাবে বলতে লাগল, “পরিবর্তনের একটা মূল্য আছে, সেটা সবাইকেই দিতে হয়। বৃহত্তর স্বার্থের জন্য সেই ক্ষুদ্র বলিদান তো যুগ যুগ ধরে চলে আসছে... এব্যাপারে আমার নতুন করে কিছু বলার নেই। আমরা তিনজন অত্যন্ত ভালো আন্ডারকভার এজেন্টকে হারিয়েছি, তাই সরকারী তরফ থেকে সেরকম উৎসাহ আর নেই। এই মিশনটা অনেকটাই আমার নিজের উদ্যোগে...ফিল্ডে কারো জীবনের গ্যারান্টি আমি দিতে পারবো না। তবে সাহায্য পূর্ণমাত্রায় থাকবে। আমার একটা ক্ষীণ আন্দাজ আছে, কি ঘটছে সে ব্যাপারে... কিন্তু সেটা প্রমাণ করা এবং সে প্রমাণ দিয়ে আদেও এ সমস্যার সমাধান হবে কিনা তা ভবিষ্যৎই বলবে। কাউকে জোর করার কিছু নেই, যার ইচ্ছে সে থাকবে। টেবিলে প্রত্যেকের সামনে আজকের ফ্লাইটের রিটার্ন টিকিট রাখা আছে, যার ফেরার ইচ্ছে উঠিয়ে নাও।”, রন আঙুল দিয়ে জানলা দিয়ে নির্দেশ করল, “তবে একটা কথা, সমস্যার সমাধান না হলে আর কিছুদিনের মধ্যে হয়তো আমাদেরকেও ঐ ঐখানে একটা করে খাঁচা বানিয়ে থাকতে হবে আক্রমণের হাত থেকে বাঁচতে; আর...আর নয়তো জোম্বি হয়ে দলে ভিড়তে হবে।”

    গোটা ঘরে সূচীবিদ্ধ নিস্তব্ধতা।

    প্রায় মিনিট এক বাদে গ্যাব্রিয়েল প্রথমবারের মতো মুখ খুলল, “আমাদের সুইজারল্যান্ড কবে যেতে হবে?”
রন হাসল, “তার আগে একমাস তোমাদের একটু তালিম নিতে হবে, সাপলুডো খেলতে নামছো, সাপের হাত থেকে বাঁচার উপায় না শিখলে চলবে?”
   
সুইজারল্যান্ড, কোনও এক স্থানে, ১১৬ দিন পরে

    মাথায় হাত দিয়ে গ্যাব্রিয়েল বসে আছে। আজকের দিনটাও বৃথা...কোনো খবর আসবে বলে মনে হয়না, প্রায় বিকেল হতে চলল। কাজ যে কিছু এগোয়নি তা নয় কিন্তু কাজের কাজ প্রায় কিছুই এগোয়নি। গুপ্তধন তার জায়গাতেই সুরক্ষিত আছে, তারা খালি সুড়ঙ্গের কিছুটা হদিস পেয়েছে। কিন্তু এ যা দুর্ভেদ্য মায়াজাল, তা ভেদ করে আগে এগোবার যে কি উপায় তা বোধহয় ইন্টেলিজেন্সের সেরা মাথাও ভেদ করতে পারবে না। খালি একটা... একটা খুব ক্ষীণ সম্ভাবনার উপর ভিত্তি করে অনন্ত প্রতীক্ষায় থাকতে হচ্ছে গ্যাব্রিয়েলকে। যদি একবার, শুধু একবার মাত্র......

    বিকেলের মৃদু আলো নেমে এসেছে, সুইজারল্যান্ডের প্রাকৃতিক দৃশ্য দিনের যেকোনো সময়ে চোখ জুড়িয়ে দেওয়ার মতো অভাবনীয়। সে নাম ধরে স্টানাকে ডাকল, স্টানা  খুব মন দিয়ে একটা জার্নাল পড়ছিল। গ্যাব্রিয়েলের ডাক শুনে মুখ তুলে তাকাল, তারপর আড়মোড়া ভেঙে পায়ে স্নিকার গলিয়ে নিল। তারা যে জায়গাটায় আপাতত আছে, সে জায়গাটা বেশ গ্রাম্য। এই নিয়ে প্রায় ১১ বার থাকার জায়গা বদলাতে হয়েছে, গ্যাব্রিয়েলকে একা, স্টানা এসেছে মাত্র দিন দুয়েক। দুজনে কাঁচা রাস্তা দিয়ে হাঁটতে লাগল।

“তাহলে রনের ধারণাই সত্যি?”, স্টানা চিন্তিতস্বরে জিজ্ঞেস করল।

    গ্যাব্রিয়েল কিছুটা সময় কোনও উত্তর দিল না, চিন্তামগ্ন হয়ে হাঁটতে লাগল। তারপরে ধীরে ধীরে মুখ খুলল, “এখনো অবধি যে অনেকগুলো দেশ চেষ্টা করেছে, একা বা যৌথভাবে, জ্ঞানত তাদের কেউ সফল হয়নি। একমাত্র পাবলো, ফ্রান্সের শেষ এজেন্ট, সে একমাত্র একটা সূত্র ধরতে পেরেছিল। কোনওভাবে সে আন্দাজ করেছিল, পুরো ব্যাপারটার মধ্যে জেনেভা হাসপাতালের কিছু একটা গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগ আছে। ব্যাস এটুকুই, এমব্যাসিতে খবরটা পাঠানোর পরে পাবলোকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। শুধু এই তথ্যের উপরে ভিত্তি করেই, এখানে আসা ইস্তক আমি নজরদারি চালিয়েছি। এ দেশের রাষ্ট্রপতি কে জানো?”

    স্টানা মাথা নাড়ল, “জুলিয়ান ফারনি; খুব স্বার্থপর লোক শুনেছি।”

    গ্যাব্রিয়েল সায় দিল, “হ্যাঁ, খুব ডিস্টার্বড অতীত। পারিবারিক আসল পদবী, ফায়েনা। রিফিউজি সিরিয়ান ইহুদী বংশ; পূর্বপুরুষ অনেক অত্যাচার সহ্য করে এদেশে এসে আস্তানা নিয়েছিল। জুলিয়ান মেধাবী ছাত্র ছিল; খুবই গরীব পরিবার থেকে এই জায়গায় পৌঁছায়। কিন্তু এর মধ্যে একটা পারিবারিক ইন্টারেস্টিং ঘটনা আছে। জুলিয়ানের এক কাকা কোনও এক ব্যাবসায়ীর কাছ থেকে ধার করেছিল। সময়ে শোধ দিতে পারেনি, প্রায় সপ্তাহখানেক বাদে একটা গুদামে লাস পাওয়া যায়। কাকাকে খুব ভালবাসত সে, পুরো পরিবারটার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। রাষ্ট্রপতির শপথেও বলেছিল, দেশ থেকে অপরাধ নির্মূল করবে। কাজেই......”

    আচম্বিতে বাঁক নিয়েই স্টানার মুখ চেপে ধরে গ্যাব্রিয়েল তাকে নিয়ে সরু হয়ে উঠতে থাকা রাস্তাটার পাশের দেওয়ালের গায়ে সেঁটে গেল। স্টানা হতভম্ব হয়ে তাকাল তার দিকে, গ্যাব্রিয়েল ধীরে ধীরে হাত সরিয়ে তাকে চুপ করে থাকতে ইশারা করল। স্টানা ব্যাপারটা বুঝে দেওয়াল ঘেসে পেছনের দিকে কিছুটা সরে গিয়ে গ্যাব্রিয়েলকে জায়গা করে দিল।

    লোকটা বাঁকটা নিতেই সপাটে গ্যাব্রিয়েলের লাথি খেয়ে মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়ল। মিলিটারি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গ্যাব্রিয়েল এক মুহূর্তে তাকে হাত মুচড়ে চিত করে ফেলল... কিন্তু মুখের দিকে তাকিয়েই সাথে সাথে তার দৃঢ় হাতের চাপ আলগা করে দিল, “এলিনা, তুমি? ইশ ছিছিছি! জোর লেগেছে?”

    এলিনা হাত দিয়ে ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা রক্ত মুছতে মুছতে ম্লান হাসল, “তা লেগেছে, আমার অতো জোর নেই।”

    গ্যাব্রিয়েলের লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছিল, অথচ কেউ যে তাদের পিছু নিয়েছিল সেটা বোঝামাত্র তার স্নায়ু সচেতন হয়ে গিয়েছিল।

    স্টানা এগিয়ে এসে হাত বাড়াল, কিন্তু এলিনা হাত নেড়ে না করল...সে একটু দম নিতে চায়, ব্যাথাটা বড্ড লেগেছে। গ্যাব্রিয়েল ও স্টান তার পাশে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। 
যন্ত্রণার মধ্যেও এলিনা গ্যাব্রিয়েলের দিকে হেসে তাকাল। গ্যাব্রিয়েলের হৃৎকম্পন শুরু হয়ে গেল... তাহলে তাহলে কি?

    এলিনা একটু দম নিয়ে মুখ খুলল, “উপায় আছে দেখা করবার... কিন্তু খুব এক চিলতে একটা ফাঁকা করিডর। একটু অসাবধান হলেই সব শেষ। তার পরেও বাকী থাকবে, কথা বের করা...পারবে করতে?”

“পারতেই হবে, এছাড়া আর কোনও উপায় নেই।”, গ্যাব্রিয়েল দাঁতে দাঁত চিপে বলল।

“কার সাথে দেখা?”, স্টানা কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না।

“ডঃ বেৎজালেল, এ রহস্যের একমাত্র চাবি শুধু যার কাছে আছে।”, গ্যাব্রিয়েলের স্বরে লুকিয়ে থাকা উত্তেজনা চাপা থাকল না।

নভ্যু সিমটিয়েরে ডে লা গ্যালটিয়েরে কবরস্থান, লিও, ফ্রান্স

    অনেকটা জায়গা জুড়ে সবুজ ঘাস লনের মতো বিস্তৃত হয়ে আছে। চারিদিকে অসংখ্য স্মৃতিসৌধ যেন ইহকাল ও পরকালের মিলনস্থলের বাগিচাক্ষেত্রের রক্ষী হয়ে অসীম শান্তিরক্ষায় মগ্ন।

    রন স্বপ্নালু চোখে একটা স্মৃতিসৌধের উপরে চুপচাপ বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। সুব্রত, স্টানা, লিও সবাই তাকে গোল হয়ে ঘিরে বসে আছে, সবাই চুপ, শুধু হাওয়ার সো সো শব্দ শোনা যাচ্ছে......আর রন যেন তাদের অস্তিত্ব সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসীন।

“স্যার, এটা কানে লাগিয়ে নিন।”, স্মিত কন্ঠস্বরটা কানে আসতে রন ঘোর কেটে দেখল এক স্টার গ্রেডের এক রক্ষী এসে পাশে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে।

সে প্রশ্নপূর্ণ চোখে তাকাতে মেয়েটা মৃদুস্বরে বলল, “প্রেসিডেন্ট, স্যার।”

রন ধীরে ধীরে গ্যাজেটটা কানে লাগাল, “ইয়েস স্যার।”

    “রন, আমি দুঃখিত। তোমার এত ভালো একজন সহকারীকে হারানোর ক্ষতির আমি সমব্যথী। আমি ব্যক্তিগতভাবে আসার ইচ্ছা থাকলেও তা সম্ভব নয়, কারণ তুমি জানো। যাই হোক আমি লাইনে আছি, তুমি শুরু করতে পারো।”, একটা খুব পরিচিত কন্ঠে শব্দগুলো ভেসে এলো।

    রন কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থাকল, একবার সামনের ম্লান অথচ উৎসুক মুখগুলোর দিকে দৃষ্টি বুলিয়ে নিল। তারপর শান্তস্বরে বলতে শুরু করল, “পাবলো যেখানে শেষ করেছিল, সেখান থেকে শুরু করাটা বেশ কঠিনই ছিল। কারণ, সঠিক সূত্র বের করে তা দিয়ে এগোনোটাই ছিল বিশাল একটা সমস্যা। সাহায্যের তো কোনও আশাই ছিল না। আমরা কাজটা শুরু করলাম সম্পূর্ণ অন্যভাবে। আরাউ, যোফিনযেন, সিওন, লেনজবার্গ এভাবে প্রায় সাতটা জায়গার সবচেয়ে বড় জেলখানাগুলোকে টার্গেট করা হল। এরপরের কাজটা ছিল সবচেয়ে কঠিন; স্থানীয় ভবঘুরে, ড্রাগ অ্যাডিক্ট, অত্যন্ত গরীব...মানে সোজা ভাষায় যাদের পয়সার খুব অভাব সেরকম শ্রেণীর লোকেদেরকে খুঁজে বের করে তাদের দিয়ে এই নজরদারির কাজ চালানো। দিনের পর দিন লিও আর গ্যাব্রিয়েল কি অসাধারণ ধৈর্য্য ও সতর্কতার সাথে বিভিন্ন জায়গায় এই দলগুলো তৈরী করেছিল তা এক অবিশ্বাস্য কাহিনী। অবশ্য সর্বত্র হয়নি, তবে এভাবে পাঁচটা জেলের ওপরে নজরদারি রাখার বন্দোবস্ত শেষ অব্ধি করা গেছিল। উদ্দেশ্য খুব সহজ, পাবলোর দেওয়া তথ্যের যৌক্তিকতা বিচার করা আর তার পরের অ্যাকশন প্ল্যান বানানো।”, রন চুপ করল।

    কয়েক সেকেন্ড পরে লিও মুখ খুলল, “আমাদের কিছু করার ছিল না। সরকারী স্তরে কানাঘুষোও যদি এ খবর পৌঁছত, মিশনের ওখানেই ইতি টানতে হোত। তবে শেষ পর্যন্ত আমাদের পরিশ্রম সফল হয়েছিল।”, লিও একটু থামল, “পাবলোর কথা অক্ষরে অক্ষরে সত্যি ছিল। সবকটা জেল থেকে বিচারে দোষী সাব্যস্ত হওয়া অপরাধীদের জেনেভা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হোত।”

“আর তারপর? তাহলে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের ব্যাপারটা সত্যি?”, সুব্রত জিজ্ঞাসা করলেন।

    রন আর লিও চোখাচুখি করে মৃদু হাসল। রন রহস্যপূর্ণস্বরে উত্তর দিল, “না, সমস্ত অপরাধীদেরকে কিছুদিন পরে ছেড়ে দেওয়া হোত।”    

    স্টানা চুপ করে রইল, বাকীটা সে মোটামুটি আন্দাজ করতে পারছে। সুব্রতর না জানাটা অস্বাভাবিক নয়; রন অসম্ভব গোপনীয়তা রক্ষা করেছে এই পুরো অপারেশনের ব্যাপারটায়, সকলকে ঠিক ততটাই জানানো হয়েছে, যে ব্যাপারে তার সাহায্য লাগে... এমনকি গ্যাব্রিয়েলও তাকে সুইস মাটিতে থাকাকালীন কিছুই প্রায় বলেনি।

    রন বলে চলল, “এবার শুরু হোল, মিশনের দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ। ছাড়া পাওয়া সমস্ত অপরাধীদের চিহ্নিত করে কৌশলে তাদের ফিঙ্গারপ্রিন্ট, রক্তের স্যাম্পেল ইত্যাদি যোগাড় করা শুরু হোল। তারপর তা নিয়মিতভাবে পাঠানো হতে লাগল, ডঃ সুব্রতর কাছে। আর তার থেকে বেরিয়ে এল এক চমকপ্রদ তথ্য।”

    সুব্রত গলা খাকড়ানি দিয়ে শুরু করলেন, “হ্যাঁ, শুরুতে ধরতে পারিনি, তবে অপরাধীদের বায়োডাটা আমার সাথে যা শেয়ার করা হয়েছিল, স্যাম্পেলগুলো পরীক্ষার করার পরে তার সাথে গরমিলটা ধরা পড়ল। প্রায় প্রত্যেক ক্ষেত্রেই তাদের বয়েস অন্তত রেকর্ডের থেকে প্রায় বছর ১০ থেকে ১৫ র বেশী বৈশিষ্ঠ্য বহন করছে। অর্থাৎ কিনা কোনও অজ্ঞাতকারণে তাদের ভুল বয়েস রেকর্ড করা হয়েছে, অথবা মেডিকাল সায়েন্সের অজানা এমন কোনও এক্সপেরিমেন্ট চালানো হয়েছে, যার ধকলে দেহের সর্বোপরি ক্ষমতা চিরকালের মতো হ্রাস পেয়ে অপেক্ষাকৃত বয়স্ক ব্যক্তিতে তারা পরিণত হয়েছে।”

    নিরিবিলি কবরস্থানের ওপর দিয়ে শুধু শো শো বাতাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে। জগতের এককোণে সময় যেন পরপারে এসে ক্ষণিকের জন্য থমকে দাঁড়িয়েছে। নিষ্প্রাণদের বিচরণভূমিতে খালি কয়েকটা জীবন্ত প্রাণ শুধু এ শতাব্দীর হয়তো সর্বাপেক্ষা গূঢ় রহস্যসন্ধানে মগ্ন।        

    “আমি নিঃসন্দেহ হলাম আমার ধারণা সম্পর্কে, শুধু একটাই মিসিং লিঙ্ক বাকী ছিল... কি এক্সপেরিমেন্ট চালানো হচ্ছে অপরাধীদের ওপরে যাতে তারা বদলে যাচ্ছে এবং আশ্চর্যভাবে আর কোনও অপরাধ ঘটাচ্ছে না?”, রনের কণ্ঠস্বরে মঞ্চের ম্যাজিশিয়ানের রহস্য, “এলিনা! জেনিভা হাসপাতালের অতি সামান্য এই নার্সটির আশাতীতভাবে সাহায্য না পেলে হয়তো আজকেও আমাদের শূন্যহাতে বসে থাকতে হোত। এলিনার সাহায্যেই গ্যাব্রিয়েল জানতে পারে জেনিভা হাসপাতালের নীচে একটা আন্ডারগ্রাউন্ড ইউনিট আছে...যেখানে হাসপাতালের সাধারণ কর্মচারীদের ঢোকা নিষেধ। আর সেই ইউনিটের প্রধান হচ্ছেন, ডঃ বেৎজালেল। ব্যাস, আমরা মিশনের সবচেয়ে কঠিন তৃতীয় পর্যায়ের জন্য প্ল্যান বানানো শুরু করলাম, ডঃ বেৎজালেলের সাথে সাক্ষাত এবং সাক্ষাতকারের।”  

    “একটা ব্যাপার আমার মাথায় ঢুকছে না, এলিনা কেন সাহায্য করল? তার কি স্বার্থ ছিল এতে?”, ডঃ সুব্রত প্রশ্ন করলেন।

    লিও তির্যক হাসল, “মানুষের আদিমতম রিপুর কারণে, জিঘাংসা......যা যুগ যুগ ধরে ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়েছে। সুইস প্রেসিডেন্ট জুলিয়ানের কাকা যে মহাজনের হাতে মারা গিয়েছিল, রাজনীতিতে আসার পর ক্ষমতার প্রয়োগে সেই পরিবারকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিয়েছিল সে। এলিনা সেই দুর্ভাগা পরিবারের মেয়ে, আমাদের ইন্টেলিজেন্স এই তথ্যটা জানতে পেরে গ্যাব্রিয়েলকে জানায়। সেই অস্ত্র ব্যবহার করে বাকী এলিনাকে দলে টানা গ্যাব্রিয়েলের মতো প্রশিক্ষিত এজেন্টের কাছে জলভাত ছিল।”

    “শুধু এলিনা নয়, তার মতই আরেক হতভাগ্য তরুণীর সাহায্য না পেলে হয়তো ডঃ বেৎজালেলের সাথে কথাই বলা সম্ভব হোত না।”, রন লিওর কথার খেই ধরে শুরু করল, “স্বাভাবিকভাবেই ডঃ বেৎজালেলের চারিপাশে সিকিউরিটির বিশাল জাল ছড়ানো ছিল। এসবক্ষেত্রে, একটা সূঁচ ঢোকার মত ছিদ্র খুঁজে পেলে তাই দিয়েই অসাধ্যসাধন করতে হয়। শুরু হোল, আবার এক পরীক্ষা...তার দৈনন্দিন জীবনযাত্রার উপর নজর রাখা। দিনের পর দিন বেরিয়ে গেল, কিন্তু না একটাও ফাঁক পাওয়া গেল না, দুর্ভেদ্য প্রতিরক্ষা......একটা মাছি গলারও জায়গা নেই। হাল প্রায় ছেড়ে দেওয়ার মতো অবস্থা, তখন এলিনার সাহায্যে জানা গেল, প্রতি দুমাসে একবার এক নির্দিষ্ট তারিখে বেৎজালেল তার একমাত্র মেয়ে আয়েলেতের সাথে ঘণ্টা একের মতো দেখা করতে যান, আর অদ্ভুতভাবে সেসময়টুকুর জন্য কোনও সিকিউরিটি সাথে থাকে না।”

    “কিন্তু এতে তো সফট টার্গেট হওয়ার জায়গা থাকে তো।”, সুব্রত অবাকস্বরে বললেন।

    “হ্যাঁ, তা থাকে। কিন্তু বেৎজালেল তার মেয়ের সাথে দেখা করতে যেত কবরস্থানে। আয়েলেত বছর পাঁচেক আগে গাড়ি অ্যাক্সিডেন্টে মারা যায়। কবরস্থানের বাইরে সিকিউরিটি থাকে কিন্তু ভেতরে ডঃ এর সাথে নয়। এটাই ছিল আমাদের জন্য এক এবং একমাত্র সুযোগ। তবে ব্যাপারটা অতোটাও সহজ ছিল না, ডঃ আসার আগে পুরো কবরস্থান জুড়ে সিকিউরিটি চেকিং হোত। কাজেই আমাদের খুব সাবধানে পা ফেলতে হোত। সামান্য একটু ভুল এতদিনের সমস্ত পরিশ্রমে জল ঢেলে দিত। যাই হোক, সেইমতো প্ল্যান করে শেষপর্যন্ত গ্যাব্রিয়েল বেৎজালেলের দেখা পেল।”, রন থামল।
“জানতে পারি কি, গ্যাব্রিয়েল কি করে সিকিউরিটিকে ফাঁকি দিল?”, সুব্রত উৎসুক কন্ঠে জিজ্ঞাসা করলেন; দীর্ঘদিন এই পেশার কারণে অনেক আশ্চর্য ব্যাপার জানতে পেরেছেন, কিন্তু প্রত্যেকবারই যেন আরো নতুন চমক সামনে এসে হাজির হয়।
রন লিওর দিকে তাকিয়ে হাসল, লিও তাই দেখে হেসে শুরু করল, “আইডিয়াটা আমারই ছিল। কবরস্থানে গ্যাব্রিয়েলের জন্য একটা গোপন কৃত্রিম কবর খুঁড়তে হয়েছিল। বেতজালেল আসার আগের দিন রাত থেকে তাকে সেখানে থাকতে হয়েছে। তবে অক্সিজেন, খাবারের ব্যবস্থা ছিল। ব্যাপারটা শুনতে বেশ কষ্টকর, তবে গ্যাব্রিয়েলের মতো দক্ষ ফিল্ড এজেন্টদের তো এসব তালিম থাকেই।”

    “এত বাধাবিপত্তি পেরিয়ে শেষপর্যন্ত ডঃ এর দেখা পাওয়া গেল। কিন্তু তাকে দিয়ে কথা বলানোর জন্য আমাদের হাতে একটাই অস্ত্র ছিল, আবেগ। দু তিনটে কয়েক সেকেন্ডের ভিডিওক্লিপ, বর্তমান পরিস্থিতির পরিসংখ্যান আর মুখের কথার জাদু এই তিনটে কাজে লাগিয়ে গ্যাব্রিয়েলকে ঐ ঘন্টাখানেকেরও কম অমূল্য সময়ে এই অসাধ্য সাধন করতে হত। বলা বাহুল্য, সে সেটা পেরেছিল আর যে অত্যাশ্চার্য তথ্য জানতে পেরেছিল তা আজকের দিনে দাঁড়িয়েও অবিশ্বাস্য। স্টানা, বাকীটা কি তুমি বলবে?”, রন দম নিতে থামল।

    স্টানা জায়গা চেড়ে উঠে নরম ঘাসে পায়চারী করতে লাগল, “মানুষের মস্তিষ্ক অতি অদ্ভুত একটা জায়গা। সেখানে যে কি খেলা চলে তা ধরার ক্ষমতা বোধহয় কোনওদিনও মনুষ্যজাতির হবে না। মানসিক চিকিৎসার জায়গাটাও তাই অনেকটাই খুব পরিসংখ্যানভিত্তিক। দীর্ঘদিন ধরে বহু সমস্যাকে বিশ্লেষণ করে কেস স্টাডি নির্ভর চিকিৎসা করা হয়। একটা উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা একটু পরিষ্কার হবে, আমরা তাকেই পাগল বলি যারা আমাদের মতো ব্যবহার করেনা, ঠিক? কিন্তু এভাবেও তো দেখা যেতে পারে, একজন পাগলের ব্যবহার সমাজের চাপিয়ে দেওয়া কিছু পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের ঠিক না মনে হলেও তার দিক থেকে হয়তো ঠিক। কাজেই তার দুনিয়ায় সে ঠিক, যেটা আমাদের দুনিয়ায় বেঠিক, তাই আমরা যেমন তাকে পাগল মনে করছি, সেও হয়তো আমাদেরকেও সেটাই ভাবছে। পুরোটাই আপেক্ষিক একটা ব্যাপার। আর মনের ঠিক সেই আপেক্ষিকতার রহস্যকেই ডঃ বেতজালেল সাফল্যের সঙ্গে কিছুটা ভেদ করতে পেরেছেন। একজন মানুষের মনে তার গত এক বছরের স্মৃতি যেটুকু টাটকা থাকে তাকে দীর্ঘসময়ের জন্য বদলে দেওয়ার পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন। আর সেই উপায়কে কাজে লাগিয়ে জুলিয়ান অপরাধদমন করে চলেছে।”
    
    সবাই স্থাণুবৎ অচঞ্চলভাবে মুগ্ধ হয়ে এই অবিশ্বাস্য বক্তব্য শুনে চলেছে, স্টান থামাতে একটা পাখির আওয়াজও ভেসে এলনা।

    স্টানা বলে চলল, “ব্যাপারটা খুবই সহজ, চিকিৎসার মাধ্যমে অপরাধীদের মাথায় ভিক্টিমের স্মৃতি ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। যাতে অপরাধীর মনে হয় তার সাথেই অন্যায়টা হয়েছে......এটাই হচ্ছে তার শাস্তি! তারপরে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। স্বাভাবিকভাবেই, সে ব্যক্তির পক্ষে দ্বিতীয়বার অপরাধ করা সম্ভব নয়।”

    “কিন্তু বাস্তবে তা কি করে সম্ভব? সে যদি নিজেকে ভিক্টিম মনে করে, সে কি চুপ করে বসে থাকবে? থানাপুলিশ করবে তো।”, লিও থাকতে পারল না।

    “প্রমাণ কই? কে বিশ্বাস করবে? উলটে সবাই তাকে পাগল মনে করবে। এখানেই জুলিয়ানের চিন্তার সাফল্য।”, স্টানা যোগ করল, “তবে এ পদ্ধতি এখনো পূর্ণমাত্রায় সফল নয়। পার্শবপ্রতিক্রিয়া ভয়ানক, তার কিছুটা প্রমাণ তো আমরা দেখেইছি। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি নাকচ হয়ে যাবে, সেটা বুঝেই জুলিয়ান এত গোপনীয়তা রক্ষা করছে।”

“অবিশ্বাস্য! কিন্তু গ্যাব্রিয়েল?”

    রন সাথে সাথে এ প্রশ্নের কোনও উত্তর দিল না, গম্ভীরমুখে সবুজ ঘাসের দিকে তাকিয়ে থেকে ধীরে ধীরে মুখ খুলল, “আরো প্রমাণের দরকার ছিল, যে সমস্ত রাসায়নিক অপরাধীদের উপর প্রয়োগ করা হয়, তার স্যাম্পেল যোগাড়ের চেষ্টা করছিল। কিছুটা পাঠিয়েছেও, স্টানা তার বিশ্লেষণও শুরু করেছে। কিন্তু হঠাৎ করে এক্সপোজ হয়ে যায়......তারপর...তারপর সেন্ট গ্যালেনে এক খালের ধারে......”

    সকলে মাথা নীচু করে বসে আছে। রন আকাশের দিকে তাকিয়ে কান থেকে গ্যাজেটটা খুলে ফেলল, তার দায়িত্ব শেষ হয়ে গেছে......এখন সারা জীবন তাকে এর বোঝা বয়ে নিয়ে যেতে হবে।
 
এলিসে প্যালেস, রাষ্ট্রপতি ভবন, ফ্রান্স

    “তুমি জানো এদিয়ে আর কিছু এগোনো যাবেনা। সমাজের কাছে ভুল বার্তা যাবে।”, ফরাসীতে ‘ক্লোজড’ লেখা ফাইলটাকে ঝকঝকে প্ল্যাটিনামখচিত সুদৃশ্য পেনস্ট্যান্ডটার পাশে নামিয়ে রাখতে রাখতে রাষ্ট্রপতি বললেন।

    “ইয়েস স্যার”, রন সংক্ষেপে সারল।

    রাষ্ট্রপতি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন,“আফশোষ কি জানো? এতগুলো দামী প্রাণ, মূল্যবান সময়, অর্থ সব বেকার গেল। সমস্যা যে তিমিরে সে তিমিরেই রয়ে গেল।”
    রন এবার নড়েচড়ে বসল, “তা কেন স্যার? আমরা একটা বিশাল শিক্ষা তো লাভ করেইছি, অপরাধীরা নিজেরা অপরাধের শিকার হলে মানসিকভাবে তাদের মেরুদন্ড ভেঙে যায়। এই গুপ্তচাবি দিয়েই তো এ বিশাল সমস্যার মূলে সজোরে আঘাত করা যায়।”

    “কিভাবে?”, রাষ্ট্রপতি বিস্মিত চোখে রনের দিকে তাকালেন।

    রন তার ট্রেডমার্ক একচিলতে রহস্যময় হাসি মুখে এনে চেয়ার ছেড়ে উঠে মিটিং কক্ষের দরজার দিকে পা বাড়াল, “শেষের সেদিন মধুর। একটা টাস্ক ফোর্স তৈরী করা হচ্ছে......সেটার আর ক্যাম্পেনের বাজেটটা ফিনান্স ডিপার্টমেন্টকে দিয়ে দয়া করে পাশ করিয়ে দেবেন। কিছু ডামি ঘটনা, কিছু ডামি অভিনেতা, কিছুটা অ্যানাস্থেশিয়া আর হ্যালুসিনেশন এবং বাকীটা মিডিয়া। ডিটেইলড প্ল্যানটা ক্লাসিফায়েডভাবে এ সপ্তাহের শেষে পাঠিয়ে দেব। চিন্তা করবেন না, সমস্যার পূর্ণ সমাধান হবে কিনা এ গ্যারান্টি না দিলেও অপরাধ কমতে বাধ্য। শেক্সপিয়ারের সেই বিখ্যাত কবিতাটার প্রথম লাইনটা আছে না, অল দ্য ওয়ার্ল্ড’স অ্যা স্টেজ... আসি স্যার।”

সমাপ্ত

উপসংহার

মাস আটেক পরে......

লা বেলে ফ্রান্স অ্যাপার্টমেন্ট, অরলিয়েন্স, ফ্রান্স

রাত দুটোর সময় ফোনটা বেজে উঠল। দীর্ঘদিনের অভ্যাসবশত রনের পাতলা ঘুম ভাঙতে এক মুহুর্ত লাগল না। এই প্রাইভেট নাম্বারটা গোটা পৃথিবীতে এই মুহুর্তে শুধু একজনের কাছেই আছে।

“হ্যালো”, রনের শান্ত কণ্ঠস্বরে কোথায় একটা হালকা উত্তেজনা লুকিয়ে আছে।
“মিশন সাকসেসফুল! আর কতদিন আন্ডারকভার থাকতে হবে রন?”, একটি অতি পরিচিত কণ্ঠস্বর ফোনের ওপার থেকে ভেসে এল।

উত্তেজনায় রনের কান লাল হয়ে গেল,“ব্রাভো! বেশ কিছুদিন। তোমার ওখান থেকে যত শীঘ্র সম্ভব বেরোনোর ব্যবস্থা আমি করে দিচ্ছি। আপাতত ইটালিতে কিছুদিন। গ্যাব্রিয়েল, তুমি যা করলে ইতিহাস তোমাকে স্যালুট করবে একদিন দেখে নিও।”    

এই মুহুর্তটা......শুধু এই মুহুর্তটার জন্য কত বিনিদ্র রজনী যে রনকে কাটাতে হয়েছে তার কোনও হিসেব নেই।

“আমার মন খারাপ হলে কি করি জানো রন? তোমার পাঠানো আমার সেই অন্ত্যেষ্টির ভিডিওটা দেখি, হাসতে হাসতে মুড ঠিক হয়ে যায়।”, গ্যাব্রিয়েলের হাস্যস্বর শোনা গেল,“কিন্তুটা কাজটা কি ঠিক হচ্ছে রন?”

রনও সে হাসিতে যোগ দিল, “আলবাত ঠিক হচ্ছে রন। স্টানা জানিয়েছে, গবেষণা ঠিক দিকে এগোচ্ছে। বাকীটা শুধু সময়ের অপেক্ষা! ভাবতো, কি বিশাল উপকার হবে গোটা বিশ্বের? নয়তো এভাবে ভাঁওতা দিয়ে আমি কতদিন অপরাধ দমন করব? চিন্তা কোরনা, যতদিন না এর ব্যবহার সেফ হওয়ার গ্রীণ সিগন্যাল আসছে, তার আগে কিছুই করা হবে না।”

“ওকে রন। ভালো থেকো।”

লাইন কাট হয়ে গেল।

রন ধীর পায়ে বেডরুমের ঝকঝকে কাঁচের জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়াল, দূরে রাতের ফ্রান্সের ঝিকমিকে আলো দেখা যাচ্ছে। সেদিকে তাকিয়ে সে আনমনে বিড়বিড় করে বলে চলল, “পরিবর্তনের একটা মূল্য আছে, সেটা সবাইকেই দিতে হয়। বৃহত্তর স্বার্থের জন্য সেই ক্ষুদ্র বলিদান তো যুগ যুগ ধরে চলে আসছে...”

সমাপ্ত
 
 
Abhishek Guha Roy