বসন্ত রং - পল্লবী সেনগুপ্ত

 বসন্ত রং

পল্লবী সেনগুপ্ত

 (১)


    ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে উদাস দৃষ্টিতে সকলের রঙ আর আবীর খেলা দেখছিল সুপ্রিয়া । যারা খেলছেন তারা সকলেই এই পাড়ারই লোকজন । আজ শনিবার তাই দোলের আগেরদিন হওয়া সত্ত্বেও অনেকেরই ছুটি । সেই সুযোগেই বোধ হয় এরা চুটিয়ে উপভোগ করছেন প্রাক দোল পর্ব ।
সুপ্রিয়া সকলের সাথে খুব একটা মিশতে পারে না , ও চিরকালই খুব মুখচোরা স্বভাবের । সেইজন্য পাড়ায় ওর তেমন কোন বন্ধু নেই । তবুও আজ ওদের দেখতে , ওদের রঙ খেলা দেখতে ভীষণ ভাল লাগছে । ওর মনটা হুহু করে দৌড় লাগাচ্ছে ফেলে আসা পুরনো দিনে । ছোটবেলা থেকেই রঙ নিয়ে এই লুটোপুটিটা ওকে কেন যেন বড্ড টানে । সেই ছোট্ট বয়স থেকেই ওর বারবার বড্ড ইচ্ছা করত আবীর আর রঙ নিয়ে জমিয়ে দোল খেলতে । কিন্তু সে ইচ্ছা ওর কোনদিনই পূরণ হয় নি । বাবা মা এই দোল খেলা জিনিসটা একদম পছন্দ করতেন না । তাই তাদের কড়া নজর থাকত মেয়ে যাতে দোল খেলতে না পারে সেদিকে । ওরা বলতেন গায়ে রঙ লাগালে নাকি চামড়ায় এলারজি হতে পারে ।
এভাবেই আঠারোটা বসন্ত পের হয়ে গেছিল সুপ্রিয়ার রঙ খেলার অসমাপ্ত ইচ্ছেকে বুকে জড়িয়েই । হয়তো এইভাবেই ইচ্ছাটা চিরকালের মত অসম্পূর্ণই ওর থেকে যেত যদি না তানিয়া ওর জীবনে আসত । তানিয়া ওর বেস্ট ফ্রেন্ড । মুখচোরা স্বভাবের সুপ্রিয়ার কোনদিনই তেমন কোন বন্ধু না থাকলেও কিভাবে যেন তানিয়া কলেজের প্রথম দিন থেকেই ওর বড্ড কাছের হয়ে গেছিল । মেয়েটা যেমন ডানপিটে তেমনই আমুদে । ঐ জোর করে সেকেন্ডে ইয়ারের পড়ার সময় কলেজের বসন্ত উৎসবে সামিল করেছিল সুপ্রিয়াকে । বাবা মার ভয়কে জয় করে সেই প্রথম সুপ্রিয়ার রঙ মাখা । তানিয়া রঙ মাখিয়ে ভূত করে দিয়েছিল ওকে । বাকী অনেক সহপাঠীই ছিল সেদিন রঙ লাগানোর দলে । আর সেদিন বিশেষ একজনও রঙ্গিন করেছিল ওকে । আদৃত । ওদের ডিপার্টমেন্ট এরই সেরা ছেলে  । এমনিতে বেশ গম্ভীর আর মিতভাষী হলেও আদৃত সেই দোলের দিন যেন ছিল বাঁধনহারা নদী । 

    
    কলেজের শুরুর দিক থেকেই সুপ্রিয়ার মন কেড়েছিল আদৃত । কিন্তু নিজের মনের কথা জানাবার সাহস কোনদিনই হয় নি সুপ্রিয়ার । শুধু তানিয়া জানত সবটুক । কতবার ও বলেছে
-“ প্রিয়া মনের কথা মনে চেপে রাখতে নেই ।তাই বলে দে আদৃতকে । তুই না পারলে আমিই বলছি “। কিন্তু পেরে ওঠেনি সুপ্রিয়া । তানিয়াকেও বলতে দেয় নি । কিন্তু সেই সুপ্রিয়াই ভেবেছিল সে বছর দোলে আদৃতের ছোঁয়া পেয়ে এবার জানাবে নিজের মনের কথা । নাঃ, তাও হয় নি । আদৃত অন্য কাউকে ভালবাসে , একথা জানতে পেরেছিল ও  সেই দোলের দিন কয়েক পরেই ।
কিন্তু তাহলে কেন আদৃত সেদিন আবীরে রাঙিয়েছিল ওকে ? শুধু বন্ধুত্বের ছলেই কি ? হয়তো তাই হবে । সব প্রশ্নের উত্তর তো জীবন দিয়ে যায় না । হয়তো এটাও তেমনি এক না মেলা উত্তর ।
 

    আসলে সুপ্রিয়ার জীবনটাই বোধ হয় অমীমাংসিত লক্ষ প্রশ্নের এক খাতা হয়ে রয়ে গেল । আদৃত এর প্রতি ওর অনুভবটাকে প্রেম নয় একটা সাময়িক ভাল লাগা বা ইনফ্যাচুয়েশন বলে সেটা সময়ের সাথে সাথে নিজেই বুঝতে পেরেছিল ও । তারপর আর কখনও  সত্যিকারের প্রেম আসেনি ওর জীবনে । বিয়ে করারও ইচ্ছা তেমন ছিল না ওর ।
কিন্তু বাবা মা আর সে কথা শুনবেন কেন ? সুপ্রিয়া পড়াশুনায় তেমন আহামরি ভাল কোনদিনই ছিল না । তাই কলেজপাশ করে কম্পিউটার কোর্স করে নিলেও তেমন কোন চাকরি  জোটেনি  । বাবা মা সেইজন্যই ছেলে দেখতে শুরু করেছিলেন ।
 

    শেষ পর্যন্ত  কলকাতাবাসী , বিধবা মায়ের একমাত্র সন্তান নিখিল সরকারের সাথে বিয়েটা পাকা হয় ওর । নিখিলকে বিয়ে করতে রাজী হবার পিছনে ওর  একটাই  কারণ ছিল ।  ছেলেটা ওর পূর্বপরিচিত ।
সমন্ধ করে বিয়ের ক্ষেত্রে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিয়ের আগে থেকে সেভাবে কোন ভালবাসা তৈরি হয় না । সবটাই শুরু হয় বিয়ের পরে । তেমনই কিছু আশা নিয়ে এই বাড়িতে পা রেখেছিল সুপ্রিয়া । কিন্তু ভালবাসা বোধ হয় সত্যিই ওর কপালে লেখা ছিল না । তাই নিখিল কি এক অজ্ঞাত কারণে যেন সব সময় দূরে সরিয়ে রাখে নিজেকে । সব সময় নিরুত্তাপ , ঠাণ্ডা ব্যবহার মানুষটার । নিজেকে সদাই আড়াল করে রেখেছে অভেদ্য এক কঠিন খোলসে । সুপ্রিয়ার আজকাল ভীষণ ভয় করে নিখিলের কাছাকাছি যেতে । ওই খোলস ভাঙ্গার ক্ষমতা যে ওর নেই । মানুষটা ওর পূর্বপরিচিত হলেও বন্ধু তো আর ছিল না কোনদিন ।  কিন্তু কেন এমন করে নিখিল ? ও কি এই বিয়েটা চায় নি ? ও কি অন্য কাউকে ভালবাসে বা বাসত ? তাহলে কেন নিজের জীবন জড়াল সুপ্রিয়ার সাথে ? না , কোন উত্তর নেই এই প্রশ্নগুলোর । নিজের যন্ত্রণাও কাউকে দেখাতে পারে না মেয়েটা । কাকে বলবে ? বাবা মা দুজনেরই বয়স হয়েছে , শরীরও ভাল না । তাদের তো নিজের জীবনের অসুখী দাম্পত্যের গল্প শুনিয়ে আরও চিন্তাগ্রস্ত করে তুলতে পারে না ও । আর বন্ধু বান্ধব ও তেমন কেউ নেই শুধু তানিয়া ছাড়া । তানিয়াও এখন কলকাতায় থাকে না । ব্যাঙ্গালরে চাকরী করে । তাই ওর সাথেও মন খুলে কথা বলার সুযোগ কম । যা কথা তা শুধুই ফোনে আর চ্যাটে ।
হঠাৎ ভীষণ কান্না পেল সুপ্রিয়ার । কেন ? কেন ওর জীবনটাই এমন রঙহীন ফ্যাকাশে হয়ে গেল? কি দোষ ছিল ওর ? কেন জীবনে নিজের ঘরের মানুষটাই ভালবাসতে পারল না ওকে ?
-“ প্রিয়া , তোর ফোন বাজছে “। শাশুড়ির ডাকে যেন ভাবনার জগৎ ছেড়ে বাস্তবে এসে নামল ও ।
সত্যি তো মোবাইল বাজছে । স্ক্রিনে ভাসছে তানিয়ার নম্বর ।
-“ কিরে তুই ? এমন অসময়? অফিস নেই “?
-“ আরে শোন । তোকে একটা সারপ্রাইজ নিউজ দিচ্ছি । আমি শান্তিনিকেতন এ এসেছি । এই বছর এখানেই দোল কাটাব বুঝলি । আমার সাথে আমার বেশ কয়েকজন বান্ধবীও আছে । তাই বলছি তুইও চলে আয় প্রিয়া । আবার খুব করে দোল খেলব আমরা । রঙ মাখব । তোকে আমাদের হোটেলের ঠিকানা মেসেজ  করছি । সোজা চলে আয় ট্রেন ধরে “। কলকল করছে তানিয়া ।
মনের ভিতরটা দুলে উঠল সুপ্রিয়ার । আবার কত বছর পর রঙের হাতছানি । কিন্তু……
-“ কিন্তু তানিয়া আমার হবে না রে । মানে এভাবে হুট করে ……”
-“ জীবন তো একটাই রে প্রিয়া । আর কত নিজের ইচ্ছেগুলোকে গলা টিপে মারবি “?
-“ আচ্ছা আমি দেখছি “। ফোন কেটে দিল সুপ্রিয়া । ইতিমধ্যেই কখন যেন দরজায় এসে দাঁড়িয়েছেন শাশুড়িমা । নিখিল যতই সুপ্রিয়াকে অবচ্ছেদা করুক না কেন , এই মানুষটার ভালবাসায় তার জন্য ভাটা  পরে নি কোনদিন ।
-“ মা , আমার  কলেজের বান্ধবীরা সবাই শান্তিনিকেতনে দোল সেলিব্রেট করছে । তাই আমাকেও ওরা …” আমতা আমতা স্বরে বলল সুপ্রিয়া ।
-“ ঘুরে আয় । তোর যে রঙ খেলার বড় সাধ আমি জানি । তাই আনন্দ করে আয় মা । যে মানুষটা তোর মন পড়তে পারে না তার জন্য নিজের ইচ্ছেকে আর বলি দিস না । “
হুহু করে এবার কেঁদে উঠল সুপ্রিয়া । শাশুড়ি মা এসে মাথায় হাত রাখলেন ওর । মনে মনে ঈশ্বরকে বললেন
-“ আমার ছেলেটার সুমতি দাও ঠাকুর । এই মেয়েটাকে একটু শান্তি দাও তুমি “। 


                              
                               (২) 


    রোজকার মতই অফিস থেকে ফিরছিল নিখিল । কিন্তু বাস থেকে নামার পরেই আজ ধাক্কা মারল চোখে দৃষ্টিটা ।  রাস্তার একপাশে কতগুলো লোক মিলে কি যেন এক দহনকাজে মেতে উঠেছে ।
-“ কি হচ্ছে এসব “? প্রশ্নটা মাথায় আসার সাথে সাথেই যেন উত্তরটাও ধাঁ করে মনে চলে এল । আরে ! এটা তো নিশ্চয়ই নেড়া পোড়া হচ্ছে , হ্যাঁ আগামীকালই তো দোল ।
    দোলের কথা মনে আসতেই কেমন যেন ফ্ল্যাশব্যাকের মত সেই দৃশ্যটা চোখের সামনে ভেসে উঠল  নিখিলের । একটা মেয়েকে খুব করে নীল আবীর মাখাচ্ছে একটা ছেলে । আর সেই মেয়েটা লজ্জার আবেশে কেমন যেন লাল হয়ে যাচ্ছে । লাল আর নীলে মিশে মেয়েটার মুখে কেমন অদ্ভুত মায়াবী সে এক রঙের খেলা ।আর অনেকটা দূর থেকে অন্য একটা ছেলে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছে দৃশ্যটা । নিমেষে তার বুকটা কেমন যেন ভার হয়ে উঠল একটা অব্যক্ত কষ্টের কামড়ে । হাতের মুঠোয় রাখা আবীরের ঠোঙাটা ছুঁড়ে ফেলে দিল সে। দৌড়ে চলে গেল কলেজ ক্যাম্পাসে দোল খেলার হইহই করা পরিবেশটা ছেড়ে  নিজের চোখের জলটুকু সবার অলক্ষে লুকিয়ে ফেলে ।
 

    নিখিল এই দৃশ্যটা সত্যি ভুলতে চায় । আরও অনেক অতীত স্মৃতি , জানা অজানাই ভুলে যেতে চায় ও । কিন্তু কেন যেন কিছুতেই পারে না । বারবার মনে চলে আসে পুরনো দিনের কথাগুলো । অথচ এগুলো ভোলা যে ভীষণ দরকার তা বেশ বোঝে নিখিল । কিন্তু মস্তিষ্ক অনেক যুক্তি বুঝতে পারলে অবুঝ আর অবাধ্য মনটা তো আর সব সময় বোঝে না , আর সেইজন্যই বোধ হয় নিখিলের ভুলতে চেয়েও সবটুকু ভোলা আর হয়ে ওঠে না । শুধুমাত্র অতীতের সেই দিনগুলো থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না বলেই নিখিলের বিবাহিত জীবনটাও অসম্পূর্ণ হয়ে রয়েছে । নিজের স্ত্রীকে মন থেকে পুরোপুরি মেনেও নিতে পারছে না ও , অথচ তাকে নিজের মনের কথা সবটা খুলে বলতেও পারছে না । সেইজন্যই বিয়ের চোদ্দ মাস পরেও আজও নিখিল যেন নিজের স্ত্রীয়ের কাছেই এক আগুন্তুক ।
আনমনেই হাঁটছিল ও নিজের বাড়ির পথে । হঠাৎ থমকে গেল । বাড়ির গলির মুখেই একটা ছোট রঙ পিচকারীর দোকান বসেছে । একটা মাঝারি সাইজের বাটিতে ভর্তি করে সাজান রয়েছে নীল আবীর । আবার, আবার সেই দৃশ্যটা ফুটে উঠল নিখিলের চোখের সামনে । নিজের অজান্তেই এবার চোখটা বুজে ফেলল ও । ও ভুলতে চায় । মনে প্রাণে ও অতীতটাকে ভুলতে চায় ।
                              
        

                                                                          (৩)


    শান্তিনিকেতনে বেশ বড় হোটেলই ভাড়া নিয়েছে তানিয়ারা । সেই হোটেল সংলগ্ন বাগানেই চলছে আজ দেদার দোল খেলা , এক টুকরো বসন্ত উৎসব , যাতে সামিল হয়ছে সুপ্রিয়াও। গতকাল বিকাল নাগাদই এসে পৌঁছেছে ও । না, নিখিলকে জানিয়ে আসা হয় নি । শাশুড়ি মা বললেন উনিই সবটা জানিয়ে দেবেন । তবুও মনটা খুঁতখুঁত করছে সুপ্রিয়ার । আবার বেশি রাগ করবে না তো ও ?
লাল , হলুদ , সবুজ, গোলাপি , কমলা বাহারি নানা রঙের আবীর নিয়ে  চলছে দোল খেলা । সুপ্রিয়ারও সারা শরীর রঙিন হয়ে উঠেছে নানা বর্ণের আবীরে , ঠিক যেমনটা ও একদিন চাইত । সবাই ছবি তুলছে খচখচ । কিন্তু সুপ্রিয়ার ইচ্ছে করছে না । এত রঙ ,আবীরের ছোঁয়া পেয়েও আজ যেন কিছুতেই রঙিন হয়ে উঠতে পারছে না ও । ভিড়ের মাঝেও ও যেন বড্ড একা । তাই সবার থেকে সরে থাকতেই শান্তি পাচ্ছে যেন  ।
-“ এই কিরে ? এভাবে একা একা এখানে দাঁড়িয়ে কেন তুই ? ওভাবে খেলা ছেড়ে চলে এলি কেন “? তানিয়া এসে পিঠে হাত রাখল বন্ধুর । শুধু এই স্নেহের স্পর্শটুকুর অপেক্ষাতেই যেন ছিল সুপ্রিয়া । মনের সবটুকু মেঘ নিমেষের ঝরে পড়ল বৃষ্টি হয়ে । ভরা ফাগুনেও দু চোখ জুড়ে ওর নেমে এল শ্রাবণ ।
-“ আমার কিচ্ছু ভাল লাগছে না রে তানিয়া । আমি যে জীবনে হেরে গেলাম । 

    আদৃতকে আমি ভালবাসিনি । শুধুই ওকে ভাল লাগত । তাই সেদিন ও অন্য কারোর হয়ে যাবার পরও আমার খুব একটা কষ্ট হয় নি । কিন্তু নিখিলকে যে আমি নিজের অজান্তেই আমি বড্ড ভালবেসে ফেলেছি রে । তাই ওর আমার থেকে ক্রমশ সরে যাওয়াটা আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না । আমি নিখিলকে কিছুতেই হারাতে পারব না তানিয়া , আজ ওর থেকে দূরে এসে আরও বেশি করে বুঝতে পারছি যে আমি ওকে ছাড়া কিছুতেই বাঁচতে পারব না । কিন্তু নিখিল তো আমায় ভালবাসে না । আমি জানি না কি আমার দোষ ? কিন্তু আমি কি করব বলে দে আমায় তানিয়া । আজ এত রঙ এর মাঝেও আমার নিজেকে বড্ড বিবর্ণ লাগছে । কারণ আমি এখন শুধু নিখিলের  হাতের আবীর চাই । ভালবাসার রঙ ছাড়া দোলের যে সত্যি কোন মানে থাকে না আর। “  বন্ধুকে জড়িয়ে ধরে হাউহাউ করে কাঁদছে সুপ্রিয়া ।  অন্য মানুষরা ওকে দেখছে সে খেয়ালই যেন নেই ওর ।
-“ চুপ কর প্রিয়া , চুপ কর । শান্ত হ । এভাবে ভেঙ্গে পড়িস না । যদি তোর ভালবাসা সত্যি হয় তবে নিখিল শুধু  তোরই থাকবে । দেখিস তুই “। বন্ধুকে সান্ত্বনা দিতে দিতে গলা ভিজে আসছে আজ তানিয়ারও । কেন এমন করছে নিখিল ? কি চায় ও ? ও কি তবে সত্যি সুপ্রিয়াকে ভালবাসে না ?

                                                             (৪)


    ট্রেন থেকে  ষ্টেশনে নেমেই রিক্সা স্ট্যান্ডের দিকে এগিয়ে গেল নিখিল । অনেক রিক্সা  দাঁড়িয়ে রয়েছে ।
-“ কবিমন  রিসোর্ট  এ যাবে “?
-“ হ্যাঁ বাবু । এই যে এই দিকে আসুন “।
রিক্সায় চেপে বসল নিখিল । এগিয়ে চলেছে কবিমন রিসোর্টের দিকে শান্তিনিকেতনের পথ বেয়ে । মাঝে মাঝেই চোখে এসে ঝাপটা মারছে টুকরো টুকরো বসন্ত বন্দনার ছবি ।
গতকাল অফিস থেকে ফিরে এসেই শূন্য বেডরুমটা দেখে ধক করে উঠেছিল নিখিলের বুকের ভেতরটা । বিগত চোদ্দ মাসে এমনতো কোনদিন হয় নি । রোজই ফিরে দেখতে পেয়েছে সুপ্রিয়াকে ঘরের ভিতর । গতকাল খালি ঘরটা দেখে যখন ও দাঁড়িয়েছিল তেতো মুখে তখনই মা এসে বলেছিলেন
-“ প্রিয়া শান্তিনিকেতন গেছে । বন্ধুদের সাথে দোল টোল খেলবে । ওর বন্ধু ফোন করেছিল । তাই আমিই ওকে যেতে বলেছি “।
-“ আমাকে না বলেই চলে গেল “?
-“ কেন ? কেন বলবে তোকে ? কি এমন ভালবাসায় ভরিয়ে তুলেছিস তুই ওকে ? 

    আমি জানি না খোকা তোর সমস্যাটা ঠিক কোথায় হয় ওকে মেনে নিতে ? এত্ত ভাল একটা মেয়ে ! আর তোর যদি ওকে এতোই অপছন্দ তাহলে বিয়ের আগে বললি না কেন ? আমি তো বারবার জিজ্ঞাসা করেছিলাম তোকে ? অন্য কাউকে ভালবাসতিস তুই ? তাহলে সেটাই বা জানালি না কেন ? যাইহোক এখন এসব কথার কোন মানে হয় না । তুই যদি পারিস শান্তিনিকেতন থেকে গিয়ে ওকে নিয়ে আসিস । আমার কাছে ওর রিসোর্টের ঠিকানা আছে ।“ মা বেশ রাগ দেখিয়ে হনহন করে বেরিয়ে গেছিলেন ঘর ছেড়ে । আর একটা কষ্টের দলা আটকে আসছিল নিখিলের গলার কাছে । ভীষণ অসহায় লাগছিল । ও কি করে বোঝাবে কাউকে নিজের মনের অবস্থাটা ।
-“ বাবু এসে গেছে রিসোর্ট “। রিক্সা থেকে নেমে পড়ল নিখিল । রিসোর্টের ভেতর ঢুকতে গিয়েও থমকে গেল । কি বলবে ও সুপ্রিয়ার সামনে গিয়ে ? হঠাৎ কেন এল ও এখানে ? সে কি আদৌ ভাল ভাবে নেবে নিখিলের উপস্থিতিটা ? এখানে একটু আনন্দ করছে ও নিজের একঘেয়ে জীবন থেকে ছুটি নিয়ে , সেখানে নিখিল অবাঞ্ছিত নয় তো ?
 

    দ্রিমদ্রিম করে হঠাৎ কেঁপে উঠল বুক পকেটে রাখা মোবাইল যন্ত্রটা । ফোনটা বের করেই মুখে বিরক্তির ছায়া ফুটে উঠল নিখিলের । আবার ভিডিও ক্লিপ পাঠিয়েছে কেউ হোয়াটসআপে । সকাল থেকে পাগল করে দিচ্ছে সব ।
কিন্তু একি ! ক্লিপ পাঠিয়েছে তানিয়া ! ব্যস্ত হাতে এবার সবুজ আইকন ছুঁল নিখিল । লোড হচ্ছে ভিডিও ক্লিপ ।
পুরোটা লোড হতেই কেঁপে উঠল নিখিলের বুক । একি ! অঝোর ধারায় তানিয়াকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে সুপ্রিয়া । ব্যক্ত করছে নিজের জীবনের যন্ত্রণা । নিখিলকে ভালবাসে ও । শুধু ওর ভালবাসা পেতেই আজ ও মরিয়া ।
আস্তে আস্তে ঝাপসা হয়ে আসছে নিখিলের চোখ । বুকের মাঝে চিনচিন করছে অদ্ভুত ভাললাগা মেশান একটা কষ্ট । দ্রিম দ্রিম করে আবার কেঁপে উঠল ফোনটা । তানিয়া মেসেজ পাঠিয়েছে ।
-“ নিখিল গত বার যখন আমি কলকাতায় এসেছিলাম তখন প্রিয়াকে না জানিয়েই তোর মুখোমুখি হয়েছিলাম কফিশপে । জানতে চেয়েছিলাম সরাসরি কেন ওকে এত কষ্ট দিচ্ছিস তুই ? কোন সদুত্তর সেদিন তুই দিতে পারিস নি । কিন্তু উত্তর না পেলেও সেদিন তোর চোখে ওর জন্য আমি ভালবাসা দেখতে পেয়েছিলাম । আর তাই এটা ভেবে অবাক হয়েছিলাম ওকে ভালবাসা সত্ত্বেও কেন এমন করছিস তুই ?
না আজও আমি জানি না সত্যি তুই কি চাস । একটা ভিডিও ক্লিপ পাঠালাম । আমার কথায়  প্রিয়ার যন্ত্রণা ভরা একটা মুহূর্ত ওর অজান্তেই মোবাইলের ক্যামেরা বন্দী করেছে আমার কলিগ সুজি । সবটা দেখার পরেও যদি তোর মনে ওর জন্য জায়গা তৈরি না হয় আমি তাহলে ওকে নিয়ে ব্যাঙ্গালর চলে যাব । ওর জন্য একটা চাকরির ব্যবস্থা করব আমি “
হতভম্বের মত মোবাইল হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে নিখিল । সব হিসেব যেন নিমেষের মধ্যে কেমন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে । আবার চোখের সামনে ফুটে উঠছে বহু বছর আগের সেই দৃশ্যটা । একটা মেয়ে। তাকে খুব করে নীল আবীর মাখাচ্ছে একটা ছেলে । সেই ছেলেটার নাম ছিল আদৃত । নিখিলদের ডিপার্টমেন্টের ওদের ব্যাচের সেরা ছেলে । ওই ছেলেটার প্রতিই যে দুর্বল ছিল সুপ্রিয়া সেটা ক্লাসের অনেকেই জানত । হয়তো আদৃতও জানত । আর নিখিলও জানত । কিন্তু জেনেই বা কি ! সব কিছু জানার পরেও যে নিখিলের মন বারবার খুঁজে বেড়াত ঐ সরল নিষ্পাপ বড় বড় চোখ দুটোকে । মন শুধু খুঁজত ঐ মুখটা । কিন্তু কোনদিন সে কথা কাউকে বলতে পারে নি নিখিল । কি করেই বা বলবে ? সুপ্রিয়া তো কোনদিন ভুল করেই একবারও তাকাত না নিখিলের দিকে । আর সত্যি তো কেনই বা তাকাবে ? কোথায় আদৃত আর কোথায় নিখিলের মন সাধারণ একটা ছেলে !
 

    আর সেই বছর , আদৃতের হাত থেকে সুপ্রিয়ার রঙ মাখার দৃশ্যটা কেন যেন সহ্য করতে পারে নি নিখিল । সেদিন ও বুঝে গেছিল ওর ভালবাসার মানুষের বুক জুড়ে শুধুই আছে আদৃত নামের ওই ছেলেটা । ও কোথাও নেই । কোনদিন থাকবেও না । এক রাশ অভিমান সেদিন ভিড় করেছিল নিখিলের মনে আর চোখে । ও ঠিকই করে নিয়েছিল আর কোনদিন ভাববে না ও ওই মেয়েটার কথা । তাকাবেও না ওর দিকে । নিজের সংকল্পে  সফলও হয়েছিল ও বেশ খানিকটা । কলেজ জীবন শেষ হবার পরেও আর কোনদিন সুপ্রিয়ার কোন খবরই নিতে চায় নি ও । নিজেকে ডুবিয়ে দিয়েছিল পুরোপুরি পড়াশুনার মধ্যে ।
কিন্তু উপরের ওই লোকটার মতিগতি বুঝতে পারা সত্যি বড় দায় । স্কুল সার্ভিস কমিশনের চাকরীটা পাবার পরই মা মেয়ে দেখতে শুরু করলেন নিখিলের জন্য । কিন্তু নিখিল চায় নি । সব কটা সম্বন্ধই নানা বাহানায় ভেস্তে দিত ও । অবশেষে পাকে চক্রে কিভাবে যেন একদিন নিখিলের হাতে এসে পৌঁছল সেই ছবিটা । পাত্রীর ছবি দেখেই সেদিন বুকের ভেতর দামামা বেজে উঠেছিল ওর । সেই দুটো নিষ্পাপ চোখ , সেই সারল্য মাখা মুখ । এই মেয়ে পাত্র খুঁজছে ? কিন্তু কেন ? কোথায় গেল ওর আদৃত ? সেদিন নিখিল ভেঙ্গে দিতেই চেয়েছিল এই সম্বন্ধটাও । কিন্তু পারে নি । কি যেন এক অদৃশ্য মোহ বন্ধন রুদ্ধ করেছিল ওকে । হয়তো মনের মাঝে সযত্নে চাপা দিয়ে রাখা ভালবাসাই সেই মোহ বন্ধনের নাম ।
বিয়ে করে সুপ্রিয়াকে বাড়িতে নিয়ে এলেও কোনদিন ওর সামনে সহজ হতে পারে নি নিখিল । বারবার ওর মনে হয়েছে নিশ্চয় নিতান্ত দায়ে পড়ে বা ভাগ্যের ফেরে আদৃতের সাথে কোনভাবে সম্পর্ক হারিয়েই নিশ্চয় বিয়েটা করতে হয়েছে মেয়েটাকে । কিন্তু ওর মন ? পরিস্থিতির চাপে মন তো আর বদলায় না । নিশ্চয়ই ওর মন জুড়ে এখনও আদৃতই আছে ।
 

    যতবার সুপ্রিয়ার কাছে যেতে চেয়েছে নিখিল ততবার ওর চোখের সামনে ভেসে উঠেছে সেই নীল আবীর মাখানোর দৃশ্যটা । আর অমনি পিছিয়ে গেছে নিখিল । কিন্তু সুপ্রিয়া ? সেও তো কোনদিন জোর করে নি । চুপ থেকেছে নিখিলের শীতলতায় । আর সেইজন্যই তো নিখিল ধরেই নিয়েছিল মেয়েটা সমঝোতা করেই বুঝি ঘর বেঁধেছে নিখিল নামের এই অপছন্দের মানুষটার সাথে ।
কিন্তু আজ ? আজ যে সবটুকু এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে । নিখিলের জন্য নিজের বুকে এত ভালবাসা জমিয়ে রেখেছে ওই মেয়েটা ? অথচ পুরনো অভিমানে অন্ধ হয়ে নিখিল সেটা দেখতে পায় নি । শুধু কষ্ট দিয়ে গেছে এতদিন ধরে নিজের ভালবাসার মানুষটাকে ! গত বছর দোলেও তো সারাদিন বন্ধুর বাড়িতে পড়ে ছিল নিখিল । এক ফোঁটা রঙও ভুল করেও লাগায় নি সুপ্রিয়ার গালে কিংবা কপালে ।
 

    কিন্তু অনেক হয়েছে । আর নয় । এবার নিজের সবটুকু ভুল শুধরে নেবে নিখিল । এত ভালবাসবে প্রিয়াকে যাতে ওকে কোন দুঃখ আর স্পর্শও করতে না পারে । কিন্তু সে সুযোগ প্রিয়া ওকে দেবে তো ? হঠাৎ যেন রিসোর্টের গেট থেকে প্রিয়া পর্যন্ত পৌঁছানোর দূরত্ব টা বড্ড বেশি নিখিলের । ব্যস্ত হাতে গেট ঠেলে দ্রুত পা ফেলে ভিতরে ঢুকল ও । এগোচ্ছে হন হন করে । দু মিনিটের মধ্যে ও পৌঁছে গেল রিসোর্টের গার্ডেনে । এখানেই চলছে রঙ আর আবীর নিয়ে টুকরো বসন্ত বন্দনা । কিন্তু সুপ্রিয়া কোথায় ? ওকে দেখা যাচ্ছে না তো ? অস্থির লাগছে নিখিলের ।
নিখিলকে দেখতে পেয়েই এবার এগিয়ে এল তানিয়া ।
-“ ও কোথায় তানিয়া ? “ আকুল স্বরে জিজ্ঞাসা করল নিখিল ।
আঙ্গুল তুলে দেখাল তানিয়া । নিখিলও দেখতে পেল । রঙ আবীর হইচই সব কিছু থেকে সরে এক কোণায় উদাস চোখ মেলে দাঁড়িয়ে রয়েছে সে ।
ধীর পায়ে ওর দিকে এগিয়ে গেল নিখিল। পিছন থেকে আলতো স্পর্শ করল ওর পিঠে ।
-“ প্রিয়া “… ডাকল অস্ফুটে ।
এবার সামনে ফিরল সে। দু চোখের কোলে চিকচিক করছে মুক্তো দানা ।
-“ তুমি? তুমি এখানে এসেছ “? কি ভীষণ মায়াময় স্বরে যেন বলল সুপ্রিয়া ।
-“ হ্যাঁ এসেছি । একটা কথা বলতে , যে কথাটা শহরের নিত্য দিনের অভ্যাসগত জীবনে বারবার বলতে চেয়েও বলতে পারিনি সেটা বলতেই আজ এসেছি । “
-“ কি কথা “? গলা কাঁপছে প্রিয়ার ।
-“ ভালবাসি । তোকে খুব ভালবাসি প্রিয়া । শুধু আজ নয় , সেই কোন যুগ থেকে । কলেজের প্রথম দিন থেকেই “।
-“ মিথ্যা কথা । মোটেই ভালবাস না তুমি আমায় । ভালবাসলে কেউ এভাবে কাউকে শুধুশুধু কষ্ট দেয় ? বিনা দোষে দূরে সরিয়ে রাখে “? আবার চারপাশের তোয়াক্কা না করেই কাঁদছে মেয়েটা ।
-“ কি করব বল আমি যে বড্ড বোকা, আর বাজেও  । সেইজন্যই তো নিজের মনের কথা বলতে পারি না । নিজের মনের মানুষের মন বুঝতেও পারি না । এই বোকা , বাজে বরটাকে ভালবেসে একবার নিজের করে দেখ প্রিয়া । আর কোনদিন সে তোকে কোন কষ্ট পেতে দেবে না “।
এবার নিখিলের বুকে আছড়ে পড়ল ওর প্রিয়া । কেঁদেই চলেছে অঝোর ধারায় ।
-“ আমার দিকে তাকা প্রিয়া । একটিবার “।
আস্তে আস্তে মুখ তুলল সুপ্রিয়া । আর অমনি দু হাতের নীল আবীর নিখিল ঘষে দিল বউয়ের গালে ।
-“ এই কি হল এটা “? বলেই হেসে উঠেছে সুপ্রিয়া । পলকেই লজ্জায় রক্তাভ ওর মুখ । লাল নীলের মিশেলেঅদ্ভুত মায়াবী রঙ খেলছে ওর মুখে । চোখে ঝিকমিক করছে অসংখ্য  নক্ষত্রের মত উজ্জ্বল ভালবাসা , যে ভালবাসার প্রতিটি কোণায় নিখিল দেখতে পাচ্ছে শুধুই নিজের নাম ।
 

    কপালে একটা চুমু খেয়ে ঝট করে বউকে নিজের বুকে চেপে ধরল নিখিল ভিড় থেকে একটু আড়াল খুঁজে নিয়েই । আকাশে বাতাসে উড়ছে রঙ বাহারি আবীর । দূরে কোথায় যেন বড্ড সুরেলা স্বরে ডেকে উঠল একটা কোকিল । আকাশ বাতাস  সবাই যেন সমস্বরে চীৎকার করে বলছে
‘ বসন্ত এসে গেছে … বসন্ত এসে গেছে ‘……

                                        ------ সমাপ্ত------
Pallabi Sengupta