উত্তরাধিকার- দেবাশিস্‌ ভট্টাচার্য্য

 


উত্তরাধিকার

দেবাশিস্‌ ভট্টাচার্য্য

 

 

    বৃষ্টির মধ্যে রাস্তায় পা রাখতেই অজিতের তার সেল ফোনটা বেজে উঠল। রাত আটটা বেজে গেছে, অফিস থেকে তার পি জি হাঁটাপথে পাঁচ মিনিট। স্ক্রীনে নম্বরটা ভালো করে দেখতে পেল না তবে কারও নাম না দেখানোয় বুঝল অচেনা নম্বর থেকে ফোনটা এসেছে। “হ্যালো!” বলতেই শুনতে পেল কাকার পরিচিত গলা।

“কেমন আছিস? অনেকদিন কোন খবর নেই”।

“না কাকা কাজের চাপ যাচ্ছে, সময় পাই না। তুমি কেমন আছ?”

“আমি ভালো আছি। তোর তো শনি রবি ছুটি কাল একবার এখানে আয়” কাকা বেশ জোরের সাথেই বললেন।

“ কেন, বিশেষ কোন দরকার?”

“হ্যাঁ, খুবই দরকার। এখানকার বিষয় সম্পত্তির একটা ব্যবস্থা না করলেই নয়। কাল শনিবার, কাল চলে আয় পরশু ভোর ভোর না হয় বেরিয়ে যাবি”।

আপনজন বলতে এই কাকা ছাড়া আর কেউ নেই। ছোটবেলায় এই কাকা অনেক কোলে পিঠে করেছে। অনেকদিন কাকার একটা খবর পর্যন্ত নেয় নি। তাই কাকার কথা ফেলতে পারে না সে, “ ঠিক আছে যাব কাল”।

নানা কথা ভাবতে ভাবতে পি জি তে এসে পৌঁছাল অজিত। কলকাতায় অজিতের আস্তানা বলতে এই পি জি, তার রুমমেট নেপাল বেড়াতে গেছে তাই সে রুমে এখন একা। রাতে পি জির মালিক রতনকাকুর কাজের লোক রবিদা টিফিনক্যারিয়ারে করে রাতের খাবার আনলে অজিত  বলে দিল আগামীকাল সে বাড়ি যাবে ফলে খাবার না দিতে।

 

    মেদিনীপুরের প্রত্যন্ত গ্রাম পারুলদা সেখানেই তার জন্ম। পাকা বাড়ি, চাষের জমি, পুকুর, অবস্থা মন্দ নয়। মা, বাবা, কাকা আর হরিদা এই ছিল তাদের সংসার। হরিদার তিনকূলে কেউ ছিল না, বাবা তাকে কোথাও থেকে নিয়ে এসেছিল। সে ছোট থেকেই হরিদা কে দেখছে। কাকা বাবার থেকে বছর তিনেকের ছোট, বিয়ে করে নি। সে ছিল কাকার অত্যন্ত আদরের। বাবা মা র চেয়েও কাকা তার বেশী আপন ছিল। বারো বছর বয়সে অজিত মা কে হারায়। বাবা, কাকা আর হরিদা তাকে মানুষ করে। মা মারা যাবার পর কাকা তাকে যেন আরো বেশী করে আগলে রাখতে থাকে। সাইকেলে তিন মাইল দূরের স্কুলে যেত, বর্ষায় ঝামেলার একশেষ। সেই স্কুল থেকেই খুব ভালোভাবে হায়ার সেকেন্ডারি আর জয়েন্টে পাস করে সুযোগ পায় আনন্দপুরের ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে। গ্রামের ছেলে কলকাতার মত অজানা অচেনা শহরে গিয়ে একা থাকতে হবে ভেবেই হাত পা পেটের ভেতর সেঁধিয়ে যাচ্ছিল। তাছাড়া ওখানে প্রচুর খরচ বলে সে দ্বিধায় ছিল, কিন্তু কাকার আশ্বাসে সে ভর্ত্তি হয়ে যায়। হোস্টেলেও জায়গা পেয়ে যায়, সমস্ত খরচ কাকাই পাঠাত। আই টি ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে ক্যাম্পাস থেকেই এই চাকরী। পোস্টিং হয় বেঙ্গালুরুতে। প্রথম প্রথম তার মন টিঁকত না সেখানে। কাকাও দু দুবার বেঙ্গালুরুতে এসে দেখে যায় তার প্রিয় ভাইপো খোকন কেমন আছে। খোকনকে ছাড়া দেশে তারও মন টিঁকত না।

 

    তারপর অজিতের মন লেগে যায়, বছরে একবারই আসত। বেঙ্গালুরুতে আসার তিন বছরের মাথায় বাবার মৃত্যু সংবাদ পেয়ে শেষবারের মত দেশের বাড়িতে এসেছিল। কাকার সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ ছিল, কিন্তু আগ্রহটা কাকার তরফেই বেশী ছিল। ধীরে ধীরে সম্পর্কটায় ভাঁটা পড়ে যাতে থাকে। বহুবার কাকা দেশে ঘুরে যাবার জন্য বলেছে, কিন্তু যাচ্ছি যাব করে যাওয়া হয়ে ওঠেনি। পাঁচ বছর বেঙ্গালুরুতে কাটানর পর গত দুবছর হল কলকাতায় প্রমোশন পেয়ে বদলি হয়ে এসেছে। তাও দেশের বাড়ি যাওয়া হয়ে ওঠেনি।

অফিসের কাজের চাপ আর পিঙ্কি।

 

    অজিতের প্রেমিকা ও সহকর্মী পিঙ্কি। পাঞ্জাবী, তবে দুই পুরুষ ধরে কলকাতায় বাস। ভবানীপুরে নিজেদের বাড়ি। পিঙ্কি শুধু রূপবতীই নয়, অনেক গুণ তার। পিঙ্কি খুব ভালো রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে পারে। কলকাতা অফিসে জয়েন করার পরে পরেই পিঙ্কিকে দেখে মুগ্ধ হয়ে যায় অজিত। তারপর মেলামেশা ও ঘনিষ্ঠতা, এখন তো পিঙ্কিকে ছাড়া জীবন অজিত ভাবতেই পারে না। সপ্তাহের পাঁচদিন দুজনে একসঙ্গে কাজ করলেও উইকএন্ড গুলোয় পিঙ্কিকেও সময় দিতে হয়। তার ওপর একটা ফ্ল্যাট কেনার চেষ্টায় বেশ ঘোরাঘুরি করতে হচ্ছে। বিয়েটা শীগগিরই সেরে ফেলতে হবে আর বিয়ের পর তো অজিত শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে থাকতে পারে না বা বউ নিয়ে পি জি তে উঠতে পারে না। তাই একটা ফ্ল্যাট না কিনতে পারলেই নয়।

 

    শেষবার কাকার সাথে ফোনে কথা বলেছে বোধহয় বছর ঘুরতে চলল। অপরাধ বোধ জাগে তার মনে, “যে কাকার জন্যে আজ সবকিছু, সেই কাকাকে... নাঃ, কাল দেশে গিয়ে ক্ষমা চেয়ে নিতে হবে।”

তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ে, সকাল সাড়ে ছটার মেদিনীপুর লোকাল ধরতে হবে।

 

    ভোর চারটের সময় প্রোজেক্ট হেডের ফোন, একটা সফটওয়্যার কাজ করছে না ক্লায়েন্টের খুব অসুবিধা হচ্ছে, অজিতকে একবার অফিসে আসতেই হবে। সকাল ছটায় অফিসে ঢুকল একেবারে ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে দেশে যাবার জন্যে তৈরী হয়ে, কিন্তু সব কিছু ঠিক করতে বিকেল চারটে বেজে গেল। হাওড়া পৌঁছতে প্রায় পাঁচটা বাজল।

 

    ট্রেনের জানলা দিয়ে বুভুক্ষুর মত গ্রাম বাংলার দৃশ্য দেখতে থাকে। হালকা মেঘ করেছে, ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে। ক্ষেতের কাজ শেষ করে পুরুষেরা একটু আলসেমী করছে, বিড়ি ধরিয়েছে। মাথায় বোঝা নিয়ে মেয়েরা, বউরা যাচ্ছে, গরু নিয়ে যাচ্ছে বালকেরা, কোথাও ট্রাক্টর দাঁড়িয়ে আছে। তারে ফিঙের ঝাঁক বসে আছে। দ্রুত দৃশ্যপট বদল ও হতে থাকে। বাঁশগাছে ঘেরা ছোট্ট পুকুর, হাঁস চরছে, মাঝে মাঝে হাঁস মাথা ডুবিয়ে বোধহয় গেঁড়ি গুগলি খাচ্ছে, পুকুর পাড়ে দাঁড়ান হাঁসগুলো ঘাড় ঘুরিয়ে পিঠে ঠোট ডুবিয়ে চুলকে নিচ্ছে। মুগ্ধ হয়ে দেখতে থাকে অজিত। হঠিতকারেকটা আমবাগান দেখে বিদ্যুৎ চমকের মত চোখে ভেসে ওঠে দেশের এক ঝড় বাদলের দিনে আমবাগানে দৌড়োদৌড়ির কথা। সাধনদের আমের বাগানে খুব আম হত, ঝড় হলেই সে দৌড় দিত আম কুড়োতে। অবশ্যই একা নয়, তার সাথী ছিল কবিতা। মনে পড়ে, বিপুলকাকার মেয়ে কবিতাকে। খুব ভাব ছিল তার সাথে, একসাথে স্কুলে যাওয়া আসা, ঝড়ে আম কুড়ান, বৃষ্টিতে ভেজা, একসাথে খেলা। ছোটবেলার সমস্ত দুরন্তপনার সাথী। তার যৌবনে কোন মেয়েকে প্রথম চুম্বনের স্বাদও সে পায় কবিতার কাছেই। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সময় গরমের ছুটিতে কলকাতা থেকে দেশে ফিরেছে। নির্জন দুপুরে, বিপিনকাকাদের বাড়িতে সেই প্রথম চুম্বনের ঘটনা। কবিতার নাকের ডগায় বিন্দু বিন্দু ঘাম, তিরতির করে কাঁপছিল সেদিন ওর পুরন্ত ঠোঁট দুটো, টানা টানা বড় বড় চোখ দুটো বুঁজিয়েছিল সে। আজও এতদিন পরেও সেই দৃশ্যটা তার চোখে ভাসছে, একদম অমলিন সে স্মৃতি।

   

    কিন্তু বেঙ্গালুরুতে গিয়ে ধীরে ধীরে সবই ভুলে যায়। আজ স্মৃতির দরজা খুলে হু হু করে সব পুরনো ঘটনা মানসপটে ভেসে উঠতে থাকে। বাবার কাজে এসে কবিতাকে না দেখেও মনে কোন প্রশ্ন জাগেনি। বিলকুল ভুলে গিয়েছিল তাকে! কখন যেন তার মনের পৃষ্ঠা থেকে ইরেজার ঘষে ঘষে কেউ কবিতার ছবিটাকে যেন মুছে দিয়েছিল। জানলা দিয়ে বাইরে থেকে আসা ঠান্ডা জলো হাওয়া ঝাপটা মারে তার চোখে মুখে। চোখ দুটো কেন জানি না কড়কড় করে ওঠে।

 

    স্টেশনে পৌঁছল সাড়ে আটটায়। শনিবার হওয়ায় অনেক লোকই কলকাতা থেকে বাড়ি ফিরছে, লোকের ভীড়ের সাথে বেরিয়ে বাসস্ট্যান্ডে এল অজিত। যেতে হবে রামকৃষ্ণপুর। রামকৃষ্ণপুরের বাসস্ট্যান্ডে নেমে সাঁকো পার হলেই তাদের গ্রাম পারুলদা।আকাশে মেঘ আরো গাঢ় হয়েছে টিপ্‌টিপ্‌ বৃষ্টিও শুরু হল। অজিতের ভাগ্য ভাল, স্ট্যান্ডে গিয়ে বাসে বসার জায়গাও পেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাস ছেড়ে দিল।

 

    রামকৃষ্ণপুরে যখন বাস পৌঁছল তখন বৃষ্টি বেশ জোরেই পড়ছে, প্রায় পৌনে দশটা বাজে। এমনিতে এই সময়ে বাস স্টপেজে কিছু দোকান গুমটি খোলা থাকারই কথা কিন্তু বৃষ্টির জন্যে আজ একটাও খোলা নেই। একটা বন্ধ দোকানের চালার নীচে দাঁড়াল সে। রাস্তার বাঁ দিকেই আছে খাল। বেশ চওড়া, খাল পার হলেই তাদের গ্রাম পারুলদা। অনেক আগে এই খাল পার হতে হত গ্রীষ্মে হেঁটে আর বর্ষায় ডোঙায়, তাদের ছোটবেলাতেই খালের ওপর বাঁশের সাঁকো তৈরী হয় আর এখন পাকা কংক্রিটের সাঁকো তৈরী হয়েছে একাধিক। সামনেই প্রথম সাঁকোটা পেরিয়ে পারুলদা, আধ মাইল দূরে আরেকটা সাঁকো সেটা পার হলে তালক্ষিরি একইরকমভাবে আরো মাইলখানেক পর তৃতীয়টা পার হলে পাকুরপুর। বন্ধ দোকানের চালার নীচে দাঁড়িয়ে যে বৃষ্টির ছাঁট থেকে পুরোপুরি বাঁচতে পারছে এমন নয়, তবে মাথাটা বাঁচছে।

 

    বৃষ্টির জোর খানিকটা কমতে অজিত সাকোঁয় উঠে পড়ল। দেখল উল্টোদিক থেকে ছাতা মাথায় হ্যারিকেন হাতে কেউ আসছে।

“কে রে, খোকন নাকি?” হরিদা’র গলা।

“ হরিদা কোথায় চললে?”

“যাব আবার কোথায়? সন্ধ্যের পর থেকে একটা করে বাস গেলেই আমি একবার করে দেখে যাচ্ছি তুই এলি কিনা”।

“আজও অফিস যেতে হল আর বেরতেও দেরী হয়ে গেল। কেমন আছ সবাই?”

“আমরা সবাই ভালই আছি” সংক্ষিপ্ত জবাব হরিদা’র। অজিতের হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে কাঁধে ঝুলিয়ে নিয়ে একহাতে হ্যারিকেন আর এক হাতে ছাতাটা অজিতের মাথায় ধরে হরিদা।

“আমি কি আর একা একা যেতে পারতাম না? সবই তো চেনা”।

“ সে ঠিকই, কিন্তু আজ সন্ধ্যায় অল্প ঝড় হয়েছে, তাতে করে গাঁয়ে কারেন্ট নেই। অন্ধকারে কোথায় সাপখোপ আছে তাই আমিই এলাম”।

কথা বলতে বলতে দুজনে এগুতে থাকে।

“বিপিনকাকার মেয়ে কবিতার কি খবর গো?” একটু ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করেই ফেলে অজিত।

“তোর সাথে তো খুব ভাব ছিল। তোর কাকার খুব ইচ্ছে ছিল তোদের বিয়ে দেওয়ার। কবিতারও বোধ করি তেমন ইচ্ছেই ছিল, কিন্তু ওদের অবস্থা তেমন ভালো ছিলনা। বিপিনদার বউটা ছিল খান্ডার প্রকৃতির তুই তো জানিস। তা বিপিনদার শালা এক পাত্র ঠিক করে। সে ছিল মাতাল আর চরিত্রহীন তাই কিছুদিনের মধ্যেই কবিতাকে গাঁয়ে ফিরে আসতে হল। মেয়ের দুঃখ সইতে না পেরেই বোধহয় বিপিনদা চলে গেল। বিপিনদা মারা যেতে মা আর মেয়ে পড়ল ভারী কষ্টে। তা তোর কাকা একটা ব্যবস্থা করল।  আমাদের যে রাধাকৃষ্ণের মন্দির আছে তার পূজারী বিষ্টু ভট্‌চাযের বয়েস হয়েছে, তাই তাকেই পূজোয় সাহায্য করত, মন্দির পরষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখত। দুবেলা ভোগ প্রসাদ আর একটা মাসোহারার ব্যবস্থা হয়েছিল। ঘরে চল্‌ ওর সাথে দেখা হয়ে যাবে”।

শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেল অজিতের।

 

    অজিতদের বাড়িটা গ্রামের একধারে। পুকুর আর বাগান ঘেরা বাড়িটাকে গ্রাম থেকে আলাদা করে রেখেছে। হরিদা দরজার কড়া নাড়তেই দরজা খুলে দিল কবিতা। সারা চোখে মুখে গভীর বিষাদের ছাপ।

হাঁ করে অজিত তাকিয়ে থাকে কবিতার দিকে। এ কোন কবিতা? এমন শান্ত নিষ্প্রাণ বিষাদমূর্ত্তি কবিতাকে সে দেখেনি। কোথায় গেল সেই প্রাণ চঞ্চল, প্রাজাপতির মত উড়ে বেড়ান কবিতা? একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে বুকের ভেতর থেকে।

“ভেতরে এস!” কবিতার কথায় বাস্তবে ফেরে অজিত।

সে ঢুকল বাড়ির ভেতরে, “কাকা কোথায়?” হাঁক দেয় অজিত।

এই তো আমি!”  

কাকা কে দেখে অবাক হয়ে যায় অজিত। কী বুড়ো লাগছে, কেমন যেন রুগ্ন। সামনে ঝুঁকে হাঁটছে। কে বলবে এই কাকার একদিন কি সুন্দর চেহারা ছিল। কখনো কাকার শরীর খারাপ হতে দেখেনি সে।

“কী হয়েছে তোমার? এ কী চেহারা হয়েছে?” বলতে বলতে এগিয়ে যায় অজিত, নীচু হয় প্রণাম করার জন্যে।

“থাক্‌ থাক্‌ প্রণাম করার দরকার নেই, কাল সকালে আগে মন্দিরের রাধা কৃষ্ণকে প্রণাম করিস তারপর অন্য কারোকে। যা আগে হাত মুখ ধুয়ে নে তারপর খেতে বসে কথা হবে”।

মেঝেতে কয়েকটা হ্যারিকেন জ্বলছিল, একটা তুলে নিয়ে এগিয়ে আসে হরিদা, “চল্‌, দোতলায় তোর ঘরটা পরিষ্কার করেই রাখা আছে, আজ কবিতা কাচা চাদর টাদর সব পেতে দিয়েছে”।

ঘরে ঢুকে অজিত দেখে সব কিছু একদম আগের মতই আছে, সেই খাট, সেই পড়ার টেবিল চেয়ার, টেব্‌ল ল্যাম্প।

হরিদা টেবিলের ওপর হ্যারিকেন রেখে বলে, “আমি নীচে গেলাম, খাবার গরম করছি। হাত মুখ ধুয়ে চলে আসিস, স্নান করিস না এত রাতে”।

হাত মুখ ধুয়ে পোষাক পালটে নীচে আসতে কাকা বলে, “খোকন চলে আয়, আমরা খেয়ে নিলে হরি আর কবিতা খাবে”।

অজিত এসে বসে খাবার টেবিলে, হরিদা আর কবিতা পরিবেশন করতে থাকে। অজিতের অতি প্রিয় সব পদ রান্না হয়েছে। বহু বছর পর বেশ তৃপ্তি করে খেল অজিত। খেতে খেতে অজিত সকলের সাথেই পুরনো দিনের গল্পে মেতে ওঠে। একসময়ে খাওয়া শেষ হয়। অজিত কাকাকে জিজ্ঞেস করে, “ কি জরুরী দরকার বলছিলে?”

কাকা হাত মুখ ধুয়ে নিজের ঘর থেকে একতাড়া কাগজ এনে অজিতের হাতে দিয়ে বললেন, “ এটা আমাদের সমস্ত সম্পত্তি, জমি জায়গার দলিল। সব কিছুই তোর নামে রেজিস্ট্রি করিয়ে রেখেছি। যত্ন করে রেখে দে, পরে পড়ে দেখিস। আমার শরীর বিশেষ ভালো নয়, আমি শুয়ে পড়ছি। তুইও ক্লান্ত আজ আর গল্প করে সময় নষ্ট করিস না ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়”।

“এসবের এক্ষুণি কী দরকার ছিল?”

“আছে, দরকার আছে। আমার আর হরির দুজনেরই বয়েস হয়েছে। কবে আছি কবে নেই, এই বেলা সম্পত্তির পাকাপাকি বিলি বন্দোবস্ত না করলে সব বেহাত হয়ে যাবে”।

“তোমার শরীরে কি হয়েছে?”

“বার্দ্ধক্য আর কিছু নয়”। এই বলে কাকা উঠে পড়ে।

 

    হরিদা আর কবিতার সাথে গল্প করার ইচ্ছে থাকলেও উঠে পড়ে অজিত। ঘরে গিয়ে কাগজের তাড়াটা টেবিলে রেখে শুয়ে পড়ে। শুয়ে শুয়ে সিনেমার ফ্ল্যাশব্যাকের মত তার চোখে ভেসে উঠতে থাকে ছোটবেলার একটার পর একটা ঘটনা। কাকার কাঁধে চড়ে গ্রামের রাস্তায় ঘুরে বেড়ান, দুষ্টুমি করার জন্যে বাবার হাতে মার খাওয়া আর মারের হাত থেকে কাকার বাঁচান। যখন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে কলকাতায় আসছিল, তাকে ট্রেনে তুলতে এসে ছেলেমানুষের মত কাকার কান্না। তবে স্টেশনে সেদিন আরেকজনও কেঁদেছিল, প্ল্যাটফর্মের দেবদারু গাছটার মোটা গুঁড়িটার আড়ালে দাঁড়িয়ে। সেদিন কবিতার কান্না তার চোখ এড়ায়নি। যতক্ষণ না প্ল্যাটফর্ম তার দেবদারু গাছকে নিয়ে চোখের আড়ালে চলে গেল, ততক্ষণ ট্রেনের দরজার কাছে দাঁড়িয়েছিল অজিত। গরমের ছুটি পূজোর ছুটিতে এলে কী আনন্দ সকলের! এই সব ঘটনা মনে পড়ার সাথে সাথে আত্মগ্লানি অনুভব করে অজিত। এদের এত ভালোবাসার প্রতিদানে কী দিতে পেরেছে সে! উলটে এদেরই দূরে ঠেলে রেখেছে, একপ্রকার ভুলেই ছিল এদের। এই উপেক্ষা তো এদের প্রাপ্য ছিল না! এইসব ভাবতে ভাবতে একসময়ে গভীর ঘুমে তলিয়ে যায় অজিত।

 

অনেক লোকের গলার আওয়াজ আর চেঁচামেচিতে ঘুম ভাঙ্গে অজিতের। দেখে সকাল হয়ে গেছে। চেঁচামেচিটা আসছে বাড়ির বাইরে থেকে। দ্রুত বিছানা ছেড়ে নীচে নেমে আসে অজিত। হরিদা কে কবার ডাক দেয় কিন্তু কোন উত্তর পায় না। ইতিমধ্যে কারা যেন সদর দরজা ধাক্কা দিচ্ছে।

দরজা খুলে দেখে গ্রামের অনেকেই জড়ো হয়েছে, তারা অজিতকে দেখে অবাক, “ তুমি কখন এলে? কে খবর দিল?”

“কাল রাতে এসেছি। কিন্তু কি খবর?”

তখন গ্রামের লোকেদের কাছে জানতে পারে পরশু বিকালে খুব ঝড় বৃষ্টি হয়েছিল। সেই ঝড় বৃষ্টির সময়ে ক্ষেতে ছিল কাকা আর হরিদা। বাজ পড়ে দুজনেই মারা যায়। অজিতের ফোন নম্বর না থাকায় কেউ খবর দিতে পারেনি। আজ সকালে এরা চলেছে মেদিনীপুর টাউনে, মর্গ থেকে দুজনের লাশ আনতে। গ্রামের লোকেদের কথা শুনে বিশ্বাস হতে চায় না অজিতের, একবার ঘরের ভিতর দিকে ঘুরে তাকায়, যদি কারোকে দেখতে পায়। কোনরকমে নিজেকে সামলে কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করে অজিত,

“আর কবিতা?”

“ও তো গত চৈত্র মাসে কাকভোরে মন্দিরের পূজোর ফুল তুলতে গিয়ে সাপের কামড়ে মারা যায়”। গ্রামবাসীদের উত্তর শুনে চৌকাঠের উপরেই ধপ করে বসে পড়ে অজিত। তার মাথাটা ঘুরতে থাকে, তাহলে পরশু রাতের কাকার ফোন কল, কালকের দেখা হরিদা, কাকা, কবিতা সব মিথ্যে? দিশেহারা হয়ে পড়ে অজিত।

“তুমি যখন এসেই গেছ, তখন চল আমাদের সাথে, ওদের দুজনের শেষকৃত্য তো করতে হবে?”

অজিত বলে, “আসছি, পোষাকটা পালটে আসি”। এই বলে দোতলায় নিজের ঘরে ঢোকে অজিত। দেখে কাল রাতে কাকার দেওয়া কাগজের তাড়াটা তখনও টেবিলের ওপর রাখা রয়েছে। এখন গোটা ব্যাপারটা অজিতের কাছে পরিষ্কার। তাকে সম্পত্তি বুঝিয়ে দিতেই কাকা ডেকে পাঠিয়েছিল।

রক্তের টান বুঝি একেই বলে!

 

সমাপ্ত

 

Debasish Bhattacharyya