কাগজ - শুভাঞ্জন চট্টোপাধ্যায়

 

কাগজ

শুভাঞ্জন চট্টোপাধ্যায়


 

     নিজের লাইব্রেরি রুমে চিন্তান্বিত ভঙ্গিতে বসেছিলেন মল্লার বাবু। ডান হাতে ফাউন্টেন পেন আর এক হাতে ধরা একটা ওয়াইন গ্লাসে আধখাওয়া হুইস্কি এখনো পড়ে রয়েছে। তাঁর সাধের ইজরায়েলি স্কচ লিখতে লিখতে অনেক ক্রূশিয়াল মোমেন্টে তাঁকে বুস্ট আপ করতে সাহায্য করেছে..এ অভিগ্যতা মল্লার বাবুর জীবনে কম হয় নি। কিন্তু এবারকার এক্সপেরিয়েন্স যেন একেবারেই ভিন্ন।  চিন্তার জটে পড়ে এমন হাবুডুবু মল্লার বাবু আগে কখনো খেয়েছেন কিনা, সত্যিই তাঁর মনে পড়ে না। 

    সামনে লেখার কাগজগুলো বিক্ষিপ্ত অবস্থায় পড়ে আছে। একটা কালির দাগও তাতে এখনো পড়ে নি। এখনো অবধি দু -দুটো উপন্যাস আর তিন তিনটে ছোটো গল্পের পর এবারের মতো শারদীয়া সংখ্যার জন্য এটাই তাঁর শেষ লেখা।তারপর আপাতত কয়েক মাসের ছুটি। আবার নতুন করে শুরু...। 

    কিন্তু শেষকালে এসে এই একটা লেখাই যেন মল্লার বাবুর রাতের সমস্ত ঘুম কেড়ে নিয়েছে। দিন কয়েক ধরে হাজার ভেবেও একটা ছোটো গল্পের প্লটও মাথায় এলো না এখনো। 'ভারত ' পত্রিকার সম্পাদক অঘোর বাবু গতকাল আরো একবার এসে ঘুরে গেছেন। কড়জোড়ে তাগাদা দিয়ে গেছেন... ' স্যার, মানে বলছিলাম, প্লিজ একটু তাড়াতাড়ি...। আসলে সময় কম। বিস্তর কাজ। জানি আপনাদের মাথার ওপরেও সারা বছরের চাপ... এইমাত্র কবি সারদা মল্লিক এর বাড়ি হয়ে এলাম। তিনিও আরো দিন দুই সময় চেয়েছেন... এই টাগ অব ওয়ারের মাঝে পড়ে কি যে নাজেহাল অবস্থা...!'

 ' আজ সোমবার। বুধবার দিন ডেফিনিটলি আপনার গল্প পেয়ে যাবেন। ' স্তোকবাক্য দিয়ে এ যাত্রার মতো সম্পাদক মশাইকে ঠেকানো গেলেও সময়কে কি আর বাগে আনা যায়..। দেখতে দেখতে রাত পেরিয়ে পরের দিন সকালও গড়িয়ে গেল। কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত একটা জুতসই কাহিনিও মাথায় এলো না মল্লার বাবুর। এ  ঘটনা তাঁর পঁয়ত্রিশ বছরের লেখক জীবনে অভূতপূর্ব।   গতরাত্রে আচমকাই একটা ছোটো গল্পের প্লট মাথায় এসে গিয়েছিল।গল্পের নামকরণও করে ফেলেছিলেন..'অন্ধকার।' কিন্তু লেখা শেষ করার পর কেন জানি না তাঁর মনে হলো, সত্যিই এটা ঠিক কী হলো? এমন কাঁচা,দূর্বল, জঘন্য মাণের গল্প তাঁর কলম থেকে বেরিয়ে আসতে পারে, আশা করা যায় কখনো? এ যেন নেহাৎই লেখার জন্য লেখা। এর বেশি কিছু নয়। এমন লেখা আর যাই হোক, আলোর মুখ দেখতে পারে না।  গল্পটা রিজেক্ট করতে দ্বিতীয়বার ভাবতে হলো না মল্লার বাবুকে। বাতিল করে দেওয়া কাগজ গুলো এখনো পড়ে রয়েছে তাঁর সামনে টেবিলের এক কোণে। একজন লেখক কি এইভাবেই ক্রমশ ফুরিয়ে যায়...?এখনই..এত তাড়াতাড়ি! না না তা কি করে হয়!………..চেয়ার ছেড়ে উঠে অস্থির চিত্তে পায়চারি করতে  থাকেন মল্লার বাবু। হঠাৎই তাঁর    মনে পড়ে যায় বহু বছর আগে জীবনের  একেবারে প্রথম দিকে একটা নামকরা বিদেশি গল্পের ছায়া অবলম্বনে তিনি একটা শর্ট  স্টোরি লিখেছিলেন। যে কোনো কারণেই হোক লেখাটা আর পত্রিকায় পাঠানো হয়নি।   রিডিং রুমের শেল্ফগুলো খুঁজলে এখনো সেটা পাওয়া যেতে পারে। আচ্ছা,যদি ঐ লেখাটাই অঘোর মাইতির হাতে তুলে দেওয়া হয়  তাহলে কেমন হয়?তাতে আর যাই হোক মান সম্মান টা বাঁচবে । চেয়ার ছেড়ে উঠে  রিডিং রুমের দিকে যেতে গিয়েও কি মনে করে থমকে দাঁড়িয়ে পড়েন মল্লার বাবু। সত্যিসত্যিই কি বাঁচবে মান সম্মানএ লেখা পত্রিকায় ছাপা হলে পাঠক সমাজের কাছে হয়তো জোড়ালো সমালোচনার মুখোমুখি হতে হবে তাকে। শুনতে হবে, এটা সাহিত্যিক মল্লার চৌধুরীর নিজের লেখা নয়। বিদেশি গল্পের স্পষ্ট অনুকরণ...। এককথায় নকল। হোক না সমালোচনা। একজন লেখককে  ঘিরে  ক্রিটিসিজ্ম থাকবে না, এ তো হয় না। তাছাড়া তিনি তো অভূতপূর্ব কিছু করছেন না। বিশ্ব সাহিত্যে যুগে যুগে  স্থান পেয়েছে এমন বিদেশি গল্পের ছায়া অবলম্বনে রচিত লেখার সংখ্যা নেহাৎ কম নয়। মল্লার বাবু চাইলে হাতে গুণে নামও বলে দিতে পারবেন। লোকে একদিন সমালোচনা করবে, দুদিন করবে... তারপর আস্তে আস্তে ভুলে যাবে; বছরকে বছর পুরনো হয়ে যাওয়া শারদীয়া পত্রিকার বিস্মৃতপ্রায় মলাটের মতো। এটাই জীবনের নিয়ম।  কিন্তু আজ বাদে কাল যদি অঘোর বাবু এসে দেখেন গোটা গল্প দাঁড় করানো দূরের কথা  মল্লার বাবু এখনো একটা লাইন পর্যন্ত লিখে উঠতে পারেননি... কী ধারণা জন্মাবে ওঁর মনে? অঘোর মাইতির সামনে কতখানি ফেস লস হবে তাঁর!সীদ্ধান্ত একপ্রকার নিয়েই ফেললেন মল্লার বাবু। ঐ পান্ডুলিপিখানাই তাঁকে উদ্ধার করতে পারে এই সংকটের হাত থেকে। এছাড়া আর কোনো রাস্তা  অন্তত এই মূহুর্তে তাঁর মাথায় কাজ করছে না। 'স্যার...।' মল্লার বাবুর সেক্রেটারি অজিত দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। 'কিছু বলবে? ' 'এক ভদ্রলোক আপনার সঙ্গে দেখা করবে বলে অনেকক্ষন থেকে দাঁড়িয়ে রয়েছেন?' 'কে?কী নাম'? ' নাম  বললো অরূপ সেনগুপ্ত।' ' সে আবার কে?' 'গত শনিবার কৃষ্ননগর থেকে ফেরার পথে আপনার সঙ্গে নাকি ট্রেনে আলাপ পরিচয় হয়েছিল তার।' মনে করতে খুব বেশি সময় লাগলো না মল্লার বাবুর। সেদিন কৃষ্ণনগরে একটা সাহিত্য সভার আসর সেরে ফিরছিলেন তিনি। গাড়িটা খারাপ হয়ে যাওয়ায় অত রাত্রে ট্রেনেই ফিরতে হয়েছিল তাঁকে।প্রায় নিরালা কম্পার্টমেন্টে একটি ছেলের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল তাঁর। অনেকটা সময় ধরে  ওর সঙ্গে কথা হয়েছিল বলে ঘটনাটা পরিষ্কার মনে আছে মল্লার বাবুর।ট্রেনে একা একা বসে একঘেয়েমি ধরানোর চাইতে  তিনি বেশ উপভোগ করছিলেন ছেলেটির সঙ্গ। বেকার ছেলে।চাকরি বাকরির চেষ্টা করছে বটে,কিম্তু ওসবের থেকেও সাহিত্যের প্রতি আগ্রহ তার মধ্যে অনেক বেশি তীব্র।বাবার কাছ থেকে পাওয়া পকেট খরচা জমিয়ে মাসে দুটো একটা করে সাহিত্য পত্রিকা তার কেনা চাইই চাই।  বই পড়ার মতোই গল্প লেখাটাও তার নাকি আর একটা ভালোবাসা।কিন্তু ছেলেটির পরিবারে বা তার পরিচিত মহলে এমন কেউ নেই যারা তাকে এ ব্যাপারে কোনোরকম উৎসাহ জোগাতে পারে। বরং নিরুৎসাহিত করার লোকের সংখ্যাই যেন বেশি। ছেলেটির বাবার একটা মুূদিখানার দোকান রয়েছে। ভদ্রলোকের অতীব ইচ্ছে, ছেলে এখন থেকে ব্যাবসা পত্তর শিখুক। হাত পাকাক। একদিন তো ধরতেই হবে দোকানের হাল। নয়তো কে দেখবে। সাধারণভাবে গ্র্যাজুয়েশন পাশ করে আজকের দিনে চাকরির দরজা পেরোনো যে কতটা কঠিন তা ভদ্রলোক নিজে যেমন বোঝেন, হয়তো তার ছেলেরও বিষয়টা অজানা নয়। তবু মুদির দোকানের ঐ বদ্ধ খাঁচার মধ্যে ভ্যান ভ্যান করতে থাকা মাছি, ভেলি গুড়,রেড়ির তেলের গন্ধ, দর কষাকষির খেলা আর অসাড় খেড়ো খাতায় মুখ ডুবিয়ে,নিদাঘ মধ্যাহ্নে সিন্দুকের সামনে গদি আঁটা টুলে বসে পাখার বাতাস খেতে খেতে  নিজের ভালোলাগার ক্ষেত্রটিকে জলান্জলি দিতে কিছুতেই রাজী নয় ছেলেটি।তার নিজের কথায়, মল্লার বাবুর মতো মানুষের সঙ্গে এইভাবে যে ওর  কোনোদিন আলাপ হতে পারে  এ যেন তার কাছে স্বপ্নের মতো। প্যারাডক্স। মনে হচ্ছে জীবনের সবথেকে বড় পাওয়াটা ভগবান  বুঝি তাকে পাইয়ে দিয়েছেন। ট্রেনে যতটা সময় ছেলেটি ছিল ততক্ষনই যেন মল্লার বাবুকে ঘিরে এক অদ্ভুত বিস্ময় আর সম্ভ্রম  তার চোখে মুখে খেলা করছিল। রানাঘাট ষ্টেশনে নেমে যায় ছেলেটি। যাবার আগে একটা অনুরোধ রেখেছিল সে। তার নিজের লেখা অনেকগুলো ছোটো গল্পের মধ্যে যেটা তার চোখে বেস্ট চয়েস হিসেবে চিহ্নিত, সেই লেখাটা  নিয়ে একদিন যদি সে মল্লার বাবুর বাড়িতে গিয়ে দেখা করে তাতে কোনো অসুবিধে আছে কিনা। লেখা সম্পর্কে লেখক মশাইয়ের মূল্যবাণ মতামত তার জীবনের পাথেয় হয়ে থাকবে। ছেলেটির কথাবার্তা শুনে কোথায় যেন তার প্রতি একটা তাৎখণিক ভালোলাগাবোধ জেগে উঠেছিল মল্লার বাবুর মনে।সৌজন্যের খাতিরে তার সে  অনুরোধে  না করতে পারেন নি তিনি। কিন্তু সেদিন ছিল এক পরিস্থিতি। আজ  এই মুহূর্তে  দাঁড়িয়ে কারো সাথে দেখা করা বা কথা বলার মতো সময় কিংবা মন কোনোটাই তাঁর নেই।সেক্রেটারিকে তিনি বললেন, 'গিয়ে বলো আমি একটা বিশেষ জরুরি কাজে ব্যাস্ত হয়ে পড়েছি। পরে দেখা করতে... আর হ্যাঁ, এই কাগজগুলো একটু বাইরে ওয়েস্ট পেপার বাক্সে ফেলে দাও তো.. এ আর কোনো কাজে লাগবে না।ফেলে দেওয়া গল্পের সেই স্ক্রিপ্ট গুলো অজিত এর হাতে তুলে দিলেন মল্লার বাবু। কিছুক্ষণ পর অজিত ফিরে এলো। 'ভদ্রলোক এই কাগজটা আপনাকে দিতে বলেছেন। '   কয়েকলাইনে লেখা একটা চিঠি। খানিকটা কৌতুহলী হয়ে  মল্লার বাবু চিঠিখানা পড়তে শুরু করলেন।... 'স্যার, গত কদিন ধরে আপনাকে অনেকবার ফোনে ধরতে চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত যোগাযোগ হয় নি।  আমার নিজের ডায়েরির পাতা থেকে  বাছাই করা  একটা  ছোটোগল্প আপনাকে দেখাবো বলে নিয়ে এসেছিলাম। সেটা হলো না বলে প্রথমটায় বেশ খারাপই লাগছিল। কিন্তু তার বদলে আজ যে জিনিসটা পেলাম তাতে আমার খারাপ লাগা সবটুকু অনূভুতি নিমেষেই মুছে গেছে। তখন সেক্রেটারি স্যার ওয়েস্ট পেপার বাক্সে কিছু কাগজ ফেলে রেখে গিয়েছিলেন।  পাশে দাঁড়ানো সিকিউরিটি গার্ড ভদ্রলোকের কি একটা কথার উত্তরে শুনছিলাম উনি  বলছিলেন  "একটা গল্প নিয়ে কদিন ধরে স্যারের খুব মেন্টাল প্রেসার পড়ে গেছে। লেখার পরেও পছন্দ হলো না বলে শেষে এই কাগজগুলো বাতিল করে দিলেন"। ওনারা চলে গেলে কাগজকটা  তুলে নিয়ে দেখি ওগুলো 'অন্ধকার 'নামে কোনো একটা গল্পের পান্ডুলিপি। ম্যানাসক্রিপ্টটা  আমি সাথে করে নিয়ে গেলাম স্যার। আপনাকে না জানিয়ে কাজটা করে ফেলার জন্য বিশেষ ভাবে ক্ষমাপ্রার্থী। ভালো থাকবেন। পুজোয় আপনার নতুন গল্পের অপেক্ষায় রইলাম। ইতি- আপনার গুণমুগ্ধ পাঠক অরুপ সেনগুপ্ত।'.......। 

    ফাউন্টেন পেন এ লেখা গোটা গোটা হরফ। হতভম্বের মতো কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে চিঠিটার দিকে তাকিয়ে রইলেন মল্লার বাবু।হঠাৎ তাঁর মনে পড়লো, ছেলেটা সেদিন একটা চিরকুটে নিজের মোবাইল নম্বর লিখে দিয়েছিল। এখনই ওকে ফোন করা দরকার। লাইনটা পাওয়া ভীষণ জরুরি। ব্যস্ততার সঙ্গে  ওয়ালেট থেকে চিরকুটটা বের করে রিং করলেন মল্লার বাবু।... 'হ্যালো। আমি মল্লার চৌধুরী বলছি। তুমি অরূপ তো?' 'স্যার আপনি! বলুন...।' এমন একটা দামী ফোন যে আসতে পারে, ওপাশের ব্যক্তিটি যেন কল্পনাই করতে পারে নি। কিন্তু এবারে যে প্রশ্নটা ধেয়ে এলো সেটা যেন তার কাছে আরো বেশি আনএক্সপেক্টেড।...' শোনো তুমি যেটা করেছো একেবারেই ঠিক করো নি। কাউকে কিছু না জানিয়ে এমন একটা কাজ করলে কি করে...?' আচমকা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় ছেলেটি। ' স্যার, ইয়ে, মানে আমি খুব অন্যায় করে ফেলেছি.. আসলে ডাস্টবিনে কাগজগুলো পড়েছিল, তাই ভাবলাম...। ' ' তাই সটান ওগুলো নিয়ে চলে গেলে...। ঐ ফেলে দেওয়া লেখাটা তোমার কোন্ কাজে লাগবে শুনি..?'' স্যার, আসলে আমি অনেক আশা করে...।' 'আশা.. কিসের আশা...।' মল্লার বাবুর ক্ষোভের পারদটা যেন আরো এক কাঠি বেড়ে গেল। 'ঐ রিজেক্টেড লেখা তুমি কাকে দেখাবে ?যার হাতে এ লেখা পড়বে, সে কি খুব বাহবা দেবে ভেবেছো, অ্যাঁ? যেখানে আমি নিজেই নিজেরটা বাতিল করে দিয়েছি সেখানে কেন তুমি এই কাজটা করতে গেলে...? শোনো তুমি এখন কোথায়? কত দূরে?'মল্লার বাবুর ধমকের সুরে নার্ভাস হয়ে তোতলাতে থাকে ছেলেটি।' স্যা..স্যার...আমি মানে আ..আমি তো এখন বাসে.. ল্যান্সডাউন ছাড়িয়ে... ' 'তুমি যেখানেই থাকো এসে ঐ কাগজগুলো ফেরৎ দিয়ে যাও... ।' এবার যেন ভেঙে পড়ে ছেলেটি। 'স্যার আমার কথাটা, মানে একবারটি শুনুন... কাউকে দেখানোর জন্য এ কাজ আমি করিনি স্যার...''তাহলে কিসের জন্য করেছো?' আমতা আমতা স্বরে উত্তর আসে 'ভেবেছিলাম স্যার,পাণ্ডুলিপি খানা নিজস্ব  সংগ্রহে রেখে দেবো।আমার একটা বড় যত্নের ফাইল আছে তার মধ্যে... লেখাটা শুধু আমার মন জুড়েই থেকে যাবে...  '।অবাক  হয়ে গেলেন মল্লার বাবু।কিছুটা নরম সুরে বললেন,'কিন্তু সব লেখা তো আর গল্প হয় না..।' বিনয়ী কন্ঠে ভেসে আসে,' আপনার মতো  মানুষের কলমের আঁচড়টুকু তো থেকে যাবে। জীবনে এও কি কিছু কম পাওয়া স্যার..'। এরপর আর যুক্তি চলে না।একটুক্ষন থেমে  মল্লার বাবু বললেন, ' বেশ তোমার যখন এতই আগ্রহ তখন আর ও জিনিস ফেরৎ দিতে হবে না। তবে এটাও বলি, আজ থেকে এ লেখাটার ওপর কোনো দায় কিন্তু  আমার আর রইল না..'। হঠাৎই উৎফুল্ল কন্ঠে আওয়াজ শোনা যায়,' আপনার মুখের কথাটুকুই অনেক। বিশ্বাস করুন স্যার আর আমার কোনো অপরাধবোধ রইলো না..'

 

     ফোনটা রেখে চোখ বন্ধ করে বেশ খানিক্ষণ চেয়ারে বসে রইলেন মল্লার বাবু।  ফেলে দেওয়া কয়েকটা কাগজের পাতা হঠাৎ করে  এতটা মহার্ঘ হয়ে উঠতে পারে তা যে তিনি স্বপ্নেও ভাবতে পারেন নি। মল্লার বাবুর মনে হলো জীবনে এতদূর প্রত্যাশা কি তিনি সত্যিই কোনো পাঠকের কাছ থেকে করেছিলেন? ভাবতে গিয়ে হঠাৎই ভারত পত্রিকার জন্য একটা  ঝকঝকে টাটকা  ছোটো গল্পের প্লট যেন  বিদ্যুৎের মতো ঝলক দিয়ে উঠলো তাঁর মস্তিষ্কে...যে গল্পের মূল কেন্দ্রীয় চরিত্র দুজন।  একজন প্রথিতযশা সাহিত্যিক। আরএকজন তাঁরই গুণমুগ্ধ এক পাঠক। যার সঙ্গে ঘটনাচক্রে ট্রেনের কামরায় লেখক এর পরিচয় এবং তারই সূত্র ধরে কাহিনির অগ্রগতি ;পরিশেষে আজকের অভিজ্ঞতা। শুধু চরিত্রের নামগুলো অদলবদল করে দিতে হবে এই যা...। এক বেলার মধ্যে গল্পটা শেষ করার টার্গেট মাথায় রেখে কলম ধরলেন মল্লার বাবু। তার আগে প্রিয় পাঠকটিকে একবার বড়সড় ধন্যবাদ না জানিয়ে পারলেন না তিনি। 

 

    পরের দিন ঠিক বেলা বারোটা নাগাদ অঘোর বাবু এলেন আশা নিরাশার মাঝে একরাশ দোলাচল নিয়ে। মল্লার বাবু তাঁর আধ ঘন্টা আগে শেষ করা গল্পের ম্যানস্ক্রিপ্টটা এগিয়ে দেবার সাথে সাথেই ভদ্রলোকের নাদুসনুদুস গাল জোড়ায় একরাশ হাসি ফুটে উঠলো...'কি বলে যে আপনাকে ধন্যবাদ...।'

'একবার গল্পটা পড়ে নিন..আমার দিক থেকে ভুল ত্রুটি যদি কিছু...। ' বললেন মল্লার বাবু। 

'ভুল ত্রুটি...কার? আপনার?'

মুখের হাসিটাকে আগের মতোই ধরে রেখে ব্যাগে  রাখা একটা রুপোলী কৌটো থেকে পান বের করে মুখে পুরে ভদ্রলোক বললেন, 'দু মিনিট সময় দেন তো একটা ছোট্ট লাইফ হিস্ট্রি তুলে ধরি?'

'দিলাম। বলুন।'

'বছর কুড়ি কি তারও বেশি আগের আগের কথা। এ প্রত্রিকা, সে পত্রিকার অফিসে ম্যানাসক্রিপ্ট বগলদাবা করে ছুটে বেড়াচ্ছি তখন।এভাবেই একদিন এডিটার'স অফিসে আপনার সঙ্গে পরিচয়..কি তাই তো? আপনি তখন মোটামুটি নাম করেছেন লেখালেখির জগতে। আর আমিও ঠিক আপনারই মতো চোখে একরাশ স্বপ্ন নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি...লেখক হবার স্বপ্ন..।'

    অঘোর বাবুর সঙ্গে মল্লার বাবুর চেনা পরিচয় আজকের নয়। লেখক হয়ে ওঠার বাসনা নিয়ে জীবন শুরু করলেও,প্রারম্ভিক স্তরে কিছু কিছু গল্প    ছোটোখাটো পত্র পত্রিকায় মোটামুটি জনপ্রিয়তা কুড়োলেও ঐ জায়গা থেকে উঠে তেমন কোনো সাফল্যের সিঁড়ি পেরোনো অঘোর বাবুর পক্ষে আর সম্ভব হয়ে ওঠে নি। সে যাই হোক, লেখালেখির সূত্রেই মল্লার বাবুর সঙ্গে ওঁর পরিচয় আর তারই সুবাদে ভদ্রলোক মাঝেমাঝে আসা যাওয়া করতেন বাড়িতে।

 

    একদিন মল্লার বাবুর কাছে এসে ভদ্রলোক নিজেই বললেন,' না মশাই, অনেক তো চেষ্টা চরিত্র করলাম.. জুতোর শুকতলা খয়ে গেল.. দেখলাম কলমের শুধু একগাদা কালিই খরচা করে গেছি এতদিন...কাজের কাজ ঢুঁঢুঁ...গ্যাটেঁর পয়সা খরচ করে বই ছাপিয়ে লোককে বিলি করা ছাড়া আর তো কোনো রাস্তা দেখছি না.. এ লাইন সবার জন্য নয়...একটা নতুন প্ল্যান মাথায় এসেছে...বাড়ির নীচের তলায় যে পৈতৃক ছাপাখানাটা রয়েছে, বাবা মারা যাবার পর মেশিন পত্তর গুলোতে আর সেভাবে হাত পরেনি কারো। এক ব্যাটা কর্মচারী ছিল, সে অন্য জায়গায় কাজ পেয়ে তারপর থেকে আর আসে না। জিনিস পড়ে আছে। অথচ কাজ জানা লোকের অভাব। ভাবছি নীচের ঘরটাকে নতুন রং টং লাগিয়ে, রিপেয়ারিং করে যদি একটা এডিটিং অফিস খুলতে পারি...লেখা আসবে..,বই হয়ে, ম্যাগাজিন হয়ে ছেপে বেরোবে...কমদিন তো আর এ লাইনে চষে বেড়ালাম না...এডিটিং, শর্টিং,প্রূফ রিডিং... কাজগুলো সব চোখের সামনে, কাছ থেকে দেখেছি... সেই অভিজ্ঞতাকেই কাজে লাগিয়ে যদি একটা অফিস খুলে ফেলা যায়...এবার সত্যিই নিজেকে নিয়ে ভাবার সময় এসেছে মশাই...কাল রাত্তিরে নীচের তলার ঘরখানা কি মনে করে ঘুরে দেখতে গিয়ে মেশিন পত্তরগুলোর দিকে তাকিয়ে হঠাৎ আইডিয়াটা মাথায় এলো। করতে পারলে কেমন হয় বলুন তো? 'আপনার যখন অভিজ্ঞতা আছে, দেখুনই না। কে বলতে পারে...।'

' বলছেন?'

চোখে মুখে একরাশ উৎসাহ নিয়ে বলেছিলেন অঘোর বাবু। 

' অবশ্যই আপনি শুরু করুন।'

' দরকার শুধু দুটো জিনিস দাদা। লোকবল। আর আপনাদের মতো গুণী মাণী মানুষের একটু সাপোর্ট। পাশে থাকবেন তো দাদা? অন্য কিচ্ছু নয়। খালি একটু লেখার মাধ্যমে পাশে থাকা... এই আর কি..।'

    তদ্দিনে 'লেখক মল্লার চৌধুরী ' নামটা তড়তড় করে খ্যাতির সিঁড়ি বেয়ে শারদীয়া সংখ্যায় বেস্ট সেলার গল্প, উপন্যাসের তালিকায় মোটামুটি পাকা জায়গা করে নিয়েছে বলাই যায়। 

পূর্ব পরিচয় আর সৌযন্যের খাতিরে লেখক জীবনের হাজারো ব্যাস্ততার মাঝেও অসময়ে মানুষটার পাশে দাঁড়ানোর অনুরোধে না করতে পারেন নি মল্লার বাবু। 

    সম্পাদক অঘোর মিত্তিরের নতুন পেশাগত জীবনের সেই শুরু। তাঁর সম্পাদিত 'ভারত পত্রিকা' তাঁরই নিজের ছাপাখানা থেকে প্রথম প্রকাশিত হলো... সে প্রায় বহু বছর আগের কথা। সেদিনের সেই ছোটোখাটো কলম পত্রিকা আজ এত বছর পেরিয়ে  এসে আকারে,পরিসরে বেড়েছে তো বটেই; পর পর বছর কয়েক হলো বেস্ট সেলার ছোটো পত্রিকার তকমাটাকেও বজায় রাখার ক্ষেত্রে বলা যায় দারুণ ভাবে সফল। 

     পান চিবোতে চিবোতে অঘোর বাবু বলতে লাগলেন আগের কথার রেশ ধরে.. ' লেখালেখির জগতকে একপ্রকার বিদায় জানিয়ে তখন সবে নতুন প্রফেশান শুরু করেছি। একদিন কি একটা কাজে অন্বেষা পত্রিকার দুঁদে সম্পাদক প্রভাকর সরকারের বেনিয়াটোলা লেনএরঅফিসে গিয়ে ঢুঁ মারলাম। প্রভাকর বাবু এককালে বাবার পুরনো বন্ধু ছিলেন। আগে আমাদের বাড়িতে যাতায়াতও করেছেন কয়েকবার। বাবার অবর্তমানে, সময়ের গতিকে তারপর অবিশ্যি আর...। আমাকে এডিটিং  পেশা সম্পর্কে অনেক উৎসাহ ব্যাঞ্জক কথাই  বললেন তিনি। শিক্ষানবিশের মতো শুনে গেলাম। অনেক কথার মধ্যে একটা খুব দামী কথা বলেছিলেন সরকার মশাই..."বুঝলে অঘোর, ওয়েষ্ট পেপার বাক্সে ফেলে দেওয়া হলুদ হয়ে যাওয়া কাগজের গায়ে লেখা অক্ষরও সোনা হয়ে উঠতে পারে, যদি সেটা লেখার মতো লেখা হয়। শুধু দেখবার মতো একটা চোখ দরকার এই যা..।" চোদ্দ  বছর হয়ে গেল আমার এ পত্রিকা অফিসের বয়স। সরকার মশাই আজ আর নেই। কিন্তু ওঁর সেদিনের কথা মনে গেঁথে আছে আজও.."দেখবার মতো একটা চোখ "। সাধে কি আর আপনাদের মতো মানুষের অপেক্ষায়  হাপিত্যেশ করে বসে থাকি দাদা...ডাস্টবিন থেকে রত্ন খুঁজে নেওয়াই যে আমাদের কাজ..। আপনাদের পাশে না পেলে আজ এ পত্রিকা কটা লোকের কাছে পৌঁছোতো বলুন দেখি? '

    ফেলে দেওয়া কাগজ, ডাস্টবিন, রত্ন...প্রতিটা শব্দ যেন অদ্ভুতভাবে কানে এসে বাজছিল মল্লার বাবুর।ভদ্রলোককে আর একটু বাজিয়ে দেখার জন্য হেঁয়ালির সুরে তিনি জিগ্যেস করলেন, 'সবসময় ডাস্টবিন খুঁজলেই বুঝি রত্ন মেলে?'

'তা হয়তো মেলে না। কিন্তু ভাবুন দেখি একবার হলুদ হয়ে যাওয়া ছেঁড়াখোড়া কোনো পাতার গায়ে আপনার কলমের দু দুটো আঁচড় সে পাতার গ্র্যাভিটিকে কোথায় নিয়ে এসে পৌঁছে দেবে..?সোনার আংটির আবার হলমার্ক...। হ্যাঁ, ছাপতে গিয়ে প্রিন্ট মিস্টেক হলে দ্যান্ আই উইল পে ফর দ্যাট...এই নিন স্যার আপনার চেক। আজ তাহলে উঠি।'

    কথার সাথে মুখের কষ বেয়ে পানের পিক গড়িয়ে পড়ার উপক্রম হচ্ছিল আর একটু হলেই।রুমাল দিয়ে  কোনোক্রমে নিজেকে সামলে নিলেন ভদ্রলোক। মূহুর্তের দৃশ্যটা একটু আগে হলে হয়তো স্বাভাবিক কারণে  হাসির উদ্রেক ঘটাতে পারতো মল্লার বাবুর মনে। কিন্তু মূহুর্ত কয়েকের ব্যবধান মানুষের অবস্থানকে বোধহয় সরিয়ে নিয়ে আসতে পারে কয়েক যোজন...। 

 

    বিয়ারার চেকটা মল্লার বাবুর হাতে তুলে দিয়ে সম্পাদক মশাই হাসি মুখে বিদায় নিলেন।

 

    ডাস্টবিনে আজ আর পরে নেই কোনো ফেলে দেওয়া গল্পের পান্ডুলিপি। কেউ আসেনি সেই পান্ডুলিপির সন্ধানে। রত্নের খোঁজে। ড্রয়িং রুমে বসে থাকতে থাকতে এক আশ্চর্য অনুভূতি যেন ক্রমেই ঘিরে ধরছিল মল্লার বাবুর চারিপাশের পৃথিবীটাকে। এ বছরের জন্য শারদীয়া পত্রিকায় শেষ ছোটো গল্প.. কলমের শেষ আঁচড়টুকু যে আত্মতৃপ্তির স্বাদ এনে দিয়েছিল মল্লার বাবুর মনে, ঠিক ততোটাই যেন গভীর..  ততোটাই যেন গাঢ় এই মূহুর্তের এই অচেনা অনুভূতি..! গল্পটা পড়ে শেষ করে ওঠার পর  একই রকম অনুভূতি হয়তো অঘোর বাবুর মনকেও গ্রাস করবে। করতে বাধ্য....। কি অদ্ভুত! কি আশ্চর্য! এমনটাও হয়...!

সেক্রেটারি অজিত ঘরে এলো। 

'স্যার, এই চিঠিটা কেউ ড্রপ বক্সে রেখে গিয়েছিল। সম্ভবত আজই।'

    অন্যমনস্ক মনে চিঠিখানা অজিতের হাত থেকে নিয়ে পড়তে যাওয়া মাত্রই চোখদুটো আটকে গেল মল্লার বাবুর। একটা ছোটো কাগজে ফাউন্টেন পেন এ লেখা খুব চেনা গোটা গোটা হরফে কয়েকটা লাইন..."স্যার, মনের মাঝে জমে থাকা কথাগুলো বলবো বলেই আজ এতো সকালে না এসে আর থাকতে পারলাম না। কাউকে না পেয়ে চিঠিখানা ড্রপ বক্সে রেখে গেলাম। কাল আপনার ওখান থেকে বাড়ি ফিরে আসার পর একটা অনুভূতি ক্রমাগত তারিয়ে নিয়ে বেরিয়েছে আমাকে।এ নিয়ে  নিজের সঙ্গে কম লড়াই করি নি। বারবার প্রশ্ন করেছি নিজেকে। রাত্রে ভালো করে ঘুমোতে পারি নি। অবশেষে অনেক চিন্তা করে দেখলাম, যে লেখার ওপর আপনার কোনো দায় নেই  পাঠক হয়ে সে লেখার ওপর আমারও কোনো দাবি থাকতে পারে না। থাকাটা উচিতও নয়। এ লেখা বরং মুছেই যাক.. শুধু আপনার মন থেকে নয়, আমারো মন থেকে। জানি লেখাটাকে ঘিরে আপনার অনেক টেনশন গেছে। আর চিন্তা করবেন না। কাগজগুলো যেখানে ছিল আবার সেখানেই রেখে গেলাম। ভালো থাকবেন।  ইতি - আপনার গুণমুগ্ধ পাঠক...। 

 

 

.....সমাপ্ত.....

 

 subhanjan Chatterjee