রাঙিয়ে দিয়ে যাও - ঐষিক_মজুমদার



রাঙিয়ে দিয়ে যাও

ঐষিক মজুমদার


    দেরী হয়ে গেল! বড় দেরী হয়ে গেল! - ক্লান্ত, অশক্ত হাতে যন্ত্রের সার্কিট শেষবারের মত ঠিকঠাক করে নিতে-নিতে ভাবলেন অশীতিপর বিজ্ঞানী বাসব রায়। এতদিন পরে সম্ভব হবে কি তাঁর স্বপ্নের সেই রঙীন জগতে ফিরে যাওয়া?
নিজের আবাস এই ধাতব গোলকের স্বচ্ছ জানালা দিয়ে একবার বাইরে তাকালেন বিজ্ঞানী। সেই একঘেয়ে, বৈচিত্র্যহীন ধূসরতা। রুক্ষ, প্রাণহীন প্রান্তরে ইতস্ততঃ ছড়িয়ে রয়েছে আরো কিছু ধাতব গোলক। ক্ষীয়মান জীবনের একমাত্র চিহ্ন। শুধু এই শহর বলে নয়। ভূপৃষ্ঠের সর্বত্রই একই চালচিত্র।

    অথচ একদিন এমন ছিল না। বর্ণময় ছিল আজকের এই মৃতবৎসা পৃথিবী। ছিল উদ্ভিদের সবুজ, পরিণত শস্যের সোনালী, জলাশয়ের নীল, ফুল-পাখি-প্রজাপতির বহুবর্ণ কোলাজ। আর এত রঙের মধ্যেই তাঁর জীবনে এসেছিল আরো রঙীন সেই দিন....

নাঃ, এখন নয়! একটি নিঃশ্বাস ফেলে সবলে নিজেকে বাস্তবে ফিরিয়ে আনলেন বিজ্ঞানী। দেখবেন, তিনি দেখবেন। নিজের জীবনের শেষ রঙীন দিনটির যে স্বপ্ন শয়নে-জাগরণে তাঁর নিঃসঙ্গ জীবনের দোসর হয়ে আছে, না দেখে পারেন কি তা? সেই স্বপ্নকে ঘিরেই তো তাঁর এত আয়োজন!
দেখবেন তিনি অবশ্যই! তবে তার আগে শেষ কাজটুকু সেরে নেওয়া দরকার। অন্যান্য আবিষ্কারের অন্তরালে সারা জীবন ধরে যে সাধনা তিনি করে এসেছেন, এই তার অন্তিম পর্যায়। এতে সফল হলে ওই স্বপ্ন আর থমকে যাবে না মাঝপথে, শূন্যে মিলিয়ে যাবে না অলীক মরীচিকার মত!
মাঝপথে? হ্যাঁ , মাঝপথেই থেমে যায় ওই স্বপ্ন, ঘোর ভেঙে যায় সেই রঙীন, কিন্তু ভয়ঙ্কর মুহূর্তটিতে এসে পৌঁছলেই!
ছোট্ট বাড়িটার সামনে উচ্ছল একঝাঁক তরুণ-তরুণীর ভিড়। তার মধ্য থেকে বেরিয়ে এল অহনা। হাসিমুখে ছুটে আসছে তাঁর দিকে। হাতের মুঠিতে আবীর। উদ্বেল আগ্রহে অপেক্ষা করছেন বাসব।
হঠাৎ কেঁপে উঠল পায়ের নীচের মাটি। ছুটতে-ছুটতেই থমকে দাঁড়াল অহনা। রঙে-রঙে রঙীন তার শরীর সহসা আরো রঞ্জিত হয়ে উঠল উৎকট গাঢ় লাল রঙে। তারপর সব অন্ধকার।
আবার একটি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন বাসব। অহনা তাঁর কলেজের বান্ধবী। প্রায় এক বছর ধরে গাঢ় হয়ে উঠেছিল দু'জনের পরিচয়। তার আমন্ত্রণে হোলির দিন তার বাড়িতে গেছিলেন তিনি।
ষাট বছর আগে সেই অভিশপ্ত হোলির দিনেই এই শহরে আছড়ে পড়ে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঢেউ। বিপক্ষ বায়ুসেনার অতর্কিত বোমাবর্ষণে মৃত্যু হয় অহনা-সহ আরো অনেকের। যারা বেঁচে গেল, তাদের স্থায়ী ঠিকানা হল এই মৃত্যু আর ধ্বংসের সাম্রাজ্য।

     তিন বছর। তিন বছর ধরে চলেছিল সেই যুদ্ধ। মাত্র তিনটি বছরে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল পৃথিবীর অর্ধেক মানুষ, আর তার সাথে মানুষের তিলে-তিলে গড়ে তোলা সভ্যতার অর্ধেক। যে অর্ধেক পড়ে রইল, তাদের জীবন অবরুদ্ধ হল দুঃস্বপ্নের কারায়। বাসব তাদের একজন।
যুদ্ধে যথেচ্ছ ব্যবহৃত হয়েছিল পরমাণু-অস্ত্র। ফলে তেজস্ক্রিয় বিকিরণে আক্রান্ত হল অনেকে। উপার্জনহীন, ব্যাধি-জর্জর জীবন নিয়ে আহত কীটের মত বেঁচে রইল তারা। ক্ষতিগ্রস্ত হল পৃথিবীর রক্ষাকবচ ওজোন স্তর। ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা ক্রমেই বাড়তে লাগল। পরবর্তী কয়েক দশকে আন্টার্কটিকার বরফ গলে জলমগ্ন হল বহু দেশ। অবশিষ্ট অংশে প্রথমে উদ্ভিদ, পরে প্রাণীরা লুপ্ত হতে থাকল। যুদ্ধোত্তর পঞ্চাশ বছরে ধীরে-ধীরে পৃথিবী পরিণত হল এই বিবর্ণ, ধূসর গোলকে।
এরই মধ্যে অতি কষ্টে পড়াশোনা এবং তারপর বিজ্ঞানসাধনা চালিয়ে গেছেন বাসব। চোখের সামনে অহনার বীভৎস মৃত্যু দেখার পর তিনি আর সংসারী হন নি। আজ প্রতিকূল পরিবেশের সাথে মানুষের নিরন্তর সংগ্রামের অন্যতম প্রধান স্তম্ভ বিজ্ঞানী বাসব রায়। আজকের উদ্ভিদহীন পৃথিবীতে বায়ু সংশোধন ও খাদ্য উৎপাদনের পদ্ধতি, বসবাসের অযোগ্য পরিবেশে ধাতব গোলকের এই কৃত্রিম উপনিবেশ, বাইরে চলাচলের বিশেষ পোশাক - এর প্রায় সব কিছুর পেছনেই তাঁর অবদান রয়েছে।

    তবুও, হারছেন তিনি। হারছেন তাঁরা। হারছে সমগ্র মানবজাতি। দ্রুত ফুরিয়ে আসছে সমস্ত ভাণ্ডার। কমছে বিশ্বের জনসংখ্যা। তেজস্ক্রিয়তার বিষে প্রজনন-ক্ষমতা হারিয়েছে অনেকে। যারা সক্ষম, তারা সন্তানধারণে নারাজ। আরেকটি প্রাণকে নিজেদের দুর্ভাগ্যের অংশীদার করতে চায় না তারা।
তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে কেউই জেতে নি - মাঝে-মাঝে ভাবেন বিষণ্ণ বাসব। আরেক মরণপণ লড়াইয়ে তাঁরা এক অবশ্যম্ভাবী এবং চূড়ান্ত পরাজয়কে সামান্য বিলম্বিত করছেন মাত্র।

    তবুও, ফিরে-ফিরে আসে ওই স্বপ্ন। বর্তমানের এই ধূসর বিবর্ণতার তীব্র বৈপরীত্যে বর্ণময় অতীতের সেই আভাস বারে-বারেই উঁকি দিয়ে যায় তাঁর চেতনায়। সেই অধরাকে ধরতেই তাঁর এই উদ্ভাবন, তাঁর গণনাতীত দিনের সাধনার ফল - স্বপ্নসম্ভব!

     হ্যাঁ, তিনি এই যন্ত্রের নাম রেখেছেন স্বপ্নসম্ভব। কৈশোর ও যৌবনে বিজ্ঞানের সাথে সাহিত্যকেও ভালোবেসেছিলেন বাসব। এই নাম তারই প্রতিফলন। তাঁর ভাণ্ডারে আজও মাইক্রোফিল্ম আকারে রক্ষিত আছে বিশ্বসাহিত্যের অমূল্য সব মণিমুক্তো। তাঁর মৃত্যুর সাথে-সাথেই যাবে সব। আজকের নির্মম, নিষ্করুণ জগতে সাহিত্য ও সুকুমার কলার চর্চা অবলুপ্ত। একদিন আলেকজান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগারে বহ্ন্যুৎসবের মধ্য দিয়ে যার সূচনা, সেই বর্বরতার বৃত্ত সম্পূর্ণ হয়েছে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে এসে।

     শেষ সার্কিটটি যথাস্থানে বসিয়ে জেনারেটরের সুইচ অন করলেন বাসব। মৃদু গুঞ্জনে চালু হয়ে গেল যন্ত্র। সেটিকে পাশে টেনে এনে ইজিচেয়ারে ক্লান্ত শরীর এলিয়ে দিলেন তিনি।

     স্বপ্ন দেখার সময় মস্তিষ্কের তড়িৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গের যে সূক্ষ্ম বিচলন হয়, এই যন্ত্র তা অনুভব ও বিশ্লেষণে সক্ষম। সেই ক্ষমতার বলে তাঁর স্বপ্নকেও বিশ্লেষণ করবে এই যন্ত্র। তারপর নির্ধারণ করবে তাঁর মনের গতিপ্রকৃতি। সবশেষে তাঁরই ইচ্ছা অনুযায়ী ওই অর্ধসমাপ্ত স্বপ্নকে পূর্ণতা দেবে সে। নিজের স্বপ্নের ঈপ্সিত পরিণতিটি প্রত্যক্ষ করবেন তিনি। তারপর....না, তারপর কি হবে, তা তাঁরও জানা নেই।

     উদাস দৃষ্টিতে জানালা দিয়ে চেয়ে রইলেন বাসব। ক্লান্তিতে তাঁর চোখের পাতা ঢলে পড়ছে। বাইরে ধাতব গোলকগুলির মধ্য দিয়ে এঁকেবেঁকে এগিয়ে গেছে রুক্ষ পথ। অহনার বাড়ির পথটিও ছিল কিছুটা এমনই। তফাত একটাই। সে পথের দু'পাশে ছিল গাছ, ছিল সবুজ মাঠ। আর এই পথের ধারে আছে প্রাণহীন, বর্ণহীন প্রান্তর...
বর্ণহীন? না, একটু ভুল হল বোধহয়! দূরে দেখা যাচ্ছে না সামান্য সবুজের আভাস? কৌতূহলী বাসব সেদিকে পা বাড়ালেন।
হ্যাঁ, এবারে আর সন্দেহ নেই! ওখানে মাঠ আবার সবুজ ঘাসে ঢেকে গেছে। উত্তেজনায় তাঁর চলার গতি বেড়ে গেল।
এখন বাসবের দু'পাশে গাছের সারি। তাদের সবুজ পত্ররাজির ফাঁকে-ফাঁকে লাল ফুলে আগুনের আভাস। আজ হোলি যে! প্রকৃতিও বুঝি তাই সেজেছে রঙীন সাজে! কি যেন নাম এসব গাছের? হ্যাঁ, মনে পড়ছে! পলাশ, কৃষ্ণচূড়া....
দ্রুত পায়ে, প্রায় দৌড়ের গতিতে চলেছেন তিনি। তাঁর মনে পড়ে যাচ্ছে সব। আরেকটু এগোলেই অহনার বাড়ি। আর....
আর ওই যে অহনা!

     থমকে দাঁড়িয়েছেন বাসব। নিজের হৃদস্পন্দন শুনতে পাচ্ছেন তিনি নিজে। ওদিকে রাস্তার ওই প্রান্ত থেকে খিলখিল হেসে যেন পরীর মতই উড়ে আসছে অহনা! তার হাতের মুঠিতে আবীর।
স্থাণুর মত দাঁড়িয়ে আছেন বাসব। আসছে অহনা, আসছে.....এসে পড়ল! না, থমকে যায় নি স্বপ্ন!
প্রেয়সীর দামাল আক্রমণে বিপর্যস্ত হয়ে পড়লেন তিনি। হাসতে-হাসতে অত্যাচারী দস্যুর মত সে হাতের আবীর মাখিয়ে দিল তাঁর মুখে-গলায়-ঘাড়ে।
"কি হচ্ছেটা কি?" - কপট ক্রোধে তাকে সামান্য ঠেলা দিলেন তরুণ বাসব। পরক্ষণেই আবদ্ধ করলেন তৃষিত দুই বাহুর নিবিড় আলিঙ্গনে....

                                            ***

        হ-৪২ কৃত্রিম উপনিবেশের ক-১ অঞ্চলে বিখ্যাত বিজ্ঞানী বাসব রায়ের বাস -গোলক থেকে পুরো একদিন কোনোরকম সঙ্কেত না আসায় সেখানে অনুসন্ধানকারী দল পাঠাল উদ্বিগ্ন কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক সংস্থা। দলের সদস্যরা গোলকের দরজা ভেঙে দেখতে পেল - জানালার সামনে ইজিচেয়ারে শুয়ে চিরঘুমে ঘুমিয়ে পড়েছেন বর্ষীয়ান বিজ্ঞানী। তাঁর মুখে শুধু আনন্দ আর প্রশান্তি। মাথার পাশে রয়েছে এক বিচিত্রদর্শন যন্ত্র, যার গঠন বা উদ্দেশ্য অনুধাবনের কোনো উপায় এখন আর নেই। স্তব্ধ হয়েছে জেনারেটর, গলে লয় হয়ে গেছে তার সমস্ত সার্কিট।

        পৃথিবীর শোকস্তব্ধ মানুষ জানল - হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে তাদের ছেড়ে চলে গেছেন তাদের অস্তিত্ব-সংগ্রামের চিরস্মরণীয় সেনাপতি মহান বিজ্ঞানী বাসব রায়। শুধু একটি রহস্যের সমাধান কেন্দ্রীয় সংস্থা করতে পারে নি। প্রয়াত বিজ্ঞানীর মুখে, গলায়, পরিধেয় বস্ত্রে লেগে ছিল এক ধরণের সূক্ষ্ম রঞ্জক-চূর্ণ। অনুসন্ধানকারী দলের সদস্যরা প্রথমে বুঝতে পারে নি তা কি।

     তাদের সংগৃহীত নমুনার বিশ্লেষণ এবং কেন্দ্রীয় তথ্যভাণ্ডার অন্বেষণের পর জানা যায়, বস্তুটির নাম আবীর। পুরাকালে হোলি নামে এক অধুনা-বিলুপ্ত উৎসবে তার ব্যবহার ছিল। কিন্তু বিস্মৃত অতীতের সেই রঙ এই বর্ণহীন জগতে কি করে এল - সেই রহস্যের কোনো মীমাংসা এখনও হয় নি।

Oeeshik Majumdar









Comments

Loading... Logging you in...
  • Logged in as
There are no comments posted yet. Be the first one!

Post a new comment

Comments by