ঋত্বিকের মাস্টারপিস লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
ঋত্বিকের মাস্টারপিস লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

খেজুরতলার ইতিকথা -অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়


খেজুরতলার ইতিকথা

অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়


        তেমন গরম পড়েনি এখনও। সন্ধের ঝটকা হাওয়ায় ধুলো উড়ছে এলোমেলো। পার্বতী মেঠো উঠোন ঝাঁট দিচ্ছে সনিষ্ঠ যত্নে।বসে থাকলে চলে না। সে বসে গেলে পরিবারও বসে যাবে।আরো তিনটে ছেলেমেয়ে আছে। কাঁচা বয়েস, কাঁচা মন। তবে পেকে যাচ্ছে অকালের বাতাসে।ঘরের পুরুষটার তেমন নড়াচড়ার ক্ষমতা নেই। পুরুষটা তার শ্বশুরমশাই। প্রায় সর্বক্ষণ শুয়ে থাকে। কি হয়েছে কে জানে। ডাক্তার বদ্যি করার পয়সা কোথায়। দু মাইল দূরের স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে গুলি এনে খাওয়ায় মাঝেমধ্যে। কাজের কাজ কিছুই হয় না তেমন। হাত পা ফুলে উঠছে কেমন। অসাড়ে বিছানা ভিজিয়ে ফেলে যখন তখন। কে সামলাবে এত ঝক্কি। মাটির মেঝেয় খড় পেতে শুইয়ে রাখা হয়েছে লোকটাকে। বুদ্ধিসুদ্ধিও লোপ পেয়েছে মনে হয়। প্রায় সারাক্ষণই নিজের মনে বিড় বিড় করে কি সব বকে নিজের মনে। মাঝে মাঝে নিকুঞ্জ... নিকুঞ্জ করে ডাকে । নিকুঞ্জের কোন সাড়া পায় না। তবু অবুঝের মতো ডাকে। নিকুঞ্জ হল বুড়োর ছেলে । আজ বারো বছর ধরে সদরের জেলখানায় জীবন কাটাচ্ছে। কি অপরাধ পরিষ্কার কেউ জানে না। রেল কোয়ার্টারের পেছনে নাকি ফেলে দেওয়া কয়লা কুড়োচ্ছিল। ফেলে দেওয়া কয়লা— জোড়া তাপ্পি দেওয়া সংসারে যদি এট্টু কাজে আসে। পুলিশে ধরেছিল। তারপর থেকে সদরের জেলখানায়। বারো বছর কেটে গেল এইভাবে। জোয়ান নিকুঞ্জ বুড়িয়ে যেতে চলল। তার অপরাধটা কি আজও তার হদিশ পায়নি সে। উকিল লাগাবার পয়সা কোথায়। সরকার উকিল দিয়েছিল একটা। কিন্তু তাকে ধরাও যায় না, ছোঁয়াও যায় না। বছরের পর বছর কেস ওঠে না কোর্টে। নিকুঞ্জ অনেক ভেবে ভেবে এখন ভাবনার ঘরে তালা চাবি মেরে দিয়েছে। তিনটে বাচ্চার কথা ভেবে খুব কান্না পেত প্রথম প্রথম। এখন মরে গেছে সে জলের সোঁতা। এখন শুধু অ্যাঁকাব্যাঁকা হিসেব করে দিনভর, আর কতদিন সে বাঁচবে। তার বুড়ো বাপটা কি বেঁচে আছে এখনও ? পার্বতী কিভাবে ঘর ছেলেপুলে সামলাচ্ছে , কে জানে । মদন এলে এবার জিজ্ঞেস করতে হবে সবকিছু। মদন বড় ভাল ছেলে। আর ক’বছরই বা সে বাঁচবে। মরার আগে তার দোষটা জানতে পারলে বড় ভাল হত।

  

   তিনটে বৌ কোমরে ঘড়া ভরা ।জল নিয়ে মন্ডলপাড়ার দিকে যাচ্ছে নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বলতে।

 বিকেল ফুরিয়ে গিয়ে সন্ধে ঝুঁকে আসছে। ঝাঁট দেওয়া শেষ করে ঝাঁটাটা দাওয়ার একধারে রেখে মুখ তুলতেই দেখতে পেল মাথা নীচু করে আনমনে কি ভাবতে ভাবতে মদন আসছে।মদন দাস। পার্বতীর বোনপো। দিদির ছেলে।বড় উপকারি ছেলে।প্রায় পাঁচবছর ধরে আগাগোড়া পাশে আছে জানমান দিয়ে। তার আগে ও বড্ড ছোট ছিল।

 মদন কাছে এসে দাঁড়াতে পার্বতী ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল।মদন কিন্তু চোখ তুলল না। মাথা নীচু করেই দাঁড়িয়ে রইল।

— ‘ কিছু হল না, না ? ‘ পার্বতী উদাস এবং প্রত্যাশাহীন স্বরে প্রশ্ন করে, যে প্রশ্ন সে বারো বছর ধরে করে আসছে।

— ‘ না, মানে .... আজ কোর্টে খুব গন্ডগোল । জজ আসেনি... ‘ মদন অপরাধী গলায় জবাব দেয়।

 নতুন কোন কথোপকথন নয়।বছরের পর বছর চলছে একই ধারায়। দিন চলে যায়, শরীর বদলে যায়, পৃথিবী আরও বুড়ো হয়। কিন্তু এ দুনিয়ার বহু মানুষের জীবনের রঙ কখনও বদলায় না।হেমন্তের ধূসর মাঠ পড়ে থাকে অগোচরে, অনাদরে ।

       মদন কাটোয়ার একটা হোটেলে কাজ করে। ভাতের হোটেল। এবেলা ওবেলা মিলে প্রায় তিনশো লোক খায় । মালিক সনৎ বরাট খুব ভাল লোক। অনেক চেষ্টা করেছে নিকুঞ্জর জন্য একটা ভাল উকিল যোগাড় করে দেবার । কিন্তু এত বছরেও সেটা হয়ে উঠল না। এটা হয় তো, ওটা হয় না। ওটা হয় তো এটা হয় না। ‘অন্তত জামিনের ব্যবস্থাটা যদি হয়ে যেত.... তারপর মামলা গড়ায় গড়াক। আমি শীল বাবুকে বলে রেখেছি। মদন দেখিস তুই এবার মামলা উঠবেই।’ এই করে করে বারো বছর গেল। মদন চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে।তার আর কোন তাপ উত্তাপ হয় না এসব শুনে। এত বছর ধরে এত শুনেছে এসব কথা। সনৎ বরাটের মন খারাপ হয়ে যায় মদনের নির্বাক হতাশ মুখের দিকে তাকিয়ে। বলে, ‘ আমার কি আর খারাপ লাগে না ! খুব খারাপ লাগে, বুঝলি মদন, খুব খারাপ লাগে । এতগুলো বছর গেল কিছুই করতে পারলাম না নিকুঞ্জর জন্য .... তবু হাল ছাড়িস না, বুঝলি মদন, হাল কখনও ছাড়তে নেই। ব্যবস্থা একটা হবেই।’

       সেদিন বাড়ি ফেরার পথে মদন দেখল স্টেশনের বাইরের দোকানে গরম গরম জিলিপি ভাজা হচ্ছে। যেমন মুচমুচে লালচে বরণ তেমনি রসে চুপচুপে।মদনের জিভে জল এসে গেল। পকেটে মোট পঁয়ত্রিশ টাকা আছে। তাছাড়া কিছু খুচরো পয়সা আছে। তিনটে জিলিপি কিনল।পনের টাকা লাগল। মদন দোকানের সামনে পাতা বেঞ্চে বসল শালপাতার ওপর রস গড়িয়ে পড়া তিনটে গরম জিলিপি নিয়ে।গরম জিলিপি একটা ছোট কামড়ে মুখের ভেতরে নিল সে। পরম আবেশে মদনের চোখ বুজে এল। সংসারের সব যন্ত্রনা যেন কর্পূরের মতো উবে গেল । আ: কি সুখ !


       মদনের বাবা তারকনাথ মারা গেছে বারো বছর আগে, সাপের কামড়ে। চক্রবর্তীদের জমিতে কাজ করে মাঠের মধ্যে দিয়ে শর্টকাট করছিল বাড়ির দিকে। ভর সন্ধেবেলা। সূয্যি পাটে গেছে। ভাল করে দেখা যায় না কিছু । অসাবধানে গায়ে পা পড়ে গিয়েছিল । জাত কালসাপ। নিমেষে ছোবল মারল। চিৎকার শুনে বিধু মন্ডল ছুটে এল কাছের কুঁড়ে থেকে।দুচারটে লোকজনও জড়ো করল। কিন্তু বিশেষ কিছু করা গেল না। কর্ত্তব্য ঠি ক করতে করতেই সরসর করে বিষ উঠে গেল মাথায়। সদরের হাসপাতাল ওখান থেকে দশ মাইল দূরে। ওরা তৈরি হয়েছিল যাবার জন্য। কিন্তু তারকনাথের ভবিতব্য তাদের সে সময় দিল না। চলে গেল অকালে।মদনের বয়েস তখন মোটে তেরো।


       মদনের মা শেফালি গরু চরানোর কাজ করে চার বাড়ি। ঢেঁকিতে পাড়ও দেয় ঘোষাল বাড়ি। মদন ক্লাস এইট অব্দি পড়েছিল অচিন্ত্যমোহন  বিদ্যাভবনে। তার পর আর সম্ভব হল না। কাটোয়া স্টেশনের ধারে সনৎ বরাটের ভাতের হোটেলে কাজে লেগে গেল। এখন তার চব্বিশ/ পঁচিশ বছর বয়েস। তার খুব ইচ্ছে সেও একদিন একটা ভাতের হোটেলের মালিক হবে। সনৎ বরাটও তাকে খুব উৎসাহ দেয়। বলে, ‘ লেগে থাক মদন, তোরও একদিন হবে , ঠি ক হবে। এখন এই নিকুঞ্জটার জন্যই বড় চিন্তা।যদি একটা জুতসই উকিল পাওয়া যেত ..... ।’ সনতের মতো লোক হয় না। বারো বছর ধরে নিকুঞ্জর দু:খ বহন করে চলেছে। এর মধ্যে দুনিয়ার কত কিছু বদলে গেল। কত লোক এল, কত লোক গেল। নিকুঞ্জটা জেলে পচে মরছে বিনা দোষে। কবে যে কি হবে.... । বড় নরম সরম মানুষ সনৎ বরাট। কি করে যে কারবার চালায় কে জানে। ধড়িবাজ লোকের তো অভাব নেই। ওপরওয়ালা বোধহয় নরম মানুষের মাথায় খানিক স্নেহের হাত রাখেন কখনও সখনও।

 

      তার মা আর তার মাসী পার্বতীর খুব মিলমিশ। জেলখানায় তার মা আর মাসী অনেকবার গেছে মেশোমশায়ের সঙ্গে দেখা করতে।মদনও গেছে বেশ কয়েকবার। দেখা করা সহজে হয় না। তার জন্যও জেলের গেটে গিয়ে ধরা করা করতে হয়। ঘুষ দিতে হয়। অন্তত বিড়ি সিগারেট। তাদের মতো গরীব মানুষ এর বেশি আর কিই বা দেবে। তারা আশাও করে না এর বেশি । এখন আর জেলখানায় যায় না অনেকদিন হল। মনটা বড় খারাপ হয়ে যায়। মেশোর খুব কষ্ট। প্রথমদিকে কান্নাকাটি করত। এখন অনেকটা সামলে নিয়েছে।মদন ভাবে এ বছর পুজোর মধ্যে যে করে হোক উকিলের ব্যবস্থা করবেই। জামিনটা একবার হলে হয়। তারপর নয় লড়াই করা যাবে। সনৎ বরাটও চেষ্টায় আছে । দেখা যাক কি হয়। মাসী খুব যুদ্ধ করছে। কত ঝড় জল সয়ে তিনটে বাচ্চাকে বড় করে তুলছে। গ্রামের ইস্কুলেও ভর্তি করেছে। পড়াশোনায় অবশ্য মন নেই কোনটার। শুধু মিড ডে মিল খাওয়ার জন্য ইস্কুলে যায়।

 

   বর্ষাকাল এসে গেল ।ঘরের চালে খড় দেওয়ার দরকার। জীবন জীবনের মতো চলে।পেছনে তাকায় না। পুজোর আর মাস তিনেক বাকি। তার আগে কি উকিল যোগাড় হবে ? তাদের তো টাকা পয়সা নেই। উকিলবাবুরা বিনি পয়সায় খাটবেই বা কেন। তাদের কত কাজ। নিশ্বেস ফেলার ফুরসত নেই। সনৎ বরাট একবার একজনের সঙ্গে কথা বলেছিল। সে কোর্টে উকিলদের বসার জায়গায় তার সঙ্গে দেখা করতে বলে। কিন্তু পরপর পাঁচদিন বিভিন্ন সময়ে গিয়েও তার দেখা পায়নি মদন। তারপর হাল ছেড়ে দেয়। অবশ্য হাল ঠি ক ছাড়েনি।বলা যায়, দাঁত কামড়ে পড়ে আছে লড়াইয়ের মাঠে আরও কড়া লড়াই দেবার জন্য।

 

       শিবব্রত সান্যালের তিন পুরুষের পেষা ওকালতি। ভবানীপুরে পেল্লায় বাড়ি। রাজপ্রাসাদ বলা যায়। তিনি নিজেও বাগুইহাটিতে আড়াই  হাজার স্কোয়্যার ফিটের ফ্ল্যাট কিনেছেন বছরখানেক আগে। এখন সেখানেই থাকেন। বাড়ির কাজের লোকের উপস্থিতি বাদ দিলে বাড়ির সদস্য সংখ্যা চার। স্বামী স্ত্রী এবং দুটি সন্তান। দুটিই ছেলে। বড়টির বয়স বারো। ছোট ছেলের বয়স দশ। সমস্যা বড় সন্তানটিকে নিয়ে। এ এস ডি অর্থাৎ অটিস্টিক স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার  আক্রান্ত। প্রকৃতি বা নিয়তি জীবন ঢাকবার জন্য গোটা চাদর কাউকে দেয় না। একটা দিক ঢাকতে গেলে আর একটা দিক উদোম হয়ে যায়। জীবনের একদিকে সতেজ সজীব বৃষ্টি অরণ্য থাকলেও আর একদিকে ধু ধু মরুভূমি জেগে থাকে, ঠি ক পৃথিবীপৃষ্ঠের মতো।সব মিলিয়েই প্রকৃতি এবং পৃথিবী।মরু এবং অরণ্য একে অপরের পরিপূরক। মানুষের জীবনও ঠি ক তাই।একদিক ভরা, একদিক খালি। না হলে বহমানতা বজায় থাকে না। পূর্ণ এবং শূন্য , এই দুই প্রান্তের প্রবহমান চলাচলে গতিষ্মান থাকে জীবন। সেই কারণেই হয়ত শিবব্রত সান্যালের এক দিক ধূসর যন্ত্রণাময়। সেই যন্ত্রনার রূপ হল তার বড় ছেলে শুদ্ধসত্ত্ব বা বাবিন।কোটি কোটি টাকার সুখময়তায় চাপা দেওয়া যায় না কোন কোন ব্যথার কাঁটা। থেকে থেকে ছোবল মারে কষ্টের কালসাপ।

      ছোট ছেলে অতলান্ত একবারেই স্বাভাবিক। চনমনে এবং বুদ্ধিদীপ্ত। দশ বছর বয়েস। আপনমনে খেলে বেড়ায়। আপনমনে হোমওয়ার্ক করে, নিজে নিজেই তৈরি হয়ে স্কুলে যায়, গৃহশিক্ষকের কাছে পড়তে বসে। তার মা বাবার সময় নেই তার দিকে নজর দেবার। তা নিয়ে তার কোন অনুযোগ নেই। বাবা তার পেশাগত কাজে চব্বিশ ঘন্টা ব্যস্ত। তার ছেলেরা কোন ক্লাসে পড়ে সে খবরই তিনি রাখেন কিনা সন্দেহ।বাবিন এখন আর স্কুলে যেতে পারে না। তার মা সবসময়েই তাকে নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। নিজে মাল্টিন্যাশানাল কোম্পানির চাকরি ছেড়ে দিয়েছে বাবিনের দেখভাল করার জন্য। সন্তান বড় মায়ার জিনিস। গর্ভের নাড়ি ছেঁড়া ধন। শিবব্রতবাবুরও বুকে হাহাকার আছে। তিনি হাহাকারের শূন্য গহ্বর চাপা দিয়ে রাখেন ভারি ভারি কাজের পাথর দিয়ে।

    শিবব্রতবাবু ভাবলেন, কাজের থেকে ছুটি চাই একটু। পরিবারের সকলেরই ছুটি চাই, ভরাট প্রবল কর্মের ফাঁস আলগা হওয়ার দরকার। স্ত্রী স্বাতীলেখারও দরকার, দুই ছেলেরও দরকার।স্বাতীলেখার সঙ্গে পরামর্শ করে ঠিক করলেন উত্তরাখন্ডের দিকে যাবেন। প্রথমে যাবেন হরিদ্বার আর মুসৌরি তারপর রানীক্ষেত, আলামোড়া, কৌসানি।

 

       সনৎ বরাট বলল, ‘ কাল সকালে তোকে নিয়ে একবার কলকাতায় যাব শিবব্রত উকিলের বাড়ি , বুঝলি মদন। মস্ত উকিল। আমার ভায়রা ভায়ের খুব চেনা।ওকে দিয়েই যোগাযোগ করিয়েছি, অনেক বলে কয়ে। তা, উকিলবাবু কাল সকাল এগারোটায় টাইম দিয়েছে। কলকাতায় ভবানীপুরে বাড়ি, বুঝলি মদন। কাল সকালে ছটা বত্রিশের ট্রেন ধরব। কাগজপত্র যা আছে সঙ্গে নিয়ে আসিস।’

  মদন কৃতজ্ঞতা মাখা চোখে সনতের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আচ্ছা ঠিক আছে।’

মদন ভাবল মাসীর বাড়ি একবার যেতে হবে ।কাগজ বলতে থানা থেকে দেওয়া বর্ধমান কোর্টের স্ট্যাম্প মারা কি একটা পড়চা আছে। আর জেল থেকে দেওয়া কোর্ট অর্ডারের একটা কপি আছে।ওইটা খুঁজে বার করতে হবে।

  

   বেলা পৌনে এগারোটা নাগাদ ভবানীপুরে শিবব্রত সান্যালের প্রায় একশো বছরের পুরনো বাড়ির বিশাল দরজার পাশে  কলিং বেলে দুরুদুরু বুকে চাপ দিল সনৎ বরাট। পাশে দাঁড়িয়ে মদন। একজন টাকমাথা রোগামতো লোক দরজা খুলে তাদের দিকে তাকিয়ে রইল।

 — ‘ আজ্ঞে আমাদের আজ অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল স্যারের সঙ্গে। ওই মহেন্দ্র .... মানে, মহেন্দ্র বিশ্বাসের সঙ্গে কথা হয়েছিল ....’

   টাকমাথা লোকটি একেবারেই কথা বাড়াল না। বলল, ‘ আসুন, ওপরে আসুন । স্যার আসছেন এক্ষুণি ।’ লোকটি তাদের দোতলায় নিয়ে গেল। সনৎ স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। মনে মনে ভাবল, যাক এক গাঁট পেরনো গেল।

  লোকটি আবার বলল, ‘ এই যে, এইদিকে আসুন।এই বারান্দা দিয়ে সোজা গিয়ে ওই ডানপাশের ঘরটায় বসুন।স্যার আসছেন।’

   সনৎ আর মদন ওই ঘরে গিয়ে ঢুকল।ঘরে বনবন করে পাখা ঘুরছে। মাঝারি সাইজের ঘর। উকিল বাবুর বসার চেয়ার টেবিল রয়েছে। টেবিলের সামনে দুটো চেয়ার এবং তার পেছন দিকে জনা চারেক লোক বসার মতো একটা সোফা রয়েছে। দরজার পাশেও দুটো ফাইবারের চেয়ার রয়েছে। বিরাট উঁচু সিলিং। দেয়ালে কোন ক্যালেন্ডার নেই। উকিলবাবুর চেয়ারের পেছনে শুধু  বিবেকানন্দের একটা বাঁধানো ছবি টানানো আছে।

   ফুল স্পীডে ঘোরা পাখার হাওয়ায় টেবিলের কাগজপত্র ফরফর করে কাঁপছে। টেবিলের একপাশে ডাঁই করে রাখা প্রচুর ফিতে বাঁধা ফাইল। সনৎ আর মদন পেছনের সোফায় গিয়ে বসল। নীচে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি রোড থেকে অবিশ্রান্ত গাড়ি চলাচলের আওয়াজ আসছে।

  

    তারা দুজন চুপচাপ বসে শিবব্রত সান্যালের জন্য প্রতীক্ষা করতে লাগল। সনৎ একবার বলল, ‘ আজ মনে হয় বৃষ্টি হবে।কেমন গুমোট পড়েছে।’ মদন বলল, ‘ হ্যাঁ তা হতে পারে।’ সনৎ আবার বলে, ‘ দুটো তেইশে কাটোয়া লোক্যাল আছে.... যদি কাজ হয়ে যায়.... কোথাও চাট্টি খেয়ে নিয়ে ... ওই গাড়িটা....’

এইসময়ে কে একটা ঘরে এসে ঢুকল।সনৎরা শিবব্রতবাবু এলেন ভেবে তটস্থ হয়ে দাঁড়িয়ে উঠল। ও হরি ! এ যে একটা বাচ্চা ছেলে।

   ছেলেটা একটা ফুলপ্যান্ট আর ফুলশার্ট পরা। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে তাদের দেখতে লাগল।এগারো বারো বছর বয়স হবে ছেলেটার। রঙ খুব ফর্সা। সনৎ একটু হেসে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ল। ছেলেটার মধ্যে কোন ভাবান্তর দেখা গেল না। সে ওইভাবে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রইল ওদের দিকে।ভাবলেশহীন দৃষ্টি। ওকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মদন ওকে হাতছানি দিয়ে ডাকল।কে জানে কি কারণে ছেলেটার মুখে হাল্কা হাসি ফুটে উঠল। একটা চার বছরের ছেলের মতো হঠাৎ হুড়মুড় করে মদনের দিকে ছুটে এল। যেন অনেক দিনের চেনা লোক। ছুটে এসে মদনের পাশে বসল। বসে বুকের কাছে হাত দিল।বুকে নাক লাগিয়ে কিসের যেন গন্ধ শুঁকল।তারপর মদনের পাশে সোফায় হেলান দিয়ে বসল।

   এইসময়ে শিবব্রত সান্যাল ঘরে ঢুকলেন। ক্লায়েন্টের পাশে বাবিনকে শান্ত হয়ে বসে থাকতে দেখে বেশ অবাক হয়ে গেলেন। তার চেম্বারে এত ক্লায়েন্টের আনাগোনা। কিন্তু এহেন দৃশ্য তিনি কখনও দেখেননি। যাই হোক, পরম স্নেহভরে তিনি বাবিনকে বললেন, ‘ তুমি ভেতরে যাও বাবা.... এখানে থাকে না... ‘

বাবিনের কিন্তু বিশেষ প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না বাবার কথায়।সে হেলান দিয়ে বসেই রইল মদনের বাহুতে হাত দিয়ে।ডাকসাইটে আইনজীবী শিবব্রতবাবু তার চেয়ারে এসে বসলেন এবং তার হৃদয়ের অতি কোমল জায়গা শুদ্ধসত্ত্ব বা বাবিনের দিকে কোমল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।

 — ‘ আসুন ...’  শিবব্রতবাবু মদনদের দিকে নজর ঘোরান। সনৎ আর মদন উঠে গিয়ে উকিলবাবুর উল্টোদিকের চেয়ার দুটোয় বসল। বাবিনও উঠে গিয়ে মদনের পাশে দাঁড়াল। শিবব্রতবাবুর বেশ অবাক লাগছে। নিজের মা বাবা ছাড়া আর কারো সঙ্গে বাবিনের এমন প্রতিক্রিয়া কখনও দেখেননি। তিনি মামলাটার কথা ভুলে গিয়ে বাবিনের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

   ‘ আজ্ঞে , মহেন্দ্র বিশ্বাস আমার ভায়রা হয়।আপনার ভরসাতেই আমরা..... ‘ সনৎ সময় নষ্ট না করে আসল কথাটা পাড়ে ।

— ‘ ও হ্যাঁ হ্যাঁ ... বলুন, বলুন ...’ শিবব্রত সান্যালের সম্বিৎ ফেরে। তিনি নিজের জগতে ফিরে আসেন।

       তিনি সনৎ বরাটের কাছ থেকে নিকুঞ্জর ব্যাপারে খুব মন দিয়ে সব কিছু শুনলেন। মামলার ধরণ অবশ্য তার কাছে খুবই পরিচিত।এরকম পেটি কেসে মুরুব্বির জোর নেই বলে কোর্টে কেস উঠছে না বছরের পর বছর এবং জেলে অকারণে পচে মরছে, এ সব ব্যাপার তার মতো আইন কানুনের মাঠে পোড় খাওয়া খেলোয়াড়ের অজানা থাকার কথা নয়। কাজেই মামলার সারাৎসার তিনি সহজেই বুঝে নিলেন। এই সময়ে তার আবার চোখ গেল বাবিনের দিকে। বাবিন মদনের চেয়ারে একটু জায়গা করে নিয়ে একেবারে তার কাছ ঘেঁসে বসে আছে।যারা ওকে চেনে সবাই বুঝবে যে, বাবিনের বিহেভিয়ারাল প্যাটার্নে এটা একটা অভূতপূর্ব ঘটনা।মদন স্বাভাবিক বাৎসল্যস্নেহবশত: তার একহাত বাবিনের কাঁধে রাখল। ওর দিকে তাকিয়ে হাসল। বাবিনও একগাল হেসে মদনকে ডানহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরল এবং সবাইকে চমকে দিয়ে পরিষ্কার উচ্চারনে ( যা এখন পর্যন্ত বাবিনের মুখে কেউ শোনেনি )বলল, ‘ মদন... বাবা....’। মদন অবাক হয়ে বাবিনের দিকে তাকিয়ে রইল। বাবিনের বিচক্ষণ এবং বিদগ্ধ আইনজীবী পিতা প্রবল বিস্ময়ে প্রস্তরীভূত হয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে বসে রইলেন।

   এইসময়ে সেই রোগামতো টাকমাথা লোকটি হন্তদন্ত হয়ে ঘরে এসে ঢুকল। ‘ এ: হে ... এই যে বাবুসোনা ..... তুমি এখানে! আমি এদিকে সারা বাড়ি খুঁজে মরছি।কিছু হয়ে গেলে বৌদিদিমনি কি ভাববে ! ইশশ্ ....‘  মদনের চেয়ার থেকে  বাবিনকে ছাড়িয়ে নিয়ে যাবার জন্য টানাটানি করতে লাগল। বাবিন এদিকে মদনের সঙ্গে এঁটে বসে আছে। টানাটানিতে বিশেষ ফল হল না। লোকটা আবার বলতে লাগল, ‘ ... এ: হে এমন করে না বাবুসোনা ... মা ডাকছেন.... চল ...চল ... বাপিকে কাজ করতে দাও ‘। কে জানে কোন অজ্ঞাত কারণে বাবিনকে একচুলও টলানো গেল না। শিবব্রতবাবুর বিস্ময়ের মাত্রা এতক্ষণে আকাশ ছুঁয়েছে। বাবিনের মধ্যে যে এমন নিজস্ব ইচ্ছা প্রকাশ করার জেদের অস্তিত্ব আছে তা বারো বছরের মধ্যে তিনি এই প্রথম জানলেন।তিনি ধীর স্বরে লোকটিকে বললেন, ‘ ওকে ছেড়ে দাও ভবানী.... তুমি যাও... ‘। টাকমাথা লোকটির নাম বোধহয় ভবানী।

 

   শিবব্রত কাজে ফিরে এলেন।বললেন, ‘ দিন , কাগজগুলো দিন। ‘

 বহু বছর ধরে সযত্নে গুছিয়ে রাখা দুটো কাগজ বার করে শিবব্রত সান্যালের দিকে বাড়িয়ে ধরে সনৎ বলল, ‘ এই দুখানাই আছে। একটা থানার কাগজ, আর একটা কোর্টের.......’

— ‘ ঠিক আছে , যা আছে তাই দিন।অরিজিনালগুলো দেবেন।চিন্তা নেই আমি জেরক্স করিয়ে নিয়ে এগুলো পরে আপনাকে ফেরত দিয়ে দেব ’ , শিবব্রতবাবু বললেন। তিনি আরও বললেন—‘প্রথম কাজ হল কেসটা কলকাতার কোন কোর্টে ট্রান্সফার করা, নাহলে আমি পার্সোনালি অ্যাপিয়ার হতে পারব না।তারপর হিয়ারিং-এর ডেটের জন্য একটা পিটিশান ইনভোক করতে হবে।হিয়ারিং-এর ডেটটা পেয়ে গেলে কেসটা আমার আওতায় আসবে। সেটা করে ফেলতে পারব আশা করি।এখন দেখতে হবে আই পি সি কত নম্বরে ফেলেছে কেসটা।এসব কেস সাধারণত: দুশো পাঁচ বা দুশো ছয়ে ফেলে।ঠিক আছে কোন চিন্তা করবেন না।এটা কোন কগনিজেবল অফেন্স নয়। আমি আছি আপনাদের সঙ্গে। আমি কাজ শুরু করছি । সামনের মঙ্গলবার আমাকে একটা কল দেবেন দুপুর একটা নাগাদ।’

   শিবব্রতবাবু একটানা বলে থেমে গেলেন এবং সব কিছু ভুলে গিয়ে আবার বাবিনের দিকে তাকিয়ে রইলেন। দেখলেন, বাবিন মদনের কাঁধের কাছে মাথা হেলান দিয়ে বসে আছে নীচের দিকে তাকিয়ে।

      সনৎ বলল, ‘ আজ আমরা তালে উঠি স্যার....’ , তারপর মদনের সঙ্গে চোখ চাওয়া চাউয়ি করে বলল, ‘ ..... স্যার আজ আপনাকে .....মানে...কত....’

       শিবব্রত সান্যাল সনতের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে যে কথাটা আগে কখনও বলেননি,সেই কথাটা বললেন, ‘ কিছু দিতে হবে না। আগে কাজটা করি তারপর ওসব ভাবা যাবে । আপনারা কোন চিন্তা করবেন না। চিন্তাটা আমাকে ট্রান্সফার করে দিন। মহেন্দ্র আমার অনেকদিনের পরিচিত ....। ‘

     যখন তিনজনেই ভাবছে কি করে মদনকে আঁকড়ে থাকা বাবিনকে আলাদা করা যায় ঠিক সেই সময়ে বাবিন কি জানি কি কারণে মদনের কাঁধের ওপর ঘুমে ঢলে পড়ল।শিবব্রতবাবু দাঁড়িয়ে উঠে উৎকন্ঠা ভরা গলায় চেঁচিয়ে উঠলেন— ‘ ভবানী...... ভবানী..... ।’ ছুটে এল রোগাসোগা টাকমাথা ভবানীচরণ।

 

  নীচে নেমে মদন আর সনৎ পেট ভরে ভাত খেল একটা পাইস  হোটেলে।’কাটোয়ায় আমরা এর চেয়ে অনেক ভাল চালের ভাত খাওয়াই খদ্দেরকে।’ সনৎ বলে।

‘ কিন্তু ছেলেটার ব্যাপার কিছু বুঝতে পারলি ? হঠাৎ তোকে কেন....’  মদন বলে , ‘ কি জানি, বুদ্ধিতে কিছু আসছে না...’

 

      মদন পরের দিন পার্বতী মাসির বাড়ি গিয়ে পৌঁছল প্রায় সন্ধেবেলা। পার্বতী বাড়ির পেছনের মাঠ থেকে একটা গরুর দড়ি ধরে আস্তে আস্তে হেঁটে আসছে।গরুটা দুধ টুধ কিছু দেয় না। শখে পোষা, স্নেহবশত:। কলকাতার উকিলের বৃত্তান্ত শুনে পার্বতীর  বিশেষ ভাবান্তর হল না। বারো বচ্ছর ধরে এমন অনেক কিস্যা সে শুনে আসছে।কাজের কাজ কিছুই হয়নি। কুঁড়ের বাঁ পাশে আমগাছগুলোর ওপরে সাঁঝের আঁধার ঘন হয়ে নেমে আসছে। মদনের মুখে সব শুনে টুনে ‘ অ , তা ভাল....’ বলে গোয়ালে গরুটা বেঁধে রেখে ঘরের ভেতরে গেল। ঘরে শুয়ে থাকা লোকটা দুপুরে আবার বিছানা ভিজিয়েছে। দুর্গন্ধে টেক্কা যায় না।সারাদিনে নিশ্বাস ফেলার ফুরসৎ নেই। এখন পোস্কের টোস্কের করতে হবে যেভাবে হোক।নাজেহাল অবস্থা একেবারে।ছেলেমেয়েগুলো দাওয়ায় পড়তে বসবে একটু পরে।

 

      পরের মঙ্গলবার দুপুর ঠিক একটার সময়ে সনৎ শিবব্রত সান্যালের মোবাইলে কল দিল তার হোটেলে বসে। সনতের মনে হল শিবব্রতবাবু যেন তার ফোনের জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। ওদিক আওয়াজ এল, ‘ হ্যাঁ, হ্যালো .... কাজ এগিয়েছে .... হিয়ারিং-এর ডেট বার করেছি... অনেক কষ্টে কেসটা ব্যাঙ্কশাল কোর্টে ট্র্যানজিটও করা গেছে।’ উকিলবাবুর গলায় প্রবল উচ্ছ্বাস, যা শুনে , যারা তাকে চেনে তারা বেশ অবাক হবে। এমন দ্রুতগতির প্রচেষ্টা তার পেশাগত জীবনে বিরল বলা যায়।

     সে যাই হোক, সনৎ আবেগে আপ্লুত হয়ে বলল, ‘ ধন্যবাদ স্যার, অনেক ধন্যবাদ.... মানে কি বলব স্যার....আপনি যা করলেন আমাদের জন্য.... কি বলব .... ‘

    ওদিক থেকে শিবব্রতবাবু আবার বললেন, ‘ ..... হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিক আছে ..... ওসব পরে হবে’খন ....আপনারা কুড়ি তারিখ, মানে এই সোমবারের পরের সোমবার সকাল দশটা নাগাদ ডালহৌসির ব্যাঙ্কশাল কোর্টে পৌঁছে যাবেন।আমি ওখানে থাকব। চেষ্টা করব যাতে সিঙ্গল হিয়ারিং-এ ভারডিক্ট হয়ে যায়।আর হ্যাঁ, মদনবাবু যেন অবশ্যই থাকে। ওর সঙ্গে অনেক দরকার আছে।’

 

   ধুরন্ধর আইনজীবী শিবব্রত সান্যালের কেরামতিতে সত্যিই  বারো বছর ধরে আটকে থাকা  নিকুঞ্জ দাসের জামিনের রায় মাত্র দু ঘন্টার মধ্যে বেরিয়ে গেল। এখন কোর্টের বর্ধমান সংশোধনাগারে পৌঁছন পর্যন্ত অপেক্ষা । তারপর নিকুঞ্জ তার গাঁয়ের বাড়িতে ফিরে যেতে পারবে। শিবব্রতবাবু বললেন, এর পরের কাজ হল কেসটা ডিসমিস করানো। সেটাও নাকি খুব শীঘ্র হবে।

  কোর্ট থেকে বেরিয়ে গাড়ির পার্কিং স্লটের দিকে হাত দেখিয়ে শিবব্রতবাবু বললেন, ‘ আসুন...’

— ‘ আজ্ঞে কোথায় ? ‘ সনৎ বলে।

—- ‘ এ..ই আমার বাড়িতে একটু যেতে হবে। একটু দরকার ছিল...আমার ড্রাইভার আপনাদের ঠিক সময়ে হাওড়া স্টেশনে ফেরবার গাড়ি ধরিয়ে দেবে। .... না না ওসব ব্যাপার নয়। কিছু দিতে হবে না । সামান্য ব্যাপার.... আসুন আসুন....’

মদন আর সনৎ অবাক হয়ে মুখ চাওয়া চাউয়ি করে।

 

    গাড়িতে শিবব্রতবাবু সনৎ আর মদনের সঙ্গে পিছনের সিটে বসলেন। মদন মাঝখানে , বাকি দুজন দুপাশে।গাড়ি রেড রোড দিয়ে মেয়ে রোডে গিয়ে পড়ল। এরপর পার্ক স্ট্রীট ফ্লাই ওভার ধরবে।শিবব্রতবাবুকে একেবারেই তার পরিচিত ধরণে দেখা যাচ্ছে না। তিনি এতক্ষণ চুপ করে বসেছিলেন।এবার বললেন, ‘ সেদিন আপনারা যাওয়ার পর থেকে আমার বড় ছেলে বাবিনের একটা আশ্চর্যজনক পরিবর্তন হয়েছে। সব কথা মোটামুটি পরিষ্কার বলতে পারছে , যেটা সে এতদিন পারত না।এতদিন আমরা অনেক ট্রি টমেন্ট   করেছি, কিন্তু সেরকম ইমপ্রুভমেন্ট কিছু হয়নি।সেদিন মদনবাবুর টাচে এসে কি ব্যাপার ঘটল কিচ্ছু বুঝতে পারছি না। প্রায়ই বলছে মদন আমার ছেলে.... কত বড় হয়ে গেছে । সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হল সে আপনাদের গ্রামের নামও বলছে। বলছে খেজুরতলায়  যাব। আজই যাব। মদন তোমার গ্রামের নাম কি খেজুরতলা  ?’

মদন বলল, ‘ আজ্ঞে হ্যাঁ ‘

 

    শিবব্রতবাবু বাড়িতে পৌঁছে ওদের দুজনকে নিয়ে ওপরে গেলেন এবং অফিস রুমে বসালেন।নিজেও বসলেন। তিনি মদনকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ আচ্ছা মদন , তোমার বাড়িতে কে কে আছেন ? নিকুঞ্জ দাস তো তোমার মেশোমশাই হন ?’

— ‘বাড়িতে শুধু আমার মা আছে,আর কেউ নেই। হ্যাঁ উনি আমার মেসো।’ মদন উত্তর দেয়।

— ‘ আর তোমার বাবা ?’

— ‘ বাবা মারা গেছে অনেকদিন আগে।আমার তখন বারো তেরো বছর বয়স।’ মদন জানায়।

— ‘ তা মোটামুটি কতদিন আগে হবে ?’

— ‘ তা ধরুন বারো বছর হবে ।’

— ‘ বারো বছর ! একদম ঠি ক তো ? শিবব্রতবাবুর কপালে দুটো ভাঁজ পড়ে। রুমাল বার করে তিনি মুখের ঘাম মোছেন ।’ তারপর আবার বলেন ‘ আচ্ছা তারকনাথ কার নাম ? ‘

— ‘ আজ্ঞে আমার বাবার নাম।’ মদন জবাব দিতে না দিতে কোথা থেকে হঠাৎ হুড়মুড় করে বাবিন এসে ঢুকল।পেছনে ছুটতে ছুটতে আসলেন তার মা স্বাতীলেখা।বাবিন সকলকে বিস্ময়ে বোবা বানিয়ে বলতে লাগল — ‘ আমি তারক ... তারক .... মদন কোথায় গেলি .... বাবা মদন .... ‘ , বলতে বলতে মদনের দিকে ছুটে এল আগের দিনের মতো। শিবব্রতবাবুর মুখের পেশীগুলো কুঁচকে গেল। ডান হাতের তেলোয় মুখ রেখে কিংকর্ত্তব্যবিমূঢ় হয়ে নিজের চেয়ারে বসে রইলেন।মদন ও সনৎ বিষ্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইল।স্বাতীলেখা ছুটে বাবিনের কাছে গেলেন মদনের চেয়ারের পাশে । বাবিনকে ধরে দাঁড়িয়ে রইলেন।

 

    নিকুঞ্জর জামিনের অর্ডার হয়ে গেছে। জেল প্রশাসনের হাতে কাগজ পৌঁছল পরদিন সকালে।শিবব্রতবাবু নিজে জেলের অফিসে গিয়ে তদারকি করে নিকুঞ্জকে রিলিজ করালেন বেলা বারোটা নাগাদ। সে যে কোনদিন মুক্তি পেতে পারে নিকুঞ্জ সে  বিশ্বাস পুরোপুরি হারিয়ে ফেলেছিল। যে সব অবিশ্বাস্য ঘটনা কদিন ধরে ঘটছে, তার ওপর তার জন্য তদ্বির করতে স্বয়ং উকিলবাবুর জেলের ভেতর আবির্ভাব, তার মনে হতে লাগল সে স্বপ্ন দেখছে কিনা।নিজের গায়ে চিমটি কেটে দেখল সে জেগে আছে না ঘুমিয়ে আছে।চিমটিতে লাগল বেশ।

       জেল থেকে বেরিয়ে সে সনৎ বরাট আর মদনের সঙ্গে একটা চায়ের দোকানে গিয়ে বসল।সঙ্গে তাদের আইনজীবী শিবব্রত সান্যাল।তার গাড়ির ড্রাইভারকে হাত নেড়ে গাড়িটা চায়ের দোকানের উল্টোদিকে রাখতে বললেন। তিনিও ওদের সঙ্গে কাঁচের গ্লাসে চা খেতে লাগলেন।মদনরা বেশ সংকোচ বোধ করছে। কিন্তু শিবব্রতবাবু নির্বিকারভাবে চায়ে চুমুক দিলেন।দুটো চুমুক মেরে তিনি বললেন, ‘আমাদের উত্তরাখন্ড ট্যুর প্রোগ্রাম ক্যানসেল করেছি । নিকুঞ্জ তো তার বাড়ি পাটলিপাড়া গ্রামে ফিরে যাবে। সপ্তাহে একদিন করে লোক্যাল ফাঁড়িতে মুখ দেখিয়ে আসবে যতদিন না কেসটা খারিজ হয়।ফাঁড়িতে কাগজ চলে যাবে শিগ্গীর। আর আমি যাব মদনের গ্রাম খেজুরতলায়..... উইথ হোল ফ্যামিলি। আমি পুরো রহস্যটাই জানতে চাই। আমি আর সহ্য করতে পারছি না । মদনরা তিনজন হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল দুঁদে উকিল শিবব্রত সান্যালের মুখের দিকে। ইতিমধ্যে গাড়ির ড্রাইভার এসে এক গ্লাস চা নিয়ে বসেছে।

 

    তিনদিন পরে মদন, সনৎ আর নিকুঞ্জর সঙ্গে শিবব্রতবাবুর পরিবার খেজুরতলা গাঁয়ে মদনদের বাড়ি গেলেন।মদনের মা শেফালি কি করবে না করবে ভেবে পাচ্ছে না। শিবব্রতবাবু তাকে বললেন , ‘ব্যস্ত হবেন না, ব্যস্ত হবেন না। আমরা একটা কাজে এসেছি।’

     বেলা দশটা বেজেছে। চড়চড় করে রোদ উঠে চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। সকলে মদনদের কুঁড়ে থেকে একটু দূরে গাছপালা ঘেরা একটা মেঠো জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। বাবিন তার মার হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে। সবার চোখে পড়ল  বাবিন অস্থিরভাবে চারদিকে দেখছে।তারমধ্যে অটিজমের সব লক্ষ্মণ যেন ম্যাজিকের মতো গায়েব হয়ে গেছে। কোন এক গন্ধে যেন সে ছটফটিয়ে উঠছে। আচমকা তার মার হাত ছাড়িয়ে সে মদনদের কুঁড়ের দিকে ছুটতে আরম্ভ করল। তার পিছন পিছন ওরাও ছুটতে লাগল। সবাই শুনতে পেল বাবিন শেফালি শেফালি বলে ডাকতে ডাকতে ছুটছে। ছুটতে ছুটতে বাবিন এক জায়গায় হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল।পড়ে গিয়ে বাঁ পাটা চেপে ধরে একটা ঘসঘসে গলায় চেঁচাতে লাগল ‘ ওরে বাবারে.... মরে গেলাম.... মরে গেলাম .... জ্বলে যাচ্ছে রে..... ও: ...মদন কোথায় গেলি রে..... ও মদন শিগ্গীর আয়.... শিগ্গীর আয়.....

       ততক্ষণে মদনরা সকলে সেখানে এসে পৌঁছে গেছে। অটিস্টিক পেশেন্ট তার বড় ছেলে শুদ্ধসত্ত্বকে এমন ছুটতে দেখে তার বাবা মা বাকরুদ্ধ  হয়ে গেছেন।

মদনকে দেখে বাবিন বলল, ‘ মদন .... মদন ... ধর আমাকে ... শিগ্গীর বাঁধ এইখানটা... জ্বলে যাচ্ছে... জ্বলে যাচ্ছে ...

    মদন ওখানে উবু হয়ে বসল।বাবিন মদনকে জড়িয়ে ধরল। মদন তাকে কোলে শুইয়ে নিয়ে মাটির ওপর বসল।

    নিকুঞ্জ পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। সে বলল, ‘ ঠিক এই জায়গাটায় মদনের বাবাকে সাপে কেটেছিল বারো বচ্ছর আগে।


Anjan Bandopadhyay



 

                         


                              


গোলাপকাঠের মশলার বাক্স- বৈশাখী রায়

 


গোলাপকাঠের মশলার বাক্স

বৈশাখী রায়

               


         গোলাপকাঠের মশলা-বাক্সটা হারিয়েই গিয়েছে মনে হয়। কাল থেকে ওটা আঁতিপাতি করে খুঁজে চলেছেন মহামায়া। কাবার্ড, জাল-আলমারি, চিমনির পাশের তাকগুলো,মায় গ্যাস বার্ণারের তলাটা পর্যন্ত বাদ রাখেননি; কোত্থাও নেই। অথচ বেশ মনে আছে গত পরশুরাতে ওটা থেকেই তো স্টার আনিসগুলো বের করলেন! একরাতের মধ্যে বেমালুম হাওয়া হয়ে গেলো নাকি বাক্সটা! তাও কি সম্ভব! তবে কি কেউ জেনেবুঝে সরিয়ে নিলো ; ঘরে তো মোটে তিনটি প্রাণী; এমন কাজ করবেই বা কে!

         মহামায়া রান্নাঘর অন্তপ্রাণ। এই বিষয়ে শৈলর শাশুড়ির সাথে তাঁর মিল এবং অমিল দুইই আছে। বিধবার একমাত্র ধন- কোলের ছেলে কিংবা বুড়োবয়সে দু'দণ্ড জিরোনোর জায়গা ঠাকুরঘরের দখলও তিনি হেলায় হারাতে রাজি; কিন্তু রান্নাঘর! নৈব নৈব চ! ছেলের বিয়ের আগেই সেকথা পষ্টাপষ্টি বনানীকে জানিয়েও দিয়েছিলেন তিনি। বনানীর অবশ্য তাতে অসুবিধা ছিলো না কখনোই,  যদিও রান্নাবান্না করতে খারাপ লাগে না তার, তবে সদ্য বিবাহিত জীবনে আপাতত সে বাপেরবাড়ি, শ্বশুরবাড়ি আর অফিসবাড়ি নিয়ে হেজে আছে বিস্তর। এখানে আবার উপরি পাওনা হিসেবে মশলা-চা'টুকু পর্যন্ত টেবিলে হাজির হয় বিনা আয়েসে। মহামায়া তাই জানেন, মশলার বাক্সের হদিসটুকু পর্যন্ত বনানীর অজানা। ছেলে অরূপ তো সকালে বেরোয়; ফেরে সেইই রাতে; তাকেও সন্দেহ করতে নারাজ মহামায়া। তবে কে? এবং তার থেকেও বড়ো প্রশ্ন হলো কেনো? এতকিছু থাকতে একটা তুচ্ছ মশলা-বাক্সের ওপরেই নজর পড়ার কারণ কিছুতেই খুঁজে পেলেন না তিনি। অথচ বাক্সটা বড়ো দরকার যে, কাল থেকেই উতলা হয়ে আছেন দম বিরিয়ানি রাঁধবেন বলে! এই চৌত্রিশ বছরের সংসারে একটাদিনের জন্যও কাছছাড়া করেননি ওটা, আজ এত বছরের সঙ্গীকে হারিয়ে বড়োই অস্হির হয়ে পড়লেন তিনি। আরো একবার ভালো করে গোটা রান্নাঘরটা ঘেঁটেঘুটে দেখেও, না পেয়ে  অবশেষে ক্ষান্ত দিয়ে ড্রয়িংরুমে এসে ধপ্ করে বসে পড়লেন মহামায়া। তাঁর মাথা ঘুরছে, চোখে অন্ধকার দেখছেন, জিভের ডগা শুকনো....সকাল থেকে জলটুকু খাওয়ার কথা মনে ছিলো না , মশলা-বাক্সটা নিংড়ে নিয়েছে যাবতীয় মনোযোগ! ঝাপসা দৃষ্টিতে মহামায়া শুধু দেখতে পেলেন বনানী ছুটে আসছে এদিকে। তারপর আর কিছুই মনে নেই !

        অষ্টমঙ্গলার পর নতুন-বৌ সবে রান্নাঘরে ঢুকেছে, অপটু হাতে নাড়াচাড়া করছে হলুদ-জিরে-মরিচের কৌটো।  লাল রঙের সুতির  শাড়ির আঁচলে এখনো কাগজের স্টিকার মারা, মোটা মোটা শাঁখার গায়ে নেইলপলিশের এবড়ো-খেবড়ো ফোঁটা, এখনো মাথায় টানা সিঁদুর, আর পায়ের গোড়ালিটা আলতায় ঢাকা।  অনভ্যাসের শাড়ি, ঘোমটা, গয়না, গলার তুলসীকাঠের মালা- সবেতেই চুড়ান্ত অসাচ্ছন্দ্য বোধ করছে মহামায়া। তার ওপর আবার জলখাবার বানাতে হবে! একান্নবর্তী বিশাল রান্নাঘরটির হাঁ-মুখ করা রাবণের চিতাসদৃশ উনুন আর একগাদা বিরাট বিরাট লোহা-কাসা-পিতলের মধ্যে দাঁড়িয়ে দু'বার ঢোক গিলল সে। নাহ্; বাড়ির আদরের ছোটোমেয়েকে রান্নাঘর থেকে দূরেই রেখেছিলেন মহামায়ার মা; টুকটাক ঠেকনা দেওয়া কাজ চালাতে পারলেও এই বিশাল যোগাড়ের মধ্যে পড়ে রীতিমতো থতোমতো খেয়ে গেল সে।

          প্রায় আধঘণ্টা বাদে, মহামায়া যখন খাবার বানানোর কথা বেমালুম ভুলে হাঁ করে কালিপড়া কড়িকাঠ আর বিশাল বিশাল চিনামাটির বয়াম গুণছে, তখনই দরজা দিয়ে ঢুকলেন দয়াময়ী; সকলে ওনাকে বড়মা বলেই ডাকে। লম্বা, ফর্সা, সাদা কাপড় পরা, চুড়ো করে চুলবাঁধা, আপাতকঠিন মানুষটি যে অপার স্নেহের আধার, তা সেদিনই টের পেয়েছিলেন মহামায়া। ওনার হাতেই ছিল বাক্সটা। পালিশ করা কাঠের গোলাকার একটা বাক্স, ডালায় সুক্ষ্ম মিনাকারি কাজ করা, লতাপাতা ফুলের নকশা কাটা,  চ্যাপ্টামতো, তাতে মোট নয়টা খোপ। একহাতেই ধরা যায় সেটা। মহামায়া পরে জেনেছিলেন ওটা ছিলো গোলাপকাঠের তৈরি।

         মশলার বাক্সটা ওইদিনই  মহামায়ার হাতে তুলে দিয়ে দয়াময়ী বলেছিলেন, " জানিস বৌ, মশলা হলো এমন একটা জিনিস, যা যেকোনো খাবারকে আলাদা আলাদা স্বাদ দিতে পারে। ধর, তুই শুধু  মৌরি ফোড়ন দিয়ে একরকম স্বাদ আনতে পারিস, আবার রাঁধুনি ফোড়ন দিলেই পাল্টে দিতে পারিস স্বাদ। ভাজা মেথির স্বাদ এক, আবার মেথিশাক শুকনো খোলায় নেড়ে হালকা হাতে গুড়িয়ে নিয়ে তরকারিতে ছড়ালেই আরেক স্বাদ, ডালে পাঁচফোড়ন দিলে বেশ লাগে, কিন্তু হিং দেওয়া ডাল খেয়েছিস বৌ? শোন্ বৌ, রান্নাকে যত ভয় পাবি, তত দেখবি নুন বেশি পড়বে, ঝোল ট্যালট্যাল করবে, মশলা কষালেও কাঁচা গন্ধ ছাড়বে না, আর একটু ভালোবাসলেই দেখবি রান্নাও তোর কথা শুনছে, যেমন বলবি, তেমন রং-রূপ নেবে রে।"

                 এইভাবেই শুরুটা হয়েছিলো, দয়াময়ী হাতে ধরে তৈরি করেছিলেন মহামায়াকে, অবশ্য মহামায়ারও শখ ছিলো বৈকি, তিনিও নিশ্চিত বুঝেছিলেন, রান্নাকে ভালো না বাসলে পাকা রাঁধুনি হওয়া যায় না কোনোমতেই। দয়াময়ী শিখিয়েছেন রাঁধুনিবাটা দিয়ে কেমন পাল্টে ফেলা যায় শুকতোনির স্বাদ, মশলার বাক্সের একদম কোণের একটা খোপ থেকে একটু কেশর বের করে বলেছিলেন,  "দুধের স্বাদে মিশিয়ে দেখেছিস কখনো এ জিনিস? দেখবি কেমন স্বাদ পাল্টে যায়!" কাঁচা সরষের সাথে দুটো কাঁচা লঙ্কা বেটে নিলে তিতকুটে স্বাদটা মরে, আর কাসুন্দি বানাতে হয় ছাড়া কাপড়ে; এইসবই দয়াময়ীর কাছে শেখা। কালে কালে মহামায়াও তো কম শিখলেন না কিছু। রোজকার ডাল ভাত বেগুনভাজাও কথা বলতো তার হাতে, পরে কায়দা করে এর ওর কাছে শিখেছেন আরো অনেক পদ- মোগলাই, চিনা-জাপানি থেকে শুরু করে লাউয়ের পায়েস, চিতলের মুইঠ্যা কিছুই বাদ রাখেননি। একান্নবর্তী রান্নাঘরটা ছিলো তার যাবতীয় পরীক্ষা নীরিক্ষার আতুড়ঘর। মশলার বাক্সটাও ততদিনে জায়ফল, জয়িত্রি, কাবাবচিনি, বড়ো এলাচি, চারমগজ , পোস্তদানার ভারে উপচে পড়ছে। দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়েছিলো, "বৌ এসেছে বটে রায়বাড়িতে! সাক্ষাৎ দ্রৌপদী যেনো!"

         সেসব কবেকার কথা, তারপর কতকাল কেটে গিয়েছে, ভাঙন ধরেছে যৌথ পরিবারে, সাবেকি রান্নাঘরে একসাথে তিন-চারটে চুলো জ্বলেছে কতদিন; টুকরো টাকরা হয়েছে সংসার।  তারও অনেক পরে স্বামীর বদলি, গ্রামের বাড়ি ছেড়ে শহরে একচিলতে ভাড়াবাড়িতে নতুন ঠাঁই; তারপর একটা নিজের বাড়ি, এমনকি ছেলের চার-কামরার ফ্ল্যাটবাড়ি, সবকিছুরই সাক্ষী বাক্সটা। ওই একটা জিনিস একদিনের জন্যও হাতছাড়া করেননি মহামায়া। এমনকী স্বামীর মৃত্যুর পর, মৎস্যমুখের দিনও বাক্সটা খুলে বসেছিলেন তিনি- রান্না করবেন; কর্তা বড়ো ভালোবাসতেন যে তাঁর রান্না।

          তারপর এই তো সেদিনের কথা, ছেলে নতুন ফ্ল্যাট কিনেছে,  মহামায়া পড়লেন রান্নাঘর নিয়ে। হালকাফুলকা হালফ্যাশনের জিনিস তার মোটে পছন্দ না, বাকি ঘরগুলোর সাজসজ্জা হবু বৌ আর ছেলে মিলে ঠিক করলেও রান্নাঘরের প্রতিটা আসবাবপত্র মহামায়ার পছন্দের। ভারী কাঠের পাল্লার বার্ণিশ করা কাবার্ড, জাল বসানো আলমারি, তামা আর কাঁসার বাসন, বাসন রাখার দেরাজ এমনকী সাবেকি ধাঁচের গ্যাস বার্ণারটুকুও খুঁজেপেতে পছন্দ করে কিনেছেন তিনি। ঘষা কাঁচের জানালা, কালচে ছোপের টাইলস এমনকী পিতলের নকশাকাটা কলগুলো পর্যন্ত সাবেকিয়ানা বজায় রাখতে মরিয়া। আর আছে গোলাপকাঠের বাক্সটা; দীর্ঘদিনের ব্যবহারে তার চেহারার সেই ঔজ্জ্বল্য আর নেই, চলটা উঠেছে এদিক ওদিক, তবুও অপার স্নেহে সেটা আগলে রাখেন মহামায়া; যেনো প্রাণপণে আকড়ে থাকতে চান একটা বিগত দশকের স্মৃতি- ঐতিহ্য আর মায়ায় মোড়ানো একগুচ্ছ স্মৃতি।

          সেই গোলাপকাঠের মশলার বাক্সটাও হারিয়ে গেলো অবশেষে। শত শত ভাঙ্গাগড়ার সঙ্গী একটা যুগের অবসান হলো যেনো!

                                             ***


         একচিলতে ব্যালকনিতে চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিলেন মহামায়া; মহানগরীর চিরাচরিত  ব্যস্ততা এখনও শুরু হয়নি, বাতাস তাই শান্ত আর স্নিগ্ধ; আকাশের গায়ে গোপালগোবিন্দজীউয়ের শ্যামরঙা গায়ের ছোপ। কতকাল এমন আকাশ দেখেননি মহামায়া, সকাল থেকেই রান্নাঘরে ঢোকা তাঁর চিরকালের অভ্যেস, আজ এতদিনে সেই অভ্যাসে ছেদ পড়লো যেনো!

        কতক্ষণ একভাবে  ছিলেন খেয়াল নেই তাঁর, হুশ ফিরলো বনানীর রাখা চায়ের কাপের আওয়াজে, তাকিয়ে দেখেন আরো একটা কাপ হাতে চেয়ার টেনে বসলো বনানী। বিয়ের পর এই প্রথম মনে হয় বনানী  কিছু বানালো, এতদিন অবশ্য দরকারই পড়েনি তেমন, ওইদিকটা তো তিনিই সামলাতেন বরাবর, ভালোবেসেই করতেন সবটা। বনানী  অবশ্য সাহায্য করতে চেয়েছে এক দু'বার, তিনিই হেসে এড়িয়ে গিয়েছেন। কি জানি, হয়তো জায়গাটা ছাড়তে চান নি, কিংবা বলা  ভালো পারেননি ছাড়তে।

        আজ চায়ে চুমুক দিয়েই চোখ বুজে ফেললেন তিনি- চিনি কম, কড়া লিকার; মেয়েটার তবে নজর আছে সবদিকে। পরপর আরো দু'তিনটে চুমুক দিলেন মহামায়া! তারপর  একটু জোরে শ্বাস নিয়ে ভোরের বাতাস বুকে ভরে বললেন,

"জানো তো বনানী, তোমার শ্বশুরমশাই ভলেন্টারি রিটায়ারমেন্ট নিতে চেয়েছিলেন একসময়, আমার ভয়ে পারেননি, মরার আগে পর্যন্ত সেই দুঃখ ছিলো তাঁর, গোটা জীবনটা নাকি কাজই করে গেছেন; অবসর নেননি কখনো!"

        বনানীর চা শেষ হয়েছে, মহামায়াকেই দেখছিলো সে। একটু চুপ থেকে মহামায়া আবার‌ বললেন, " আজ কদিন আমার শরীরটাও বড়ো অবসর চাইছে জানো; সেই কবে থেকে সংসার সংসার‌ করে মায়া আকড়ে পড়ে আছি, ক্লান্ত লাগে এখন।"

            উঠে দাঁড়ালো বনানী, তারপর মহামায়ার কাঁধে হাত রেখে বললো, " আন্টি, তুমি না কাল‌ থেকে বড্ড ডিস্টার্বড হয়ে আছো, একটু সময় দাও নিজেকে, দেখবে সবটা ঠিক হয়ে যাবে।"

  মৃদু হাসলেন মহামায়া।

          মহানগরীর ব্যস্ততা শুরু হয়ে গিয়েছে আরো একটা দিনের জন্য। চায়ের দোকান থেকে গলির মোড়, ঝাড়ুদার থেকে কাগজওয়ালা; ফুলের মাসি থেকে কাজের পিসি; সবাই কাইকিচির রবে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিতে তৎপর! উঠে পড়লেন‌ মহামায়া; একমাত্র তাঁরই কেনো ব্যস্ততা নেই আজ।

        এই ফ্ল্যাটও সরগরম হয়ে উঠছে ক্রমশঃ। বনানী প্রথমবার সবার জন্য লাঞ্চ বানাবে; চেলো কাবাব, মাখন দেওয়া জিরা-রাইস আর বুন্দির রায়তা। স্বভবতই ভীষণ উত্তেজিত সে, ততোধিক নার্ভাসও; বারবার করে অরূপকে বুঝিয়ে দিচ্ছে বাজার থেকে কি কি আনতে হবে, কিভাবে কাটাতে হবে মাংস এইসব।

        নিজের ঘরে এসে আয়নার সামনে দাঁড়ালেন মহামায়া। বয়সটা দেখতে দেখতে ষাট ছাড়িয়ে গেলো, এতদিনে সেটা খেয়াল পড়লো যেনো, অথচ তবুও মনে হয় এই তো সেদিনই ভরা কলসি চাল‌ উল্টে রায়বাড়িতে ঢুকলেন তিনি! সবকিছুই পাল্টে যায়, ছেড়ে যায়, চলে যায়, নয়তো লুকিয়ে পড়ে আড়ালে; বদলে যায় অনেককিছু, আর এই বদলটুকু সামলে নিয়েই পথ চলতে হয়।

         রান্নাঘর থেকে উৎসারিত কন্ঠস্বর ভেসে আসছিলো বনানীর, সাথে টিক্কা কাবাবের ধোঁয়া ধোঁয়া গন্ধটা। অরূপের উৎসাহ ও কম না, বৌ‌ প্রথমবার রান্না করছে বলে কথা। শূণ্যস্থান পূরণ হচ্ছে দ্রুত , অতিদ্রুত! সেই একটা কথা আছে না, জীবন থেমে থাকে না কারোর‌ জন্যই!

        এবার খুঁজেপেতে আরেকটা ঠিক অমনি মশলার বাক্স কিনবেন মহামায়া; অমনি গোলাপকাঠের তৈরি; ওইরকমই কারুকাজ করা , ঢাকনায় লতাপাতাফুল আঁকা। তারপর আলাদা আলাদা সুগন্ধি মশলায় ভরে তুলবেন বাক্সটির প্রতিটি প্রকোষ্ঠ, মশলার সাথে জড়িয়ে দেবেন ভালোবাসা, আর‌ তারপর বনানীকে উপহার দেবেন ওটা। মেয়েটারও রান্নাবান্নার শখ প্রবল, অনেকটা তাঁর মতোই।

        একটু সুস্থ হলেই খুঁজতে বেরোবেন অমন একটা বাক্স, এখন‌ তো তাঁর অনন্ত অবসর। ভালো করে খুঁজলে সব পাওয়া যায়; আর একটা বাক্স পাবেন না তিনি! ঠিক পাবেন। মহামায়া নিশ্চিত জানেন, তিনি পাবেনই।দু'দিন পর এই এতক্ষণে তাঁর মনটা অজানা এক আনন্দে ভরে উঠলো। আর তিনি সেই আনন্দের নাম দিলেন মুক্তি।


Baishakhi Roy