৭.
প্রফেসর নন্দীর সেক্রেটারি ছেলেটি এতক্ষণ জড়সড় হয়ে বসে ছিলো। শ্রীময়ী ঘরে
ঢুকতেই উঠে দাঁড়াতে গেল।
-" বসুন, কয়েকটা
প্রশ্নের উত্তর দরকার", বলল শ্রীময়ী।
-" হ্যাঁ হ্যাঁ
বলুন", যথেষ্ট
নার্ভাস দেখাচ্ছে ছেলেটাকে।
-" রিল্যাক্স।
ভেবে চিন্তে উত্তর দিন। আপনার নামটা যেন কী ?"
-" বিকাশ
সিংহ্"
-" তো আপনি কখন
দেখলেন যে প্রফেসর মারা গেছেন ?"
-" মানে আমি
এমনিতে আটটা নাগাদ চলে আসি। আজ একটু তাড়াতাড়ি এসেছিলাম। ঢুকতেই দেখি দরোয়াজা খোলা।
তারপর তো এই।"
-" কেন ? তাড়াতাড়ি
এসেছিলেন কেন ?"
-" না মানে
স্যার বলেছিলেন আসতে তাই।"
-" আই সী। তারপর
এসে কী দেখলেন ?"
-" দেখলাম স্যার
মাটিতে পড়ে আছেন। চারদিক রক্তে ভেসে যাচ্ছে। সেটা দেখেই ভয় লেগে গেলো। আমি তখুনি
ফোন করি থানায়।"
-" হুম। আচ্ছা
আপনার স্যার বস হিসেবে ছিলেন কেমন?"
-" অমায়িক লোক।
এটা বহুত বাজে ব্যাপার হলো।"
-" আপনার কাউকে
সন্দেহ হয় ?"
-" দেখুন আমি তো
আম আদমি। আমি কিছুই জানি না এ ব্যাপারে।"
-" কদ্দিন চাকরি
করছেন ?"
-" তা বেশিদিন
না। ছ মাস। আগে একটা অন্য কোম্পানি তে ছিলাম। ফেরো কেমিক্যাল লিমিটেডে। স্যার
বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন। এপ্লাই করেছিলাম..."
-" কোথায় ছিল
কোম্পানিটা ?"
-" সল্টলেকের
নিকট, সেক্টর
থ্রি।"
-" তা ওখানে
ছাড়লেন কেন ? মাইনে কম
ছিলো ?"
-" হ্যাঁ মানে
ওই আর কি..."
-" কাল রাত
আটটার পর কোথায় ছিলেন ?"
-" আমি এখান
থেকে ছ বাজে বেরোই রোজই। তারপর বাড়ি ফিরে খাওয়া দাওয়া করে শুতে শুতে সাড়ে
দশটা হয়। পাশেই একটি পাইস হোটেলে খাই। রেগুলার। আপনি জিজ্ঞেস করলেই বলবে
ওরা।"
-" আচ্ছা ওকে
আপনি এখন আসতে পারেন। আবার পরে দরকার হলে ডেকে নেবো। আপনি আপাতত আপনার ঠিকানাটা দিয়ে যান। আর হ্যাঁ
কলকাতার বাইরে কোথাও যেতে হলে লোকাল থানার অনুমতি নিয়ে যাবেন।"
-" আচ্ছা ম্যাডাম।"
যতক্ষণ জেরা চললো অনির্বাণ চুপ করে পাশে দাঁড়িয়ে ছিলো। এবার বিকাশ চলে যেতেই
বললো, " ছেলেটার কথায়
কিন্তু একটা অবাঙালি টান রয়েছে !"
-" দেখেছি", গম্ভীর মুখে
বললো শ্রীময়ী। তারপর এগিয়ে গেলো বারান্দার দিকে।
৮.
বাড়ির চারপাশটা একবার ভালো করে দেখলো শ্রীময়ী। জোর করে প্রবেশ করার কোনো চিহ্ন নেই
কোথাও। অপরাধী যেই হোক সে দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করেছিলো অবাধে। তার মানে
চাবির হদিশও ছিলো তার কাছে। তাহলে কি খুনী প্রফেসরের পরিচিত কেউ ? নইলে উনি একা
মানুষ। বিয়ে থা করেননি। এতটা সন্ধান পাবে কী করে অন্য কেউ !!!!
-" ম্যাডাম
একবার এদিকে আসবেন ?", অনির্বাণ কখন
এসে পেছনে দাঁড়িয়েছে টের পায়নি শ্রীময়ী। জিজ্ঞেস করলো, " কী হয়েছে ?"
-" আসুন না
একবার", বলে
শ্রীময়ীকে প্রফেসরের বেডরুমে নিয়ে গেলো অনির্বাণ। গোটা ঘর
এলোমেলো ভাবে ছন্নছাড়া হয়ে রয়েছে। যেন কেউ তন্ন তন্ন করে কিছু খুঁজেছে।
আলমারি খোলা হয়েছে। সমস্ত জিনিসপত্র ছত্রাকার হয়ে রয়েছে।
-" টাকা পয়সা
কিছু চুরি গেছে কি ? খুঁজে
দেখেছেন ?", জানতে চাইলো
শ্রীময়ী।
-" আলমারিতে
হাজার বিশেক টাকা রয়েছে। এদিকে লকারটাও খোলা হয়েছে, কিন্তু ভেতরে দরকারি কাগজপত্র, বাড়ির দলিল, ব্যাঙ্কের
পাসবই সবই তো রয়েছে। দামি কিছু নিলে কি বিশ হাজার টাকাটা রেখে
যেতো ?", বললো
অনির্বাণ।
-" এটা এত সহজ
ব্যাপার নয় অনির্বাণ বাবু। কোথাও কিছু একটা গোলমাল রয়েছে শিওর। আচ্ছা
ফিঙ্গারপ্রিন্ট পাওয়া গেছে ?"
-" কিছু ট্রেস
করা গেছে। ফরেনসিকে পাঠানোর ব্যবস্থা করছি।"
-" আর ওই
নোটবুকটা নিয়ে নিন। যে শ্লোকটা লেখা আছে ওটা আলাদা করে একবার চেক করতে হবে। আর
এই সেক্রেটারী ছেলেটির এলিবাই ভেরিফাই করুন। ওর পুরোনো কোম্পানি
থেকে ওর ডিটেলস নিয়ে এখনকার সাথে মিলিয়ে দেখবেন। প্রতিটা জিনিস খুঁটিয়ে দেখে
রিপোর্ট করবেন আমায়। ও হ্যাঁ প্রফেসরের মোবাইলটা দেখেছেন ?"
-" না ম্যাডাম
ওটা মিসিং।"
-" হুম। নম্বর
জোগাড় করুন প্রফেসরের। তারপর কল রেকর্ড চেক করে জানান আমায়।"
-"ওকে
ম্যাডাম।"
বাইরে একটা
ট্যাক্সি এসে দাঁড়ানোর শব্দ পেতেই বেড রুমের জানালাটা দিয়ে তাকালো শ্রীময়ী।
রাতুল নামলো। প্রায় একবছর পর ওকে দেখছে শ্রীময়ী। সেই উস্কোখুস্ক চুল, কেমন যেন
একটা ছন্নছাড়া ভাব। এই ক'বছরেও একটুও
বদলায়নি।
৯.
ট্যাক্সির ভাড়াটা
মিটিয়ে প্রফেসর নন্দীর বাড়ির দিকে এগোতেই বেশ ভিড় চোখে পড়লো। এতক্ষনে
অনেকেই জেনে গেছে। মিডিয়ার অল্প কিছু লোকজনকেও দেখা যাচ্ছে। এরকম একজন বিখ্যাত
ব্যক্তির মৃত্যুতে একটা ভালোমতো স্টোরি পাওয়ার আশায় অনেক চ্যানেলই
ঘুরঘুর করছে। দু চারজন পুলিশ কনস্টেবল রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে ভিড় সামলাতে।
যাহোক করে ভিড় ঠেলে সামনের দিকে এগোতেই বাধা পেলো রাতুল। দুজন কনস্টেবল তাকে
আটকে দিয়েছে। বলল,
" সরি ভেতরে
যাওয়া যাবে না। ওপরমহলের নির্দেশ। "
-" আরে আমাকে
আপনাদের ম্যাডাম নিজেই ডেকেছে", বলতেও কোনো লাভ হলো না। রাতুলকে
একচোট ধাক্কা মেরে পাশে সরিয়ে দিলো।
মহা মুশকিল।
মোবাইলটা বার করে একটা ফোন করতে যাবে, দেখলো শ্রীময়ী ভিড়ের ওপাশে এসে নিজে
দাঁড়িয়েছে আর ওকে হাত নেড়ে ডাকছে। বোধহয় ভিড়ের মধ্যে ওকে ভেতর থেকে দেখতে
পেয়েছিলো। রাতুল এবার এগিয়ে যেতেই একজন কনস্টেবল ওকে প্রায় লুফে নিয়ে ভেতরে
ঢুকিয়ে দিয়েই আবার কর্ডন করে ভিড় সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।
-" আয় রাতুল, তোর জন্যই
অপেক্ষা করেছিলাম", রাতুল আসতে
না আসতেই বললো শ্রীময়ী।
রাতুল কিছুক্ষণ
শ্রীময়ীকে দেখে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। কতদিন পর ওকে দেখছে ? একবছর তো হবেই। এর
মধ্যে কি কিছু পরিবর্তন হয়েছে শ্রী র। মনে তো হচ্ছে না। সেই একইরকম ছটফট
করছে, দাঁত দিয়ে নখ
কামড়ে চিরাচরিত নার্ভাস ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে।
-" ব্যাড
হ্যাবিট। এখনো ছাড়তে পারলি না ?", চোখ টিপে জিজ্ঞেস করলো রাতুল।
মুখ থেকে হাতটা সঙ্গে সঙ্গে নামিয়েই বললো, " উফ আমার কথা ছাড়। কেসটা
সিরিয়াসলি গোলমেলে।"
-" যেকোনো
মার্ডারই গোলমাল ছাড়া হয় না ডিয়ার।"
-" না। এটার
ব্যাপারটা একটু আলাদা। এদিকে আয় আমার সাথে আমি তোকে বোঝাচ্ছি পুরো
বিষয়টা", বলে স্টাডির
দিকে এগোতেই রাতুল পিছন থেকে একটু বিদ্রুপের সুরে বলে
উঠলো, " তাই এতদিন পর
আমায় ম্যাডামজীর মনে পড়েছে। সো নাইস অফ ইউ।"
বলেই ফিক করে হাসলো রাতুল। শ্রীময়ী বললো, " রাতুল একদমই নয় সেটা। প্লিজ তুই
এভাবে বলিস না।"
-" আরে না না
জাস্ট জোকিং, চল দেখি কী
সমস্যা " ,বলে রাতুল
মৃদু হেসে শ্রীময়ীকে অনুসরণ করলো।
ওরা দুজন
স্টাডিরুমে প্রবেশ করতেই রাতুল একটু পিছিয়ে এলো। যে দৃশ্য সে দেখছে তা বোধহয়
স্বপ্নেও কল্পনা করা যায় না। প্রফেসর নন্দী যে আর নেই সেটাই যেন অবিশ্বাস্য
লাগছে। এক কালে ওনার ক্লাস করতে মুখিয়ে থাকতো; আর আজ সেই মানুষটাকে
এভাবে দেখা বেশ কষ্টকর তাঁর একজন গুণমুগ্ধ ছাত্র হিসেবে।
ইতিমধ্যে ডেডবডির
চারদিকে স্পট মার্কিং করা হয়েছে, যাতে লাশ নিয়ে চলে গেলেও পরে এসে ইনভেস্টিগেশন করতে অসুবিধা না
হয়। স্পট অফ মার্ডার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয় কিছু কিছু ক্ষেত্রে। তাই
সাদা মার্ক করে দেহ যে স্থানে পড়েছিলো সেই স্থানটাকে চিহ্নিত করে রাখার
রেওয়াজ।
এরকম দৃশ্য মোটেই
ভালো লাগছিলো না রাতুলের। " কী করে হলো এরকম ?", প্রশ্ন করলো রাতুল। গলার
স্বরে একটা উত্তেজনা স্পষ্ট। কাঁপা কাঁপা গলায় রাতুল কথা বলছে শ্রীময়ীর
সাথে, " গুলি করেছে
নাকি ?"
-" হ্যাঁ, বুকে আর
পেটে। কিন্তু সেটার চেয়েও রহস্যজনক হলো এইটা", বলে নোটবুকে লেখা শ্লোকটা
রাতুলকে দেখালো শ্রীময়ী।
রাতুল কয়েক মিনিট চুপ করে দেখলো লেখা গুলো, তারপর বললো, "এতো স্যারের
হাতের লেখা নয়। আমি ওনার লেখা চিনি"।
খানিকক্ষণ বসে ভাবলো ও। তারপর ধীরে ধীরে বললো, " পৌরাণিক ইতিহাস নিয়ে স্যার কাজ
করছিলেন জানি। কিন্তু এটা লেখার তৎপর্য কী ?"
-" সেই জন্যই তো
তোকে ডাকলাম। শ্লোকটা আগে শুনেছি, কিন্তু এটার সম্পূর্ণ মানে আমার জানা নেই। কেন জানি না মনে
হচ্ছে এই কেসটা অন্য সবার মতো সাধারণ খুনের ঘটনা নয়। একটু
আলাদা।", বললো
শ্রীময়ী।
" 'স্বধর্মমপি
চাবেক্ষ্য ন বিকম্পিতুমর্হসি।
ধর্ম্যাদ্ধি যুদ্ধাচ্ছ্রেয়োহন্যৎ ক্ষত্রিয়স্য ন বিদ্যতে ।।'
এতো শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা
থেকে অবতারণা করা হয়েছে। দ্বিতীয় অধ্যায় থেকে সাংখ্যযোগ বোঝাতে গিয়ে
শ্রীকৃষ্ণ পার্থকে বলছেন, ক্ষত্রিয়রূপে
তার স্বধর্ম বিবেচনা করে জানা উচিত যে, ধর্ম
রক্ষার্থে যুদ্ধ করার থেকে ক্ষত্রিয়ের পক্ষে মঙ্গলকর আর
কিছুই নেই। দ্বিধাগ্রস্থ হওয়া উচিত নয়। কিন্তু...", বেশ চিন্তান্বিত
দেখালো রাতুলকে।
"কিন্তু কী ?", উত্তেজিত হয়ে
জিজ্ঞেস করলো শ্রীময়ী।
-" এর মাধ্যমে
এমন একটা কিছু বলা হচ্ছে যেটা কোনো কর্তব্য বা এরকম কোন কাজের সাথে
রিলেটেড। যোদ্ধা কে ? খুনী নিজে ? কিন্তু কেন ? আর তাই যদি
হয় তবে কী কর্তব্য
সাধনের জন্য এই খুন করা হলো ? অনেক গুলো প্রশ্ন এসে যাচ্ছে রে শ্রী।"
-" লেখাটা কার ? আততায়ীর ?"
-" হতে পারে।
স্যার খামোকা এটা লিখবেন কেন ? আর তাছাড়া স্যারের হাতের লেখা আমি চিনি। এটা অন্য কেই লিখেছে। খুনী যদি
লিখে থাকে তাহলে কি কোনো মেসেজ দিতে চাইছে ?"
-" তোর কী মনে
হয় ?"
-" দেখ শ্রী
স্যারের ব্যাপারে আমরা কলেজে যতটুকু জানতাম সেটা খুব সামান্যই। এর বাইরেও
আরো অনেক কিছু থাকতে পারে। সেই তথ্যগুলো দরকার।"
-" প্রফেসরের
ঘরে কিছু একটা খোঁজা হয়েছে। কী জিনিস সেটা জানা যায়নি। এমন একটা কিছু যেটা হয়তো এই
মৃত্যুর কারণ হতে পারে।"
" খোঁজ নিয়েছিস
কি, কী এমন জিনিস
হতে পারে যেটার জন্য এরকম তোলপাড় করা হয়েছে। একটু সময় লাগবে। বাট আমি
পেয়ে যাবো। দেখ রাতুল এই কেসটা আমার কাছে একটু আলাদা মনে হয়েছে সামহাউ।
-" ডেফিনিটলি।
এইভাবে হত্যা করে
শ্লোক লিখে রাখা খুব একটা নর্মাল ব্যাপার নয়। এর পেছনে অনেক গূঢ় কোনো রহস্য
আছে ম্যাডাম। ব্যাপারটা বেশ গোলমেলে।"
-" প্রফেসরের
ডিটেইলস আমি বার করে ফেলবো খুব শিগগিরই। পেলেই তোকে পাঠাচ্ছি। আমি চাই তুই
সাথে থাক এই কেসটায়। তাহলে খুব ভালো হয়।"
-" ওকে জাহাপনা।
কিন্তু হেল্প করলে তো তার বিনিময়ে কিছু চাই আমার।"
-" বল কি চাস ?"
-" সময়মতো চেয়ে
নেবো। ডোন্ট ওয়ারি শ্রী", বলে অদ্ভুত ভাবে হাসলো রাতুল।
১০.
প্রফেসর নন্দীর
বাসভবনে ইনভেস্টিগেশন পর্ব মোটামুটি শেষ করেই এনেছিলো শ্রীময়ী। তেমন কিছু
জানা গেলো না ঠিক কী কারণে এই খুন হতে পারে। ওনার কিছু ব্যক্তিগত সামগ্রী, ল্যাপটপ, মোবাইল এসব
নিজেদের জিম্মায় নিয়ে ক্রাইমসীন ভালো করে মার্কিং করে বেরিয়ে এলো সবাই।
অনির্বাণকে দুএকটা
অনুসন্ধানের ভার দিলো শ্রীময়ী। প্রফেসরের ব্যাকগ্রাউন্ডটা একবার খতিয়ে দেখতে
হবে। ওনার পেশাগত জীবন যতটা সর্বজনবিদিত, ব্যক্তিগত জীবনের কিছুই প্রায়
কেউ জানে না। সেটাও জেনে নেওয়া দরকার, কারণ এমন একটি হাই প্রোফাইল
কেসের প্রতিটি খুঁটিনাটি নজরবন্দি করে রাখতে হয়। বলা যায় না কখন কোনটা কাজে
লাগে।
এর মধ্যে বাইরে একগাদা
টিভি চ্যানেল থেকে লোকজন এসেছে তাদেরও সামলাতে হবে এবার। এমনিতে এই
প্রাথমিক পর্বে কিছুই না বলার দস্তুর। তাছাড়া প্রফেসর নন্দীর খুনের কোনো
মোটিভই এখনো পর্যন্ত পুলিশ খুঁজে উঠতে পারেনি। আপাত দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে না
নিছক টাকা পয়সা চুরির কোনো ঘটনা এই খুনের জন্য দায়ী। সেক্রেটারী
ছেলেটি আর দু একজন কাজের লোকের কাছ থেকেও তেমন কোনো খবর পাওয়া গেলো না।
তবুও মিডিয়াকে একটা কিছু তো বলতে হবে, সেই ভেবে শ্রীময়ী এগিয়ে গেলো।
খানিকটা গিয়েই রাতুলের সাথে চোখাচোখি হলো। রাতুল বাইরে দাঁড়িয়ে সিগারেট
খাচ্ছিলো।
-" ব্যাড
হ্যাবিট, এখনও ছাড়তে
পারলি না", বলে রাতুলকে
পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গিয়েও কি ভেবে একবার থমকে দাঁড়ালো। তারপর অনির্বাণ বাবুকে ডেকে বললো, " শোনো তুমি রাতুল
বাবুকে বাড়ি ছেড়ে দিয়ে এসে ডাইরেক্ট থানায় মিট করো। ওখানেই দেখা হবে। আর
রাতুল আমি তোর সাথে আজ একবার সন্ধ্যায় মিট করে নেবো।"
-" ওকে
ম্যাম", বলে অনির্বাণ
চলে যেতেই রাতুল আধখাওয়া সিগারেটটা টান মেরে বাইরের দিকে
ফেলে দিয়ে, শ্রীময়ীর
দিকে এগিয়ে গেলো। তারপর বললো, " এত ফর্মালিটিস
করছিস কেন বলতো ? তোর সাহায্য
লাগলে আমি সবসময় আছি। শোন তোকে কষ্ট করে দেখা করতে হবে না। আমি
বরং তোকে জানাচ্ছি আমার তরফ থেকে কিছু সুরাহা হলে।"
শ্রীময়ী একবার মৃদু হাসলো শুধু। তারপর, " আচ্ছা আমি ফোন করে নেবো", বলে বাইরের
দিকে এগিয়ে গেলো।
১১.
'পাঞ্চজন্য'র বাইরে তখন
বেশ ভিড় জমে গেছে। পুলিশ মিডিয়ায় ছয়লাপ চতুর্দিক। এই ভিড়ের মধ্যেই
এতক্ষণ একজোড়া চোখ পুরো পরিস্থিতিটা নজর রেখেছিলো। এবার একটু সুযোগ পেতেই
মোবাইলটা বার করলো । স্পীড ডায়ালে 'এক' নম্বরটি
টিপলো।
কয়েক সেকেন্ড রিং হতেই গুজরাটি ও হিন্দি মিশ্রিত ভাষায় উত্তর এলো- " বলো
ওদিকের কী খবর ?"
-" পুলিশ এখনো
কোনো ক্লু পায়নি।"
-" সে পাবেও না।
যাইহোক তোমায় কেউ দেখতে পায়নি তো ?"
-" না স্যার।
কেউ না।"
-" ভেরি গুড।
আমায় সময়মতো আপডেট দিতে থাকো।
-" তবে স্যার, পুলিশ ছাড়াও
আর একজন মনে হলো এই কেসে সাহায্য করছে। দেখলাম লেডি অফিসারের সাথে কথা বলছে, কিছু টিপস
দিচ্ছিলো বোধহয়। "
-" অফিসারের
দোস্ত হবে"
-" সেই সাথে মনে
হয় প্রফেসরের স্টুডেন্ট। এখন বোধহয় ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করছে। কথাবার্তা শুনে আমার
এরকমই মনে হলো।"
-" আহ, আই সী। নজর
রাখো। ওকে আমার দরকার লাগতে পারে।"
-" ওকে। আর কিছু
?"
-" না আপাতত
এইটুকুই। তুমি সাবধানে থাকো।"
ফোনটা কেটেই বৃষকেতু কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো গঙ্গার ধারে। এখানে সে মাঝে মাঝেই
আসে। বেশ লাগে একা একা গঙ্গার ধারে এভাবে সময় কাটাতে।
তারপর পকেট থেকে
একটা মোবাইল বার করে তার সিমটা প্রথমে ভেঙে দু টুকরো করে গঙ্গার জলে ফেলে
দিলো আর সেই সাথে ফোনটাও। তারপর গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে গঙ্গার পাড়
ধরে এগিয়ে গেলো-
" .... এক মেলা য্যয়সা লাগতা হ্যায়
বিখরা বিখরা ইয়ে শুনাপন
ইয়াদো কে সায়ে
এয়সে মে
করনে লাগতে হে আলিঙ্গন..... "
১২.
সারাটাদিন রাতুলের মনে
একটাই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিলো। প্রফেসর নন্দীর খুনের পর ওভাবে শ্লোক লিখে
রাখার অর্থ কী হতে পারে? এর সাথে কি
পুরোনো কোনো ঘটনার যোগাযোগ আছে? খুনি কী
মেসেজ দিতে চাইছে ? আর কেনই বা
দিচ্ছে ? অজস্র প্রশ্ন
মাথার মধ্যে ঘুরে
ফিরে আসছিলো তার।
প্রিয় প্রফেসরের
মৃত্যু তাকেও বেশ বিহ্বল করে দিয়েছে। মনে আছে সে নিজেই একবার প্রফেসরের
নন্দীর সাথে দেখা করেছিলো রিসার্চের ব্যাপারে। কতদিন হবে এই বছর খানেক আগে।
খুব ইচ্ছে ছিলো ওনার তত্ত্বাবধানেই কাজ করবার।
কিন্তু উনি রাজি
হননি। আসলে প্রফেসর নন্দী মানুষটাই এমন ছিলেন। কোনো এক জায়গায় মন বসাতে পারতেন
না। তাই হয়তো চাননি নিজের খামখেয়ালিপনার প্রভাব রাতুলের রিসার্চের
ওপর পড়ুক। তবে মাঝে মধ্যেই কথা হতো রিসার্চের ব্যাপারে। সরাসরি না হলেও অনেক
ভাবেই রাতুলকে নানা সাহায্য করেছেন উনি। সত্যি বলতে কী, মানুষটার
পান্ডিত্য নিয়ে কোনো প্রশ্নই উঠতে পারে না। তাই এভাবে ওনার চলে যাওয়া যেন
কিছুতেই মন থেকে মেনে পারছে না রাতুল।
প্রফেসর নন্দী
সম্বন্ধে ইন্টারনেটে অনেক তথ্যই পাওয়া গেলো। তাঁর সারাজীবনে কার্যকলাপের
ব্যাপ্তি কিছু কম ছিলো না। সার্ফিং করতে করতে একটা বিশেষ জায়গায় চোখ
আটকে গেলো রাতুলের। একটা সেমিনারে প্রফেসর নন্দীর কিছু বক্তব্য একটি দৈনিক
সংবাদপত্রে বিস্তারিত ছাপা হয়েছে।
বক্তব্যের মূল বিষয়
মহাভারত। সেখানে উনি বার বার বিভিন্ন আঙ্গিকে মহাভারতের নানা ঘটনাবলী
বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা সহ তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের কথা।
ওটা তাঁর মতে একটা প্রকান্ড নিউক্লিয়ার যুদ্ধ ছাড়া আর কিছুই নয়, যা কালক্রমে
বহুজনশ্রুত হয়ে একটা পৌরাণিক ঘটনায় পরিবর্তিত হয়েছে। ইতিহাস আর
পুরাণ এ দুটোকে আমরা গুলিয়ে ফেলি বারবার। আর তার কারণ একটাই, পাশ্চাত্য
সভ্যতার মানুষ যখন এদেশে রাজত্ব করতে এসেছিলো ভারতবর্ষের সোনালী অতীত দেখে
ঈর্ষাকাতর হয়ে পড়ে। তার পর এক এক করে তাদের আরোপিত কিছু ইতিহাস আমাদের
সভ্যতার মূল চিত্রটিকেই বদলে দেয়।
প্রফেসর নন্দী একাধিক
অস্ত্রের কথা বলেছেন যেগুলো কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে ব্যবহৃত হয়েছিলো।
যেমন - আগ্নেয়াস্ত্র, যা নিক্ষেপ
করা হলে লক্ষ্য লক্ষ্য আগুনের গোলা আকাশ থেকে নেমে আসতো।
মহাভারতে একাধিকবার এ অস্ত্রের প্রয়োগ করা হয়। এর সাথে
আজকের দিনে মিসাইলের খুব অমিল রয়েছে কি ?
কিংবা বরুণাস্ত্র
যা যুদ্ধক্ষেত্রে প্রলয়কারী লহর সৃষ্টি করে সাময়িক বানভাসি করে দিতে পারতো
শত্রুপক্ষকে। এর সাথে বিশ্বের কিছু মহাশক্তিধর দেশের আবহ নিয়ামক
একপ্রকার অস্ত্রের তুলনা করা হয়েছে। গত ২০০৮ এ এই ধরনের অস্ত্রের পরীক্ষামূলক
প্রয়োগ করে কয়েকটি দেশ। আকাশের মেঘ লক্ষ্য করে এমোনিয়াম নাইট্রেট
যুক্ত একপ্রকার রাসায়নিক মিসাইল নিক্ষেপ করে দেখা গেছে মেঘের ঘনত্ব অস্বাভাবিক
রকম বেড়ে গিয়ে কোনো নির্দিষ্ট জায়গায় অস্বাভাবিক বেশি বৃষ্টিপাত
ঘটানো যায়, যাকে অনেকসময়
আমরা মেঘ ভাঙা বৃষ্টিও বলে থাকি। সংহার করতে বরুণাস্ত্রকে এভাবেই
ব্যবহার করা হতো অতীতে।
ইন্দ্রের বজ্র আর আধুনিক প্লাজমা লেসর দিয়ে তৈরি করা কৃত্রিম বিদ্যুৎ তরঙ্গ, লক্ষ্যের ওপর
আঘাত হানলে একই রকম ধ্বংসলীলা করতে পারে।
এছাড়া ব্রহ্মাস্ত্র, পাশুপাতাস্ত্র
এগুলোর প্রয়োগে যে প্রচন্ড বিধ্বংস হয়ে থাকে তা আজকের নিউক্লিয়ার অস্ত্রের কথা মনে
করিয়ে দেয়।
প্রফেসর নন্দীর এরকম
একের পর এক ব্যাখ্যা রাতুলকে তাজ্জব করে দেয়। কতটা শিক্ষণীয় হতে পারতো
তাঁর এইসমস্ত বিশ্লেষণ গুলো যা আজ আর কোনো ভাবেই সহায়ক হতে পারবে না। এটা ভেবে
বেশ খারাপ লাগছিলো রাতুলের।
নাঃ কোথাও কোনো সূত্র পাওয়া যাচ্ছে না। ওদিকে শ্রীময়ী কিছু তথ্য জোগাড় করতে
পারলো কিনা কে জানে!
ল্যাপটপটা বন্ধ করতে
যাচ্ছিল, হঠাৎ একটা বিশেষ
প্রতিবেদন রাতুলের দৃষ্টি আকর্ষণ করলো। বেশ কয়েক বছর আগের ছবি।
তার মধ্যে তিনজন লোকের চেহারা দেখা যাচ্ছে। আর পেছনে এক বিশাল প্রান্তরে
ছড়িয়ে বেশ কিছু ভগ্নপ্রায় শহরের অংশ বিশেষ। আর প্রতিবেদনটির
শিরোনাম- "লোথাল শহরে ভয়াবহ অগ্নিকান্ড, কোনক্রমে বেঁচে ফিরলেন তিন
রিসার্চার"।
ছবিতে যে দুজনকে দুপাশে দেখা যাচ্ছে তাদের চেনেনা রাতুল। কিন্তু ওদের মধ্যমণি
যিনি তাঁকে এই মাত্র প্রাণহীন দেহে দেখে এসেছে সে।
প্রফেসর জনার্দন নন্দী।
কী এমন ঘটেছিলো সেখানে? এর সাথে এই
হত্যাকাণ্ডের কোনো সম্পর্ক নেই তো?
ক্রমশ...