কবিতা - মনোলিপি - সঞ্জয় কর্মকার

 মনোলিপি 

সঞ্জয় কর্মকার


একটা মনে শীতের বিকেল বরফ ভাঙা ঝড়
আর একটা মন বসন্ত রোদ চৈত্রে বাঁধা ঘর।

একটা মনে গ্রীষ্ম দুপুর নেই তো অভিসার
আর একটা মন উজান বেয়ে নিচ্ছে মেনে হার।

একটা মনে ভাঁটার শোষণ মৃত্যুমুখী ঢেউ
আর একটা মন বসত গড়ে জ্যোৎস্না আনে কেউ।

একটা মনে বিবর্ণ মেঘ নিভৃত সন্ধ্যার
আর একটা মন সোহাগ সকাল ফিরছে বারংবার।

...............

 

Sanjay Karmakar 

 


 

ভুবনডাঙার হাট - টুম্পা বিশ্বাস

 

ভুবনডাঙার হাট
টুম্পা বিশ্বাস  


           আমি আশুতোষ মল্লিক,মধ্যবয়সী,সুচাকুরে,গৃহস্থ।মোটের ওপর শান্তির জীবন। তবে সুখ শান্তি সবটাই আপেক্ষিক। মানুষের স্বভাবই এমন যে সে সবেতেই অসন্তুষ্ট,খানিকটা শুঁয়োপোকার মতো,তার কেবল প্রজাপতি হবার সাধ,তার চাই খোলা আকাশ।

         আমি বরাবরই ভ্রমণপিয়াসী। ঘরের চারদেয়ালে বন্দী থেকেই জীবনের বেশিটা কাটে বলেই বছরে বার দুয়েক অন্তত আমাকে বেরোতে হয়।তবে নাম না জানা, লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকা কোন অখ্যাত স্থানই আমার পচ্ছন্দ। দৈনন্দিন ভীড় থেকে পালাতে গিয়ে পর্যটকদের ভীড়ে গিয়ে পড়া,সে আমার পোষায় না।ফাঁদে পড়া জীবন আর ফাঁদে পড়া ভ্রমণ -দুই ই আমার কাছে অসহনীয়। 

         আজকাল ইন্টারনেটের যুগে অবশ্য এমন জায়গা পাওয়া ভার।পৃথিবী যেখানে মুঠোফোনে বন্দী সেখানে অখ্যাত জায়গা!আমি তবু চেষ্টা ছাড়ি না।কখনও ট্রেনের টাইম টেবিল কখনও গুগল বাবাজীর সহায়তা-মোট কথা পচ্ছন্দ মত জায়গা আমার খুঁজে বার করা চাই।একবার খবর পেলাম কোলকাতা থেকে ৩৫কিমি দূরে একটি জায়গার,নাম চন্দ্রকেতুগড়।বিদ্যাধরী নদীর তীরে অবস্থিত জায়গাটি নাকি মোটামুটি লোকচক্ষুর অন্তরালে ছিল,হালফিলে কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্যের ফলে জায়গাটি খানিকটা প্রকাশ্যে এসেছে। তা হলেও জনগন এখনও ওখানে হামলে পড়ে না।

         সেবার পুজোর ছুটিতে ওখানেই উপস্থিত হলাম সপরিবারে, মানে স্ত্রী অনুরাধা আর ছেলে অর্ণবকে নিয়ে।আমার এক বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে উঠলাম।ঐতিহাসিক জায়গাগুলি দেখে নিলাম পরেরদিনই।সমস্ত জায়গা জুড়ে বিভিন্ন স্তূপ, ঢিপি।এগুলোর নাকি ঐতিহাসিক গুরুত্ব অসীম। বিভিন্ন যুগের নিদর্শন নাকি পাওয়া গেছে এখানে। খনা মিহিরের ঢিপিটা দেখতে দেখতে মনটা কোন অতীতে চলে গিয়েছিল!!তাছাড়া জায়গাটার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যেও মোহিত হলাম।সভ্যতার লোভী থাবা এখনও জায়গাটাকে গ্রাস করেনি।এখনও এখানে আকাশ গাঢ় নীল। নদীর ধারে হেঁটে নির্মল বায়ুসেবন করে যেন শহুরে ধোঁয়া ভর্তি ফুসফুসগুলো হাঁফ ছেড়ে বাঁচত।

        একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে ফিরলাম বন্ধুর বাড়ি।একদিন সন্ধ্যেবেলা আড্ডা দিচ্ছিলাম বারান্দায় বসে।আড্ডার বিষয়বস্তু ছিল- আশেপাশে আর কি কি দ্রষ্টব্য আছে।বন্ধুর কাছেই খবর পেলাম এখান থেকে আরো তিন চার কিমি দূরে একটা গ্রামে একটি সাপ্তাহিক হাট বসে প্রতি বুধবার। গ্রামের নাম ভুবনডাঙা।নামটাতেই আটকে গিয়েছিলাম।তাই হাটে যাওয়া মনস্থির করলাম পরেরদিন।পরেরদিনই ছিল বুধবার।তবে সেখানে নাকি কোন যানবাহনে যাওয়া চলবে না।জঙ্গলের ধার ঘেঁষে গ্রামটির অবস্থান। তাই হয় সাইকেল নাহয় পায়ে হাঁটা।আমার কাছে শেষোক্তটিই শ্রেয় মনে হল।

         গ্রাম্য হাট দেখতে আগ্রহ ছিল না বাকিদের।ছেলে আর তার মা যেতে রাজী হল না,হাঁটার ভয়েই বোধহয়।বন্ধুর থেকে পথনির্দেশ নিয়ে আমি একাই রওনা দিলাম।পথ খোঁজার মধ্যেও আনন্দ আছে।লোকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে হাট খুঁজে নিলাম।হাটে পৌঁছে দেখি আর পাঁচটা গ্রাম্য হাটের মতোই।বেশিরভাগ হাতের তৈরী জিনিস নিয়ে বসেছে গ্রামবাসীরা।ভীড় নেই। দোকানীরা যেন আড্ডার মেজাজে, বিক্রি না হলেও চিন্তা নেই। এদিককার অধিবাসীদের মূল জীবিকা নাকি চাষাবাদ।কাজেই হাটটা হয়ত জীবন মরণের প্রশ্ন নয় ওদের কাছে।

         জঙ্গলের সীমা দেখা যাচ্ছিল অনতিদূরেই।মনে হচ্ছিল খানিকটা জঙ্গল সাফ করেই যেন এই হাট বসানোর ব্যবস্থা করেছে গ্রামবাসীরা।যেহেতু এখানে পর্যটকদের আনাগোনা নামমাত্র সেহেতু বেশিরভাগ নিত্য ব্যবহারের সামগ্রীই বিক্রি হচ্ছিল ।বেতের চুপড়ি,সস্তা প্লাস্টিকের আয়না ইত্যাদি।কিন্তু পরিবেশটা বড় মনকাড়া। নীল আকাশের ক্যানভাসে দোকানীরা যেন রঙ তুলিতে আঁকা। দেখলাম খদ্দেররা দোকানীদের সাথে আড্ডায় মশগুল। 

         খানিকটা এগিয়ে দেখি এক কিশোরী পসরা সাজিয়ে বসে আছে।মায়াময় মুখ।আনমনা দৃষ্টি। তার পসরায় সুন্দর বেতের তৈরী জিনিস।একটা ফুলদান নজর কেড়েছিল।দাম জানতে চাইলাম।

"আমি এমনি জিনিস বেচি না গো বাবু।খরিদ্দার পচ্ছন্দ হলে তবেই বেচি।"

ওর কথায় হকচকিয়ে গিয়ে আমি বললাম, 
"এমন কথা তো শুনিনি কখনও।তা বল কিভাবে পচ্ছন্দ কর খরিদ্দারকে?"

"বাবু তোমার সবচেয়ে বড় দোষ কি? "

"দোষের কি অভাব আছে?তা হঠাৎ দোষের কথা কেন?"

"প্রশ্নের উত্তর প্রশ্নে হয় না বাবু।জবাব দাও।"

"রাগলে আমার মাথার ঠিক থাকে না,কি করি,কি বলি তার হুঁশ থাকে না।এটাই বোধহয় সবচেয়ে বড় দোষ।" খানিকটা ভেবে জবাব দিলাম।

"তাহলে বাবু ওই রাগকেই ত্যাগ করতে হবে।না করলে এ ফুলদান নষ্ট হয়ে যাবে।এই নাও।"

"সে কি গো,আমায় পচ্ছন্দ হয়ে গেল?"আমি অবাক হয়ে জানতে চাই।

"যে এককথায় নিজের দোষ স্বীকার করে তাকে পচ্ছন্দ না করে কি করি?"

         সেদিন ফুলদানটা নিয়ে বন্ধুর বাড়ি ফিরলাম।কিন্তু পুরোটাই যেন ঘোরের মধ্যে হল।এক গ্রাম্য বালিকা কি এ ভাষায় কথা বলে?আমি কি স্বপ্ন দেখলাম?তবে ফুলদানটা পেলাম কোথায়?পরেরদিনই কোলকাতায় ফেরার কথা।খুব যত্ন করে পুরনো খবরের কাগজে মুড়ে নিয়ে এলাম ওটাকে।বাড়ি ফিরে টেবিলে সাজালাম ফুলদানটা।যেই দেখত ওটার প্রশংসা করত।এমনকি দুরন্ত অর্ণবও দেখতাম ওটার দিকে তাকিয়ে বসে আছে।গিন্নী শত কাজ ফেলেও রোজ ওটা সাফ করতে বসত।অতিথিরা জানতে চাইত ওটা কোথা থেকে কেনা।বলাই বাহুল্য সেই কিশোরীর অদ্ভুত কথাবার্তা কাউকেই বলিনি।

         সেদিন দেখি গিন্নী ফুলদানে রজনীগন্ধা সাজাচ্ছেন, বিয়ের পর পর এটা দেখতাম।তারপর সাংসারিক ঘানিতে পিষ্ট হয়ে ওসব শখ চলে গিয়েছিল কবে।মনটা তাজা হয়ে গেল ফুলগুলো দেখে।
"রজনীগন্ধা! কত বছর বাদে!" গিন্নীকে বললাম আমি।
"আজ বেরিয়েছিলাম,রাস্তায় বিক্রি হতে দেখলাম, তাই নিলাম। তুমি তো ভালোবাসো।"গিন্নীর মুখে একটা সলাজ হাসি।যেন ফুলগুলো আনার জন্য লজ্জিত। 
"ভালোবাসি,তোমাকেও।"বললাম। গিন্নীর মুখটা আরো রাঙা হল। 
 এসে আমার মাথায় হাত রাখলেন গিন্নী ,কত যুগ পর।ফুলগুলো আর সাথে ফুলদানটা আমাদের দাম্পত্যের এক মিষ্টি মুহূর্তের সাক্ষী হয়ে রইল।
 
         এদিকে আমার সুপুত্রও দেখি কেমন শান্ত হয়ে গেছে। আগে কথা না মানা,অগোছালো স্বভাবের জন্য মায়ের কাছে বকা খেত রোজ।আজকাল দেখি নিয়ম মেনে পড়ে,নিয়ম মতো খেলে,আর অবসরে ফুলদানটার দিকে তাকিয়ে কি ভাবে।একদিন দেখি ওটাকে নিয়ে কবিতাও লিখে ফেলেছে। ভারী ভালো লাগল সেদিন।ছেলেটা একটা অনুভবী মন নিয়ে বড় হচ্ছে।আসলে আমাদের সকলকে ওই সামান্য বস্তুটা মায়ার বাঁধনে বেঁধে ফেলেছিল।আর সেই কিশোরী আমার মনের চিলেকোঠার ঘরে বসত করত সবসময়। কি ছিল তার সেদিনের কথাগুলোর মধ্যে, জানিনা।তবে তাকে ভুলতে পারিনি। 

         হ্যাঁ,বলা হয়নি,এ ক'মাস আমি রাগ করিনি একবারও।সবকিছু সুন্দর চলছিল।কিন্তু একদিন ছন্দপতন হল।অফিস থেকে বাড়ি ফিরে দেখি গ্রামের বাড়ি থেকে আমার জ্যাঠামশাই এসেছেন। সোফায় বসে চা পান করছেন।সামনে আমার স্ত্রী মৃত্যুদন্ড পাওয়া আসামির মতো দাঁড়িয়ে আছেন।বুঝতে পারলাম জ্যাঠামশাই ইতিমধ্যেই একচোট বক্তৃতা সেরে ফেলেছেন। পুরনো রাগটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠল আমার মনে।আমাকে দেখেই জ্যাঠামশাই নতুন উদ্যোগে শুরু করলেন,

"তুই তো নিজের আত্মীয়দের ভুলেই গেছিস।আমার ভাইটা চলে গেল।তারপর তোরা তো বাড়িতে যাওয়াই ছেড়ে দিলি।মনে রাখিস,যারা নিজের গ্রাম,নিজের মানুষকে ভালোবাসতে শেখেনি তারা ঠিকমতো মানুষ হয়নি।"

         আমার চন্ডাল রাগ জেগে উঠল।নিজেকে বলতে শুনলাম, 

"তোমার ভাই যখন দীর্ঘদিন শয্যাশায়ী ছিল,কদিন খোঁজ নিয়েছিলে?সে যাবার পর নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে এসেছিলে কেবল।স্নেহ করেছো যে সম্মানের প্রত্যাশা কর?"

        এটুকুতেই জ্যাঠার মুখ অপমানে নীল হল।উনি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, 

"স্নেহের টানেই এসেছিলাম আশুতোষ। "

উনি আর দাঁড়ান নি।আমিও ঘরের দরজা বন্ধ করে নিজের অভিমানের সাথে বোঝাপড়া করেছিলাম।আত্মীয়দের অনাত্মীয়তা আমাকে বরাবর পীড়িত করেছে।সেই পুঞ্জীভূত রাগটাই জ্যাঠামশায়ের ওপর বেরিয়ে এসেছিল।

         পরদিন সকালবেলা ঘুম ভাঙতে মনে হল যে কাল রাতে একটু বাড়াবাড়ি করেছি,অতটা না করলেও চলত।বাড়িতে আসা অতিথির অনাদর ভালো নয়।কিন্তু তখন আর কিছু করার নেই।তাই রোজকার অভ্যাসমতো ফুলদানটাকে একবার দেখতে গেলাম।দেখি ফুলদান টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। কেউ বলতে পারল না যে সেটা কিভাবে ভাঙল।আমার মনটা তখন ছটফট করছে।কিশোরীর কথা বার বার মনে পড়ছে-রাগ করলে ফুলদান নষ্ট হয়ে যাবে।ইটকাঠের এই পৃথিবীতে কি অলৌকিক কিছু সম্ভব? এ ঘটনার ব্যাখ্যা কি সেটা না জানা পর্যন্ত স্বস্তি পাব না।

         বুধবার অফিস থেকে অসুস্থতার অজুহাত দেখিয়ে ছুটি নিলাম।রওনা দিলাম চন্দ্রকেতুগড়ের উদ্দেশ্যে।বাড়িতে বললাম বন্ধু অসুস্থ। ভুবনডাঙার হাটে পৌঁছে কিন্তু কিশোরীর দেখা মিলল না।কিন্তু আমি তখন মরীয়া,আমাকে জানতেই হবে এসবের মানে কি?আশেপাশের বিক্রেতাদের কাছে বর্ণনা করতে তারা কিন্তু সহজেই চিনে নিল কিশোরীকে।প্রথমে কেউ অবশ্য আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে চায়নি।একজন বহিরাগতকে কেনই বা তারা তাদের আভ্যন্তরীণ খবর দেবে?শেষমেশ এক বৃদ্ধা আমাকে সেই ভাগ্যহীনার কাহিনী শোনালেন।আমি তাকে আমার সাথে কিশোরীর আগের দিনের সব কথাবার্তা আর আজকে তার খোঁজ করার কারণ জানিয়েছিলাম। 

"ওর নাম লক্ষী, বাবু।আমরা ডাকতাম লখাই।ভারী সরল মেয়ে, খানিকটা পাগলাটে।ওর মা ছোটবেলাতেই মরে গিয়েছিল। বাবা মাতাল,অন্য কারোর সাথে থাকত।লখাই ওর দাদুর ঘরে মানুষ। 

         তারপর একদিন বাবাটা ফিরে এল।থাকতে চাইল ওর সাথে।সে নাকি নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে।লখাইয়ের মনটা নরম।ও রাজী হল।কিন্তু শর্ত রাখল। বলল মদ ছাড়তে হবে।ছেড়েওছিল।কিন্তু একদিন কোন অনামুখো বন্ধু এল,তার পাল্লায় পরে আবার মদ খেল আপদটা।লখাই কি কান্নাই কাঁদল।পরেরদিন থেকে কি জ্বর এল মেয়ের।মেয়েটা আর উঠল না।"

         আমি শিউরে উঠলাম। কি জানি কেন আমার মনে একটা অদ্ভুত তত্ত্ব এল।লখাই আমাকে বলেছিল রাগ করলে তার তৈরী ফুলদান নষ্ট হয়ে যাবে। অর্থাৎ একটি দোষের বদলে একটি বস্তু।আর বাবাকে বলেছিল মদ না খেতে।তার বদলে বাবাকে সে তার আপন সত্তাকে দিয়েছিল।বাবা মদ খাওয়ার ফলেই কি তাহলে তার সেই সত্তা নষ্ট হয়ে গেল? 

         কিন্তু এও কি সম্ভব? মানুষ যুক্তিবদ্ধ জীব।সব রহস্যের মীমাংসা করেই সে শান্তি পায়।অথচ মানুষকে ঘিরে থাকে কত রহস্য।আমার কাছে লখাইও একটি নিরুত্তর প্রশ্নের মতো থেকে গেল আজীবন। 

        এরপর থেকে যখনই কোন অজানা জায়গায় গেছি বেড়াতে, কোন অচেনা মানবীকে প্রকৃতির কোলে বিচরণ করতে দেখেছি,তখনই লখাই আমার মনের মধ্যে ফিরে এসেছে। একবার মাত্র তাকে আমি দেখেছিলাম অথচ তার মুখ আমি ভুলিনি। তার তৈরী করা ফুলদানটা আমি নষ্ট করে ফেলেছিলাম নিজের দোষে,কিন্তু তাকে দেওয়া আমার কথা আমি আর ভাঙিনি।রাগকে আমি ত্যাগ করেছি।তাতে জীবন আমার কাছে স্বমহিমায় এসেছে। আমাকে ভরিয়ে রেখেছে সৌরভে।
...................................
 
Tumpa Biswas
 

 

আমার মুক্তি আলোয় আলোয় - শুচিস্মিতা চক্রবর্তী

 



আমার মুক্তি আলোয় আলোয়
শুচিস্মিতা চক্রবর্তী
 
            

(১)
 
 
- ভোকাট্টা...ভোকাট্টা...

    আকাশের বুক চিরে, বাড়ি-ঘরের ছাদ ছুয়ে ,গাছের উঁচু ডাল ছুঁয়ে  মাতাল হাওয়ায় তালে তাল মিলিয়ে ঘুরে ঘুরে নামছে চাঁদিয়ালটা আর তার পেছনে ছয় থেকে ষোলো মাঠের ধূলো,রাস্তার ভিড়,বাড়ির পাঁচিল সমস্ত বাধা ঠেলে ঘুড়ির স্বাধীনতাকে নিজের করায়ত্ত করার দৌড়ে সামিল।যার হাতে ঘুড়ি,সেই তার ভবিষ্যৎ মালিক।তাছাড়া দলে তখন তার কদরই আলাদা।এমন সময় ছন্দপতন।বাঁজখাই গলায় মায়ের ডাক
- পিকলু,শিগগির ঘরে ঢোক...

- আর একটু মা, ঘুড়িটা লুফেই আসছি

- না, এক্ষুনি। আর একটা কথা নয়!

অগত‍্যা শত অনিচ্ছা সত্ত্বেও গুটিগুটি পায়ে বাড়ি ঢোকে পিকলু ওরফে ঋদ্ধি।ওর ঘাড়ের ওপর দিয়ে হুশ করে দমকা হাওয়ায় মত এগিয়ে যায় ছেলে-ছোকরার দল।

- কতবার বলেছি ঐ সব আজেবাজে ছেলেগুলোর সাথে একদম খেলবিনা।পড়া নেই শোনা নেই সারাদিন টো টো করে সব ঘুরে বেড়ায় আর তোর যত মেলামেশা ওদের সঙ্গেই...
     যাও এক্ষুনি মাস্টারমশাই আসবেন, হাত মুখ ধুয়ে পড়তে বসে যাও।
ঘাড় গুঁজে একটি কোণে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে পিকলু।বোঝাই যাচ্ছে একটি কথাও তার কানে ঢোকেনি।তার চোখে এখনও সেই মাতাল ঘুড়িটা ঘুরে ঘুরে নামছে আর পিকলু প্রাণপনে দৌড়ে চলেছে ...আর একটু ,আর একটু ;ঘুড়ির সুতো প্রায় পিকলুর হাতের মুঠোয়...

- বলি কথা কিছু কানে ঢুকছে?
 ধপাস করে ফিরে আসে পিকলু ঘরের ভেতর।মিনমিন করে বলে,
- ওরাও সবাই ইসকুলে পড়ে মা!

- আমাকে উদ্ধার করে বাবা! একটা বিশ্রী মুখভঙ্গি করে পিকলুর মা বলে,
তুই আর কোনদিন ওদের সাথে খেলবি না।এই আমি শেষ বারের মত বলে দিলাম।

- তাহলে আমি কাদের সাথে খেলব?পিকলুর চোখ জলে ভরে আসে।

- বাড়িতে থাকবে।পড়াশুনো করবে,ছবি আঁকবে,তবলা বাজাবে,গান শুনবে কিন্তু ঘরের বাইরে নয়।

(২)

- মুক্তি আর স্বাধীনতা দুইটো কি একই জিনিস বাবা?

- মুক্তি আর স্বাধীনতা, দুটোই প্রায় সমার্থক হলেও দুটোর মধ‍্যেই একটা সূক্ষ্ম পার্থক্য আছে ,বুঝলি রামদাস।
এই যে তুই সকাল থেকে সন্ধ্যে আমার কাছে পড়ে থাকিস , তোকে কেউ কিছু বলেও না ,তোর যা ইচ্ছে তুই তাই করিস।এটা তোর স্বাধীনতা।কিন্তু দিন শেষে সেই ঘরটিতে ফিরে যাস।যেখেনে তোর মা তোর অপেক্ষায় ভাতের থালা নিয়ে বসে আছে।সেইটে হল টান।পিছুটান।এর জন্য তুই কোথাও গিয়ে থাকতে পারিসনে,মন আকুলি বিকুলি করে তাইতো?

- হ‍্যাঁ, বাবা ; দিনশেষে একবারটি ঘরে যে ফিরতেই হবেক...

- ঐ,  ঐ হল গিয়ে মায়া! যতদিন থাকবে ততদিন ফিরে ফিরে যাবি। মুক্তি নেই।যেদিন আর ফিরে যেতে মন চায়বিনে সেইদিন জানবি তোর মুক্তি।

- তাইলে কি আমার মুক্তি নেই বাবা? 

- তোর কি চিন্তা রে পাগলা?তুই তো স্বাধীন রে...বলেই হো হো করে হেসে উঠলেন বাবা অনিলানন্দ মহারাজ।

- আর আপনে বাবা?

      এক চমকে হাসি থেমে গিয়ে নিজের মধ্যেই হারিয়ে গেলেন বাবা।
- আমি? আমার মুক্তি নেই রে ...আর স্বাধীনতা তো নেইই।সেই ছোট্ট থেকেই বড্ড পরাধীন।

- আপনের তো বাবা, ঘর নেই, সংসার নেই, আগায়- পিছায় কুনো পিছ্টান নেই,আপনে তো পুরা স্বাধীন...

- না রে না ; এই যে তোরা রোজ আসিস্,গল্প করিস্,এই যে আমার বাসা এই ফেলে কি আমি যখন যেদিকে ইচ্ছে চলে যেতে পারছি? পারছি না রে...কেন জানিস্?এই তোদের ভালোবাসা, তোদের সাথে কাটানো সময়,ভালো সময়, এই ছেড়ে যেতে পারছিনা...এটাই মায়া। জড়িয়ে গিয়েছি ।মুক্তি নেই।

- বাবা,আপনের বাড়ির কথা মনে পড়ে?মায়ের কথা,বাপের কথা?

- ও আমার আগের জন্ম রে! তবে মনে কি আর পড়ে না! পড়ে, ইস্কুল, বই,ব‍্যাগ,তবলা,ঘুড়ি...
আবার আনমনা হয়ে পড়েন বাবা।কিছুক্ষণ এক দৃষ্টিতে সামনের তালগাছটার দিকে তাকিয়ে থাকেন।
রামদাস গলা খাঁকারি দিলে আবার ফিরে আসেন।

- মুখগুলো ভালো করে আর মনে পড়ে না জানিস্ ; সব মায়েরাই বোধ হয় একই রকম দেখতে, তাই না রে?

(৩)
 
    তারপর থেকে সত‍্যিই মা আর কোনোদিন  বাইরে বেরোতে দেয়নি।ঘরের চার দেওয়ালে বন্দি পিকলুর মন ছুটে চলত দেশ থেকে দেশান্তরে,সাগর নদী পেরিয়ে মেঘের ভেলায় পাড়ি দিয়ে বহুদূর।
পড়াশোনায় বরাবর ভালো পিকলু।মনের ইচ্ছে পাইলট হবে।উড়ে বেড়াবে দেশ দেশান্তরে।কিন্তু আবার সেই স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ।বাবা বললেন,
- ঐসব প্লেন টেন চালানো হবে না।ভালো রেজাল্ট যখন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ো।ভবিষ্যৎ ভালো।
দাঁতে দাঁত চেপে কেটেছিল চারটে বছর। সেখানেও দারুণ রেজাল্ট।শেষ সেমিস্টারের আগেই লোভনীয় অঙ্কের চাকরি।
মা-বাবা দুজনেই ভীষণ খুশি হয়েছিলেন।প্রাণ ভরে আশীর্বাদ করেছিলেন ছেলেকে।
-“আরও বড় হও, পৃথিবীর সমস্ত আনন্দ তোমাকে ঘিরে থাকুক”

পিকলু বড় হয়ে আকাশ ছুঁতে চেয়েছিল, সেই চাঁদিয়ালটার মত ।কিন্তু তার সুতোটাও অকালেই ছিঁড়ে পড়েছিল।

    ন’টা পাঁচটার ঘেরাটোপে অস্হির হয়ে উঠেছিল পিকলু।শরীর মন বিদ্রোহ করতে শুরু করে।মা-বাবা ভাবেন যৌবন তার স্বাভাবিক চাহিদার বশবর্তী।পিকলুর বিয়ের জন্য পাত্রী দেখতে শুরু করেন।
আবার বাঁধন।এক নয়,দুই নয়,সাত পাকের বাঁধন।মা-বাবা,পরিজনদের কথা ভেবে এই কাজটাও করে নেয় পিকলু।বিয়ে, ফুলশয্যা আর মাত্র দুটো দিন ; নতুন বৌয়ের মুখটাও ভালো করে দেখেনা সে।নিজেকে আর ভুলিয়ে রাখতে পারেনা, সব ছেড়ে ছুড়ে রওনা দেয় নিরুদ্দেশে।মায়ের জন্য বুকটা প্রথমে মোচড় দিয়েছিল বটে, আর ঐ নববধূটির জন্য।ওর তো কোনো দোষ ছিল না!কিন্তু না আর পিছুটান নয়, এত পরাধীন জীবন,এত শিকল পিকলুর জন্য নয়।

    ঘুরতে ঘুরতে ট্রেনে,বাসে পায়ে হেঁটে পিকলু এসে পৌঁছেছিল মনিকর্ণিকার ঘাটে।ক্ষুধার্ত, তৃষ্ণার্ত ,ক্লান্ত অবসন্ন শরীরে হেঁটে যাচ্ছিল ঘাট বরাবর।হঠাৎ কানে এল অশ্রাব্য কিছু গালিগালাজ-
- শালা শুয়ো—বা—আমার সাথে ধান্দাবাজী? মুনাফা ?মুনাফার মন্তর বলতে হবে? শালা গতর খাটাবিনে ,গদিতে বসে মন্ত্র পড়ে মুনাফা হবে?জটাধারী সাধু দেখলেই খালি মতলব না? ম‍্যাজিসিয়ান মনে করিস্ নাকি? দুনিয়ার কোনো ম‍্যাজিসিয়ান পারবেক নাই,ঐ উ ম‍্যাজিসিয়ান ভি না...
বলে বামহাতের তর্জনী উঠিয়ে আকাশের দিকে নির্দেশ করেন আর ডানহাতে একখান চ‍্যালাকাঠ ছুঁড়ে মারেন কথাগুলো এতক্ষণ যার উদ্দেশ্যে বলছিলেন তার দিকে।ভাগ্য ভালো অল্পের জন্য ফস্কে গেল ।সে বেচারা পড়ি কি মরি করে কোনোরকমে সেখান থেকে পালিয়ে বাঁচে।

    দেখেই বোঝা যায় ব‍্যবসায়ী গোছের মানুষ।ইচ্ছে ছিল সাধুর কাছে মন্ত্র-তন্ত্র শিখে ব‍্যবসায় ভালো লাভের মুখ দেখবে।কিন্তু এ যা মূর্তি দেখল ,আর সারা জীবনেও বোধ হয় সাধু-সন্ন্যাসীর পথ মাড়াবেনা।
নিজের মনেই খানিক হেসে পিছনদিকে পা বাড়াতেই সেই গলা; কিন্তু এখন বেশ নরম।
- মুক্তি কি আর অত সহজ রে বেটা? তবে আজাদী মিলবে ।

    থমকে দাঁড়িয়ে গেল পিকলু।চকিতে ফিরে দেখে সেই সাধু তখন পিকলুর দিকে তাকিয়েই মিটিমিটি হাসছেন।কোথায় সেই উগ্র রূপ! তার বদলে শান্ত সমাহিত বড় মায়াময় দুটো চোখ।যেন পিকলুকেই ডাকছে।
পিকলু মন্ত্রমুগ্ধের মত এক পা এক পা করে এগিয়ে যায়।হাতদুটো যেন নিজে থেকেই জড়ো হয়ে আসে।– “কি বললেন বাবা আপনি?”
- ছাড় ছাড়,উসব কথা ছাড় দিকি। প‍্যাটে তো দানাপানি পড়েনি।আয় আয় ভিতরে আয়।

    যেন কতকালের চেনা।কিছু আগেই যে মানুষটা আরেকজনকে দুরছাই করছিল,সেই মানুষই কিনা পিকলুর মতো এক অজানা অচেনাকে নিজের কুটিরে ডাকছে!
- অচেনা কাঁহা রে বেটা? এই তু এলি,এবার গল্প করবি,চিনে লিব।একটা মানুষকে চিনতে কতক্ষণ লাগে?
- আপনি কি মন পড়তে জানেন?
হাঃ হাঃ হাঃ করে দরাজ হাসি হেসে উঠলেন বাবা।মুখে বললেন, “ যা ঐ কোণের প‍্যাকেটটা লিয়ে আয়...”

    এতক্ষণ ভালো করে দেখেনি পিকলু।এবার চতুর্দিকে চোখ ঘুরিয়ে দেখল ঘর বলতে ছেঁড়াখোঁড়া ত্রিপলের ছাউনি।কোণে একখান ভাঙা টুলের উপর চারটে নারকেলের খোল,একটা মাটির ঘড়া আর একটা প‍্যাকেট।একদিকে একটা দড়িতে ময়লা গামছা আর কিছু লাল কাপড় মতো,ঠিক তেমন যেরকমটা এখন ওনার লজ্জা নিবারণ করছে।
ধীরে ধীরে গিয়ে প‍্যাকেটটা নিয়ে সাধুর সামনে এল পিকলু।মনে হল ছাতুর প‍্যাকেট।নিয়ে আসা মাত্রই সাধু পিকলুর হাত থেকে ছোঁ মেরে ওটা নিয়ে সামনে রাখা কমন্ডলুর মধ্যে ঢেলে ঘটঘট করে নিজে খানিকটা খেয়ে বাড়িয়ে দিল পিকলুর দিকে-
- “লে পি’লে...দিল ঠান্ডা হবে।মাথা ভি।“
পিকলুও কথা না বাড়িয়ে গলায় ঢেলে নিল।
আহ্!কি শান্তি।চোখ জুড়ে ঘুম আসে পিকলুর।সেই সাধুর ছাউনিতেই খোলা মাটিতে শুয়ে পড়ে সে।

    সেই শুরু।আর বাড়ির কথা মনে করেনি সে।সাধুর সাথেই ঘুরে বেড়িয়েছে এক ঘাট থেকে আরেক ঘাট,পাহাড় থেকে সমুদ্র।যা পেয়েছে তাই খেয়েছে, যেখানে পেরেছে সেখানেই আশ্রয় নিয়েছে।সাধুবাবাই ওকে বলেছে,- “তু হাওয়ার মতো আছিস্,বেটা; একদম নিরমল,একদম সচ্চা।তোর নাম অনিলানন্দ”।
যেখানেই গেছে মানুষ ছেঁকে ধরেছে।তার গুরুর প্রেমের বাণী শোনার জন্য লোক ভিড় জমিয়েছে।কিন্তু কোনো জায়গায় গুরু বেশিদিন থাকেননি।ইহজগতেও না।দেহত‍্যাগের সময় ঠিক কত বয়স হয়েছিল পিকলু বলতে না পারলেও তাঁর বলে যাওয়া অমর বাণীগুলো পিকলু ওরফে অনিলানন্দর কন্ঠস্থ।গুরুর মতো শিষ‍্যের কাছেও লোক আসে দলে দলে।
তারা সব জীবনের পাঠ নেয়।না,কোনো সমস্যার সমাধান নয়,বরং সেটার সঙ্গে লড়ে জেতার মন্ত্র তারা অবশ্যই পায়।
এদের নানাবিধ সাংসারিক দেনা-পাওনা,সুখ-দুঃখের জালে জড়িয়ে পড়ে অনিলানন্দ।ভক্তদের বানিয়ে দেওয়া কুটিরে আশ্রয় নেন।আর কোথাও যাওয়া হয় না।
স্বাধীনতা হারায়।আবার জড়িয়ে পড়েন স্নেহের বাঁধনে।

(৪)
 
    প্রতিদিন এই বেলা পড়ে এলে একে একে মহল্লার নানা বয়সের পুরুষ-মহিলা জড়ো হয় চৌকিতে অনিলবাবার “পাঠ” শুনবে বলে।বাবা কোনোদিন গীতা পড়েন,তো কোনোদিন মহাভারত পড়েন।আবার মাঝে মাঝে কোরান, বাইবেল, গুরু গ্রন্থসাহেব তো কখনও জাতকের গল্প নিজের কথায় সরল করে ভক্তদের পড়ে শোনান।সবার সাথে বন্ধুর মতো মেশেন,দাদার মত পথ দেখান,বাবার মতো স্নেহ করেন।নানাবিধ প্রশ্নের উত্তরও দেন।শুধু নিজের কথা কিচ্ছুটি বলেন না।ওনার কথা কেউ জিজ্ঞেস করলেই বলেন
- ও তো আমার গতজন্ম, এ জন্মে আমি স্বাধীন।তোমাদের ভালোবাসাতেই আমার মুক্তি।

আবার হারিয়ে যায় অনিলানন্দ।ভাবে,সত্যিই কি সে স্বাধীনতার স্বাদ পেয়েছে?ছোট থেকে যে স্বাধীনতার জন্য ঘর-পরিবার সমস্ত ত‍্যাগ করে এল,এই কি তাই! তবে মনে সেই আনন্দ নেই কেন?
গুরুজী যে বলতেন, “ত‍্যাগেই মুক্তি, ত‍্যাগেই আনন্দ”
ঘর-সংসার ত‍্যাগ করে বাঁধন থেকে নিজেকে মুক্তি করছি,চিন্তা থেকে পেরেছি কি?মায়ের মুখ মনে না থাকলে কি হবে, মাঝে মাঝেই ঘুমের ঘোরে ‘পিকলু’ বলে যে আকুল ডাক শুনতে পাই! তার কি হবে? আর ঐ নববিবাহিতা স্ত্রী, ক্ষনিকের জন‍্যও গ্রহন না করেই যাকে ত‍্যাগ করে এলাম, সে কি ক্ষমা করতে পেরেছে? এ স্বাধীনতায় যে বড় বিষাদ মিশে আছে।

আঁধার নামে চৌকিতে।নারী-পুরুষেরা এক এক করে বাড়ির পথ ধরে।রামদাস ছোট্ট পিতলের লম্ফটাতে একটু তেল দিয়ে সলতেটা উসকিয়ে দেয়।
- বাবা, দুটো সন্দেশ আর একটু চিড়ে রেখে গেলাম ।খেয়ে লিবেন।
সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়ে অনিলানন্দ।

- সাবধানে যাস। বলে রামদাসের গতিপথের দিকে তাকিয়ে হাত নাড়তে গিয়েই  চোখ যায় আসরের কোণে বসা মহিলার দিকে।সেই কোন দুপুর থেকে উনি ওখানে ঠায় বসেই রয়েছেন।কোনও প্রশ্নও করেননি।
আজ মহাভারতের নবম অধ‍্যায় পড়তে পড়তে বারে বারে চোখ চলে যাচ্ছিল ঐ মহিলার দিকে।আগে কোনদিন ওনাকে এখানে দেখেছেন বলে তো মনে পড়ে না।চেনা চেনাও লাগছে না। ওনাকে দেখেই বারে বার অনিলানন্দ হারিয়ে যাচ্ছিলেন, ফিরে যাচ্ছিলেন নিজের অতীতে।অথচ এমন তো হওয়ার কথা নয়! তিনি তো অতীত ভুলেছেন বহু আগেই।তিনি স্বাধীন,তিনি মুক্ত।

    বারবার নিজেকে সামলে নিচ্ছিলেন।এখন সবাই চলে যাওয়ার পর মহিলা ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন।পরনে হালকা রঙের তাঁতের শাড়ি।এখন আঁধার নামতে যদিও রঙ বোঝা যায় না।সাদা-সাদা মতোই মনে হয়।সারাদিন দেখলেও রঙটা ঠিক মনে করতে পারেন না অনিলানন্দ।মহিলা ধীর গতিতে এগিয়ে আসতে থাকে তার দিকে।আসরের প্রায় প্রত‍্যেক মহিলাকেই ‘মা’ বলে সম্বোধন করলেও কেন না জানে এনার ক্ষেত্রে সেই ‘মা’টি কিছুতেই মুখে এল না।সম্বোধন উহ‍্য রেখেই তিনি বললেন,
- আপনি কি কোনো বিশেষ উদ্দেশ্যে এসেছেন? সেই দ্বিপ্রহর থেকেই আপনাকে দেখছি, অথচ আপনার জিজ্ঞাসা কিছু ছিল বলে তো মনে পড়ছে না...

- আপনি ঠিকই ধরেছেন।আপনার কাছে আমার জিজ্ঞাস‍্য কিছুই নেই।যদিও আপনি মহাজ্ঞানী, আপনার অনেক ভক্ত...
মহিলার কথাগুলো বড় কঠোর, কর্কশ ঠেকে অনিলানন্দর কানে।তিনি বেশ বিরক্ত বোধ করেন।তবুও কন্ঠের উষ্মা যথাসম্ভব আড়াল করে ধীর কন্ঠে জিজ্ঞেস করেন
- তাহলে এখনও আপনার এখানে কি প্রয়োজন?

- মুক্তি

- মুক্তি?আমি?আমি দেব মুক্তি?আমি আপনাকে মুক্তি দেওয়ার কে?

- শ্রীমান ঋদ্ধি ভট্টাচার্য্য।
চমকে ওঠেন অনিলানন্দ।তেলের বাতিটা ধীরে ধীরে মহিলার মুখের সামনে বাড়িয়ে ধরেন।

- কে আপনি? আমার পূর্বজন্মের নাম আপনি কি করে জানলেন?
কিছুক্ষণ নিকষ নীরবতা।তারপর ধীরে ধীরে চোখ তুলে সোজা অনিলানন্দর চোখে চোখ রেখে বলেন
- আমি ইন্দ্রাণী, ইন্দ্রানী মুখোপাধ্যায় ভট্টাচার্য্য ।প্রথমের নামটা যতটা দৃঢ়তার সঙ্গে উচ্চারণ করেছিল,পরের ভট্টাচার্য্য শব্দটা ততটাই ক্ষীণ স্বরে মুখ দিয়ে বেরোল।

- ইন্দ্রানী ! নামটা বেশ শোনা শোনা...
অতর্কিতে হাত থেকে তেলের বাতিটা পড়ে যায় অনিলানন্দর।ইন্দ্রানী তাড়াতাড়ি পিছিয়ে গিয়ে সামাল দিয়ে আবার বাতিটা জ্বালানোর চেষ্টা করে।

- আপনি,মানে তুমি ইন্দ্রানী! কিন্তু আমিতো ...
কথা জড়িয়ে আসে অনিলানন্দর।কি বলবেন কিছুই বুঝতে পারেন না।সমস্ত অতীত যেন মাথার চারপাশে ঘুরপাক খেতে থাকে।সেই সানাই,জোড়ের মালা,সাতপাক,ফুলশয্যা তারপর পালিয়ে আসা,মনিকর্ণিকার ঘাটে গুরুজীর সাথে দেখা...সব।

- আপনি অকারণে ভীত হবেন না।এতদিন পর আমি আপনার কাছে কোনো দাবি নিয়ে আসিনি।আমার আপনার প্রতি কোনো ক্ষোভও নেই, কোনো প্রশ্ন বা কৈফিয়তও আমার চাই না।আমার শুধু মুক্তি চাই।

- কিন্তু আমি মুক্তি দেব কি প্রকারে? আমি তো সেই দিনই তোমায় সমস্ত বাঁধন থেকে মুক্ত করে চলে এসেছিলাম।তুমি তো স্বাধীন।আর তো কোনো বাঁধন নেই।
- হ‍্যাঁ, আমি স্বাধীন।সেই অর্থে আমার কোনো বাঁধন নেই কিন্তু আমি যে মুক্ত নই।এখনও আমার নামের পাশে অকারণে আপনার পদবীটা রয়ে গেছে।ঐটা থেকে যে আমার মুক্তি চাই!
অবাক চোখে চেয়ে থাকেন অনিলানন্দ।

- আমি সধবা নই,বিধবা নই,ডিভোর্সি নই ; স্বামী পরিত‍্যক্তা ! এ যে ঘোর অপবাদ, সমাজের চোখে অপরাধ।আমার কি দোষ ছিল আমি জানি না কিন্তু ঐ একটি পদবী আমার সমস্ত স্বাধীনতাকে খানখান করে দিয়েছে।হাজার নিষেধ আর নিয়মের বেড়াজালে বেঁধে দিয়েছে আমার জীবন।এর থেকে আমার মুক্তি চাই।বহু দিন ধরে আমি আপনার খোঁজ করে চলেছি...
- “এখন আমার কি করণীয় ইন্দ্রানী?” হাজার ভাঙা গড়া চলছে বুক জুড়ে।

- শুধু একটা সই।আমি আপনাকে বাঁধতে আসিনি।শুধু নিজের ন‍্যায‍্য স্বাধীনতাটুকু ভিক্ষা চাই।

- আমায় ক্ষমা করতে পারবে তো?

- সে ক্ষমতা আমার নেই। বলেই কাঁধের ঝোলানো ব‍্যাগ থেকে একতাড়া কাগজ বের করে বাতির সামনে মেলে ধরল।
কাগজগুলোকে ঠিক যেন ছোটবেলার সেই এক একটা চাঁদিয়া্লের মতো মনে হতে লাগল।ঢিল ছাড়লেই উড়ে যাবে নিরুদ্দেশে।এখন তো ডোরও নিজের হাতে নেই! 

    ধীরপদে ইন্দ্রানী আঁধারে মিলিয়ে গেল।স্বাধীনতা স্বাধীনতা করে সারাজীবন হাহাকার করে যাওয়া মানুষটাকে যেন বড় সহজেই এই তুচ্ছ শব্দটার গূঢ় অর্থ বুঝিয়ে দিয়ে গেল।প্রদীপের তেলও কমে এসেছে।রাতের আঁধার যেন বড় গাঢ় হয়ে আসছে।
সারাজীবন স্বাধীনতার পেছনে ছুটে চলা পিকলু আজ বুঝতে পারল আসল স্বাধীনতার অর্থ।বড় বড় জ্ঞান দেওয়া বাবা অনিলানন্দর সমস্ত অহং রাতের তারাদের আলোয় হারিয়ে গেল।গুরুজী যথার্থ বলতেন- “দিল খুশ,তো সব খুশ, আজাদী মন থেকে আসে বাচ্চা; মুক্তি তো মনের”।

পড়ে থাকল তার পর্ণকুটির,গোছানো আসর,চৌকি,তেলের বাতি...সব কিছু পেছনে ছেড়ে মনের আনন্দে আলোর পথে পাড়ি দিল অনিলানন্দ ; না না ,পিকলু...
 
........................................
 
Suchismita Chakraborty
 

 

উত্তরাধিকার- দেবাশিস্‌ ভট্টাচার্য্য

 


উত্তরাধিকার

দেবাশিস্‌ ভট্টাচার্য্য

 

 

    বৃষ্টির মধ্যে রাস্তায় পা রাখতেই অজিতের তার সেল ফোনটা বেজে উঠল। রাত আটটা বেজে গেছে, অফিস থেকে তার পি জি হাঁটাপথে পাঁচ মিনিট। স্ক্রীনে নম্বরটা ভালো করে দেখতে পেল না তবে কারও নাম না দেখানোয় বুঝল অচেনা নম্বর থেকে ফোনটা এসেছে। “হ্যালো!” বলতেই শুনতে পেল কাকার পরিচিত গলা।

“কেমন আছিস? অনেকদিন কোন খবর নেই”।

“না কাকা কাজের চাপ যাচ্ছে, সময় পাই না। তুমি কেমন আছ?”

“আমি ভালো আছি। তোর তো শনি রবি ছুটি কাল একবার এখানে আয়” কাকা বেশ জোরের সাথেই বললেন।

“ কেন, বিশেষ কোন দরকার?”

“হ্যাঁ, খুবই দরকার। এখানকার বিষয় সম্পত্তির একটা ব্যবস্থা না করলেই নয়। কাল শনিবার, কাল চলে আয় পরশু ভোর ভোর না হয় বেরিয়ে যাবি”।

আপনজন বলতে এই কাকা ছাড়া আর কেউ নেই। ছোটবেলায় এই কাকা অনেক কোলে পিঠে করেছে। অনেকদিন কাকার একটা খবর পর্যন্ত নেয় নি। তাই কাকার কথা ফেলতে পারে না সে, “ ঠিক আছে যাব কাল”।

নানা কথা ভাবতে ভাবতে পি জি তে এসে পৌঁছাল অজিত। কলকাতায় অজিতের আস্তানা বলতে এই পি জি, তার রুমমেট নেপাল বেড়াতে গেছে তাই সে রুমে এখন একা। রাতে পি জির মালিক রতনকাকুর কাজের লোক রবিদা টিফিনক্যারিয়ারে করে রাতের খাবার আনলে অজিত  বলে দিল আগামীকাল সে বাড়ি যাবে ফলে খাবার না দিতে।

 

    মেদিনীপুরের প্রত্যন্ত গ্রাম পারুলদা সেখানেই তার জন্ম। পাকা বাড়ি, চাষের জমি, পুকুর, অবস্থা মন্দ নয়। মা, বাবা, কাকা আর হরিদা এই ছিল তাদের সংসার। হরিদার তিনকূলে কেউ ছিল না, বাবা তাকে কোথাও থেকে নিয়ে এসেছিল। সে ছোট থেকেই হরিদা কে দেখছে। কাকা বাবার থেকে বছর তিনেকের ছোট, বিয়ে করে নি। সে ছিল কাকার অত্যন্ত আদরের। বাবা মা র চেয়েও কাকা তার বেশী আপন ছিল। বারো বছর বয়সে অজিত মা কে হারায়। বাবা, কাকা আর হরিদা তাকে মানুষ করে। মা মারা যাবার পর কাকা তাকে যেন আরো বেশী করে আগলে রাখতে থাকে। সাইকেলে তিন মাইল দূরের স্কুলে যেত, বর্ষায় ঝামেলার একশেষ। সেই স্কুল থেকেই খুব ভালোভাবে হায়ার সেকেন্ডারি আর জয়েন্টে পাস করে সুযোগ পায় আনন্দপুরের ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে। গ্রামের ছেলে কলকাতার মত অজানা অচেনা শহরে গিয়ে একা থাকতে হবে ভেবেই হাত পা পেটের ভেতর সেঁধিয়ে যাচ্ছিল। তাছাড়া ওখানে প্রচুর খরচ বলে সে দ্বিধায় ছিল, কিন্তু কাকার আশ্বাসে সে ভর্ত্তি হয়ে যায়। হোস্টেলেও জায়গা পেয়ে যায়, সমস্ত খরচ কাকাই পাঠাত। আই টি ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে ক্যাম্পাস থেকেই এই চাকরী। পোস্টিং হয় বেঙ্গালুরুতে। প্রথম প্রথম তার মন টিঁকত না সেখানে। কাকাও দু দুবার বেঙ্গালুরুতে এসে দেখে যায় তার প্রিয় ভাইপো খোকন কেমন আছে। খোকনকে ছাড়া দেশে তারও মন টিঁকত না।

 

    তারপর অজিতের মন লেগে যায়, বছরে একবারই আসত। বেঙ্গালুরুতে আসার তিন বছরের মাথায় বাবার মৃত্যু সংবাদ পেয়ে শেষবারের মত দেশের বাড়িতে এসেছিল। কাকার সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ ছিল, কিন্তু আগ্রহটা কাকার তরফেই বেশী ছিল। ধীরে ধীরে সম্পর্কটায় ভাঁটা পড়ে যাতে থাকে। বহুবার কাকা দেশে ঘুরে যাবার জন্য বলেছে, কিন্তু যাচ্ছি যাব করে যাওয়া হয়ে ওঠেনি। পাঁচ বছর বেঙ্গালুরুতে কাটানর পর গত দুবছর হল কলকাতায় প্রমোশন পেয়ে বদলি হয়ে এসেছে। তাও দেশের বাড়ি যাওয়া হয়ে ওঠেনি।

অফিসের কাজের চাপ আর পিঙ্কি।

 

    অজিতের প্রেমিকা ও সহকর্মী পিঙ্কি। পাঞ্জাবী, তবে দুই পুরুষ ধরে কলকাতায় বাস। ভবানীপুরে নিজেদের বাড়ি। পিঙ্কি শুধু রূপবতীই নয়, অনেক গুণ তার। পিঙ্কি খুব ভালো রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে পারে। কলকাতা অফিসে জয়েন করার পরে পরেই পিঙ্কিকে দেখে মুগ্ধ হয়ে যায় অজিত। তারপর মেলামেশা ও ঘনিষ্ঠতা, এখন তো পিঙ্কিকে ছাড়া জীবন অজিত ভাবতেই পারে না। সপ্তাহের পাঁচদিন দুজনে একসঙ্গে কাজ করলেও উইকএন্ড গুলোয় পিঙ্কিকেও সময় দিতে হয়। তার ওপর একটা ফ্ল্যাট কেনার চেষ্টায় বেশ ঘোরাঘুরি করতে হচ্ছে। বিয়েটা শীগগিরই সেরে ফেলতে হবে আর বিয়ের পর তো অজিত শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে থাকতে পারে না বা বউ নিয়ে পি জি তে উঠতে পারে না। তাই একটা ফ্ল্যাট না কিনতে পারলেই নয়।

 

    শেষবার কাকার সাথে ফোনে কথা বলেছে বোধহয় বছর ঘুরতে চলল। অপরাধ বোধ জাগে তার মনে, “যে কাকার জন্যে আজ সবকিছু, সেই কাকাকে... নাঃ, কাল দেশে গিয়ে ক্ষমা চেয়ে নিতে হবে।”

তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ে, সকাল সাড়ে ছটার মেদিনীপুর লোকাল ধরতে হবে।

 

    ভোর চারটের সময় প্রোজেক্ট হেডের ফোন, একটা সফটওয়্যার কাজ করছে না ক্লায়েন্টের খুব অসুবিধা হচ্ছে, অজিতকে একবার অফিসে আসতেই হবে। সকাল ছটায় অফিসে ঢুকল একেবারে ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে দেশে যাবার জন্যে তৈরী হয়ে, কিন্তু সব কিছু ঠিক করতে বিকেল চারটে বেজে গেল। হাওড়া পৌঁছতে প্রায় পাঁচটা বাজল।

 

    ট্রেনের জানলা দিয়ে বুভুক্ষুর মত গ্রাম বাংলার দৃশ্য দেখতে থাকে। হালকা মেঘ করেছে, ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে। ক্ষেতের কাজ শেষ করে পুরুষেরা একটু আলসেমী করছে, বিড়ি ধরিয়েছে। মাথায় বোঝা নিয়ে মেয়েরা, বউরা যাচ্ছে, গরু নিয়ে যাচ্ছে বালকেরা, কোথাও ট্রাক্টর দাঁড়িয়ে আছে। তারে ফিঙের ঝাঁক বসে আছে। দ্রুত দৃশ্যপট বদল ও হতে থাকে। বাঁশগাছে ঘেরা ছোট্ট পুকুর, হাঁস চরছে, মাঝে মাঝে হাঁস মাথা ডুবিয়ে বোধহয় গেঁড়ি গুগলি খাচ্ছে, পুকুর পাড়ে দাঁড়ান হাঁসগুলো ঘাড় ঘুরিয়ে পিঠে ঠোট ডুবিয়ে চুলকে নিচ্ছে। মুগ্ধ হয়ে দেখতে থাকে অজিত। হঠিতকারেকটা আমবাগান দেখে বিদ্যুৎ চমকের মত চোখে ভেসে ওঠে দেশের এক ঝড় বাদলের দিনে আমবাগানে দৌড়োদৌড়ির কথা। সাধনদের আমের বাগানে খুব আম হত, ঝড় হলেই সে দৌড় দিত আম কুড়োতে। অবশ্যই একা নয়, তার সাথী ছিল কবিতা। মনে পড়ে, বিপুলকাকার মেয়ে কবিতাকে। খুব ভাব ছিল তার সাথে, একসাথে স্কুলে যাওয়া আসা, ঝড়ে আম কুড়ান, বৃষ্টিতে ভেজা, একসাথে খেলা। ছোটবেলার সমস্ত দুরন্তপনার সাথী। তার যৌবনে কোন মেয়েকে প্রথম চুম্বনের স্বাদও সে পায় কবিতার কাছেই। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সময় গরমের ছুটিতে কলকাতা থেকে দেশে ফিরেছে। নির্জন দুপুরে, বিপিনকাকাদের বাড়িতে সেই প্রথম চুম্বনের ঘটনা। কবিতার নাকের ডগায় বিন্দু বিন্দু ঘাম, তিরতির করে কাঁপছিল সেদিন ওর পুরন্ত ঠোঁট দুটো, টানা টানা বড় বড় চোখ দুটো বুঁজিয়েছিল সে। আজও এতদিন পরেও সেই দৃশ্যটা তার চোখে ভাসছে, একদম অমলিন সে স্মৃতি।

   

    কিন্তু বেঙ্গালুরুতে গিয়ে ধীরে ধীরে সবই ভুলে যায়। আজ স্মৃতির দরজা খুলে হু হু করে সব পুরনো ঘটনা মানসপটে ভেসে উঠতে থাকে। বাবার কাজে এসে কবিতাকে না দেখেও মনে কোন প্রশ্ন জাগেনি। বিলকুল ভুলে গিয়েছিল তাকে! কখন যেন তার মনের পৃষ্ঠা থেকে ইরেজার ঘষে ঘষে কেউ কবিতার ছবিটাকে যেন মুছে দিয়েছিল। জানলা দিয়ে বাইরে থেকে আসা ঠান্ডা জলো হাওয়া ঝাপটা মারে তার চোখে মুখে। চোখ দুটো কেন জানি না কড়কড় করে ওঠে।

 

    স্টেশনে পৌঁছল সাড়ে আটটায়। শনিবার হওয়ায় অনেক লোকই কলকাতা থেকে বাড়ি ফিরছে, লোকের ভীড়ের সাথে বেরিয়ে বাসস্ট্যান্ডে এল অজিত। যেতে হবে রামকৃষ্ণপুর। রামকৃষ্ণপুরের বাসস্ট্যান্ডে নেমে সাঁকো পার হলেই তাদের গ্রাম পারুলদা।আকাশে মেঘ আরো গাঢ় হয়েছে টিপ্‌টিপ্‌ বৃষ্টিও শুরু হল। অজিতের ভাগ্য ভাল, স্ট্যান্ডে গিয়ে বাসে বসার জায়গাও পেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাস ছেড়ে দিল।

 

    রামকৃষ্ণপুরে যখন বাস পৌঁছল তখন বৃষ্টি বেশ জোরেই পড়ছে, প্রায় পৌনে দশটা বাজে। এমনিতে এই সময়ে বাস স্টপেজে কিছু দোকান গুমটি খোলা থাকারই কথা কিন্তু বৃষ্টির জন্যে আজ একটাও খোলা নেই। একটা বন্ধ দোকানের চালার নীচে দাঁড়াল সে। রাস্তার বাঁ দিকেই আছে খাল। বেশ চওড়া, খাল পার হলেই তাদের গ্রাম পারুলদা। অনেক আগে এই খাল পার হতে হত গ্রীষ্মে হেঁটে আর বর্ষায় ডোঙায়, তাদের ছোটবেলাতেই খালের ওপর বাঁশের সাঁকো তৈরী হয় আর এখন পাকা কংক্রিটের সাঁকো তৈরী হয়েছে একাধিক। সামনেই প্রথম সাঁকোটা পেরিয়ে পারুলদা, আধ মাইল দূরে আরেকটা সাঁকো সেটা পার হলে তালক্ষিরি একইরকমভাবে আরো মাইলখানেক পর তৃতীয়টা পার হলে পাকুরপুর। বন্ধ দোকানের চালার নীচে দাঁড়িয়ে যে বৃষ্টির ছাঁট থেকে পুরোপুরি বাঁচতে পারছে এমন নয়, তবে মাথাটা বাঁচছে।

 

    বৃষ্টির জোর খানিকটা কমতে অজিত সাকোঁয় উঠে পড়ল। দেখল উল্টোদিক থেকে ছাতা মাথায় হ্যারিকেন হাতে কেউ আসছে।

“কে রে, খোকন নাকি?” হরিদা’র গলা।

“ হরিদা কোথায় চললে?”

“যাব আবার কোথায়? সন্ধ্যের পর থেকে একটা করে বাস গেলেই আমি একবার করে দেখে যাচ্ছি তুই এলি কিনা”।

“আজও অফিস যেতে হল আর বেরতেও দেরী হয়ে গেল। কেমন আছ সবাই?”

“আমরা সবাই ভালই আছি” সংক্ষিপ্ত জবাব হরিদা’র। অজিতের হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে কাঁধে ঝুলিয়ে নিয়ে একহাতে হ্যারিকেন আর এক হাতে ছাতাটা অজিতের মাথায় ধরে হরিদা।

“আমি কি আর একা একা যেতে পারতাম না? সবই তো চেনা”।

“ সে ঠিকই, কিন্তু আজ সন্ধ্যায় অল্প ঝড় হয়েছে, তাতে করে গাঁয়ে কারেন্ট নেই। অন্ধকারে কোথায় সাপখোপ আছে তাই আমিই এলাম”।

কথা বলতে বলতে দুজনে এগুতে থাকে।

“বিপিনকাকার মেয়ে কবিতার কি খবর গো?” একটু ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করেই ফেলে অজিত।

“তোর সাথে তো খুব ভাব ছিল। তোর কাকার খুব ইচ্ছে ছিল তোদের বিয়ে দেওয়ার। কবিতারও বোধ করি তেমন ইচ্ছেই ছিল, কিন্তু ওদের অবস্থা তেমন ভালো ছিলনা। বিপিনদার বউটা ছিল খান্ডার প্রকৃতির তুই তো জানিস। তা বিপিনদার শালা এক পাত্র ঠিক করে। সে ছিল মাতাল আর চরিত্রহীন তাই কিছুদিনের মধ্যেই কবিতাকে গাঁয়ে ফিরে আসতে হল। মেয়ের দুঃখ সইতে না পেরেই বোধহয় বিপিনদা চলে গেল। বিপিনদা মারা যেতে মা আর মেয়ে পড়ল ভারী কষ্টে। তা তোর কাকা একটা ব্যবস্থা করল।  আমাদের যে রাধাকৃষ্ণের মন্দির আছে তার পূজারী বিষ্টু ভট্‌চাযের বয়েস হয়েছে, তাই তাকেই পূজোয় সাহায্য করত, মন্দির পরষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখত। দুবেলা ভোগ প্রসাদ আর একটা মাসোহারার ব্যবস্থা হয়েছিল। ঘরে চল্‌ ওর সাথে দেখা হয়ে যাবে”।

শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেল অজিতের।

 

    অজিতদের বাড়িটা গ্রামের একধারে। পুকুর আর বাগান ঘেরা বাড়িটাকে গ্রাম থেকে আলাদা করে রেখেছে। হরিদা দরজার কড়া নাড়তেই দরজা খুলে দিল কবিতা। সারা চোখে মুখে গভীর বিষাদের ছাপ।

হাঁ করে অজিত তাকিয়ে থাকে কবিতার দিকে। এ কোন কবিতা? এমন শান্ত নিষ্প্রাণ বিষাদমূর্ত্তি কবিতাকে সে দেখেনি। কোথায় গেল সেই প্রাণ চঞ্চল, প্রাজাপতির মত উড়ে বেড়ান কবিতা? একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে বুকের ভেতর থেকে।

“ভেতরে এস!” কবিতার কথায় বাস্তবে ফেরে অজিত।

সে ঢুকল বাড়ির ভেতরে, “কাকা কোথায়?” হাঁক দেয় অজিত।

এই তো আমি!”  

কাকা কে দেখে অবাক হয়ে যায় অজিত। কী বুড়ো লাগছে, কেমন যেন রুগ্ন। সামনে ঝুঁকে হাঁটছে। কে বলবে এই কাকার একদিন কি সুন্দর চেহারা ছিল। কখনো কাকার শরীর খারাপ হতে দেখেনি সে।

“কী হয়েছে তোমার? এ কী চেহারা হয়েছে?” বলতে বলতে এগিয়ে যায় অজিত, নীচু হয় প্রণাম করার জন্যে।

“থাক্‌ থাক্‌ প্রণাম করার দরকার নেই, কাল সকালে আগে মন্দিরের রাধা কৃষ্ণকে প্রণাম করিস তারপর অন্য কারোকে। যা আগে হাত মুখ ধুয়ে নে তারপর খেতে বসে কথা হবে”।

মেঝেতে কয়েকটা হ্যারিকেন জ্বলছিল, একটা তুলে নিয়ে এগিয়ে আসে হরিদা, “চল্‌, দোতলায় তোর ঘরটা পরিষ্কার করেই রাখা আছে, আজ কবিতা কাচা চাদর টাদর সব পেতে দিয়েছে”।

ঘরে ঢুকে অজিত দেখে সব কিছু একদম আগের মতই আছে, সেই খাট, সেই পড়ার টেবিল চেয়ার, টেব্‌ল ল্যাম্প।

হরিদা টেবিলের ওপর হ্যারিকেন রেখে বলে, “আমি নীচে গেলাম, খাবার গরম করছি। হাত মুখ ধুয়ে চলে আসিস, স্নান করিস না এত রাতে”।

হাত মুখ ধুয়ে পোষাক পালটে নীচে আসতে কাকা বলে, “খোকন চলে আয়, আমরা খেয়ে নিলে হরি আর কবিতা খাবে”।

অজিত এসে বসে খাবার টেবিলে, হরিদা আর কবিতা পরিবেশন করতে থাকে। অজিতের অতি প্রিয় সব পদ রান্না হয়েছে। বহু বছর পর বেশ তৃপ্তি করে খেল অজিত। খেতে খেতে অজিত সকলের সাথেই পুরনো দিনের গল্পে মেতে ওঠে। একসময়ে খাওয়া শেষ হয়। অজিত কাকাকে জিজ্ঞেস করে, “ কি জরুরী দরকার বলছিলে?”

কাকা হাত মুখ ধুয়ে নিজের ঘর থেকে একতাড়া কাগজ এনে অজিতের হাতে দিয়ে বললেন, “ এটা আমাদের সমস্ত সম্পত্তি, জমি জায়গার দলিল। সব কিছুই তোর নামে রেজিস্ট্রি করিয়ে রেখেছি। যত্ন করে রেখে দে, পরে পড়ে দেখিস। আমার শরীর বিশেষ ভালো নয়, আমি শুয়ে পড়ছি। তুইও ক্লান্ত আজ আর গল্প করে সময় নষ্ট করিস না ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়”।

“এসবের এক্ষুণি কী দরকার ছিল?”

“আছে, দরকার আছে। আমার আর হরির দুজনেরই বয়েস হয়েছে। কবে আছি কবে নেই, এই বেলা সম্পত্তির পাকাপাকি বিলি বন্দোবস্ত না করলে সব বেহাত হয়ে যাবে”।

“তোমার শরীরে কি হয়েছে?”

“বার্দ্ধক্য আর কিছু নয়”। এই বলে কাকা উঠে পড়ে।

 

    হরিদা আর কবিতার সাথে গল্প করার ইচ্ছে থাকলেও উঠে পড়ে অজিত। ঘরে গিয়ে কাগজের তাড়াটা টেবিলে রেখে শুয়ে পড়ে। শুয়ে শুয়ে সিনেমার ফ্ল্যাশব্যাকের মত তার চোখে ভেসে উঠতে থাকে ছোটবেলার একটার পর একটা ঘটনা। কাকার কাঁধে চড়ে গ্রামের রাস্তায় ঘুরে বেড়ান, দুষ্টুমি করার জন্যে বাবার হাতে মার খাওয়া আর মারের হাত থেকে কাকার বাঁচান। যখন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে কলকাতায় আসছিল, তাকে ট্রেনে তুলতে এসে ছেলেমানুষের মত কাকার কান্না। তবে স্টেশনে সেদিন আরেকজনও কেঁদেছিল, প্ল্যাটফর্মের দেবদারু গাছটার মোটা গুঁড়িটার আড়ালে দাঁড়িয়ে। সেদিন কবিতার কান্না তার চোখ এড়ায়নি। যতক্ষণ না প্ল্যাটফর্ম তার দেবদারু গাছকে নিয়ে চোখের আড়ালে চলে গেল, ততক্ষণ ট্রেনের দরজার কাছে দাঁড়িয়েছিল অজিত। গরমের ছুটি পূজোর ছুটিতে এলে কী আনন্দ সকলের! এই সব ঘটনা মনে পড়ার সাথে সাথে আত্মগ্লানি অনুভব করে অজিত। এদের এত ভালোবাসার প্রতিদানে কী দিতে পেরেছে সে! উলটে এদেরই দূরে ঠেলে রেখেছে, একপ্রকার ভুলেই ছিল এদের। এই উপেক্ষা তো এদের প্রাপ্য ছিল না! এইসব ভাবতে ভাবতে একসময়ে গভীর ঘুমে তলিয়ে যায় অজিত।

 

অনেক লোকের গলার আওয়াজ আর চেঁচামেচিতে ঘুম ভাঙ্গে অজিতের। দেখে সকাল হয়ে গেছে। চেঁচামেচিটা আসছে বাড়ির বাইরে থেকে। দ্রুত বিছানা ছেড়ে নীচে নেমে আসে অজিত। হরিদা কে কবার ডাক দেয় কিন্তু কোন উত্তর পায় না। ইতিমধ্যে কারা যেন সদর দরজা ধাক্কা দিচ্ছে।

দরজা খুলে দেখে গ্রামের অনেকেই জড়ো হয়েছে, তারা অজিতকে দেখে অবাক, “ তুমি কখন এলে? কে খবর দিল?”

“কাল রাতে এসেছি। কিন্তু কি খবর?”

তখন গ্রামের লোকেদের কাছে জানতে পারে পরশু বিকালে খুব ঝড় বৃষ্টি হয়েছিল। সেই ঝড় বৃষ্টির সময়ে ক্ষেতে ছিল কাকা আর হরিদা। বাজ পড়ে দুজনেই মারা যায়। অজিতের ফোন নম্বর না থাকায় কেউ খবর দিতে পারেনি। আজ সকালে এরা চলেছে মেদিনীপুর টাউনে, মর্গ থেকে দুজনের লাশ আনতে। গ্রামের লোকেদের কথা শুনে বিশ্বাস হতে চায় না অজিতের, একবার ঘরের ভিতর দিকে ঘুরে তাকায়, যদি কারোকে দেখতে পায়। কোনরকমে নিজেকে সামলে কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করে অজিত,

“আর কবিতা?”

“ও তো গত চৈত্র মাসে কাকভোরে মন্দিরের পূজোর ফুল তুলতে গিয়ে সাপের কামড়ে মারা যায়”। গ্রামবাসীদের উত্তর শুনে চৌকাঠের উপরেই ধপ করে বসে পড়ে অজিত। তার মাথাটা ঘুরতে থাকে, তাহলে পরশু রাতের কাকার ফোন কল, কালকের দেখা হরিদা, কাকা, কবিতা সব মিথ্যে? দিশেহারা হয়ে পড়ে অজিত।

“তুমি যখন এসেই গেছ, তখন চল আমাদের সাথে, ওদের দুজনের শেষকৃত্য তো করতে হবে?”

অজিত বলে, “আসছি, পোষাকটা পালটে আসি”। এই বলে দোতলায় নিজের ঘরে ঢোকে অজিত। দেখে কাল রাতে কাকার দেওয়া কাগজের তাড়াটা তখনও টেবিলের ওপর রাখা রয়েছে। এখন গোটা ব্যাপারটা অজিতের কাছে পরিষ্কার। তাকে সম্পত্তি বুঝিয়ে দিতেই কাকা ডেকে পাঠিয়েছিল।

রক্তের টান বুঝি একেই বলে!

 

সমাপ্ত

 

Debasish Bhattacharyya

 


 

স্বপ্ন-সূত্র - মধুমিতা মুখার্জী

 

স্বপ্ন-সূত্র
মধুমিতা মুখার্জী
 

    আজকাল সকালে ঘুম থেকে উঠেও কেমন একটা ক্লান্তি সারা শরীরে ছেয়ে থাকে। মনে হয়, এর থেকে আমার আর নিস্তার নেই। ভালোই ছিলাম এতদিন। যেদিন থেকে নতুন উপসর্গগুলো দেখা দিয়েছে; আমার মনের শান্তি নষ্ট হয়ে গেছে। 
 
    নতুন উপসর্গ বলতে, আমার স্বপ্নের কথা বলছি। বিয়ের পর হিমাচল প্রদেশে চলে এসে ভালো ছিলাম। পুরনো সব স্মৃতি ধীরে ধীরে মন থেকে চলে গেছিল। স্বপ্নে আবার সেই স্মৃতিগুলো ফিরে আসছে। স্বপ্নের মধ‍্যে সেই পুরোনো স্মৃতির সূত্র এসে প্রতিরাতে আমাকে অস্হির করে তুলছে; ধরতে গিয়েও তাদের ঠিকমত ধরতে পারছিনা। সেই অধরা স্বপ্ন-সূত্র আমাকে সারাদিন তাড়া করে চলেছে।
এখানে আসার ঠিক তিন মাস পরেই এই সমস্যার সূত্রপাত। একরাতে গভীর ঘুমের মধ‍্যে প্রথম স্বপ্নটা দেখলাম। দেখলাম, আমাদের বাংলোর মধ‍্যে সর্বক্ষণ ‘মিউ মিউ’ করে পায়ে পায়ে ঘুরে বেড়ানো দুধ সাদা বিড়ালটাকে। কিন্তু, বিড়ালটার চোখদুটো অন‍্যরকমের ছিল। সেই চোখের দৃষ্টি আমি জীবনেও ভুলতে পারবনা। আমার স্বপ্নে বিড়ালটার সবুজ চোখ বদলে মণির রঙ ঘন নীল দেখেছিলাম। এইরকম ঘন নীল চোখ আমি বহু আগে একজনের দেখেছিলাম; সারা জীবনেও ভুলবনা। সেই চোখদুটো বহুদিন আমাকে জীবন্ত দগ্ধ করেছে, কাউকেই বলে উঠতে পারিনি। বাবার গুরুদেব সেই সুঠাম দেহের অধিকারী, নিত‍্যানন্দ বাবাজীর চোখদুটো আশ্চর্য রকমের ঘন নীল ছিল। সেইবার তিনি আমাদের বাড়িতে আসার পরে পা টিপে সেবা করার জন‍্য আমাকে পছন্দ করেছিলেন। দরজা বন্ধ করে সেদিন…। উফফ! সেই ভয়াবহ স্মৃতি আমি চেষ্টা করে ভুলে ছিলাম। স্বপ্নে বিড়ালটার চোখদুটো বদলে ওইরকম হয়ে যেতে আবার মনে পড়ে গেল। স্বপ্নে বিড়ালটা আমার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল, ঠিক সেই গুরুদেবের মত। আমি ভয় পেয়ে বিড়ালটাকে দরজার খিল খুলে মারতে গিয়েও ব‍্যর্থ হলাম। যেমন হঠাৎ করে উদয় হয়েছিল; তেমনভাবেই মিলিয়ে গেল বিড়ালটা। আমি আবার ঘুমিয়ে পড়লাম। সারাদিন কেমন একটা ক্লান্তি আমাকে ঘিরে রইল। আমার স্বামী মৃদুল সকালে আমার দিকে কেমনভাবে তাকিয়ে ছিল। আমার খুব ভয় করছিল, ঘুমের মধ‍্যে আবার নিত‍্যানন্দ বাবাজীর কথা বলে ফেলিনি তো? ও যেটা বলা হয়নি- সেই দুধসাদা বিড়ালটাকে আর আমাদের বাংলোতে দেখতে পেলাম না। বেড়ালটা মৃদুলের খুব প্রিয় ছিল, প্রতিদিন অফিস যাওয়ার আগে নিজের হাতে বেড়ালটাকে দুধ খাওয়াত। সেটাকে দেখতে না পেয়ে ও একবারও খোঁজ করলনা, এটাই আশ্চর্য ব‍্যাপার। যাইহোক, আমিও বিড়ালটাকে আর দেখতে চাইছিলাম না।
 
    ধীরে ধীরে সব স্বাভাবিক হয়ে আসছিল। আবার নতুন স্বপ্ন এসে সবকিছু তোলপাড় করে দিল। দিনটা ভালোভাবেই শুরু হয়েছিল। সকাল থেকে ঘন নীল আকাশে মেঘের খেলা দেখে মনটা ভালো ছিল। রাতে গভীর ঘুমের মধ‍্যে আবার একটা স্বপ্ন দেখলাম। সেই স্বপ্নে আমাদের ফাইফরমাস খাটা বাচ্চা ছেলে সঞ্জুকে দেখলাম। সঞ্জুর বয়স মাত্র বারো বছর, শিশু শ্রমিক। স্বপ্নে দেখলাম সঞ্জু আমার দিকে এগিয়ে আসছে। শুধুমাত্র এইটুকু দেখেই আমি অস্হির হইনি। দেখলাম, সঞ্জুর হাতদুটো অস্বাভাবিক দেখাচ্ছে। অস্বাভাবিক বলতে, ওর ফর্সা রঙের সাথে বেমানান মিশকালো হাত! শুধু তাই নয়, হাতদুটো লম্বা লম্বা…বড়দের মত। ঠিক এইরকম হাত আমি দেখেছিলাম। আমাদের পুরোনো পাড়ার মুদির দোকানদার তারকের এমন কালো-লোমশ হাত ছিল। দুপুরবেলায় আমাকে কেন যে মা তারকের দোকানে নুন কিনতে পাঠাল সেদিন! ফাঁকা দোকানে আমাকে একা পেয়ে…
 
    ভুলতে চেয়েও যে ভুলতে পারিনা সেকথা। সেদিন ফেরার সময় হাতের নুনের প‍্যাকেটের নুন - নাকি আমার গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়া জল কোনটা বেশি নোনতা ছিল বুঝে উঠতে পারিনি কোনোদিন। 
 
    আমি স্বপ্নে সঞ্জুকে আমার দিকে এগিয়ে আসতে দেখে, ভয় পেয়ে গেছিলাম। স্বপ্নেই দরজার খিলটা নিতে গিয়ে সেটা খুঁজে পেলাম না। তখন টেবিলে রাখা পেতলের ওজনদার ফুলদানিটা নিয়ে ওর দিকে ছুঁড়তে গিয়ে দেখলাম সঞ্জু হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। ঠিক বেড়ালটার মত। এমন অদ্ভুত স্বপ্ন পৃথিবীতে আর কেউ দেখে বলে মনে হয়না। জানেন, পরেরদিন সকালে আর সঞ্জুকে দেখতে পেলাম না, এমনকি সেই ফুলদানিটাও দেখলাম না। মৃদুল কেমনভাবে যেন আমার দিকে তাকিয়েছিল। একটা আস্ত মানুষ আর একটা বিড়ালের মধ‍্যে কিছু পার্থক্য আছে। সঞ্জুর ঘরে ওর জামা-কাপড় পড়েছিল অবহেলায়। শুধুমাত্র, বিছানার চাদরটা নিয়ে সঞ্জু কোথায় চলে গেছিল। মৃদুল কিন্তু সেই নিয়ে একটা কথাও বললনা, আমিও বললাম না। এমনিতেই আর সঞ্জুকে চোখের সামনে দেখতে চাইছিলাম না। মৃদুল অবশ্য সঞ্জুর বাড়িতে খবর দিয়েছিল। ওর হত দরিদ্র বাবা-মা পাশের পাহাড়ের গ্রাম থেকে এসে বেশ খানিকটা কান্নাকাটি করে মৃদুলের দেওয়া দশ হাজার টাকা নিয়ে, চোখের জল মুছে ফিরেও গেছিল। আবার সবকিছু স্বাভাবিকভাবেই চলতে থাকল। একটা হতদরিদ্র পাহাড়ি পরিবারের পাঁচ নম্বর সন্তান হারিয়ে গেলে অবশ্য তেমন কিছু হেলদোল দেখা যাওয়ার কথাও নয়। 
 
    সেই গুরুদেব আর পাড়ার মুদির দোকানদার তারকের সাথেও এমন আশ্চর্য কিছু ঘটনা ঘটেছিল। নাহ্, তারা হারিয়ে যায়নি। গুরুদেব আমাদের বাড়ির তিনতলার একমাত্র ঘরটায় অতিথি হিসাবে কিছুদিন ধরে ছিলেন। আমাদের পুরোনো দিনের বাড়ি বলে শৌচাগারগুলো একতলায় বাড়ির উঠোনের একপাশে ছিল। গুরুদেব স্নান করার জন‍্য সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে গড়িয়ে পড়ে গেছিলেন। শিরদাঁড়ায় এমন আঘাত লেগেছিল যে তিনি আর কখনোই উঠে দাঁড়াতে পারেননি। সিঁড়িতে নাকি তেল পড়েছিল, মনে হয় গুরুদেব স্নান করতে যাবেন বলে বেশি করে তেল মেখেছিলেন। হয়ত, সিঁড়ির সামনে দাঁড়িয়েই তেল মাখছিলেন! কিছুই বলা যায়না।
 
    তারকের সাথে আবার অন‍্যরকমের ঘটনা হয়েছিল। তারক রোজ দুপুরে দোকানে বসে, বাড়ি থেকে নিয়ে আসা টিফিন বক্স খুলে ভাত খেত। একদিন, ও দুপুরে খাওয়ার পরেই মুখ দিয়ে গ‍্যাঁজলা বেরিয়ে, অজ্ঞান হয়ে যায়। বেশ কিছুক্ষণ ওইভাবে একা দোকানে পড়ে ছিল। বিকেলে একজন খরিদ্দার এসে তারককে ভাতের থালার সামনে ওই অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে চিৎকার করে লোকজন জড়ো করে হাসপাতালে দেয়। সে যাত্রায় তারক আর বেঁচে ফিরতে পারেনি। তারকের পাকস্হলীতে ইঁদুর মারার বিষ পাওয়া গেছিল। কিন্তু, ওর মায়ের বানিয়ে দেওয়া ভাত, তরকারিতে সেই বিষ পাওয়া যায়নি। পাকস্হলীতে নাকি মিষ্টি পাওয়া গেছিল! অথচ, তারকের মা সেদিন টিফিনে মিষ্টি দেননি বলেই পুলিশের কাছে জানিয়েছিলেন। আশ্চর্য ব‍্যাপার…খুব আশ্চর্য ব‍্যাপার। এতদিন পরে আমার স্বপ্নে তাদের বিশেষত্বগুলো দেখাটাও অত‍্যন্ত বিস্ময়কর ঘটনা। 

    আসল সমস্যার সূত্রপাত এই দ্বিতীয় স্বপ্নের পরেই হল। মৃদুল বদলে গেল। অবশ্য মৃদুল বদলে গেল বলাটা ঠিক নয়…ওর আচার-আচরণ বদলে গেল। ও আমার সাথে স্বাভাবিক ব‍্যবহার করা বন্ধ করে দিল। আমি যদিও এমনিতেই কম কথার মানুষ; তাও মৃদুলের আমাকে ঘিরে পাগলামোগুলো খুব মনে পড়ত বিভিন্ন সময়ে। আমাদের তিনমাসের দাম্পত‍্য কিন্তু বেশ আবেগঘন ছিল। পরিবর্তিত মৃদুল যন্ত্রের মত নিজের কর্তব্য করে চলেছিল, আলাদাভাবে কোনো কথাবার্তা আর বলতনা। সে না বলুক, আমার সাথে ঘনিষ্ঠ হতে চাইতনা সেটাই খারাপ লাগত। মাঝেমধ‍্যে অফিস থেকে ফিরে কার সাথে যেন দেখা করতে যেতে শুরু করল। ফোনেও কারোর সাথে আড়ালে গিয়ে কথাবার্তা বলতে শুরু করল। বুঝতে পারছিলাম, আমার কপাল পুড়েছে। এরপরই একদিন মনে হল,  অফিসে যাওয়ার সময় আমার খাবারের সাথে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দিয়ে যায় মৃদুল। সারাদিন খুব ঘুম পেত। অফিসে যাওয়ার সময় জোর করে এক গ্লাস হরলিক্স নিয়ে এসে মুখের সামনে ধরে বলত, “এটা খেয়ে নাও, তমালিকা। তুমি খুব দুর্বল হয়ে পড়ছ।"
 
    প্রথম প্রথম সন্দেহ করিনি, মনে হয়েছিল সত‍্যিই আমার স্বাস্থ্য নিয়ে চিন্তা করছে। পরে বুঝতে পারি, ওসব লোকদেখানো ব‍্যাপার। আসলে মৃদুল চাইছিল যে, আমি সারাদিন ঘুমিয়ে থাকি। আমি বহু চেষ্টা করেছিলাম যাতে ও হরলিক্স রেখে চলে যায়। তাহলে সুবিধামতো ফেলে দেওয়া যাবে। কিন্তু, ও নিজের হাতে খাইয়ে তবেই অফিসে যেত। আমিও হরলিক্স খেয়েই গভীর ঘুমে ঢলে পড়তাম। জেগে থাকলেও খুব ক্লান্ত লাগত।
 
    সেদিন একটা অন‍্যরকমের স্বপ্ন দেখলাম। সেই স্বপ্নটা দেখার পর থেকে আমি মনেমনে খুব অস্হির হয়ে পড়লাম। দেখলাম, একটা বিশাল বড় সাপ ফনা তুলে আমাকে ছোবল মারতে আসছে। আমি আশেপাশে কিছু আঘাত করার মতো আছে নাকি খুঁজে দেখতে গিয়ে কিছু না পেয়ে ছোট তেপায়া টেবিলটা হাতে তুলে নিলাম। সাপটাকে আঘাত করতে গিয়ে যা দেখলাম, তাতে আমার সারা শরীর ভয়ে কেঁপে উঠল। দেখলাম, সাপটার মুখটা পুরো মৃদুলের মতো হয়ে গেছে। ওর হাঁ মুখের ভেতর থেকে চেরা জিভ বার করে আমাকে ছোবল মারার জন‍্য প্রস্তুত হয়ে আছে। আমি প্রাণপণে শক্তি সঞ্চয় করে সাপটার দিকে টেবিল ছুঁড়ে মারতে যাই। সাপটা আমাকে লেজের ডগা দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে। আর কিছুই মনে নেই। সকালে উঠে ভয়ে ভয়ে তেপায়া টেবিলটার দিকে তাকিয়ে দেখি সেটা যথাস্হানে আছে। আমি ধীরে ধীরে বিছানা ছেড়ে উঠে বাইরের ঘরে মৃদুলকে সংবাদপত্র হাতে বসে থাকতে দেখে স্বস্তির শ্বাস ফেলি। আগের দু’বার স্বপ্নে যাকেই দেখেছিলাম; ঘুম ভেঙে উঠে তাকে আর কোথাও দেখতে পাইনি। এবার ব‍্যতিক্রম। আমি মৃদুলকে দেখে স্বস্তি পেলেও ঠিক আনন্দ পেয়েছি নাকি বুঝতে পারছিলাম না। আমি ঠিক করলাম, সেদিন হরলিক্স কিছুতেই খাবনা। মৃদুল অফিসে যাওয়ার সময় হরলিক্স গুলে কাপে করে নিয়ে এসেছিল। আমি বললাম, “আজ আমি হরলিক্স খাবনা।“
মৃদুল কেমন যেন ঘাবড়ে গিয়ে বলল, “সরবত করে আনব?”
আমি মুখের ভাব করুণ করে বললাম, “আমি আজ কোনোরকমের পানীয় খেতে চাইছিনা। আজকের মতো আমাকে ছেড়ে দাও।“
 
    মৃদুল কিছুক্ষণ ভুরু কুঁচকে কিসব চিন্তা করে আমার কথা মেনে নিল। মনে হল, ও সেদিন আমাকে ঘুমের ওষুধ না খাওয়াতে পেরে একটু হতাশ হয়ে পড়েছে। 
বিকেলে বাড়ি ফিরেই অন‍্য ঘরে গিয়ে ফোন নিয়ে বসে পড়ল। সেদিন আমার সারাদিন ঘুম পায়নি, তাই সজাগ ছিলাম। ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে বহু কষ্টে কান পেতে শুনলাম, মৃদুল খাদের মধ‍্যে কাউকে ফেলে দেওয়ার কথা বলছে। ভালো করে শুনতে পাইনি। তবে মনে হল, খাদ, অবোধ, ফেলে দেওয়া এইসব শব্দ নিয়ে কিছু বলছে। মনে হচ্ছে কঠিন কোনো পরামর্শ করছে কারোর সাথে। খুব ভয় করছিল আমার, আসলে আমাদের বাংলোর ঠিক পেছনেই গভীর খাদ। সেই খাদের নিচের দিকটায় সর্বক্ষণ অন্ধকার জমাট বেঁধে থাকে…এতটাই গভীর সেই খাদ। একটু পরেই প্রতিদিনের মতো বেরিয়ে পড়ল মৃদুল। আমি একটু দূর থেকে ওকে অনুসরণ করলাম। পাহাড়ের একটা বাঁকে গিয়ে একজন সৌম‍্যদর্শন বৃদ্ধের সাথে মৃদুল হাত-পা নেড়ে কথা বলছিল। আমি ধীরে ধীরে সেদিকে এগিয়ে গেলাম। দুজনেই কথাবার্তায় এত মগ্ন ছিল যে, আমার উপস্হিতি প্রথমে বুঝতে পারেনি। আমাকে হঠাৎ সেই ভদ্রলোক দেখতে পেয়েই চিৎকার করে উঠলেন, “মৃদুল! আমি এই ভয়টাই পাচ্ছিলাম।“
মৃদুল অবশ্য ঘুরে দাঁড়িয়ে আমাকে দেখার সুযোগ পায়নি। ও কিভাবে যেন আমার সাথে ধাক্কা লেগে চোখের সামনে খাদে পড়ে গেল। ওর পড়ে যাওয়ার সময় সেই ভয়াবহ আর্ত চিৎকার আজও কানে বাজে।
 
    আমি এখন পাহাড়ের কোলে একটা লাল রঙের বিশাল বাড়িতে অনেকের সাথে থাকি। সেই সৌম‍্যদর্শন ভদ্রলোক বলেছেন, আমার নাকি মাথা খারাপ, তাই একটা প্রাণী আর দু’জন মানুষকে হত্যা করেছি। পাগলদের জেল হয়না বলে এখানে রেখেছে। সে রেখে ভালোই করেছে, আমি এমনিতে ঠিকই আছি। তবে গতরাতে স্বপ্নে এই বাড়িটার আর আমাদের মতো আবাসিকদের যিনি দেখাশোনা করেন…তাঁকে স্বপ্নে দেখেছি। স্বপ্নে সেই ওয়ার্ডেন দিদির চোখগুলো বেড়ালটার মতো সবুজ হয়ে গেছিল। আমি ওনাকে তাড়া করেছিলাম, উনি ছুটে পালাচ্ছিলেন। আমি প্রায় ধরে ফেলব এমন সময় হাওয়ায় মিলিয়ে গেলেন। ঘুম ভেঙে তাকিয়ে দেখি আমি লাল বাড়ির পেছনের জঙ্গলে যাওয়ার দরজার সামনে মেঝেতে ঘুমিয়ে আছি। যাইহোক, তাঁকে নাকি সকাল থেকে পাওয়া যাচ্ছেনা। আমাকেও জিজ্ঞাসা করছিল সবাই। আমি কিভাবে জানব? দেখুক খুঁজে সবাই মিলে। বলা যায়না, হয়ত কেউ যেখানে জন্মেও যায়না…এই বাড়ির পেছনের জঙ্গলের ধারের খাদে ভালো করে খুঁজলে পাওয়া যেতেও পারে। কিভাবে যে মানুষ উধাও হয়ে যায় বুঝতেই পারিনা।
 
 
*সমাপ্ত*
 
Madhumita Mukherjee