শ্রবণ বিভ্রাট - সৌভিক দাস


শ্রবণ বিভ্রাট

সৌভিক দাস 

  
    বাড়ির নাম "শান্তি-নিবাস" বাসিন্দা সাকুল্যে দুজন হলেও গৃহকর্ত্রী দোর্দণ্ডপ্রতাপ খ্যান্তবালা দাসী ও তার ভুলে ভরা ভাইপো হরিচরণের সৌজন্যে শান্তি নিবাসে কস্মিনকালেও শান্তির নামগন্ধ ছিলোনা, এখনও নেই।

    পিসীমার কঠোর শাসনে থরোহরি কম্প হরিচরণ সর্ব কর্মেই গোল পাকিয়ে গন্ডগোল বাঁধতে ওস্তাদ কাজেই অষ্টপ্রহর হরিনাম সংকীর্তনের ন্যায় চিৎকার চেঁচামেচির কারণে পাড়ার ফঁচকে ছেলে ছোকরারা মাঝে মধ্যে বাড়ির নেমপ্লেটে খড়ি দিয়ে 'অ' জুড়ে অশান্তি নিবাস" লিখে রেখে যায়।

    এরমধ্যে হরিদ্বার থেকে পিসীমার পরম পূজনীয় গুরুদেব শ্রীশ্রী স্বামী তিনশো বাহাত্তর ভন্ডুলানন্দ ব্রহ্মচারী মহাশয়ের আগমন উপলক্ষে বাড়িময় সাঁজো সাঁজো রব।

    গুরুদেবের নামের আগে তিনশো বাহাত্তর সংখ্যাটি কিসের প্রতীক প্রশ্ন করাতে গুরুদেব অন্ত প্রাণ পিসিমা বলেছিলেন ওই সংখ্যা গুরুদেবের বয়স সুনিশ্চিত করে।
যদিও গুরুদেবের স্থির চিত্র পর্যবেক্ষণ করে হরিচরণ নিশ্চিত এনার বয়স ষাট-পঁয়ষট্টি হলেও তিনশো বাহাত্তর নৈব নৈবচ...

    বহু বৎসর গতে বাড়িতে গুরুদেবের পবিত্র পদধূলি পড়তে চলেছে বলে পিসীমার ব্যাস্ততার সীমা পরিসীমার উর্ধসীমা পরিমাপ করা সম্ভব নয়!
গুরুদেব যা যা ভোজন করতে পছন্দ করেন সেসব উৎকৃষ্ট খাদ্যবস্তু স্বহস্তে তৈরি করলেও গুরুদেবের বিশ্রাম কক্ষ সহ তামাম বাড়িঘর মায় বাগান থেকে আরম্ভ করে রাস্তা সবই হরিচরণকে দিয়েই পরিষ্কার করিয়েছেন, এছাড়া পিসীমার পছন্দের লোকজনকে আমন্ত্রণ জানানোর হরিচরণকে শহরের এমাথা থেকে ওমাথা ঘড়ির পেন্ডালুমের মতো দৌড় করিয়ে ছেড়েছেন।

    যথা সময়ে পিসীমার গুরুদেব শ্রীশ্রী স্বামী তিনশো বাহাত্তর ভন্ডুলানন্দ ব্রহ্মচারী মহাশয় শান্তি নিবাসে দেহ রাখলে হরিচরণের অশান্তি দ্বিগুণ হলো...

    পিসিমা নিজহাতে গুরু সেবা যতটা না করেন তার চতুর্গুন হরিচরণকে দিয়ে করিয়ে নেন। তার ওপর গুরুদেবের অতি খাই খাই স্বভাবের কারণে ঘন্টায় ঘন্টায় বাজারে ছুটতে ছুটতে নাম থেকে হরি বিদায় নিয়ে স্রেফ চরণ যুগলই হরির একমাত্র ভরসা।
 
    থেকে থেকেই শুঁয়ো পোকার মতো গুরুদেবের খিদে চাগার দিয়ে ওঠে, জিলিপি খাবো, আমৃতি খাবো, রাবরী খাবো, খালি খাবো আর খাবো বারংবার বাজারে ছুটতে ছুটতে হরির চরণ দুখানি কাজে ইস্তফা দেওয়ার জন্য এক পায়ে খাড়া...

    দেখতে দেখতে গুরুদেবের প্রস্থানের সময় আগত হলে চরণ দুখানি পুনরায় তার নামের আগে ফিরে পাওয়ার আনন্দে হরি উল্লসিত হয়ে উঠল...

    গুরুদেব হিমালয়ের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেওয়ার পূর্বে গুরুদেবের নির্দেশে পিসীমার উৎসাহে বিশেষ তিথিতে ভক্তবৃন্দের সমাগমে শান্তি নিবাসে পূজাপাঠ তৎসহ শান্তি যজ্ঞের আয়োজন করা হলো।
যথা সময়ে পূজা শুরুর পর পিসীমার নজরে এলো সর্বনাশ একি একি অনাসৃষ্টি কান্ড গো-চোনা আনা হয়নি!

    গো-চোনা ছাড়া চরণামৃত প্রস্তুত অসম্ভব!  গুরুদেবের চরণামৃত পান না করলে বৃথাই এ মানবজীবন  উপলব্ধি করে পিসিমা  হরিচরণকে অতি দ্রুত বিশুদ্ধ গো-চোনা সংগ্রহের কাজে  পাঠালেন।

    ইচ্ছে না থাকলেও পিসীমার বিরুদ্ধাচরণ করার দুঃসাহস হরিচরণের নেই ফলে অনিচ্ছা সত্ত্বেও গ্রীষ্মের প্রখর দাবদাহ উপেক্ষা করে বেরিয়ে পড়তে হলো...

    হরিচরণ সমগ্ৰ শহর খুঁজে খুঁজে হয়রান! যার নাম ধরে পিসিমা তাকে দিবারাত্র সম্বোধন করেন সে বস্তু পাওয়া এতটা দুষ্কর হরি কখনো স্বপ্নেও কল্পনা করেনি।

    সারা শহর খুঁজে ফিরলেও কোনমতেই ও বস্তু জোগাড় করতে না পেরে ব্যার্থ মনোরথে হরি যখন ও বস্তু বিনা কিভাবে পিসীমার মুখোমুখি দাঁড়াবে সে চিন্তায় ঘোরতর সন্দিহান ঠিক সেই সময় মুশকিল আশান হয়ে আবির্ভুত হলেন পথচারী।

    শুকিয়ে আমশি হয়ে যাওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে সেই কৌতূহলী পথচারী হরিচরণের  সমস্যা শ্রবনে মূল্যবান পরামর্শ প্রদান করে সমস্যা সমাধানের উপায় বাতলে দিলেন।

    অবশেষে হরিচরণ বাড়ি থেকে প্রায় সাত ক্রোশ পথ পদব্রজে অতিক্রম করে বিস্তর সাধ্য সাধনার পর নগদ এক হাজার টাকা জামানত রেখে বিকেলের আগেই ফিরিয়ে দেওয়ার শর্তে  এক খাটাল মালিকের থেকে পিসীমার ফরমায়েশি বস্তু জোগারে সক্ষম হলো।

    ওদিকে চার ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও হরিচরণের দেখা নেই! অগত্যা গো-চোনা ছাড়াই চরণামৃত প্রস্তুত করে পূজা সাঙ্গ করতে হলো।

    এতো নিষ্ঠাভরে এতো আয়োজন স্বত্বেও পুজোয় খুঁত থেকে যাওয়ায় খুঁতখুঁতে পিসিমার মেজাজ সপ্তমে চড়ে গেলো! হতচ্ছাড়া হরি আজ ফিরুক দেখাচ্ছি মজা মনেমনে এই সংকল্প নিয়ে উত্তপ্ত মস্তিষ্কে পিসিমা অপেক্ষা করতে লাগলেন। 

    দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে যাওয়ার পর পিসীমার ফরমায়েশি বস্তু জোগারে সফল হরিচরণ পরমানন্দে বাড়ি ফিরলে বাহবার বদলে বেচারার কপালে জুটল অসীম দুর্ভোগ!

    পিসীমার মুখ নিঃসৃত গোলাগুলি বা গালাগালির সামলে হরিচরণ কোনমতে মিনমিন করে জানালো শহরে খাটালের সংখ্যা অপ্রতুল, দু একটা যাও আছে তার মালিকেরা অচেনা অজানা ছোকরার হাতে বাছুর ছাড়তে রাজি নয়! এটাই বিলম্ব হওয়ার একমাত্র কারণ!

    জবাব শুনে হতভম্ব পিসিমা বল্লেন হতচ্ছাড়া আধ দামড়া বলদ, কে তোকে বাছুর আনতে বলেছে?  কেন? আপনিই তো বল্লেন গো-ছানা জোগাড় করে নিয়ে আয়! আর কেনা জানে গো-ছানা অর্থাৎ কিনা গরুর ছানা যাকে বলে বাছুর!

    গরু কোথাকার! এই বয়সেই কানের মাথা খেয়েছিস! দাঁড়া দেখাচ্ছি মজা এই বলে রাগে অগ্নিশর্মা পিসিমা গুরুদেবের ত্রিশূল উঁচিয়ে হরিচরণকর তেড়ে যেতেই বেচারা পালাতে গিয়ে দরজার সামনে দাঁড় করিয়ে রাখা বাছুরের ঘাড়ের ওপর চিৎপাত!

    আচমকা জগদ্দল পাহাড়ের ন্যায় হোৎকা হরি ঘাড়ে এসে পরতে আপাত নিরীহ বাছুরটি আর নিরীহ রইলনা! তিড়িং বিড়িং করে লাফিয়ে উঠে হাম্বা রবে দড়ি ছিঁড়ে ঊর্ধস্বাসে ছুটল.....
 
    এক্ষেত্রে হরিচরণের বহুদিনের বিশ্বস্ত সঙ্গী হরির চরণ যুগল বিশ্বাসঘাতকতা করল! প্রানপনে পিছু ধাওয়া করেও মতেই সে বাছুরকে পাকড়াও করতে সক্ষম হলোনা...

    শোনা যাচ্ছে পিসীমার রোষানল তৎসহ খাটাল মালিককে সন্ধ্যের মধ্যে বাছুর ফেরত দেওয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে অপারগতার কারণে হরিচরণ আপাতত স্থানীয় কচুবনে গা ঢাকা দিয়েছে।

    বিশ্বস্ত সূত্রে প্রাপ্ত সর্বশেষ সংবাদ অনুযায়ী যে গুরুদেবকে এদ্দিন দুচক্ষে দর্খতে পারতনা সেই গুরুদেবের পিছু পিছু হিমালয়ের উদ্দেশ্যে পাড়ি দেওয়ার ব্যাপারে হরিচরণ গভীর চিন্তা ভাবনা শুরু করেছে।
(সমাপ্ত)

souvik das