না-মানুষী ভাষা
হৈমন্তী ভট্টাচার্য
বৈশাখের
খর গরমের দুপুরে তেঁতুল দিয়ে মাজা বাসনের মত চকচকে রোদ থাকলে কী হবে, দমকা
হাওয়ায় সুপুরি গাছগুলো এ ওর গায়ে গিয়ে পড়ছে। চোখ বন্ধ করে পাতার আওয়াজ
শুনলে মনে হয় ঝিরঝির করে জল পড়ছে। বুধানী বাগচী বাড়ির বাঁধানো কলপাড়ে
চৌবাচ্চার কলে ঝপাঝপ বাসন ধুয়ে তুলল। তারপর ন্যাতাটা কেচে পাঁচিলের ওপর
ফেলতেই বাড়ির পেছনের দিকের সানসেটের দিকে নজর পড়ল। একটা ছোট্ট কালো মতন দড়ি
নড়ছে যেন। সাপ নাকি! চোখের চারপাশের কোঁচকানো চামড়া আরো কুঁচকে ঠাহর করে
দেখল, না, সাপ নয়, তবে কিসের একটা লেজ, লোমহীন সরুপানা। পায়ের পাতার ওপর
উঁচু হয়ে বুধানী গলাটা যদ্দুর সম্ভব ঘুরিয়ে দেখবার চেষ্টা করল। সাপ নয়, তবে
কি বেঁজি?
বুধানী মুখ তুলে দেখল দোতলার সামনের দিকের
বারান্দাটা ফাঁকা। একটু আগে অবধি বুলবুলি দিদি বসে ছিল। ইদানিং বড্ড চুপচাপ
হয়ে গেছে মেয়েটা। বিয়ের একবছর পর বিয়োতে গিয়ে আঁতুড়েই চার দিনের ছেলে মরে
গেল। তারপর নয় নয় করে পাঁচ বছর কেটে গেছে। কীরকম মনমরা হয়ে থাকে আজকাল।
বাপের বাড়ি এসেছে সংক্রান্তি কাটাতে।
বেঁজিই হবে, উবু হয়ে
বাসনগুলো হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে একবার তাকাতেই বড় বড় গোল গোল পুঁতির মত
দুটো চোখের সাথে চোখাচুখি । একটা ছোট্ট লোমশ কালচে মাথা একবার উঁকি দিয়েই
দেওয়ালের আড়ালে চলে গেল ঝট করে।
-"ও হরি এ তো হুনুমানের ছানা।"
-"হুনুমানের
পাল এসেছে, সব বড়ি আচার তুলে নাও গো ছাদ থেকে।" বুধানীর সাবধানবাণী শুনে
আশপাশের বাড়ির ছাদে জানালায় কয়েকটা মুখ দেখা গেল, "কই গো?"
নদে
জেলার হাঁসখালিতে অবশ্য হনুমান আসা কোনো নতুন খবর নয়। এ তো কলকাতা নয়, যে
হনুমান দেখতে হলে চিড়িয়াখানায় টিকিট কাটতে হবে। এখানে দিব্যি হনুমান দলবল
নিয়ে পাড়া টহল দিতে বের হয়। পালের গোদা মস্ত বড় হনু তার লেজটা পিঠের উপর
বাঁকিয়ে ইংরেজি আলফাবেট সি এর মত করে লাফ দিয়ে এ বাড়ি থেকে ওবাড়ির ছাদে
তাণ্ডব করে। মাদি হনু পেটে ছানাকে আঁকড়ে ধরে খোসা ছাড়িয়ে কলা খায় আর পথ
চলতি মানুষকে মুখ ভ্যাংচায়। ছাদ বাগানের লেবু বেগুন, বাড়ি আচার খেয়ে কলাগাছ
আমগাছ ধ্বংস করে দল বিদায় নিয়ে যায় অন্যপাড়ায়।
বুধানীর সাবধান
বাণীতে বাড়ির বউ ঝিরা গলা বাড়িয়ে কোনো হনুমান দেখতেই পেল না। পাশের বাড়ির
ক্লাস ফাইভের পিকলু দোতলার জানলা থেকে বুধানীকে বলল, "তুমি হুনুমান বলছ
কেন? ইস্কুলে শিখিয়েছে হনুমান। হনু মানে হল চোয়াল।"
-"থাম দিকি।"
বুধানী ফোকলা মুখের ঠিক সামনে পাটিতে মুড়ির মত লেগে থাকা দাঁতটা ঠোঁটে
দুবার ঘষে চারপাশ ভালো করে দেখে নিল। নাহ চারপাশের গাছ গাছালিতে বড় মেজো
সেজো গোদা কোনো হনুমান দেখা যাচ্ছে না তো। তবে সানসেটের ওপর ওই ছানাটা এল
কোথা থেকে?
এ বাড়ির ভেতর থেকে বাগচীবৌদি বলে উঠল, "কী হয়েছে রে বুধানী?"
-"হুনুমানের ছানা গো, তোমাদের জানলার ওপরে।"
বাগচী গিন্নী গ্রিলের দরজা খুলে লাল রোয়াকের ওপর দিয়ে এগিয়ে বুধানীর পাশে এসে দাঁড়ালেন,"কই রে?"
-"ছোট্ট
ছানা গো", পাশের বাড়ির ছাদ থেকে পিকলু বলে উঠল, "মনে হয় কাল যে হনুর দলটা
এসেছিল, তাদের কারোর বাচ্চা। হয়ত লাফ দিতে গিয়ে পড়ে গেছে।"
-"তুই দেখতে পাচ্ছিস? আশে পাশে ওর মা আছে?"
পাশের দুটো বাড়ির ছাদ থেকে পিকলু আর বিন্তি চারপাশ ভালো করে দেখে বলল, "না গো।"
ক্রমশ চারপাশের বাড়ির ছাদে,আর পাঁচিলের বাইরে পাড়ার ছেলে পিলে ভিড় জমালো।
-"দেখো কত টুকুনি বাচ্চা। আহা গো।"
চার বছরের ভণ্ডুলকে ওর মা আঙ্গুল দেখিয়ে বলল, "ওই দেখ , আরেকটু বড় হলে তোর মত হবে।"
দুবাড়ির ছাদ থেকে পিকলু আর বিন্তি তর্ক জুড়েছে।
পিকলু
বেশ জোর গলায় বলল, "শোন হনুমান সীতা দেবীকে খুঁজতে গিয়ে ল্যাজ জ্বালিয়ে
লঙ্কায় আগুন লাগিয়েছিল । তারপর সেই লেজটা মুখে পুরে ওর মুখটা পুড়ে কালো হয়ে
গেছে। তাই হনুর মুখ কালো।"
বিন্তি চশমার আড়াল থেকে টেরা চোখে
তাকিয়ে বলল, "তোর মুণ্ডু, হনুমান সূর্যের কাছে পড়তে গিয়েছিল। সূর্যের তো
অনেক কাজ। তখন হনু বলল, আপনি রথ চালান, আমি আপনার দিকে মুখ করে পেছন দিকে
ছুটব, আর আপনি যা বলবেন শিখব।সূর্যের রথের দিকে তাকিয়ে পেছন দিকে দৌড়ে দৌড়ে
শিক্ষা নিয়েছিল বলে রোদে পুড়ে মুখ কালো হয়ে গেছে।"
পিকলু মানবে না, "তুই ভুল জানিস। এটা আমার দাদু বলেছে।"
-"না রে হনুমান, তুই ভুল জানিস। আমায় মা এই গল্পটা বলেছে।"
ওদিকে হনুমানের ছানা তো এত মানুষ জন দেখে ভয়ে আরো সিঁটিয়ে গেছে। কি করা যায় ছানাটাকে বাঁচানোর জন্য সেই বিষয়ে জল্পনা শুরু হল।
-"কী হবে বল তো? গোটা একদিন পড়ে আছে আটকে। এভাবে থাকলে তো না খেয়েই মরে যাবে।"
-"বাহাদুর পুর বিট অফিসে ফোন করা যাক।" ঝটপট ফোন হল বনদফতরে। কিন্তু লোক কম। তাই দেরি হবে আসতে।
বুলবুলি
ইতিমধ্যে পায়ে পায়ে মায়ের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। খুব খুঁটিয়ে দেখে মনে হল
ছানাটা পেছনের পা বা কোমরটা নাড়তে পারছে না। এতক্ষণ , প্রায় একদিন ওই
সানসেটে আটকে আছে। আরো কত দেরি হবে কে জানে! বুলবুলি ভিড়ে দাঁড়ানো যুবকদের
উদ্যেশ্যে বলল, "ওকে নামানোর ব্যবস্থা কর দিকি তোরা।"
-"মানুষ গায়ে হাত দিলে যদি ওর মা না নেয়!"
বাগচী গিন্নী আমতা আমতা করে বললেন।
-"মা
যদি নিতই, তাহলে কি রেখে চলে যেত? যেত নি। এ হল জানোয়ারের মর্জি। আগেও
দেকিচি, কোনো কোনো ছানাকে মা কাচেও নেয় না, দুদও দেয় না। মেরে ফেলে ।আবার
অনেক সময়ে মায়ের দূর ছাইতে এমনিই না খেয়ে ছানা মরে যায়।" বুধানী বেশ
বিজ্ঞের মত বলে উঠল।
-"একটু ওকে নামিয়ে দে সন্তু", বুলবুলির গলায় মিনতি।
জোয়ান ছেলে সন্তু পাঁচিলের খাঁজে পা রেখে তরতর করে উঠে গিয়ে হাত বাড়াতেই ছানাটা ভয়ে "চি চি" করে ডেকে উঠল।
-"সাবধানে। ওর পিঠে ব্যথা আছে মনে হয়", বুলবুলি নীচ থেকে ডেকে বলল।
বেশ
কসরত করে ছানাকে নামানো হল। বুধানী বলে উঠল,"জয় বজরংবলী"। গোল গোল চোখদুটো
কাঁচের গুলির মত ঝকঝকে। বুলবুলি স্থির চোখে চেয়ে রইল। ঠিকই আন্দাজ
করেছিল। পেছনের পায়ের নিচের দিকে আর পেটে বেশ খানিকটা জায়গা লোম উঠে
ভেতরকার লালচে মাংস বেরিয়ে আছে। রস জমে আটকে আছে লোমের সাথে। হয়ত পড়ে গিয়ে
জখম হয়েছে। পুরো শরীরটা ব্যথায় নাড়াতে পারছে না ।অল্প ঘাড় নেড়ে প্রাণীটা
ভয়ে ভয়ে চারপাশে তাকাচ্ছে।
-"বিট অফিসের লোকজন কখন আসবে কে জানে!"
জল
খাওয়ানোর চেষ্টা হল মগে করে। সরু ধারায় মুখের কাছে ফেললেও গালে পৌঁছল না,
গড়িয়ে গেল। এক্কেবারে নেতিয়ে গেছে। ঘাড় তুলে হাঁ করেও জল খেতে পারছে না।
বুধানী ঠোঁট ছড়িয়ে বলল, "এ বাঁচবে নি গো।"
বুলবুলি আর দাঁড়ালো না।
প্রায় দৌড়ে বাড়ি থেকে তুলোর প্যাকেট আর জলের বোতল নিয়ে ফিরে এল। পায়ে পায়ে
এগিয়ে এসে চৌবাচ্চার বাঁধানো পাড়ে বসে পড়ে বলল, "আমার কোলে একটু আস্তে করে
তুলে দাও দিকি।"
বুলবুলির কোলে এসে ছানাটা গোল গোল চোখে দেখছে।
বুলবুলি তুলো সরু করে জলে ভিজিয়ে মুখের কাছে এনে আঙ্গুল দিয়ে চাপ দিতেই
ফোঁটায় ফোঁটায় জল পড়ল ছানাটার মুখে,"না হাঁ কর"। আস্তে আস্তে হাঁ করে জল
খেতে লাগল ছানাটা।
বুধানী বলল, "আহা কত তেষ্টা পেয়েছিল বল দিনি।"
বুলবুলির
জামা ভিজে উঠেছে গড়িয়ে পড়া জলে। ছানাটা অল্প উসখুস করে উঠল। বুলবুলি
ছানাটাকে কোল থেকে নামাতে যেতেই সে ছোট্ট ছোট্ট আঙ্গুল দিয়ে জামাটা আঁকড়ে
ধরল,"কি হল, ছাড়"। আরেকবার নামাতে গেলে ছানাটা আরো বেশি করে আঁকড়ে ধরল
জামা। বাগচী গিন্নী মুখ টিপে হেসে বললেন, "তোকে পছন্দ হয়েছে। ওই জন্য আঁকড়ে
আছে।"
বুলবুলি একদৃষ্টে প্রাণীটার ভীত ছোট্ট ছোট্ট চোখওয়ালা হালকা
রোমশ মুখটার দিকে তাকিয়ে অল্প হাসল। গোল গোল অবুঝ চোখে অবলা মরণাপন্ন
প্রাণীটাও ওকে দেখছে অদ্ভুত নির্ভরতায়।
সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। বিনবিনে
গান গাইতে গাইতে মশার ঝাঁক দল বেঁধে ঘুরছে মাথার ওপর। বুলবুলি মানবশিশুর মত
করে কোলে জড়িয়ে নিল ছানাটাকে। বুলবুলির নখ অসাবধানে অল্প ছুঁয়ের গেল
প্রাণীটার লালচে ক্ষতয়। "ইস, ষাট ষাট" বুলবুলির কালো চোখদুটোর দৃষ্টি নরম
হয়ে উঠল। তার মুখের রেখায় লালচে সূর্যের আলো । উঠে দাঁড়িয়ে বলল, "বুধানী
পিসি একবার ঘরে এসো তো। টাকা দিচ্ছি। দুধের ফিডিং বোতল আর এক প্যাকেট দুধ
এনে দাও তো।"
******
-"বুলবুলি রে, এবার নিশ্চিন্ত । বিট অফিসের লোক এসে গেছে।" বাগচী গিন্নী ঘরে ঢুকলেন।
বুলবুলি
একমনে ছানাটাকে বোতলে দুধ খাওয়াচ্ছে বোতলে। চক চক শব্দ করে অবিকল
মানবশিশুর মত দুধ খাচ্ছে ছানাটা। বুলবুলি মায়ের দিকে তাকালো। মুখ দেখে মনে
হল না সে নিশ্চিন্ত হয়েছে। সাবধানে পুরো দুধটা খাইয়ে ফাঁকা বোতল নামিয়ে
রাখল মাটিতে। তারপর গলায় উদ্বেগ নিয়ে বলল, "ওরা নিয়ে গিয়ে যত্ন করবে তো?"
-"আরে হ্যা। ওদের কত পশুদের ডাক্তার আছে।"
-"ওকে
যদি না দিই, ও থাকুক না আমার কাছে। আমি যত্ন করে সুস্থ করে ছেড়ে দেব।"
বুলবুলির গলার স্বরে কাতরতা এমন ভাবে ফুটে উঠল যে বাগচী গিন্নী নির্বাক হয়ে
রইলেন। মেয়ের মাথায় হাত রেখে নরম সুরে বললেন, "তা কি হয় রে? ওরা ওর ঠিক মত
চিকিৎসা করবে। যদি আমাদের কাছে মরে যায়?"
-"মরবে না। আমি ঠিক মায়ের মত
যত্ন করে ওকে বাঁচাবো। আমি ওকে ছাড়ব না কারোর কাছে।" বুলবুলির গাল বেয়ে বড়
বড় জলের ফোঁটা নীরবে গড়িয়ে পড়ল।
বাগচী গিন্নী কী বলবেন বুঝতে না পেরে চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন,
-"শোন
মা ,জানোয়ারের ভালোবাসা মানুষের মত নয়। এই যে তুই ওর সেবা করলি, ও ঠিক এই
বাড়ি আর তোকে মনে রাখবে। সুস্থ হয়ে জঙ্গলে চলে যাবার পর দেখবি আবার তোর
কাছে ঠিক একদিন আসবে। তোর হাত থেকে খেয়ে যাবে।" মেয়ের চুলে আঙ্গুল ডুবিয়ে
আদর করতে লাগলেন। সন্তানহীন আত্মজার কষ্ট তিনি মর্মে মর্মে বোঝেন। জলভরা
চোখে তিনি মনে মনে মেয়েকে আশীর্বাদ করে বললেন,"অবলা প্রাণীর সেবা করলে
ভগবানের সেবা হয়। দেখিস মা ষষ্ঠীর পুত আসবে এবার তোর কোল আলো করে। তোর বুক
ফাঁকা থাকবে না।"
বিট অফিসের লোকজন খাঁচায় ভরে নিল ছানাটাকে। যাবার
আগেও বুলবুলির জামাটা আঙ্গুলে শক্ত করে ধরা ছিল। অবুঝ চোখ দুটো যেন বলছিল,
"রাখো না তোমাদের কাছে আমায়।" বুলবুলি কান্না গিলে আদর করে বলল, "যা বাবু,
সুস্থ হয়ে আসিস আবার। আমিও খোঁজ নেব তুই কেমন রইলি।"
অন্ধকারে ঢাকা
রাস্তায় বন দফতরের গাড়ি বাঁক নিয়ে ক্রমশ অস্পষ্ট হয়ে গেল। বাগচী গিন্নী
জোড়হাত মাথায় ঠেকিয়ে বললেন, "ওই টুকু বাচ্চা , যেন রক্ষা পায় ।ঠাকুর তুমি
দেখো।" বুলবুলি জলভরা চোখে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে রইল। দুটো নামানুষী চোখের
নির্ভরতার ভাষা তার শূন্য বুকের মধ্যে আশ্রয় খুঁজে বেড়াতে লাগল। নাহ, বড্ড
মায়ায় জড়িয়ে ফেলেছিল ছানাটা একবেলাতেই। ফেরার অপেক্ষা করলে ও কী সত্যিই
ফিরবে! হয়ত ফিরবে না। একেবারে ভুলেই যাবে।
বুলবুলি চোয়াল শক্ত করল, তাকেও ভুলতে হবে, এক্কেবারে ভুলতে হবে।
****সমাপ্ত****
অলঙ্করণ :- প্রিয়াঙ্কা সরকার