তাহাদের কথা
সুদেষ্ণা রাহা
রাতে ঘুমের মধ্যে প্রচন্ড জোরে দুটো' দুম দুম' আওয়াজ শুনে উঠে পড়ল রেবা। বাইরে প্রচণ্ড শোরগোল ছুটোছুটি। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল তারকও উঠে পড়েছে, রাহুল আর রিণি ঘুমোচ্ছে অঘোরে।
দরজায় আগল দিয়ে স্বামীস্ত্রী ছুটে বেরোল দেখতে। বস্তির সরু গলির ভেতর ফিয়ে খানিকদূর এগিয়েই দেখা গেল ব্যাপারটা। লেবুতলা বস্তির পেছন দিকে একটা স্পঞ্জের কারখানা ছিল। দাউদাউ করে জ্বলছে পুরো কারখানা।
ভিড় ঠেলাঠেলির মধ্যে ওরা এগোল খানিকটা। পাড়ার ছেলেরা বালতি করে জল ছুঁড়ছে। আগুনটা যেন লুফে গিলে নিচ্ছে সব জল। দেখতে দেখতে পাশের ঘরের চালাদুটো ধরে গেল। ' দমকল দমকল' করে চেঁচাচ্ছে লোক, হাতে মোবাইল অথচ দমকলের নম্বর কারুর কাছে নেই।
আতঙ্কে দিশেহারা হয়ে ঘর থেকে জিনিষপত্র বার করছে মালতি মাসি। প্রচণ্ড শব্দ করে স্বরূপের ঘরের গ্যাস সিলিন্ডার ফাটল। লেলিহান শিখায় আগুন আরো পাঁচ ঘরে ছড়িয়ে গেল।
দুমিনিট দাঁড়িয়েই অবস্থা বুঝে নিল তারক আর রেবা। পেছন ফিরে দৌড়ল নিজেদের ঘরের দিকে। হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকে যেখানে যত ব্যাগ পেল বার করল রেবা। প্রথমেই নিজেদের জামাকাপড় যতটা সম্ভব ভরে নিল ব্যাগে। একটা বস্তা টেনে রান্নাঘর থেকে চাল ডাল আলু তেল যতটা পারল ভরল। চানের বালতির মধ্যে পাম্পস্টোভ আর আধ বোতল কেরোসিন তেল রাখল।
তারক ততক্ষণে হাত দিয়েছে তোরঙ্গে। ট্রাঙ্ক খুলে বার করল চারজনের আধার কার্ড, র্যাশন কার্ড, ব্যাঙ্কের খাতা। একেবারে তলায় লুকিয়ে রাখা হাজার তিনেক টাকা আর রেবার গলার একটা সরু সোনার চেন।সবকিছু একটা চেনটানা ছোট ব্যাগে ভরে রেবার হাতে দিয়ে বলল
-----" ধর। কাউক্কে দিবি নি। মরলেও বুকে নিয়ি মরবি। তৈরি থাক। আমি দেখে আসি উধারের খপর।"
বলেই প্যান্ট গলিয়ে মোবাইল হাতে ছুটে বেরিয়ে গেল।
বলতে হত না রেবাকে। গাঁয়ের মেয়ে শহুরে হালচাল বোঝে না। কিন্তু বিপদ এলে কি করে বাঁচতে হয় জানে। ভাল ঘরে বিয়ে হয়েছিল। দুবিঘে জমি একটা পুকুর ছিল। সেগুলোর আয়ে বছরের খোরাকটা উঠত। তারক গঞ্জের একটা দোকানে কাজ করত।বাকি খরচটা তাতেই চলত।
তারপর এল আয়েলা। সেকি বীভৎস বন্যা, তেমনি বৃষ্টি। পাকা বাড়িগুলো কাদার তালের মত ভেঙে তুবড়ে জলে ঢুকে গেল। তাদের বাড়িটাও গেল। জল বাড়ছে দেখে গোটা গ্রামের সঙ্গে তারাও উঠেছিল ইস্কুল বাড়িতে। রেবা তারক আর শাশুড়ি। রাহুল ক্লাস ফোর, রিণি কোলে, ছমাসের মেয়ে।
কদিন শুকনো চিঁড়ে আর লঙ্গরখানার খিচুড়ি খেয়ে কাটল। প্রায় দিনদশেক পর নোনা কাদাজল থিতোল। মহামারী হয়ে এল আন্ত্রিক আর চামড়ার রোগ। সারা গ্রামে কোথাও খাবার জল ছিল না। মরা পশুপাখির পচা শরীরের গন্ধে ভরে গেল দশদিক।শাশুড়ি মারা গেল আন্ত্রিকে। রিণিটাকে শুধু বুকের দুধ ভরসা করে বাঁচিয়ে রেখেছিল।
সেই সময় শহর থেকে ভলেন্টিয়াররা এসে শিখিয়েছিল বিপদের সময় কোন জিনিস আগে সামলাতে হয়, কেমন করে রাখতে হয়, বাঁচতে হয়। ভাবেনি রেবা সেই শিক্ষা শহরে এসেও আবার কাজে লাগাতে হবে।
চোয়াল শক্ত করে হাত চালাচ্ছে রেবা। রাহুল উঠে পড়েছে তাকে বলল-----
-------" ইস্কুলের বইখাতা ব্যাগে করে পিটে নিয়ে নে, ইস্টোবের বালতিটা হাতে রাকবি আর অন্য হাতে বুনের হাতটা ধরি আমার সনে ছুটবি। খপরদার বুনের হাত ছাড়বিনি।"
প্রচন্ড জোর একটা আওয়াজ তার সঙ্গে সব আলো নিভে গেল। চীৎকার হট্টগোল ছুটোছুটি আরো বেড়ে গেল। রেবা ঘরের বাইরে এসে দাঁড়াল। আগুন আরো ছড়িয়েছে। একটা ছেলেকে জিগেস করে জানল ট্রান্সফরমার উড়ে গেছে বলে অন্ধকার। দমকলের দুটো গাড়ি এসে জল দিচ্ছে কিন্তু বস্তিতে জল নেই। পাম্প করে জল নিতে পারছে না। আগুন আরো বেড়ে যাচ্ছে।
ধুমধাম সিলিন্ডার ফাটার আওয়াজ আসছে। সোহন লাল এ সি বসিয়েছিল, সেটাও ফাটল। লকলক করে শিখা এগিয়ে আসছে। তারক এল ছুটতে ছুটতে। এসেই বলল----
------" কাউনসিলার আইছে। উ পাসের বড় মাঠে সবায়েরে যেতি কইল মালপত্ত নিয়ে। চ চ উঠ।"
বড় ব্যাগটা তারক মাথায় চাপিয়ে রাহুলের হাত ধরল, রেবা রিণিকে কোলে নিয়ে অন্য দুটো ব্যাগ নিয়ে ছুটল তারকের পেছন পেছন। বড় মাঠে ভিড় জমে গেছে। যে যতটা পারছে জিনিস ঘর থেকে এনে জড়ো করছে। তাদের একজায়গায় বসিয়ে দিয়ে তারক আবার ছুটল ঘরের দিকে। আরো কিছু যদি বাঁচানো যায়। পেছন থেকে চীৎকার করল রেবা-----
-----" যেও নি গো! থাক পড়ে উসব।"
শুনতে পেল না তারক। চারদিকে কান্না, হাহাকার, গালিগালাজ । রেবা জানে এমনি হয়। জিনিসপত্রগুলো গুছিয়ে নিয়ে ছেলেমেয়ে দুটোকে কোলের কাছে নিয়ে উৎকণ্ঠিত হয়ে বসে রইল তারকের জন্য।
খানিকপরে মাথায় একটা বিশাল পোঁটলা নিয়ে এসে তারক ধপ করে ফেলল। বিছানার চাদরে বেঁধে বাসনকোসন আর শোবার তোষকটা গুটিয়ে নিয়ে এসেছে। বসে পড়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল------
----" এতক্ষণে আমাদের ঘরও ধরে লিয়েছে। "
আকাশের নিচে রাত কাটানো এই প্রথম নয়। তারক রেবা জানে কাল সকাল থেকে মেলা লোক আসবে। মন্ত্রী, কাউন্সিলর, পুলিশ, খবরের কাগজ, টিভি------ কি হয়েছিল, কেন হয়েছিল, কি ক্ষতি হল উত্তর দিতে দিতে জিভ খড় হয়ে যাবে। কিন্তু ----- কি হবে, কোথায় থাকবে, কি খাবে, রাতের পর একটা দিন, দিনের পর আবার রাত, আরো কতগুলো দিনরাত তাদের কাটবে কি করে?--- এই কথাগুলোর উত্তর তাদের কেউ দেবে না।
বন্যা আগুন দুর্যোগ বারবার আসবে তাদেরি জন্য। দাঁতে দাঁত চেপে প্রতিটা পা তাদের লড়াই করে ফেলতে হবে যতক্ষণ না তাদের ছেলেমেয়েদের জন্য একটু মাটি একটা ছাত একথালা ভাত তারা এনে দিতে পারবে। কাল থেকে শুরু হবে সেই লড়াইটা আরো একবার। তার আগে আজকের রাতটুকু একটু চোখদুটো বুঁজে নেওয়া যাক।