ভ্ৰমণ লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
ভ্ৰমণ লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

ভ্ৰমণ - অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাগানবাড়ী - ভবেশ দাস

 



অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাগানবাড়ী
ভবেশ দাস

 

জীবনে যখনই ইঁট চাপা ঘাসের মতো বিবর্ণ রঙ লাগে তখনই হাঁটি-হাঁটি, পা-পা করে বেরিয়ে পড়ি। ইচ্ছেশক্তির জোরে সাথীর অভাব হয় না।

আজ সকালে জলখাবার খাচ্ছি জমিয়ে, ফুলকপির সিঙারা ও আউসধানের লালচে মুড়ি।
আধুনিক প্রজন্মের সকল গুণধারী আমার তনয়া 
ফোনে মুখ গুঁজে সিঙারায় কামড় দিয়ে, 'উফ্' বলে উঠল। 

আমি তার দিকে একবার তাকিয়েই আবার সিঙারা-মুড়ির প্রেমে মজলাম। খেতে খেতে মনে মনে মেয়ের ফোন আসক্তিকে মুন্ডুপাত করছি
নিজের স্বভাব দোষে। সে বোধহয় কিছু একটা টের পেয়ে আমাকে বললে, " দুপুরে খাওয়ার পর এক জায়গায় নিয়ে যাবো তোমাকে আর মা'কে।"

কথাটা শুনেই আমার ললাটের তিনটি সরলরেখা বক্র হয়ে উঠল। স্ত্রী কন্যা সহ বেড়ানো মানেই মানিব্যাগের মূর্ছা যাওয়া। গিন্নির টেলিপ্যাথির জোর সাংঘাতিক। রান্নাঘর থেকে আমাদের শুনিয়ে বলে দিল, " যেখানে মন চায় বাপ-বেটিতে ঘুরে এসো। আমাকে টানা হ্যাঁচড়া করো না এই বিষাক্ত ঠাণ্ডায়।"

আমার ধড়ে প্রাণ এলো এই ভেবে, ঘরোয়া মজলিশে খালি গলার গানই ভালো। বাজনদারের খরচটা অন্তত কমে। 

সময়ের নিয়মে দ্বি-প্রহর উপস্থিত। মেয়েকে নিয়ে স্টেশন থেকে ট্রেনে উঠলাম। গন্তব্য কোন্নগর। 

ট্রেনের কামরায় এক হকার গলার শিরা ফুলিয়ে উর্দ্ধশ্বাসে বলছে, " আর কারো ঠকবার ইচ্ছা আছে কি..." সে দিকে তাকিয়ে দেখি, ঝুড়িতে করে কমলালেবু বিক্রি করছেন তিনি। মনে মনে হেসে ভাবলাম দেশের নেতারা এমন সৎ হলে কতই ভালো হতো।

কোন্নগর স্টেশনে নেমে টোটো'য় চড়ে বসলাম। যাবো মিরপাড়া বাগানবাড়ী। যেতে যেতে রাস্তার দু'ধারে তাকিয়ে দেখি পুরনো মফস্বল শহরের 
চুন-সুরকির আস্তরন এখনও অল্প বিস্তর টিকে রয়েছে। আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে তবুও পুরোপুরি নিষ্প্রাণ হয়ে যায় নি শহরটা। 

জি.টি-রোডের একধারে টোটো নামিয়ে দিল। সামনেই দেখি অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামাঙ্কিত তোরণ। মেয়ে চোখ নাচিয়ে বললে,
" তুমি চিনতে এই জায়গাটা?" আমি ঘাড় হেলিয়ে না বললেম।  এক ছটাক বিশ্বজয়ের হাসি আমার পানে ছুঁড়ে দিয়ে সে বললে, " ফোন ঘাঁটতে দেখো শুধু। জানো, ফোনেই জেনেছি এই বাগানবাড়ীর কথা।" আমি চুপচাপ গুটি-গুটি পায়ে এগোতে থাকলাম। 

টিকিট কাটার বালাই নেই। গেটের সামনে এক প্রৌঢ় ভদ্রলোক বলেদিলেন, " ঘাসের ওপর দিয়ে হাঁটবেন না। ফুল ছিঁড়বেন না। বাঁধানো রাস্তা দিয়ে বাঁ-দিকে চলে যান গঙ্গার ধারে। সব দেখে ওটা দিয়েই ফিরে আসবেন।"

মেয়ের হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে গঙ্গার দিকে এগোচ্ছি। প্রাচীন বটবৃক্ষ ঝুরি বিস্তার করে দন্ডায়মান। গাছের ডালে ঝুলিয়ে রাখা বোর্ডে সাবধান বানী," এই স্থানে বিষধর সাপ আছে।" পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার শুদ্ধতা জায়গাটিকে মনোমুগ্ধকর করে তুলেছে। পায়ে-পায়ে পৌঁছে গেলাম গঙ্গার ঘাটে। আধুনিক নির্মানে 
ত্রি-ধারা আর্চের মাধ্যমে ঘাটের শোভাবর্ধন। 

সেখানে একটু বসলাম। আশেপাশে আরো কিছু মানুষ জড়ো হয়েছে। সবাই আপন মুঠোফোনে খচাৎ শব্দে তুলছে নিজস্বী। আমি ঘোরে আছি। 
আমার কন্যারত্নটি জানে এই সময়ে তার কল্পনাবিলাসী বাবাকে কথা বলানো যাবে না। 
চোখবুজে ভাবে আচ্ছন্ন হয়ে আমি দেখতে পাচ্ছি,
অবনঠাকুর নদীরঘাটের বজরা থেকে নামছেন তাঁর সাধের বাগানবাড়িতে। সঙ্গে লটবহরের মধ্যে চিত্রলিপির সরঞ্জাম। এক অন্য জগতে পৌঁছে যাবার হাতছানিতে আমি ডুবে যাচ্ছি। সেই মুহূর্তে মেয়ে গায়ে হাত রেখে বললে, " বাবা ওদিকে চলো। বাড়ীর ভেতরে ঢুকি।" 

বাস্তবে ফিরে এসে মেয়েকে নিয়ে অবনঠাকুরের বাড়ীতে প্রবেশ করলাম। পুরনো স্থাপত্য বজায় রেখে আধুনিক ভাবে কলেবর সাজানো হয়েছে বাড়ীটিকে। মাথার উপরে প্রকান্ড কড়ি-বরগার ছাদ। খড়খড়ি দেওয়া জানালা। সুউচ্চ দরজা।
ঘরের ভেতর দিয়ে ঘর। বিশালতা যেন ব্যঙ্গ করছে 
দশফুট বাই দুশফুটে থাকা মানুষদের। 

আমি তন্ময় হয়ে সব দেখছি। মেয়ে ছবি তুলতে ব্যস্ত। একটি বড় ঘরে অবন ঠাকুরের জগৎবিখ্যাত চিত্রের কিছু প্রতিলিপি রাখা আছে। চতুর্ভুজা ভারতমাতা, শাজাহানের অন্তিমকাল, ওমর খৈয়াম, বুদ্ধ ও সুজাতা। 

সেখান থেকে বেরিয়ে বাড়ীর পেছনদিকে গেলাম। 
বুড়ো আমগাছ ক্ষয়িষ্ণু ভাবে জানান দিচ্ছে তার প্রাচীনতা। যোগ্য সাথীর সাক্ষ বহন করছে তাল, কাঁঠাল, অশ্বত্থ ঘেরা ছায়া নিবিড় প্রাঙ্গন। 

সব জায়গায় যত্নের ছাপ সুস্পষ্ট দেখে কোন্নগর পৌরসভার তারিফ করলাম মনে মনে।

গঙ্গারদিকে বাগানবাড়ীর সন্নিকটেই একটি ইসলামী মাজার। কোনো পীর সাহেব শয়নে আছে বোধহয়। টাটকা রজনীগন্ধা ফুল ও ঝকমকে ঝালর দেওয়া চাদরে বোঝা যায় ভক্তি ভাব আজও বিদ্যমান।

এই আমাদের ঐতিহ্য মন্ডিত বাংলা। যেখানে বিরোধ নেই। সহবস্থান আছে। 

আশেপাশে যে টুকু স্থান ফাঁকা ছিল সেইখানে প্রাকৃতিক ঘাসের সবুজ গালিচার উপরে শীতকালীন ফুলের সমারোহ। দেখেই নয়ন জুড়িয়ে আসে। 
মনের মধ্যে শীতলতার স্পর্শ অনুভব করি।  

ফিরে আসার সময় হয়ে এলো। কন্যাটি আমার কৌতুহল বশত বললে, " বাবা, রাজকাহিনী,বুড়ো-
-আংলা, ক্ষীরের পুতুল এই বইগুলো অবনঠাকুরের লেখা তো। ছবি আঁকা ছাড়াও ওঁর লেখা পড়তে আমার খুব ভালো লাগে।" আমি আশ্বস্ত হয়ে ভাবলাম, যাক  যন্ত্র নির্ভর আধুনিকতার নামে নিজের সংস্কৃতির বিসর্জন দেয় নি। 

অনেকদিন আগে পড়া একটা লেখার কথা মনে পড়ে গেল। মেয়েকে বললেম, " জানিস বাবু, ঋতুপর্ণ ঘোষ একটি প্রবন্ধে লিখেছিলেন, রবি ঠাকুরের ছায়ায় অবনঠাকুর নিজেকে ঠিকমতো  মেলে ধরতে পারেন নি। আসলে কি জানিস তো,সূর্যের পাশে শুকতারার অস্তিত্ব থাকলেও উজ্জ্বলতা হ্রাস পায়।
কাকলিদি সাধে বলেন রবি ঠাকুর ছিলেন দানবীয়
প্রতিভার অধিকারী।"

গঙ্গার দিকে তাকিয়ে দেখি, ভাগীরথীর কোলে মিলিয়ে যাচ্ছে বৈকালিক অস্তরাঙা সূর্যের কিরণ।

বিচিত্র অনুভূতির রঙে মনকে রাঙিয়ে দুহিতার হাত ধরে বাড়ী ফিরে এলাম।
..................