' দ্য স্ট্রাগলিং নাইট ' এবং সেই ফুচকাওয়ালা
অঙ্কুর চক্রবর্তী
২০০১ সালের গ্রীষ্মকালটা আমার কেটেছিল হাওড়ার একটা মেস বাড়ির তিনতলার ঘুপচি ঘরে। দশ বাই দশ ফুটের এই এক চিলতে ঘরটায় আমার তক্তপোষ এবং ইজেল ও রং তুলি রাখার পর আর বিশেষ জায়গা ছিল না। কিন্তু আমার ঘরটা অপছন্দ ছিল না তার কারণ ঘরের একমাত্র জানলাটা খুলে দিলে গঙ্গা এবং তার তটের দৃশ্য চোখে পড়ত। চোখে পড়ত নদীর ওপারের চটের কলগুলোর সারি সারি চিমনি আর অসংখ্য ছোট ছোট আলো যাদের প্রতিটির নিশ্চয়ই নিজস্ব কোনো গল্প ছিল। একজন শিল্পীর জন্য আদর্শ দৃশ্য সন্দেহ নেই। গঙ্গার ধারে ঘিঞ্জি বস্তি সংলগ্ন এলাকায় মেস বাড়িটার অবস্থানের জন্য এই ঘরটার ভাড়াও ছিল কম। যদিও এখন বলতে বাধা নেই যে, মাঝে মাঝেই সেই ভাড়া গুনতেও আমাকে নাজেহাল হতে হতো এবং মেসের ম্যানেজার হৃষিকেশ বাবু অত্যন্ত সজ্জন ভদ্রলোক হওয়ার কারণেই আমাকে নিতান্ত উৎখাত হতে হয়নি।
আমার এই অর্থকষ্টের মূল কারণ হলো আমার ছবির বিক্রি নেই। আজকাল ছবি এঁকে পেট চালানো যায় না বললেই চলে। তবুও পোট্রেট হলে কথা ছিল, খেয়ালি বড়োলোকের কিছু ছবির বরাত জুটে যেত ঠিকই। কিন্তু আমার পছন্দ ল্যান্ডস্কেপ। মডার্ন আর্টের এই যুগে ল্যান্ডস্কেপ ছবির প্রদর্শনী হয় কম, বিক্রি আরো কম। তবুও সুযোগ একটা এসেছে দিন কয়েক হলো। মিত্র গ্যালারির উদ্যোগে টলিগঞ্জে একটা প্রদর্শনী হচ্ছে শুধুমাত্র ল্যান্ডস্কেপ ছবির ওপর। ছবির বিষয় - কলকাতার রাত। আমি ঠিক করেছি গঙ্গার ওপরে নেমে আসা রাত হবে আমার ছবির বিষয়বস্তু। আমি আমার ক্যানভাসে ফুটিয়ে তুলতে চাই রাতের আবছা অন্ধকারে লুকিয়ে থাকা এক অব্যক্ত হতাশার কথা। ছবিটার একটা যুতসই নামও ঠিক করে ফেলেছি ইতিমধ্যে - দ্য স্ট্রাগলিং নাইট বাই দি গ্যাঞ্জেস। স্টুডিও পাড়ার কাছেই যেহেতু গ্যালারি, কপাল জোরে কোনো ফিল্মস্টার হয়ত পছন্দ করে ফেলল ছবিটা, কিংবা কোনো প্রোডিউসার কলমের এক আঁচড়ে আমার জন্য লিখে দিলেন মোটা অঙ্কের চেক আর তাতে সমাধান হয়ে গেল আমার জীবনের না মেলা সব অঙ্কগুলো? এমন হতে পারে না কি কখনো? দিবাস্বপ্ন দেখতে কার না ভালো লাগে, আমারও লাগে।
অনেক রাত অবধি কাজ করা আমার অভ্যেস। সকালবেলায় মুটে মজুরদের হাঁক ডাকে এপাড়ায় কাজের সুবিধে হয় না। তাছাড়া দিনের বেলা হৃষিকেশবাবু মাঝে মাঝে এসে উপস্থিত হন ভাড়ার তাগাদা দিতে। তাই দিনের বেলাটা আমি ঘরে থাকা এড়িয়ে চলি। হয় ইতস্ততঃ ঘুড়ে বেরাই না হয় গ্যালারির কিউরেটরদের সাথে আলাপ জমাই কাজের খোঁজে কিংবা নিতান্ত অনন্যোপায় হলে নেশন্যাল লাইব্রেরিতে কাটিয়ে দেই ছবির ব্যাপারে পড়াশুনো করে। পাশ্চাত্য শিল্পে রাতের ছবি বিষয়টা নতুন কিছু নয়। রেনেসাঁর সময় থেকেই বারবার রাত ফুটে উঠেছে শিল্পীদের রং তুলিতে। কখনও সেই চিত্রের বিষয়বস্তু ধর্মীয়, কখনও যুদ্ধ কিংবা মহাকাব্যের কোনো ঘটনা। এই ছবিগুলোর মধ্যে নিশ্চিতভাবে সবচেয়ে বিখ্যাত ভ্যান গগের আঁকা " স্টারি নাইট"। রাতের শেষে ভোরের প্রথম আলো ফুটে ওঠার ঠিক আগের সেই অপার্থিব ছবিটি মানুষের আশা নিরাশায় দোলা জীবনের কথা বলে। এ পিকচার স্পিকস এ থাউজ্যান্ড ওয়ার্ডস- শতাব্দী পেরিয়েও এই ছবিটি তাবৎ বিশ্বের মানুষের সাথে ফিসফিসিয়ে কত কথা বলতে চায়।
জানলা খুলে রোজ রাতে আমি বাইরের দৃশ্য স্টাডি করি। দীর্ঘক্ষণ জানলার কাছে দাঁড়িয়ে থাকার পর ফিরে যাই ক্যানভাসে। কিছুদিন ধরে একটা অদ্ভুত ব্যাপার চোখে পড়ছে আমার। রাত একটু গভীর হলেই একটা ফুচকাওলা এসে বসে গঙ্গার ধারের একটা ল্যাম্প পোস্টের নীচে। কাঁচের বয়াম ভর্তি করা ফুচকা। এত রাতে কে ফুচকা খেতে আসবে কে জানে, তবু লোকটা আসে রোজ। ভোর হয়ে আসার ঠিক আগে, লোকটা গিয়ে বসে গঙ্গার ঘাটে। সারা রাতে একটাও ফুচকা বিক্রি হয় না তার। দিনের বেলা কিন্তু আর দেখা যায় না তাকে।
- ২-
আজকাল অয়েল পেইন্টিং আঁকার খরচ কিছু কম নয়। বেশ কিছু রঙের টিউব কেনার দরকার ছিল। কলেজ স্ট্রিটের চেনা দোকানে ধার হয়ে গেছে অনেক, সহজে দিতে চাইছিল না এবার; শেষ পর্যন্ত দিয়ে বলেছে যে এই শেষবার। আমি খুব বুঝতে পারছি, এভাবে আর বেশিদিন চলবে না।
কলেজ স্ট্রিট থেকে হাওড়া ফিরব বাসে, দুপুরের বাসে বিশেষ লোক থাকে না। কন্ডাক্টর টিকেট কাটতে এলে ওর হাতে একটা টাকা গুঁজে দিয়ে বললাম, টিকিটের দরকার নেই। সে কথা না বাড়িয়ে অন্য যাত্রীদের টিকিট করতে লাগলো, আমার নগদ তিনটে টাকা বেঁচে গেলো।
বিকেলের দিকে গঙ্গার ঘাটে ইতস্তত ঘোরাফেরা করতে লাগলাম নিছক সময় কাটানোর জন্য। এসময় হৃষিকেশ বাবু মেসে থাকেন, ওনার সামনে পড়লে আবার ভাড়ার কথা তুলবেন। এই ছবিটি এক্সিবিশন এ জমা নিলে মিত্র গ্যালারির থেকে সাম্মানিক হিসেবে কিঞ্চিৎ অর্থপ্রাপ্তির সম্ভাবনা আছে, সেটা না পেলে আমার একেবারেই চলবে না। সন্ধ্যে নামার অনেকক্ষণ পর অবধিও গঙ্গার ঘাটে ঘুরে সেই রাতের ফুচকাওয়ালার কোনো সন্ধান আমি পেলাম না। আচ্ছা বোকা লোক তো, গঙ্গার ঘাট এই সময় লোকে গমগম করছে, কপোত কপোতী আইসক্রিম আর চিনেবাদাম শেষ করে ফেলছে মুহূর্তে। এমনকি দুটো ফুচকাওয়ালাও দেখতে পেলাম, তাদের বিক্রি বাট্টাও নেহাত মন্দ নয়। এই সময় না এসে সেই লোকটা আসবে গভীর রাতে। কি ব্যাপার কে জানে, লোকটা কি ব্যবসার কাজ কিছুই জানে না?
রাত নটার দিকে চোরের মত চুপিচুপি মেসে ঢুকলাম। সবার নজর এড়িয়ে তেতলায় নিজের ঘরে ঢুকে নতুন কেনা রঙগুলো রাখলাম বিছানার ওপর। বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে মগ্ন হয়ে গেলাম আমার ছবিটার মধ্যে। রাত তখন একটা প্রায়, খুব গুমোট লাগছে বলে জানালার পাশে এসে দাঁড়ালাম। গঙ্গার স্নিগ্ধ হাওয়া শরীরটাকে জুড়িয়ে দিল, নদীর ওপর নিশুতি রাত নামছে। চাঁদ উঠেছে মধ্য গগনে, মাঝ গঙ্গায় একখানি ছোট নৌকা ভেসে রয়েছে। নদীর পাড়ের কোনো কোনো চটের কলের আলো দেখা যাচ্ছে, কোনটার আলো জ্বলছে না, হয়ত লক আউট চলছে। সেসব কারখানার শ্রমিক, নৌকার মাঝির অশ্রু আর ঘামে ভারী হয়ে আছে কলকাতার গ্রীষ্মের রাতের বাতাস। ঠিক এই ছবিটাই তো আঁকতে চাইছি আমি আমার ' দ্য স্ট্রাগলিং নাইট ' এর ক্যানভাসে। জানলার বাইরে দৃশ্যে খাপ খাচ্ছে না শুধু মাত্র একটি ব্যাপার। রাতের সেই ফুচকাওয়ালা আবার হাজির আজ তার কাঁচের বয়াম ভর্তি ফুচকা নিয়ে। আজও তার একটিও খদ্দের নেই। একবার ওর কাছে যাব নাকি? একটা অদ্ভুত আকর্ষণ অনুভব করছি আমি, আর সেটা ঠিক মাঝরাতে ফুচকা খাওয়ার লোভ নয়। নিজেকে বোঝালাম সময় নষ্ট করে লাভ নেই। আমি একরকম জোর করেই আবার মন বসালাম আমার কাজে, আজই শেষ করে আনতে পারব বলে মনে হচ্ছে ল্যান্ডস্কেপ টা।
-৩-
মিত্র গ্যালারিতে ঢুকলেই দেখা যাবে, শ্রী অম্বরেন্দু মিত্র মহাশয়ের একটা অয়েল পোট্রেট। সেকালে ডাকসাইটে বিত্তশালী লোক ছিলেন অম্বরেন্দু মিত্র, সাবানের ব্যবসা করে পয়সা করেছিলেন বিস্তর। ধুরন্ধর ব্যবসায়ী হওয়ার পাশাপাশি তিনি ছিলেন শিল্পের পৃষ্ঠপোষক। তারই সংগৃহীত দেশি বিদেশি ছবি নিয়ে আজকের এই ' মিত্র গ্যালারি ' । এই গ্যালারির কিউরেটর এখন পার্থসারথি সাহা। আমি তার সামনেই বসে ছিলাম ছবিটি দেখানোর জন্য। একটা ঢাউস অ্যালবামের পাতা উল্টে কিছু একটা দেখে চলেছেন বিশালবপু পার্থসারথি বাবু। এয়ার কন্ডিশনারের ঠান্ডা হাওয়া সত্বেও জুন মাসের এই দুপুরে ঘেমে উঠছে তার কপাল; আমার উপস্থিতি যেন গ্রাহ্যই করছেন না ভদ্রলোক। শেষে না থাকতে পেরে বললাম
- স্যার..
- হুম্ করে একটা ছোটো শব্দ করলেন পার্থসারথি বাবু। তার মনোযোগ এখনও অ্যালবামে।
আমি একটা ছোট্ট কাশির শব্দ করলাম।
- হ্যাঁ? এতক্ষণে সম্বিৎ ফিরে পান ভদ্রলোক। ও তোমার ছবিটা না? এই চা খাওনি? ছি ছি!
ফোন তুলে বেয়ারাকে দুটো চা এর অর্ডার দেন পার্থসারথি সাহা।
-কই দেখাও দেখি ছবিটা..
আমি ফোল্ডার থেকে বার করে যত্ন করে মেলে ধরি তার সামনে। খুঁটিয়ে দেখতে থাকেন ভদ্রলোক ল্যান্ডস্কেপ টা। বেয়ারা এসে চা দিয়ে যায়, আমি উদগ্রীব হয়ে আছি পার্থসারথি বাবুর প্রতিক্রিয়ার জন্য।
কিছুক্ষণ বাদে চোখ থেকে চশমা নামিয়ে আমার দিকে তাকালেন ভদ্রলোক
- দেখো, তোমার ছবিটা ভালো। কিন্তু কিছু একটা মিসিং।
- কি মিসিং স্যার?
- একটা হিউম্যান টাচ্! মানুষের কথা কোথায় বলছে ছবিটা?
- স্যার মানে রাতের কথা, বন্ধ হয়ে যাওয়া কারখানা গুলো দেখুন, তাদের শ্রমিকের কথা, নৌকার মাঝিদের কথা। এমনকি গঙ্গার নিজের কথা, সারা ভারতের সমস্ত আবর্জনা বয়ে নিয়ে চলার কথা, এগুলোই তো বলছে ছবিটা।
- না হে না! বড্ড ভেগ , বড্ড অস্পষ্ট সেসব। এরম অবস্থায় ছবিটাকে এক্সিবিশন এ নিতে পারব না। আরো চেষ্টা করো।
আর কি চেষ্টা করবো, আগামীকাল ছবি জমা করার শেষ দিন, আমি কথা না বাড়িয়ে উঠে পড়লাম। পার্থসারথি বাবুর গলা শুনতে পেলাম আবছা
- আরে, চললে নাকি? চা টা খেয়ে গেলে না। যাক গে মাথায় রেখো হিউম্যান টাচ্ চাই..
আমার দমবন্ধ হয়ে আসছে, একটা যে দীর্ঘশ্বাস ফেলেবো সে শক্তিটুকু যেন নেই। এবারেও হলো না? পকেটে পয়সা একেবারে শেষ, একটা সিগারেট কেনাও বিলাসিতা। তবুও গতকালের টিকিট বাঁচানোর টাকা দিয়ে একটা চা আর একটা ফ্লেক নিলাম। পায়ে পায়ে কখন মেট্রোরেলের স্টেশনে এসে বসেছি আমার নিজেরও খেয়াল নেই। একটার পর একটা পর একটা মেট্রো চলে যাচ্ছে, ওঠানামা করছে কর্মব্যস্ত মানুষের দল। ঠিকমতো কলেজ শেষ করে কি একটা চাকরি জুটিয়ে নেওয়া যেত না ওদের মতই? এখন চোখের সামনে শুধু নিরেট অন্ধকার।
একবার উঠে মেট্রোরেলের লাইনটা দেখে এলাম, ট্রেন আসার আগে কেমন একটা সর সর করে আওয়াজ হতে থাকে। ইচ্ছে করছে কান পেতে শুনতে সেই আওয়াজ। ওই লোহার পাতগুলোর ও কি মাঝে মাঝে পেতে ইচ্ছে করে না মানুষের ছোঁয়া, মানে পার্থসারথি বাবুর ভাষায় যাকে বলে হিউম্যান টাচ্? আবার ঝিক ঝিক শব্দ শুরু হয়েছে; টানেলের ভেতর থেকে আলো দেখা যাচ্ছে মেট্রোরেলের, আর আমার জীবনের এই সুরঙ্গের শেষে আলো কোথায়? মেট্রোটা আরো কাছে চলে এসেছে এখন , খুব টানছে আমাকে ইস্পাতের লাইনটা।
নাহ! কি সব ছাইপাশ ভাবছি, নিজেকে জোর করে সরিয়ে আনলাম সেখান থেকে।
-৪-
সন্ধ্যের বাসে অফিসের ভিড়। কোনোমতে একটু দাঁড়ানোর জায়গা পেয়েছি মাত্র। কন্ডাক্টর আসাতে আমি হাতে একটা টাকা দিলাম রোজের মতোই।
- দাদা, ভাড়া পাঁচ টাকা।
আমি চোখের ইশারায় বললাম টাকাটা রেখে দিতে নিজের কাছে। কিন্তু ভিড় বা অন্য যেকোনো কারণেই হোক, আজ সে নাছোড়বান্দা
- বাসে উঠলে পুরো ভাড়াই দিতে হবে দাদা। না থাকলে নেমে যান। সবাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে কথাটা বলল কন্ডাক্টর। আমার পকেটে সত্যি আর একটা পয়সাও নেই, তাই মাথা নিচু করে অপমানটা হজম করলাম আমি। পরের স্টপেজ আসতে নেমে পড়লাম বাস থেকে।
বাকি পথটা হেঁটে যখন মেসের ঘরে পৌঁছলাম তখন রাত দশটা হবে। শরীরে আর এক ফোঁটা শক্তি অবশিষ্ট নেই। গামছা হাতে বাথরুমে ঢুকলাম মুখে চোখে জল দেওয়ার জন্য। সারাদিন না খাওয়ার জন্যই হোক কিংবা এই জৈষ্ঠের গরম মাথায় করে এতটা হাঁটার জন্যই হোক টালমাটাল লাগছে খুব। বাথরুমে ঢুকে সিলিং এর দিকে তাকালাম, শক্ত পোক্ত একটা হুক থেকে জ্বলছে বাল্বটা, সেটার দিকে তাকিয়ে থাকলে চোখে ধাঁধা লেগে যায়। মাথার মধ্যে একটা চিন্তা পোকা যেন কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। কোথাও একটা টিকটিকি ডেকে উঠলো - ঠিক ঠিক। গত ছয় মাসে আমার একটাও ছবি বিক্রি হয়নি, তিনমাসের মেস ভাড়া বাকি হৃষিকেশ বাবুর কাছে, আজকের বাসের সমস্ত যাত্রীদের দৃষ্টি আমাকে নিরীক্ষণ করে চলেছে বন্ধ বাথরুমের ভেতরেও। এরপর আমার মাথাটা যেন একেবারে ফাঁকা হয়ে গেল।
তারপর কিছুক্ষণের জন্য আমি নিজের মধ্যে ছিলাম না। হয়ত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম। সম্বিৎ যখন ফিরল, তখন আমি খোলা জানলার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছি, ফুরফুর করে গঙ্গার হাওয়া আসছে, ক্যানভাসে টাঙানো আমার ' দ্য স্ট্রাগলিং নাইট ' । এখনও আমি ঠিক প্রকৃতিস্থ নই, একটা স্বপ্ন স্বপ্ন ভাব আমার চারিদিকে, নিজেকে আশ্চর্যরকম হালকা অনুভব করছি। ল্যাম্পপোস্টের নীচে আজও দাঁড়িয়ে আছে সেই ফুচকাওয়ালা। কিন্তু আজ একটা পরিবর্তন হয়েছে, তার কাছে ফুচকা খাচ্ছে এক জোড়া তরুণ তরুণী। সারাদিন কিছুই খাইনি, খিদে বোধ হচ্ছে না যদিও তবু একটু ফুচকা খেলে মন্দ হয় না। সারাদিনের অনাহারের জন্যই আমার পায়ে কোনো সাড় নেই বোধহয়, যেন সেগুলো শূন্যে ভাসছে। তবুও কিভাবে যেন হাঁটতে হাঁটতে কিংবা হয়ত ভাসতে ভাসতেই একরকম পৌঁছে গেলাম ফুচকাওয়ালার কাছে।
আমাকে দেখে একগাল হেসে শালপাতা ধরিয়ে দিল সে। মাথায় ছোট করে ছাটা কাঁচা পাকা চুল, চোখগুলো কেমন গর্তে বসা, মুখে একটা ক্ষ্যাপাটে ভাব। শীর্ণ আঙ্গুলগুলো দিয়ে আলু মটর মাখতে শুরু করেছে সে। মাখতে মাখতেই সে ফ্যাসফ্যাসে গলায় নিজের মনেই বলে চলেছে,
- ছোটেলালের ফুচকা, প্রতিটা পিস মাস্টারপিস। একবার খেলে বার বার খাবেন।
প্রথম ফুচকাটা মুখে তুলেই বুঝলাম, লোকটা ভুল কিছু বলেনি, দিব্যি স্বাদ ফুচকার।
- তা ছোটেলাল। তুমি সন্ধ্যেবেলা না বসে এই রাতদুপুরে বসো কেন?
ফিক করে হেসে লোকটা বলে ওঠে
- আমার খদ্দেরদের যে এটাই সময়।
- মানে?
- মানে আপনি যা ভাবছেন তাই! ফ্যাসফ্যাসে গলায় উত্তর এলো।
- কি বলতে চাও হে, ভূতেদের খদ্দের করেছ নাকি তুমি? হালকা মেজাজে কথাটা বললাম আমি।
- বলতে চাই না বলছি। একটু আগেই যে একজোড়া এসছিল, বাড়িতে মেনে নেয়নি বলে ওরা তো এই ঘাটেই ঝাঁপ দিয়েছিল হেঁ হেঁ। আর আমিও তো, বেঁচে থাকতে ফুচকা বিক্রিই হত না। অন্যরা নিজেদের ফুচকা বিক্রি শেষ করে চলে যেত, আমি বসে থাকতাম ঘাটে। চার বছর আগে একদিন দিলাম সব শেষ করে!
- কি আবোল তাবোল বকছ তুমি বলত? আমার কণ্ঠস্বর কেঁপে ওঠে এবার।
- " আবোল তাবোল নয় বাবু" । কান এঁটো করা হাসি হেসে বলে চলে ছোটেলাল। " আমার পেছনে বোস বাবু আসছেন। ইন্সুরেন্স এজেন্ট। লাইফ ইন্সুরেন্স বিক্রি না করতে পেরে একদিন নিজের লাইফটা শেষ করে দিলেন। ওনার নিজের কোনো ইন্সুরেন্স ছিল না হেঁ হেঁ।"
বলতে বলতে ছোটেলাল নিজের মুন্ডুটা পুতুলের মত ঘাড়ের ওপর একশো আশি ডিগ্রী ঘুড়িয়ে দেয়। এই পৈশাচিক আতঙ্কের মধ্যেও আমি তার দৃষ্টি অনুসরণ করে লক্ষ্য করলাম, একজন গোবেচারা গোছের লোক কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে এগিয়ে আসছে। ল্যাম্প পোস্টের আলো লোকটার ভারী চশমার কাঁচে প্রতিফলিত হচ্ছে। আশ্চর্য এই ছোটেলালের ঘোরানো মাথা তাকে একটুও অবাক করল না।
আমি আর এক মূহুর্ত দাঁড়ালাম না সেখানে, নিমেষের মধ্যে পৌঁছে গেলাম আমার মেসের দরজায়। আমি বুঝতে পারছি, এত ভয়ের মধ্যেও একটা প্রশ্ন বারবার উঁকি দিচ্ছে আমার মনের মধ্যে।
দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকতেই ইজেলে টাঙানো ছবিটায় চোখ পড়ল। মন্ত্রমুগ্ধের মত রং তুলি তুলে নিলাম হাতে, ফুটিয়ে তুললাম আমার দেখা ফুচকাওয়ালার সেই ভর্তি বয়ামটা আর টিমটিম করে জ্বলতে থাকা পিদিম। সারাদিনের বিক্রি না করতে পারার যন্ত্রণা নিয়ে সাদা ধুতি আর বাংলা শার্ট পড়া ফুচকাওয়ালা বসে আছে গঙ্গার ধারে। এবার আমার ছবিতে এসেছে কি পার্থসারথি বাবুর চাওয়া সেই " হিউম্যান টাচ"?
ছবিটা রোল করে ফোল্ডারে ঢুকিয়ে, মিত্র গ্যালারির ঠিকানা সেটে দিলাম তাতে, এবার কাঙ্ক্ষিত স্থানে পৌঁছে যাবে সেটা। তারপর তার ভাগ্য নির্ধারণ হবে, সেটার জায়গা হবে হয়ত মিত্র গ্যালারির মাস্টারপিস সেকশানে কিংবা হয়ত আস্তাকুড়ে।
ক্লান্ত মস্তিষ্কে রং মাখা হাত বাথরুমে ধুতে ঢুকতেই যে দৃশ্যটা চোখে পড়লো তার জন্য আমি একেবারেই প্রস্তুত ছিলাম না। বাথরুমের ছাদের আংটার সঙ্গে বাঁধা গামছা থেকে ঝুলে আছে একটা দেহ। তার গালের দু সপ্তাহের না কাটা দাঁড়ি, হাতা গোটানো ঘামের দাগ বসা সবুজ শার্ট - এগুলো আমার খুব চেনা কারণ সেগুলো আমি বহুবার দেখেছি। হ্যাঁ, মৃতদেহের হাঁ করা চোখ ঠিকরে যাওয়া যে মুখটা এখন বিভৎস হয়ে গেছে সেটাও আমি অজস্র বার দেখেছি - আয়নায়। আমি এটাও বুঝলাম আমার মনের মধ্যে লেগে থাকা প্রশ্নটার উত্তর আমি পেয়ে গেছি এবার। এখন স্পষ্ট বুঝতে পারছি কেন চার বছর আগে মরে ভূত হয়ে যাওয়া লোকটার হাতের ফুচকা আমি খেতে পারলাম আজ। কারণ আজ থেকে আমিও যে সেই ব্যর্থ মানুষগুলোর দলে যারা জীবনের ক্যানভাস থেকে নিজেদের মুছে ফেলেছে চিরকালের মতো। আর সেই না-মানুষ আমিই আমার শেষ আঁকা ছবিতে এনে দিয়েছি হিউম্যান টাচ - মনুষ্যত্বের স্পর্শ।
আমার অন্তিম ল্যান্ডস্কেপ এর কাজ সম্পূর্ণ হয়েছে, জানলার গরাদ গলে বাইরে বেরিয়ে এলাম, কোনো অসুবিধে হলো না। গঙ্গাবক্ষের অপার্থিব জোৎস্নার সেই জগৎ আমার ইজেলের নীল কালো আর সাদা রঙের মতোই অবসাদ আচ্ছন্ন অথচ সুন্দর। এই পৃথিবীতে ভাড়ার তাগাদা নেই, আমার ছবি বিক্রির চিন্তা নেই, ছোটেলালের ফুচকা বিক্রির দায় নেই, বোস বাবুর ইন্সুরেন্স নেওয়ার ক্লায়েন্ট নেই। আছে শুধু কালচে নীল রঙের অনন্ত অন্ধকার। রাতের অন্ধকারের সেই নেশাতুর রঙের সাথেই আস্তে আস্তে মিশে যাচ্ছে আমার আঠাশ বছরের জীবনের ব্যর্থতা, হতাশা আর সমস্ত স্ট্রাগল। সব শিল্পীর সেরা শিল্পীর আঁকা শেষ রাতের সেই ক্যানভাসে আমি নিজেকে বিলীন করে দিলাম।
(সমাপ্ত)