―ভূতের ইয়ে, থুড়ি তেনাদের কথা আমি শুনতে পাই। তবে সে ক্ষমতা কিভাবে পেলাম তা আমি জানিনা। আমার ঠাকুর্দা একসময় পূজো অর্চনা করতেন। ঝাড়-ফুঁক, ভূত তাড়ানো এসবেও বেশ সিদ্ধহস্ত ছিলেন। আমি একটু বড় হতে তার সাথে সাথে ঘুরে বেড়াতাম। কিছু মন্ত্র শিখেছিলাম। ঠাকুর্দার চ্যালা হিসেবে বেশ বিশ্বস্ত হয়ে পড়েছিলাম। তখনই হয়তো কাজ করতে করতে এই ক্ষমতাটা চলে এসেছে। বুঝলি তো?
“আর পশু-পাখীর ভাষাটা?” বললাম আমি।
দাদু বলল, “হ্যাঁ রে সেই কথাতেই তো আসছি।”
“এরপর কলকাতা থেকে একটা বাসে চেপে এসে পৌঁছলাম একটা ডকে। ডক বুঝিস তো? যেখান থেকে জাহাজ ছাড়া হয়। জায়গাটার নাম খিদিরপুর। তা সেখানে এসে কোথায় যাবো, কি করবো ভাবতে ভাবতে একদল শ্রমিকের সাথে ভিড়ে গিয়ে কিছু বাক্স নিয়ে ঢুকে পড়লাম জাহাজের ভেতরে। কেউ কাউকে চিনি না। কোথায় যাচ্ছি না জানিনা। রাত্রে খেতে বসে ধরা পরে গেলাম। মাথাপিছু রসদ মিলছে না। ক্যাপ্টেনের কাছে নিয়ে যাওয়া হল। তিনি ভারী অমায়িক মানুষ। আমার উদ্ভ্রান্ত অবস্থা দেখে হয়তো তার মায়া হলো। কাজের বিনিময়ে খাবারের শর্ত দিলেন। মাইনে পত্তর কিছু পাবো না। আমি তাতেই রাজি। এই বা কি কম। কথায় আছে। পেটে খেলে তবেই না পিঠে সয়। চারদিন তিনরাত সমুদ্রের উথাল পাথাল সহ্য করার পর একটা জায়গায় এসে পৌঁছলাম। জায়গাটার নাম আন্দামান। মনে হলো না বাংলাদেশ থেকে বেরিয়ে এসেছি। যেন আবার আরেক বঙ্গে পৌঁছে গেছি। গাছগাছালিতে ভরা, নির্মল একটা জায়গা। মজার ব্যাপার এখানেও সবাই বাংলা বলে। আর এখানেই আছে ভারতের ইতিহাসের সেই কুখ্যাত জেলখানা সেন্ট্রাল জেল। আন্দামানের জলের রং কালচে। তাই একে বলা হত কালাপানি। এটা নাকি একটা দ্বীপ। সমুদ্রের মাঝে একটা ছোট্ট ভূমি। সেখানেই দিন কাটাতে শুরু করলাম। কতো কাজই না করেছি। মাছ ধরা, বেচা, জেলের পিওন, ব্যবসা, নৌকা চালানো, মুটে মজুর কি না করেছি। যত কাজ করেছি তত কাজের প্রতি নিষ্ঠা বেড়েছে। বুঝেছি কোনো কাজই ছোট নয়।”
প্যাঙলাদা আবার কিছু বলতে যাচ্ছিল। আমি চিমটি কেটে চুপ করিয়ে বললাম, “তারপর কি হলো দাদু?” দাদু বোতল থেকে ঢকঢক করে জল খেয়ে আবার শুরু করলেন, “তা ওই আন্দামানেই আমার রোমাঞ্চকর জীবনের হাতে খড়ি। সারা সপ্তাহ এদিক ওদিক কাজ করি আর শুক্কুরবার বেরিয়ে পরি কখনো জঙ্গলে, কখনো পাহাড়ের চূড়ায়, কখনো বা ভাঙাচোরা বাড়িঘরের ভিতরে। কি না দেখেছি। রস আইল্যান্ডে জাপানিদের বাসস্থান, হাভলক আইল্যান্ডের তারা ভরা আকাশ, নীল আইল্যান্ডের ঘন নীল স্বচ্ছ জল। মাড ভলকানো। এভাবে বেশ ভালোই যাচ্ছিল দিন কিন্তু ওই যে টাকা রোজগারের সূতোয় আটকে থাকাটা কিছুতেই মানতে পারছিলাম না। সেই তো পিছুটান। সেই তো শিকড়ে আটকে থাকা। একদিন বেশ কিছু জমানো টাকা আর জামাকাপড় নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম বারট্যাং আইল্যান্ডের উদ্দেশ্যে। শুনেছি ওখানেই নাকি জারোয়া উপজাতি থাকে। ওরা ভীষণ হিংস্র। ওদের কয়েকজন অধিবাসীকে সরকার শিক্ষিত করে পাঠিয়েছিল ওদের সমাজে যাতে ওরাও ওই কয়েকজনকে দেখে সভ্য সমাজে এসে জীবন যাপনের কথা ভাবে। যেদিন পাঠানো হলো তারপরেরদিন ওই কজনের কাটা মুন্ডু ওরা রেখে গেল সমুদ্রের ধারে। ওরা নিজেদের গন্ডিতেই খুশি। জারোয়া সম্বন্ধে অনেক কথা শুনেছিলাম। ওদের চোখে দেখার ইচ্ছেটা সংবরণ করতে পারলাম না। বি.ট্যাং আইল্যান্ডে নেমে হাঁটা লাগালাম। চারিদিকে উঁচু উঁচু গাছ। ওদের শিকড়, মাথা কোনোটারই হদিশ মেলা কঠিন। একটা ছোট ভোজালি দিয়ে ছোট ছোট আগাছা কেটে পথ বানাতে বানাতে চলেছি। আসলে কোথায় যে চলেছি নিজেই বুঝতে পারছি না। তখনও জারোয়ার দেখা পাইনি। কিন্তু স্থির বিশ্বাস নিশ্চই ওদের সাথে দেখা হবে। মনের মধ্যে এক অদ্ভুত আশঙ্কার জন্ম হয়েছে। ওরাও মানুষ, আমিও মানুষ। তবু কতো পার্থক্য। দিনের আলো ফুরিয়ে এলো। আর এক পা-ও চলা সম্ভব নয়। ঝুপ করে অন্ধকার নেমে এসেছে চারিদিকে। আমি একটা উঁচু মতন ডালপালা ঘেরা গাছ বেছে তাতে দড়ি আর কাপড়ের সাহায্যে দোলনা মতো বানিয়ে নিলাম। এতেই রাতটা কাটানো যাবে। ভোজালিটা হাতের কাছেই রাখলাম। কোনো পশু আক্রমণ করলে আত্মরক্ষা করা যাবে। তাছাড়াও, ব্যাগে ছিল একটা লাইসেন্সড বন্দুক। জেলে কাজে থাকতে জেলারের থেকে বাগিয়ে রেখেছিলাম। সারাদিনের ক্লান্তিতে চোখ জুড়িয়ে আসছিল। মুড়ি-বাতাসা আর জল খেয়ে নিমেষে ঘুমিয়ে পড়লাম। তারপর কি যে হলো? দিনের আলো চোখে এসে লাগতেই বুঝলাম আমি পাশ ফিরতে পারছি না। শুধু তাই নয়, আমি হাত পা নাড়াতে পারছি না। বেশ কিছুক্ষণ নড়াচড়া ধস্তাধস্তি করে চোখ খুলে দেখলাম আমার হাত পা শক্ত রসি দিয়ে বাঁধা। চিৎকার করে বললাম, “কে আছো, আমায় খুলে দাও। বেঁধে রেখেছো কেন?” কেউ সারা দিল না। এবার চারিদিক ভালো করে দেখলাম। আমি দোলনায় শুয়েছিলাম। এখন পরে আছি মাটিতে। আমার ব্যাগ আর ভোজালি একটু দূরে পরে আছে। জায়গাটায় মনে হলো মানুষের বাস আছে। মাটির একটা অংশ পরিষ্কার করে রাখা, জায়গাটা পোড়াও বটে। যেন রান্না করা হয়েছে ওখানে। ইতস্তত খাবারের টুকরো পরে আছে। ভিতরটা ধক করে উঠল। তাহলে কি আমি কিডন্যাপ হলাম?
না এইখানে তো সাধারণ মানুষের আসার কথা নয়। তবে কি আমি জারওয়াদের ডেরায় এসে পৌঁছলাম? ভীষণ খুশি হলাম। এত অনায়াসে এভাবে পৌঁছে যাবো আশা করিনি। পরক্ষণে ভয়ও হলো। এরা নাকি নরখাদক। আমায় কি শিকার হিসেবে ধরে আনল নাকি!
শরীরের যন্ত্রণায়, খিদে তেষ্টায় শরীর আরো দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। কতক্ষন এভাবে পরেছিলাম মনে নেই। হঠাৎ দেখলাম একটা উলঙ্গ বাচ্চা কোত্থেকে দৌড়ে এসে আমার মুখের উপর ঝুঁকে কিছু দেখল। তারপর মুখে অদ্ভুত শিস দিতে শুরু করল। সেই আওয়াজ শুনে চারপাশ থেকে আরো কিছু তেমনি উলঙ্গ নারী পুরুষ বেরিয়ে এসে আমাকে ঘিরে ধরল। ওদের দেখে মনে হচ্ছিল যেন ওরা এক অদ্ভুত জীব দেখছে। মনে মনে প্রমাদ গুনলাম। জারোয়ারা শুনেছি আজও পোড়া মাংস খায়। আমায় যদি কাবাব বানিয়ে খেতে চায় এবার, পালিয়ে প্রাণ বাঁচাবার শক্তি টুকুও তো নেই। আবার ইষ্ট নাম জপতে শুরু করলাম। খুব ক্ষীণ কণ্ঠে বললাম, একটু জল। কে কি বুঝল কে জানে? আমাকে কথা বলতে দেখে সবাই ভয়ে সরে দাঁড়াল। আমি এবার নিশ্চিত, ভোজালির কোপে না হলেও গলা শুকিয়ে মরে যাবো নির্ঘাৎ। এবার শুনলাম ওরা নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। না, বাংলা, হিন্দি, ইংরেজি বা অন্য কোনো মনুষ্য কথিত ভাষা নয়। দুর্বোধ্য সে ভাষা। পৃথিবীর কোন সভ্য ভাষা যে তা নয় সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। কিছুটা শিষের মতো। যেন অনেকগুলো পাখি গান ধরেছে। আমি আবার বললাম, জল। এবার ওদের মধ্যে থেকে একজন পুরুষ বেরিয়ে এসে একটা পাতার বাটি থেকে জল ঢেলে দিল আমার মুখে। তখন আমার পিপাসার্ত শরীরে ওই নোনতা সমুদ্রের জলই অমৃত। এবার যেন শরীরে বল পেলাম। বললাম, “আমায় খুলে দাও। আমি তোমাদের ক্ষতি করবো না।” পুরুষটি মাথা নেড়ে উঠে গেল। সন্দেহ হলো লোকটি কি আমার কথা বুঝল? তাহলে মাথা নেড়ে না বলল কিভাবে? একটা গাছের গুঁড়িতে পিঠ ঠেকিয়ে বসিয়ে রাখা হলো আমাকে সারাদিন। অনেক রকমের খাবার দেবার চেষ্টা করল ওরা কিন্তু সে সব খাবার দেখে আমার গা গুলিয়ে উঠল। সন্ধ্যে নামতেই জায়গাটায় কাঠকুটো দিয়ে আগুন জ্বালানো হলো। সেদিনের শিকার করা একটা হরিণ আর খরগোশ ঝলসাতে দেওয়া হলো সেই আগুনে। আমার গা গুলাতে শুরু করল। কেন যে বাড়ি ছাড়লাম। কেন যে এডভেঞ্চারের ভূত মাথায় চাপল। সত্যি বলছি তখন বাড়ীর কথা খুব মনে পড়ছিল। যখন মনে মনে নিজের মুণ্ডুপাত করছি তখনই জঙ্গল ভেদ করে আবির্ভুত হলেন এক সাধুবাবা। ঠিক যেন সুনীল গাঙ্গুলির সবুজ দ্বীপের রাজা। লম্বা লম্বা সাদা দাঁড়ি গোঁফ, পরনে সাদা ধুতি আর উত্তরীয়, হাতে একটি পাত্র। চোখে এক অদ্ভুত চাউনি। উনি আসতেই সেই জারোয়াগুলি সরে দাঁড়াল। লোকটি একটি পাথরের ওপর বসলেন। সবাই একে একে তার সামনে এসে বসল। শিকারের সময় প্রাপ্ত ক্ষত গুলি এগিয়ে দিল ওঁর দিকে। উনি নাড়াচাড়া করে একটি লেপন লাগিয়ে দিলেন। কাউকে বা কিছু খাইয়ে দিলেন। আমি নিশ্চিত উনি সভ্য সমাজের। কিন্তু এখানে কি করছেন? আমি ওঁর সাথে কথা বলার একটা ফন্দি আটতে শুরু করলাম। তবে কোন ভাষায় উনি স্বচ্ছন্দ তা বুঝতে পারছিলাম না। যদিও এই কদিনে হিন্দি বলতে শিখে গেছি।
সকলে আবার খাওয়া নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেই ভদ্রলোক আমার সামনে একটি পাথরে এসে বসলেন। আমায় চমকে দিয়ে উনি বললেন, “ এখানে কি করতে?” আমি সাগ্রহে বলে উঠলাম, “আপনি বাঙালী?” উনি বিরক্ত হয়ে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বললেন, “আমি ভারতীয়। মানুষ। কোনো জাতি বা সম্প্রদায়ের নই। এই জাতের চক্করে কারোর আর ভারতীয় হওয়া হলো না ” তারপর আমার দিকে তাকালেন, “এখানে এই মানুষগুলোকে নিজের মতো করে থাকতে দিলেই ভালো। এরা সভ্য হলেই এই উপজাতি বিলুপ্ত হয়ে যাবে। সরকার চেষ্টা করছে ওদের সংরক্ষণের কিন্তু মানুষগুলো থাকতে দিলে তো। ওদের ধরে নিয়ে গিয়ে দাসে পরিণত করে ওরা। কি করতে এসেছো এখানে বলো?” ওঁর ধমকে কেঁপে উঠে বললাম, “আমি কোনো খারাপ উদ্দেশ্য নিয়ে আসিনি। সত্যি বলছি। শুধু একবার ওদের দেখতে এসেছি।”
― দেখতে এসেছো? ওরা কি চিড়িয়াখানার জন্তু নাকি? ওরা মানুষ। ঠিক তোমার মতো। শুধু ওরা তোমাদের মতো সভ্য নয়, তোমাদের ভাষা বলতে পারে না।
আমি ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “আপনি এখানে এদের মধ্যে কি করছেন স্যার?” উনি একটু তির্যক হেসে বললেন, “স্যার? প্রাণের দায় পড়লেই স্যার এহ? আমি এখানে এদের বাঁচাতে এসেছি। এরা যাতে বিলুপ্ত হয়ে না যায় তার জন্য আমি ওদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছি। কি করবে তোমার সমাজ? কি করবে? আমায় পাগল বলবে, আমায় নিয়ে হাসাহাসি করবে, করুক না। তাতে আমার কিচ্ছু যায় আসে না। আমি আগেও বন্য গাছপালা নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করছিলাম, আমৃত্যু করবো।”
ওঁর কথায় কিছুটা আঁচ করতে পারলেও পুরোটা বোঝার জন্য বললাম, “এক্সপেরিমেন্ট? আপনি কি বিজ্ঞানী?" উনি খেপে উঠে বললেন, “না আমি পাগল বিজ্ঞানী। পাগল।” রাগে ওর চোখ দুটো লাল হয়ে গেছে। ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলছেন। সে কি তেজ মানুষটার! ওই বয়সেও আমার মতো একজন যুবকের মনে ভয় জাগিয়ে দিয়েছিলেন। তারপর কি জানি কি ভেবে একটা শিস দিতেই সেই ছেলেটা যে আমায় জল দিয়েছিল সে ছুটে এল। মহারাজ তাকে বাংলায় বললেন, “ওকে খেতে দে। হাত খুলে দিস, পা বাঁধা থাক।” কথা মতো আমার হাত খুলে আমায় খেতে দেওয়া হলো। ভাত, শাক আর পোড়া মাছ। দুদিনের অভুক্ত পেটে সেটাই যেন অমৃত। গোগ্রাসে গিলে ঢকঢক করে জল খেয়ে আমি যেন প্রাণ ফিরে পেলাম। ছেলেটি আবার আমার হাত বেঁধে দিল। আমি তাকে অনুরোধ করলাম আমায় না বাঁধতে। সে স্পষ্ট বাংলায় উত্তর দিল যতক্ষণ না মহারাজ আদেশ দেন ততক্ষণ সে কিছু করতে পারবে না।”
গল্প করতে করতে বুঝতেই পারিনি সময়ের হিসেব। প্রায় ঘন্টা
দুয়েক পথ অতিক্রম করে যেখানে এসে পৌঁছলাম দাদু বললেন সেই জায়গাটার নাম বুড়ো
বটতলা। প্যাংলাদাদা মুখ ভেটকে বলল, “ধুর বটতলা নয় তো গয়নাতলা। তুমি কোথায়
নিয়ে এলে দাদু?” পাগলা দাদু মিটিমিটি হেসে বললেন, “এই বুড়োশিবের গায়ে একসময়
লাগানো ছিল বড় বড় সোনার বেলপাতা আর চোখ। মাথার সাপটাও ছিল সোনার।
ত্রিশূলটা অবশ্য লোহার ছিল। সবাই মনে করতো খুব জাগ্রত দেবতা, তাই যখন যার
মনস্কামনা পূর্ণ হতো, ভগবানকে উপহার দিয়ে যেত। একরাত্রে সেই গয়না চুরি গেল।
রে রে রে রে কান্ড। কিন্তু চোরকে আর খুঁজে পাওয়া গেল না। তখন থেকে এই
জায়গাটাকে গয়নাতলা বলেও ডাকা হতে লাগল।” আমি একবার বিড়বিড় করে মিলিয়ে
নিলাম, “গয়নাতলার বুড়োশিব, দখিন হাওয়ার পাল/ফোকলা বটের ঝাড়ে ঝাড়ে সুলুক
সন্ধান।”
দাদু আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “ভাবতে থাকো ছোট নাতি। চলো বুদ্ধি খোলার জন্য একটু পেট ভরানো যাক।” দাদা জিজ্ঞেস করলো, “তুমি এই জায়গার সম্বন্ধে এতো কিছু জানলে কিভাবে দাদু।” দাদু হঠাৎ দাঁড়িয়ে পরে দুহাত ওপরের দিকে তুলে চিৎকার করে উঠল, “এ যে আমার জন্মস্থান! আমার গ্রাম!”
ভাত, ডাল, আলুভাজা, মাছের মাথা দিয়ে বাঁধাকপি, চিংড়ি মাছ দিয়ে এঁচোর, পার্শে মাছের ঝাল, চাটনি, মিষ্টি। একটা ছোট্ট ভাতের হোটেলে এরকম এক এলাহী খাওয়া খেয়ে আমাদের মন আনন্দ নিকেতন হয়ে উঠল। প্যাংলাদাদা পেটে হাত বোলাতে বোলাতে বলল, “আহ! কি খাওয়া খেলাম রে সুজু! এমন খাবার খেয়ে লম্বা একটা ঘুম দিতে পারলেই জীবনটা স্বার্থক।” পাগলা দাদু হেসে বলল, “ঘুমোলে আর গুপ্তধন পাবে না। চলো পা চালাই।” আমরা বললাম, “কোথায়?” এমন সময় মনে হলো, দাদা আশেপাশে নেই। খাওয়ার পর হাত ধুতে গেছিল পাশের ঝোপে এখনো তো ফিরল না। দাদাকে খোঁজা শুরু হলো। হোটেলের ত্রিসীমানায় সে নেই। অনেক হেঁকেও সারা পাওয়া গেল না। আমাদের মাথায় হাত। কোথায় গেল! খুঁজতে খুঁজতে চলে এলাম সেই বুড়োশিবতলায়। দেখি দাদা দাঁড়িয়ে আছে একটা বটগাছের নিচে। প্যাংলাদাদা দাদার মাথায় একটা গাঁট্টা দিয়ে বলল, “এই হতভাগা! এখানে হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছিস যে? আমরা সবাই তোকে খুঁজে খুঁজে হয়রান হয়ে গেলাম।” দাদা তেমনি অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে বলল, “এই গাছটা দূর থেকে একটা ফোকলা বুড়োর মতো দেখতে লাগছিল জানিস। দেখ কোটরটা, যেন একটা দাঁত বিহীন বুড়ো দাদু। পান্তা দিদার ধাঁধায় আছে না, ফোকলা বটের ঝাড়ে ঝাড়ে সুলুক সন্ধান।” আমি একবার মনে মনে একটা ছক কষে নিয়ে বলে ফেললাম, “তার মানে এই মন্দিরের দক্ষিণ দিকে এই ফোকলা বটগাছের পূর্ব দিকে আমাদের যেতে হবে। কারণ সূর্য তো পূবদিকেই ওঠে। সেখানে কথামতো থাকতে হবে ধানের ক্ষেত। তাইতো দাদু?” দাদু হেসে বললেন, “বাহ! মাছের মাথা খেয়ে দুই নাতির বুদ্ধি তো বেশ খোলতাই হয়েছে দেখছি। তোর কি খবর রে প্যাংলা?” প্যাংলাদাদা মাথা চুলকে বলে উঠল, “গুপ্তধন ক্ষেতের মধ্যে লুকানো? মাটি খুঁড়তে হবে তাহলে।” সঙ্গে সঙ্গে কাকতলীয় কিনা কে জানে, একটা কাক প্যাংলাদাদার মাথায় ইয়ে করে পালাল। আমরা হাসব না কাঁদব ভেবে পাচ্ছিনা। প্যাংলাদাদা ব্যাজার মুখে একবার আকাশের দিকে আর একবার আমাদের দিকে তাকাতে থাকল। দাদু হেসে বললেন, “পেয়ে গেলি তো তোর উত্তর। এবার চল।” দাদু চললেন আগে আগে, আমরা চললুম পিছু পিছু। প্যাংলাদাদা পথে পরে থাকা শুকনো পাতা দিয়ে নিজের নোংরা মাথা পরিষ্কার করতে করতে কাকটার গুষ্টির তুষ্টি করতে লাগল। বেশ কিছুক্ষণ চলার পর সামনে এলো একটা বিশাল বাড়ী। পাগলা দাদু গটগট করে ঢুকে গেল বাড়িটায়। আমরা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি পরস্পরের দিকে। দাদু পিছন ফিরে বললেন,“কি রে দাঁড়িয়ে আছিস যে?” প্যাঙলাদা বলল, “এটা কি দিদার বাড়ি?” দাদু হেসে বললেন, “না এটা আমাদের জমিদারের বাড়ি। এখন কেউ থাকে না। সূর্য পাটে চলল। আজ রাতটা এখানেই থাকবো।” আমাদের গলা শুকিয়ে এল। রাতের বেলা ভাঙা বাড়িতে থাকব! এটা তো প্ল্যানে ছিল না। তবু উপায়ন্তর না পেয়ে ঢুকে গেলাম। যা থাকে কপালে বলে। দাদু সাফ সুতরা জায়গা দেখে তার থলের ভিতর থেকে একটা চাদর পেতে বসলেন। আমরাও বসলাম তার পাশে। সকলেরই পেট ভর্তি। খাওয়ার তেমন ইচ্ছে নেই। মনে পড়ল দাদুর গল্প টি শেষ হয়নি। আমি বললাম, “দাদু, গল্পটা তো শেষ করলে না। তুমি ওখান থেকে ছাড়া পেলে কিভাবে?” দাদু একটা লম্বা হাই তুলে বললেন, “তা খেয়ে দেয়ে সকলে যখন ঘুমের দেশে পাড়ি দিয়েছে। তখন সেই আদিবাসী ছেলেটি এসে আমার বাঁধন খুলে দিয়ে বলল, “মহারাজ আপনাকে ছেড়ে দিতে বলেছেন। আপনার ব্যাগ পত্র নিন আর পালান।” আমি বললাম, “এই ঘন অন্ধকারে আমি কোথায় যাবো? আমায় যদি কোনো পশু আক্রমণ করে?” ছেলেটি একটু চিন্তিত হয়ে একটি গাছের আড়ালে চলে গেল। আমিও ব্যাগটা বাগিয়ে তার পিছু পিছু চললাম। অন্ধকারে চোখ সয়ে গেছে। দেখলাম ছেলেটি যে জায়গায় এল সেটি একটি গুহা। সে ভেতরে ঢুকে গেল, আমিও নিঃশব্দে চললাম তার পিছু পিছু। বেশ কিছুটা অলিগলি পথ পেরিয়ে দেখলাম একটা জায়গায় আগুন জ্বলছে। সেই আলোয় দেখলাম মহারাজ একটা চৌপায়ার ওপর বসে ধ্যান করছেন। ছেলেটি একটু গলা খাঁকারি দিতে উনি চোখ মেলে তাকালেন। ছেলেটি আমার কথাগুলি বলল। উনি স্মিত হেসে বললেন, “বাঙালি বাবু যখন চলেই এসেছেন তখন দেখাই করে যান।” ছেলেটি অবাক হয়ে পিছন ফিরতেই আমায় দেখতে পেল। আমিও অবাক এত ঘন অন্ধকারে আমায় দেখতে পাওয়া অসম্ভব ভেবেছিলাম। ছেলেটি রেরে করে তেড়ে আসতেই মহারাজ তাকে বাধা দিলেন। তারপর আমায় ডেকে বসালেন আরেকটি চৌকির ওপর।
আমি অপরাধীর মতো বসলাম। বলা বাহুল্য ওঁর সম্পর্কে আমার কৌতূহল দমন করতে পারছিলাম না। উনি বললেন, “বাঙালির মনে অনেক প্রশ্ন। বরাবর তাই। যখন বাংলাদেশে গাছগাছড়া নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট শুরু করলাম তখনও বাঙালি আমায় পাত্তা দিল না। বলল কেমিক্যাল ওষুধের যুগে এসব গাছ পাতার ওষুধ কেউ পাত্তা দেবে না। আমার দীর্ঘ পনের বছরের পরীক্ষা নিরীক্ষা ওরা বিশেষজ্ঞদের সামনে তুলেই ধরল না। আমায় পাগল বলে বের করে দিল ইনস্টিটিউট থেকে। তারপর অনেক ঝড় ঝাপ্টার পর এই জঙ্গলে এসে আশ্রয় নিলাম। এদের পূর্বপুরুষরা তোমার মত করেই আমায় ধরে এনেছিল। সেদিন এক জারোয়া শিকার ধরতে গিয়ে আহত হয়েছিল। এরকম হলে ওদের মধ্যে নিয়ম সেই ব্যক্তিকে এক নিভৃত স্থানে রেখে আসার। কারণ সে ওই ক্ষতেই পচে মারা যাবে এটা ওদের স্থির বিশ্বাস। কিন্তু আমি বাধা দিলাম। আমার ভাষা ওরা বুঝল না বটে কিন্তু একজন আমার হাতের বাঁধন খুলে দিল। আমি ওদের বিশ্বাস অর্জনের জন্যই ওদের একজনকে সাথে নিয়ে আমার চেনা কিছু গাছগাছড়া খুঁজে আনলাম। তারপর তার প্রলেপ বানিয়ে ওই ব্যক্তির হাতে লাগিয়ে দিলাম। পরেরদিন ক্ষত অনেকটা সেরে গেল। ওরা ভাবল আমি হয়তো কোনো ম্যাজিশিয়ান। ওরা আমায় এখানেই রেখে দিল। আমার প্রয়োজনের সব ওরাই এনে দেয়। যে বিজ্ঞানের জন্য আমি আমার সমাজে ব্রাত্য সেই বিজ্ঞান আমায় ব্রাত্য সমাজের রাজা বানিয়ে দিল।" উনি থামলেন। কতটা কষ্ট, লাঞ্ছনা পেলে একটা মানুষ নিজের সব ছেড়ে এভাবে একদল আদিবাসীর সাথে থাকতে রাজী হয়। তারপর বললাম, “ওদের ভাষা কিভাবে রপ্ত করলেন?” উনি বললেন, “ওদের ভাষা হলো জঙ্গলের ভাষা। এই ভাষা শিখলে তুমি যেকোনো পশু পাখির ভাষা শিখে যাবে।” এই বলে তিনি আমায় জারোয়াদের ভাষা শেখাতে শুরু করলেন। সারা রাত আমি ওঁর কাছে সেই ভাষা শিখলাম। এক এক ধরণের শিষ। কোনোটা মিহি সুরের, কোনোটা খাদের, কোনোটা আবার মাঝারি। তাদের এক একেকটার একেক মানে। সে এক আশ্চর্য অভিজ্ঞতা। আশ্চর্য শিক্ষা জীবনের। আমি কোনোদিন ভুলতে পারবো না ওই রাতটা। জীবনের থেকে বড় শিক্ষা হয় না রে। আর কোনো বড় শিক্ষক নেই।
তারপর দিনের আলো ফুটতেই সেই ছেলেটির সাথে আমায় পাঠিয়ে দিলেন সমুদ্রের দিকে। ছেলেটি এমন পথে আমায় নিয়ে এল যে আমি পিছন ফিরে পথ চিনতেই পাড়লাম না। বুঝলাম, পরে এই পথ খুঁজে পাওয়া আমার পক্ষে অসাধ্য। ছেলেটি সমুদ্রের ধরে একটি জেটিতে এনে দাঁড় করালো। তখন একটি জাহাজ ছাড়ছিল। ক্যাপ্টেনের সাথে কথা বলে ছেলেটি আমায় তুলে দিল জাহাজে। ব্যস আবার নিরুদ্দেশে দিলাম পাড়ি।”
গল্প শেষ হলো। অন্ধকারে ভরে গেল চারিদিক। দাদু একটা মোমবাতি জ্বাললেন। ঘুমে আমাদের চোখ ঢুলে আসছে। প্যাঙলাদা চারিদিক বেশ বিজ্ঞের মতো দেখতে লাগল। দেখতে দেখতে সে এ ঘর ও ঘর করতে লাগল। আমি আর দাদা মোটামুটি ঘুমিয়েই পড়েছিলাম দাদুর পাশে শুয়ে। হঠাৎ প্যাঙলাদার চিৎকারে ধড়মড়িয়ে উঠলাম। এদিক ওদিক খুঁজে একটা ঘরে এসে দেখলাম দাদা খাটে বসে হাঁপাচ্ছে। চোখ দুটো বিস্ফারিত। আমাদের দেখে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরল দাদুকে। শত প্রশ্নেও সে উত্তর দেয় না। ওর চোখ অনুসরণ করে দেখলাম দেওয়ালে টাঙানো একটা ছবি। একজন ভদ্রমহিলার। মনে হলো এক জমিদার গিন্নী। আমি সেটির দিকে এগোতেই প্যাঙলাদা আমার হাত চেপে ধরল, “যাস না। ছবিটা নড়ছে।” আমি ওর কথায় গুরুত্ব না দিয়ে হাত ছাড়িয়ে এগিয়ে যেতে যেতে বললাম, “ধূর তুমিও পারো দাদা। ছবি আবার নড়ে নাকি। হাওয়া লেগেছে হয়তো।” কিন্তু মনে মনে একটু যে ভয় পেলাম না তা নয়। কারণ ঘরটায় কোনো জানলা খোলা নেই। হাওয়া ঢোকার পথ নেই। আমি ছবিটার কাছে যেতেই সত্যিই মনে হলো যেন ভেতরের প্রতিকৃতিটা হালকা মাথা নাড়ল। আমি চমকে পিছিয়ে এলাম। সঙ্গে সঙ্গে চারিদিক অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। আমরা দাদুকে জড়িয়ে ধরলাম। সে আমাদের আশ্বস্ত করে বলল, “চুপ কর চুপ কর। আহ বৌদি। বাচ্চাগুলোকে এত ভয় দেখানোর কি আছে বলো তো?” অমনি উত্তর এল,“বাচ্চাগুলো যে এমন মাথা মোটা। বিশেষ করে প্যাঙলা। তা কি আমি জানতাম ঠাকুরপো?” আমরা অবাক এ যে পান্তা দিদার গলা। আমরা চারিদিকে মাথা ঘুরিয়ে বললাম, “ও দিদা। তুমি এখানে? এখানে থাকো?” উনি বললেন, “আমার অনেকদিনের শখ বুঝলি তো সুজু এই জমিদার বাড়ীতে থাকব। দাসী বাদী এসে পা টিপে দিয়ে যাবে। তা যখন ভূত হয়ে কোথাও জায়গা পাচ্ছিলাম না। দেখলাম এ বাড়ী খানা খালি। ব্যস ঢুকে পড়লাম। তবে মাঝে মাঝে তোদের বাড়ী যেতাম বিড়াল সেজে। আর ঐ মুখ্য প্যাঙলা কে ধাঁধার উত্তর দিতে। তা সে এমন গাম্বাট ছেলে আমাকে দেখলেই ভিরমি খেতো। আমি আর কিছু বলার সুযোগই পেতাম না। তার মধ্যে ঠাকুরপো এসে উঠলেন তোদের বাড়ীতে। আমার মনে আশার উদয় হলো। তাহলে এবার আমার সেই গুপ্তধন উদ্ধার হবে।"
দাদা বলল, “কিন্তু দিদা তুমি যে ধাঁধাটা পুরো বলে যাওনি। আমরা বুঝব কিভাবে?”
দিদা চিৎকার করে উঠলেন, “বলবো না। হতভাগা গুলো নিজের মাথার গোবর খরচ কর। আর শোন, আমার গুপ্তধন পেলে ওই জিনিসগুলো এনে এই ঘরে রেখে দিয়ে যাবি। যদি হেলা ছেদ্দা করে ফেলে দিয়েছিস তো দেবো তোদের ঘাড় মটকে।”
দিদার গলা প্রতিধ্বনিত হতে হতে মিলিয়ে গেল। তারপর সব কিছু শান্ত। যেন ঝড় থেমে গেল। ছবিটা আবার স্থির হয়ে গেল। আমরা কাঁপতে কাঁপতে আর প্যাংলাদাকে ধরে ধরে আবার নিজের জায়গায় এসে বসলাম। একে অপরকে জড়িয়ে ধরেই সারারাত কাটিয়ে দিলাম। ঘুম এলেও ঘুমাতে পারলাম না। যদি দিদা চলে আসেন। কিন্তু আমাদের সকলের ভয়ের তোয়াক্কা না করে পাগলা দাদু সারারাত নাক ডেকে ঘুমালো। তার ডাকের চোটে তন্দ্রা এলেও পড়িমরি করে পালাচ্ছিল। আমরা জানলার দিকে তাকিয়ে রইলাম সকালের আশায়। এভাবে হয়তো কোনোদিন সকাল দেখার অপেক্ষা করিনি।
সকাল হতেই আমরা পাগলাদাদুকে টেনে তুললাম ঘুম থেকে। আচমকা এমন আক্রমণে উনি একটু হতভম্ব হয়ে গেলেও পরে বিরক্ত হয়ে বললেন, “ধুর হতচ্ছাড়া। এতো তাড়াতাড়ি উঠে কি করবো?” আমরা তো এদিকে কিছুতেই এবাড়ীতে থাকবো না। তাকে টেনে বের করলাম রাজবাড়ী থেকে। বাইরেই মুখ হাত ধুয়ে, চা খেলাম, টিফিনের ব্যবস্থা এখানেই করতে হবে। তারপর সারাদিন হেঁটেই চলেছি, হেঁটেই চলেছি। মাঝে একটা হোটেলে ভাত খেয়ে বিশ্রাম নিয়ে আবার হাঁটা। পথ যেন আর ফুরাতে চায় না। বিকেল হয়ে এল। সূর্য ঢলতে শুরু করেছে পশ্চিমে। আমাদের আর পা চলছে না। সারাদিন হেঁটেই কেটে গেল। মনে মনে ধাঁধাটা ভেজেই চলেছি। পড়া বলার মতো মুখস্থ হয়ে গেছে। এবার সামনে এলো একটা বিস্তীর্ণ মাঠ। সেই মাঠের চারিদিকে সারি সারি টিলা। এটাকেই হয়তো দিদা পাহাড় বলে উল্লেখ করেছেন। সেই টিলার সামনে বিস্তৃত জায়গা জুড়ে ধানক্ষেত। প্যাংলাদাদা “পেয়েছি” বলে লাফিয়ে উঠল। আমাদের মনেও আশার সঞ্চার হলো। পান্তাদিদা তাহলে মজা করেনি। কিন্তু ধাঁধাটা যে অসম্পূর্ণ। দাদুর দিকে তাকালাম। তিনিও কি সেই কথাই ভাবছেন? আমার কিছু বলার আগেই তিনি বললেন, “ছোট নাতি বলো এবার?” আমি মাথা নেড়ে বললাম, “মাটির প্রাসাদ মানে কি দাদু? প্রাসাদ কি মাটির হয়?” দাদু হেসে বললেন, “যার যেটা বাড়ি সেটাই তো তার প্রাসাদ রে ব্যাটা।” তার মানে এই যে সারি সারি মাটির বাড়ি তার মধ্যে একটা পান্তাদিদার বাড়ি আর সেখানেই আছে তার গুপ্তধন। 'মো' মানে কি মোহর? আমরা তড়িঘড়ি পা চালালাম। কিন্তু পান্তাদিদার বাড়ি কোনটি? আমরা তো কেউ চিনিনা। পাগলা দাদুই বলতে পারে। ধাঁধাটা যতটা সহজ ভাবছিলাম ততটা সহজ নয়। দাদু আমাদের এনে দাঁড় করালেন একটি ভাঙা বাড়ির সামনে। মাটির বাড়ি। তার একদিকের দেওয়াল ভেঙে পরে আছে। খড়ের ছাউনিও উড়ে গেছে ঝড়ে। এরকম আরো অবাক বাড়ি সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে। যেন কোনো এক বিধ্বংসী ঝড়ে ছারখার করে দিয়ে গেছে একটা গোটা গ্রাম।
প্যাংলাদাদা বলল, “এইটা কি দিদার বাড়ি?” দাদু মাথা নাড়লেন, “এককালে এটাও বাড়ি ছিল রে। ওই দূরে যে বাড়িগুলো দেখছিস ওগুলোর মধ্যে একটা বৌদির বাপের বাড়ী। এটা আমার পৈতৃক ভিটে। কিন্তু যেবার মড়ক লাগলো, বৌদির বাড়ির সবাই মারা গেল। আমাদের বাড়িও রক্ষে পেল না। সারা গাঁ উজাড় হয়ে যাওয়ার জোগাড়। সব যখন শুনলাম তখন আমি অনেক দূরে। ততোদিনে সব শেষ হয়ে গেছে। আমার কিছু করার জো নেই। ফিরে আসার টাকাকড়ি নেই। বাড়ি ছাড়ার অনেক জ্বালা রে দাদু! অনেক জ্বালা।” দাদুর কথা শেষ হতে না হতেই কি একটা আওয়াজে তাকিয়ে দেখি প্যাংলাদাদা একটা সরু লাঠি নিয়ে মাটি কোপাতে শুরু করেছে। শক্ত মাটি, রোদে জলে শুকিয়ে ফেটে গেছে। কোপাতে বেশ কষ্ট হচ্ছে। আমরা অবাক হয়ে দেখছি যে ছেলের কাজের নামে জ্বর আসে সে কেমন হাতের আস্তিন গুটিয়ে গুপ্তধন খুঁজছে। দাদু রে রে করে উঠলেন, “করিস কি, করিস কি! ভিতের বাড়ি সব হুড়মুড়িয়ে পরবে যে।" প্যাংলাদা হাত নেড়ে বলল, “কিচ্ছু হবে না দাদু। ভরসা রাখো। আমার স্থির বিশ্বাস দিদা এখানেই তার গুপ্তধন পুঁতে রেখেছে। আরে বাবা গল্পে পড়নি? রাজা মহারাজারা ডাকাতদের হাত থেকে রক্ষা করতে তাদের সম্পত্তি মাটির নীচে, চোরা কুঠুরিতে লুকিয়ে রেখে যেত।” প্যাংলাদা দ্বিগুণ উৎসাহে আবার মাটি কোপাতে শুরু করলো। আমাদেরও নির্দেশ দিল ওকে সাহায্য করতে। আমরা এদিক ওদিক খুঁজেও মাটি কোপানোর কিছু পেয়ে আবার দাদুর পাশে এসে দাঁড়ালাম। দাদুর মুখটা ভীষণ গম্ভীর। দুদিন ধরে তাকে যেমন দেখেছি। তেমন মোটেই না। যেন ভীষণ রেগে গেছেন। যেন এক্ষুনি রাগে ফেটে পড়বেন। হঠাৎ আমাদের তিনজনকে চমকে দিয়ে দাদু চেঁচিয়ে উঠলেন, “থাম, থাম বলছি।” প্যাংলাদা বিস্মিত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। তার হাতের লাঠিটাও এতক্ষণে ভেঙে গেছে। মাটিটা অবশ্য একটু খানি রূপবদল করেছে। দাদু এগিয়ে এসে বললেন, “তোরা কিচ্ছু জানিস না। বৌদি ঠিক বলেছিল। তোদের মাথায় গোবর ভরা।” বলে একটু এদিক ওদিক দেখলেন তারপর নরম সুরে বললেন, “ওরে মেয়েমানুষ বড় যত্ন জানে রে। ওসব মাটি খুঁড়ে নয়, এমন জায়গায় জিনিসটা রাখবে যা চোখেও পড়বে না আবার হাতের কাছেও। সরে আয়, সরে আয়।” প্যাংলাদাদা লাঠি ফেলে সরে এল। তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। দাদু ঘরের চারপাশ দেখে নিয়ে নির্দেশ দিলেন কুলুঙ্গিতে খুঁজতে। আমরা অবাক। কুলুঙ্গি? কুলুঙ্গি আবার কি জিনিস! প্যাংলাদা বলল, “এটা কোন ঘর? কুলুঙ্গি বলে কোনো জায়গা আছে নাকি? বাথ্রুমকে কুলুঙ্গি বলা হত নাকি?” দাদু এই কথায় হোহো করে হেসে উঠে দেওয়ালের একটা খোপে হাত ঢুকিয়ে কিছু ভাঙা মোমবাতি আর লোহার টুকরো বের করে আনলেন। বললেন, “এই জায়গাগুলোকে কুলুঙ্গি বলে। তোরা তো পাকাবাড়িতে থাকিস। এসব বুঝবিও না। চোখে দেখিসও নি। চল চল কাজে লেগে পর।” আমরা সঙ্গে সঙ্গে ছড়িয়ে পড়লাম সারা বাড়িতে। তিনটে ঘর, গোয়াল ঘর, আতুর ঘর, রান্নাঘর সবই খোঁজা হলো কিন্তু গুপ্তধনের সন্ধান কোথাও পাওয়া গেল না। সূর্য তখন অস্তগামী। চারিদিকে অন্ধকারের ছায়া পড়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আঁধার নামবে। তখন তো আর এই ভাঙা মাটির বাড়িতে কিছু খুঁজে পাওয়া মুশকিল। তাছাড়া সাপ খোপের ভয়ও আছে। খুঁজে খুঁজে হয়রান হয়ে হতোদ্যম হয়ে বসে পড়েছি ওই অপরিস্কার মাটিতেই। দূতদিনের পরিশ্রম একদম বৃথা। তারওপর আবার পান্তা দিদার আত্মার শাসানি। জিনিসগুলো না পেলে বাড়ীতে উৎপাতের শেষ থাকবে না। এদিকে বলছেও না যে এই বাড়ী ছাড়ার আগে সে তার গুপ্তধন কোথায় রেখে গেছিলেন। মানুষ নাহয় ভুলে যেতে পারে। ভূত হওয়ার পর তো তার মনে পড়বে সেসব। মাটিতে বসে আছি। আশার প্রদীপ প্রায় নিভু নিভু। হঠাৎ প্যাংলাদাদার মাথায় কোথা থেকে একটা খাগের কলম এসে পরল। ওপরে তাকিয়ে দেখি খোলা চালের একটা খোপে একটা পায়রা ঘোরাঘুরি করছে। প্যাংলাদাদা আমাদের তুলনায় লম্বা, সে সটান লম্বা লম্বা হাত পা ফেলে ওপরে উঠল। আমরা উদ্বিগ্ন হয়ে চেয়ে রইলাম দাদার দিকে। আদৌ কিছু পাওয়া যাবে কিনা কে জানে। প্যাংলাদাদা কিছু একটা নাড়াচাড়া করে চিৎকার করে “পেয়েছি” বলে একলাফে নেমে এলো মাটিতে। ওর হাতে দেখলাম একটা ছোট্ট কাঠের বাক্স। কাছে গিয়ে দেখলাম, বাক্সটার গায়ে ধূলো জমে গেছে পুরু হয়ে। ঢাকনার কাঠের ওপর নক্সা করা। একটা ছোট্ট তালা ঝোলানো বটে তবে তা মরচে পরে কালো হয়ে গেছে। মাথায় ঘুরতে লাগল হাজার চিন্তা। ঢাকনার ওপারে কি আছে? মোহর নাকি অন্য কিছু? কি লুকিয়ে রেখে গেছিল পান্তাদিদা? কোনো গুপ্তধনের নক্সাও হতে পারে। প্যাংলাদাদার চোখ চকচক করছে। সে হাত বাড়িয়ে ধীরে ধীরে ঢাকনাটা খুলতেই আমাদের সব আশা ভস্মের মতো উড়ে গেল। ভেতরে ভর্তি কিছু ছেঁড়া কাগজ, পুরোনো উঁই কাটা বই, একটা খালি দোয়াত আর কিছু খাগের কলম। প্যাংলাদাদা পাংশুটে মুখে বলল, “ এমা! এটা কি?” দাদু কাগজগুলো হাতে নিয়ে একে একে খুলে দেখলেন। তাতে মেয়েলি হস্তাক্ষরে লেখা, ‘আমি পড়ি, আমি লিখি’, ‘বীণা কুমারী’, ‘শক্ত, ভক্ত, রক্ত’, ‘একে চন্দ্র ১’ । উঁই ধরা বইগুলি লক্ষ্মীর পাঁচালী, চাঁদমামার গল্প, ঠাকুমার ঝুলি। আমরা সপ্রশ্ন চোখে তাকালাম দাদুর দিকে। তিনি হেসে বললেন, “শিক্ষা। নারীশিক্ষা। এ এক বিরাট গুপ্তধন প্যাংলা। এক যুগে মেয়েরা পড়াশুনার অধিকারী ছিল না। তাদের নিজের প্রতিভা, নিজের ইচ্ছে লুকিয়ে রেখে বাঁচতে হতো। বাড়ির ছেলেরা দশবার ফেল করলেও তাদের পড়া ছাড়ানো হতো না। এদিকে মেয়েগুলো মেধাবী হলেও তাদের প্রাইমারীর পর আর পড়াশোনার সুযোগ দেওয়া হতো না। বৌদিরও মেধা ছিল কিন্তু সুযোগ ছিল না। বৌদি লুকিয়ে পড়াশুনা করত। তার দাদাদের বই থেকে টুকে টুকে লিখত। আড়াল থেকে পড়া শুনে পড়া মুখস্থ করতো। ওই যে ওই ভাঙা মাটির বাড়িটা ছিল বৌদির বাবার বাড়ি। আমরা সব এক পাড়ার ছেলেমেয়ে। বীণা দিদি, মানে তোদের পান্তা দিদা, এগুলো লুকিয়ে আনত আমার কাছে। আমি বানান শুধরে দিতাম। আর লুকিয়ে রাখতাম আমার ঘরে। তখন আমিও পড়তাম থ্রি ক্লাসে। বীণা দিদিকে পড়া বুঝিয়ে নিজেকে বেশ বিজ্ঞ ভাবতাম। হে হে হে। কিন্তু যেদিন বিয়ের বয়স হলো সব বন্ধ হয়ে গেল। আমার দাদার সাথেই বিয়ের দিন ধার্য হলো। আমি তো বেশ খুশি। বীণা দিদি আমার বৌদি হয়ে আসছে। কতো খেলা হবে, কতো পড়াশুনা শেখাবো দিদিকে। বেশ কিছুদিন চলেওছিল সেইরকম। বৌদি বেশ শার্প ছিলেন। চট করে ধরে ফেলতেন। আমি ইস্কুলের সব পড়া শেখাতাম। আমারও বেশ পড়া হয়ে যেত। কিন্তু নিয়তি। নিয়তি বড় নিষ্ঠুর। সংসারের যাঁতাকলে মেয়েরা শুধুই পেষণ খায়। তাদের বাঁচার সময়টুকু কোথায় যে হারিয়ে যায়। বৌদির কোল জুড়ে খোকা এল, খুকু এল। সংসার বাড়ল। দায়িত্ব বাড়ল। ব্যাস সংসারের যাঁতাকলে বীণা দিদিকে সব স্বপ্ন বিসর্জন দিতে হলো। কত বুদ্ধিমতি ছিলেন দেখছিস! তোদের কেমন ধাঁধা বলে ভুর্কি দিয়ে দিল। হাহাহা... ” আমার গলার কাছে কি যেন আটকে এল। চোখ ঝাপসা হয়ে গেল। সূর্য যাওয়ার আগে তার শেষ রং ছড়িয়ে যাচ্ছেন। কতো কষ্ট পেয়েছে দিদা সারাজীবন। সব স্বপ্ন কেমন ধূলিস্যাৎ হয়ে গেল তার। সমাজ শুধরেছে ঠিকই কিন্তু তার অজ্ঞতায় কতো মেয়ে এরকম অন্ধকারে ডুবে গেছে কে জানে! আমরা যে শিক্ষার সুযোগ পাই সেই সুযোগ অবহেলা করি। আর কয়েক বছর আগে এই সুযোগটুকুর জন্য কতো মানুষ চাতকের মতো চেয়ে ছিলেন।
প্যাংলাদাদা পুকুরপাড়ে দাঁড়িয়ে একা। ওর মনের ভিতর কি চলছে আমি জানি। দাদুর সঙ্গে আমরা গিয়ে দাঁড়ালাম ওর পাশে। দাদু তার কাঁধে হাত দিয়ে বললেন, “কি বড় নাতি, মন খারাপ? গুপ্তধন পাওয়া হলো না, বলো?” প্যাংলাদাদা অস্ফুটে বলল, “শিক্ষাই গুপ্তধন তাই না দাদু?” দাদু মাথা নাড়লেন, “ঠিক বুঝেছিস বাবা। একদম ঠিক।” প্যাংলাদাদা বলল, “বাবাকে একটু বলবে আমায় আবার ইস্কুলে ভর্তি করে দিতে?”
দাদু মাথা নেড়ে হাঁটা লাগালেন। আমরাও চললাম তার পিছু পিছু।
হাতে সেই নক্সা করা কাঠের বাক্স। পান্তা দিদার অমূল্য রত্ন। যার জিনিস তাকে
ফিরিয়ে দিতে হবে যে।
| সমাপ্ত।