ভিন্নস্বাদের গল্প লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
ভিন্নস্বাদের গল্প লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

সৌদামিনীর দারোগা দর্শন - কৌশিক চট্টোপাধ্যায়


 

সৌদামিনীর দারোগা দর্শন 

কৌশিক চট্টোপাধ্যায়

 


  


-আরে অলপ্পেয়ে, ড্যাকরা মিনসে এখানে কিসের দরকার? 

সৌদামিনীর হুঙ্কার শুনে পটলের ল্যাজ থাকলে বোধহয় ল্যাজেগোবরে অবস্থা হত৷৷

-না মানে আমি পটল , পিসী চিনতে পারছোনা?

পটলের আর্তস্বর সৌদামিনীর কানে পৌঁছায় না৷

-ঝাঁটা দেখেছিস? ঝাঁটা…

পটল তো পালাবার পথ খুঁজছে৷

হঠাৎ সৌদামিনীর খেয়াল পড়ল যে চশমাটা চোখে নেই তাই কেমন ঝাপসা লাগছে৷ চেনাও যাচ্ছেনা লোকটাকে৷

-শেফালি, আমার চশমাটা নিয়ে আয় তো...

বৌমা শেফালি, গোয়াল থেকে ছুটে আসে৷

-যাই মা, এ নিন  চশমা৷

সৌদামিনী চশমাটা চোখে গলিয়ে নেন৷বাঁ দিকের চশমার ডাঁটিটা নড়বড় করতে থাকে৷ এবার দরমার বেড়ার ওপারের মিনসেটাকে চিনতে পারেন সৌদামিনী৷

-ও তুই পটল না?

-হ্যাঁ পিসি কখন থেকে বলছি আমি পটল৷

সৌদামিনী পার্টটাইম কালা৷ কখনও শোনেন ভাল কখনও শোনেন না তবে কেউ ফিসফিস করে নিন্দে করলেও সেটা শুনতে পান ৷

ফোকলা দাঁতে কেঠো হাসি হেসে পটলার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন৷

-কী খবর রে পটলা ?কিছু বলবি?

-না মানে বিকেলের দিকে আমাদের বাড়ী যেও ৷মা বলে দিয়েছে৷ 

পটলার মা আশালতা সৌদামিনীর ছোটবেলার সই৷এই শামুকখোল গ্রামেই ভাগ্যচক্রে দুজনেই এসে পড়েছে বিয়ের পরে৷ তবে হ্যাঁ ,পার্থক্য একটা আছে ৷আশালতার বিয়ে হয়েছে বড় ঘরে ৷ সে তুলনায় সৌদামিনীর অবস্থা কিছুই নয়৷ বড় ঘর থেকে একেবারে সাপ লুডোর সাপের মুখে পড়লে যা হয় অনেকটা তাই ৷একেবারে পতন প্রায় পাতাল প্রবেশ বলা চলে৷

-যাবো রে পটল ,বাড়ীতে কিছু আছে না কি?

সৌদামিনীর গলায় এখন শুদ্ধ রে খেলা করছে৷মোলায়েম চিকন সুরে প্রশ্ন করে তাই৷

-মা আজকে চন্ডীখুড়োকে ডেকেছে, নামগান হবে ৷তাই তোমাকে যেতে বলেছে৷

পটলার বাবা অনাদির দুরসম্পর্কের বোন হবার সুবাদে পটলা সৌদামিনীকে পিসি বলেই ডাকে৷ 

পটলা চলে গেলে সৌদামিনী রান্নাঘরে যায়৷ এ গ্রামের সবাই সৌদামিনীকে ভয় পায় ৷ভয় পায় তার বাক্যবাণ আর গালাগালিকে ৷নিন্দুকেরা বলে ঝগড়াতে সৌদামিনীর ব্ল্যাকবেল্ট আছে৷বাড়ীতে কাক চিল বসেনা সে তো ঐ গলার জোরে৷

তাতে সৌদামিনীর ভালই হয়েছে ৷মনের সুখে শীতের রোদে যখন বড়ি দেয়, আচার করে তখন আর কেউ এ বাড়ীর ছায়াও মারায় না৷ পশু পাখী সবাই এড়িয়ে চলে সৌদামিনীকে৷

যতই হক কার মেয়ে দেখতে হবো না !

ডাকাত ধরা মায়ের মেয়ে৷

এ বাড়ীতে পুরুষ মানুষ একজনই সে হল রতন৷ সৌদামিনীর ছেলে৷৷  বহু কষ্টে সব মরে একটা ছেলেই বেঁচে আছে ৷তবে সৌদামিনীর দুঃখ, রতন সৌদামিনীর স্বভাব পায়নি ৷বাপের দিকে গেছে৷ মিনমিনে পুরুষ সৌদামিনী সহ্য করতে পারেনা কিন্তু এমনই কপাল রতনের বাবা তপন দাস নিতান্তই  ভাল মানুষ এবং মুখচোরা৷৷ অন্য ভাইরা বাবাকে ধরে জমির ভাগ নিয়ে নিয়েছে৷ সবার ভাল অবস্থা ৷তপন কিছুই মুখ ফুটে চাইতে পারেনি ৷

নে  এবার! ফলটা দ্যাখ!

একটা কাঁচা বাড়ী , সামনে খোলা উঠোন তাতে তিনটে গাছ রাম শ্যাম যদুর মতই আম জাম আর কাঁঠাল, একটা টিউবওয়েল , টিন এর জরাজীর্ণ ভাঙাচোরা দরজাওয়ালা একটা চানঘর ,পায়খানা ,রান্নাঘর, দুটো ঘর  আর গোয়াল নিয়ে সৌদিমিনীর সংসার৷ 

দু বছর হল রতনের বাবা মারা গেছে৷  নিন্দুকেরা বলে বিধবা সৌদামিনীর এরপর তেজও বেড়েছে মাত্রা দিয়ে৷

রতন দিল্লীতে কাজ করত ৷তারপর দেশে ভয়ঙ্কর রোগ এল ৷রতন তাই আবার ফিরে এসেছে গ্রামে৷শেফালি এ গ্রামেরই মেয়ে ৷বয়স অল্প ৷সৌদামিনী চোখে চোখে রাখে তাই৷ রতন বাড়ীতে থাকে না জমির কাজে বাইরে থাকে৷ উঠতি ছেলেরা দরমার বেড়ার ফাঁক দিয়ে শেফালিকে আড় চোখে দেখে ৷

ঐ পর্যন্তই ৷এর বেশী কিছু করার ক্ষমতা কারুর নেই ৷সৌদামিনীর সতর্ক প্রহরা৷

-শেফালি ,ভোলাকে খেতে দিয়েছ ?

শেফালি ছুটে আসে ৷

-হ্যাঁ মা ৷দিয়েছি খেতে৷

 সৌদামিনী এখন আর গোয়ালে যাবে না৷ সকালে গোয়াল পরিস্কার করার পর  ভোলার দায়িত্ব শেফালির উপর৷

সৌদামিনী ঘ্যাঁটকোল তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে৷ আজকের দুপুরে রান্না করবে৷

সৌদামিনীর মা নিস্তারিনীও সাংঘাতিক তেজী ছিলেন৷ একবার আঁশ বঁটি নিয়ে ডাকাত তাড়িয়েছিলেন৷ হারু ডাকাত ভয়ে তখন আম গাছের উপর উঠে পড়েছে  নীচে নিস্তারিনীর বজ্র নির্ঘোষ শোনা যাচ্ছে সে এক কেলেঙ্কারিয়াস ব্যাপার৷

-আয়, বাপের ব্যাটা হলে নীচে নেমে আয় দেখাচ্ছি তারপর ৷

আসলে নিস্তারিনী শাড়ী পরে গাছে ওঠার চেষ্টা করেছিলেন বটে তবে সফল হননি৷ সফল হলে হারু ডাকাতের কপালে অশেষ দুর্গতি ছিল৷ লখাই আর নিতাই মানে হারুর দুই সঙ্গীর হাতের আঙুল কেটে দিয়েছিলেন নিস্তারিনী৷ ৷

সে কবেকার কথা৷ 

সারা শরীরে রক্ত মাখা, নিস্তারিনী আঁশ বঁটি নিয়ে বনবন করে ঘুরোচ্ছেন , সবাই হাতজোড় করছে ...

মা কালির নতুন  মূর্তি যেন সবাই চোখের সামনে দেখছে

হারু গাছের উপরে ঠকঠক করে কাঁপছে

-মা ঠাকরুন, পায়ে পড়ি ছেড়ে দিন ৷নাক মুলছি, কান মুলছি আর জীবনে ডাকাতি করব না ৷

নীচে নিস্তারিনী রাগে ফোঁসফোঁস করছেন৷ যারা সে দৃশ্য দেখেছিল তারা বলেছিল সেদিন নিস্তারিনীকে সত্যি মা কালি ভর করেছিল৷এবং প্রায় একঘন্টা এই গা ছমছমে নাটক অভিনীত হয়েছিল৷ সেই শীতের নির্জন রাতে গ্রামের সবাই সৌদামিনীদের বাড়ীতে চিৎকার শুনে হাজির হয়েছিল৷হ্যাজাকের আলোয় সবাই দেখেছিল উঠোনে রক্তের মধ্যে লখাই  আর নিতাই অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে৷পাশে তাদের সড়কি৷ ডানহাতের আঙুল কেটে ফেলেছিলেন নিস্তারিনী ৷

বিজন দারোগা, যাকে গ্রামের লোক বাঘের মত ভয় পেত তিনিও নিস্তারিনীর সাহস দেখে অবাক হয়েছিলেন৷ 

সৌদামিনীর মনে আছে বিজন দারোগা তার বাহিনী নিয়ে 

এসেছেন৷

লখাই আর নিতাইকে পুলিশ নিয়ে যাচ্ছে হাসপাতালে৷ 

হারু তো পুলিশ দেখে আনন্দে আত্নহারা হয়ে ৷চিৎকার করছে 

-আমি এখানে ,আমাকে ধরুন... বাঁচান আমাকে ৷না হলে মরে যাবো৷ মা ঠাকরুন মেরে ফেলবে৷…

ইতিহাসে এমন বিরল নজীর খুব কম আছে যখন ডাকাত নিজেই পুলিশ কাস্টডি চায়৷

এ গল্প শেফালিকে বহুবার করেছেন সৌদামিনী ৷তবে দুঃখ একটাই এ বাড়ীতে ঐরকম ভয়ঙ্কর আঁশবঁটি নেই ৷

তাতে পরোয়া নেই সৌদামিনী একটা ধারালো দা সবসময় হাতের  কাছে রাখেন ৷রতনের বাবাকে বলে করিয়ে নিয়েছেন ৷সেটা মাঝে মাঝে বনবন করে ঘুরিয়ে প্র্যাকটিশ করেন৷ অন্ততঃ শেফালি লুকিয়ে দেখেছে৷ তাছাড়া ছানি পড়া ঘোলাটে চোখ এখন না হয় হয়েছে  তা না হলে বছর পাঁচেক আগেও হাতের গুলতি দিয়ে অনেক দূরের নিশানা ভেদ করতে পারতেন৷এখন অবশ্য গুলতি আর হাতে নেন না৷

সৌদামিনীর খুব ইচ্ছে এই ট্রেনিং তিনি শেফালিকে দিয়ে যাবেন৷ কারণ রতনের মধ্যে বারুদ নেই ৷একেবারে মিয়োনো পুরুষ অনেকটা নিজের বাবার মতই৷

-তা মা, তারপর কী হল?

সৌদামিনী বলতে থাকেন৷ 

-বুজলে শেফালি , বিজন দারোগা তো খুব খুশি ৷ এ জীবনে এরকম সাহসী দারোগা খুব কম দেখেছি৷ সব ডাকাতদের ঠান্ডা করে দিয়েছিল৷ হারুর কপাল মন্দ তাই সে রাতে আমাদের বাড়ী ডাকাতি করতে ঢুকেছিল৷ আমার বাবার ছিল মাছের ব্যবসা৷ পুকুর লিজ নেবে বলে টাকা নিয়ে পরের দিন সকালে নীলগঞ্জে যাবে৷ হারুর দল কেমন করে জেনেছিল৷  আমি তখন খুব ছোট ৷ আমরা শুয়ে পড়বো ৷মা রান্নাঘর গুছোচ্ছে৷ বাবা বারান্দায় তামাক খাচ্ছেন ৷এমন সময় মা রান্নাঘরের জানলা দিয়ে দেখতে পেলেন দূরে মশালের আলো৷ 

মা সাহসী ছিল৷ বুঝে গেছেন কী হতে চলেছে ৷

লখাই সিঁদকাঠি দিয়ে মাটির দেওয়াল গর্ত করে ভিতরে ঢুকবে আর সদরের দরজা খুলে দেবে ৷হারু তখন ভিতরে বিনা বাধায় ভিতরে ঢুকে আসবে৷ এই ভাবে ওরা ডাকাতি করত৷গ্রামে শীতের রাতে সবাই তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ে৷


নিঝুম রাত৷ লখাই তো কাজ আরম্ভ করেছে মা চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে আঁশ বঁটি হাতে পাঁচিলের এ পাশে ৷সবে লখাই হাত দুটো ঢুকিয়েছে৷ ব্যাস! মা দিলেন এক কোপ ৷ডানহাতের তিনটে আঙুল আর নেই ৷

লখাই তো একবার আর্তচিৎকার করে মোটামুটি অজ্ঞান৷ মা লখাইকে টেনে নিয়েছেন এপাশে  ৷নিতাই শব্দ শুনে ঢুকতে চেষ্টা করছে৷এবার নিতাই এর পালা৷ নিতাই সড়কি নিয়ে তবুও লড়ার চেষ্টা করেছিল৷ মার রণরঙ্গিনী মূর্তির কাছে খাপ খুলতে পারেনি৷ আঁশবঁটির কোপে হাত থেকে আঙুল সহ সড়কি মাটিতে৷ হারু প্রথমে বুঝতে পারেনি৷ মা নিজেই সদর দরজা খুলে দিয়েছিলেন৷

হারু যেই বাড়ীর ভিতর ঢুকেছে মা চিৎকার করে হারুকে আক্রমন করল ৷হারু দেখে নিয়েছে ততক্ষণে লখাই আর নিতাই রক্ত নদীর মধ্যে পড়ে আছে ৷

হারু অবস্থা বেগতিক দেখে দৌড়াচ্ছে আর পেছনে আঁশবঁটি নিয়ে মা তাড়া করেছেন৷ তারপর হারু আমগাছে উঠে পড়ে৷ মা উঠতে পারেনি ৷শাড়ী পরে মেয়েমানুষের গাছে ওঠা মুশকিল ৷

পরে মা বাবাকে বলেছিল  শাড়ী খুব বাজে জিনিষ ৷বিজন দারোগার  মত প্যান্টালুন থাকলে হারুর দফা রফা করে দিতাম৷

বিজন দারোগার মত দাপুটে লোকও মার সাহস দেখে খুব প্রশংসা করেছিল৷ মা মেডেল পেয়েছিল ৷কাগজে ছবি ছাপা হয়েছিল৷


সৌদামিনী যতবার এ গল্প করেন গর্বে তার বুক ফুলে ওঠে৷ ঘোলাটে চোখ আনন্দে বুঁজে আসে৷ মুখে হাসি খেলা করে৷গর্বের হাসি৷  


বিকেলে সৌদামিনী  তৈরী হচ্ছেন পটলার বাড়ী যাবার জন্য ৷

রতনটা এখনো এল না কেন? তিনটের মধ্যেই তো চলে আসে জমি থেকে কাজ করে৷

যত্তসব৷কোথায় আড্ডা মারছে কে জানে৷ রতন এলে তবে নিশ্চিন্তমনে সৌদামিনী বের হতে পারেন৷ শেফালিকে একা রেখে যাবার সাহস পান না৷দিনকাল খুব বাজে৷ শেফালিরও একটু ছোঁকছোঁক স্বভাব আছে৷

-পিসী ও পিসী …

হঠাৎ কে ডাকছে যেন শুনতে পান সৌদামিনী৷

-শেফালি, কেউ ডাকছে না? 

সৌদামিনী কান খাড়া করে শোনার চেষ্টা করেন ৷

-হ্যাঁ মা বাইরে কেউ ডাকছে 

সৌদামিনী দাওয়া থেকে উঠে পড়েন৷হাতে দা টা নেন৷

-কে ?

-আজ্ঞে আমি কালু, পিসী

-কী দরকার ?

-রতনকে পুলিশ ধরেছে ৷বলছে ও নাকি আর্শাদের খেতের শ্যালো পাম্প চুরি করেছে৷ শিগগিরি পিসী থানায় যাও ৷

কালু হাঁফাতে হাঁফাতে বলে ৷

সৌদামিনী চোখে সর্ষের ফুল দেখেন৷ রতন গোবেচারা ছেলে ৷সে করবে চুরি ? কিন্তু ডাকাতের সাথে লড়াই করা যায় কিন্তু পুলিশের সাথে ? কিভাবে লড়াই করবেন ভাবতে থাকেন সৌদামিনী৷

এমনি ডাকাবুকো হলেও রতন তার একমাত্র দুর্বল জায়গা৷ চারটে সন্তান মারা যাবার পর শিবরাত্রির সলতে বলতে একমাত্র রতন৷

সেই রতনকে পুলিশ ধরে নিয়ে গিয়েছে শুনে সৌদামিনী 

কাঁদতে থাকেন৷ 

চোখের জল আর বাগ মানে না৷ চশমাটা চোখে দিয়ে ঠিক করেন না তাকে থানায় যেতে হবে৷ ৷পুলিশের সাথে কথা বলে একটা ব্যবস্থা করতে হবেই তাকে৷ 

-শেফালি তুই দরজাটা আটকে দে৷ আমি কালুর সাথে যাচ্ছি ৷

শেফালিও কাঁদতে থাকে৷

থানার সামনের পুলিশ গুলো সৌদামিনীকে ঢুকতে দেয়না ৷

সৌদামিনী বারবার বলতে থাকেন

-দে না বাবারা, একটু দেখা করব৷আমার রতন কোনও দোষ করেনি গো ৷ওকে কেন ধরে এনেছে তোমরা…

তারস্বরে চিৎকার করে কাঁদতে থাকেন সৌদামিনী৷

পুলিশগুলো নির্বিকার ৷শুধু খৈনী ডলতে থাকে চেয়ারে বসে৷


 সৌদামিনী নিজেও জানেন না তার কান্নায় ম্যাজিক আছে৷

এদিকে এসপি  ব্যানার্জী সাহেব নীলগঞ্জ থানায় এসেছেন কিছুক্ষণ আগে৷বড়বাবু ঘোষ কোথায় স্যারকে বসাবেন বুঝতে পারেন না৷

-আপনারা সর্ষের তেল দিয়ে ঘুমোন... ডিসগাস্টিং,ওয়ার্থলেস...মিডিয়া বলছে ফরাসডাঙায় গোষ্ঠী সংঘর্ষ হয়েছে সাতজন মারা গেছে…


বড়বাবু মিস্টার ঘোষ ভয়ে ভয়ে মাথা চুলকোন ৷এসপি ব্যানার্জ্জী  ভীষণ কড়া৷

-সরি স্যার ,এক্ষুনি ফোর্স পাঠাচ্ছি ৷

-উঁহু,নিজে যান৷ আমার একঘন্টার মধ্যে রিপোর্ট চাই ৷

বাইরে হঠাৎ তীব্র কান্নার আওয়াজ আর চিৎকারে ব্যানার্জ্জী সাহেব অবাক হন৷ সৌদামিনীর কান্না তখন তীব্র৷

-বাইরে গন্ডগোল কেন? 

বড় বাবু তাড়াতাড়ি বাইরে যান জানতে 

-স্যার, একটা বুড়ী দেখা করতে চাইছে ৷ওর ছেলে লকআপে ৷বুড়ী  কাঁদছে আর বলছে ছেলে নির্দোষ৷

ঘোষবাবু কাঁচুমাচু মুখে বলেন৷

-পাঠান তো আমার কাছে ৷কী বলছে দেখি?

সৌদামিনী এসেই সোজা ব্যানার্জ্জী সাহেবের পায়ের উপর পড়ে৷

-আরে !আরে !কী হয়েছে?ছাড়ুন পা ছাড়ুন..

-বাবা, আমার রতনকে ধরে এনেছে বিনা কারণে আজ জমি থেকে...৷

-কী কেস ঘোষবাবু? 

-স্যার ,শ্যালো পাম্প চুরি হয়েছিল আর্শাদের জমিতে সেখানেই  রতনকে দেখে মেজবাবু তুলে এনেছে ৷মানে ..

ঘোষ সাহেব তোতলাতে থাকেন সাহেবের সামনে৷

-প্রমাণ আছে ?কেউ দেখেছে চুরি করতে?

-না ৷মানে ..

ব্যানার্জী সাহেব বুঝে যান৷

এ অত্যাচার গ্রামে অহরহ হয়৷যদুর বদলে মধু ,গোঁজামিল দেওয়া অঙ্ক৷ মাথা গোনার অঙ্ক ৷চোর খুঁজে না পেলে অন্য একজনকে ঢুকিয়ে দেওয়া৷

-ছেড়ে দিন এক্ষুনি ৷ওয়ার্থলেস৷আসল চোর, ডাকাত ধরুন৷কাজে দেবে৷

বুড়ী অবাক হয়ে দেখে ,কনস্টেবলরা লকআপ থেকে রতনকে বার করে৷ বড়বাবুও এসপির চিৎকারে কেঁপে ওঠেন৷

জলভরা চোখে সৌদামিনী এগিয়ে আসে ব্যানার্জ্জী সাহেবের দিকে

-কিছু বলবে?

সৌদামিনী শুধু হাত তুলে বলে

-আশীর্বাদ করি খুব উন্নতি হোক৷তুমি দারোগা হও৷ 

এস পি ব্যানার্জী সাহেব হতবাক হয়ে থাকেন৷ দারোগা পদের সম্মান  আর মাহাত্ম্যকথা তার বোধগম্য হয় না৷


সৌদামিনী রতনকে নিয়ে হাঁটতে থাকে বাড়ীর দিকে৷ 

এতদিনে বিজন দারোগার যথার্থ  উত্তরসূরী দেখেছে সৌদামিনী ৷বাপরে !কি দাপট৷ এক কথাতেই রতনকে খালাশ করে দিল থানার বড়বাবু৷

ছানি পরা ঘোলাটে চোখে  সৌদামিনী হাসতে থাকেন আপন মনেই৷


...........................

অলঙ্করণ :-  পায়েল খান 

 


 


নতুন বৌঠান - ত্রিদিবকুমার চট্টোপাধ্যায়

নতুন বৌঠান
ত্রিদিবকুমার চট্টোপাধ্যায়

 


 

 


 


হ্যালো। হ্যাঁ রে, কেমন আছিস?
ক্ - কে? আপনাকে...
বলছি, সব ঠিকঠাক তো?
হ্যাঁ... কিন্তু...
এই তো!  এর মধ্যেই ভুলে যাচ্ছিস? গুড গুড! গলাটাও চিনতে পারছিস না দেখছি।
আরে কে? কে?  ...  এই নাম্বারটা...
হ্যাঁ, এটা অন্য নাম্বার। যদি না ধরিস। তোর এখন যা --
কী এখন? ধরব না কেন? এবার কিন্তু ভালো লাগছে না, কেটে দেব। টু মাচ।
ভালো তো লাগবেই না, যা করলি আমার সঙ্গে! আয়াম রিয়্যালি শকড।... আমি কপোতাক্ষ। এখন কি তোর...
ক-পো! ও মাই গুডনেস! থাম থাম। সত্যি রে কপো, সারাক্ষণ তোর শুধু ড্রামা... কী হয়েছেটা কী?
কী করেছি আমি?
কিছু করিসনি? এতবড় খবরটা আমায় অন্যের মুখ থেকে শুনতে হল। সো এমব্যারাসিং।  আমি তো ধরেই নিয়েছি, তোর আর আমার কথা শেষ।
ধ্যেৎ! কী হাবিজাবি বকছিস বল তো!...  হিঃ হিঃ, বুঝেছি, বুঝেছি। আমার বিয়ের খবর। হ্যাঁ রে, আজ বিকেলে ফাইনাল হয়ে গেল। কোত্থেকে খবরটা পেলি রে কপো?
সেটা বড় কথা নয়। কিন্তু এটা কি ঠিক হল শুক্লা?
কোনটা?  বিয়ে? তুই কি পাগল হয়ে গেছিস কপো?  আমি বিয়ে করতে রাজি হয়েছি,  বাড়ি থেকে ছেলে দেখছিল, আজ পাকা হয়ে গেল। এর মধ্যে ঠিক-বেঠিকের কী আছে ?
ঠিক- বেঠিক নয়?  আমাদের সাত বচ্ছরের রিলেশন এক ফুঁয়ে নিভিয়ে দিলি?
নিভিয়ে দিলাম? কী ভাট বকছিস? ইউ আর অলওয়েস মাই বেস্ট ফ্রেন্ড।
ফ্রেন্ড!  হাঃ, কী কথা! এমনি নয় --- আবার বে-স্ট ফ্রে-ন্ড!  
হ্যাঁ, অবশ্যই বেস্ট ফ্রেন্ড। তুই আমার কাছে তাই ছিলি, আছিস, থাকবি।

তাই?...  শুক্লা, আমরা কি শুধুই ফ্রেন্ড?  ব্যস?  সাত বছর ধরে যেখানে তুই, সেখানে আমি। তোর জন্যে আমি বর্ধমান থেকে উজিয়ে নৈহাটি এসেছি, তারপর একসাথে কলকাতায় চক্কর কেটেছি, সিনেমা থেকে বইমেলা, কলেজ স্ট্রিট, ক্রিকেট সব আমরা একসাথে। সাত বছর ধরে আমাদের মধ্যে শুধু কি ফ্রেন্ডশিপই ছিল?
অবশ্যই ছিল। কেন, ছেলে আর মেয়ের মধ্যে কি পিওর ফ্রেন্ডশিপ হতে পারে না?
কেন পারে না?  একশো বার পারে, হাজার বার পারে। কিন্তু তোর চোখের চাউনি, তোর বডি ল্যাঙ্গুয়েজ কি সেকথা বলত? দিনের পর দিন আমরা গা ঘেঁষাঘেঁষি করে হেঁটে গেছি, বৃষ্টির দিনে তোর লেডিস ছাতার তলায় লেপ্টে থেকেছি, ঠাণ্ডায় কেঁপেছি, কত কত এতোল বেতোল বকে গেছি, দুজন দুজনের মুখের দিকে হাঁ করে ঘন্টার পর ঘন্টা চেয়ে থেকেছি... এসব কি সত্যি নয়?  
হ্যাঁ সত্যি,  সো হোয়াট? যদি তুই আর আমি এক জেন্ডার হতাম, তখন কী বলতিস? গে বা লেসবিয়ান? যদি তুই আমার দাদা বা ভাই হতিস, তখন কী মানে হতো?  বন্ধুত্ব নয়? তুই -- তুই--
কপো, তোর মেন্টালিটি দেখে আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি।
সে তো আমিও। যদি সত্যিই তুই আমাকে তোর বেস্ট ফ্রেন্ড মনে করিস, তার মর্যাদাও কি দিয়েছিস? তোর একটুও রিপেন্টেন্স হচ্ছে না?  
কেন?  রিপেন্টেন্স হবে কেন?  
বাঃ রে শুক্লা, বাঃ! নাম্বার ওয়ান,  তুই যে ফাইনালি বিয়ে করতে রাজি, সেটা বাড়ির লোকজন জেনে গেল, বেস্ট ফ্রেন্ড জানবে না,  বল? এমনকী, তোর পাকা দেখা হয়ে ডেট ফিক্সড হয়ে গেল, তারপর পাঁচ ঘন্টা কেটেও গেল, তার পরেও তোর মুখ থেকে আমি জানব না? বাঃ রে শুক্লা, এটাই তোর বেস্ট ফ্রেন্ডশিপের নমুনা !
উঁ...
কী উঁ?  চুপ করে আছিস কেন?  বল, জবাব দে।
কপো...  ভাই কপো...  আই অ্যাম সরি কপো। সত্যিই আমার অন্যায় হয়েছে রে। আসলে...  আসলে বিয়ের এক্সাইটমেন্টে আমার সব গুলিয়ে গেছে। প্লিস, আমাকে মাপ করে দে।
দ্যুৎ,  পাগলি কোথাকার!  বন্ধু আবার মাপ চায় নাকি। জানিস শুক্লা,  আমি এতদিনে নিশ্চিন্ত হলাম।
নিশ্চিন্ত?  কেন? কপো, আর হেঁয়ালি করিস না রে ভাই। আমি ভুল করেছি, স্বীকার করছি। প্লিস,
কী বলতে চাস, একটু সোজা বাংলায় বল।
সোজা বাংলাতেই তো বলছি রে শুক্লা। আমি বলতে চাইছি,  আজ আমার মাথা থেকে একটা বিরাটবোঝা নেমে গেছে। আমি সত্যিই খুব রিলিভড ফিল করছি। ক'বছর ধরে তুই আমার সঙ্গে যে লেভেলে বিহেভ করেছিস, যেরকম ইন্টিমেটলি মিশেছিস, আমার ওপর সব ব্যাপারে ডিপেন্ড করেছিস, আমি বারবার ভেবেছি, শুক্লা আমায় অন্য চোখে দেখছে না তো!  জিগ্যেস করতে সাহস পাইনি, তুইও কিছু বলিসনি। দুশ্চিন্তায় কাঁটা হয়ে থেকেছি। কারণ, বিশ্বাস কর, আমি তোকে একফোঁটাও গার্লফ্রেন্ড ভাবিনি। তারপর আজকের খবরটা হঠাৎ অন্য সোর্স থেকে পেয়ে আরও ঘাবড়ে গেলাম। তোকে প্রপোজ করিনি বলে তুই কি আমার ওপর রেগে গেলি? অভিমান করে হঠাৎ ডিসিশন নিলি? তাহলে কি আমাদের এতদিনের রিলেশনটা কাট্টি হয়ে গেল? সেইজন্যেই জানালি না?
কপো, তুই সত্যিই একটা পাগল! সো সুইট! লাভ ইউ।
যাগ্যে, এবার বল দেখি, কেমন দেখলি তোর হবু বরকে?  হ্যান্ডু তো?
হ্যাঁ রে, ঠিকঠাক। অন্তত আমার ভালোই লেগেছে। সবচেয়ে ভালো লাগল ওর চোখদুটো। তুই তো জানিস,  আমার চোখের উপর স্পেশাল ফ্যাসিনেশন আছে।
তা আর জানি না!  উরিব্বাস -- তোর চক্ষু রিলেটেড কতরকম টার্ম আছে! গরুর চোখ, বাজপাখির চোখ, শকুনের চোখ, শিয়ালের চোখ, লোভী হায়েনার চোখ, নেকড়ের চোখ... তা সোনা, তোমার বর বাবাজি কোন ক্যাটেগরিতে পড়ছে?
হিঃ হিঃ হিঃ,  তুই একটা রামবিচ্ছু, যাকে বলে হাড়জ্বালানো পাজি। তুই নির্ঘাত আওয়াজ দিবি, তবু বলতে বাধ্য হচ্ছি,  ওগুলোর কোনটাই নয়। বুঝলি, আমার বরের চোখদুটো  সমুদ্রের মতো, গভীর,  অতল।
আহা রে, মরে যাই, মরে যাই। তুই তো দেখছি এক সিটিংএই ফিদা। সেই লোকটা খুব  লাকি। তা তিনি থাকেন কোথায়, মানে তার বাড়ি?
বাড়ি না রে, ফ্ল্যাট। বিটি রোড, সোদপুর মোড়। কী যেন নাম কমপ্লেক্সটার।
সোদপুর?  আর ইউ সিওর?
সিওর!  রবীন্দ্রভারতীতে পড়ায়, বেলঘরিয়া ক্যাম্পাস।
বেশ, বেশ। তার বাবা মা?  সবাই কি ওখানেই থাকেন?  
বাবা মা?  এই রে, তুই তো মুশকিলে ফেললি। বাবা মা কে দেখলাম, একটা ভাইও আছে, শুনলাম।
কিন্তু তারা ঠিক কোথায় থাকে, জানা হয়নি। একমিনিট ধর, মা জানে, জিগ্যেস করে বলছি।
দরকার নেই। আমি জানি।
কী!  তুই -- তুই ওকে চিনিস?  
অবশ্যই। তোর বুদ্ধিশুদ্ধি আছে বলে ভাবতাম, তুই যে এতটা গাধা, সরি গাধি, ভাবতে পারিনি রে।
আমারই ব্যর্থতা।
অ্যাই -- অ্যাই -- তুই কিন্তু লিমিট ছাড়িয়ে যাচ্ছিস কপো।
না ছাড়িয়ে উপায় কী বল! তোর হবু বরের নাম শুনতে চাস?  বলব?...  হাঃ হাঃ হাঃ --- শ্রীল শ্রীযুক্ত শ্রীমান কমলাক্ষ ভট্টাচার্য। ঠিক বলেছি তো?...কী রে, চুপ করে গেলি যে? ফিউজ উড়ে গেল? বাবা মা কোথায় থাকেন? শুনে রাখ-- নৈহাটি। কী রে, এবার কিছু বুঝলি?.... ছি ছি,  এতখানি ক্লু দেওয়া সত্ত্বেও পারলি না!  সত্যিই তুই গরুর চোখবিশিষ্ট।
নৈহাটি?  
আজ্ঞে হ্যাঁ। আর কমলাক্ষর একমাত্র কনিষ্ঠ ভ্রাতার নাম হল কপোতাক্ষ।
সত্যি? ওয়াও!  কী মজা, উঃ -- আমার যে কী আনন্দ হচ্ছে... আমি সত্যিই বুদ্ধু...  তুই -- তুই আমার একমাত্র...
ইয়েস, ওয়ান অ্যান্ড অনলি দেবর। তোমার আদরের ঠাকুরপো। তবে আমি তোমায় ছাড়ছি না ম্যাডাম! এবার শুরু হবে আমাদের নতুন এপিসোড।
নতুন এপিসোড!
অবশ্যই।...যেথা আমি যাই নাকো তুমি প্রকাশিত থাকো / আকুল নয়নজলে ঢালো গো কিরণধারা...
আরে, আরে ! কী হল তোর ?
ইয়েস!  তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা... নতুন করে পাব তোমায়...  আমি রবি আর তুই নতুন বৌঠান... তারপর...  হুঁ হুঁ... কুঞ্জবনে, ইয়ে মানে বাগানে...  সেদিন দুজনে দুলেছিনু বনে... হাঃ হাঃ!
অ্যাই চুপ, চুপ... বিচ্ছু মর্কট উল্লুক...  তোকে আমি কামড়ে খিমচে... শেষ করে দেব।

...............................

অলঙ্করণ :-  প্রিয়াঙ্কা সরকার


 

শিকার মহল - সোমা কাজী


শিকার মহল
সোমা কাজী 
 

 
 

রৌনক যখন মুরারই স্টেশনে পা দিল তখন সবে ভোরের আলো ফুটছে। ওরা তিনজন, রৌনক, ওর সাংবাদিক বন্ধু সায়ন আর ক্যামেরা ম্যান অংকুর। সুদূর কানাডা থেকে  তিনমাসের ছুটিতে ভারতে এসেছে রৌনক, ইতিহাসের তরুণ অধ্যাপক। অনেক ছোটবেলায় বাবার সঙ্গে এখানে এসেছিল সে। মাস তিনেক ছিল। তখন থেকেই সায়নের সঙ্গে বন্ধুত্ব। কানাডায় থাকলেও বন্ধুত্ব অটুট এখনো। 
একটা টোটো নিয়ে তিনজনে চলল বাঁশলৈ গ্রামের দিকে। একদিকে গাছপালা ঢাকা মোরামের রাস্তা আর অন্যদিকে  ঝিরিঝিরি  সুরবতীকে পাশে নিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা পৌঁছে গেল 'শিকার-মহল'। 
চারপাশে লোকালয় অথচ সামান্য দূরেই ঝোপঝাড়ে ঢাকা একটা খন্ডহর... চোখ দুটো জ্বালা করে উঠলো রৌনকের। 
ক্যামেরাম্যান একটা চাদর বিছিয়ে দিল সামনের ঘাসজমিতে। একসময় হয়তো সবুজ কার্পেটের মতো ছিল, এখন বয়স্ক পুরুষের সপ্তাহ খানেক না কামানো দাড়ির মতো চারদিক বুনো গাছের খোঁচায় জর্জরিত! ব্যাকপ্যাক নামিয়ে সায়ন শুকনো খাবার বের করল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে রৌনক  আলুর পরোটার একটা টুকরো মুখে ফেলল। খুব খিদে পেয়ে গেছিল সকলের। 
       হাতে ফোল্ডিং স্টিক নিয়ে সামনে দু'জন, পিছনে ক্যামেরাম্যান অংকুর। লাঠি ঠুকতে  ঠুকতে রৌনক বলল,  
 -চারপাশ ভালো করে দেখতে দেখতে হাঁটো। সাপ তো বটেই বুনো জানোয়ারও যে দুটো একটা থাকবে না কে বলতে পারে?              
আলিশান প্রাসাদ না হলেও যথেষ্ট বড় বাড়ি। শ্যাওলা- ছোপ জরাজীর্ণ পাঁচিলে ঘেরা। এই কারণেই দূর থেকে কেবল ভগ্নদশা গ্রস্ত দোতলাটাই নজরে পড়ে। চাতাল থেকে আট-দশটা ধাপ উঠলে সার সার ঘর। দুপাশ দিয়ে ছাদে ওঠার সিঁড়ি। দরজার আর্চের মাথায় ভারী সুন্দর লতাপাতার নকশা।   
 -দরজা নেই একটাও ঘরে! সায়নের কথায় রৌনক জবাব দিল 
 -চোর-ছ্যাঁচড়ের কাজ আর কি! 
একমনে ছবি তুলছিল অংকুর। বলল   
-এ বাড়ির গল্পটা তো জানা হ'ল না এখনো!  -আগে তো চারদিক ঘুরে দেখি! 
বলতে  বলতে মজে যাওয়া একটা  ফুটিফাটা পুকুরের দিকে এগিয়ে চলল রৌনক। বেশ বড়সড় ছিল একসময়। ভাঙা ঘাটের ফাটলে অজস্র রং- বাহারি ল্যান্টানা ক্যামেরা ফুলের ঝাড়। দক্ষিণমুখী একটা জীর্ণ মন্দির।দেবী হংসেশ্বরী একসময় বিরাজ করতেন মন্দিরে। শোনা যায় কোন তিনি নাকি রুষ্ট হয়ে অদৃশ্য হয়ে যান! 
  লেন্সে কভার পরাতে পরাতে অংকুর বলল,
  - চা খাওয়া যাক, কি বলো? 
 ঘাটের একদম উপরের ধাপে বসল তিনজন । ফ্লাস্ক থেকে চা ঢেলে এগিয়ে দিয়ে রৌনক শুরু করলো 
   - দিল্লিতে ফিরোজ শাহ তুঘলক শাসন করছেন।  আমাদের পুরনো বাংলা তখনও স্বাধীন। যদিও জীবন যাপনে সুলতানি প্রভাব কিছুটা হলেও ছিল। 
সায়ন বলল, 
-তাই  ইসলামিক আর্কিটেকচারের টাচ? 
 - একদম ঠিক। মাঝে কতগুলো বছর পেরিয়ে গেল...রৌনক বিড়বিড় করছিল। 
চায়ের কাপে আয়েশ করে একটা চুমুক দিয়ে অংকুর বলল 
-তুমি এতকিছু জানলে কি করে?  
- জানতে হয় হে চিত্রগ্রাহক! ব'লে কথায় ফিরল রৌনক,
-বাঁশলৈ থেকে একশো কিলোমিটারের মধ্যে পাকুড়। সেখানকার রাজাদের একটা অংশ চ'লে আসে মহেশপুর ব'লে একটা জায়গায়। এখান থেকে কুড়ি কিলোমিটার প্রায়। খুব সম্ভব শরিকি বিবাদ। ওখানেই তারা বসবাস করতে থাকে। আশপাশে সব সরল আদিবাসী। তাদের কাছ থেকে এরা জলের দরে জমি কিনে নিজেদের এলাকা  বাড়াতে থাকে। এখন মহেশপুরের রাজবাড়িও প্রায় ভেঙে পড়েছে। 
দীর্ঘশ্বাস চেপে আবার শুরু করলো রৌনক,
 -এই রাজবাড়িতে থাকতেন রাজা দীপ্রকর, রাজমহিষী ও তাঁর পরিবার। তখন চারদিকে ঘন জঙ্গল। জঙ্গলে অজস্র পশুপাখি। রাজার ছিল শিকারের শখ। একবার শিকারের জন্য তিনি এই বাঁশলৈয়ের কাছাকাছি জায়গায় এসে পথ হারিয়ে ফেলেন।এই যে পোড়ো বাড়ি, এরই কাছাকাছি কোন জায়গায় একটা ছোট্ট মেয়ের সঙ্গে দেখা হয়ে যায় তাঁর। 
-দারুণ ইন্টারেস্টিং তো! সায়ন সাগ্রহে তাকাল রৌনকের দিকে। 
 চায়ের খালি কাপটা ঝোপের ভেতর ছুঁড়ে দিয়ে রৌনক বলল, 
-শুনেছি মেয়েটির বাবা নাকি রাজাকে সেই রাতে আশ্রয় দিয়েছিল তাদের বাড়িতে। আতিথেয়তায় খুশি হয়ে রাজা গলার হার উপহার দেন মেয়েটিকে। আর এখানে বানিয়ে ফেলেন এই 'শিকার-মহল', মাঝে মাঝে শিকারে আসবেন বলে। 
 - বলো কি? 
অংকুর ক্যামেরা ব্যাগে চালান করে দিয়ে চোখ বড়ো বড়ো করল দেখে রৌনক বলল,   
- বোঝোই তো, রাজারাজড়াদের কারবার...
              -আরে থেমে গেলে কেন? সায়নের কথায় হঠাৎ যেন জেগে উঠলো রৌনক। 
- রাজার পরের সব প্রজন্মের কারো বিশেষ মাথাব্যথা ছিল না এই বাড়ি নিয়ে। কারণ  শিকার করার সখ টখ তাদের ছিলনা বললেই চলে! আস্তে আস্তে এক এক করে মহলের গা থেকে দরজা জানালা খুলে নিতে নিতে একেবারে নিঃস্ব করে দিল চোরের দল। শেষে ঝোপঝাড়ে মুখ ঢেকে প'ড়ে রইল বেচারা দুয়োরাণী হয়ে! 
মুঘলদের সরিয়ে বৃটিশ শাসন চালু হ'ল ভারতে। মহেশপুরের শেষ রাজা ছিলেন চরম লম্পট।এক মালো মহিলাকে বিয়ের কথা দিয়ে তিনি সহবাস  করেন। সে গর্ভবতী হয়ে পড়ে বিয়ের কথা বললে তাকে রাজা পুরোপুরি অস্বীকার করেন। সেই তখন থেকে মালো জাতের সঙ্গে  রাজাদের চরম শত্রুতা।              -মালো মানে জাতির নিরিখে নীচু... তাই না? অংকুরের প্রশ্নে মাথা নেড়ে সহমত জানাল রৌনক।             
মাথার উপর সূর্য প্রায় উঠে পড়েছে। বেশ গরম লাগছে দেখে ওরা ঘাট ছেড়ে মূল বাড়িটার দিকে রওনা দিল। ডানপাশের যে সিঁড়িটা ছাদে উঠে গেছে, তার গোড়ায় মস্ত একটা জারুল গাছ। এত অনাদরেও বেগুনি ফুলে ছেয়ে আছে। হয়তো এখনো এ বাড়ির প্রতি মমতায় ভরে আছে তার শরীর! ছায়ায় বসে লাঞ্চ সারলো ওরা। ভেতরে ভেতরে অস্থির হয়ে উঠছিল রৌনক কিন্তু বাকিদের অনুরোধ ঠেলতে না পেরে ফের পোড়ো বাড়ির গল্পকথা শুরু করল,   
- অন্যান্য অনেক রাজাদের মতো বৃটিশরা মহেশপুরের রাজাদের সম্পত্তিও দখল ক'রে একটা মাসোহারার ব্যবস্থা করে দেয়। তাতেই তাদের  চলতে থাকে। এদিকে সেই মালো মেয়েটি একটি  ছেলের জন্ম দেয়। কপাল দ্যাখো, রাজার ঘরে যার থাকার কথা সে থাকে দরমার ঘরে। শৈশব কৈশোর ছাড়িয়ে সে যুবক হয়ে উঠলো ক্রমে ক্রমে। শরীর আর মনে তার অসম শক্তি। হঠাৎ ঘটলো ঘটনাটা। একরাত্রে সবাই যখন  ঘুমিয়ে পড়েছে তখন সেই মালো যুবক সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে  আচমকা  রাজবাড়ি আক্রমণ ক'রে রাজা,  তাঁর দুই ছেলে তাদের দুই স্ত্রীকে মেরে ফেলে। তার এবং মায়ের প্রতি অবহেলা সে সইতে পারেনি মনে হয়। রানী ছেলেটার পায়ে প'ড়ে দুই নাতির প্রাণ ভিক্ষা চায়। যুবকটির দয়া হয়। কিন্তু তাঁদের ঠাঁই হয় জংগলের আড়ালে থাকা 'শিকার মহলে'। সঙ্গে আসে দরকারি জিনিস পত্র আর কয়েকজন চাকর-বাকর। 
           - এ যে ইতিহাসের পাতা ওলটাচ্ছি! সায়নের গলায় রীতিমতো মুগ্ধতা।       রৌনক বলল,
- বেলা পড়ার আগেই বেরোতে হবে কিন্তু! এখন চটপট শেষ করি। তা, রাজবাড়ির পাহারাদার কিছু কুকুরও এলো রানীর সঙ্গে। বড়ো নাতি তখন বছর দশেক। বাইরে থেকে খাবার দাবারের যোগাড় করে দেয় চাকরেরা। পরে একজন বাদে বাকি সকলে কেটে পড়ে। দুটো ছাড়া বাকি কুকুরগুলোও অযত্নে মারা যায় একে একে। কুকুরের ভয়ে কোনো বাইরের লোক ঘেঁষত না। বাড়িটার কথা বাইরের লোকে ভুলেই গেল প্রায়।
বড় নাতিটি পরে পালিয়ে গিয়ে হাজির হয় মামাবাড়িতে। কারণ এখানে তার দম বন্ধ হয়ে আসত নাকি! পিতৃমাতৃহীন ছেলেটাকে মামা উপযুক্ত করে মানুষ করেছিলেন।পরে সে সেখান থেকে পড়াশোনা ক'রে বিদেশে পাড়ি জমায়। একটু দম নিল রৌনক। 
 -আমাদের দেশে  বৃটিশ শাসন শেষ হ'ল কিন্তু রানী অনেক চেষ্টা করেও মহেশপুরের রাজবাড়ির দখল ফিরে পেলেন না। বড়ো অভিমানে তিনি  আংটির হীরে খেয়ে আত্মহত্যা করলেন। বড় নাতি এতদিন বিদেশ থেকে টাকা পাঠাতো, তাতেই চলতো রানী আর ছোট নাতির। রানীর মৃত্যুর পর দেশে ফিরে শেষকাজ সেরে আবার ফিরে যায় বড়ো নাতি। ছোট ভাই  তার থেকে যায় এখানেই। পাসপোর্ট ভিসার ব্যবস্থা করা হলেও ঠাকুমা কিংবা ভাই যেতে চায়নি তার কাছে। ২০১৫ সালে ছোট ভাইও মারা যায় বলে শুনেছি। রৌনক উঠে দাঁড়ালো, 
 -চলো এবার ভেতরে ঢোকা যাক। 
রৌনক সামনে, পিছনে দু'জন। ঘরে বিরাট একটা টেবিলে চিনেমাটির ডাইনিং -সেট। একটা কাপ গড়াগড়ি খাচ্ছে টেবিলে। বহু দিনের হলেও লেগে থাকা চায়ের  চিহ্ন বোঝা যাচ্ছে।  এককোণে মেঝেয় তেলচিটে একরাশ চাদর বালিশ... ধুলোর পুরু স্তর  সবকিছুতে। কানেকশান কাটা ফ্রীজ, ঝাড়বাতি। মেঝের এককোণে মরচে পড়া স্টোভ আর কিছু হাঁড়িকুড়ি। সুখী জীবনে অভ্যস্ত রানী শেষজীবনে হয়তো নিজেই কোনমতে দুটো পেটের জন্য রান্না করতেন! এছাড়া আসবাব বলতে তেমন কিছুই নেই। বাইরের লোক ভাবতেই পারবেনা এমন দীনহীন ভাবে রাজ পরিবারের মানুষ কাটাতে পারে! কোনমতে বেরিয়ে আসা চোখের জল গিলে ফেলল রৌনক। সাংবাদিক সায়নের নির্দেশ মতো অংকুর ছবি তুলতে ব্যস্ত। উল্টো দিকে বালিশের নীচে গোঁজা বিবর্ণ হলদে হয়ে যাওয়া কিছু কাগজপত্র নজরে পড়ল রৌনকের। হাতে নিয়ে  দেখল কয়েকটা খাম। খামের গায়ে বিদেশি স্ট্যাম্প। ভেতরে চিঠি রয়েছে বোঝা যাচ্ছে। খামের ওপর ঠিকানা লেখা হস্তাক্ষর রৌনকের খুব পরিচিত!  আর রয়েছে পোকায় কাটা পুরনো পাসপোর্ট - ভিসা। দুজনের নজর এড়িয়ে চটপট ব্যাগে সেসব ঢুকিয়ে নিল রৌনক।
                বাড়িটা সরকারি অধিগ্রহণ হবে বলে শুনেছে রৌনক। তবে এ ব্যাপারে কোনোভাবেই কোন সাংবাদিকের মুখোমুখি হতে চায়না সে। এখানেই মুছে যাক সব পরিচয়। অবশিষ্ট চিহ্নগুলোও কি ভাসিয়ে দেবে সুরবতীর জলে! ভাবপ্রবণ হয়ে যাচ্ছে কেন সে! ইতিহাস গরিমাময় হয়না সবসময়। অন্ধকারের ইতিহাস খুঁড়লে কেবল ধূলোয় ধূসরিত হবে তার হাত! একটা মানুষের লালসার আগুনে ছারখার হয়ে গেছে কতগুলো মানুষ! তাও বিনা দোষে। রৌনক বা তার ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কি কখনও নিজের প্রকৃত পরিচয় দিতে পারবে দেশের মানুষের কাছে! সুদূর কোন্ অবিমৃষ্যকারী পূর্ব পুরুষের কৃতকর্মের  লজ্জা আজ এতকাল পরেও বুকটা বড় ভারী করে দিচ্ছে  তার!
             সমস্ত বাড়ি ঘুরে যখন সবাই বেরলো, বিকেল শেষ হব হব করছে। একদৃষ্টে রৌনক কিছুক্ষণ বাড়িটার দিকে তাকিয়ে থাকল। তারপর  দূর থেকে  মন্দিরের দিকে ফিরে প্রণাম জানিয়ে মনে মনে বলল,
 -আমাদের কাছে তোমার অধিষ্ঠাত্রী  যত্নেই আছেন। তাঁর অমর্যাদা হবে না আমি বেঁচে থাকতে!
 
.........................
 
অলঙ্করণ :- সহিষ্ণু কুড়ি
 

 

গল্পবাজ - বিদিশা মুখার্জি


গল্পবাজ
বিদিশা মুখার্জি
 

 
 

ডাঃ সুদীপ জানার সাথে আমার বন্ধুত্বটা ঠিক তখন থেকে শুরু, যখন প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে গেলেও বন্ধু লাগে। তাতে প্রকৃতি ডাকলো কিনা ম‍্যাটার করে না,সৌহার্দ্যতাটাই আসল । তখনও সে ব‍্যাটা ঠিক সুদীপ বলে পাত্তা পেত না। কখনও 'দীপু' আবার কখনও রাগ হলে 'দীপে' বা কখনও 'গল্পবাজ' বলেই বন্ধুদের কাছে পরিচিত ছিলো। তার উপর রাগ আমাদের প্রায়ই হতো  ; কারণ বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলায় তার জুড়ি মেলা ভার ছিলো। আমি তো নিশ্চিত ছিলাম ও ব‍্যাটা একদিন নামকরা সাহিত্যিক হবে। 
যখন জয়েন্টে ভালো র‍্যাঙ্ক করে মেডিকেল কলেজে ভর্তি হলো আমরা ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম জয়েন্টের খাতায় কি গল্প লিখেছিলি রে ,যে তোর এত ভালো র‍্যাঙ্ক হয়েছে?

     শুনে 'হো-হো'-করে হেসে বলেছিলো, সে গল্প বলা বারণ আছে। না'হলে তোরা জানলে তোদের র‍্যাঙ্ক আমার থেকেও ভালো হতো। শুনে এত রাগ হয়েছিল, বলেছিলাম,

'দ‍্যাখ দীপে, তোর অনেক চ‍্যাংড়ামি এতদিন ধরে সহ‍্য করছি, তাবলে এক্সাম নিয়ে ফক্করি সহ‍্য করব না।' শুনে এমন দাঁতের দোকান খুলেছিল যে রাগে ব্রহ্মতালু জ্বলে গিয়েছিল। 

            আসলে কি জানেন,  সব সময় পাশাপাশি থাকা বন্ধুদের মধ‍্যে কেউ যদি হঠাৎ করে ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যায়, তখন মুখে গুণগান গাইলেও মনে মনে বড় জ্বলন হয় ।  এটা ঠিক হিংসে নয়, বন্ধুকে হারাবার এক প্রবল ভয়। সমকক্ষ হয়ে না উঠতে  পারলে যে আর সেই দোস্তি থাকবে না তা যেন মন অবলীলায় বুঝতে পারে।
 নিজের হীনমন্যতা মানুষকে মানুষের থেকে দূরে সরিয়ে দেয় ধীরে ধীরে। এভাবেই নষ্ট হয়ে যায় কত ভালো-ভালো বন্ধুত্ব।  আমিও ,'দীপু' অথবা রাগে বা আদরে ডাকা 'দীপে'-কে হারিয়ে ফেলার  ভয়ে যতবেশি পেতে লাগলাম ততই ওর থেকে দূরে- দূরে থাকা শুরু করলাম। ইংলিশ অনার্স নিয়ে ভর্তি হলাম স্থানীয় কলেজে। ছুটিতে যখন দীপু বাড়ি আসত কয়েকঘন্টা আড্ডা দিতে চলে আসত আমাদের সঙ্গে। চিরকালের গুলবাজ দীপু কলকাতার যেসব ঘটনা বর্ণনা করত, শুনতে শুনতে আমরাও তার স্বভাব ভুলে যেতাম। আমরা মফঃস্বলের ছেলে, কলেজে উঠলেও তেমন লিয়াকত আলি খাঁ হবার সুযোগ পাইনি তখনও। বন্ধুদের সঙ্গে বসে সিগারেট খাচ্ছি হয়তো, দূরে বাবা আসছেন দেখেই সবাই সিগারেট গুলো পায়ের তলায় ফেলে মুখের সামনে উড়ে যাওয়া মাছি তাড়াতে ব‍্যস্ত হ‍য়ে পড়তাম ঠিকই , কিন্তু  মাটিতে ফেলে দেওয়া মহার্ঘ্য বস্তুটির জন্য প্রাণ ফেটে যেত। তখন আমাদের হাতে এত পয়সাও থাকত না যে হরদম সিগারেট কিনবো। তিনজনে মিলে হয়ত একটা সিগারেট ভাগ করে খেতাম। এ হেন আদরের বস্তু,যার কিনা স্থান আমাদের ঠোঁটে তাকে পায়ে মাড়িয়ে ফেলা যে কত বেদনাদায়ক তা শুধু ভুক্তভোগীরায় জানে। 

   একদিন বিকেলে আমরা গল্প করছি পাড়ার মোড়ের বিপুলদার চায়ের দোকানে। এখন এটাই আমাদের 'কফিহাউস' । আমরা সাতবন্ধু সেই ছোটবেলা থেকেই বিপুলদার দোকানের খদ্দের। দোকানটার একদিকটা মুদিখানা আর একটা দিকে চা-জলখাবারের দোকান। বৌদি আর বিপুলদা মিলে প্রচণ্ড পরিশ্রম করে এই দোকানের পিছনে। আমরা এলে বৌদি দুটো চা-কে সাতভাগ করে দেয়। আর বিপুলদা দুটো সিগারেট বের করে বলে, ছোটোতে তোরা চকলেট নিতি কিন্তু গোটা একটা করে। যত বড় হচ্ছিস  তত বন্ধুত্ব গাঢ় হচ্ছে। সব ভাগাভাগি করে খেতে শিখছিস, চিন্তায় আছি চাকরিবাকরি বিয়েশাদি নিয়ে। এতটুকু বলে একটা চোখ বন্ধ করে খ‍্যা-খ‍্যা করে হাসে। আমরাও বেশ মজা পায়। সেদিন দীপু আমাদের সঙ্গে থাকায়- চা-সিগারেটের ভাগীদার বাড়ল,  বা বলা ভালো প্রত‍্যেকের ভাগের পরিমাণ কমলো। তবু সেই চন্নামিত‍্যটুকু গলায় ঢেলেয় আমরা গপ্পে মশগুল হয়ে পড়লাম। একটু পরে দুটো সিগারেট দিলো বিপুলদা সঙ্গে সেই একচোখের ফিঁচেল হাসি। আমরাও হাসতে হাসতে সিগারেট ধরিয়ে চারজন করে একটা সিগারেটে একফুঁক মাত্র দিয়েছি এমনসময় সামনের মোড় ঘুরে আমাদের সঙ্গে থাকা এক বন্ধুর বাবাকে বিপুলদার দোকানের দিকে আসতে দেখেই সিগারেট ফেলে তার উপর পা-চেপে দাঁড়িয়ে হাতনেড়ে বিশ্বের যত মশা-মাছিকে হাত দিয়ে উড়িয়ে দিতে তৎপর হলুম। কাকু এসে বিপুলদার কাছে মুদিখানার জিনিস নিয়ে আমাদের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে চলে গেলেন। তখনকার  দিনে বাবারাও এইভাবেই ছেলের বড় - হয়ে ওঠাকে মর্যাদা দিতেন।এখনকার মত মাইডিয়ারি ভাব দেখিয়ে আদিখ্যেতা করে সন্তানের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতেন না। 'ছেলে বড় হয়েছে'-এই মর্যাদাটুকু উদাসীনতার বর্ম দিয়ে ঢেকে দিতেন। 

     কাকু চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা দুঃখি মুখে বেঞ্চে বসে পড়লাম।এমনসময় দীপে বলে উঠলো,
"কলকাতায় এমন হয় না"।
সবাই উৎসুকমুখে তাকিয়ে বললাম, 

"কি রকম রে?"

"এই যে বাবাকে দেখলেই দামি সিগারেট কেউ ফেলে দেয় না।"

"বলিস কি ! বাবার সামনেই সবাই সিগারেট খায়"?

" কেউ কেউ তাও খায় বইকি। তবে সবাই অতটা বাড়াবাড়ি না করলেও খানিকটা আড়াল করে রাখে। বাবা অন‍্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে চলে যান, যেন ছেলেকে দেখেননি।"

" এত্ত সাহস! বাবার সম্মান নাই?"

" এতে অসম্মানের কি আছে?খাবার জিনিস খেয়েছে।"

আমরা হাঁ - করে দীপুর দিকে চেয়ে রইলাম । একদিকে যুক্তিবাদী মন বলছে , 'ঠিকই তো, সবাই খায় যখন তাতে দোষ কোথায়!' 
অন‍্যদিকে সহবত শিক্ষায় শিক্ষিত মন বলছে - 
' বড়দের সামনে যে-কোনো রকম নেশা করাটা অন‍্যায়।'

হঠাৎ বিপুলদা বলে উঠলো, 
"এই যে ছেলেরা ,তোদের সহবতের পুরস্কার স্বরূপ আমি দুটো সিগারেট তোদেরকে আজ খাওয়াচ্ছি। তোরা যেটা করিস সেটাই সঠিক ভাই"।
আমরা এই কৃতিত্বের মূল্য হাতে পেয়ে ভীষণ খুশি হয়ে উঠলাম।
 
 (২)

পরেরদিন আবার আমরা আটজন বসে গল্প করছি বিপুলদার দোকানে, সামনে দিয়ে পাড়ার পুঁটি দোকানে এলো। আমরা সবাই ছোটো থেকেই পুঁটিকে চিনি,কিন্তু আজকাল যেন কেমন অন‍্য দোলা মনের মধ‍্যে অনুভব করছি পুঁটিকে দেখলে। এত মিষ্টি একটা মেয়েকে পুঁটি বলে ডাকতে আমার মোটেও মন চাইছে না। পুঁটি কিন্তু আমার দিকে ফিরেও চাইলো না,আড়চোখে একবার দীপের দিকে তাকিয়ে সওদা নিয়ে চলে গেলো।ব‍্যাকগ্ৰাউন্ডে বিপুলদার গান শুনলাম-
"রাধেএএ, মনটাকে দিয়ে এলি বল্ কোন্ মথুরায়......"
বুকের ভিতরটা মোচড় দিলো আমার। বন্ধুদের দু'একজনের মুখের দিকে তাকিয়েও দেখলাম মুখের নক্সা আমারই মত। বেশ একটা তৃপ্তি পেলাম , তাহলে আমি একা  ছ‍্যাঁকা খাওয়া রোমিও নই,দলে লোকজন বেশ ক'জন আছে। বয়েসখানা এমন যে ছ‍্যাঁকা খাওয়ার সঙ্গী পেলেও তখন মন ভরপুর আনন্দ পায়।

          তারপর  গরমের ছুটি শেষ হয়ে গেলো,দীপু কলকাতায় চলে গেছে আমরাও নিজেদের কলেজ,আড্ডা নিয়ে বেশ সময় কাটাচ্ছি। সেদিন ছিলো রাখীপূর্ণিমা, দূরে দেখি পুঁটি আসছে বিপুলদার দোকানের দিকে। প্রায়ই আসে তাই বিশেষ কিছু মনে হয়নি প্রথমে কিন্তু হঠাৎ এসে আমার হাতটা ধরে রাখী পড়িয়ে বললো,"তোমার বোন নেই তো কি হয়েছে অপুদা, আমি কি তোমার বোনের মত নই? এর জন্যে তুমি আত্মহত্যা করতে যাচ্ছিলে? এখন থেকে প্রতি রাখীতে আর ভাইফোঁটায় আমি তোমাকে দাদার মত রাখী পরাবো আর ভাইফোঁটা দেবো।"
আমার দূর্দশা তখন কহতব‍্য নয়। এক তো বোন নেই বলে কোনোদিনই আমি তার অভাব বোধ করিনি,আত্মহত‍্যা তো স্বপ্নের অগোচরে। তার উপর আবার পুঁটি আমার সেই বোন হতে চাইছে,দুঃখে জলেডুবে মরতে ইচ্ছা হচ্ছিলো তখন। কিন্তু আমার এ সর্বনাশ কোন্ হারামজাদা করলো না জেনে মরাটা কোনো কাজের কথা নয়। পুঁটি আমার হতভম্ব মুখ দেখে বললো, "দীপুদা আমাকে চিঠিতে তোমার এই দুঃখ  সম্পর্কে লিখেছে । তোমার নামেও একটা চিঠি দিয়েছে আমাদের ঠিকানায়। তোমার ঠিকানায় কেনো দেয়নি জানতে চাইলাম কাল ফোনে, বললো, "বোনের হাতে বন্ধুর চিঠি পেলে নাকি তোমার বোন পাওয়ার আনন্দ দ্বিগুণ হবে। তবে আমাকে তোমাকে লেখা চিঠিটা পড়তে বারবার মানা করে দিয়েছে।"

"এই নাও" -বলে চিঠিটা দিয়ে পুঁটি চলে গেলো। 

আমি চিঠিটা খুলে দেখলাম, লেখা ছিলো-

"প্রহর শেষের আলোয় রাঙা সেদিন চৈত্রমাস/তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ। 
তাই রাখী পরিয়ে বাঁধ দিলাম।"

পিছনে রাখু আমাদের সপ্তরথীর এক রথী বলে উঠলো,"story depends on who is telling it......"
 .........................................
 
অলঙ্করণ :- সহিষ্ণু কুড়ি
 

 

কৈতব - সৌমী আচার্য্য

কৈতব
সৌমী আচার্য্য

 


 


ঘাড় গুঁজে পড়ে রয়েছি নীল সন্ধ‍্যের ভেতর।কিছুতেই দিশা পাই না আমি ঠিক কোন অক্ষরের পিছু পিছু হাঁটতে হাঁটতে এই অজ পাড়াগাঁয়ে এসে বসেছি।দোরে দোরে শঙ্খ বাজে টিমটিম করে।আলো জ্বলে প্রদীপের। আমি কেবল জড়োসড়ো হয়ে একা দাঁড়িয়ে থাকি।কোন দিক যাব দিশা পাই না।ধোঁয়া ওঠা পথ একা বোকার মতো শুয়ে থাকে।ওর গা থেকে মন খারাপের হাবিজাবি গন্ধ উঠে আমায় আরো বেকুব করে দেয়।নিশানাথ যেদিন আমার সব পাণ্ডুলিপি নিয়ে চলে গেল,বলেছিলো,চুকলিবাজি করে কার কার জীবনের গোপন কথা লিখেছিস পড়ে দেখি।তবে তো ছাপার প্রশ্ন।আমি পাণ্ডুলিপি চেপে ধরি।আমার গল্প ফেরৎ দে।ছাপতে হবে না।জোর করে কেড়ে নিয়ে খ‍্যাঁখ‍্যাঁ করে হাসলো।

-আমার থেকে কেড়ে নিবি?কি করে?মনে রাখিস অনন্ত এই পাশা খেলায় আমিই শকুনি আমিই যুধিষ্ঠির।জিতবো আমি হারাবো আমি আবার শেষেও জিতবো আমি।

সেই থেকে ভয় পেয়ে কুঁকড়ে আছি।আমার বৌ লতিকা ভারি মিষ্টি মেয়ে।ওর বুকের খাঁজে মৌরিফুল গন্ধ কিন্তু আমায় দেখলেই চটে যায়।আর বড্ড মাতব্বরী করে এই যা দোষ।

-এমন ভিজে ন‍্যাতানো লোক কেন তুমি?তোমার গল্প ছেপে কোন লোকে টাকা কামায়?তার নাম তো বলো?তুমি ভিখারীর মতো ছুঁড়ে দেওয়া পয়সা কুড়িয়ে নিয়ে কবরে আলো জ্বালবে আর কতদিন?তাহলে লিখো না অনন্ত,লিখো না।এই করে ব‍্যবসাটা পর্যন্ত লাটে উঠতে বসেছে।তোমার এই উত্তর না দেওয়াটা সহ‍্য হয় না।

ওর কথায় উত্তর দিতে পারিনা।কোনদিন পারিনি।কি করে বোঝাবো আমি সত‍্যি জানিনা নিশানাথ কোথায় থাকে।কাগজে গল্প বেরোলে বুঝি আমার পাণ্ডুলিপি বেচে দিয়েছে।আমাকে হতাশ দেখে প্রথম প্রথম লতিকা কষ্ট পেত।এখন রাগে গরগর করে।পালিয়ে যাই বাড়ি থেকে।বাসস্ট‍্যাণ্ডে গিয়ে বসি।হুশহুশ করে সময় বয়ে নিয়ে যায় ব‍্যস্ত অফিস ফেরৎ ক্লান্ত মানুষ,গায়ে গায়ে লেগে থাকা জড়িবুটি যুবক যুবতী,লোকের বাড়ি কাজ সেরে ফেরা অতসীর মা সবাইকে।অন্ধকার ফুঁড়ে হঠাৎ লিকলিকে ছোড়া এগিয়ে আসে,কি কাকু এমন অন্ধকার নিয়ে বসে আছেন কেন?কোথায় যাবেন?ওর বলার ধরণে তীব্র গন্ধ।চারিদিক কালো করে আসে।যত বলি আআআআআমায় ছাড়োওওও।তত কনুই চেপে বলে,কি নেশা করো বাপ এমন ডুবে রয়েছো?আমি কোনদিন কোন নেশা করিনি এই তীব্র হাহাকার নিয়ে নিজেকে গুঁজে দিই চলন্ত বাসে।হৈহৈ কনডাক্টারের কর্কশ স্বরের পেছন পেছন কে যেন বলে,বুড়ো কালে যত হিরোগিরি।সব উৎকট মন্তব‍্যের অশ্লীলতা নিয়ে ঝুপ করে নেমে পড়ি অন্ধকারে।বাসের লাল চোখ অন্ধকারে মিলিয়ে যেতেই ঝিঁঝিঁ ডাকে বেধড়ক।এটা বোধহয় পৃথিবীর শেষ প্রান্ত।আর একটু এগোলেই মুক্তি।নিশানাথ আর আমার শব্দ অপহরণ করতে পারবে না।আমি যেভাবেই হোক একটা শক্ত খুঁটি পেলেই উঠে দাঁড়াব আবার।লতিকা বিয়ের রাতে শক্ত খুঁটি হতে চেয়েছিল।চোখ বড় করে বলেছিল,তুমি লেখক?তুমি লেখ?এই  লোহা লস্করের মধ‍্যে থেকে লেখার সময় পাও?আমায় পড়িও পড়বো।কিন্তু কোনদিন শোনেনি কেবল রাগ আর শাসন।

অন্ধকার চলে আমার আগে আমি ঘাড় গুঁজে তার পিছনে,অন্ধকার চলে আমার পিছনে আমি ভয়ে ঘাড় গুঁজে তার আগে।ট্রুইইই ট্রুট্রু জানান দেয় পাখি।মৌবনী পাখির নাম জানতো।মামাবাড়ি গেলেই ওর সাথে ঘুরতাম।সব পাখি চেনাত আর আমি ভুলে যেতাম।রেগে উঠতো,অনন্ত তুই একটা ম‍্যাদামারা ছেলে।চোখ মরা,বুদ্ধি মরা।তুই থেকেও নেই।এক মেঘলা দিনে মামা বাড়ি থেকে নিজের বাড়ি যাবো বলে বেরিয়েছি,মৌবনী রাস্তা থেকে টেনে নিয়ে গেল ওর সাথে।ওর জোরের কাছে আমি সব সময় অসহায়।মরালীর তীর ঘেঁষে জঙ্গলে টানটান শুয়ে ফিসফিস করে বললো,ঐটা শামুকখোল আর ঐ যে মোটাহাঁটু।

-ধুর মোটাহাঁটু কোন পাখির নাম হয়?

ঠোঁটের উপর আঙুল এসে পড়লো সাথে মৃদু শাসন,চুপ!কথা বললে উড়ে যায়।ঐ দেখ মাণিকজোড়,সরালি।

মৌবনীর গলা পিছলে আমার চোখ ভরাট বুকে স্হির।বুকের ভেতর ঝড়।বাইরে দিনের আলোতে কালি ঢেলে দিল মেঘ।ঠোঁটের নরম হাতছানি বিভ্রমে ফেলেছিল আমার গোপন লজ্জাকে।হঠাৎ কাদায় পা ধরে টেনে নিল মৌবনীকে।ছেলেগুলো আমার গলায় দা রেখে এক হ‍্যাঁচকায় প‍্যান্ট খুলে গাছে ঝুলিয়ে দিল। আমার বাড়ি ফেরার ব‍্যাগটাকেও গাছের নীচে ছুঁড়ে দিল।আর মৌবনীকে উপড়ে নিল জামা কাপড়ের ভেতর থেকে।আমার চোখের সামনে উফ্!তুলতুলে কাদামাটিতে কি অপূর্ব দক্ষতায় বীজ বুনছিল ওরা।চিৎকার করে মৌবনী আমায় গাল দিতে শুরু করলো,থুথু ছিটিয়ে দিল মুখে।আমি ঘাড় গুঁজে পড়ে থাকলাম কাপুরুষের মতো।কি উপভোগ‍্য সেই মৈথুন দৃশ‍্য।ইচ্ছাই জাগেনি ওকে বাঁচাই।ছেলেগুলো ওকে কাদায় অজ্ঞান করে ফেলে রেখে আমায় শাসিয়ে তাড়িয়ে দিল।ভয়ে ঘাড় গুঁজে ট্রেন ধরে পালিয়ে এলাম সোজা বাড়ি।মনে মনে দৃশ‍্যটা বারবার দেখেছি সারাজীবন।কতবার লতিকাকে তেমন ভাবেই... কিন্তু প্রতিবার হেরে গিয়েছি।হয়তো উন্মুক্ত প্রকৃতিতে কাছে এলে তেমন আশ্চর্য কিছু হতো।লতিকা আমায় দেখলে রেগে ওঠে,কাপুরুষ,ইতর বলে দুচ্ছাই করে।আচ্ছা ছেলেগুলো যদি লতিকাকে ভোগ করে মৌবনীর মতো ও কি খুব খুশি হবে।ছেলেগুলো কোথায় থাকে জানলে নিমন্ত্রণ পাঠাতাম।আমি দূর থেকে আবার নয় দেখতাম।

রাস্তাটা প্রায় বন্ধ হয়ে এসেছে ঝোপ জঙ্গলে।বর্ষার সোহাগের চিহ্নসর্বত্র।ভিজে মাটি আর মন খারাপ করা ভয় আমার শিরদাঁড়া কাঁপিয়ে দিচ্ছে।চোর বলে পিটিয়ে মেরে ফেললে নিজেকে বড় বেকুব মনে হবে।সামনের বাড়িটায় ঢুকবো কি ঢুকবো না ভাবতে ভাবতে এগিয়ে আসি আরো অনেক পথ।একটা বাওড় চোখে আসে।বড় করে আগুন জ্বলছে।মন বলে এমন কটূ গন্ধ নিয়ে চড়বড় করে নিজেকে জানান দেয় যে সে কেবল শ্মশান।বড় বড় কথা বলতো জ‍্যেঠা।এইখানেই নাকি শান্তি।শান্তি!কিসের শান্তি?মরলে আবার শান্তি কি?আর মরলেই যদি শান্তি তবে আমার বিধবা মাকে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করতে নকল দলিল বানিয়েছিল কেন?

পুরো দুনিয়াটাই জোচ্চোর।আমার হাবাগোবা মা ঐ স‍্যাঁতস‍্যাঁতে বাড়ির রান্নাঘরে চিরকাল নির্বাসিত ছিল।কতবার দেখেছি সকলের পাতে মাছ। আমার আর মায়ের পাতে কেবল ডালের জল পেঁপে সিদ্ধ।ডালের জল আলগোছে জ‍্যেঠিমা আগেই আলাদা করে তুলে রাখতো।মা আর আমি রান্নাঘরে খেতাম ওরা বারান্দায়।এই দুখি দুখি চিত্র আমি ঘষে ঘষে তুলে দিয়েছিলাম।যেদিন জ‍্যেঠু গলায় দড়ি দিয়ে মরলো তারপর থেকে শুধু ঘষে গেছি।নিরাপদ মামা অবশ‍্য ভরসা দিয়েছিলেন কোর্টে কেস করার জন‍্য কিন্তু দরকার হয়নি।জ‍্যেঠিমার মাথার অসুখ বাড়তে বাড়তে আকাশ ছুঁয়ে নিতেই বৃষ্টি হয়ে ঝরে গেল মায়ের সব কান্না।জ‍্যেঠু বেশি বয়েসে বিয়ে করেছিলো তাই ছোট ভাই বোন গুলোকে মা পরম যত্নে আঁচলে তুলে নিল।আমি সবার জন‍্য মাছ আনতাম।জ‍্যেঠিমাকে পাগল গারদে দেবার মতো শয়তানি আমার মাথায় কোনদিন আসেনি।তবে জ‍্যেঠিমা যেখানে সেখানে চলে যেত।হাওয়ায় ঢিল ছুঁড়তো আর চিৎকার করতো,খা খা আমাকে খা।শেষে বাধ‍্য হয়ে ঘরে বাঁধলাম।ওষুধ খাইয়ে মুখ মুছিয়ে দিলে ফ‍্যালফ‍্যাল করে তাকাতো।কৃতজ্ঞতা না বিস্ময় কে জানে?মুখ নামিয়ে উঠে আসলেই মুক্তি।বড় শান্তি যুতসই সংসারের ওমে।শ্মশানে কিসের শান্তি?সব পোড়া,সব।দাউদাউ আগুণ জ্বলছে।জ্বলছে জীবন,জ্বলছে সাধ,স্বপ্ন,আশা আকাঙ্খা।আহ্!এখানে গুটিয়ে থাকি বরং।আশেপাশে ছায়া ভীড় করে আসে।যতবার যতদূরে চলে যাই স্মৃতি পেরিয়ে।ছায়া আসে ভীড় করে।হাত বাড়িয়ে ডাকে প্রেতের মতো।আমি অক্ষর লিখি জীবন জুড়ে।

মৌবনী আমার দিকে আঙুল দেখায়,ও করেছে সব,ওর গুটিয়ে যাওয়া মুখ দেখে করুণা করবেন না।ও শয়তান,জীবন্ত শয়তান।আমি ঘাড় গুঁজে বলে গেছি আমিইইইই কিছু করিনি সত‍্যি বলছি।বলতে পারিনি আমি শুধু দুচোখ ভরে দেখেছি।লাজুক,সরল,বোকা ঘাড় গোঁজা অনন্ত সরকারকে মেয়েটা কেন দোষারোপ করছে কেউ বুঝে উঠতে পারেনি।মাটি দাপিয়ে মাথা খুঁড়েছে মেয়েটা আমি মামাদের হাত চেপে ধরে থরথর কেঁপেছি।জন্মে ইস্তক করুণা প্রার্থী আমি।এমন ভয় পেয়ে ছিলাম বলার নয়।ঘটনার দিন আমি বাড়ি ফিরে গিয়েছিলাম আর উড়নচণ্ডী মৌবনীর ধর্ষণ কাণ্ডে একাধিক প্রেমিকের উপস্থিতি বড় হয়ে উঠেছিল।একথা প্রমাণ হতে দেরি হয়নি।মৌবনী আর কোনদিন পাখি চেনায়নি আমায়।

মাঝেমাঝে জ‍্যেঠু একই ভাবে সরে আসে পাশে।কানের লতিতে শ্বাস ফেলে,আমি তো তোদের মেরে ফেলিনি,তুই আমায় মারলি কেন?ধুতরার বিজ খাইয়ে আমার বৌটাকে পাগল করে দিলি?অনাথ করে দিলি ছেলেমেয়ে গুলো কে।থতমত খেয়ে যাই।এরা আমায় দোষ দেয় কেন?আমি তো ঘাড় গুঁজে চলা সরীসৃপ।কেবল মাথার ভিতর লকলক করে আগুন খাণ্ডব পেলেই পোড়ানোর ছুঁতে খোঁজে।কাছে ঘেঁষে আসে লতিকা।

-কি দেখতে চেয়েছিলে অনন্ত!জীবন্ত শরীর পুড়লে কেমন গন্ধ ভাসে?আমার শুধু এটুকুই দোষ যে আমি তোমায় ডাক্তার দেখাতে বলেছিলাম।তুমি কোনদিন এক অক্ষর লেখোনি অথচ কাগজের অফিসে গিয়ে রোজ রোজ ঝামেলা করেছো যে তোমার পাণ্ডুলিপি চুরি করে লেখকরা গল্প লেখেন।কাদের কল্পনা করে নাও তোমার আশেপাশে?যারা কেউ নেই বাস্তবে।আমি তো ছিলাম অনন্ত।তোমার সব পাগলামো মেনে নিয়ে।কতবার,কতবার আমায় জন্তুর মতো ভোগ করেছো যেন  তুমি একাই চার পাঁচজনের প্রতিচ্ছবি।বারবার বার বার।তবু ধুয়ে মুছে যত্নে নিয়েছি বুকে।কি হত ডাক্তার দেখালে?আর কি হতো আমায় বাঁচতে দিলে?

-তুমিই তো একমাত্র সব জানতে।তাই তো কৌশল‍্যা মাসী এসে ভ‍্যানভ‍্যান করতে শুরু করলো,ওকে মেরে ফেল অনন্ত,এতদিনের লোকানো পাপ সবাইকে জানিয়ে দেবে।মনের ডাক্তার তোর সব পাপ জেনে যাবে।মেরে ফেল মেরে ফেল।আমিও অধৈর্য হয়ে আগুন জ্বেলে দিলাম।মায়া হচ্ছিল খুব মায়া কিন্তু পারলাম না।

লতিকা বোকা,বোকার হদ্দ আমি নাকি কিছু লিখিনি।কিচ্ছু লিখিনি আমি?সেই ছোট থেকে একের পর এক লিখেই চলেছি,তবু বলে আমি লিখিনি?আজ আবার একটা উপন‍্যাস শুরু হবে হয়তো এইখানে।যত্ন করে লিখতে হবে এটাও।চুল দাড়ি কামিয়ে সন্ন‍্যাসের পাঠ শুরু করেই এসেছি।সাথে যা আছে তাই দিয়ে নিপূণ ভাবে লেখা যাবে নতুন কাহিনী।শ্মশানের পাশে কালী মন্দিরে কয়েকজন ছেলে ছোকড়া দেশী নেশা করছে।ম্লান মুখে কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই খিস্তি করলো,কেডায় রে শালা!এহানে কি চাই?ভাগ?আমি নরম হয়ে প্রার্থনা করলাম,বাবা এই চাতালে একটু শোব?রাতটুকু কাটাবো।কিছু চাইনা বাবা।পরমেশ্বরের দরবারে ফকিরের চাহিদা শূন‍্যের জন‍্যেই।দেখ লতিকা ওদের গদগদ মুখে কৃপা প্রার্থনা করার ভঙ্গীতে নান্দীমুখ হয়েই গেল।তবে ঘাড়গুঁজে চলার অভ‍্যেস আমি ছাড়তে পারবো না।ভদ্রতার উৎকৃষ্ট নমুনা ত‍্যাগ ক‍রতে নেই।সব শয়তানি অক্ষর মুছে ফেলা যায় ঘাড় গুঁজলে।রাতটা আর ভয় দেখাতে পারছে না বরং শক্তি হারিয়ে ফ‍্যাকাশে হয়ে গেছে।অক্ষর গুলো যুতসই করে নিই।ছায়াগুলো আবার আসবে জানি কিন্তু আমার এখনো অনেক লেখা বাকি।আবার নতুন গল্প নতুন প্লট।
......................

অলঙ্করণ :-  প্রিয়াঙ্কা সরকার