তিতি - পিন্টু মান্না



 তিতি

 পিন্টু মান্না

 

    রোজ বনানীর কলেজ থেকে ফেরার অপেক্ষায় থাকে একজোড়া পিটপিটে চোখ । কলিংবেল বাজলেই তিতি তিতি বলে দে দৌড় ! দরজা খোলামাত্রই একগাল হাসিতে ছোট্ট হাত পেতে নিজের দাবিদাওয়া পেশ হয় ।
-‘কি চাই?’
-‘তকলেত’
-‘অ্যাঁ রোজ বাবুর জন্য চকলেট আনতে হবে ! কে রে আমার !’
চকলেটের প্যাকেট দিদিকেই কাটতে হয় । দিদি বলে
-‘আমায় দে’
যে সামান্য অংশ দিদির মুখে যায় তাও স্থায়ী হয় না বেশিক্ষন ! দিদির মুখের এঁটো চকলেটের যে কি স্বাদ সে সেই বোঝে !

                              

-‘উফফ আবার এসেছে ! এতবড় বিছানা থাকতে আমার গায়ের উপরেই শুতে হয় তোকে?’
নিষ্ফল আবেদন । বরং আরো জাপটে জুপটে শোয় ।
রোজ সকালে ঘুম ভাঙলে টলতে টলতে এসে দিদির গায়ের উপর ঘন্টাখানেক তৃপ্তির ঘুম না দিলে শান্তিই হয়না তার ।

        রোজ দিদির হাতে গায়ে হিজিবিজি ট্যাটু তো আছেই । একদিন সকালে দিদি ঘুম থেকে উঠে আয়নায় দেখল তার গোঁফ হয়েছে ! দেখল বিছানায় বালিশের পাশে তার পার্মানেন্ট মার্কারটা পড়ে আছে ।অপরাধটা একটু বেশিই হয়েছিল । মায়ের বকুনি খাওয়ার সময় সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয় তার দিদিই ।
-‘ও এখন কেন ভিজে বেড়ালের মতো আসছিস কাছে ?’
হাতে দাঁত বসলো !
-‘উফফ ! আ্যই কামড়ালি কেন ?’
-‘তুই বেলাল বল্লি তেনো !’


        সেদিন মায়ের হাত ধরে ধিতাং ধিতাং করে নাচতে নাচতে উলঙ্গ রাজা দিদির ঘরে এসে ঢুকলেন । আড়চোখে দেখল বনানী।
-‘ওকে বলে দাও কাম্মা আমি ওকে স্নান করাতে পারবো না !’
দুটো ছোট্ট চোখ গোল গোল হয়ে গেল । বেশ রেগে মেগে বলল
-‘তেনো ?’
-‘অ্যাঁ কেন ! তুই আমার মাউথওয়াশে কুলকুচি করিসনি ?!’
-‘বেত তোলেতি ! তুই তকলেত দিন্নি তেনো ?’
-‘ওরে আমার কে রে ! ওর জন্য রোজ গাড়ি গাড়ি চকলেট যোগান দিতে হবে !’
চোখ পাকলো মা
-‘আ্যই বেশ করেছিস ? দেখবি মজা ?’
অমনি একলাফে বিছানায় উঠে দিদির নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গেল ।
-‘ও এখন দিদি কেন নেংটা রাজা ?’
দাঁত বসল !
-‘দেখেছ কান্ড ! আ্যই কামড়ালি কেন দিদিকে ?’
-‘ও আমাতে নেনতা বল্লো তেনো ?’
-‘তবেরে !’
মহারাজ একলাফে লাফ মেরে দিদির বাথরুমে
হাসতে হাসতে প্রতিমাদেবী বললেন
-‘নে মিঠু পোশাক পাল্টে নে , তোকে স্নান না করিয়ে তো ওনার স্নান হবে না !’
-‘যা বলেছ কাম্মা ! মাথায় জল ঢাললেই জড়িয়ে ধরে সে কি কান্ড করবে !’
হাসলেন প্রতিমাদেবী
-‘নেহাত আমি পেটে ধরেছি । কেন যে তোকে মা বলে না সেই আশ্চর্য লাগে আমার !'


        সেদিন মহারাজ রান্নাঘরে গিয়ে দেখলেন লুচি ভাজা চলছে ।
মানদা পিসি লুচি দিতে গেল । দুটো ডাবা ডাবা চোখ একটাই প্রশ্ন করল
-‘তিতি ?’
মা বললেন
-‘হ্যাঁ তোমার দিদিকেও দেওয়া হবে কোনো চিন্তা নেই !‘
জেঠিমা হাসতে হাসতে বললেন
-‘ওরে ওকে দিয়ে লাভ নেই মানদা । মিঠুকে দিয়ে আয় যদি বাবুর পেটে যায় !’
মানদা পিসির হাত ধরে নাচতে নাচতে গেল ।দিদির ঘরে ঢুকেই বিছানায় উঠে লাফাতে লাফাতে বলল
-‘তিতি ! তিতি ! নুচি ! নুচি !!’
লুচি অর্ধেকটা দিদির মুখে যায় । দিদির মুখ থেকে মুখ লাগিয়ে ছিঁড়ে না খেলে বাবুর শান্তিই হয়না তার । শুধু লুচি বিস্বাদ লাগলো ।অতএব দিদির মুখটা তরকারিতে মাখামাখি হলো ।
রবিবার অফিস নেই । বনানীর বাবা মুকুলবাবু ঘরেই ছিলেন । দেখে সে কি হাসি !
-‘তুমি হাসছ বাবা ?’
সব কান্ড দেখে মানদা পিসি হেসে বলতে গেল সবাইকে ।

        একদিন মানদা পিসি বলল এই যে বিল্টুবাবু অত দিদি দিদি করোনা ! দিদির বিয়ে হয়ে যাবে ব্যাস আর পাবে না !
অমনি দিদির ঘরে দৌড়
-‘তিতি পিয়ে তি?’
-‘বিয়ে? যার সাথে যার বিয়ে হয় তাকে অনেক দূরে নিয়ে চলে যায় । আর আসেনা ।‘
বিজ্ঞের মতো ভাবলো কিছুক্ষন বলল
-‘তল তুই আল আমি পিয়ে হয়ে দাই !’
শুনে দিদির কি হাসি।


        দিদির বিয়ের দিন গায়ে হলুদে সবচেয়ে বেশি হলুদ সেইই মাখলো । দিদির পাশে থাকার জন্য মাসিমার মেয়ে নিতকনে শ্রবনার সাথে প্রতিযোগিতা চললো । দিদিকে বিয়েটাও পিঁড়িতে ওকে কোলে নিয়ে বসেই করতে হলো । দিদির আঁচল ধরে সেও সাতপাক ঘুরল । খাবার টেবিলে ‘নুচি' episode পুনরাবৃত্ত হলো ।বাসর ঘরে দিদির কোলেই ঘুমালো ।

পরদিন যাওয়ার সময় বনানী ভীষণ দেখতে চাইছিল ভাইকে।প্রতিমা দেবী বললেন
-‘ওরে তাকে অনেক কষ্টে ঘুম পাড়িয়ে এসেছি।তোকে যেতে দেখলে রক্ষে থাকবেনা আর ! কি কান্ড করে বসবে !’

-‘বাগানে বসে album টা খুলে বনানীর ছবিগুলো দেখছিলেন দেবকুমারবাবু।বড় স্নেহ করতেন ভাইঝিকে ! তার দাদার থেকেও বেশি । প্রতিমাদেবী হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন ।
-‘ওগো তুমি একটিবার চলো ! ঘুম থেকে উঠে সে যে লঙ্কাকান্ড করছে ! কেঁদে আছাড়-কাছাড় ! হাতের সামনে যা পাচ্ছে ছুঁড়ছে ! কাউকে কাছে ঘেঁষতে দিচ্ছে না !’
-‘সেকি কথা ! চলোতো দেখি !’
-‘তুমি কিন্তু ওকে কিচ্ছুটি বলতে পারবে না বলে দিলাম ! আমার মাথা খাও ! দিদি যে ওর প্রাণ !’
-‘কিন্তু তাইবলে...

একটা দিন অতিকষ্টে ভুলিয়ে রাখা গেল । পরের দিন ঘটনার তীব্রতা বাড়ল ।


        Reception এর লোকজন ব্যস্ততার মধ্যেও মাঝে মাঝেই আনমনা হয়ে যাচ্ছিল বনানী । হু হু করছিল মনটা । অনুষ্ঠান শেষে ফুলশয্যার ঘরে দশ মিনিটও ঢোকেনি । পরিচিত তীব্র কণ্ঠস্বর শোনাগেল বাইরে
-‘তিতি ! তিতি !! তিতি !!!’
বনানী ছুটে গিয়ে দরজা খুলতেই ঝাঁপিয়ে পড়লো কোলে ! কি তৃপ্তি !!
কাকু বলল
-‘কিছুতেই রোখা যাচ্ছিল না ওকে মিঠু একবার না নিয়ে এলেই চলছিল না তাই….’
ইতস্তত কাকুকে থামিয়ে জামাই নিশীথ বলল
-‘বেশ করেছেন ।‘

-‘অ্যাই দিদিকে দেখেছো । এবার চলো আমার সাথে ।‘
আর কে ছাড়ায় তাকে ! এমন ভাবে দিদির কাপড়টা জাপটে ধরল যেন কেউ প্রাণ চেয়েছে !
নিশীথ বাবু হেসে বললেন
-‘ও আমাদের কাছেই থাক । এখন ওকে দিদির কাছ থেকে ছাড়ালে মারাত্মক অপরাধ হয়ে যাবে ।‘
-‘সে কি করে হয় …!’
-‘কোনো কিন্তু নয় আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন ।‘

এরপর একটা দুর্ঘটনা ঘটলো ! ছোট্ট পকেট থেকে দু-দুটো চকলেট নিশীথবাবুর হাতে চলে এলো !
-‘একিরে !! তুই আমাকে তো একদিনও পুরো চকলেট দিসনি ! আজকে দু খানা চকলেট দিয়ে দিলি !! গদাই কোথাকার !!!’
জোরে দাঁত বসল !
-‘মাগো !! উফফ ! আ্যই কামড়ালি কেন !?’
-‘তুই দদাই বল্লি তেনো ?’
সব্বার কি হাসি !!

ফুলশয্যার মাঝরাতে দিদির কোলে পরম নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে ছোট্ট প্রাণটি । নিশীথবাবু বললেন
-‘কিছু বলছনা যে !’
বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বনানী বলল
-‘তোমার ডাকে সাড়া দিতে বয়েই গেছে !! সাতরাজা ধন মানিক যখন পাওয়া আমার হয়েই গেছে !!’
হাসলেন নিশীথবাবু
-‘বটে!!’


Pintu Manna