প্রবন্ধ লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
প্রবন্ধ লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

প্রবন্ধ - ভালোবাসার ভাঁজে ভাঁজে - চিরঞ্জিৎ সাহা

ভালোবাসার ভাঁজে ভাঁজে

চিরঞ্জিৎ সাহা




" অঙ্ক কষে মাপতে গেলে দেখবে ডিফল্ট ব্রেনে ,
চেন টানলেই যায় না থামা ভালোবাসার ট্রেনে ...."
                                                    --- স্বরচিত


মানবমননে স্তরে স্তরে সাজানো অনুভূতিগুলির অন্দরে সর্বাধিক সংবেদনশীল অংশটা বরাদ্দ ভালোবাসার নামে । ভালোবাসা না থাকলে এ দুনিয়ার সৃষ্টির ঘড়ি থমকে যেত সেই কবেই । টেস্টটিউব নামক সায়েন্টিফিক টাইফুন আসার আগে অবধি আপনি , আমি কিংবা বিশ্বব্যাপী গোটা মানবসভ্যতা --- ধরাধামে সকলের আবির্ভাব কিন্তু ওই চিরন্তন জৈবিক পদ্ধতির হাত ধরেই ; যার মূলে রয়েছে দুজন নরনারীর প্রবলতম ভালোবাসার আদিমতম বহিঃপ্রকাশ । হোক না সে তাৎক্ষণিক কিংবা রোজনামচার তেলকালির ক্লান্ত আঁচের গতানুগিক অভ্যাসজাত ,হোক না সে বৈবাহিক কিংবা গোপন অবৈধ --- শারীরিক সোহাগ, কামকুঞ্জের আর্তনাদ আর অক্সিটোসিনের আহ্লাদের মাঝেও অন্তত সেই নাটকীয় মুহূর্তে প্রকট হয়ে বেঁচে ওঠে ভালোবাসার ভীষণতম রূপ । কোথাও নিষিদ্ধ , কোথাও আবার স্বভাবের চেয়েও অনেক বেশি স্বাভাবিক । কোথাও মুখ , কোথাও আবার রঙচঙে মুখোশের আড়াল ।  সত্যি আর মিথ্যের বিতর্কিত জ্যাকেটে , আজীবন কিংবা ক্ষণিকের বাঁধভাঙা মোহে --- ভালোবাসার প্রত্যক্ষ অবদান আমাদের প্রত্যেকের সৃষ্টির মূলেই কিন্তু জড়িয়ে রয়েছে অঙ্গাঙ্গীনভাবে  ; কখনও সেটা উৎসস্রোতেই পরিবর্তনহীন অব্যয় বয়ে চলে আজীবন , ছুঁয়ে থাকে সারাবেলা কিংবা অনুভূতির সমস্ত স্তরকে । কখনও আবার জাল কেটে বেরিয়ে যায় হাজার একটা প্রশ্ন তুলে ; মানবতার আদালতে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়াতে বাধ্য করে বিধ্বস্ত ' ভালোবাসা ' শব্দটিকে । তাই , বিবর্তনবাদের হাত ধরে , প্রগ্রেসিভ ইভোলিউশনের দিকে যত এগিয়ে চলেছে মানুষ --- " জট বাড়ছে ভালোবাসার , নিত্যনতুন নামে ; 
চেনা মানুষ যায় বিকিয়ে অচেনা দরদামে । "


শুধু শারীরিক , বৈবাহিক কিংবা পারস্পরিক মানবসম্পর্ককেন্দ্রিক নয় ;  সৃষ্টিশীল এই বিশ্বের শিল্প, সাহিত্য , বিজ্ঞান সবকিছুই আদতে গড়ে ওঠে ভালোবাসার স্পর্শেই । যে সকল সম্পর্কে চাওয়া-পাওয়া কিংবা লাভ-ক্ষতির গাণিতিক হিসেব রন্ধ্রে রন্ধ্রে হেঁটে বেড়ায় অকুণ্ঠভাবে , তাকে ভালোবাসা না বলে ব্যবসা বলাই শ্রেয় । স্বামী বিবেকানন্দ ঘর ছেড়েছিলেন ভালোবাসা তথা মানবসেবার টানে । তাঁর গুরু শ্রীরামকৃষ্ণের স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে জনসেবার নেশায় সমগ্র সভ্যতার আশ্রয়স্থল হয়ে উঠতে চেয়েছিলেন তিনি এবং পেরেওছিলেন শেষমেষ । মৃত্যুর একশো আঠারো বছর পেরিয়ে আসার পরও আজও মানুষের মধ্যে ভালোবাসা বিতরণে মগ্ন তাঁর তৈরি প্রতিষ্ঠান। ডিপ্রেশনে স্লিপিং পিলের চেয়ে এখনও অনেক বেশি কার্যকর ' সবার স্বামীজি'র কয়েকটা পাতা । নীচ জাতি , অজ্ঞ ,মুচি , মেথর কিংবা ভারতবর্ষকে ভালোবাসার আদর্শ নিয়ে বেড়ে ওঠা নরেন প্রতিদানে কোনোদিন আশা করেননি কিছুই । চেয়েছিলেন জাতিগত , ধর্মগত , পেশাগত ভেদাভেদ ভুলে মানবসমাজকে ভালোবেসে যেতে নিঃস্বার্থভাবে । কোনোরকম পার্থিব প্রত্যাশা না থাকার কারণেই সফলতার রূপ দেখেছিল তার ভালোবাসা । সংসার , কেরিয়ার , আর্থিক সমৃদ্ধির মোহকে জলাঞ্জলি দিয়ে ধৈর্য ধরে হেঁটেছিলেন নিঃস্বার্থ ভালোবাসা বিতরণের পথে । তাই , তাঁকে সরে আসতে হয়নি কোনোদিন । অশ্রু ঝরাতে হয়নি প্রতারিত হয়ে । আসলে , প্রত্যাশাহীন ভালোবাসায় আঘাত লাগার কোনো জায়গা থাকে না যে , তাই তো তা সদর্পে রাজ করে জীবনভর ।

শুধু শ্রীকৃষ্ণকে ভালোবাসবেন বলেই সমস্ত জাগতিক মায়া কাটিয়ে আজ থেকে সাড়ে পাঁচশো বছর আগে ঘর ছেড়েছিলেন শ্রী চৈতন্যমহাপ্রভু। একটা মূর্তির প্রতি ভালোবাসায় পার্থিব প্রাপ্তির আশা থাকে না বিন্দুমাত্র । আপাত অস্তিত্বহীন কোনো বিশ্বাসকে ছোঁয়ার জন্য নিজের সর্বসুখ বিসর্জন দিয়ে একনিষ্ঠভাবে ছুটে যেতে প্রয়োজন হয় পারিপার্শ্বিক মোহহীনতার । আর সেটা ছিল বলেই কৃষ্ণপ্রেমের পথে শ্রীচৈতন্য ছুটে যেতে পেরেছিলেন সমস্ত চেতনা দিয়ে । প্রেমের এমন সার্থক উদাহরণ ইতিহাসে আর কোথায় ! মোহময় ভালোবাসা অনেকটা কাঁচের পৃথিবীর মতো ; অল্প আঘাতেই ধসে পড়ে মোহের মোড়ক , গুড়িয়ে যায় কাঁচের পৃথিবী । কিন্তু সেসব স্বার্থদীর্ণ জাগতিকতার উর্ধ্বে উঠে অপ্রাপ্তির অলংকারকে সগর্বে যারা নিতে পারেন গলায় , ভালোবাসার পথে তারা দিশা হারান না কোনোদিন । জগাই-মাধাইয়ের ছোঁড়া কলসির কানায় আহত হয়েও প্রেম বিলিয়ে যান অকাতরে । ভালোবেসে যাওয়ার ঐকান্তিক অভ্যেস জাগতিক দেনা-পাওনা , হিসেবনিকেষ থেকে এদের সরিয়ে রাখে কয়েক যোজন দূরে আর ঠিক সেই কারণেই কৃষ্ণপ্রেমে নিজেকে উৎসর্গ করা মহাপ্রভু গোটা জীবন জুড়ে আর্তজনকে ভালোবাসা বিলিয়ে গেছেন অকাতরে । সমগ্র বিশ্বের মানুষকে চিনিয়েছেন নিঃস্বার্থ ভালোবাসার এক অমোঘ শান্তিময় পথ । তাই তো মহাপ্রস্থানের পাঁচশো বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরও মহাপ্রভুর দেখানো ভালোবাসা অর্জিত শান্তির পথে লাখো লাখো মানুষ ছুটে চলেছে আজও ।

বিবেকানন্দ কিংবা মহাপ্রভুর এই ভালোবাসাকে মনুষ্য সমাজের একটা বড়ো অংশ ' আধ্যাত্মিকতা ' নামে আখ্যায়িত করতে চাইলেও আসলে তা ছিল এক নিখাদ প্রেম যাতে স্বার্থের কোনো কলুষিত সংস্পর্শ ছিল না । ছিল না কোনো দরকষাকষি কিংবা পার্থিব চাওয়াপাওয়ার জটিলতম অঙ্ক আর এভাবেই ভালোবাসার সার্থকতম প্রকাশে তা পরিচিত হয়েছে ' আধ্যাত্মিকতা' নামে । আসলে বিবেকানন্দ কিংবা মহাপ্রভু অন্য কোনো প্রাপ্তির নেশায় ভালোবাসার পথে আসেননি , ভালোবেসেছিলেন কেবল ভালোবাসার জন্য । আমাদের মনুষ্য সম্পর্কগুলোতে এমন নিঃস্বার্থতা আজ কোথায়!

বিজ্ঞানকে ভালোবেসে স্বেচ্ছায় নির্বাসনকে বরণ নিয়েছিলেন গ্যালিলিও গ্যালিলি। বিনিময়ে , বিজ্ঞানের থেকে আশা করেননি কিছুই ; তাই চার্চের বিধানে কঠোরতম দণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার পরও অপ্রাপ্তির শোকে ভিজে কোপারনিকাসের মতো সরে আসেননি বিজ্ঞানের পথ থেকে। 


বিপ্লবী হিসেবে কোনোরকম মাস মাইনে পেতেন না শহিদ ক্ষুদিরাম বসু । মৃত্যুর পর পরিবারের বিশাল অঙ্কের ক্ষতিপূরণ লাভের কোনোরকম গল্প তো ছিলই না উপরন্তু তৎকালীন ব্রিটিশ শাসক কর্তৃক লাঞ্ছিত হওয়ার সম্ভাবনা ছিল পুরোদমে । তথাপি , আঠারো বছরের ক্ষুদিরাম বসু দেশপ্রেমে ভর করে কিংসফোর্ডের গাড়িতে বোম মেরে ফাঁসির দড়ি গলায় পড়েছিলেন হাসিমুখে । ফাঁসির মঞ্চে ওঠার সময় তাঁর মুখে কোনো চিন্তা , আফসোস কিংবা হতাশার ছাপ না দেখে বিস্মিত হয়েছিলেন তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের দোর্দণ্ডপ্রতাপ ফাঁসুড়ে । আসলে , দেশমাতৃকার সাথে  ক্ষুদিরামের ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিল না কোনো । স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে নিঃস্বার্থভাবেই সে ভালোবেসেছিল দেশকে । তাই , অপ্রাপ্তির কোনো আক্ষেপ গ্রাস করেনি তাঁকে । শেষ নিঃশ্বাস অবধি প্রাণপণে রয়ে গেছিলেন দেশপ্রেমের পথে ।

ভালোবাসা একটা শান্তির নীড় । যে শান্তি জীবনানন্দ খুঁজে নিয়েছিলেন নাটোরের বনলতা সেনের চোখে । কিন্তু , আজকের দিনে লাভ-ক্ষতির ন্যক্কারজনক হিসেব , স্বার্থপরতার করালগ্রাস ছাড়েনি ভালোবাসাকেও । শান্তিনীড়ের উপমা ছেড়ে ভালোবাসাও তাই আজ সততই যুদ্ধক্ষেত্র । পাহাড় জমছে ডিভোর্স ফাইলের। আসলে , আমরা আর ভালোবাসার জন্য ভালোবাসি না ; আজকের দিনে ভালোবাসা আদতে রূপগত সৌন্দর্য আর সম্পদগত ঐশ্বর্যের অঙ্ক মেলানোর খেলা । বর্গ-ঘন-যোগভাগ-বর্গমূল করে --- যেভাবেই হোক , ডানপক্ষকে মেলাতে হবে বামপক্ষের সাথে । জীবনে ভালোবাসা তাই আর আগের মতো ঝরণার স্বাভাবিক ছন্দে মেলে না ,বরং মেলে কঠোরতম গাণিতিক নিয়মে । প্রতিধাপে চাওয়া-পাওয়ার হিসেব কষে নামতে নামতে একসময় ডানপক্ষও আর মেলে না বাম পক্ষের সাথে । লাভ-ক্ষতির দড়ি টানাটানি চলতে চলতে আলগা হয়ে আসে সম্পর্কের বাঁধন । জীবন তখন খুঁজে নেয় নতুন কোনো সূত্র । বীজগাণিতিক নিয়ম ছেড়ে ক্যালকুলাসে বামপক্ষ মিলতে চায় নতুন কোনো ডানপক্ষের সাথে । ব্রেকআপের মতো শব্দরা তাই দ্রুতগতিতে উঠে আসে অভিধানে । আসলে , আজকের দিনে ফেসবুক , ইনস্টা , টুইটারে কথার জাল বুনে সুকৌশলে চলে ভালোবাসার দরকষাকষি তথা দাম বাড়ানোর মনস্তাত্ত্বিক খেলা । চুপিসারে নিলাম চলে রূপ কিংবা ঐশ্বর্যের । বিড দেওয়ার লোকেরও অভাব নেই অত্যাধুনিক ভার্চুয়াল বাজারে । কয়েকদিনের চুক্তি । বনিবনা না হলেই আবারও নতুন করে নিজেকে তুলে ধরা নেট-নিলামের মঞ্চে । গোটা ফেব্রুয়ারি জুড়ে চলে ভালোবাসার ফ্ল্যাট সেল । বিয়ের মন্ত্রের 'হৃদয়ম 'কে 'ঐশ্বর্য ' কিংবা ' সৌন্দর্য ' দিয়ে আজ তাই প্রতিস্থাপিত করাই যায় অনায়াসে । 


বছর কুড়ি আগে ভালোবাসায় এত্ত জটিলতা ছিল না , টিউশন থেকে ফেরার পথে এক বছর ধরে শুধু চোখাচুখি হয়ে গেছে দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটার সাথে । কথা হয়নি কোনোদিন । শুধু ওই দেখাটুকুর জন্যই ছেলেটা সপ্তাহভর অপেক্ষা করে থাকত অঙ্ক টিউশনের । সমস্তরকম পারিবারিক অনুষ্ঠান ,নাচের ক্লাস বাদ দিয়ে মেয়েটাও ওই দুটোদিন সময়মতো ঠিক চলে আসত বারান্দায় । এটাই হয়তো ভালোবাসা । একদিন বারান্দায় ছেলেটা আর দেখতে পেল না মেয়েটাকে । বুকের সমস্ত সাহস কুড়িয়ে নিয়ে পাড়ার চায়ের দোকানে ইতস্ততভাবে জিজ্ঞেস করতেই জানতে পারল , বাড়ি বিক্রি করে তারা চলে গেছে অন্যত্র । ছেলেটা আজও নীরবে ভালোবাসে মেয়েটাকে । আসলে ,ভালোবাসায় প্রাপ্তির আশা থাকতে নেই যে । থাকে শুধু শান্তি আর স্বস্তিপ্রদায়ী এক স্বর্গীয় অনুভূতি ।


কোনোদিন স্বামী হিসেবে পাবেন না জেনেও সাবিত্রীদেবী আজীবন ভালোবেসে গেলেন মহানায়ক উত্তমকুমারকে ; কোনো লোকদেখানো নেই , ফেসবুকে স্ট্যাটাস আপডেট নেই , বাহুল্য নেই , তিক্ততা নেই । হয়তো বুকের ভেতর লুকিয়ে চিৎকার করা অভিমানেরা আছে , হাসিচাপা কান্না আছে কিন্তু কোনো ঘৃণা নেই ,নেই কোনো ক্ষতির হিসেব । হৃদয়ের ভালোবাসা অনুভূতি হয়ে বেঁচে ছিল তখনও ,একবিংশ শতকের মতো পণ্য হয়ে বিকিয়ে যায়নি চৈত্রসেলে ।


লাভ-ক্ষতির পাটিগাণিতিক হিসাবে ভালোবাসাকে ব্যবসায় পরিণত করার পাঠ এখন আমাদের শেখানো হয় অনেক ছোট থেকেই । অনিচ্ছা সত্ত্বেও ইংরেজি কিংবা বাংলার বদলে প্রায়শই বাচ্চাদের জোর করা হয় বিজ্ঞানকে ভালোবাসতে । আসলে বিজ্ঞানকে ভালোবাসলে বিনিময়ে প্রাপ্তির সুযোগ অনেক বেশি থাকে যে….


অবচেতন মনে এই পৃথিবীর প্রতিটি মানুষই  আদতে সবথেকে বেশি ভালোবাসে নিজেকে । আত্মসুখের পথই তাই তারা সন্ধান করে চলে আজীবন । কেউ সেই সুখ পায় মানবসেবায় , কেউ কৃষ্ণপ্রেমে , কেউ দেশসেবায় , কেউ আবার বিজ্ঞানচর্চায় । বাহ্যিক দৃষ্টিতে আত্মবঞ্চনা কিংবা আত্মপ্রবঞ্চনার কথা মনে হলেও , তাদের আত্মা কিন্তু সে পথেই থাকে চরমতম সুখী । তথাকথিত পার্থিব সুখের জলাঞ্জলির মধ্যেই খুঁজে নেয় নিজেদের ভালো থাকার রাস্তা ; বিবেকানন্দ, মহাপ্রভু , গ্যালিলিও কিংবা ক্ষুদিরামের মতোই যুগ থেকে যুগান্তরে অমর হয়ে বেঁচে থাকে তাদের ভালোবাসার গাথা। 
কেউ কেউ আবার মিষ্টিমুখে সোশ্যাল বাজারে দরদাম করে ভালোবাসার । ম্যাট্রিমণি সাইট যেন প্রেমের শপিং মল । আর্থিক প্রতিপত্তি আর সৌন্দর্যের ট্যাগ বসিয়ে ভালোবাসা নামক পণ্যের অবাধ বিক্রি সেখানে । তবে এসব বাধা পেরিয়ে নিঃস্বার্থ ভালোবাসা আর বিশ্বাসে গড়া শান্তির প্রাসাদে সৌভাগ্যক্রমে একবার যদি ঢুকতে পারেন , অনলাইনের ওই নিলাম স্টলের কথা ভাবলেই দম আটকে আসবে । নিশ্চিত !

 .......................
 

 


  

প্রবন্ধ - ইতিহাসের অলিন্দে থাকা হাম্পি - সঞ্চারী ভট্টাচাৰ্য্য

 

ইতিহাসের অলিন্দে থাকা হাম্পি
সঞ্চারী ভট্টাচাৰ্য্য 
 
 

আক্ষরিক অর্থে দিল্লি-সুলতানির পতন ঘটেছিল পানিপথের প্রান্তরে, সুলতান ইব্রাহিম লােদীর পরাজয় এবং জহিরুদ্দিন মহম্মদ বাবর কর্তৃক মুঘল শাসন প্রতিষ্ঠার সাথে (১৫২৬ খ্রিঃ)। কিন্তু প্রকৃত অর্থে এই ভাঙনের সূচনা হয়েছিল অনেক আগেই সুলতান মহম্মদ-বি-তুঘলকের রাজত্বকালে। মহম্মদ-বিন-তুঘলকের অবাস্তব পরিকল্পনাসমূহের উপর্যুপরি ভ্রান্তি ইত্যাদি একাধিক কারণে সুলতানি শাসন যখন অস্থির, তখন উচ্চাকাঙ্ক্ষী প্রাদেশিক শাসকরা আঞ্চলিক স্বাধীনতা অর্জনের স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার সুযােগ পান। সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অংশে একের পর এক বিদ্রোহ দেখা দেয়। বিদ্রোহ দমনের জন্য সুলতান দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটে বেড়ান। কয়েকটি ক্ষেত্রে বিদ্রোহ দমনে তিনি সফলও হয়েছিলেন। কিন্তু ব্যর্থতার প্রতিক্রিয়া ছিল বেশি ক্ষতিকর।

এরপর দক্ষিণ ভারতে স্থাপিত হয় স্বাধীন বিজয়নগর সাম্রাজ্য। দাক্ষিণাত্যের আরও উত্তরে বহিরাগত মুসলমানরা দৌলতাবাদকে কেন্দ্র করে প্রতিষ্ঠা করেন স্বাধীন মুসলমান রাজ্য। পরে এটিই বাহমনী সাম্রাজ্যে পরিণত হয়। পূর্ব ভারতে বাংলাদেশ স্বাধীনতা ঘােষণা করে। যে মহম্মদ তুঘলকের আমলে দিল্লি-সুলতানি বিস্তৃতির সর্বোচ্চ-সীমায় পৌঁছেছিল; সেই মহম্মদের রাজত্বের শেষ পর্বে শুরু হয়েছিল ভাঙনের অধ্যায়। পরবর্তীকালে কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থার ক্রমিক অবনতি ; তৈমুর লঙের বিধ্বংসী আক্রমণ, তুঘলকবংশীয় শাসনের অবসান ইত্যাদির সুযােগে কয়েকজন প্রাদেশিক শাসক এবং ছােটো ছােটো স্বশাসিত রাজ্যের রাজারা স্বাধীনতা ঘােষণা করেন। দাক্ষিণাত্যের বাহমনী ও বিজয়নগর রাজ্যে এবং পূর্ব ভারতে বাংলাদেশ-এর পথে অগ্রসর হয় পশ্চিম ভারতের সিন্ধু ও মুলতান, গুজরাট, মালব ও জৌনপুর (পূর্ব-উত্তরপ্রদেশ)। আজমির থেকে মুসলমান শাসনকর্তাকে বিতাড়িত করে রাজপুতানার রাজ্যগুলিও তাদের হৃতস্বাধীনতা পুনরুদ্ধার করে।

১৪১৪ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে সুলতানি সাম্রাজ্যের পরিধি উত্তর ভারতের ক্ষুদ্র গণ্ডীর মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে।তুঘলক শাসনের অবসান ও মুঘল সাম্রাজ্যের উত্থানের অন্তর্বর্তীকালে ভারতের রাজনৈতিক কেন্দ্রবিন্দু দিল্লি থেকে অন্তর্হিত হয়েছিল। আলােচ্য পর্বে উত্তর ভারতের সদ্য-স্বাধীন রাজ্যগুলির ক্ষমতাদখলের চেষ্টা এবং দিল্লির সৈয়দ ও লােদীবংশীয় শাসকদের সুলতানির মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠার ব্যর্থ প্রচেষ্টার মধ্যেই ভারতের রাজনৈতিক কর্মসূচি সীমাবদ্ধ হয়েছিল। তবে এই সময় আঞ্চলিক রাজনৈতিক কর্মসূচির মধ্যে বৃহত্তর সাম্রাজ্য স্থাপনের প্রয়াস যেমন দেখা যায়নি তেমনি একটি বিশেষ রাজ্যের শক্তিবৃদ্ধির পথে অন্তরায় সৃষ্টি করার ক্ষেত্রে অন্যান্যদের উদ্যোগেরও অভাব ছিল না। পশ্চিম ভারতে গুজরাট, মালব ও মেবার একে অপরের শক্তিবৃদ্ধির পথে বাধা হিসেবে দাঁড়িয়ে থাকে। বাংলাদেশের সাথে সংঘাত চলে উড়িষ্যা ও জৌনপুরের মধ্যে। লােদীদের দ্বারা জৌনপুর অধিকৃত হলে একদিকে বাংলার ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়, অন্যদিকে লােদীশাসক রাজপুতানা ও মালবে কর্তৃত্ব-বিস্তারের কাজে উদ্যোগী হন।

অধ্যাপক সতীশ চন্দ্রর মতে, এই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী রাজ্যই উত্তর রাজ্যগুলির মধ্যে শক্তিসাম্য বজায় রাখার নির্দিষ্ট প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়। অর্থাৎ এই সকল রাজ্যের তেমনি কোনাে ভারতের কর্তৃত্ব অর্জনের অধিকারী হত। সম্ভবত, এই কারণে রানা সংগ্রাম সিংহ দিল্লির বিরুদ্ধে বাবরকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। তার লক্ষ্য ছিল মুঘলের সাহায্যে লােদী-শক্তিকে ধ্বংস করে মেবারকে উত্তর ভারতের নেতৃশক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা। অবশ্য এই ঘটনা সত্যি হলে স্বীকার করতে হয় যে, রানা সংগ্রামের মধ্যে দেশপ্রেমের অভাব হয়তাে ছিল না, কিন্তু তার রাজনৈতিক দূরদর্শিতার অভাব অবশ্যই ছিল।

বিজয়নগর সাম্রাজ্য :

বিজয়নগর সাম্রাজ্যের উৎপত্তি সম্পর্কে নানা মত প্রচলিত আছে। তবে দুটি প্রাথমিক বিষয়ে সবাই একমত যে, মহম্মদ-বিন-তুঘলকের আমলে দাক্ষিণাত্যের তুর্কি-মুসলমানদের আধিপত্যের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া এই হিন্দুরাজ্যের উৎপত্তির প্রেরণা দিয়েছিল এবং সঙ্গমবংশীয় দুই ভাই হরিহর এবং বুক্ক ছিলেন এই রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা। ঐতিহাসিক সীওয়েল (Sewell) তার বিখ্যাত “এ ফরগটন এম্পায়্যার” গ্রন্থে বিজয়নগরের উৎপত্তি সম্পর্কে সাতটি কিংবদন্তীর উল্লেখ করেছেন। এগুলির মধ্যে ‘হরিহর ও বুক্ক’ সম্পর্কিত কাহিনিটি একাধিক পণ্ডিতের বক্তব্যে সমর্থিত হয়েছে। সিওয়েল লিখছেন যে, বরঙ্গলের কাকতীয় বংশের অধীনে সামন্ত হিসেবে সঙ্গমবংশ নিয়ােজিত ছিল। কাকতীয়বংশীয় রাজা প্রতাপরুদ্রদেবের অধীনে সঙ্গমবংশীয় হরিহর ও বুক্ক নামক দুই ভাই নিয়ােজিত ছিলেন|সুলতানি-বাহিনী বরঙ্গল আক্রমণ করলে এই দুই ভাই হােয়সলরাজ তৃতীয় বীরবল্লালের রাজ্যে চলে আসেন এবং তার অধীনের চাকুরি গ্রহণ করেন। সুলতানি বাহিনী হােয়সলরাজ্য আক্রমণ কালে এই দুই ভাইকে বন্দি হিসেবে দিল্লিতে নিয়ে যায়। সেখানে তাদের ইসলামে ধর্মান্তরিত করা হয়। পরে দাক্ষিণাত্যের হিন্দু-বিদ্রোহকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে মহম্মদ তুঘলক এদের এনে গুণ্ডিতে শাসকপদে নিযুক্ত করেন। পরে সুযােগমতাে এঁরা স্বাধীনতা ঘােষণা করেন এবং স্বাধীন বিজয়নগর রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন।

ইতিহাসবিদ ভেঙ্কটরামনাইয়া (N. Venkataramanayya) এবং ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার বিজয়নগর রাজ্যের উৎপত্তির মূল প্রেরণা হিসেবে দাক্ষিণাত্যে মুসলিম-বিরােধী হিন্দু-প্রতিক্রিয়ার কথা উল্লেখ করেছেন। ড. স্মিথ (V. A. Smith) লিখেছেন : “There is however no doubt that the new power was the outcome of the efforts made by the five brothers, sons of Sangama, to stay the tide of the Muslim invasion and preserve the Hindu Dharama in the penisula.” এঁদের মতে, শুধুমাত্র রাজনৈতিক ক্ষমতাদখলের উচ্চাকাঙ্ক্ষা নয় ; বিজয়নগর রাজ্য স্থাপিত হয়েছিল দাক্ষিণাত্যে ক্রমপ্রসারমান মুসলিম অধিপত্যকে বাধা দেবার জন্য। ড. মজুমদারের মতে, তেলেঙ্গানা, অন্ধ্র এবং কৃষ্ণা-তুঙ্গভদ্রার দক্ষিণতীরের হিন্দু রাজ্যগুলির মধ্যে মুসলমান সম্প্রসারণ-বিরােধী একধরনের শক্তিজোট গড়ে উঠেছিল। এর অন্যতম কারণ হল দক্ষিণ ভারতে মুসলমান শক্তির অগ্রগতির প্রাথমিক চরিত্র যতটা রাজ্যবিজয়ের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল, তার থেকে অনেক বেশি ঘনিষ্ঠ ছিল একদল শক্তিশালী মানুষের দম্ভপূর্ণ কর্তৃত্ব জাহির করা ও লুঠতরাজের মানসিকতার সাথে। দক্ষিণ ভারতের যেখানেই মুসলমান বাহিনী গেছে, সেখানেই তারা ধ্বংস ও মৃত্যু বয়ে নিয়ে গেছে। তখন দক্ষিণ ভারতে হিন্দুরাই ছিল সংখ্যায় ও কর্তৃত্বে গরিষ্ঠ। স্বভাবতই মুসলমান আক্রমণের ফলে হিন্দুরাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল সবথেকে বেশি এবং এই ক্ষতি হয়েছিল আর্থিক ও
প্রতিপত্তি উভয় দিক থেকেই।

এমতাবস্থায় দক্ষিণ ভারতে হিন্দু-সম্প্রদায়ের মধ্যে যে অসন্তোষ দানা বেঁধেছিল, তাই ক্রমে মুসলিম-বিরােধী মুক্তি সংগ্রামের রূপ নেয়। মহম্মদ-বিন-তুঘলকের আমলে হিন্দু-প্রতিক্রিয়ার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। কৃষ্ণা-গােদাবরী নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলে জনৈক প্রলয় নায়ক হিন্দু-অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেন। প্রলয় নায়ক-এর মৃত্যুর পর তাঁর ভ্রাতুস্পুত্র কাপায় নায়ক (বা কৃষ্ণ নায়ক)-এর নেতৃত্বে হিন্দু-সংগঠন আরও জোরদার হয়। দক্ষিণ ভারতের প্রায় পঁচাত্তর জন হিন্দু নায়ক কৃষ্ণনায়কের নেতৃত্বে আন্দোলন চালিয়ে যান। হােয়সলরাজ তৃতীয় বীরবল্লালের সহায়তায় তিনি বরঙ্গলের মুসলমান গভর্নর মালিক মকবুলকে বিতাড়িত করে অন্ধ্র অঞ্চল মুসলিম-কর্তৃত্বমুক্ত করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

ক্রমে এই হিন্দু-জাগরণ পশ্চিম দাক্ষিণাত্যে ছড়িয়ে পড়েছিল। তুঙ্গভদ্রার উপকূল অঞ্চলে চালুক্য সােমদেবের নেতৃত্বে হিন্দুরা সংঘবদ্ধ হন। কাম্পিলির মুসলমান গভর্নর মালিক মহম্মদের বিরুদ্ধে সােমদেব ব্যাপক আন্দোলন শুরু করেন। পাের্তুগীজ পর্যটক নুনিজ-এর বর্ণনা থেকেও কাম্পিলির নিকবর্তী আনেগুণ্ডিতে হিন্দু কর্তৃত্ব স্থাপনের কাহিনি সমর্থিত হয়েছে। সুলতান মহম্মদ-বিন-তুঘলক কূটনৈতিক উপায়ে কাম্পিলি পুনঃরুদ্ধারের উদ্যোগ নেন। তিনি ইতিপূর্বে হরিহর ও বুক্ক নামক দু-ভাইকে কাম্পিলি থেকে বন্দি করে রাজধানীতে এনেছিলেন। এঁরা ইসলামে ধর্মান্তরিতও হয়েছিলেন।মহম্মদ আনুগত্যের শপথ করিয়ে নিয়ে এই দুই ভাইকে কাম্পিলির শাসক-পদে নিয়ােগ করেন। সুলতানের উদ্দেশ্য প্রাথমিক পর্যায়ে সফল হয়। আনেগুণ্ডিতে এই দুই ভাই জনসমর্থন লাভে সমর্থ হন। কিন্তু অল্পদিনের মধ্যেই এই দুই ভাই দিল্লির আনুগত্য অস্বীকার করেন। এঁরা বুঝতে পারেন যে, দিল্লির বহু দূরে অবস্থিত এই হিন্দুপ্রধান অঞ্চলে দিল্লি-সুলতানির আধিপত্য বজায় রাখা খুবই কষ্টকর।আবার দিল্লির প্রভাবমুক্ত স্বাধীন সুলতানি প্রতিষ্ঠা ও রক্ষা করা প্রায় অসম্ভব। এমতাবস্থায় হরিহর এবং বুক্ক ইসলামধর্ম ত্যাগ করে পুনরায় হিন্দুধর্ম গ্রহণ করেন এবং তুঙ্গভদ্রা নদীর তীরে স্বাধীন হিন্দুরাজ্যের সূচনা করেন।

ইসামী ও বারাণীর রচনাতেও জনৈক বিধর্মী কর্তৃক কাম্পালায় স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠার কাহিনি উল্লিখিত হয়েছে। স্বধর্মে প্রত্যাবর্তনের ব্যাপারে হরিহর ও বুক্ককে প্রভাবিত করেন তাদের গুরু মাধব বিদ্যারণ্য। স্বধর্মে প্রত্যাবর্তনের কাজটাও খুব সহজ ছিল না। কারণ হিন্দুধর্মে অন্য কোনাে ধর্মাবলম্বীকে পুনগ্রহণের রীতি ছিল না। তা ছাড়া, মুসলিম শাসকের প্রতিনিধি হবার ফলে এই দুই ভাইকে হিন্দুরা কিছুটা সন্দেহ ও অবিশ্বাস করত। হিন্দুদের এই সন্দেহ দূর করার জন্য বিদ্যারণ্য তার শৃঙ্গেরীর অদ্বৈত মঠের প্রধান বিদ্যাতীর্থের শরণাপন্ন হন। বিদ্যারণ্য তার গুরুকে বােঝান যে, মুসলমানদের হাত থেকে হিন্দুধর্মকে রক্ষা করার জন্য এই দুজনকে হিন্দুধর্মে পুনগ্রহণ আবশ্যিক। যাই হােক, শেষ পর্যন্ত তিনি সফল হন। জনগণকে সন্তুষ্ট করার জন্য ঘােষণা করা হয় যে, হরিহর ভগবান শ্রীবিরূপাক্ষের প্রতিনিধি রূপেই দেশ শাসন করবেন। এজন্য হরিহর শ্রীবিরূপাক্ষ’নাম গ্রহণ করেন এবং এই নামেই সমস্ত সরকারি নথিতে স্বাক্ষর দেন। ১৩৩৬ খ্রিস্টাব্দে হরিহর হাম্পি-হস্তিনাবতী’র রাজা হিসেবে অভিষিক্ত হন। এই বিজয়কে স্মরণীয় করে রাখার জন্য তুঙ্গভদ্রার তীরে নতুন রাজধানী বিজয়নগর-এর ভিত্তিস্থাপন করেন। ঐতিহাসিক দেশাই একটু স্বতন্ত্রভাবে এই ঘটনার ব্যাখ্যা করেছেন। তার মতে, "দাক্ষিণাত্যে হিন্দু-জাগরণের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন হােয়সলরাজ তৃতীয় বীরবল্লাল। তিনিই অধীনস্থ রাজ্য হিসেবে হাম্পি রাজ্যের পত্তন করেন এবং হরিহরকে শাসক নিযুক্ত করেন। তৃতীয় বল্লাল নিহত হবার পর হরিহর স্বাধীনভাবে রাজ্য শাসন শুরু করেন। যাই হােক, একথা সর্বজনস্বীকৃত যে, হরিহর এবং বুক্ক বিজয়নগর রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং দাক্ষিণাত্যের মুসলমান শক্তির প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে প্রায় তিনশাে বছর বিজয়নগর রাজ্যে নিজের অস্তিত্ব বজায় রেখেছিলেন।

রাজনৈতিক ইতিহাস : বাহনী-বিজয়নগর সংঘর্ষ –

ক. সঙ্গমবংশ : বিজয়নগর সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা হরিহর ও বুক্কর পিতা সঙ্গমের নামানুসারে এই রাজবংশ সঙ্গমবংশ নামে পরিচিত হয়েছে। হরিহর ও বুক্ক ছাড়াও সঙ্গমের অপর তিন পুত্র কম্প,মুরপ্পা ও মুদাও রাজনৈতিক কাজে অংশ নিতেন।হরিহর ১৩৩৬ খ্রিস্টাব্দে সঙ্গমবংশের শাসন শুরু করেন। তবে হরিহর এবং বুক্ক সম্ভবত রাজা উপাধি গ্রহণ করেননি। পার্শ্ববর্তী দুই শক্তিশালী রাজ্য—মহীশূরের হােয়সল রাজা এবং মাদুরাই-এর সুলতানি রাজ্যের ঈর্ষা বা প্রতিদ্বন্দ্বিতামুক্ত থেকে শক্তিসংগ্রহের উদ্দেশ্যেই তারা রাজকীয় উপাধি গ্রহণে দ্বিধান্বিত ছিলেন। অবশ্য সাহস ও উদ্যোগের অভাব তাদের আদৌ ছিল না। হরিহর জানতেন যে, অবিরত যুদ্ধের দ্বারাই তাকে রাজ্য রক্ষা ও বিস্তার করতে হবে। তবে সুযােগের জন্য অপেক্ষা ও সাফল্যের জন্য ধৈর্যরক্ষার মহৎ গুণ তার ছিল। মাদুরার সুলতান ছিলেন উচ্চাভিলাষী। তিনি এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে হােয়সলরাজ তৃতীয় বীরবল্লালকে পরাজিত ও হত্যা করেন। অতঃপর হরিহর ও বুক পতননান্মুখ হােয়সল রাজ্যটিকে গ্রাস করতে উদ্যত হন। স্বভাবতই মাদুরার সাথে বিজয়নগরের সংঘর্ষ বাঁধে । সঙ্গম-ভাইয়েরা সাফল্যের সাথে মাদুরার আক্রমণ প্রতিহত করে ১৩৪৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে সমগ্র হােয়সল রাজ্যটিকে বিজয়নগরের অধিকারভুক্ত করেন। বিজিত অঞ্চলের শাসনভার সঙ্গমের পুত্রগণ ও সহযােগী আত্মীয়দের মধ্যে বণ্টন করে দেওয়া হয়। হােয়সল রাজ্যের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশ থাকে হরিহরের হাতে, পূর্ব ও মধ্যভাগের দায়িত্ব পান বুক্ক। উদয়গিরি ও উত্তর কানাড়া অঞ্চল পান যথাক্রমে কম্প ও মুরপ্পা। মহীশূরের দক্ষিণ-পশ্চিম ভাগের শাসনভার পান মুদল্লা। এই ব্যবস্থাকে অধ্যাপক সতীশ চন্দ্র সমবায় 'লােকায়ততন্ত্র’ -ধরনের শাসন বলে উল্লেখ করেছেন। এইভাবে উত্তর ও দক্ষিণে কৃষ্ণা ও কাবেরী নদীর মধ্যবর্তী ভূখণ্ড ও পূর্ব-পশ্চিম দুই সমুদ্রের মধ্যবর্তী অঞ্চল বিজয়নগর সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। ফেরিস্তার বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, বামনী রাজ্যের হাতে পরাজিত হয়ে হরিহর তার রাজ্যের কিছু ভূখণ্ড সুলতান বাহমন শাহকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। হরিহরের মৃত্যুর পর ১৩৫৬ খ্রিস্টাব্দে বিজয়নগরের সিংহাসনে বসেন বুক্ক। তিনি ১৩৭৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন। বুক্কর প্রধান কৃতিত্ব হল প্রতিবেশী শত্রু রাজ্য মাদুরার বিরুদ্ধে সফল অভিযান চালিয়ে ওই রাজ্যের শক্তি খর্ব করা। সম্ভবত, বুক্কর মৃত্যুর বছরেই সম্পূর্ণ মাদুরা রাজ্য বিজয়নগরের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। দক্ষিণে রামেশ্বরম্ পর্যন্ত তিনি সাম্রাজ্য সম্প্রসারিত করতে সক্ষম হন। একটি লিপিতে তিনি নিজেকে পূর্ব-পশ্চিম-দক্ষিণ সমুদ্রের অধিপতি’বলে অভিহিত করেছেন।

বুক্কর সময় বাহমনী রাজ্যের সাথে বিজয়নগরের দীর্ঘ সংগ্রামের সূচনা হয়। রাজ্যের উত্তরদিকে মুসলমান-শাসিত বামনী রাজ্য ছিল বিজয়নগরের সবথেকে বড়ড়া প্রতিদ্বন্দ্বী। ১৩৪৭ খ্রিস্টাব্দে বাহমনী রাজ্যের প্রতিষ্ঠা হয়। প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন জনৈক আফগান সৈনিক আলাউদ্দিন হাসান শাহ। তিনি বাহমান শাহ উপাধি নিয়েছিলেন। তাই এই রাজ্যটিবাহমনী রাজ্য নামে পরিচিতি লাভ করে। যাই হােক, মুসলমান-শাসিত বাহমনী রাজ্যের সাথে হিন্দু-শাসিত বিজয়নগর রাজ্যের সংঘাত ছিল ইতিহাসের অনিবার্য পরিণতি। সাধারণভাবে বলা যায় যে, হিন্দু পুনরুজ্জীবনবাদী আন্দোলনের ধারক হিসেবে বিজয়নগর রাজ্য মুসলমান-শাসিত বাহমনী রাজ্যের বিনাশসাধনে উন্মুখ ছিল। আবার বাহমনী রাজ্যের শাসকদের হিন্দুবিদ্বেষ অস্বাভাবিক কোনাে ঘটনা ছিল না। কিন্তু শুধুমাত্র ধর্মীয় বিদ্বেষ এই দুটি দক্ষিণী-রাজ্যের দীর্ঘ সংঘাতের মূল কারণ ছিল না। এই সংঘর্ষের আপাত লক্ষ্য ছিল দাক্ষিণাত্যের রাজনৈতিক প্রাধান্য অর্জন করা। তবে সেই লক্ষ্য গভীর অর্থনৈতিক প্রয়ােজনবােধ দ্বারা অনুপ্রাণিত ছিল। তুঙ্গভদ্রা-দোয়াব, কৃষ্ণা-গােদাবরী বদ্বীপ ও মারাঠা রাজ্য—এই তিনটি সুনির্দিষ্ট অঞ্চলের ওপর
কর্তৃত্ব স্থাপনের সাথে অর্থনৈতিক লাভ-ক্ষতির প্রশ্ন জড়িত ছিল।

(১) কৃষ্ণা ও তুঙ্গভদ্রা নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চল তুঙ্গভদ্রা-দোয়াব বা রায়চুর-দোয়াব নামে পরিচিত ছিল। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য প্রাচীনকাল থেকেই এই অঞ্চলকে কেন্দ্র করে দক্ষিণী রাজ্যগুলির মধ্যে সংঘাত চলত। প্রাচীনকালে পশ্চিমি-চালুক্যও চোলদের মধ্যে এবং পরে যাদব ও হােয়সলদের মধ্যে এই ধরনের দীর্ঘ সংঘাত ঘটেছিল। মধ্যযুগে সেই স্বার্থসংঘাতের ধারা লক্ষ্য করা যায় বিজয়নগর ও বামনী রাজ্যের মধ্যে।

(২) কৃষ্ণা-গােদাবরী উপকূল অঞ্চলটি ছিল অত্যন্ত উর্বর ও বাণিজ্যসমৃদ্ধ। এই অঞ্চলে অনেকগুলি সমৃদ্ধ ও ব্যস্ত বন্দর থাকার ফলে ব্যাপক বহিবাণিজ্য সম্ভব হত এবং কৃষিজ উৎপাদনের ক্ষেত্রও অঞ্চলটি ছিল লােভনীয়। স্বভাবতই এই সমৃদ্ধ অঞ্চলের কর্তৃত্বলাভের জন্য দক্ষিণ ভারতের দুটি অগ্রণী শক্তির মধ্যে সংঘর্ষ ছিল অনিবার্য।

(৩) বিজয়নগর বাহমনী সংঘর্ষের তৃতীয় কারণ ছিল কোঙ্কন ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের কর্তৃত্ব দখলের ইচ্ছা। পশ্চিমঘাট পর্বত ও সমুদ্রের মধ্যবর্তী কোঙ্কন অঞ্চলটি ছিল এই অঞ্চলের মধ্যে। ভারতে ভালাে জাতের ঘােড়া ছিল না। ভালাে ঘােড়ার জন্য ভারতীয় শাসকদের নির্ভর করতে হত মধ্য-এশিয়ার ব্যবসায়ীদের ওপর। গােয়া বন্দর হয়ে ঘােড়া আমদানি সহজ ছিল। তাই এই অঞ্চলের সামরিক উপযােগিতাও ছিল গুরুত্বপূর্ণ। তাই বিজয়নগর ও বাহমনী রাজ্য দুটি এই তিনটি অঞ্চলেআধিপত্য স্থাপনের লক্ষ্যে দীর্ঘ সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছিল।
বিলুপ্তির পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত বিজয়নগর ও বাহমনী রাজ্যদ্বয়ের মধ্যে প্রায়ই সামরিক সংঘাত চলেছিল।এই যুদ্ধে বহু মানুষ প্রাণ হারায় এবং বিনষ্ট হয় প্রভূত ধনসম্পদ। ধ্বংসের কাজে কোনােপক্ষই পিছিয়ে ছিল না। উভয়েই অপরের গ্রাম ও নগর লুণ্ঠন করত, অগ্নিসংযােগ করত এবং স্ত্রী, পুরুষ ও শিশুদের বন্দি করে ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রি করত। সব মিলিয়ে উভয় রাজ্যই নৃশংসতা ও বর্বরতার আশ্রয় নিত। বিজয়নগররাজ বুক্ক রায়চুর-দোয়াবে ‘মুদগল’ দুর্গ আক্রমণ করে (১৩৬৭ খ্রিঃ) এই দীর্ঘ সংঘর্ষের সূচনা করেন। বুক্ক এই আক্রমণকালে যথেষ্ট নৃশংসতার পরিচয় দেন। এর প্রত্যুত্তরে বাহমনী রাজ্যের সুলতান এক লক্ষ হিন্দুকে হত্যা করার শপথ নিয়ে বিজয়নগরের বিরুদ্ধে যাত্রা করেন।তিনি ‘মুদগল’ দুর্গ পুনর্দখল করেন এবং তুঙ্গভদ্রা অতিক্রম করে বিজয়নগর রাজ্যে প্রবেশ করেন। এই যুদ্ধে উভয়পক্ষই সর্বপ্রথম কামান ব্যবহার করেছিল। অবশ্য তুলনামূলকভাবে রাজ্যের অশ্বারােহী ও গােলন্দাজ বাহিনী বেশি দক্ষতার পরিচয় দেন। দীর্ঘদিন যুদ্ধের পরেও ফলাফল অমীমাংসিত থেকে যায়। শেষ পর্যন্ত রণক্লান্ত উভয়পক্ষই সন্ধিস্থাপনে আগ্রহ প্রকাশ করে। শর্তানুসারে উভয়পক্ষ যুদ্ধপূর্ব অবস্থায় ফিরে যায় এবং দোয়াব-অঞ্চল উভয়ের ভাগাভাগি হয়। উভয় রাজ্যই যুদ্ধে নিষ্ঠুরতা পরিহার করার পক্ষে মতপ্রকাশ করে। স্থির হয়, ভবিষ্যৎ যুদ্ধে অকারণে অসামরিক ব্যক্তিদের হত্যা করা হবে না।

ড. সতীশ চন্দ্র লিখেছেনঃ “কখনাে কখনাে এ মতৈক্য লঙ্ঘিত হলেও এই সন্ধি দক্ষিণ ভারতের যুদ্ধবিগ্রহের মানবিকতাবােধকে জাগ্রত করতে সাহায্য করেছিল।” বুক্ক রামেশ্বরম্ পর্যন্ত তার কর্তৃত্ব প্রসারিত করেন এবং একটি লেখতে নিজেকে ‘পূর্ব, পশ্চিম ও দক্ষিণ সমুদ্রের অধিপতি’ বলে বর্ণনা করেছেন। শাসক হিসেবেও তিনি দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। আঞ্চলিক শাসকদের ওপর তিনি কেন্দ্রের কার্যকরী নিয়ন্ত্রণ আরােপে সক্ষম ছিলেন। ভাষা-সাহিত্যের প্রতিও তার গভীর অনুরাগ ছিল। তার আমলে বেদের নতুন ব্যাখ্যা রচিত হয়। তেলেগু ভাষার উন্নয়নে তিনি বিশেষ আগ্রহ দেখান। তেলেণ্ড-কবি নাচনা সােমা তার পৃষ্ঠপােষকতা অর্জন করেছিলেন। বুক্কের মৃত্যুর পর সিংহসনে বসেন তার পুত্র দ্বিতীয় হরিহর (১৩৭৭ – ১৪০৬ খ্রিঃ)। তিনিই সর্বপ্রথম মহারাজাধিরাজ এবং রাজা পরমেশ্বর উপাধি নেন। সুযােদ্ধা দ্বিতীয় হরিহর মাদুরাই দখল করে পূর্ব-উপকূলের দিকে রাজ্যবিস্তারে মন দেন। এই অংশে কয়েকটি হিন্দু রাজ্যের অস্তিত্ব ছিল। এদের মধ্যে উচ্চ বদ্বীপ অঞ্চলে রেডিরা এবং কৃষ্ণা-গগাদাবরী নিম্ন বদ্বীপ অঞ্চলে বরঙ্গল রাজ্য ছিল গুরুত্বপূর্ণ। এই পূর্ব-উপকূলের দিকে উড়িষ্যা রাজ্য এবং বামনী রাজ্যের কর্তৃত্ব বিস্তারের ইচ্ছা ছিল। যাই হােক, রঙ্গল রাজ্যের সাথে বামনী সুলতানের মিত্রতার ফলে হরিহরের ইচ্ছা পূর্ণ হয়নি। বরঙ্গল-বাহমানী জোট পঞ্চাশ বছরের অধিক স্থায়ী ছিল। এতসত্ত্বেও দ্বিতীয় হরিহর বিজয়নগরের মর্যাদা ও প্রতিপত্তি অক্ষুন্ন রাখতে সক্ষম হন। তার বড়াে কৃতিত্ব হল যে, তিনি বাহমনী সুলতানের কাছ থেকে পশ্চিমে বেলগাঁও এবং গােয়া দখল করতে সক্ষম হয়েছিলেন। গােয়া দখল করার ফলে বিজয়নগরের আর্থিক ও সামরিক শক্তি বৃদ্ধি পায়। সম্ভবত সিংহলের বিরুদ্ধেও তিনি একটি অভিযান পাঠিয়েছিলেন।

দ্বিতীয় হরিহরের মৃত্যুর পর তার পুত্রদের মধ্যে উত্তরাধিকার-সংক্রান্ত বিরােধ দেখা দেয়। প্রথমে প্রথম বিরূপাক্ষ সিংহাসন দখল করেন। কয়েকদিনের মধ্যেই তাকে অপসৃত করে ক্ষমতা দখল করেন দ্বিতীয় বুক্ক। তবে শেষ পর্যন্ত তাকে সরিয়ে স্থায়ীভাবে সিংহাসন দখল করেন প্রথম দেবরায় (১৪০৬-১৪২২ খ্রিঃ)। তাঁর আমলে আবার বাহমনী রাজ্যের সাথে সংঘর্ষ হয়। বাহমনী-সুলতান ফিরােজ শাহ দেবরায়কে পরাস্ত করে দশ লক্ষ মুদ্রা, বহু মুক্তা, হস্তী ও বিজয়নগর রাজকন্যার সাথে বাহমনী সুলতানের বিবাহ দিতে বাধ্য করেন। এই বিবাহ উপলক্ষ্যে তিন দিন ধরে উৎসব চলে। তবে এই বৈবাহিক সম্পর্ক উভয় রাজ্যের মধ্যে স্থায়ী রাজনৈতিক মৈত্রী রক্ষা করতে পারেনি। কিছুদিনের মধ্যেই দেবরায় বরঙ্গল রাজ্যের সাথে জোটবদ্ধ হন। তাদের লক্ষ্য ছিল দুর্বল ‘রেড্ডি’ রাজ্যটিকে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেওয়া। বাহমনী মৈত্রীজোট থেকে বরঙ্গলের বেরিয়ে আসার ফলে দক্ষিণ ভারতের রাজনৈতিক শক্তিসাম্যের পরিবর্তন ঘটে। দেবরায় বাহমনী-সুলতান ফিরােজ শাহকে পরাজিত করে কৃষ্ণানদীর তীর পর্যন্ত সমগ্র ভূখণ্ড নিজ অধিকারভুক্ত করেন।

প্রথম দেবরায়ের পর মাত্র কয়েক মাসের জন্য সিংহাসনে বসে ছিলেন বিজয়রায়। তারপর শুরু হয়সঙ্গমবংশের শ্রেষ্ঠ নৃপতি দ্বিতীয় দেবরায়-এর শাসন (১৪২২ – ‘৪৬ খ্রিঃ)। তার আমলেও বাহমানী রাজ্যের সাথে সংঘর্ষ অব্যাহত ছিল। দ্বিতীয় দেবরায় উপলব্ধি করেন যে, সুদক্ষ তিরন্দাজ বাহিনী দেশের সামরিক শক্তিবৃদ্ধির অন্যতম প্রধান উপাদান। ফেরিস্তা লিখেছেন যে, বিজয়নগর বাহিনীকে তিরন্দাজিতে সুদক্ষ করে তােলার জন্য দ্বিতীয় দেবরায় জায়গির দিয়ে দু-হাজার মুসলিম প্রশিক্ষক নিয়ােগ করেছিলেন। তবে ড. সতীশ চন্দ্র মনে করেন যে, ইতিপূর্বেই বিজয়নগর বাহিনীতে মুসলমান সৈন্য নিয়ােজিত ছিল। দক্ষ তিরন্দাজও বিজয়নগরে ছিল। সম্ভবত অশ্বারােহী নিপুণ তিরন্দাজ হিন্দু-বাহিনীতে ছিল না। এই ত্রুটি দূর করার জন্য দ্বিতীয় দেবরায় হয়তাে কিছু নতুন মুসলমান প্রশিক্ষক নিয়ােগ করেছিলেন। যাই হােক, সামরিক বাহিনীর শক্তিবৃদ্ধি করার পর তিনি রাজ্যবিস্তারে মন দেন। এই সূত্রে দ্বিতীয় দেবরায় বাহমনী রাজ্য আক্রমণ করেন। ১৪৪৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি বাহমনী রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত মুগল, বাঁকাপুর প্রভৃতি স্থান পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করেন। দুরাজ্যের মধ্যে তিনটি যুদ্ধ সংঘটিত হয়। কিন্তু কোনােপক্ষই বিজয়ী না-হওয়ায় স্থিতাবস্থা মেনে নিতে বাধ্য হয়।

ভারতে আগত পর্তুগীজ নুনিজ-এর লেখা থেকে জানা যায় যে, কুইলন, শ্রীলঙ্কা, পুলিকট, পেণ্ড (ব্রহ্মদেশ) ও তেনাসেরিম (মালয়) প্রভৃতি রাজ্য দ্বিতীয় দেবরায়কে কর দিত। তবে এরা সবাই বিজয়নগরের করদ-রাজ্য ছিল বলে মনে হয় না। ড. সতীশ চন্দ্রের মতে, বিজয়নগর রাজ্য নৌ-বাহিনীতে এত বেশি দক্ষ ছিল না যে, পেগু বা তেনাসেরিম-এর মতাে উপকূলবর্তী রাজ্য থেকে নিয়মিত কর আদায় করতে পারত। সম্ভবত মৈত্রীর নিদর্শন হিসেবে তারা বিজয়নগরে উপঢৌকন পাঠাতেন। তবে সিংহলের বিরুদ্ধে বিজয়নগর কয়েকবার সফল অভিযান পাঠিয়েছিল এবং হয়তাে সেখান থেকে বিজয়নগর নিয়মিত কর লাভ করত।

দ্বিতীয় দেবরায়ের মৃত্যুর পর (১৪৪৬ খ্রিঃ) তার পুত্র মল্লিকার্জুন বিজয়নগরের শাসনভার গ্রহণ করেন। তার দীর্ঘ ১৯ বছরের রাজত্বকালে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হল বাহমনী ও উড়িষ্যা রাজ্যদ্বয়ের মিলিত আক্রমণ। অবশ্য মল্লিকার্জুন এই আক্রমণ প্রতিহত করে নিজ রাজ্যকে অটুট রাখেন। এই কাজে বিশেষ কৃতিত্ব দেখান চন্দ্রগিরির সালুভবংশীয় জনৈক সেনানায়ক নরসীমা। স্বভাবতই বিজয়নগর রাজ্যেনরসীমার প্রভাব ও মর্যাদা খুবই বৃদ্ধি পায়। মল্লিকার্জুনের পর বিজয়নগরের সিংহাসনের বসেন তারভাই দ্বিতীয় বিরূপাক্ষ (১৪৬৫ খ্রিঃ)। দীর্ঘ দু-দশক ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকলেও শাসক হিসেবে তিনিছিলেন খুবই অদক্ষ। ফলে সারা রাজ্যে বিশৃঙ্খলা প্রকট হয়ে ওঠে। বহু সামন্ত তাঁর কর্তৃত্ব অস্বীকার করে স্বাধীন আচরণ করতে থাকেন। উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের মধ্যেও লােভ ও শােষণপ্রবণতার বাহুল্য দেখা দেয়। প্রজাদের দুঃখদুদর্শা বাড়তে থাকে। এই সুযােগে উড়িষ্যার রাজা পুরুষােত্তম গজপতি দক্ষিণদিকে তিরুভেন্নামেলাই পর্যন্ত ভূখণ্ড দখল করে নেন। বাহমনী রাজাও বিজয়নগরের ভূখণ্ড গ্রাস করতে উদ্যত হন। এই সার্বিক বিশৃঙ্খলা ও ভাঙনের মুহূর্তে সেনানায়ক নরসীমা রাজা দ্বিতীয় বিরূপাক্ষকে সিংহাসনচ্যুত করে ক্ষমতা দখল করে নেন। এইভাবে সঙ্গমবংশের অবসান ঘটে ও সালুভবংশের শাসন শুরু হয়।


খ. সালুভবংশ : সালুভবংশীয় শাসন চালু ছিল মাত্র সতেরাে বছর (১৪৮৬ – ১৫০৩ খ্রিঃ)। প্রতিষ্ঠাতা রাজা নরসীমা মােটামুটি দক্ষ শাসক ছিলেন। অভ্যন্তরীণ আইনশৃঙ্খলা তিনি কঠোর হাতে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। তবে উড়িষ্যা ও বাহমনী রাজ্যের হাত থেকে যথাক্রমে উদয়গিরি ও রাইচুর-দোয়াব অঞ্চল তিনি পুনরাধিকার করতে ব্যর্থ হন। তাঁর পুত্র ইম্মাদি নরসিংহের আমলে জনৈক সেনাপতি নরসনায়ক রাজ্যের সমস্ত ক্ষমতা হস্তগত করেন। সিংহাসনে না বসলেও তিনিই ছিলেন প্রকৃত শাসক।নরসনায়কের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র বীর নরসিংহ পিতার ক্ষমতার অধিকারী হন। তবে তিনি ছিলেন বেশি উচ্চাকাঙ্ক্ষী। তাই ইম্মাদীকে হত্যা করে তিনি নিজেকেই ‘বিজয়নগরের রাজা’ বলে ঘােষণা করেন। এটি ছিল বিজয়নগর রাজ্যের দ্বিতীয় সামরিক অভ্যুত্থান। এর ফলে সালুভবংশের শাসনের সমাপ্তি ঘটে এবং সূচনা হয় তুলভবংশের শাসনপর্ব।

গ. তুলভবংশ : বীর নরসিংহ অবশ্যই দক্ষ শাসক ছিলেন। কিন্তু তার শাসনকাল (১৫০৫ – ১৫০৯ খ্রিঃ) অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ ও মুসলমানদের আক্রমণ দ্বারা বেশ সংকটপূর্ণ ছিল। নরসিংহ অত্যন্ত দক্ষতার সাথে বিদ্রোহী সামন্তদের দমন করেন। এই সময় বাহমনী রাজ্য ভেঙে বিজাপুর রাজ্যের প্রতিষ্ঠা হয়েছে। বিজাপুর শাসক ইউসুফ আদিল শাহ রায়চুর-দোয়াব দখল করতে উদ্যত হলে বিজয়নগরের রাজার সাথে সংঘর্ষ বাঁধে। এই সময় বাহমনী সুলতান মামুদ শাহের উদ্যোগে মুসলমান অভিজাতরা বিজয়নগরের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করেন। বিজাপুর সুলতান রায়চুর ও মুগল দুর্গ দখল করে নেন। তবে বিজাপুর সুলতান বিজয়নগরের অভ্যন্তরে ক্ষমতা বিস্তারের চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। এক্ষেত্রে বীর নরসিংহ আরভিডু অঞ্চলের শাসক রাম রায় ও তার পুত্র তিম্মার বিশেষ সাহায্য লাভে উপকৃত হন। যুদ্ধ-ব্যস্ততার মাঝেও বীর নরসিংহ সামরিক বাহিনীর সংস্কার সাধন করেন। তিনি পাের্তুগাল গভর্নর আলমিদার এক চুক্তি দ্বারা তার আমদানিকৃত সমস্ত ঘােড়া কেনার ব্যবস্থা করেন। এর ফলে বিজয়নগরের অশ্বারােহী বাহিনী শক্তিশালী হয়। রায়তদের অবস্থার উন্নতির জন্য তিনি কৃষি-সম্পর্কের ক্ষেত্রেও সংস্কার করেন।

কৃষ্ণদেব রায় ও তার কৃতিত্ব :

বীর নরসিংহের পর তার সৎ-ভ্রাতা কৃষ্ণদেব রায় বিজয়নগরের সিংহাসনে বসেন। তিনি কেবল এই বংশের শ্রেষ্ঠ রাজা ছিলেন না; অনেকেই তাকে বিজয়নগরের সমস্ত রাজার মধ্যে শ্রেষ্ঠতম শাসক বলে মনে করেন। এই মূল্যায়ন অযৌক্তিকও নয়। ব্যক্তিগত গুণাবলীর বিচারে তিনি ছিলেন অসাধারণ। সামরিক ও অসামরিক উভয় কাজে তার দক্ষতা ছিল অতুলনীয়। কৃষ্ণদেব রায়ের রাজত্বকালে (১৫০৯-১৫৩০ খ্রিঃ) বিজয়নগরের রাজ্য গৌরবের শীর্ষে আরােহণ করেছিল। বহিরাগত প্রায় সকল পর্যটকই রাজা কৃষ্ণদেবের চরিত্রের ও কৃতিত্বের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। যােদ্ধা হিসেবে তিনি ছিলেন সাহসী ও দক্ষ, কূটনীতিবিদ হিসেবে বিচক্ষণ, শাসক হিসেবে প্রজাদরদী, মানুষ হিসেবে ন্যায়পরায়ণ, দয়ালু এবং সংস্কৃতিমনস্ক।

কৃষ্ণদেব রায়ের সিংহাসনারােহণ কালে দেশ অভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে সমস্যাকীর্ণ ছিল। বীর নরসিংহ প্রাদেশিক শাসকদের দমন করলেও কেন্দ্রীয় সরকারের কর্তৃত্ব তখনাে সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল। দেশের নানা অংশে ক্ষমতাবান পলিগারগণ কেন্দ্রের আনুগত্য অস্বীকার করতে দ্বিধান্বিত ছিল না। বিজয়নগরের পূর্বাঞ্চল উড়িষ্যার রাজা গজপতির দখলে ছিল। বাহমনী রাজ্য ভেঙে গেলেও বিজয়নগরের বিরুদ্ধে মুসলমান সুলতানদের প্রতিরােধ তখনাে ছিল অব্যাহত। উত্তর সীমান্তে নবগঠিত বিজাপুর সুলতানি বিজয়গনরের পক্ষে যথেষ্ট শঙ্কার কারণ হয়ে উঠেছিল। কৃষ্ণদেব রায় যথেষ্ট সাহস ও বিচক্ষণতার সাথে এই বহুমুখী সমস্যার মােকাবিলা করেন।
শাসনের শুরুতেই কৃষ্ণদেব বামনী রাজ্যের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হন। সুলতান মামুদ শাহ বিশাল বাহিনী ও অভিজাতবৃন্দের সাহায্যপুষ্ট হয়ে বিজয়নগর আক্রমণ করেন (১৫০৯ খ্রিঃ)। ‘দোনি ও কোভেলা কোণ্ডার’ যুদ্ধে বিজাপুরের শাসক ইউসুফ আদিল শাহ নিহত হন। এর ফলে সদ্যগঠিত বিজাপুর রাজ্যে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। সেই সুযােগ নেন রাজা কৃষ্ণদেব। ১৫১২ খ্রিস্টাব্দে কৃষ্ণদেব রায় কৃষ্ণা-তুঙ্গভদ্রার ‘দোয়াব’ আক্রমণ করে রায়চুর দুর্গ দখল করে নেন। অতঃপর তিনি ‘গুলবর্গা’ দুর্গও দখল করতে সক্ষম হন। বিদর’ আক্রমণ করে বারিদ’ দুর্গটিও তিনি হস্তগত করেন। এরপর কৃষ্ণদেব কূটনৈতিক চাল হিসেবে মামুদ শাহকে বামনী রাজ্যে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন। এই কাজকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য তিনি যবন রাজ্যস্থাপন আচার্য উপাধি নেন। কৃষ্ণদেব রায় জানতেন যে, স্বাধীন ও স্বতন্ত্র বামনী রাজ্যের অস্তিত্ব বিজাপুর, গােলকুণ্ডা প্রভৃতি নবগঠিত রাজ্যগুলির কাছে সহনীয় হবে না। এই সূত্রে মুসলিম রাজ্যগুলির মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব দেখা দেবে এবং তাদের দুর্বলতার কারণ সৃষ্টি
করবে।

এরপর কৃষ্ণদেব রায় দক্ষিণ-মহীশূরের বিদ্রোহী শাসক পলিগার-এর বিরুদ্ধে অভিযান চালান। বীর নরসিংহের আমল থেকে উচ্চকাবেবী উপত্যকা অঞ্চলে জনৈক পলিগারের স্বাধীন শাসন চলছিল। পলিগারের স্পর্ধা ও শক্তির মূলে ছিল ‘শ্রীরঙ্গপত্তম’ ও ‘শিবনসমুদ্র’ নামক দুটি দুর্গের অস্তিত্ব। কাবেরীর দুটি শাখার মধ্যবর্তী বদ্বীপে অবস্থিত এই দুর্গ ছিল অজেয়। যাই হােক, কৃষ্ণদেব প্রথমে
শ্রীরঙ্গপত্তমদখল করেন। বিপদ বুঝে উমারের শাসক গঙ্গারাজা শিবনসমুদ্রমে সরে যান। কৃষ্ণদেব এটিও দখল করেন। পলায়মান গঙ্গারাজা কাবেরীর জলে ডুবে মারা যান। কৃষ্ণদেব রায় এই অঞ্চলে একটি নতুন প্রশাসনিক কেন্দ্র গড়ে তােলেন। প্রধান কার্যালয় স্থাপিত হয় শ্রীরঙ্গপত্তমে।উড়িষ্যার রাজা গজপতি প্রতাপরুদ্র বিজয়নগরের অন্তর্গত ‘উদয়গিরি’ ও ‘কোণ্ডাভিডু’ অঞ্চল দুটি আগেই দখল করেছিলেন। পূর্ববর্তী বিজয়নগর রাজারা তা পুনর্দখলের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছিলেন। এখন কৃষ্ণদেব রায় হৃতরাজ্য পুনরুদ্ধারে উড়িষ্যার বিরুদ্ধে যুদ্ধে অগ্রসর হন। বিজয়নগর বাহিনী পরপর ‘উদয়গিরি’ (১৫১৩ খ্রিঃ) ও ‘কোণ্ডাভিডু’ (১৫১৪ খ্রিঃ) দখল করে। কৃষ্ণানদীর তীর পর্যন্ত উপকূল-অঞ্চল কৃষ্ণদেব রায়ের হস্তগত হয়। কোণ্ডাভিডু’র পতনের সাথে সাথে উড়িষ্যার যুবরাজ ও ভাবীরাজা বীরভদ্র ও গজপতির এক রানী কৃষ্ণদেবের হাতে বন্দি হয়ে বিজয়নগরে আনীত হন। উড়িষ্যার বিরুদ্ধে অন্য দুটি যুদ্ধ দ্বারা কৃষ্ণদেব বেজওয়াদা এবং কোন্দাপন্নী দুর্গ দুটিও দখল করে নেন।

দেশের আট জন প্রখ্যাত পণ্ডিত তাঁর রাজসভা অলংকৃত করতেন। তাঁর আমল ছিল তেলেগু ভাষার স্বর্ণযুগ। তিনি নিজে একাধিক সাহিত্য রচনা করেছেন। সেগুলির মধ্যে দুটির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া গেছে। এগুলির একটি হলো তেলেগু ভাষায় রচিত রাষ্ট্রদর্শন বিষয়ক গ্রন্থ “আমুক্তমাল্যদা” এবং সংস্কৃত ভাষায় রচিত নাটক “জাম্ববতি কল্যাণম”। অল্লসনি পেড্ডন ( peddan) এইসময় অন্ধ্র কবিতা পিতামহ নামে সম্মানিত ছিলেন। তাঁর রচিত কাব্য হল মনুচরিতম। “অষ্টদিগগজ” ছাড়াও তিনি প্রতি বছর বসন্ত উৎসবের সময় বিভিন্ন সাহিত্যিক দার্শনিক দের আমন্ত্রণ জানিয়ে মূল্যবান উপহার দিতেন।নির্মাতা হিসাবেও তাঁর সুনাম ছিল। বিজয়নগরের অনতিদূরে মাতা নাগলম্ব-র স্মৃতির উদ্দেশ্যে তিনি একটি সুসজ্জিত নতুন শহর নির্মাণ করেন। এই শহর নাগালপুর নামে পরিচিত হয়। এছাড়া কৃষ্ণ মন্দির, হাজার স্বামীমন্দির , বিঠল মন্দির প্রভৃতি তাঁর স্থাপত্য কীর্তি ও ধর্মভাবনার অন্যতম কীর্তি।

ধর্মীয় উদারতা ও পরধর্ম সহিষ্ণুতা ছিল কৃষ্ণদেব রায়ের চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তিনি নিজে বৈষ্ণব হলেও সকল ধর্মের প্রতি ছিল তাঁর সমান শ্রদ্ধাবোধ। মোট কথা তিনি ছিলেন একজন পরিপূর্ণ শাসক। দক্ষিণ ভারতের অন্য কোনো শাসকদের মধ্যে এমন বহুমুখী প্রতিভা ও গুণের সমন্বয় লক্ষ্য করা যায় না।

কৃষ্ণদেব রায়ের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে বিজয় নগরের পতনের পথও প্রশস্ত হয়। মৃত্যুর কিছু পূর্বে তিনি তাঁর নাবালক পুত্র কে সিংহাসনে বসিয়ে শাসনকার্য পরিচালনা করতে শুরু করেন। কিন্তু ষড়যন্ত্রের দ্বারা এই পুত্রের মৃত্যু হলে তিনি জনৈক আত্মীয় অচ্যুত রায় কে তাঁর উত্তরাধিকারী মনোনীত করে যান।কৃষ্ণদেব রায়ের মৃত্যু হলে তাঁর শ্যালক রাম রায় সিংহাসন দাবি করে বসেন। এর ফলে বিজয়নগরের অভ্যন্তরে শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। বিজয় নগরের অন্তর্দ্বন্দ্বের সুযোগে উড়িষ্যার রাজা গজপতি এবং বিজাপুরের রাজা ইব্রাহিম আদিল শাহ বিজয়নগর আক্রমণ করে বসেন। এইভাবে এক ডামাডোল পরিস্থিতির মধ্যে দিয়েই বিজয় নগরের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এগোতে থাকে।অচ্যুত রায়ের মৃত্যুর পর সদাশিব রায় সিংহাসনে বসেন। তাঁর আমলে প্রকৃত ক্ষমতা ন্যস্ত ছিলো রাম রায় এর হাতে।রাম রায় মুসলিম রাজ্য গুলিতে কূটনীতির দ্বারা বিরোধ ও বিভেদ সৃষ্টি করে তাদের ক্ষমতা খর্ব করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তিনি তাৎক্ষণিক সাফল্য ও অর্জন করেন কিন্তু অচিরেই তাঁর এই কূটনৈতিক উদ্দেশ্য মুসলিম রাজ্য গুলির কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

আহম্মদ নগর, বিজাপুর, গোলকুন্ডা, বিদর এই জোটের মুখ্য নায়ক ছিল বিজাপুরের আলি আদিল শাহ। বেরার এই জোটের বাইরে থাকে। জোট বাঁধার পর আদিল শাহ রাম রায়ের কাছে রায়চুর, মুদগল দাবি করেন। স্বাভাবিক ভাবেই রাম রায় এই অন্যায় দাবি নস্যাৎ করে দেন। সঙ্গে সঙ্গেই মুসলমান রাজ্যের এই শক্তি জোট বিজয় নগরের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা শুরু করে।

“রাখখস” ও “তাংদি” নামক গ্রামের সন্নিকটে শুরু হয় এই সংগ্রাম। এটিই ইতিহাসে তালিকোটার যুদ্ধ ( ১৫৬৫) নামে খ্যাত। রাম রায় ও তাঁর দুই ভাই বীর বিক্রমে যুদ্ধ করেন কিন্তু শেষপর্যন্ত বিজয়নগর পরাজিত হয়। বিজয় নগরের দুই মুসলমান সেনাপতির বিশ্বাসঘাতকতায় মুসলিম জোট বিজয়ী হয়। রাম রায় কে হত্যা করা হয়।ডক্টর ঈশ্বরীপ্রসাদ তালিকোটার যুদ্ধকে বিজয়নগর রাজ্যের মৃত্যু ঘণ্টা বলে অভিহিত করে লিখেছেন যে , এই যুদ্ধে বিপর্জয়ের ধাক্কা কাটিয়ে ওঠা বিজয় নগরের পক্ষে সম্ভব হয় নি। মুসলমান রাজ্য গুলির পক্ষেও এই যুদ্ধ শুভ ছিল না। তারা নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে নিজেদেরই ধ্বংস ডেকে এনেছিল। তাই বলা চলে “তালিকোটার যুদ্ধ” যদি বিজয়নগর রাজ্য কে ধ্বংস করে, তাহলে এই যুদ্ধই মুসলমান রাজ্য গুলির পতনের পথও প্রশস্ত করেছিল।

বিজয়নগর রাজ্যের সামরিক ব্যাবস্থা ও ভূমিদান রীতির সাথে বিশেষ ভাবে জড়িত ছিল “নায়ক” বা
“নায়ঙ্কারা” প্রথা। নায়ক দের অধিকার, কর্তব্য, ও নায়ক প্রথার প্রকৃতি সম্পকে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ আছে। তবে শেষ পর্যন্ত নীলকন্ঠ শাস্ত্রী , মহালিঙ্গম-এর কথায় মূল কথা বলে বিবেচিত হয়। তাঁরা লিখেছেন যে, বিজয়নগরের অভ্যন্তরীণ সংগঠনের প্রধান ভিত্তি ছিল “নায়ঙ্কারা ব্যাবস্থা”। এই প্রথা অনুযায়ী রাজা নায়ক দের হাতে ভূমিরাজস্বের অধিকার অর্পণ করতেন। তাঁরা ছিলেন একাধারে সামরিক নেতা ও স্থানীয় প্রশাসক। তামিল দেশে পনেরো শতকের শেষভাগ ও ষোলো শতকের গোড়ায় এই ব্যাবস্থার ব্যাপকতা দেখা যায়।

এ যুগে শিল্প ও বাণিজ্যে “গিল্ড” বা বণিক সংঘের বিশেষ গুরুত্ব ছিল। পর্যটক আব্দুর রজ্জাক লিখেছেন যে, এক এক ধরনের শিল্প ও ব্যাবসার জন্য এক একটি স্বতন্ত্র গিল্ড বা সংঘ গড়ে উঠত। অন্যান্য পর্যটক দের রচনাতেও গিল্ড ব্যাবস্থার উল্লেখ পাওয়া যায়। বিনিময় প্রথার মাধ্যম হিসাবে সোনা ও তামার মুদ্রার প্রচলন ছিল বেশি।মুদ্রাতে দেবদেবীর মূর্তি ও পশু পাখির ছবি খোদাই থাকতো।উচ্চ,মধ্য, নীচ সমাজের সর্বস্তরের মানুষের ই নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস সংগ্রহ করার ক্ষেত্রে কোনো অসুবিধা হতো না। মোটামুটি এক আর্থিক সচ্ছলতা পরিলক্ষিত হতো বিজয় নগরে।

নারীদের বিশেষ মর্যাদা ছিল বিজয় নগরে। রাজনীতি, সমাজ, সংস্কৃতির নানা ক্ষেত্রে নারীরা সক্রিয় অংশগ্রহণ করতেন। নুনিজের বর্ণনা থেকেও জানা যায় যে, বিজয়নগরের রাজা নারী মল্ল যোদ্ধা, নারী দ্বাররক্ষী, নারী হিসাবরক্ষক নিয়োগ করতেন। সমাজে বাল্য বিবাহ, পুরুষদের বহু বিবাহ এবং সতীদাহ প্রথা প্রচলিত ছিল।কেবল ব্রাহ্মণ ছাড়া বিজয়নগরের অধিকাংশ মানুষ ই ছিল মাংসভোজী। রাজাও মাংস ভক্ষণ করতেন। তবে গরু ও বলদের মাংস খাওয়া সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ছিল।পর্যটক দের মতে সেই সময় সাহিত্য ও শিল্প সংস্কৃতিতে বিজয় নগরের খ্যাতি ছিল সর্বজন বিদিত। সংস্কৃত, তেলেগু, তামিল ও কানাড়ি ভাষা ও সাহিত্যের চর্চা যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়। সংস্কৃত মুক্ত তামিল ভাষা সাহিত্যের বিকাশ এ যুগের অন্যতম প্রধান অবদান। বেদের ভাষ্যকার সায়নাচার্য এবং তাঁর ভাই মাধব বিদ্যারণ্য বিজয় নগর রাজ্যটি কে একটি সাংস্কৃতিক ভিত্তি দেন।

শিল্প স্থাপত্যের প্রতিও বিজয়নগরের রাজাদের সহজাত আকর্ষণ ছিল। আব্দুর রজ্জাক, পায়েজ প্রমুখ বিজয়নগর শহরটির ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। বিশেষত রাজপ্রাসাদের নির্মাণশৈলী ও তাঁর ঐশ্বর্য্য তাঁদের হতবাক করেছে বার বার।একটি হিন্দু রাজ্য হলেও ধর্মীয় অনুদারতা কখনো এই রাজ্যকে গ্রাস করতে পারেনি। নাগরিক দের ধর্মাচরণ এর ক্ষেত্রে অবাধ স্বাধীনতা ছিল। সামরিক বাহিনীতে বহু মুসলমান সদস্য ছিল।তাই বলা যেতে পারে বিজয়নগর রাজ্য তাঁর আপন ঐতিহাসিক মহিমায় ইতিহাসে এক উল্লিখিত স্থান দখল করে আছে।


হাম্পির হারানো দেশ :-

তুঙ্গভদ্রার ঘন কালো জল কখনো উচ্ছল, কখনো অতি বিনম্র ভাবে পাহাড়ের অলি-গলি বেয়ে এগিয়ে চলছে। পাথরের মরুদেশে একাকিনী সে। চারিপাশে সবুজের সংখ্যা নামমাত্র। পার্শ্ববর্তী পাহাড়ের ফাটল থেকে মুহুর্মুহু উপল খন্ড এসে তুঙ্গভদ্রার গতি অবরোধ করার প্রবল চেষ্টা করে যাচ্ছে। তবু সে অবিচল, দুর্গম প্রান্তরের সব বাধা বিপত্তি লঙ্ঘন করে অবিরাম ছুটে চলেছে কৃষ্ণার উদ্দেশ্যে।
হাজার বছর ধরে এই তুঙ্গভদ্রা আর ফুটিফাটা পাথর গুলো সাক্ষী হয়েছে কত গোপন ইতিহাসের। সেই ইতিহাসের পথ ধরে পৌঁছানো যায় বিজয়নগরের স্মৃতিবিজড়িত রাজধানী হাম্পিতে। সম্ভবত ১৩৩৬ সালে, পম্পাপতি মন্দিরকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল হক্ক ও বুক্কার স্বপ্নপুর। তারপর আট শতাব্দী পেরিয়ে গেছে। এখন পরে আছে কিছু মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ, কিছু বিচ্ছিন্ন স্মৃতিকথা, আর তুঙ্গভদ্রার তীরে কিছু মুছে যাওয়া পায়ের চিহ্ন।

হাম্পির বর্তমান অবস্থান উত্তর কর্ণাটকের বেলারি জেলায়। এখানে পৌঁছতে গেলে প্রথমে আস্তে হবে হসপেট শহরে। দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন শহর থেকে হসপেট পৌঁছানো যায় ট্রেন বা বাসে করে। হসপেট থেকে হাম্পি ১২.৭ কিলোমিটার উত্তরে, তুঙ্গভদ্রার তীরে। হসপেট থেকে সরকারি বাস ছাড়ে নিয়মিত সময় এর ব্যাবধান এ, অথবা নিজস্ব গাড়ি ভাড়া করেও যাওয়া যায়।
যদিও হাম্পির ঐতিহাসিক ধ্বংসস্তূপ দেখতে সারা পৃথিবীর মানুষ এসে ভিড় জমায়, তবে আমাদের দেশের পৌরাণিক কাহিনীর বেশ কিছু অংশও রয়েছে এই হাম্পিকে ঘিরে। রামায়ণের বিখ্যাত বানরবংশের বাসস্থান, কিস্কিন্ধাই আজকের হাম্পি। রাম এখানেই কোনো পাহাড়ের কোলে সুগ্রীব আর হনুমানের সাথে প্রথম সাক্ষাৎ করেন। সেই ঋষ্যমুখ পর্বত ঠিক কোনটা, তা বলা মুশকিল হলেও, এখনো একটি চূড়োকে ঋষ্যমুখ পর্বত নাম অভিহিত করা হয়। রামায়ণের পর অনেক বছর কেটে গেছে, ইতিহাস ধূলিসাৎ হয়েছে। মধ্যযুগের কাদম্ব, চালুক্য, রাষ্ট্রকূট, হয়েসালা বংশীয় রাজারা নতুন ইতিহাস গড়েছে। আবার দিল্লির সুলতানরা দাক্ষিণাত্য জয় করে সব ধ্বংস করে দিয়েছে। মানুষের ইতিহাস সৃষ্টি আর ধ্বংসের ইতিহাস, আর মাঝখানে কিছু সময়ের ভালোবাসা, হিংসার ইতিহাস। তাই ধ্বংসে সব শেষ না, এই চিরন্তন দর্শনের পথ ধরেই দাক্ষিণাত্যে তৈরী হলো নতুন রাজত্ব। দিল্লির সুলতানরা ফিরে গেলেই এখানে বিজয়নগরের গোড়াপত্তন হলো। রাজত্বের রাজধানী হলো পুরান প্রসিদ্ধ হাম্পি।

রামায়ণ বা মহাভারত সকল ভারতবাসীর জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ৷আর এই রামায়ণের পরাক্রমশালী বানরসেনাদের রাজ্য কিষ্কিন্ধ্যার কথা আমাদের সকলেরই জানা ৷অতীতের সেই কিষ্কিন্ধ্যা, যা পরবর্তীকালে ইতিহাসের পাতায় বীর রাজাদের আবাসস্হল ‘বিজয়নগর’ বা ‘হাম্পি’ বলে সুপরিচিত ৷ব্যাঙ্গালোর থেকে প্রায় ৩৮০ কিলোমিটার উত্তরে অবস্হিত হাম্পি ৷ ‍‍‌‌‍‍‍ভারতবর্ষে UNESCO নির্বাচিত ‘ওর্য়াল্ড হেরিটেজ সাইট’ এর অন্যতম কর্ণাটকের এই জায়গাটি৷ বিজয়নগর রাজ্যে যে সমস্ত রাজারা বংশপরম্পরায় প্রায় দুশো বছর ধরে রাজত্ব করে গেছেন তারা এখানে অনেকগুলো দুর্গ, মন্দির এবং বিভিন্ন দেবদেবীর মূর্তি তৈরী করেছিলেন৷ কিন্তু দোর্দণ্ড প্রতাপ সুলতান আলাউদ্দীন খিলজীর রোষের হাত থেকে এর অনেকগুলিই মু্ক্তি পায়নি ৷ যে কটা স্থাপত্য রক্ষা পেয়েছিল তার ধ্বংসাবশেষ নিয়েই দাঁড়িয়ে আছে হাম্পি ৷

তুঙ্গভদ্রার দক্ষিণ তীরে গড়ে ওঠা এই শহরটা যেন ইতিহাসের গৌরবময় ও ধ্বংসের মূ্র্ত প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ৷ বিজয়নগরের গৌরবময় ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় যে একদা সমৄদ্ধশালী এই রাজত্ব বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল সুদূর রাশিয়া , পারস্য, ইতালি বা পর্তুগালের মতন দেশগুলির সঙ্গে৷ এইসব দেশের থেকে আগত পর্যটকরা বিভিন্ন জায়গায় উল্লেখ করেছেন সমৃদ্ধশালী এই রাজ্যের কথা৷

হাম্পির প্রবেশ পথে “বিরূপাক্ষ মন্দির” একটা উল্লেখযোগ্য ও দর্শনীয় স্থান ৷ এশহরের সব থেকে উঁচু চূড়া হলো পম্পাপতি মন্দির, যা বর্তমান এ বিরূপাক্ষ মন্দির নামে পরিচিত। অসাধারণ ভাস্কর্যের নিদর্শন রয়েছে মন্দিরে অভ্যন্তরীন নকশার মধ্যে। বেশকিছু মধুযুগীও ছবি এখনো অবশিষ্ট রয়েছে, যদিও তাদের মধ্যে বেশ কিছু নতুন সংযোজন লক্ষণীয়। এই মন্দিরের দুটো গোপুরা। দক্ষিণ ভারতের মন্দিরের চূড়াকে বলে গোপুরা। পূর্ব দিকের গোপুরাটি পশ্চিম দিকের তুলনায় দীর্ঘ এবং, সম্ভবত নির্মাণ কালের দিক থেকে প্রাচীন। পশ্চিমের গোপুরাটি তৈরির সম্ভাব্য সময়কাল কৃষ্ণদেব রায়ের রাজত্ব চলাকালীন (১৫০৯-১৫২৯ খ্রিস্টাব্দ) । দাক্ষিণাত্যের ভাস্কর্যের রূপ ধরেই মন্দিরের মধ্যে রয়েছে মণ্ডপ বা মান্তাপা, স্তম্ভধারী কক্ষ এবং উপাসনা গৃহ। এখনো এই মন্দিরে মধ্যে তথাকতিত হিন্দু মতে পূজার প্রচলন আছে। যদিও পর্তুগিজ পর্যটক, ডমিনিক পিয়াস পম্পাপতি মন্দিরকে তার বর্ণনায় "প্যাগোডা" বলে অবিহিত করেছেন, তবে সেযুগে প্যাগোডা মানে বৌদ্ধ বা হিন্দু যেকোনো মন্দিরকেই বোঝাতো। তথাপি, এখানকার জাদুগরে পম্পাপতি মন্দিরের বৌদ্ধ ভাস্কর্যের কিছু নমুনা এখনও রাখা আছে। কথিত আছে দক্ষযজ্ঞের পর কৈলাস ছেড়ে এসে শিব তপস্যায় বসেন “হেমকূট”এ৷ এইসময় তারকাসুরের আক্রমণে দেবতারা জর্জরিত হয়ে ওঠেন ৷ কিন্তূ তারকাসুর ছিলেন বরপ্রাপ্ত যে ব্রহ্মা, বিষ্ণু বা মহেশ্বর কেউ তার বধ করতে পারবেন না ৷ তাই দেবতাদের অনুরোধে দেবী পার্বতী হেমকূটে গিয়ে শিবের অর্চনা করে তার ধ্যানভঙ্গ করেন৷ দেবী পার্বতী ‘পম্পা’ র রূপে শিবের ধ্যানভঙ্গ করেন বলে শিবের আরেকনাম ‘পম্পাপতী’ ৷ বিরূপাক্ষ মন্দিরের শিবলিঙ্গের নামও তাই ‘পম্পাপতী’ ৷ বিরূপাক্ষ মন্দিরের অদূরেই রয়েছে আরও দুটো মন্দির – ‘পম্পাদেবী মন্দির’ ও ‘ভুবনেশ্বরী দেবী মন্দির’ ৷

হাম্পির আরেকটা দ্রষ্টব্য হল ‘অরাসরা তুলাভদ্রা’ ৷বলা হয় এইখানে ছিল এক বিশাল ‘তুলাযন্ত্র’ বা ‘দাঁড়িপাল্লা’ ৷ দশেরা বা মহানবমীর দিন দাঁড়িপাল্লার একদিকে মহারাজকে বসিয়ে অন্যদিকে সমপরিমাণে হীরেজহরত ওজন করে সেই মূল্য গরীবদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হতো৷বিজয়বিট্টল মন্দির রয়েছে এর অদূরে ৷ এই মন্দিরের অন্যতম আকর্ষন ‘মিউজিক্যাল পিলার’ বা ‘সুরের স্তম্ভ’ ৷ যদিও প্রায় পঞ্চাশটা স্তম্ভ রয়েছে মন্দিরে, আনুমানিক আট দশটা স্তম্ভ থেকে বেরোয় মৃদঙ্গ, জলতরঙ্গের সুর ৷

কোনার্কের সূর্যমন্দিরের প্রভাব পড়েছিল বিজয়নগরের রাজাদের উপর ৷ তাই একটা পাথরের রথের ধ্বংসাবশেষ দেখা যায় এখানে৷ এছাড়াও বিশেষ দ্রষ্টব্য স্হানগুলির মধ্যে ‘হাজাবোরামা মন্দির’,‘কমল মহল’, ‘পাতালেশ্বর মন্দির’|‘মহানবমী ডিব্বা’ যেখানে বসে রাজারা দশেরার মিছিল দেখতেন সেগুলি উল্লেখযোগ্য৷ রানীদের স্নানাগার, হস্তীশালা, লক্ষ্মীনৃসিংহের মূর্তি, সসীভেকালু গণেশ বা সর্ষেদানার গণেশ দেখলে আজও যেন ইতিহাসের পাতায় স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে যেতে হয় কিছুক্ষণের জন্য৷

হাম্পি শহরটার অদূরে তুঙ্গভদ্রার বিশাল জলরাশির ওপর গড়ে উঠেছে তুঙ্গভদ্রার বাঁধ ৷ একশো ষাট ফুট উঁচু ও দুমাইল বিস্তীর্ন এই বাঁধে রয়েছে একটি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প ৷ এই জলাধারের বাঁদিকে তাকালে একে সমুদ্র বলে ভ্রম হতে পারে ৷ ভালোলাগে এই জলাধারের পাশে প্রায় দুশো ফুট উঁচু একটি টিলা আছে, যার উপর থেকে তুঙ্গভদ্রার অপরূপ সৌন্দর্য্য মন ছুঁয়ে যায় ৷ নদীর তীরে গড়ে তোলা হয়েছে একটি ছোট্ট পার্ক যেখানে রঙ্গীন আলোর খেলা মনে করিয়ে দেয় মহীশূরের ‘বৃন্দাবন গার্ডেন’-এর কথা ৷ উপরিল্লিখিত টিলাটির একটি সুন্দর নাম আছে – ‘বৈকুণ্ঠ’ ৷ এই বৈকুণ্ঠে দাঁড়িয়ে অস্ত রবি কিরণে সেজে ওঠা তুঙ্গভদ্রার রূপ দর্শন এক মনোমুগ্ধকর দৃশ্য ৷

কিষ্কিন্ধ্যা বা বিজয়নগর যাই বলা হোক না কেন, ভারতবর্ষের ইতিহাসে হাম্পির একটা উল্লেখযো্গ্য স্থান রয়েছে তা অনস্বীকার্য ৷ প্রতিটা মন্দির, সৌধ, মূর্তি যেন সেকালের গৌরবময় অধ্যায়ের জাজ্বল্যমান প্রমাণ ৷ কিন্তু আক্রমণের হাত থেকে মুক্তি পায়নি এর অনেক কিছুই৷ বারে বারে বিদেশীরা এসেছে, ধ্বংস করেছে, লুঠ করে নিয়ে গেছে অনেক অমূল্য সম্পদ৷ তবু যে শিল্পকলা আজও স্বদম্ভে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে তা আজও স্বদর্পে ঘোষিত করছে সেকালের ঐশ্বর্য্য, প্রতিপত্তির কথা৷ আর এই শিল্পকলা, স্থাপত্য, এইগুলো তো ভারতবর্ষের অমূল্য সম্পদ, যা যুগযুগান্ত ধরে রচনা করে চলেছে এক সমৃ্দ্ধময় ইতিহাস ৷

পম্পাপতির মন্দিরের পূর্ব দিকে তুঙ্গভদ্রার ধারে ছড়িয়ে আছে সাম্রাজ্যের ধ্বংসাবশেষ। এই পথ ধরে চলতে চলতে পৌঁছে যাওয়া যাবে নদীর ধারে। নদীর ধারের রাস্তা বড়ই মনোরম। তুঙ্গভদ্রা উত্তরে বেঁকে গিয়ে হারিয়ে গেছে পাথরের মাঝে, সেপথে এখানকার বিশেষ ডিঙি নৌকা, বা কোরাকেল করে চড়ে গেলে আনেগন্ডি পৌঁছানো যাবে। নদীর তীর ছেড়ে পাথুরে রাস্তার পথ ধরলে প্রথমে আসা যাবে অচ্যুত রায়ের মন্দির। মন্দিরের পিছনে এখনো নাগদেবী, নাগি পূজিত হচ্ছেন।অচ্যুত রায় মন্দিরের অনতিদূরে সেযুগের ভাস্কর্যের সর্বশ্রেষ্ঠ নিদর্শন, বিঠলস্বামী মন্দির অবস্থিত। বিঠলস্বামী মন্দিরের নির্মাণ কার্য শুরু হয়েছিল রাজা কৃষ্ণদেব রায়ের সময়কালে এবং ১৫৬৫ এর তালিকটার যুদ্ধের সাথে অসম্পূর্ণ অবস্থাতেই রয়ে যায়। মন্দিরের গোপুরাগুলি ইঁট নির্মিত, তবে স্তম্ভধারী কক্ষ, মণ্ডপগুলি পাথরের কারুকার্য মন্ডিত। বেশকিছু জায়গায় প্রাচীন স্থাপত্য পুনঃনির্মান হয়েছে। বহু জায়গায় রামাযান এর লোককথা খোদাই করা হয়েছে। মন্দিরে সামনে পাথরের বিজয়রথ হাম্পির প্রতীকী স্মৃতিস্তম্ভ হয়ে উঠেছে। আগে রথের চাকা গুলিকে ঘোরানো যেত, বর্তমানে সে ব্যবস্থা অচল করা হয়েছে কর্ণাটকের সরকারি দপ্তর থেকে।
বিঠল মন্দিরের সবথেকে আকর্ষণীয় বিষয় এর সুরেলা থাম। মন্দিরের থাম গুলি কোনো বিশেষ পদ্ধতিতে নির্মিত, যাতে আঘাত করলে, থামগুলি নিৰ্দিষ্ট সুর বা "ফ্রিকোয়েন্সি" তে বাজতে থাকে। তবে, শুধু কম্পাঙ্ক (ফ্রিকোয়েন্সি) এক হলেই আশ্চর্যের এমন কিছু হতো না, অদ্ভুতভাবে থাম গুলির "টোনালিটি" বা স্বনতা বিভিন্ন, অর্থাৎ কোনো থাম তার যন্ত্রের মতো বেজে ওঠে, কোনো থাম বেজে ওঠে চামড়ার যন্ত্রের মতো। ব্রিটিশ শাসন কালে এই থাম গুলি পরীক্ষা করা হয়েছিল, তবে এখনো এর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা সঠিক ভাবে করা যায়নি।

বিঠলস্বামী মন্দিরের দক্ষিণে জাতীয় সড়ক। এই রাস্তার ধরে রয়েছে ভীমের দ্বার, জৈন মন্দির। সড়ক সোজা দক্ষিণে এসে পৌঁছবে কামলাপুরমে। কামলাপুরম থেকে ৫০০ মিটার পশ্চিম দিকে এগোলে পৌঁছনো যাবে পবিত্র চত্বর বা "সেক্রেড কমপ্লেক্স" এবং রাজার প্রশাসনিক কেন্দ্র ("রয়াল সেন্টার") । এখানে রয়েছে রানীর স্নানাগার, হাজার রাম মন্দির, প্রশাসনিক কার্যালয়, মহিলাদের অন্তঃপুর ("জেনানা এনক্লোজার"), পদ্ম মন্দির, হাতির আস্তাবল, জৈন মন্দির । প্রতিটি কীর্তিস্তম্ভের নির্মাণ কাজের মধ্যে ইসলামী স্থাপত্যের সংযোজন লক্ষণীয়। রানীর স্নানাগার একটি চতুস্কোন কক্ষ। জানালাগুলি দুটি প্রতিসম অলংকরণে বিভক্ত, এবং উপরি ভাগ তীক্ষ্ন। হাজার রাম মন্দিরের মধ্যে কালো পাথরের মূর্তি শোভাবর্ধন করছে। মহিলাদের অন্তঃপুরের অনেক কারুকার্য ইসলামী স্থাপত্যের নিদর্শন বহন করছে। পদ্ম মন্দিরের গঠন, তীক্ষ্ন চূড়া, খাঁজকাটা জানালা, ভীষণভাবে ইসলামী শিল্পের নির্দেশক। বিজয়নগরের এই অংশগুলি কবে ঠিক তৈরী হয়েছিল, এবং তথাকথিত হিন্দু রাজত্বে ইসলামী কারুকার্যের প্রভাবের ঐতিহাসিক গুরুত্ব নিয়ে বিশেষজ্ঞরা বহু বিতর্ক করেছেন।কামলাপুরমের ঐতিহাসিক স্তম্ভগুলো শেষ হলে আবার রাস্তা ধরে আবার উত্তরমুখে পম্পাপতির দিকে ফিরে আসার পালা। এ পথের ওপর পরবে কৃষ্ণ মন্দির, সাসিভেকালু গণেশ, কাদালেকালু গণেশ এবং নরসিংহ মূর্তি। প্রতিটি মূর্তি একটি মাত্র পাথর কেটে তৈরী করা হয়েছে। কাদালেকালু গণেশ মন্দিরের স্তম্ভের ফাঁক দিয়ে আবার দেখা যাবে পম্পাপতির গোপুরা, দূরে মাতঙ্গ পাহাড়, আর তুঙ্গভদ্রার দীর্ঘশ্বাস।
শুধু মাত্র ঐতিহাসকি পটভূমি ছাড়াও হাম্পিতে পরে আছে অসংখ্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। চারদিকে পাথরের স্তূপ, মাঝে মাঝে কিছু চাষের জমি, কোনো পাথরের স্তূপের ওপর কোনো অজ্ঞাত মন্দির। আর নদীর স্বল্প স্রোতের মাঝে ভাসমান ডিঙি, সেই অজানা মন্দিরের দিকে বেয়ে চলেছে নিজের মনে। বিকেলের পর, বিশেষ করে রোদের তেজ কমে গেলে সমস্ত পরিবেশটা বড়োই মনোরম হয়ে ওঠে। সূর্যাস্তের সময় কোনো এক পাহাড়চূড়ায় উঠে পম্পাপতির পিছনে রক্তাভ আকাশ দেখতে আসে বহু পর্যটক। তবে বহু সূর্যাস্তের সাক্ষী হবার পর, আমার পঁচিশতম শরতের প্রথম সূর্যাস্তের সঙ্গিনী ছিল একাকিনী তুঙ্গভদ্রা, আর একমুঠো অস্তাচলের আলো।
.............
তথ্যসূত্র :-

Fritz & Michell 2016, pp. 11–23, backpage

Lycett, Mark T.; Morrison, Kathleen D. (2013). "The Fall of Vijayanagara Reconsidered: Political Destruction and Historical Construction in South Indian History 1". Journal of the Economic and Social History of the Orient. 56 (3): 433–470. doi:10.1163/15685209-12341314.

Group of Monuments at Hampi, UNESCO

John M. Fritz; George Michell; Clare Arni (2001). New Light on Hampi: Recent Research at Vijayanagara. Marg Publications. pp. 1–7. ISBN 978-81-85026-53-4.

Joan-Pau Rubiés (2002). Travel and Ethnology in the Renaissance: South India Through European Eyes, 1250–1625. Cambridge University Press. pp. 234–236. ISBN 978-0-521-526
 
 

 
............

প্রবন্ধ - সীমান্তে কালো মেঘ - সিদ্ধার্থ পাল

 

 সীমান্তে কালো মেঘ
সিদ্ধার্থ পাল
 
        নিজেদের স্মৃতি থেকে ২০২০ সালকে মুছে ফেলতে এতদিনে হয়তো অনেকেই চেয়েছেন। করোনার সর্বগ্রাসী আতঙ্ক, মৃত্যুর কালো ছায়ায় ঢেকেছে গোটা পৃথিবীকে। জীবন আগে না জীবিকা, সেটা বাছাই করতে গিয়ে ধরাশায়ী হচ্ছে একের পর এক দেশের অর্থব্যবস্থা। লক-ডাউনে গৃহবন্দী মানুষ স্বাভাবিক দিনযাপনের সংজ্ঞা পর্যন্ত ভুলে গেছে। আমাদের দেশেও সেই একই দুরবস্থার ছবি সর্বত্র। তবে ভারতের পরিস্থিতি আরও সঙ্কটাপন্ন। লড়াই এখানে শুধুমাত্র অদৃশ্য ভাইরাসের সাথেই নয়। প্রতিবেশী শত্রুদেশরা পরিস্থিতির সুযোগে হানা দিচ্ছে সীমান্তে। এই নিয়ে টিভি, খবরের কাগজ বা স্যোশাল মিডিয়া, সর্বত্রই মন খারাপ করে দেওয়া সংবাদে তিক্ততর হয়ে উঠছে প্রতিটা দিন। দমবন্ধ করা নিরাশাজনক পরিস্থিতিতে ভরসা হারিয়ে যাচ্ছে সব কিছুর ওপর থেকেই। ও’দিকে, তথাকথিত বিশেষজ্ঞরা উদ্বাহু আস্ফালনে প্রতিনিয়ত মনে করিয়ে দিচ্ছে ৬২’র যুদ্ধে পরাজয়ের গ্লানির কথা। আবার হয়তো সেই কালো দিনগুলোর পুনরাবৃত্তি হবে। করোনা এবং বৈদেশিক শক্তির যূথবদ্ধ আক্রমণে দেশের মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত হবে। চতুর্দিক যখন এতটাই অন্ধকার তখন ভাবলাম একবার খুঁজে দেখতে দোষ কি, সত্যি কতটা কালো ছিল ১৯৬২’র অভিজ্ঞতা। শুধুই কি গ্লানিতে আচ্ছন্ন সেই স্মৃতিগুলো নাকি সেখান থেকেও কুড়িয়ে আনা যায় এমন কিছু ঘটনা যা আমাদের আশার আলো দেখাবে? ইতিহাস থেকে শিখবো ভেবে শুরু করলাম বই ঘাঁটা। লকডাউনের সুযোগ নিয়ে পড়ে ফেললাম ব্রিগেডিয়ার ডালভি’র ‘Himalayan Blunder’, মেজর জেনারেল পালিতের ‘War In The High Himalayas’ এবং লিউটেন্যান্‌ট জেনারেল কাউলের ‘The Untold Story’। দেখলাম, প্রতিটা বইয়ের প্রত্যেক অধ্যায়ে ফুটে উঠেছে সমসাময়িক রাজনৈতিক এবং সামরিক নেতৃত্বের সামগ্রিক বিপর্যয়ের কাহিনী। সাংবাদিক নেভিল ম্যাক্সওয়েলের লেখা ‘India’s China War’ বইতেও সেই অভিন্ন উপাখ্যান অনুরণিত হয়েছে। ভদ্রলোক চীনের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট হলেও মূল বক্তব্য সেই একই। কিন্তু কোনো বইতেই মাটির কাছাকাছি থাকা জওয়ানদের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সংগ্রামের আখ্যান সে’ভাবে খুঁজে পেলাম না। তাঁরা কি এতো সহজেই জমি ছেড়ে দিয়েছিলেন হানাদারদের? এটা তো ভারতীয় সেনার চরিত্র বিরোধী! মানতে পারছিলাম না। অবশেষে হাতে পেলাম শিব কুনাল ভার্মা’র ‘1962 The War That Wasn’t’ বইটি। বুঝলাম, প্রবল ব্যক্তিত্বশালী রাজনৈতিক নেতা বা বুকে অসংখ্য মেডেলধারী সেনাপতি নন, মাটির মানুষ, সাধারণ সেনানীদের নাছোড় লড়াইয়ের ক্ষমতার ওপরে ভরসা করেই আমরা নিশিন্তে ঘুমোতে যেতে পারি। ভাবলাম, তাঁদেরই একটা গল্প আপনাদের সাথে ভাগ করি। অনেকেই হয়তো এই বিষয়ে জানেন, আবার অনেকের কাছেই এটা নতুন তথ্যের ওপরে আলোকপাত করবে। তাই রিপিট করার ঝুঁকি নিয়েও আলোচনা করা যেতেই পারে। চলুন, একবার যাওয়া যাক ৬২’র ঘটনাবহুল দিনগুলোতে।
বর্ষার পরেই অনিবার্য যুদ্ধের কালো মেঘ ঘনিয়ে এসেছিল উত্তর সীমান্তে। দু’দেশের বর্ডারে মুখোমুখি জমায়েত হয়েছে অগুনতি সেনা। খবরের কাগজ বা অন্যান্য মিডিয়াতে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ আস্ফালক মন্তব্য করতে পিছপা না হলেও ভারতের সাধারণ জওয়ান এবং আর্মি লিডারশীপ বুঝতে পেরেছিল সাফল্যের সম্ভাবনা কতটা সীমিত। শীতবস্ত্র, খাবার থেকে আরম্ভ করে প্ল্যানিং, গোলাগুলির সরবরাহ, সর্বত্রই ছিল অভূতপূর্ব দৈন্যদশা। প্রথম গুলি চলার আগেই অবশ্যম্ভাবী পরাজয়ের বিষাদ গ্রাস করেছিল সেনাপতিদের চিন্তাভাবনাকে। অন্যদিকে, কিউবা মিসাইল ক্রাইসিসে বিশ্বের তাবড় শক্তিধর দেশগুলো তখন নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত। ভারত-চীনের বর্ডার সংঘাত নিয়ে তাদের মাথা ঘামানোর সময় কোথায়। বাইরে থেকে সাহায্য আসার সম্ভাবনাও তাই ছিলো না। এই সুবর্ণ সন্ধিক্ষণ হাতছাড়া করেনি চীন। অবশেষে দীপাবলির সাতদিন আগে, ২১শে অক্টোবর ভোর রাতে, ম্যাক্‌মোহন লাইনের নৈঃশব্দ চুরমার হয়ে যায় ‘নামকা চু’ নালার পাশে ‘ঢোলা’ পোস্টের ওপরে তাদের সৈন্যদের হামলায়। ‘থাগ্‌ লা’র শৈলশিরা ডিঙ্গিয়ে, একের পর এক, ঢেউয়ের মতন আছড়ে পড়তে থাকে শত্রুর আক্রমণ। নিচে নালার পাশে, ট্রেঞ্চে প্রতিরোধকারী হতভাগ্য ভারতীয় সেনাদের কোনো সুযোগই ছিল না এই অসম লড়াইয়ের ফল কিছুমাত্র পরিবর্তন করার। আর্মি জেনারেলদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার অকল্পনীয় স্থবিরতার এবং অমার্জনীয় শ্লথতার ফলস্বরূপ একরাতের লড়াইতেই ছত্রখান হয়ে যায় একটা গোটা ব্রিগেড। অপ্রতিরোধ্য চীনা আক্রমণের সামনে অসহায়ের মতন পতন হতে থাকে একের পর এক ডিফেন্সিভ লাইনের। তৈরি হয় একরকম ‘ডুম্‌স্‌ ডে’ পরিস্থিতির। পরেরদিন, অর্থাৎ ২২শে অক্টোবর মধ্যরাতে, ভারত, বর্মা এবং তিব্বতের ট্রাই জাংশন পয়েন্টের কাছে ‘ওয়ালঙ’ এর সীমানাতেও অনুপ্রবেশ আরম্ভ করে চীনা বাহিনী। ১৯৫০ এর ভয়ানক ভুমিকম্পে এই দুর্গম এলাকার নামমাত্র রাস্তাঘাটও সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হয়ে গেছিল। তাই আত্মরক্ষাকারীর পক্ষে সময়ের মধ্যে প্রতিরোধ গড়ে তোলা ছিল চূড়ান্ত কষ্টসাধ্য। ভারতীয় সেনারা অন্তিম বুলেট পর্যন্ত লড়াই করা সত্ত্বেও ‘কিবিথু’ ছেড়ে পিছিয়ে আসতে বাধ্য হয়। শেষ পর্যন্ত ওয়ালঙকে ঘিরে তৈরি হয় পরবর্তী ডিফেন্সিভ লাইন। নিকটবর্তী ‘অশি’ হিলের কাছে চীনে সেনার গতি বিলম্বিত করার দায়িত্ব পড়ে ৬ কুঁমাওনের ‘ডি’ কোম্পানির ওপরে। এর নেতৃত্বে ছিলেন লিউটেন্যান্‌ট বিক্রম সিং রাঠোড়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপান বা জার্মানির সাথে লড়াই করে পদক পাওয়া সেনানায়করা যেখানে সদলবলে খাবি খাচ্ছেন চাইনিজ হানাদারির সামনে, সেখানে এই সদ্য কুড়ি ডিঙ্গানো তরুণের কাছ থেকে বিশেষ কোনো আশা হয়তো কারোরই ছিল না। ‘নামতি’ নালার ওপরে থাকা কাঠের পাটাতন আর দড়ির ব্রিজ ভেঙ্গে দিলেই হয়তো চীনের অগ্রগতি একদিনের মত পিছিয়ে দেওয়া যেত। কিন্তু লিউটেন্যান্‌ট বিক্রম সিংয়ের পরিকল্পনা ছিল ভিন্ন। দুরন্ত বুদ্ধি এবং সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে তিনি প্রথমবার লড়াইকে প্রতিপক্ষের কাছে নিয়ে গেলেন। ব্রিজ একেবারে ধ্বংস না করে, বরং শেষদিকের বেশ কয়েকটা তক্তা সরিয়ে রাখা হল। তারপরে নালার একপাশে, উপযুক্ত যায়গায়, ‘ডি’ কোম্পানির একশ জন সৈন্যের সাথে ত্তৎ পেতে থাকলেন শত্রুর জন্য। তিনি নিজে, প্রত্যেক জওয়ানের পজিশন এবং রাইফেলের নিশানার পাল্লা পরখ করে নিশ্চিত করলেন, সীমিত বুলেট যেন সঠিক ভাবে কার্যকরী হয়। অতএব, প্রায় একশটা আগ্নেয়াস্ত্র এবং কিছু সংখ্যক মর্টার তাক করা রইলো ব্রিজের অপর প্রান্তের ‘চোক’ পয়েন্টের দিকে। বিক্রম সিং, সবাইকে বারবার মনে করিয়ে দিলেন, যতক্ষণ পর্যন্ত তিনি আকাশে ‘ভেরি লাইট’ বা ইলুমিনেটিং রাউন্‌ড না ছুঁড়ছেন, ততক্ষণ যেন কেউ ভুলেও ট্রিগার না টেপে। এইভাবে তৈরি হল ভারতের প্রথম প্রতি-আক্রমণের পটভূমি।
 
         ২৫শে অক্টোবর ভোর ৩টের সময় চাইনিজ অ্যাডভান্সড্‌ কলাম এসে হাজির হল নালার ও’পাশে। প্রচণ্ড কুয়াশায় সে’রাতে দৃষ্টিগোচরতা ছিল সামান্য কয়েক গজ। এক চাইনিজ স্কাউট ঝুলন্ত ব্রিজের দড়ি ধরে পায়ে পায়ে এগিয়ে আসতে থাকলো এই পাড়ের দিকে। ভারতীয় সেনাদের উপস্থিতি নজরে পড়লেই চেঁচিয়ে সবাইকে সাবধান করে দেবে। ব্রিজের এ’প্রান্তে এসে, ভালো করে ঠাহর করতে গিয়ে অন্ধকারে সে খেয়াল করলো না যে সামনের পাটাতন সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। পা ফস্‌কে, প্রচণ্ড আর্তনাদ সহকারে ও হারিয়ে গেলো নিচের খরস্রোতা নালার জলে। সেই চিৎকার কানে যেতেই চাইনিজ’রা সার্চ লাইট জ্বালিয়ে খোঁজ আরম্ভ করলো হতভাগ্য স্কাউটের। কিন্তু এই ঘটনায় তাঁদের অবস্থান উদ্ঘাটিত হয়ে গেলো অ্যাম্‌বুশে অপেক্ষারত শিকারিদের কাছে। নিখুঁত সময়ে বিক্রম সিংয়ের ছোঁড়া ‘ভেরি’ লাইট দিনের আলোর মতন ঝলমলে করে দিলো ‘নামতি’ নালার ‘চোক পয়েন্ট’। মুহূর্তের মধ্যেই রাইফেলের গুলি ঝাঁক বেঁধে ছুটে গেলো সেই দিকে। মর্টারের গোলা আছড়ে পড়তে থাকলো পাথরের আড়ালে লুকোতে চাওয়া শত্রুর ওপরে। আগুনের লেলিহান শিখা গ্রাস করে ফেললো জমায়েত হওয়া ট্রাক বা অন্যান্য ট্রুপ্‌ ক্যারিয়ারগুলোকে। দূরপাল্লার ‘.৩০৩ এনফিল্ড’ রাইফেলের অভ্রান্ত লক্ষ্যভেদে একে একে লুটিয়ে পড়লো হানাদারদের প্রাণহীন দেহ। ধ্বংসাবশেষে ভরে উঠলো নামতির পাথুরে চরা। আগ্রাসনে অভ্যস্ত চীনা বাহিনী প্রথমবার উপলব্ধি করলো শিকার হওয়ার যন্ত্রণা। যুদ্ধটা তারা একতরফা হবে ভেবেছিলো। বাস্তবে তেমন হল কোথায়।
 
        এক ঘণ্টার ক্রমাগত গুলিবর্ষণের পরে লিউটেন্যান্‌ট বিক্রম সিং রাঠোড়ের অ্যাম্‌বুশ পার্টি অকুস্থল ছেড়ে পিছিয়ে আসে। ততক্ষণে, তাঁদের উদ্দেশ্য চূড়ান্ত ভাবে সফল। নালার অপর প্রান্তে বিপুল ক্ষয়ক্ষতির প্রমাণ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। অন্ততপক্ষে দুইশত হতাহতর ধাক্কায় ভোঁতা হয়ে যাওয়া চাইনিজ আক্রমণ আর এ’পথে আগে আসার সাহস পায়নি। তার চেয়েও বড় ব্যাপার, এই তুখোড় প্রতি-আক্রমণ এক লহমায় ওয়ালঙ সেক্টরের ভারতীয় সেনা এবং কমান্ডিং অফিসারদের মনোবল বাড়িয়ে দিল অনেকগুন। সঠিক প্ল্যানিং থাকলে চাইনিজ ব্লিৎস্‌ক্রিগকেও থামানো সম্ভব। আত্মবিশ্বাসে ভরপুর বীর জওয়ানরা দ্বিগুন জোশে ঝাঁপিয়ে পড়ে একপ্রকার রুখে দিল চীনের অনধিকার প্রবেশ। বুলেট শেষ হয়ে গেলে বেয়নেট নিয়ে হাতাহাতি যুদ্ধে পর্যুদস্ত করতে লাগলো প্রতিপক্ষের প্রোবিং পার্টিদের। সম্মান নিয়ে টানাটানি দেখে দেখে চীনের মিলিটারি হাইকম্যান্ড, Chengduআর্মি রিজার্ভের যাবতীয় অস্ত্র, কামান, গোলা বারুদ এবং পদাতিক সেনাকে নিক্ষেপ করলো শুধু মাত্র ওয়ালঙ দখলের জন্য। এ’দিকে জয়ের স্বাদ পেয়ে ভারতীয় কম্যান্ডাররাও দেখলেন অসম্ভবকে সম্ভব করার স্বপ্ন। নাঃ, শুধু ডিফেন্সিভ লড়াই আর নয়। লিউটেন্যান্‌ট বিক্রম সিংয়ের শুরু করার পাল্টা মার’কে বৃহত্তর রূপ দিতে ব্রিগেড লেভেলের কাউন্‌টার অ্যাটাকের পরিকল্পনা করা হল। লোহিত নদীর পাড়ে যদি চাইনিজ আর্মিকে নাস্তানাবুদ করা যায় তাহলে NEFA (North East Frontier Area)’র প্রতিশোধ শুধু সম্পূর্ণই হবে না, দখল বাহিনীকে উৎখাত করাও সম্ভবপর হবে। কিন্তু বিধি ছিল বাম।
অক্টোবর এবং নভেম্বর অভিযানের মাঝের কয়েক সপ্তাহে চীন যখন রিজার্ভ থেকে সৈন্য ঢেলে নিজেদের অবস্থান পাকা করছিল, ভারতের আর্মি হেড কোয়ার্টার ব্যস্ত ছিল ওয়ালঙ সেক্টরের ‘Order Of Battle (ORBAT)’ পরিবর্তন করতে। মাঝের দুই সপ্তাহে ঘনঘন চেঞ্জ করা হয় কমান্ডিং অফিসারদের। বারম্বার অদলবদল করা হয় কোম্পানি আর ব্যাটেলিয়নের অর্গানাইজেশন স্ট্রাকচার। ফলস্বরূপ, অবধারিত ঘাটতি রয়ে যায় প্রস্তুতিতে বা তথ্য সংগ্রহে। শত্রুপক্ষের ব্যাপক আয়োজনের খবরও এসে পৌছায় না কম্যান্ডারদের কানে। ভারতের স্পর্ধা ভাঙ্গতে চীন তার অফুরন্ত ভাঁড়ার নিয়ে দ্বিতীয়বার আক্রমণে উদ্যত হয় ১৪ই নভেম্বরে। তাদের প্ল্যান বানচাল করতে তড়িঘড়ি ওদের পূর্ব পার্শ্বে স্পয়েলিং কাউন্টার অ্যাটাক করে ইন্ডিয়ান আর্মি। উদ্দেশ্য ছিল ইয়েলো এবং গ্রিন পিম্পল নামক দুটি পাহাড় চূড়া থেকে চাইনিজ দখল উচ্ছেদ করা। সফল হলে, পুরো ওয়ালঙ উপত্যকাতেই চীনা অনুপ্রবেশকারী বাহিনীর অবস্থান দুর্বল হয়ে যেত। কিন্তু মোক্ষম সময়ে আবার প্রকট হয়ে পড়লো গোলা-বারুদ, শীতবস্ত্র আর অন্যান্য সামগ্রীর অভাব। সকল বিঘ্ন ডিঙ্গিয়ে, অনেক ক্ষয়ক্ষতির পরে হাতে এলো গ্রিন পিম্পল। তাতেও শেষরক্ষা হল না। ইয়েলো পিম্পলের পাহাড় চূড়া থেকে মাত্র কুড়ি ফুট দূরে নিঃশেষ হয়ে গেলো আমাদের দুর্ধর্ষ অভিযানের সামর্থ্য। যুদ্ধের রসদ শেষ হয়ে যাওয়ায় চীনের প্রতি-সংহারের হাত থেকে বাঁচার কোনো উপায় থাকলো না। একে একে নির্মূল হয়ে যেতে থাকলো প্রতিরোধের অবশিষ্ট অংশগুলোও। শত্রুর সাঁড়াশি আক্রমণে ওয়ালঙে ব্রিগেড হেড কোয়ার্টার নিশ্চিত ধ্বংসের সম্মুখীন হয়ে দাঁড়ালো। এমতাবস্থায় ওয়ালঙের পশ্চিম পার্শ্ব টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব গিয়ে পড়লো বিক্রম সিংয়ের বিশ্বস্ত চওড়া কাঁধে। ব্রিগেডিয়ার সাহেবের আদেশ এলো, ১৬ই নভেম্বর সকাল ১১টা পর্যন্ত যে করে হোক আটকে রাখতে হবে চীনের আগ্রাসন। ব্রিগেডের বাকি সৈন্যরা এই সুযোগে অর্গানাইজড, ফাইটিং উইথড্রয়াল করতে পারবে। বিক্রম সিং এবারেও অক্ষরে অক্ষরে নির্দেশ পালন করলেন। ‘ডি’ কোম্পানির সৈন্যদের পাশে নিয়ে সারাদিন তুমুল লড়াইতে আটকে রাখলেন হাজারেরও বেশি হামলাকারীদের। লড়াই ছেড়ে পিছিয়ে আসার অনুমতি তিনি যতক্ষণে পেলেন ততক্ষণে অধিকাংশ সাথীই শহীদ হয়ে গেছেন। বিক্রম সিংয়ের মরিয়া প্রতিরোধে, শত্রুর ঘেরাবন্দি ভেঙ্গে পশ্চাদপসরণ করার সুযোগ পায় গুরুতর আহত অবশিষ্ট সতেরো জন। দিনাবসানে ক্লান্ত চীনা বাহিনী তাঁকে ঘিরে ফেলে। তীব্র কিন্তু নিস্ফল ক্ষোভে, বুলেট দিয়ে ঝাঁঝরা করে দেয় তাঁর বাইশ বছরের চির তরুণ দেহ। ৬ কুঁমাওনের প্রতিরোধ শেষ হওয়ার সাথে সাথেই চীনের কাছে ওয়ালঙের পতন হয়।
 
         ইতিহাসের বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে মুষ্টিমেয়র বীরত্বের অবদান কতটা? যেখানে যুগোপযোগী অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের সম্ভার সেখানে ব্যক্তিবৈশিষ্ট্যের কিই বা ভূমিকা থাকতে পারে। তাঁদের নামে বীরগাঁথা রচিত হয় হয়তো, কিন্তু প্রকৃত ফলাফলে কোনো সুদূরপ্রসারী প্রভাব থাকে কি? আপাতদৃষ্টিতে অর্বাচীন মনে হলেও এমন উদাহরণ কিন্তু বিরল নয় যেখানে একটি স্বল্পবর্ণীত চরিত্র বা তাঁকে ঘিরে গড়ে ওঠা ঘটনা আমূল বদলে দিয়েছে জাতি বা দেশের ভবিষ্যতকে। কয়েক সহস্র বছর আগে, ঝিলম নদীর তীরে, পুরুর সাথে মরণপণ যুদ্ধের শেষে আলেকজান্ডার কঠোর বাস্তবের মুখোমুখি হয়েছিলেন। বোধকরি তেমনই, লিউটেন্যান্‌ট বিক্রম সিং রাঠোড়ের রণহুংকারে নিজেদের আসু দুর্ভাগ্যের ছায়া দেখতে পেয়েছিল ৬২’র আগ্রাসীরা। মাউন্টেন ওয়ারফেয়ারের সব রকম রসদ থেকে বঞ্চিত ভারতীয়দের সরিয়ে ওয়ালঙ দখল করা খুবই ব্যয়বহুল অভিযানে পরিণত হয় চীনের কাছে। তদের হাজারেরও বেশি সেনা প্রাণ হারায়। আহত হয় আরও অনেক। Pyrrhic victory বোধকরি একেই বলে। আসামের সমতল থেকে এমন বহু বিক্রম সিংরা বদলা নিতে ছুটে আসছে জেনে একতরফা যুদ্ধ বিরতি ঘোষণা করে তারা। ফেলে চলে যায় সমস্ত বিজিত জমি। সেই থেকে চীনের অরুনাচল দখলের হুংকারে বাহ্যিক আস্ফালন ছাড়া আর কিছুই দেখা যায় নি। কে বলতে পারে, বছর বাইশের সেই তরুণ হয়তো একা হাতেই বদলে দিয়েছিলেন তৎকালীন NEFA তথা অধুনা অরুনাচল্প্রদেশের ভাগ্য।
ফিরে আসা যাক বর্তমানে। বসন্তের শুরু থেকেই অতিমারির ভয়াবহতায় প্রশাসন থেকে শুরু করে সামরিক বাহিনীও যথেষ্ট বিক্ষিপ্তচিত্ত রয়েছে। তার ওপরে, পশ্চিমে পাকিস্তানের সাথে নিত্যদিনের দ্বৈরথে ব্যস্ত থাকার দরুন অবহেলিত হয়েছে চীনকে সামলানোর কৌশল। পুনরায় সুযোগের সদ্ব্যবহার করলো তারা। সামরিক মহড়ার অছিলায় তিব্বতে হাজির হওয়া চীনের হাজার হাজার সৈন্য, বিনা প্ররোচনায় অতি দ্রুততার সাথে মোতায়েন হল লাদাখে। এর সাথেই তারা আবর্জনায় ছুঁড়ে ফেলল লাইন অফ অ্যাক্‌চুয়াল কন্ট্রোলের স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে, কয়েক দশক ধরে, দুই দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তিগুলোকে। সেই থেকে, প্রতিনিয়ত যুদ্ধের হুমকি দিয়ে অবদমিত করে রাখতে চাইছে বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের আত্মমর্যাদাকে। হাইব্রিড ওয়ারফেয়ারের সূত্রানুসারে মীরজাফরের দলও নড়েচড়ে বসেছে। সংবাদপত্রের পাতাজোড়া বিজ্ঞাপনে চীনের গুণকীর্তন চলছে। যেকোনো যুদ্ধে ভারতবর্ষের অস্তিত্ব যে অনায়াসে বিপন্ন হবে সেটা প্রমাণ করতে গিয়ে তারা বারবার তুলে আনছে ১৯৬২’র উদাহরণ। কিন্তু সেই একই উদাহরণ বিস্তারিত ভাবে জানলে দেখা যাবে চীন সেদিনও কোনো ওয়াকওভার পায়নি। এখনও পাবে না। অনেক পরিবর্তন এসেছে বরং ওদের ক্ষয়ক্ষতি সহ্য করার ক্ষমতার। আজ অনেক বেশি ইনসিক্যুরিটি তে ভুগছে চাইনিজ কম্যুনিস্ট পার্টি। সামান্যতম বিপর্যয়ের খবর যাতে জনগণের কাছে না পৌছায় তার জন্যে চতুর্দিকে বিপুল সেন্সরশিপের আয়োজন। এতো কিছু করেও আটকাতে পারছে না হংকংয়ের গণ-আন্দোলনকে। এই পরিস্থিতিতে গালওয়ানের খণ্ডযুদ্ধ যেমন চাইনিজ জুজু মুছে দিয়ে এ’দেশের প্রশাসনকে নড়েচড়ে বসতে বাধ্য করেছে, তেমনই চীনের মনেও সেই পুরনো ভয় নতুন করে ঢুকিয়ে দিয়েছে। বিক্রম সিং রাঠোড়রা এখনও অতন্দ্র প্রহরীর মত দাঁড়িয়ে আছে সীমানা জুড়ে। শুধু যদি যুদ্ধের রসদের জোগান ঠিক থাকে তাহলে যেকোনো অসাধ্য সাধন সম্ভব তাঁদের পক্ষে। ইন্ডিয়ান আর্মির বিভিন্ন ভিডিওতে তাই ঘুরেফিরে দেখা যাচ্ছে লজিস্টিক্সকে কতটা গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে এবারে। তারসাথে, অভাবনীয় দ্রুত গতিতে পাহাড় কেটে তৈরি হচ্ছে টানেল এবং রাস্তা। নদীর ওপরে বসছে নতুন ব্রিজ। অস্ত্রশস্ত্র নয়, ১৯৬২ আর ২০২০র মধ্যে এগুলোই সবচেয়ে বড় তফাৎ।
 
         আগামী তিন মাস (নভেম্বর থেকে জানুয়ারি) খুবই গুরুত্বপূর্ণ আমাদের কাছে। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের সাথে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ডামাডোলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ব্যস্ত থাকবে নিজেকে নিয়েই। এ’দিকে, ভারতের প্রস্তুতিতে কণামাত্র ঢিলেমি দেখলেই আঘাত হানবে শত্রুরা। এ’বারের আক্রমণ হবে তিন দিক থেকে সমন্বিত ভাবে। পশ্চিমে পাকিস্তান, উত্তরে চীন এবং দেশের ভিতর থেকে অন্তর্ঘাতীরা। সীমানা রক্ষার দায়িত্বে রয়েছেন বিক্রম সিংদের উত্তরসূরিরা। চোখ বন্ধ করে ওঁদের ওপরে ভরসা করা যাবে। আপামর দেশবাসীকে বরং সতর্ক থাকতে হবে যাতে জাতি বা ধর্মীয় দাঙ্গায় উৎসাহ প্রদানকারীরা সুযোগ না পায়। ধর্ম, বর্ণ, জাতপাত নির্বিশেষে সবাই একে অন্যের হাত ধরে থাকলে ভারতের অমঙ্গল চাইবে এমন সাধ্য কার?
..................................