প্রেমের গল্প লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
প্রেমের গল্প লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

যে আলো আঁধার ছুঁয়েছে - দেবাশীষ তালুকদার

 

 যে আলো আঁধার ছুঁয়েছে
দেবাশীষ তালুকদার
 
 
       আমার উত্তপ্ত মিডিয়াম সাইজ ল্যাটেতে আমি যখন গভীর মনোযোগের সাথে চকোলেট পাউডার মেশাচ্ছিলাম, সোহম ততক্ষনে ক্যাফের একটা উইন্ডো সীটে বসে পড়েছে। আমি কফিতে ছোট্ট একটা চুমুক দিয়ে তার দিকে এগিয়ে যেতেই সে তার দু ভুরু নাচিয়ে বলল,
— “শ্রেয়সী, সত্যিকারের ভালবাসায় তোমার বিশ্বাস আছে?”
আমি ফিক করে হেসে জানলার বাইরে তাকালাম। সূর্যটা ততক্ষনে ডুবে গেছে। গোধূলির সূর্যবিদায়ের তখন অনেক রঙ। সোহম টেবিলে আলতো নক করতেই আমি তার চোখে চোখ রেখে বললাম,
— “তোমরা আমেরিকায় বড় হওয়া কিডজ্ আবার সত্যিকারের ভালবাসার ধার ধারছো কবে থেকে? তোমাদের তো কারোর চোখের দিকে তাকালেই প্রেম হয়ে যায়!”
সে হতাশভাবে মাথা নেড়ে বলল,
— “ওহ্ শ্রেয়সী! not again!”
আমি মুচকি হেসে বললাম,
— “ঠিক আছে! কিন্তু সোহম, আমার যে ট্রু ফলস্ কোনরকম ভালবাসাতেই বিশ্বাস নেই! যত যাই বল ওসব ‘তোমাকে ছাড়া বাঁচব না’- টাইপ ভালবাসার দিন পৃথিবীতে আর নেই।“
— “কখনো প্রেমে পরোনি? সিরিয়াসলি...?”
— “কে বলেছে পরিনি? অনেকবার পরেছি।“
সোহম সব কটা দাঁত বের করে বলল,
— “ওয়াও! তবে শুনতে চাই ম্যাম!”
আমি কফিতে বিরাট একটা চুমুক দিয়ে বললাম,
— "তুমি কতক্ষণ শুনতে পারবে বলে মনে কর?”
— "তুমি যতক্ষণ বলতে পারবে বলে মনে কর!”
আমি অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে বললাম,
— "সোহম, টিনেইজ লাইফে আমি প্রথম যার প্রেমে পড়েছিলাম, সে আমার বাড়ির সামনে রোজ বিকেলে ক্রিকেট খেলতো। সে খেলতো আর আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে চিল্ করতাম। তার ঠিক এক সপ্তাহ পর আমি আবিষ্কার করলাম, ক্লাস এইটে পড়ুয়া সেই ইচড়েপাকা ছেলেটির একটি গার্লফ্রেন্ড আছে।… তোমার এইসব লেইম স্টোরি শুনতে ভাল লাগছে?”
— “না লাগছে না, এসব ষ্টুপিড স্টোরি সবার লাইফেই মোটামুটি কমন। আমি তোমার ট্রু লাভস্টোরি শুনতে চেয়েছি!!”
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম,
— “ট্রু..? আমি তোমাকে আগেই বলেছি সোহম, ওসব ট্রু লাভস্টোরি বলে পৃথিবীতে কিছু নেই।”
— "কিছু নেই’....কথাটির পেছনেও অনেক কিছু থাকে....তাইনা??”
 
       আমি ঠোঁট চেপে এক মুহুর্ত চুপ করে সোহম এর দিকে তাকিয়ে থাকি। আমার চাইতে ভাল আর কেউই বোধহয় জানেনা, যে এই সোহম ছেলেটি আমাকে এভারেজের থেকে একটু বেশিই পছন্দ করে। আমেরিকার এই নিঃসঙ্গ জীবনে আমি যখন বন্ধুহীনতায় মোটামুটিভাবে নিজেকে একঘরে করে ফেলছিলাম, ঠিক সেই সময়েই সোহম এর সাথে আমার পরিচয়। এই 'ভালবাসা' বা 'প্রেম' বিষয়ে আমার বাজে ধরনের অভিজ্ঞতা না থাকলে এতদিনে আমি হয়ত ওকে ভালোবেসে ফেলতাম। আমার ওপর এই সোহমের এতটা আন্তরিক অনুভূতি থাকবার পরেও কিন্তু ও আমার নিজের চারপাশে তুলে রাখা দেয়ালটা কখনও ভেঙ্গে ফেলার চেষ্টা করেনি। দেয়ালের ওপাশে থেকেই সে আমার সঙ্গে থাকে, আর অপেক্ষা করে এই ভেবে– কোনদিন হয়ত আমি নিজেই তাকে দরজা খুলে হাত বাড়িয়ে দেব। আমি আমার প্রচন্ড আক্ষেপটাকে চেপে রেখে সোহম এর দিকে তাকালাম। কেন যে আমি এই ছেলেটিকে এখনও ভালবাসতে পারিনা..! ক্ষনিকের আটকে রাখা দীর্ঘশ্বাসটা ছেড়ে দিয়ে বললাম,
— "সোহম, আমার জীবনের একমাত্র সত্যিকারের ভালবাসাটি এসেছিল ঠিক পঞ্চমবার, কারো ব্যাক্তিত্বে মুগ্ধ হবার পর। আমি ছেলেটিকে প্রচন্ড ভালবাসতাম, হ্যা! ঠিক যেমন করে সিনেমার নায়িকারা সব ভুলে গিয়ে প্রেমিকের জন্য মরে যেতে চায়, আমি তাকে ঠিক তেমন করেই ভালবাসতাম। অথচ আমার জীবনের সেই সত্যি ভালবাসাটি কদিন টিকেছিল জানো? কেবলমাত্র সাত মাস সতেরদিন। সে চলে যাবার পর আজ অবধি কেটে গিয়েছে সাড়ে ছয় বছর…! অথচ দেখ, আমি দিব্যি বেঁচে আছি। তাই my dear সোহম, এই মুহুর্তে তোমাকে সাক্ষী রেখে আমি শ্রেয়সী, শপথ করে বলছি– 'এ পৃথিবীতে সত্য ভালবাসার গল্প বলে কিচ্ছু নেই!'"
সোহম কিছুক্ষণ থমথমে একটা ভাব নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। আর আমি হাসিমুখে দুইহাত দিয়ে কফিমগের উষ্ণতা নিতে থাকি।
--- "জানো সোহম সত্যিই কি অবাক করা ব্যাপার! এতগুলো দিন চলে যাওয়ার পরেও অনির্বাণের কথা ভাবলে আজও আমার চারপাশটা কেমন যেন শীতল হয়ে আসে! অনির্বাণ কিংবা তার স্মৃতি, ধীরে ধীরে তার সব কিছুই অস্পষ্ট হয়ে এসেছে আমার মন থেকে। তার অপলক চেয়ে থাকা চোখ, ঠোঁটের এককোণ বাঁকানো হাসি, হাসবার অছিলায় তার ডানদিকে তাকিয়ে ছাড়া দীর্ঘশ্বাসের শব্দ!! আমি কি তাকে ভালবাসিনি? অথচ এতটা ভালবাসা দেবার পরেও সে আমার হয়ে কখনো থাকেনি...।"
— "কেন থাকেনি সে?”
— "ক্যারিয়ার। এই ড্যাশিং স্টেটসের হাতছানি আর কে রুখতে পারে বলো? আমিতো কোন ফ্যাক্টরই ছিলাম না! নিজের ক্যারিয়ারের জন্য এত দূরে চলে আসবার ডিসিশান সে যখন একাই নিয়ে ফেলেছিল, আমি তখন তার জন্যে ছিলাম শুধুই একটা দেওয়াল, যাকে সে অবলীলায় ভেঙ্গে যেতে পারে, যাকে ভেঙ্গে যাওয়ার দায়বদ্ধতায় একটা সেকেন্ডেও তার চোখের পাতা কখনও ভিজে উঠবেনা!”
— “কষ্ট হয়নি?”
— “হাসবে। শুনলে তুমি হাসবে।”
সোহম অপরাধীর মত মুখ করে বলল,
— “হাসব কেন?”
আমি ওর চোখ থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে বললাম,
— "আমাদের সাত মাস সতের দিনের সম্পর্ক যখন শেষের দিকে, আমি তখন দাঁতে দাঁত চেপে রাত কাটিয়ে দিতাম। আমাকে কেউ কোনদিন কখনো কাঁদতে দেখেনি, সেই আমি রাতের পর রাত চোখের জল ফেলতাম। কেউ সেটা দেখেনি, তাই সবটুকু অপারগতা নিজের কাছে রেখে আমি চলে এসেছিলাম।”
— “তারপর?”
— "অনির্বাণের জন্য আমি যেদিন শেষবারের মত কেঁদেছিলাম, সেদিন কলকাতা শহরের বুকে প্রচন্ড শীত নেমেছিল। বাসে জানলার পাশের একটা সিটে বসে আমি সেদিন দুহাত শক্ত করে আমার মোবাইলটাকে চেপে ধরেছিলাম, যে মোবাইলে আসা একটি টেক্সটে অনির্বাণ আমাকে জানিয়েছিল,
– 'ভালবাসা নামক একঘেয়েমিতে তার এখন বিরক্তি চলে এসেছে, আমি যেন তাকে আর ধরে না রাখি'। টেক্সট্ পড়া শেষ হতেই সেদিন আমার চোখ থেকে শেষ কয়েক ফোঁটা কষ্ট ঝরে পরেছিল। তারপর থেকে অনির্বাণের জন্য আমি আর কোনদিন কাঁদিনি! সেই শেষবারের মতো কাঁদবার ঠিক দুদিন পর আমি অনির্বাণকে নিজে ডেকে বলেছিলাম— ‘অনির্বাণ, তুমি মুক্তি চাও? যাও আমি তোমাকে মুক্তি দিলাম।’ সোহম, আমার ট্রু লাভস্টোরির সেখানেই এন্ডিং হয়েছিল!”
 
      এতটুকু বলবার পর সোহম এর সামনে আমি সেদিন আর একটা কথাও বলতে পারিনি। আমার নিজেকে সেদিন সম্পূর্ণভাবে ব্ল্যাংক মনে হচ্ছিল। ফল সিজনের সেই হালকা শীত আমাকে প্রচন্ড রিক্ততায় মেরে ফেলতে চাইছিল যেন! কেন জানিনা, সোহমও সেদিন আর কিছু জানতে চায়নি, চুপচাপ আমাকে তার জ্যাকেটে জড়িয়ে আমাকে আমার ফ্ল্যাটে ড্রপ করে এসেছিল। অথচ আমার কথাগুলো আমি সেদিন শেষ করতে পারিনি। সোহম আমার কাছে যে সত্যি ভালবাসার গল্প শুনতে চেয়েছিল, সেই ভালবাসার অকল্পনীয় মৃত্যুকে আগলে রেখে আমি কিভাবে আজও বেঁচে আছি– সেই গল্পগুলো আমার ওকে বলা হয়নি। আমি হয়ত ড্রাকুলার মতই একাকী জীবন্মৃতের জীবন বেছে নিয়েছিলাম। আমাকে আমার নিজের হাতে শপে দিয়ে অনির্বাণও হয়ত ভাল কাজটাই করেছিল। তাই হয়তো নিজেকে নিয়ে আমি এখন ভালই আছি। যে ক্যারিয়ারের জন্য অনির্বান বহুদুরে চলে গিয়েছিল, আমিও সেলফিশের মত সেই ক্যারিয়ারকে কেন্দ্র করেই একদিন বাড়ি ছেড়েছিলাম। তবে একটা ব্যাপার কি পাঠক জানেন, নিজেকে এই পৃথিবীতে খুব অযোগ্য মনে হলে অনেক দূরের কোন দ্বীপে কাউকে নিয়ে বেঁচে থাকবার মতো একটা স্বপ্ন থাকতে হয়। খুব অলস দুপুরে পৃথিবীতে যখন বৃষ্টি নামে না – কল্পনার সেই দ্বীপে তখন প্রিয় মানুষটির সাথে বৃষ্টিতে ভেজা যায়। অনির্বাণ চলে যাবার পর আমার সে স্বপ্নটা আর নেই।
এরপর আকাশ নীল থেকে লাল হল, আর লাল থেকে আঁধার– আর আমিও ভুলে গেলাম যে, আমারও একটা আকাশ ছিল।
প্রিয় অনির্বান, আমি এখন আর ভুল ভেবে ভুল করিনা। আমি এখন বুঝতে শিখেছি, হালকা রঙের আলতো রোদও বরফ নদীর মত শীতলতা ছড়াতে পারে। এখন চাইলেও তুমি আমাকে আর রাংধনু দেখাতে পারবে না। আমার আকাশে এখন আর কোন বৃষ্টি নেই, আমার সব না পাওয়াগুলো এখন শুধুই শুভ্র, ঠিক তুষারের মতন। আমার চারপাশের পৃথিবীটা ছোট হতে হতে আমার জানলার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে, আমিও সেই জানলার পাল্লা এঁটে দিয়েছি চিরদিনের মতো। অনির্বাণ, আমি যে চিরকাল আঁধার ভালবেসেছি, আলোতে আমার কেমন করে পোষাবে বলো? আমার এই আঁধারেই সোহম একটু একটু করে আলো জ্বালিয়ে এসেছে অনেকদিন ধরে। আমি ওকে আগে কোনদিন বলিনি আমার একটা গল্প আছে। এখানে আসবার পর আমি যখন সবকিছু থেকে নিজেকে সরিয়ে রেখেছিলাম, এই সোহম তখন আলোর মত ঝলমল করা হাসিমুখ নিয়ে আমার পাশে বসে থাকত। প্রথমদিকে আমি বিরক্ত হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বলতাম,
— "সোহম, তুমি সর্বক্ষণ এইভাবে যে আমার পাশে বসে থাকো, সেটা কিন্তু একটুও মানায় না, জানো সেটা?”
সোহম ফাটা বেলুনের মত চুপসে গিয়ে বলত,
— "তুমি এত রেসিস্ট, শুধুমাত্র আমার গায়ের রঙ ফর্সা নয় বলে তুমি আমাকে বেমানান বললে?”
— "তুমি কি ইচ্ছে করেই এমন করো? এত হাসিখুশি একটা মানুষ হয়ে আমার মত বোরিং পাবলিকের সাথে কি করে মিশছো?”
— "আমার যে ভাল লাগে, আমি কি করতে পারি?”
আমি সোহম এর এই অসম্ভব ইনোসেন্ট কথাবার্তায় আটকে যাই। সেই তো, আমরা মানুষরা বড় অসহায়; আমাদের ভাল লাগলে – আমরা কি করতে পারি?
সোহমকে এরপর আমি আর “না” করতে পারিনি। তার ভাল লাগে আমার সাথে থাকতে, আর ওর এই ভাল লাগার স্বীকৃতিটা আমি যদি নাও দিতে পারি, তবুও সে একইভাবে থাকবে আমার সাথে। ওর কি এভাবে বাঁচতে পেরেও ভাল লাগবে! কে জানে!
কিন্তু সেদিনের সেই সন্ধ্যায়, আমাকে বাড়িতে ছেড়ে আসবার পরদিন থেকে প্রায় দুই সপ্তাহ, ছেলেটা যেন বেমালুম গায়েব হয়ে গেল। আমার গল্প শুনে ও কি কোন আঘাত পেয়েছে তবে!!
আমার কখনো মন খারাপ হলে আমি আমার বাড়ির কাছে ছোট্ট একটা পাহাড়ে চলে যাই। উঠতে পারা যায় এরকম মোটামুটি একটা টিলার উপর গিয়ে আমি লম্বা হয়ে শুয়ে থাকি। কখনও চিৎকার করি, আবার কখনো বাকি সময়টাতে ছবি আঁকি। আমাকে ফলো করে সোহম একদিন চলে এসেছিল এখানে। আমি বিরক্ত হয়ে ওকে চলে যেতে বলায় ও কাচুমাচু হয়ে বলেছিল,
— "মনে কর, সোহম কোন মানুষ নয় – আমি সোহম একটা পাহাড়। কোন ফাংশান নেই। তবু থাকি!!”...
আজ আকাশের নিচে শুয়ে শুয়ে ওর ওই কথাটা মনে পরতেই ফিক করে হেসে ফেললাম আমি। পাশে তাকিয়ে সোহম নামের সেই পাহাড়টিকে দেখার খুব ইচ্ছে হল আমার। সত্যি! মানুষের মন কি বিচিত্র একটি জিনিস! কোইন্সিডেন্স কিনা জানিনা, ঠিক মিনিট পাঁচেক পরেই আমার মোবাইলে সোহম এর একটি কল এলো। আমি ফোন রিসিভ করতেই সে আলতো গলায় বলল,
— " শ্রেয়সী, আমি তোমার কাছ থেকে একটু সময় চাইতে পারি? তোমাকে একটা গল্প বলার ছিল।”
আমি আমার দীর্ঘশ্বাস আটকে বললাম,
— "সোহম, অনেক দিন তোমাকে দেখিনি! আমি আজ তোমাকে দেখতে চাই।“
সোহম যখন আমার পাশে এসে বসল, আমি বুঝতে পারলাম যে এই সোহমকে আমি আগে দেখিনি। আমি তাকিয়ে আছি বুঝতে পেরেই ও একটু ইতস্তত করে বলল,
— "ইয়ে আমি ঠিক আছি । আমি......”
আমি চোখ ফিরিয়ে নিয়ে বললাম,
— "তোমার গল্পটা?“
সোহম এর দৃষ্টি হঠাৎ করে কোথায় যেন চলে গেল, তারপর আমার দিকে না তাকিয়েই ও বলতে শুরু করল--
— "আমার গল্প, একজন শ্রেয়সীর কিংবা একজন অনির্বানেরই গল্প। আমি যখন আন্ডারগ্র্যাড কোর্স শেষ করলাম, তখন একটা ফ্যামিলি ট্যুরে দেশে গিয়েছিলাম দুই মাসের জন্য - বাবার বেস্ট ফ্রেন্ডের বাড়িতে ছিলাম সেই সময়টা। সপ্তাহ দুয়েক যেতেই আমি লক্ষ্য করলাম, আমার ছোটবোন শোহিনী কোন একটা ব্যাপারে কেমন যেন বিহেভ করছে। প্রথমটায় টিনেইজ মেন্টালিটি ভেবেই উড়িয়ে দিয়েছিলাম, কিন্তু পরে বুঝতে পারি প্রবলেমটা আসলে অন্যকিছু। প্রথমবার দেশে বেড়াতে এসে শোহিনী প্রেমে পড়ে গিয়েছিল বাবার সেই বন্ধুর ছেলের। আমি গোপনে খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারলাম ছেলেটি ইতিমধ্যেই একটি রিলেশানে আছে। ওর নাম ছিল অনির্বান। শ্রেয়সী নামের একটি মেয়ের সাথে তার রিলেশান।“
আমি তখনো আঙ্গুল দিয়ে মাটির উপর নকশা কেটে চলেছি। সোহম যখন এইটুকু বলে থেমে গেল, আমি একবারের জন্যেও বিচলিত না হয়ে বললাম,
— "চুপ করে থেকো না, সোহম আমি শুনছি।“
— "আমি যখন শোহীনি কে ডেকে সত্যি কথাটা বললাম – শোহিনী বুঝল। বলল, এই ভালোবাসার অনুভূতিকে আর সে মনে ধরে বসে থাকবেনা। আমি নিশ্চিন্ত হলাম আর এরই মধ্যে আমাদের আবার ফিরে যাবার সময়ও হয়ে এল। আমেরিকা ফিরে এসে সবাই সবার মত কাজ কর্মে ব্যস্ত হয়ে গেলেও আমি লক্ষ্য করলাম, শোহিনী আর আগের মত নেই। সে যদিও বোঝাতে চাইছে যে সে ঠিকঠাক আছে, নিজেকে সামলে নিয়েছে। কিন্তু আমি জানতাম – ওর আসলে কিছুই ঠিক নেই। ওর পড়াশুনা, খাওয়া দাওয়া– সবকিছুই ব্যালেন্স হারাতে লাগল। একদিন মাঝরাতে ও সুইসাইড এটেম্পট করতে গেলে, আমি ভাগ্যক্রমে উপস্থিত হয়ে যাওয়াতে ওকে বাঁচাতে পারলাম। আমার কাছে ধরা পড়ে যাওয়ায় শোহিনী বলতে বাধ্য হল, সে আর থাকতে পারছেনা। অনির্বানের সাথে তার এখনো মেসেঞ্জারে কন্ট্যাক্ট হয়। সে নাকি ওকে তার লাভারের ছবিও দেখিয়েছে। ওর এতকিছু মেনে নেওয়া কঠিন হয়ে যাচ্ছে। আমি হতভম্ব হয়ে শোহিনীর দিকে তাকিয়ে থাকি – ওকে এভাবে হয়ত কেউ কোনদিন কাঁদতে দেখেনি। সেদিন ওর কান্না দেখে আমি প্রচন্ড বাজে একটা ডিসিশান নিই – আমি ঠিক করি, যে কোন মূল্যেই হোক না কেন অনির্বানকে আমি শোহিনীর কাছে নিয়ে আসব। আর এরপর অনির্বানের সাথে আমার ফ্রেন্ডশিপ – ওকে দেশের বাইরে আনার ব্যাপারে যত প্ররোচনা দেওয়া যায় সবটাই আমি করতে লাগলাম দিনের পর দিন। প্রথমদিকে ওর যে খুব একটা আগ্রহ ছিল তা নয়, কিন্তু ইউনিভার্সিটিতে ওর রেজাল্ট যখন মনমত হল না, তখন ও আস্তে আস্তে নিজের ডিসিশান বদলাতে শুরু করল। ওর ডিসিশান যখন পেরেন্টস পর্যায়ে চলে গেল, তখন আমাদের দুই ফ্যামিলি মিলে ওর ডিসিশানের রোডওয়ে টা আরেকটু ইজি করে দিল। আর সেই ইজি রোডওয়েটা ছিল – শোহিনীর সাথে অনির্বানের বিয়ে।“
এতটুকু শুনেই চোখ বন্ধ করে ফেললাম আমি । দাঁতে দাঁত চেপে বললাম,
— "আমার আর শুনতে ইচ্ছে করছে না, সোহম“ সোহম মাথা নেড়ে বলল,
— “না, আমাকে বলতেই হবে শ্রেয়সী, সেই বিয়ের রাতেই আমি প্রথম বুঝতে পারি, যে শোহিনীর জন্য আমি আরেকটি মেয়ের সাথে কি ভীষণ অন্যায় করে ফেলেছি! আমার সেই অপরাধবোধ আমাকে প্রতিটা দিন শাস্তি দিতে থাকে। প্রায়শ্চিত্ত করব বলে আমি শ্রেয়সীকে খুঁজে বের করি। দূর থেকে তাকে যখন আসতে দেখতাম, আমার ইচ্ছে করত – আমি দু হাত জোড় করে তার কাছে ক্ষমা চাই। কিন্তু আমি পারতাম না। শেষ পর্যন্ত মেসেঞ্জারে তার সাথে কন্ট্যাক্ট করি। শ্রেয়সী, আমি আমার পরিচয় তোমাকে দিতে পারিনি। কিন্তু তোমার কি সেই মানুষটিকে মনে আছে যার সাথে কখনও দেখা হবেনা বলে তুমি তাকে তোমার সব কথা বলেছিলে? আমি জানিনা, তুমি ভুলে গেছ কিনা – কিন্তু ততদিনে আমি আরও একটি অন্যায় করে ফেলি। আমি বুঝতে পারি, আমার এ জীবনের সব ভাললাগা আমি তোমায় দিয়ে ফেলেছি। যখন সবকিছু তোমাকে বলতে যাব, ঠিক তখনই ভাগ্য তোমাকে নিজে থেকেই আমার দুয়ারে এনে দিল। তুমি জানালে, যে তুমি দেশের বাইরে আসছো আর যে জায়গায় আসার কথা বললে আমি ঠিক সেখানেই থাকি। আমার অপরাধী মন আবার চাইল, সব নতুন করে শুরু করতে। আমি মেসেঞ্জার অফ করে দিলাম – তোমাকে সরাসরি এপ্রোচ করলাম নতুন পরিচয়ে। কিন্তু দেখ, তবুও তুমি আমাকে ভালবাসতে পারলে না। তোমার অজান্তেই আমি তোমার সমস্ত দুঃখের কারন – অথচ তুমি সেটা বুঝতেও পারলে না। কিন্তু আমি আর তোমাকে ঠকাতে পারলাম না শ্রেয়সী। এই মুহুর্তে তোমার সবচেয়ে ঘৃণার মানুষটি যদি আমি হয়ে থাকি, আমি একটুও অবাক হব না। কিন্তু যেভাবেই হোক, should end it......আমি জানিনা আমার অ্যাটোন্মেন্ট কি হতে পারে – দুঃখিত বলবার যোগ্যতাও আমার নেই, শেয়শ্রী।”
অনেক্ষন চুপ করে থাকবার পর আমি শুধু বলেছিলাম,
— "সোহম, একে অপরের প্রতি অনেকটা অনুভূতি থাকার পরেও এ জীবনে একসাথে থাকাটা অনেক সময় সম্ভব হয়না। তোমার অপরাধ কতটুকু আমি জানিনা – আমি শুধু জানি, আমাকে আঁকড়ে রাখবার মত ভালবাসা অনির্বাণের কাছে ছিলনা। অনির্বান তার বর্তমানের জন্যই অনেক বেশি মূল্য দিয়েছিল, আর সেই মূল্যটা ও নিজের ইচ্ছেতেই দিয়েছিল। ওর নিজের ইচ্ছে না থাকলে তোমার কথা ও শুনত না!”
সোহম কিছু একটা বলতে চাইছিল, আমি ওর দিকে তাকিয়ে দেখলাম কোন এক অচেনা চাঁদের আলোয় ওর চোখে জল চিকচিক করছে। একটা বিশাল দীর্ঘশ্বাস নিয়ে ও বলল,
— “তুমি কখনও তোমার কল্পনায় আমাকে দেখোনি, তাইনা শ্রেয়সী? আজকের পর থেকে 'ওয়ান পারসেন্ট অফ সামথিং' নামক চান্সটাও আমার আর নেই, তাইনা? আমি তোমাকে আর কোনদিন বোঝাতে পারব না, তুমি আমাকে ভালবাসতে না পারলেও আমার তাতে কোন ক্ষতি নেই। আমি শুধু তোমার পাশে থাকতে চেয়েছিলাম। যার কাছ থেকে আমি সব কেড়ে নিয়েছিলাম, তার কাছেই আমার অস্তিত্ব পড়ে রইল। শ্রেয়সী, তুমি কি আমাকে ক্ষমা করবে? তুমি কি আমাকে মনে রাখবে?...“
আমি ওর কথার সেই সুর অসমাপ্ত রেখেই সেদিন চলে এসেছিলাম। সোহম আমার কাছে ক্ষমা চেয়েছিল, আর আমি ওকে অপরাধী না ভাবতে পারার অপরাধে দূরে চলে গিয়েছিলাম। অনেক দূরে। সেদিনের পর সোহম এর সাথে আমার যেদিন আবার দেখা হল – তার মধ্যে কেমন করে যেন কেটে গিয়েছিল সাড়ে তিন বছর। আমরা দুজনই তখন বছর ত্রিশ এর। ছেলেমানুষি ভালবাসায় হাস্যকর শিকারে পরিনত হয়ে হাহাকার করবার বয়স তখন আমাদের আর নেই।
-
সেই একই পাহাড় – আগেও যেমন ছিল, এখনও তেমনই আছে। জানিনা কেন আমি ভেবে নিয়েছিলাম, সোহমও একই রকম থাকবে। যে সত্যিকারের ভালবাসায় আমার একটুও বিশ্বাস ছিল না, আমি ধরে নিয়েছিলাম সেই ভালবাসা নিয়ে সোহম আমার অপেক্ষায় থাকবে। সেদিন সে সত্যিই আমার অপেক্ষায় ছিল।
— "সোহম, এই পাহাড়টিকে তোমার মনে আছে?"
— "শুধু মনে রাখা ? আমার কাছে তো এই পাহাড়টাই ছিল, শ্রেয়সী।"
—"আর আমি ভেবেছিলাম, ভুলে যাব। ভেবেছিলাম, যদি একদিন আমাকে ছাড়াই তোমার দিন ভাল যায়, যদি একদিন তোমাকে ছাড়াই আমার ভোরের স্বপ্নগুলো দিন হয়ে যায়, আমি আবার এখানে ফিরে আসব। তোমাকে আয়োজন করে মিস করব।"
— “তারপর ?”
— “পারিনি। It hurts ! সোহম ! যতটা আমি নিতে পারব বলে ভাবতাম, তার চেয়ে কষ্টটা যে আমার অনেক বেশি ছিল।”
— "একটা কথা জানো শ্রেয়সী? মানুষ চাইলেই যেমন ভালবাসতে পারেনা, তেমনি চাইলেই ভুলে যেতে পারেনা। খুব বেশি হলে হয়ত অভিনয় করতে পারে।"
— “তুমি করোনি কেন – অভিনয়?”
— “জানিনা। তোমার অপেক্ষায় থাকতে আমার ভাল লাগত – আমি কি করতে পারি?”
ভোরের প্রথম আলোয় হঠাৎ করে আমি আবিষ্কার করলাম, আমার দুচোখ অজান্তেই ভেসে যাচ্ছে।
— "সোহম! এতদিন পরে, আমি আবার নতুন করে ভালবাসতে শিখলাম কেন! বলতে পারো??......

............................

Debasish Talukdar



চন্ডীবাবু - দেবাশীষ তালুকদার

 

চন্ডীবাবু 
দেবাশীষ তালুকদার 
 
 
 
            চন্ডীবাবুর সাথে আমার পরিচয় রিকশায়। আমি রিকশার প্যাসেঞ্জার, আর তিনি চালাচ্ছেন। শোভাবাজার থেকে উঠেছি, মেসে ফিরবো। রিকশায় উঠলে রিকশাচালকদের সাথে কথা বলার পুরনো অভ্যাস আমার।
-- নাম কি আপনার?
-- আজ্ঞে চন্ডী দলুই।
-- আচ্ছা চন্ডীবাবু! আপনি যে ২০ টাকার ভাড়া ৪০ টাকা চাইলেন, কাজটা কি ঠিক করলেন?
রিকশা চালাতে চালাতে পেছন ফিরে চন্ডী বাবু একবার অবাক চোখে তাকালেন আমার দিকে। সম্ভবতঃ এই প্রথম কেউ তাকে বাবু সম্বোধন করলো।
-- শুরুতে বেশী চাওন লাগে। আমি ২০ টাকা চাইলে আপনে বলতেন ১০ টাকায় যাইবেন?
-- অন্যরা হয়তো বলতো কিন্তু আমি বলতাম না। আপনি ৪০ টাকা থেকে যে ২০ টাকায় নামলেন, এটা কি ঠিক হলো? আপনি হবেন গিয়ে এক কথার মানুষ! তাইনা! ২০ টাকা বলবেন, ২০ টাকাই। কথার নড়চড় হবে না....
আমার মুখের কথা শেষ হওয়ার আগেই ধাক্কাটা লাগলো। ঠিক টাউন স্কুলের কাছে তেরাস্তায় বাম সাইড থেকে হঠাৎ করে আসা একটা স্কুটার ধাক্কা দিলো ঠিক রিকশার সামনের চাকা বরাবর। আমি ছিটকে পড়লাম রাস্তায়। ব্যাথায় চোখে অন্ধকার দেখলাম কিছুক্ষণ। চোখ খুলে দেখি চন্ডী বাবু আরেকটু দূরে পড়ে আছেন। মাথা থেকে রক্ত গড়িয়ে রাস্তা লাল হয়ে গেছে। গোটা বাহান্নর মতো বয়স, মুখটা তখনো হাসি হাসি।
আমার কয়েক জায়গায় কেটে গেলেও সিরিয়াস কোন ব্যাথা পাইনি। টলতে টলতে উঠে দাঁড়ালাম। ইতিমধ্যে চারদিকে ভীড় জমে গেছে। রাস্তার দুজনের সহায়তায় চন্ডীবাবু কে নিয়ে গেলাম আর.জি.কর মেডিকেলে। কাঁটাছেড়ার জন্য সামান্য ব্যান্ডেজ আর ব্যাথার ওষুধ দিয়ে আমাকে ছেড়ে দিলো। কিন্তু চন্ডীবাবুর অবস্থা গুরুতর। দু ব্যাগ রক্ত লাগবে। ব্লাড গ্রুপ মিলে যাওয়ায় এক ব্যাগ আমি দিলাম, আরেক ব্যাগ জোগাড় করলাম।
চন্ডী বাবুর মোটামুটি সুস্থ হতে আট দিন লাগলো। প্রথম দুদিন আমিই ছিলাম পাশে, তৃতীয় দিনে ওনার স্ত্রী আর আট বছরের কন্যার খোঁজ পাওয়া গেলো। এর মধ্যে একটা ইনকোর্স পরীক্ষা, দুটো ক্লাস মিস হয়ে গেলো। তারথেকে বড় কথা, চন্ডী বাবুর চিকিৎসার খরচ সাড়ে সাত হাজার টাকা জোগাড় করতে নাভিশ্বাস উঠে গেলো আমার। মেসে থাকি, টিউশনি করি। সাড়ে সতশো টাকাই অনেক টাকা, আর এখানে সাড়ে সাত হাজার। চন্ডী বাবুর স্ত্রী হাতের দুটো চুড়ি বিক্রি করে পাচ হাজার টাকা আনলেন, আমি ধারদেনা করে দেড় হাজার আনলাম। বাকি হাজার টাকা হসপিটাল কর্তৃপক্ষ মাফ করে দিলেন।
-
-- আপনে কি কামডা ঠিক করলেন কন তো?
-- কি করেছি?
-- আপনে অন্য রিকশায় উঠছেন ক্যান আজকে দুপুরে?
-- তাড়া ছিল একটু, আপনাকে ফোন করার মতো সময় ছিল না।
-- আমি চন্ডী বাঁইচা থাকতে আপনের ভাড়া দিয়া অন্য রিকশায় ওঠা বন্ধ। এস্টপ! ফিনিশ! কল করবেন, আমি উইড়া আসুম। দরকার হইলে প্যাসেঞ্জার মাঝপথে নামাই দিয়া চইলা আসুম।
 
        আমি হাসলাম। গত তিন বছর ধরে চন্ডীবাবু আমাকে নিয়ে রিকশা চালায়। সকালে মেসের সামনে এসে দাঁড়ায়, আমি কলেজে আসি। তারপর সে খেপ মারতে যায়। বন্ধুরা দেখে হাসে, কেউ কেউ টিপ্পনিও মারে। আমার ক্লাস রুটিন ওনার মুখস্ত। ক্লাস শেষ হলে বের হয়ে দেখি রিকশা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। গত তিন বছরে একদিনও এর ব্যতিক্রম হয়নি। জরুরী কাজে কোথাও যেতে হলে ওনাকে ফোন করতে হয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে হাজির। প্যাসেঞ্জার নিয়ে খুব দূরে কোথাও যান না, কাছাকাছিই থাকেন যাতে ফোন করলে সবসময় পাই। অন্য কোন রিকশায় উঠলে রাগ করেন, শিশুসুলভ অভিমান। এই যেমন আজকে। আমি অনেক মানা করেছি, কোন কিছুতেই তাকে মানানো যায়নি। এই ব্যাপারে প্রচন্ড একগুঁয়ে, একরোখা। কখনোই ভাড়া নেন না, কোনো ভাবেই নেওয়ানো যায় না।
বিকালে টিউশনিতে যাই। রাতে ফেরার পথে আমরা রিকশায় কলকাতা শহরের এদিক সেদিক ঘুরি। চা খাই। আড্ডা দিই। সত্যি বলতে তিন বছরে চন্ডীবাবু আমার সবচেয়ে বড় বন্ধু হয়ে গেছেন। মন খুলে গল্প করি ওনার সাথে। তিন বছরে চন্ডী বাবুর আর্থিক অবস্থার অনেকটাই উন্নতি হয়েছে। গ্রামে জমিজমার বিবাদের জন্য সর্বস্ব হারিয়ে কলকাতায় এসে রিকশা চালাতে বাধ্য হয়েছিলেন। কিছুদিন আগে বিবাদ মিটেছে আমার এক পুলিস আত্মীয়র সহায়তায়। কিছু জমি বিক্রি করে কৃষ্ণনগরে মনোহারি দোকান দিয়েছেন, তার ছোটভাই চালায়। মাঝে মাঝে বলি,
-- চন্ডীবাবু, আর কতদিন রিকশা চালাবেন? টাকাপয়সা তো কামাচ্ছেন, এবার একটু আরাম করুন।
-- যতদিন বাঁইচা থাকি, রিকশা চালামু। আপনের রক্ত যতদিন আমার শরীলে আছে, আপনের জন্য রিকশা চালামু।
--মানুষের শরীরে রক্ত চার মাস বাঁচে। এরপর নতুন রক্ত তৈরী হয়। আমার রক্ত যা ছিলো, ফিনিস হয়ে গেছে এতোদিনে।
-- আপনেরে কইছে। দুই পাতা পইড়া বেশী জাইনা গেছেন? রক্ত আজীবন থাকে শরীলে।
আমি বোঝাতে গেলেই, তর্ক শুরু হয়...।
রাত বাড়ে। চন্ডীবাবুর সাথে কলকাতা শহর ঘুরছি আমি। আমি শুদ্ধ ভাষায় কথা বলা শেখাই, গল্প করি। চন্ডী বাবু মনোযোগী শ্রোতার মতো শোনে। ডিপার্টমেন্টের গল্প, বন্ধুদের গল্প, বান্ধবীদের গল্প, স্যারদের গল্প, টিউশনির গল্প। মাঝে মাঝে কঠিন কঠিন পড়ালেখা আর বিজ্ঞানেরও গল্প। গাউসের ছোটবেলার গল্প, এডিসন কিভাবে এডিসন হলো, আর্কিমিডিসের ইউরেকা, লাইবনিজের ক্যালকুলাস, ফার্মার লাস্ট থিওরেমের গল্প। চন্ডীবাবু কিছু বোঝে, কিছু বোঝে না। মাঝে মাঝে প্রশ্নও করে,
-- এই যে মনে করেন আপনে রিকশায় বইসা আছেন। এখন আপনে পা দিয়া যতই ঠেলেন, রিকশা কিন্তু এক পাও সামনে যাইবো না। এইডা ক্যামনে হয়?
আমি তখন নিউটনের তৃতীয় সুত্র বোঝাই। চন্ডীবাবু উপহাসের হাসি হাসে।
-- আমি মাটিতে ঠেলা দিলে মাটিও আমারে ঠেলা দেয়? এইসব উল্টাপাল্টা ভুলভাল পড়াইয়া কলেজগুলা আপনেগো মাথাটা নষ্ট করতাছে।
আমরা চায়ের দোকানে দাঁড়াই, চা খাই। এই শহরের বেশীরভাগ চায়ের দোকানদার আমাদের চেনে। রাতে একটা পাগলা ধরনের কলেজের ছেলে আর এক রিকশাওয়ালা ঘুরে ঘুরে বেড়ায়। আরেকটু রাত হলে চন্ডীবাবুর ঘরে যাই, ওনার মেয়েকে পড়াই। ওনার মেয়ের বয়স এখন এগারো, আমাকে দেখলে বাবার মতোই অভিমান করে। "কাকু, এতো দেরী করে আসো কেনো?"
-
-- আপনেরে একটা কথা বলুম। শোভাবাজার লঞ্চঘাটের সামনে চায়ে চুমুক দিতে দিতে বললেন চন্ডীবাবু।
-- কি কথা?
-- আমার একটা শখ, আপনে যখন বিয়া করবেন, কোনো পেরাইভেট ভাড়া করবেন না। আমার রিকশাতে যাইবেন, আমার রিকশাতেই বউ নিয়া আসবেন। আমি টাকা জমাইছি, বিয়ার দিন নতুন রিকশা কিনুম। আপনাদের দুইজনরে নিয়া রিকশা চালামু।
-- বিয়ের দিন রিকশায়? বৌ তো কিপটা বলে বিয়ের আগেই ডিভোর্স দিয়ে দেবে।
-- দিবো না। আপনার বউ আপনার মতোই ভালো হইবো। ওনারে আর আপনারে নিয়া রিকশায় বাইর হমু। আপনারা পিরিতের আলাপ করবেন, আমি কানে হেডফুন দিয়া রাখুম।
আমি হাসি চাপতে চাপতে বললাম,
-- চন্ডীবাবু, মনে করুন পড়ালেখা শেষে আমার বড়ো চাকরী হলো। অফিস থেকে তো গাড়ি দেবে। তখন তো গাড়িতে চড়তে হবে। তখন কি করবেন?
মূহুর্তে চন্ডী বাবুর মুখের হাসি চুপসে গেল। চুপ করে চায়ে চুমুক দিতে লাগলেন। স্পষ্ট দেখতে পেলাম, চোখের কোণে হালকা একটু জল চিকচিক করছে। আমি বিব্রত হয়ে গেলাম। কথাটা বলাই উচিৎ হয়নি।
অনেকক্ষণ চুপ থেকে চন্ডীবাবু মৃদু স্বরে বললেন,
— তাইলে আর কি করার, ডেরাইভিংটা শিখা লাগবো। এই মাসেই শুরু কইরা দেই! কি কন? এক ওস্তাদের লগে আমার চিনা-পরিচয় আছে। বাস চালানি শিখলে পেরাইভেটও পারুম, ঠিক কিনা?
আমি এবার হতম্ভব হয়ে যাই। এটাকে কি বলা যায়? ভালোবাসা? এই ভ্যালেন্টাইনদের যুগে, রিকশাওয়ালাদের চড় মারার যুগে এই ভালোবাসার স্থান কোথায়? আপনারা কি বলেন?
..........
 
Debasish Talukdar 



বসন্ত রং - পল্লবী সেনগুপ্ত

 বসন্ত রং

পল্লবী সেনগুপ্ত

 (১)


    ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে উদাস দৃষ্টিতে সকলের রঙ আর আবীর খেলা দেখছিল সুপ্রিয়া । যারা খেলছেন তারা সকলেই এই পাড়ারই লোকজন । আজ শনিবার তাই দোলের আগেরদিন হওয়া সত্ত্বেও অনেকেরই ছুটি । সেই সুযোগেই বোধ হয় এরা চুটিয়ে উপভোগ করছেন প্রাক দোল পর্ব ।
সুপ্রিয়া সকলের সাথে খুব একটা মিশতে পারে না , ও চিরকালই খুব মুখচোরা স্বভাবের । সেইজন্য পাড়ায় ওর তেমন কোন বন্ধু নেই । তবুও আজ ওদের দেখতে , ওদের রঙ খেলা দেখতে ভীষণ ভাল লাগছে । ওর মনটা হুহু করে দৌড় লাগাচ্ছে ফেলে আসা পুরনো দিনে । ছোটবেলা থেকেই রঙ নিয়ে এই লুটোপুটিটা ওকে কেন যেন বড্ড টানে । সেই ছোট্ট বয়স থেকেই ওর বারবার বড্ড ইচ্ছা করত আবীর আর রঙ নিয়ে জমিয়ে দোল খেলতে । কিন্তু সে ইচ্ছা ওর কোনদিনই পূরণ হয় নি । বাবা মা এই দোল খেলা জিনিসটা একদম পছন্দ করতেন না । তাই তাদের কড়া নজর থাকত মেয়ে যাতে দোল খেলতে না পারে সেদিকে । ওরা বলতেন গায়ে রঙ লাগালে নাকি চামড়ায় এলারজি হতে পারে ।
এভাবেই আঠারোটা বসন্ত পের হয়ে গেছিল সুপ্রিয়ার রঙ খেলার অসমাপ্ত ইচ্ছেকে বুকে জড়িয়েই । হয়তো এইভাবেই ইচ্ছাটা চিরকালের মত অসম্পূর্ণই ওর থেকে যেত যদি না তানিয়া ওর জীবনে আসত । তানিয়া ওর বেস্ট ফ্রেন্ড । মুখচোরা স্বভাবের সুপ্রিয়ার কোনদিনই তেমন কোন বন্ধু না থাকলেও কিভাবে যেন তানিয়া কলেজের প্রথম দিন থেকেই ওর বড্ড কাছের হয়ে গেছিল । মেয়েটা যেমন ডানপিটে তেমনই আমুদে । ঐ জোর করে সেকেন্ডে ইয়ারের পড়ার সময় কলেজের বসন্ত উৎসবে সামিল করেছিল সুপ্রিয়াকে । বাবা মার ভয়কে জয় করে সেই প্রথম সুপ্রিয়ার রঙ মাখা । তানিয়া রঙ মাখিয়ে ভূত করে দিয়েছিল ওকে । বাকী অনেক সহপাঠীই ছিল সেদিন রঙ লাগানোর দলে । আর সেদিন বিশেষ একজনও রঙ্গিন করেছিল ওকে । আদৃত । ওদের ডিপার্টমেন্ট এরই সেরা ছেলে  । এমনিতে বেশ গম্ভীর আর মিতভাষী হলেও আদৃত সেই দোলের দিন যেন ছিল বাঁধনহারা নদী । 

    
    কলেজের শুরুর দিক থেকেই সুপ্রিয়ার মন কেড়েছিল আদৃত । কিন্তু নিজের মনের কথা জানাবার সাহস কোনদিনই হয় নি সুপ্রিয়ার । শুধু তানিয়া জানত সবটুক । কতবার ও বলেছে
-“ প্রিয়া মনের কথা মনে চেপে রাখতে নেই ।তাই বলে দে আদৃতকে । তুই না পারলে আমিই বলছি “। কিন্তু পেরে ওঠেনি সুপ্রিয়া । তানিয়াকেও বলতে দেয় নি । কিন্তু সেই সুপ্রিয়াই ভেবেছিল সে বছর দোলে আদৃতের ছোঁয়া পেয়ে এবার জানাবে নিজের মনের কথা । নাঃ, তাও হয় নি । আদৃত অন্য কাউকে ভালবাসে , একথা জানতে পেরেছিল ও  সেই দোলের দিন কয়েক পরেই ।
কিন্তু তাহলে কেন আদৃত সেদিন আবীরে রাঙিয়েছিল ওকে ? শুধু বন্ধুত্বের ছলেই কি ? হয়তো তাই হবে । সব প্রশ্নের উত্তর তো জীবন দিয়ে যায় না । হয়তো এটাও তেমনি এক না মেলা উত্তর ।
 

    আসলে সুপ্রিয়ার জীবনটাই বোধ হয় অমীমাংসিত লক্ষ প্রশ্নের এক খাতা হয়ে রয়ে গেল । আদৃত এর প্রতি ওর অনুভবটাকে প্রেম নয় একটা সাময়িক ভাল লাগা বা ইনফ্যাচুয়েশন বলে সেটা সময়ের সাথে সাথে নিজেই বুঝতে পেরেছিল ও । তারপর আর কখনও  সত্যিকারের প্রেম আসেনি ওর জীবনে । বিয়ে করারও ইচ্ছা তেমন ছিল না ওর ।
কিন্তু বাবা মা আর সে কথা শুনবেন কেন ? সুপ্রিয়া পড়াশুনায় তেমন আহামরি ভাল কোনদিনই ছিল না । তাই কলেজপাশ করে কম্পিউটার কোর্স করে নিলেও তেমন কোন চাকরি  জোটেনি  । বাবা মা সেইজন্যই ছেলে দেখতে শুরু করেছিলেন ।
 

    শেষ পর্যন্ত  কলকাতাবাসী , বিধবা মায়ের একমাত্র সন্তান নিখিল সরকারের সাথে বিয়েটা পাকা হয় ওর । নিখিলকে বিয়ে করতে রাজী হবার পিছনে ওর  একটাই  কারণ ছিল ।  ছেলেটা ওর পূর্বপরিচিত ।
সমন্ধ করে বিয়ের ক্ষেত্রে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিয়ের আগে থেকে সেভাবে কোন ভালবাসা তৈরি হয় না । সবটাই শুরু হয় বিয়ের পরে । তেমনই কিছু আশা নিয়ে এই বাড়িতে পা রেখেছিল সুপ্রিয়া । কিন্তু ভালবাসা বোধ হয় সত্যিই ওর কপালে লেখা ছিল না । তাই নিখিল কি এক অজ্ঞাত কারণে যেন সব সময় দূরে সরিয়ে রাখে নিজেকে । সব সময় নিরুত্তাপ , ঠাণ্ডা ব্যবহার মানুষটার । নিজেকে সদাই আড়াল করে রেখেছে অভেদ্য এক কঠিন খোলসে । সুপ্রিয়ার আজকাল ভীষণ ভয় করে নিখিলের কাছাকাছি যেতে । ওই খোলস ভাঙ্গার ক্ষমতা যে ওর নেই । মানুষটা ওর পূর্বপরিচিত হলেও বন্ধু তো আর ছিল না কোনদিন ।  কিন্তু কেন এমন করে নিখিল ? ও কি এই বিয়েটা চায় নি ? ও কি অন্য কাউকে ভালবাসে বা বাসত ? তাহলে কেন নিজের জীবন জড়াল সুপ্রিয়ার সাথে ? না , কোন উত্তর নেই এই প্রশ্নগুলোর । নিজের যন্ত্রণাও কাউকে দেখাতে পারে না মেয়েটা । কাকে বলবে ? বাবা মা দুজনেরই বয়স হয়েছে , শরীরও ভাল না । তাদের তো নিজের জীবনের অসুখী দাম্পত্যের গল্প শুনিয়ে আরও চিন্তাগ্রস্ত করে তুলতে পারে না ও । আর বন্ধু বান্ধব ও তেমন কেউ নেই শুধু তানিয়া ছাড়া । তানিয়াও এখন কলকাতায় থাকে না । ব্যাঙ্গালরে চাকরী করে । তাই ওর সাথেও মন খুলে কথা বলার সুযোগ কম । যা কথা তা শুধুই ফোনে আর চ্যাটে ।
হঠাৎ ভীষণ কান্না পেল সুপ্রিয়ার । কেন ? কেন ওর জীবনটাই এমন রঙহীন ফ্যাকাশে হয়ে গেল? কি দোষ ছিল ওর ? কেন জীবনে নিজের ঘরের মানুষটাই ভালবাসতে পারল না ওকে ?
-“ প্রিয়া , তোর ফোন বাজছে “। শাশুড়ির ডাকে যেন ভাবনার জগৎ ছেড়ে বাস্তবে এসে নামল ও ।
সত্যি তো মোবাইল বাজছে । স্ক্রিনে ভাসছে তানিয়ার নম্বর ।
-“ কিরে তুই ? এমন অসময়? অফিস নেই “?
-“ আরে শোন । তোকে একটা সারপ্রাইজ নিউজ দিচ্ছি । আমি শান্তিনিকেতন এ এসেছি । এই বছর এখানেই দোল কাটাব বুঝলি । আমার সাথে আমার বেশ কয়েকজন বান্ধবীও আছে । তাই বলছি তুইও চলে আয় প্রিয়া । আবার খুব করে দোল খেলব আমরা । রঙ মাখব । তোকে আমাদের হোটেলের ঠিকানা মেসেজ  করছি । সোজা চলে আয় ট্রেন ধরে “। কলকল করছে তানিয়া ।
মনের ভিতরটা দুলে উঠল সুপ্রিয়ার । আবার কত বছর পর রঙের হাতছানি । কিন্তু……
-“ কিন্তু তানিয়া আমার হবে না রে । মানে এভাবে হুট করে ……”
-“ জীবন তো একটাই রে প্রিয়া । আর কত নিজের ইচ্ছেগুলোকে গলা টিপে মারবি “?
-“ আচ্ছা আমি দেখছি “। ফোন কেটে দিল সুপ্রিয়া । ইতিমধ্যেই কখন যেন দরজায় এসে দাঁড়িয়েছেন শাশুড়িমা । নিখিল যতই সুপ্রিয়াকে অবচ্ছেদা করুক না কেন , এই মানুষটার ভালবাসায় তার জন্য ভাটা  পরে নি কোনদিন ।
-“ মা , আমার  কলেজের বান্ধবীরা সবাই শান্তিনিকেতনে দোল সেলিব্রেট করছে । তাই আমাকেও ওরা …” আমতা আমতা স্বরে বলল সুপ্রিয়া ।
-“ ঘুরে আয় । তোর যে রঙ খেলার বড় সাধ আমি জানি । তাই আনন্দ করে আয় মা । যে মানুষটা তোর মন পড়তে পারে না তার জন্য নিজের ইচ্ছেকে আর বলি দিস না । “
হুহু করে এবার কেঁদে উঠল সুপ্রিয়া । শাশুড়ি মা এসে মাথায় হাত রাখলেন ওর । মনে মনে ঈশ্বরকে বললেন
-“ আমার ছেলেটার সুমতি দাও ঠাকুর । এই মেয়েটাকে একটু শান্তি দাও তুমি “। 


                              
                               (২) 


    রোজকার মতই অফিস থেকে ফিরছিল নিখিল । কিন্তু বাস থেকে নামার পরেই আজ ধাক্কা মারল চোখে দৃষ্টিটা ।  রাস্তার একপাশে কতগুলো লোক মিলে কি যেন এক দহনকাজে মেতে উঠেছে ।
-“ কি হচ্ছে এসব “? প্রশ্নটা মাথায় আসার সাথে সাথেই যেন উত্তরটাও ধাঁ করে মনে চলে এল । আরে ! এটা তো নিশ্চয়ই নেড়া পোড়া হচ্ছে , হ্যাঁ আগামীকালই তো দোল ।
    দোলের কথা মনে আসতেই কেমন যেন ফ্ল্যাশব্যাকের মত সেই দৃশ্যটা চোখের সামনে ভেসে উঠল  নিখিলের । একটা মেয়েকে খুব করে নীল আবীর মাখাচ্ছে একটা ছেলে । আর সেই মেয়েটা লজ্জার আবেশে কেমন যেন লাল হয়ে যাচ্ছে । লাল আর নীলে মিশে মেয়েটার মুখে কেমন অদ্ভুত মায়াবী সে এক রঙের খেলা ।আর অনেকটা দূর থেকে অন্য একটা ছেলে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছে দৃশ্যটা । নিমেষে তার বুকটা কেমন যেন ভার হয়ে উঠল একটা অব্যক্ত কষ্টের কামড়ে । হাতের মুঠোয় রাখা আবীরের ঠোঙাটা ছুঁড়ে ফেলে দিল সে। দৌড়ে চলে গেল কলেজ ক্যাম্পাসে দোল খেলার হইহই করা পরিবেশটা ছেড়ে  নিজের চোখের জলটুকু সবার অলক্ষে লুকিয়ে ফেলে ।
 

    নিখিল এই দৃশ্যটা সত্যি ভুলতে চায় । আরও অনেক অতীত স্মৃতি , জানা অজানাই ভুলে যেতে চায় ও । কিন্তু কেন যেন কিছুতেই পারে না । বারবার মনে চলে আসে পুরনো দিনের কথাগুলো । অথচ এগুলো ভোলা যে ভীষণ দরকার তা বেশ বোঝে নিখিল । কিন্তু মস্তিষ্ক অনেক যুক্তি বুঝতে পারলে অবুঝ আর অবাধ্য মনটা তো আর সব সময় বোঝে না , আর সেইজন্যই বোধ হয় নিখিলের ভুলতে চেয়েও সবটুকু ভোলা আর হয়ে ওঠে না । শুধুমাত্র অতীতের সেই দিনগুলো থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না বলেই নিখিলের বিবাহিত জীবনটাও অসম্পূর্ণ হয়ে রয়েছে । নিজের স্ত্রীকে মন থেকে পুরোপুরি মেনেও নিতে পারছে না ও , অথচ তাকে নিজের মনের কথা সবটা খুলে বলতেও পারছে না । সেইজন্যই বিয়ের চোদ্দ মাস পরেও আজও নিখিল যেন নিজের স্ত্রীয়ের কাছেই এক আগুন্তুক ।
আনমনেই হাঁটছিল ও নিজের বাড়ির পথে । হঠাৎ থমকে গেল । বাড়ির গলির মুখেই একটা ছোট রঙ পিচকারীর দোকান বসেছে । একটা মাঝারি সাইজের বাটিতে ভর্তি করে সাজান রয়েছে নীল আবীর । আবার, আবার সেই দৃশ্যটা ফুটে উঠল নিখিলের চোখের সামনে । নিজের অজান্তেই এবার চোখটা বুজে ফেলল ও । ও ভুলতে চায় । মনে প্রাণে ও অতীতটাকে ভুলতে চায় ।
                              
        

                                                                          (৩)


    শান্তিনিকেতনে বেশ বড় হোটেলই ভাড়া নিয়েছে তানিয়ারা । সেই হোটেল সংলগ্ন বাগানেই চলছে আজ দেদার দোল খেলা , এক টুকরো বসন্ত উৎসব , যাতে সামিল হয়ছে সুপ্রিয়াও। গতকাল বিকাল নাগাদই এসে পৌঁছেছে ও । না, নিখিলকে জানিয়ে আসা হয় নি । শাশুড়ি মা বললেন উনিই সবটা জানিয়ে দেবেন । তবুও মনটা খুঁতখুঁত করছে সুপ্রিয়ার । আবার বেশি রাগ করবে না তো ও ?
লাল , হলুদ , সবুজ, গোলাপি , কমলা বাহারি নানা রঙের আবীর নিয়ে  চলছে দোল খেলা । সুপ্রিয়ারও সারা শরীর রঙিন হয়ে উঠেছে নানা বর্ণের আবীরে , ঠিক যেমনটা ও একদিন চাইত । সবাই ছবি তুলছে খচখচ । কিন্তু সুপ্রিয়ার ইচ্ছে করছে না । এত রঙ ,আবীরের ছোঁয়া পেয়েও আজ যেন কিছুতেই রঙিন হয়ে উঠতে পারছে না ও । ভিড়ের মাঝেও ও যেন বড্ড একা । তাই সবার থেকে সরে থাকতেই শান্তি পাচ্ছে যেন  ।
-“ এই কিরে ? এভাবে একা একা এখানে দাঁড়িয়ে কেন তুই ? ওভাবে খেলা ছেড়ে চলে এলি কেন “? তানিয়া এসে পিঠে হাত রাখল বন্ধুর । শুধু এই স্নেহের স্পর্শটুকুর অপেক্ষাতেই যেন ছিল সুপ্রিয়া । মনের সবটুকু মেঘ নিমেষের ঝরে পড়ল বৃষ্টি হয়ে । ভরা ফাগুনেও দু চোখ জুড়ে ওর নেমে এল শ্রাবণ ।
-“ আমার কিচ্ছু ভাল লাগছে না রে তানিয়া । আমি যে জীবনে হেরে গেলাম । 

    আদৃতকে আমি ভালবাসিনি । শুধুই ওকে ভাল লাগত । তাই সেদিন ও অন্য কারোর হয়ে যাবার পরও আমার খুব একটা কষ্ট হয় নি । কিন্তু নিখিলকে যে আমি নিজের অজান্তেই আমি বড্ড ভালবেসে ফেলেছি রে । তাই ওর আমার থেকে ক্রমশ সরে যাওয়াটা আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না । আমি নিখিলকে কিছুতেই হারাতে পারব না তানিয়া , আজ ওর থেকে দূরে এসে আরও বেশি করে বুঝতে পারছি যে আমি ওকে ছাড়া কিছুতেই বাঁচতে পারব না । কিন্তু নিখিল তো আমায় ভালবাসে না । আমি জানি না কি আমার দোষ ? কিন্তু আমি কি করব বলে দে আমায় তানিয়া । আজ এত রঙ এর মাঝেও আমার নিজেকে বড্ড বিবর্ণ লাগছে । কারণ আমি এখন শুধু নিখিলের  হাতের আবীর চাই । ভালবাসার রঙ ছাড়া দোলের যে সত্যি কোন মানে থাকে না আর। “  বন্ধুকে জড়িয়ে ধরে হাউহাউ করে কাঁদছে সুপ্রিয়া ।  অন্য মানুষরা ওকে দেখছে সে খেয়ালই যেন নেই ওর ।
-“ চুপ কর প্রিয়া , চুপ কর । শান্ত হ । এভাবে ভেঙ্গে পড়িস না । যদি তোর ভালবাসা সত্যি হয় তবে নিখিল শুধু  তোরই থাকবে । দেখিস তুই “। বন্ধুকে সান্ত্বনা দিতে দিতে গলা ভিজে আসছে আজ তানিয়ারও । কেন এমন করছে নিখিল ? কি চায় ও ? ও কি তবে সত্যি সুপ্রিয়াকে ভালবাসে না ?

                                                             (৪)


    ট্রেন থেকে  ষ্টেশনে নেমেই রিক্সা স্ট্যান্ডের দিকে এগিয়ে গেল নিখিল । অনেক রিক্সা  দাঁড়িয়ে রয়েছে ।
-“ কবিমন  রিসোর্ট  এ যাবে “?
-“ হ্যাঁ বাবু । এই যে এই দিকে আসুন “।
রিক্সায় চেপে বসল নিখিল । এগিয়ে চলেছে কবিমন রিসোর্টের দিকে শান্তিনিকেতনের পথ বেয়ে । মাঝে মাঝেই চোখে এসে ঝাপটা মারছে টুকরো টুকরো বসন্ত বন্দনার ছবি ।
গতকাল অফিস থেকে ফিরে এসেই শূন্য বেডরুমটা দেখে ধক করে উঠেছিল নিখিলের বুকের ভেতরটা । বিগত চোদ্দ মাসে এমনতো কোনদিন হয় নি । রোজই ফিরে দেখতে পেয়েছে সুপ্রিয়াকে ঘরের ভিতর । গতকাল খালি ঘরটা দেখে যখন ও দাঁড়িয়েছিল তেতো মুখে তখনই মা এসে বলেছিলেন
-“ প্রিয়া শান্তিনিকেতন গেছে । বন্ধুদের সাথে দোল টোল খেলবে । ওর বন্ধু ফোন করেছিল । তাই আমিই ওকে যেতে বলেছি “।
-“ আমাকে না বলেই চলে গেল “?
-“ কেন ? কেন বলবে তোকে ? কি এমন ভালবাসায় ভরিয়ে তুলেছিস তুই ওকে ? 

    আমি জানি না খোকা তোর সমস্যাটা ঠিক কোথায় হয় ওকে মেনে নিতে ? এত্ত ভাল একটা মেয়ে ! আর তোর যদি ওকে এতোই অপছন্দ তাহলে বিয়ের আগে বললি না কেন ? আমি তো বারবার জিজ্ঞাসা করেছিলাম তোকে ? অন্য কাউকে ভালবাসতিস তুই ? তাহলে সেটাই বা জানালি না কেন ? যাইহোক এখন এসব কথার কোন মানে হয় না । তুই যদি পারিস শান্তিনিকেতন থেকে গিয়ে ওকে নিয়ে আসিস । আমার কাছে ওর রিসোর্টের ঠিকানা আছে ।“ মা বেশ রাগ দেখিয়ে হনহন করে বেরিয়ে গেছিলেন ঘর ছেড়ে । আর একটা কষ্টের দলা আটকে আসছিল নিখিলের গলার কাছে । ভীষণ অসহায় লাগছিল । ও কি করে বোঝাবে কাউকে নিজের মনের অবস্থাটা ।
-“ বাবু এসে গেছে রিসোর্ট “। রিক্সা থেকে নেমে পড়ল নিখিল । রিসোর্টের ভেতর ঢুকতে গিয়েও থমকে গেল । কি বলবে ও সুপ্রিয়ার সামনে গিয়ে ? হঠাৎ কেন এল ও এখানে ? সে কি আদৌ ভাল ভাবে নেবে নিখিলের উপস্থিতিটা ? এখানে একটু আনন্দ করছে ও নিজের একঘেয়ে জীবন থেকে ছুটি নিয়ে , সেখানে নিখিল অবাঞ্ছিত নয় তো ?
 

    দ্রিমদ্রিম করে হঠাৎ কেঁপে উঠল বুক পকেটে রাখা মোবাইল যন্ত্রটা । ফোনটা বের করেই মুখে বিরক্তির ছায়া ফুটে উঠল নিখিলের । আবার ভিডিও ক্লিপ পাঠিয়েছে কেউ হোয়াটসআপে । সকাল থেকে পাগল করে দিচ্ছে সব ।
কিন্তু একি ! ক্লিপ পাঠিয়েছে তানিয়া ! ব্যস্ত হাতে এবার সবুজ আইকন ছুঁল নিখিল । লোড হচ্ছে ভিডিও ক্লিপ ।
পুরোটা লোড হতেই কেঁপে উঠল নিখিলের বুক । একি ! অঝোর ধারায় তানিয়াকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে সুপ্রিয়া । ব্যক্ত করছে নিজের জীবনের যন্ত্রণা । নিখিলকে ভালবাসে ও । শুধু ওর ভালবাসা পেতেই আজ ও মরিয়া ।
আস্তে আস্তে ঝাপসা হয়ে আসছে নিখিলের চোখ । বুকের মাঝে চিনচিন করছে অদ্ভুত ভাললাগা মেশান একটা কষ্ট । দ্রিম দ্রিম করে আবার কেঁপে উঠল ফোনটা । তানিয়া মেসেজ পাঠিয়েছে ।
-“ নিখিল গত বার যখন আমি কলকাতায় এসেছিলাম তখন প্রিয়াকে না জানিয়েই তোর মুখোমুখি হয়েছিলাম কফিশপে । জানতে চেয়েছিলাম সরাসরি কেন ওকে এত কষ্ট দিচ্ছিস তুই ? কোন সদুত্তর সেদিন তুই দিতে পারিস নি । কিন্তু উত্তর না পেলেও সেদিন তোর চোখে ওর জন্য আমি ভালবাসা দেখতে পেয়েছিলাম । আর তাই এটা ভেবে অবাক হয়েছিলাম ওকে ভালবাসা সত্ত্বেও কেন এমন করছিস তুই ?
না আজও আমি জানি না সত্যি তুই কি চাস । একটা ভিডিও ক্লিপ পাঠালাম । আমার কথায়  প্রিয়ার যন্ত্রণা ভরা একটা মুহূর্ত ওর অজান্তেই মোবাইলের ক্যামেরা বন্দী করেছে আমার কলিগ সুজি । সবটা দেখার পরেও যদি তোর মনে ওর জন্য জায়গা তৈরি না হয় আমি তাহলে ওকে নিয়ে ব্যাঙ্গালর চলে যাব । ওর জন্য একটা চাকরির ব্যবস্থা করব আমি “
হতভম্বের মত মোবাইল হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে নিখিল । সব হিসেব যেন নিমেষের মধ্যে কেমন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে । আবার চোখের সামনে ফুটে উঠছে বহু বছর আগের সেই দৃশ্যটা । একটা মেয়ে। তাকে খুব করে নীল আবীর মাখাচ্ছে একটা ছেলে । সেই ছেলেটার নাম ছিল আদৃত । নিখিলদের ডিপার্টমেন্টের ওদের ব্যাচের সেরা ছেলে । ওই ছেলেটার প্রতিই যে দুর্বল ছিল সুপ্রিয়া সেটা ক্লাসের অনেকেই জানত । হয়তো আদৃতও জানত । আর নিখিলও জানত । কিন্তু জেনেই বা কি ! সব কিছু জানার পরেও যে নিখিলের মন বারবার খুঁজে বেড়াত ঐ সরল নিষ্পাপ বড় বড় চোখ দুটোকে । মন শুধু খুঁজত ঐ মুখটা । কিন্তু কোনদিন সে কথা কাউকে বলতে পারে নি নিখিল । কি করেই বা বলবে ? সুপ্রিয়া তো কোনদিন ভুল করেই একবারও তাকাত না নিখিলের দিকে । আর সত্যি তো কেনই বা তাকাবে ? কোথায় আদৃত আর কোথায় নিখিলের মন সাধারণ একটা ছেলে !
 

    আর সেই বছর , আদৃতের হাত থেকে সুপ্রিয়ার রঙ মাখার দৃশ্যটা কেন যেন সহ্য করতে পারে নি নিখিল । সেদিন ও বুঝে গেছিল ওর ভালবাসার মানুষের বুক জুড়ে শুধুই আছে আদৃত নামের ওই ছেলেটা । ও কোথাও নেই । কোনদিন থাকবেও না । এক রাশ অভিমান সেদিন ভিড় করেছিল নিখিলের মনে আর চোখে । ও ঠিকই করে নিয়েছিল আর কোনদিন ভাববে না ও ওই মেয়েটার কথা । তাকাবেও না ওর দিকে । নিজের সংকল্পে  সফলও হয়েছিল ও বেশ খানিকটা । কলেজ জীবন শেষ হবার পরেও আর কোনদিন সুপ্রিয়ার কোন খবরই নিতে চায় নি ও । নিজেকে ডুবিয়ে দিয়েছিল পুরোপুরি পড়াশুনার মধ্যে ।
কিন্তু উপরের ওই লোকটার মতিগতি বুঝতে পারা সত্যি বড় দায় । স্কুল সার্ভিস কমিশনের চাকরীটা পাবার পরই মা মেয়ে দেখতে শুরু করলেন নিখিলের জন্য । কিন্তু নিখিল চায় নি । সব কটা সম্বন্ধই নানা বাহানায় ভেস্তে দিত ও । অবশেষে পাকে চক্রে কিভাবে যেন একদিন নিখিলের হাতে এসে পৌঁছল সেই ছবিটা । পাত্রীর ছবি দেখেই সেদিন বুকের ভেতর দামামা বেজে উঠেছিল ওর । সেই দুটো নিষ্পাপ চোখ , সেই সারল্য মাখা মুখ । এই মেয়ে পাত্র খুঁজছে ? কিন্তু কেন ? কোথায় গেল ওর আদৃত ? সেদিন নিখিল ভেঙ্গে দিতেই চেয়েছিল এই সম্বন্ধটাও । কিন্তু পারে নি । কি যেন এক অদৃশ্য মোহ বন্ধন রুদ্ধ করেছিল ওকে । হয়তো মনের মাঝে সযত্নে চাপা দিয়ে রাখা ভালবাসাই সেই মোহ বন্ধনের নাম ।
বিয়ে করে সুপ্রিয়াকে বাড়িতে নিয়ে এলেও কোনদিন ওর সামনে সহজ হতে পারে নি নিখিল । বারবার ওর মনে হয়েছে নিশ্চয় নিতান্ত দায়ে পড়ে বা ভাগ্যের ফেরে আদৃতের সাথে কোনভাবে সম্পর্ক হারিয়েই নিশ্চয় বিয়েটা করতে হয়েছে মেয়েটাকে । কিন্তু ওর মন ? পরিস্থিতির চাপে মন তো আর বদলায় না । নিশ্চয়ই ওর মন জুড়ে এখনও আদৃতই আছে ।
 

    যতবার সুপ্রিয়ার কাছে যেতে চেয়েছে নিখিল ততবার ওর চোখের সামনে ভেসে উঠেছে সেই নীল আবীর মাখানোর দৃশ্যটা । আর অমনি পিছিয়ে গেছে নিখিল । কিন্তু সুপ্রিয়া ? সেও তো কোনদিন জোর করে নি । চুপ থেকেছে নিখিলের শীতলতায় । আর সেইজন্যই তো নিখিল ধরেই নিয়েছিল মেয়েটা সমঝোতা করেই বুঝি ঘর বেঁধেছে নিখিল নামের এই অপছন্দের মানুষটার সাথে ।
কিন্তু আজ ? আজ যে সবটুকু এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে । নিখিলের জন্য নিজের বুকে এত ভালবাসা জমিয়ে রেখেছে ওই মেয়েটা ? অথচ পুরনো অভিমানে অন্ধ হয়ে নিখিল সেটা দেখতে পায় নি । শুধু কষ্ট দিয়ে গেছে এতদিন ধরে নিজের ভালবাসার মানুষটাকে ! গত বছর দোলেও তো সারাদিন বন্ধুর বাড়িতে পড়ে ছিল নিখিল । এক ফোঁটা রঙও ভুল করেও লাগায় নি সুপ্রিয়ার গালে কিংবা কপালে ।
 

    কিন্তু অনেক হয়েছে । আর নয় । এবার নিজের সবটুকু ভুল শুধরে নেবে নিখিল । এত ভালবাসবে প্রিয়াকে যাতে ওকে কোন দুঃখ আর স্পর্শও করতে না পারে । কিন্তু সে সুযোগ প্রিয়া ওকে দেবে তো ? হঠাৎ যেন রিসোর্টের গেট থেকে প্রিয়া পর্যন্ত পৌঁছানোর দূরত্ব টা বড্ড বেশি নিখিলের । ব্যস্ত হাতে গেট ঠেলে দ্রুত পা ফেলে ভিতরে ঢুকল ও । এগোচ্ছে হন হন করে । দু মিনিটের মধ্যে ও পৌঁছে গেল রিসোর্টের গার্ডেনে । এখানেই চলছে রঙ আর আবীর নিয়ে টুকরো বসন্ত বন্দনা । কিন্তু সুপ্রিয়া কোথায় ? ওকে দেখা যাচ্ছে না তো ? অস্থির লাগছে নিখিলের ।
নিখিলকে দেখতে পেয়েই এবার এগিয়ে এল তানিয়া ।
-“ ও কোথায় তানিয়া ? “ আকুল স্বরে জিজ্ঞাসা করল নিখিল ।
আঙ্গুল তুলে দেখাল তানিয়া । নিখিলও দেখতে পেল । রঙ আবীর হইচই সব কিছু থেকে সরে এক কোণায় উদাস চোখ মেলে দাঁড়িয়ে রয়েছে সে ।
ধীর পায়ে ওর দিকে এগিয়ে গেল নিখিল। পিছন থেকে আলতো স্পর্শ করল ওর পিঠে ।
-“ প্রিয়া “… ডাকল অস্ফুটে ।
এবার সামনে ফিরল সে। দু চোখের কোলে চিকচিক করছে মুক্তো দানা ।
-“ তুমি? তুমি এখানে এসেছ “? কি ভীষণ মায়াময় স্বরে যেন বলল সুপ্রিয়া ।
-“ হ্যাঁ এসেছি । একটা কথা বলতে , যে কথাটা শহরের নিত্য দিনের অভ্যাসগত জীবনে বারবার বলতে চেয়েও বলতে পারিনি সেটা বলতেই আজ এসেছি । “
-“ কি কথা “? গলা কাঁপছে প্রিয়ার ।
-“ ভালবাসি । তোকে খুব ভালবাসি প্রিয়া । শুধু আজ নয় , সেই কোন যুগ থেকে । কলেজের প্রথম দিন থেকেই “।
-“ মিথ্যা কথা । মোটেই ভালবাস না তুমি আমায় । ভালবাসলে কেউ এভাবে কাউকে শুধুশুধু কষ্ট দেয় ? বিনা দোষে দূরে সরিয়ে রাখে “? আবার চারপাশের তোয়াক্কা না করেই কাঁদছে মেয়েটা ।
-“ কি করব বল আমি যে বড্ড বোকা, আর বাজেও  । সেইজন্যই তো নিজের মনের কথা বলতে পারি না । নিজের মনের মানুষের মন বুঝতেও পারি না । এই বোকা , বাজে বরটাকে ভালবেসে একবার নিজের করে দেখ প্রিয়া । আর কোনদিন সে তোকে কোন কষ্ট পেতে দেবে না “।
এবার নিখিলের বুকে আছড়ে পড়ল ওর প্রিয়া । কেঁদেই চলেছে অঝোর ধারায় ।
-“ আমার দিকে তাকা প্রিয়া । একটিবার “।
আস্তে আস্তে মুখ তুলল সুপ্রিয়া । আর অমনি দু হাতের নীল আবীর নিখিল ঘষে দিল বউয়ের গালে ।
-“ এই কি হল এটা “? বলেই হেসে উঠেছে সুপ্রিয়া । পলকেই লজ্জায় রক্তাভ ওর মুখ । লাল নীলের মিশেলেঅদ্ভুত মায়াবী রঙ খেলছে ওর মুখে । চোখে ঝিকমিক করছে অসংখ্য  নক্ষত্রের মত উজ্জ্বল ভালবাসা , যে ভালবাসার প্রতিটি কোণায় নিখিল দেখতে পাচ্ছে শুধুই নিজের নাম ।
 

    কপালে একটা চুমু খেয়ে ঝট করে বউকে নিজের বুকে চেপে ধরল নিখিল ভিড় থেকে একটু আড়াল খুঁজে নিয়েই । আকাশে বাতাসে উড়ছে রঙ বাহারি আবীর । দূরে কোথায় যেন বড্ড সুরেলা স্বরে ডেকে উঠল একটা কোকিল । আকাশ বাতাস  সবাই যেন সমস্বরে চীৎকার করে বলছে
‘ বসন্ত এসে গেছে … বসন্ত এসে গেছে ‘……

                                        ------ সমাপ্ত------
Pallabi Sengupta



খুঁত - পল্লবী পাল


খুঁত 
পল্লবী পাল


    অপারেশন থিয়েটারের দরজাটা বন্ধ হয়ে যাবার কিছুক্ষনের মধ্যেই লাল আলোটা জ্বলে উঠল। আশঙ্কা আর দুশ্চিন্তার বোঝ মাথায় নিয়ে অবসন্ন শরীরে দরজার পাশের চেয়ারে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসে পড়লো অভি। হ্যাঁ, বাস্তবিকই তার পিঠ ঠেকে গেছে দেয়ালে। বিগত একবছর মন আর মাথার সঙ্গে অসহায়ভাবে ক্রমাগত যুদ্ধ করতে করতে আজ নিজেকে বড়োই ক্লান্ত লাগছে। সত্যি এক একবার ভাবছে নিষ্ঠুর নিয়তির কাছে বোধহয় হেরেই যেতে হবে, আবার কোথাও যেন একটা ক্ষীণ আশা ওকে অন্তরে অন্তরে আশ্বাস দিচ্ছে - সব ঠিক হয়ে যাবে, সব ঠিক হয়ে যাবে।

    অপারেশন থিয়েটারে ঢোকার আগে স্ট্রেচারে শুয়ে যখন বিনীতার ভাষাহীন কোটরাগত চোখ দুটো থেকে নিঃশব্দে জল গড়িয়ে আসতে দেখেছিল, তখন নিজের চোখের জলকেও ধরে রাখতে পারেনি অভি। এক মুহূর্তের জন্য ভুলে গিয়েছিল ছোটবেলায় শেখানো কথাগুলো - 'ছেলেদের কাঁদতে নেই'। কি করবে অভি ? বিয়ে হয়ে থেকে এই আড়াই বছরে বড্ডো ভালোবেসে ফেলেছে যে বিনি কে, চোখের জলটার থেকেও বিনির চোখের ওই শুন্য দৃষ্টিটা যে ওর ভিতরটাকে দুমড়ে মুচড়ে দিচ্ছে। অথচ এরকম হবে ও তো কখনও ভাবেনি, সব কিছু তো সুন্দর ভাবে শুরু হয়েছিল। দুজনের আলাপ হাওয়া, একসঙ্গে পথ চলা শুরু হয়েছিল স্বপ্নের মতো।

    অভির খুব ভালো মনে আছে সেদিনের কথা। অফিস থেকে ফিরে দেখে তপা মাসি আর মা সোফায় বসে গল্প করছে। ঘরে ঢুকতেই তপা মাসি বেশ উৎসাহের সঙ্গে বললো -
---এই তো এসে গেছে অভি |
---তপা মাসি কেমন আছো? কখন এলে ?
---দুপুরে এসেছি রে, অফিস থেকে এলি যা একটু হাত পা ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নিয়ে এখানে এসে বস তো, তোর সঙ্গে কথা আছে।
এই রে! কথা আছে মানেই তো বোঝাই যাচ্ছে কি কথা। মাসতুতো বোন তুহি ঘর থেকে বেরিয়েই অভিকে দেখে একগাল হেসে বললো |
---দাদাভাই, তোর বরবাদির প্ল্যান চলছে দুজনের |
---সে তো বুঝতেই পারছি, চোখে মুখে এতো খুশি আবার আমাকে দরকার, অঙ্ক মিলে গেল, তুই কেমন আছিস বল ? ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ফার্স্ট ইয়ার , প্রেম টেম করছিস ?
---ধুর ধুর ক্লাসের একটাও যুতের না, যেগুলো একটু পদের সেগুলো আবার আগে থেকেই বুক , সিনিয়রদের দিকে তো এখন তাকানো যাবে না, পরের ইয়ারে চান্স নেবো |
তপা মাসি তুহির দিকে চোখ গোল করে বললো -
---হ্যাঁ পড়াশোনা বাদে ঐসবই হবে। অভি তুই আর এটাকে তোল্লাই দিস না, বরং শেখা যে প্রেম না করেও কীকরে নাইন পয়েন্টার হয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস্ করে ভালো চাকরি পেয়ে নিজের পায়ে দাঁড়ানো যায়।

    তুহি একটু অভিযোগের সুরে বললো -
---উফফ তোমরা ইয়ার্কিও বোঝো না, আর দাদাভাই যদি প্রেম করতো তাহলে ভালোই হতো, তোমাদের পাত্রী খোঁজার এতো ঝামেলা করতে হতো না। এতদিনে নাতি নাতনি কোলে নিয়ে বসে থাকতে।
অভির পরিচিত উত্তর ---তোমরা ঐসব করো বসে বসে, আমি হাত পা ধুয়ে আসি।

    কিন্তু ফিরে আসার পর নিস্তার আর পেলো কই, তপা মাসি প্রায় ঘাড়ের ওপর উঠে মেয়ের ছবি দেখিয়েই ছাড়ে।মেসোমশাই এর পুরোনো কলিগের মেয়ে - বিনীতা। বিনীতার মা মেসোমশাইয়ের সঙ্গে চাকরি করতেন শিলিগুড়িতে। তারপর মেসোমশাই বদলি হয়ে চলে এলেন হুগলিতে। বাবা মা দুজনেই রিটায়ারের পর এখন নাকি বিনীতারা কলকাতায় এসেছে, এখানেই পড়াশোনা করছে বিনীতা। অনেকদিন পর নাকি আবার কোনো কলিগের মাধ্যমে বিনীতার মায়ের সঙ্গে মেসোমশাইয়ের যোগাযোগ হয়েছে, সেখান থেকে নাকি তপা মাসি পেয়েছে এই ঘটকালির আইডিয়া। মাসিমনির মোদ্দা কথা হলো -
'বিনীতার মতো শিক্ষিত ও মার্জিত, আধুনিক মেয়ে নাকি খুব কম আছে। দেখতেও বেশ সুন্দর। পরিবারের লোকজন খুবই ভালো, আমাদের অভির জন্য এই মেয়ে এক্কেবারে পারফেক্ট।'

    অভির মা সুদীপ্তা দেবী আবার দেখতে ভালোর থেকেও শিক্ষিত মার্জিত মেয়ে বেশি পছন্দ করেন। নিজেও স্বভাবে সেরকমই। মাসি ওই জন্য এই কথা গুলো আগে বললো। একমাত্র ছেলের বৌ হবে তাই ছেলের পছন্দের পাশাপাশি এই দাবীটুকু সবসময় করেন। অভি পরিস্থিতি যা বুঝছে তলে তলে অনেকদিন থেকেই কথা চলছে, এখন খালি অভিযান আর বিনীতার একে অপরকে পছন্দের অপেক্ষা।
'সে দেখা যাবে’ গোছের একটা কিছু উত্তর দিয়ে অভি ঘরে চলে এল। বিয়ে বড়ো ঝামেলার ব্যাপার, বন্ধুমহলে যে কজনের উইকেট পড়েছে সবার থেকে সংসার ধর্মের গল্প শুনে বেশ চাপে আছে । ইচ্ছা যে হয়না ওর তা বলা ভুল, কিন্তু সে ভাবে মনে ধরেনি কাউকে, আসলে ওতো মেশার চেষ্টাও করে না। বাবাকে অভি খুব ভয় পেত, সেই ভয়ে অনেকদিন আগেই হারিয়ে গেছে কৈশোরের ভালোলাগাগুলো। এরমধ্যে তুহি আবার কোথা থেকে বিনীতার ফেসবুক একাউন্ট নিয়ে হাজির হলো-
---দাদাভাই ওই সব ছবি ছাড়, বিনীতা দির ফেসবুক দেখ, ফেসবুক। আমি তোকে বলছি এতে না করিস না। বিনীতাদি কে খুব ভালো লাগে, আমার তো খুবই পছন্দ। তোর মাথার সবকটা চুল পড়ে যাবার আগে এবার অন্তত বিয়ে করে নে |
---তোর বিনীতাদির আমাকে তো নাও পছন্দ হতে পারে, তার তো মতামত বা অন্য কিছু থাকতে পারে |
---ওসব নেই, জিজ্ঞাসা করেছি আমি। তুই কথা বলেই দেখ, ওর তোকে পছন্দ হবেই হবে |

    অভি বিনীতার একাউন্টে চোখ বোলালো, বেশ দেখতে, নিটোল বাঙালি চেহারা, সাহা ইনস্টিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স এ রিসার্চ ফেলো। পড়াশোনায় তারমানে ভালোই মনে হচ্ছে। পোষ্টের লেখা দেখে তো বেশ সুন্দর চিন্তার মানুষ মনে হয়, রুচিবোধও আছে । প্রথম দেখাতেই বেশ ভালো লেগে গেল অভির।
---কীরে কি বুঝলি দাদাভাই ?
---আমার একার পছন্দে কি কিছু হবে ?
---তারমানে তোর পছন্দ ?
---আরে ওই ভাবে বলা যায় নাকি, কথাবার্তা নেই কি করে বুঝবো কেমন মানুষ?
---তা বল না কথা, আমি ইন্ট্রো করিয়ে দেব। সত্যি খুব ভালো মেয়ে রে, কথা বললেই বুঝতে পারবি। খুব মিশুকে আর ভদ্র, তা বলে হাঁদা ভোঁদা ভাবিসনা যেন। তোর থেকে স্মার্ট |
---খুব ওস্তাদি করছিস না আজকাল...??
---চুপচাপ নম্বরটা সেভ কর, আমি তারপর ফোন করে কথা বলিয়ে দেব, তারপর নিজেরা বুঝে নিস্ |

    সেই যে প্রথম আলাপ হল ফোনের ওপারে, তারপর কয়েক মাসের কথাবার্তাতেই সব কেমন ম্যাজিকের মতো বদলে গেল। পাত্র পাত্রীর সম্মতি পেয়ে মা মাসিরা কাকিমারা বিয়ের কথাবার্তা আয়োজনে মেতে থাকলো। আর চুপিসারে অভি বিনীতাকে নিয়ে মনের কোনায় বেঁধে ফেললো ঘর। সত্যি মনে হতো অভির এতদিন কোথায় ছিল বিনীতা, হয়তো এই জন্যই অভির জীবনে এতদিন কোনো নারী আসেনি। বিনীতার মনের খবর পাবার পর যেন আকর্ষণ আরো বেড়ে গেল, এরকম আকর্ষণ অভির কাছে নতুন। বিনীতার সঙ্গে অভির সম্পর্কটা সহজভাবেই আপনি থেকে তুমিতে এসে গেছে।কোনো মেয়ের প্রতি এভাবে শারীরিক আকর্ষণ অনুভব করেনি কখনো আগে। হ্যাঁ, বলিউডি বা হলিউডি সিনেমা দেখে শরীরে উত্তেজনা খেলতো ঠিকই কিন্তু এভাবে হয়নি। নিজের মধ্যে পরিবর্তন গুলো ভালোই বুঝতে পারছে, কাজের ফাঁকে ফাঁকেই বিনীতার কথা মনে পড়ে, অনেক্ষন ধরে কথা বলতে ইচ্ছে হয়। বিনীতা যখন অভির ছবি চেয়ে পাঠায়, কমপক্ষে পাঁচবার চুল ঠিক করে, দশটা ছবি তুলে তবে একটা পাঠায়। আর বিনীতার যখন ইমপ্রেস হবার রিপ্লাই আসে, বা অফিসের বা শরীরের খোঁজ খবর নেয়, কিযে ভালো লাগে। বিয়ের তখন মাত্র মাসতিনেক বাকি, একদিন আদর করে হঠাৎ বিনি বলে ডেকে ফেলেছিল অভি, খুব লজ্জা পেয়ে বিনীতা বলেছিল -
---এই নামেই ডেকো, নামটা ভীষণ আদুরে
---আর যে নাম দিলো সে ?
---সেতো এখন বোঝার উপায় নেই, অপেক্ষা করতে হবে ... হি হি...
---উফফফ...এখনও তিনমাসের অপেক্ষা, এতো সহ্য হয় বলো?
---ও হো, তর সইছেনা বুঝি, তবে তুহিনা যে বলতো দাদা বিয়েই করতে চাইছিলো না
---চাইছিলাম না তো, তখন তো আর আমার জীবনে বিনি আসেনি, তর সইছে না, একদম না, এখনই তোমাকে কাছে টেনে ভীষণ আদর করতে ইচ্ছে হচ্ছে
---ইসস... ধ্যাৎ !

    সেই প্রথমবার বিনির জন্য নিজের সামসুঙের খাজা স্মার্টফোনটাকে চুমু খেয়েছিল।

    বিয়েটা ছিল পুরো রঙিন স্বপ্নের অধ্যায়, কত হাসি মজা, ইয়ার্কি ঠাট্টা আনন্দে ঝটপট করে কেটে গেল তিনটে দিন। আর ফুলসজ্জার রাতে বিনিকে নিজের মতো করে প্রথম কাছে পাবার আনন্দ, সেটা ছিল স্বপ্ন সত্যি হবার মতো। বিয়ের অনুষ্ঠানের ক্লান্তি আর ধকল থাকলেও একে অপরকে প্রথমবার ছোঁবার মারাত্মক শিহরণ সামলাতে রাখতে পারেনি দুজনের কেউই। অভির ইতস্ততা বুঝতে পেরে এক মুহূর্তে তা কাটিয়ে দিয়েছিলো বিনীতা। অভি সেই প্রথমবার হাত রেখেছিলো কোনো নারীর আবরণহীন শরীরে। বিধাতার অপরূপ সৃষ্টির নিখুঁত সৌন্দর্য প্রত্যক্ষ করেছিল স্বচক্ষে, প্রথমবার। নরনারীর পরস্পরের প্রতি আদিম অমোঘ শরীরী আকর্ষণ ও ক্রিয়ার সাক্ষী হয়ে থেকেছে দুজনে, বার বার, বহুবার।

    ক্রমে একসঙ্গে থাকারও প্রায় একবছর ঘুরে গেছে, স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক ভালোবাসা, মান অভিমান, খুনসুটি আর ঝগড়াঝাড়ি মধ্যে দিয়ে সহজ থেকে সহজতর হয়েছে। শরীরের থেকেও মন আপন হয়ে গেছে বেশী। বিনি যখন জানালো ও পিরিয়ড মিস করেছে প্রায় দুসপ্তাহ আগে, প্রথমদিকে একটু ঘাবড়ে গিয়েছিল অভি। তারপর দুজনেই আশায় আশায় বুক বেঁধেছে, প্রেগন্যান্সি টেস্ট পজেটিভ হওয়ায় খুশির যেন সীমা ছিল না, অফিস থেকে ফিরে অভি খুব আদর করেছিল বিনিকে। মা বাবা পরিবারের নিকত্মীয়েরা প্রাণ ভরে শুভেচ্ছা জানিয়ে ছিল বিনিকে। অভির মা তো বিনিকে খাওয়া দাওয়া আদর যত্নে ভরিয়ে দিয়েছিল। ভীষণ সাবধানী ছিল দুজনেই, ফার্স্ট ট্রাইমেস্টার, সাবধানে থাকতেই হবে।

    মিলনে সাবধানী হয়ে গেলেও অভি তো তখনও কতবার বিনিকে স্পর্শ করেছে, মাথা রেখে শান্তিতে শুয়েছে ওর নরম উন্মুক্ত বুকে। কেন যে আগে বুঝতে পারেনি যে বিনির নারীত্বের গর্ব দুটির একটিতে বাসা বেঁধেছে ক্যান্সার। সেভাবে খেয়াল করেনি দুজনের কেউই। একদিন রাতে বিছানায় এলিয়ে কথায় কথায় বিনি হাত তুলে আর্মপিটে হাত দিয়ে বলেছিল |
---দেখো তো... আমার এখানটা কেমন শক্ত শক্ত লাগছে |
---কই দেখি ? ... হ্যাঁ তো কেমন যেন ঢিলের মতো |
---দেখোনা অনেকদিন ধরেই নিপিল এ কিরকম ইচিং হচ্ছে, কেমন খসখসে হয়ে গেছে, রস কাটছে...
---প্রেগন্যান্সিতে অনেক কিছু সমস্যা হয়ে থাকে শুনেছি, একবার ডক্টরকে দেখিয়ে নেবো...
---কি জানি , আবার টিউমার হল না তো ?
---ধ্যাৎ ! তোমার না যত আজেবাজে চিন্তা, মাথা থেকে পা পর্যন্ত সুস্থ মানুষ, ওসব কেন হবে ? চলো কালকেই এপয়েন্টমেন্ট নিচ্ছি |

    গাইনোকোলজিস্ট ডক্টর ভট্টাচার্য সেদিন একটু গম্ভীর ছিলেন, বিশেষ কিছু বলেননি, শুধু ম্যামোগ্রাফি করবার কথা লিখে দিলেন। তারপর অভির ভালো মনে আছে রিপোর্ট হাতে পেয়ে হরমোন রিসেপ্টর ER - PR বোথ পজেটিভ ব্রেস্ট ক্যান্সার দেখে দুজনেই পড়ি কি মরি করে ছুটতে ছুটতে ডক্টর ভট্টাচার্যর চেম্বারে এসে উপস্থিত হয়েছিল। বিনি কেঁদে যাচ্ছিলো অনবরত, অভি স্বান্তনা দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু যখন নিজের কানে শুনলো বিনির ব্রেস্ট ক্যান্সার ধরা পড়েছে অ্যাডভান্সড স্টেজে অভি নিজেও দিশেহারা হয়ে পড়েছিল। ডক্টর ভট্টাচার্য অবিলম্বে রেফার করেন ডক্টর গাঙ্গুলির কাছে। আপোয়েনমেন্ট পেতে তিনদিন দেরি হয়েছিল। টকটকে লাল চোখ নিয়ে বিনি বসে ছিল ডক্টর গাঙ্গুলির চেম্বারে, সমস্ত হিস্ট্রি শুনে আর রিপোর্ট দেখে ডাক্তারবাবু নিজেই যেন কথাটা ঠিক কিভাবে শুরু করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। কথাগুলো এখনও অভির কানে বাজে |

---ভীষণ আনফর্চুনেট সিচুয়েশন। ফার্স্ট প্রেগন্যান্সি, ফার্স্ট ট্রাইমেস্টার । টিউমারের যা স্টেজ দেখছি একে ছোট করতে হলে ওষুধের সঙ্গে কেমোথেরাপি দিতে হবে। কিন্তু এই সিচুয়েশনে তো দেয়া যাবে না, সেভেন উইকস তো... অসম্ভব। এই সময় বাচ্চার অর্গান তৈরীর আরম্ভ, কেমো নিলে বাচ্চা বিকলাঙ্গ হবে, আরো অনেক প্রব্লেম আসতে পারে। দেয়া যাবেই না, এক্ষেত্রে অপশন মাত্র দুটো বাচ্চাকে রাখতে গেলে ব্রেস্ট কেটে বাদ দিতে হবে আর নাহলে এবোর্ট করিয়ে কেমোথেরাপি ...

    ডক্টর গাঙ্গুলির কথাটা শেষ হবার আগেই মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিল বিনি। অভি কোনো মতে ওকে ধরে ফেলে। বাড়িতে তখনও এই খবরটা জানায়নি কেউ। হাসিখুশি বিনির মুখ থেকে যেন হাসিতে বিদায় নিয়ে নিয়েছিল। অভি বিনিকে খুব ভালোবাসে, ওর কাছে যে আসছে তার থেকেও প্রিয় যে আছে। অনেক ভাবনা চিন্তার পর অভি বলেছিল এবোর্ট করিয়ে নিতে। কিন্তু মায়ের মন, ভূমিষ্ট হবার আগেও বাচ্চার সঙ্গে মায়ের যে কতটা এটাচমেন্ট থাকে সেটা বুঝতে পারেনি অভি। নিজের শরীরের মধ্যে একটা প্রাণশক্তিকে লালন করার যে ক্ষমতা ঈশ্বর আশীর্বাদ স্বরূপ নারীদের দিয়েছেন তার মহত্ব উপলব্ধি অনেকেই করতে পারেনা। অভিও সেভাবে পারেনি, তাই বার বার বিনিকে বলেছে তোমার আগে সুস্থ হওয়া দরকার, তোমাকে হারাতে পারবো না, এবোর্ট করিয়ে নাও, তুমি সুস্থ হলে আবার চেষ্টা করবো আমরা। বিনি পাথরের মতো শুধু শুনে গেছে, ও যে স্বপ্নেও এই ঠান্ডা মাথার খুনের কথা ভাবতে পারেনা।

    বাড়িতে একসময় জানাতেই হতো। মা বাবাদের জানানোর পর বিনীতার ওপর মানসিক চাপ আরও বেড়ে গেল। একদিকে অভির মা বাবা একদিকে বিনির মা বাবা সবাই মর্মাহত হয়ে গেলেন। কান্নাকাটি, মনখারাপ মিলে সবকিছু দুঃস্বপ্নের মতো লাগছিলো অভির, মনে মনে নিজেকে যেন আশ্বাস দিচ্ছিলো, ঘুম ভাঙলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। অভির মতে বাড়ির সবাই সায় দিল। সুদীপ্তা দেবী... যিনি নাতি নাতনির আশায় আনন্দে আত্মহারা হয়ে গিয়েছিলেন তিনিও কাঁদতে কাঁদতে বিনিকে বলেন রাজি হয়ে যা মা। অভি আঁতকে উঠেছিল বিনির মতো বাস্তববাদী মেয়ের মুখে এরকম উত্তর শুনে,
---ওকে যদি মারতেই হয় মা, তাহলে আমি নিজেই বিষ খেয়ে শেষ হয়ে যাব

    অবশেষে বিনীতার ইচ্ছা মেনেই ডক্টর গাঙ্গুলি সম্মতি দিলেন সিঙ্গেল ম্যাসেকটোমিতে। এক্সিলারি লিম্মফ নোডের সঙ্গে বাদ পড়লো বিনির বাঁদিকের স্তন।

    ট্রিটমেন্ট, কাউন্সেলিং এর জন্য বিপুল টাকা দিতে দিতে টান পড়েছে দুই পরিবারের সেভিংসে, তবু সবাই চেষ্টা করে যাচ্ছে যাতে ভালো থাকে বিনীতা।
হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফেরার পর থেকে ওর বিনিকে শুধু চোখের সামনে ক্ষয়ে যেতে দেখেছে অভি । পোস্ট সার্জারি নিয়মকানুনগুলো মানতে মানতে যেন হাপিয়ে উঠেছিল । বেশিরভাগ সময়ই কেমন আনমনা থাকতো, অভি জোর করে মন ভালো করা গান চালিয়ে দিত, বিনি চুপচাপ শুয়ে শুনতো। বইয়ের পাতা খোলাই রয়ে যেত, বিনির উদাসীন দৃষ্টিটা হারিয়ে যেত কালো হরফের মাঝে অন্যকোথাও। প্লেটে কেটে রাখা আপেলটুকরোগুলো মলিন হয়ে রয়ে যেত।
বিনির শারীরিক পরিবর্তনের কারণে এই মানসিক পরিবর্তনটা ভালোই বুঝতে পারতো অভি, ওর সাথে কোনো পরিচিত মহিলা দেখা করতে এলে ও একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে তাদের বুকের দিকে। অভি পাশে বসে হাত ধরলেও কেমন কুঁকড়ে যায়। ঘুম ভেঙে উঠে একদিন অভি দেখেছিল, বিনি আয়নায় একদৃষ্টে চেয়ে আছে নিজের অনাবৃত বুকের দিকে, একহাত বুকের বাঁদিকের লম্বা কাটা দাগটায় আর একহাত পেটের ওপর। অভি উঠে এসে বিনিকে একটু আদর করে আশ্বাস দিতে চেয়েছিলো। বিনি তাড়াতাড়ি বুকে চাপা দিয়ে বলে উঠেছিল
---আমাকে ছুঁয়োনা অভি, আমার আর তোমাকে কিছু দেবার নেই, আমার শরীরে খুঁত হয়ে গেছে।
কথাটা শুনে অভির ভীষণ কষ্ট হয়েছিল। অভি নিজেও জানে ওদের সন্তান পৃথিবীতে আসার পর হয়তো সবকিছু স্বাভাবিক হবে না। বিনির সঙ্গে ওর শারীরিক সম্পর্কও সম্পূর্ণভাবে আগের মতো হবে না, তবু বিনিকে ও মন থেকে ভালোবাসে। বিনির শরীরটাই যে ওরকাছে সব নয় এটা অনেক অনেকবার বুঝিয়েছে অভি, হয়তো বুঝতে চায়না বিনি, ভাবে অভি করুনা করছে ওর ওপর।

    শারীরিক ভাবে দুর্বল ও মানসিকভাবে বিধস্ত থাকায় বিনির প্রেগন্যান্সিতে কমপ্লিকেশন ছিলই। আজ বিকেলে বিনির হঠাৎ প্রচন্ড ব্যাথা ওঠায় এমারজেন্সিতে ভর্তি হতে হয়। ডক্টর ভট্টাচার্য সব দেখে আর রিস্ক নিতে চাননি। ইমিডিয়েটলি সি সেকশনের জন্য ওটি রেডি করার নির্দেশ দিয়ে অভিকে বলেছিলেন
---আমাকে ঈশ্বর যতটুকু ক্ষমতা দিয়েছেন তাতে আমি গাছ আর ফল দুটোকেই বাঁচাবার চেষ্টা করবো। প্রার্থনা করো আমাকে যেন ঈশ্বর এই কঠিন পরীক্ষার মধ্যে না ফেলেন।

    অপারেশন থিয়েটারে ঢোকার সময় বিনির চোখের ওই শুন্যদৃষ্টি আর নিঃশব্দে জল গড়িয়ে পড়াটা অভির চোখের সামনে বার বার ভেসে উঠছে। বিনির নিস্তেজ হয়ে আসা শরীর যেন সমস্ত লড়াই থেকে মুক্তি পেতে চায়। ওর নিঃশব্দ কান্না দেখে নিজেকে সামলে রাখতে পারেনি অভি। ভেজা চোখে বিনির হাতটা মুঠোর মধ্যে শক্ত করে ধরে বলেছিল- "মনের জোর হারিয়ে ফেলো না বিনি, আমি আছি তো তোমার সঙ্গে, দেখো সব ঠিক হয়ে যাবে, আমরা দুজনে মিলে আমাদের সন্তানকে মানুষ করব, শুনলে বিনি, তুমি আমি দুজনে..." তারপর একটা কিচকিচ শব্দ তুলে স্ট্রেচারটা ওটিতে ঢুকে যায়।

    সেই মুহূর্তে বিনিকে প্রানভরে আশ্বাস দিলেও অভি নিজের মনকে কিছুতেই স্থির রাখতে পারছে না। অতীতের হেসে খেলে কাটানো মুহূর্তগুলোকে ঢেকে দিয়ে কালো মেঘের মতো ক্রমশ জমাট বাঁধছে ভয় - এতদিনের কঠিন লড়াই শেষে হেরে যাবার ভয়, পৃথিবীর আলো দেখার মুহূর্তে ওদের ভালোবাসার সন্তানকে বিদায় জানবার ভয়, ওর আদরের বিনিকে চিরদিনের মতো হারিয়ে ফেলার ভয়। না না আর ভাবতে পারছে না, শরীরের সমস্ত শক্তি যেন ফুরিয়ে আসছে। অন্তরের অস্থিরতা, আশঙ্কা, মানসিক চাপ যেন শুষে নিচ্ছে সবকিছু। দেয়ালে মাথা ঠেকায় অভি, একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ে, চোখ বুজে আসে।

    এভাবে কতক্ষণ অপেক্ষা করেছে অভির তা খেয়াল নেই। কাঁধের মধ্যে একটা হাতের স্পর্শ পেয়ে অভি চোখ খুলল, বিনির বাবা ডাকছেন। অপারেশন থিয়েটারের লাল আলোটা নিভে গেছে। অভি তাড়াতাড়ি চেয়ার ছেড়ে ওঠার চেষ্টা করল, পারছেনা। হাত পা ভীষণ ভারী হয়ে গেছে, হাজার চেষ্টাতেও নিজেকে টেনে তুলতে পারছে না। 'অভি এস', 'অভি আয়' ডাক শুনতে পাচ্ছে। দেহের কোনায় কোনায় ভিড় করেছে এ কেমন অপ্রতিরোধ্য ক্লান্তি। অভি দেখতে পাচ্ছে বাবা মায়েরা ছুটে চলে গেল অপারেশন থিয়েটারের দরজার কাছে। ডক্টর ভট্টাচার্য এক সদ্যোজাতকে কোলে নিয়ে অপারেশন থিয়েটার থেকে হাসিমুখে বেরিয়ে এলেন। রক্তমাখা একটা ছোট্ট প্রাণ প্রানপনে চিৎকার করে নিজের অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে। সেই কান্নার আওয়াজটা নিস্তব্ধ বাতাসে তরঙ্গ তুলে এসে পৌঁছায় অভির কানে।

    অভির চোখের দৃষ্টিটা হঠাৎ কেমন ঝাপসা হয়ে যায়, সেই ঝাপসা দৃষ্টিতে ধীরে ধীরে ভেসে ওঠে একটা দৃশ্য-
বিনি উন্মুক্ত বক্ষে তার নাড়ি ছেঁড়া ধনকে স্তন্যপান করাতে ব্যস্ত, ফুটফুটে সদ্যজাতটিও চোখবুজে তার মায়ের স্নেহরসে মগ্ন। অনেকদিন পর ওর বিনি হাসছে, সেই মন ভরিয়ে দেয়া নির্মল হাসি। বুকের অপরপাশে কাটাদাগের খুঁতটা তখনও স্পষ্ট। অভির অন্তরের সব ভয় আর আশঙ্কার কালো মেঘ সরিয়ে একচিলতে আলোর মতো ধীরে ধীরে একটা অদ্ভুত শান্তি, তৃপ্তি নেমে আসছে, এতো সুন্দর, এতো পরিপূর্ণ, এতো নিখুঁত সে দৃশ্য!

সমাপ্ত


Pallabi Paul




তিতি - পিন্টু মান্না



 তিতি

 পিন্টু মান্না

 

    রোজ বনানীর কলেজ থেকে ফেরার অপেক্ষায় থাকে একজোড়া পিটপিটে চোখ । কলিংবেল বাজলেই তিতি তিতি বলে দে দৌড় ! দরজা খোলামাত্রই একগাল হাসিতে ছোট্ট হাত পেতে নিজের দাবিদাওয়া পেশ হয় ।
-‘কি চাই?’
-‘তকলেত’
-‘অ্যাঁ রোজ বাবুর জন্য চকলেট আনতে হবে ! কে রে আমার !’
চকলেটের প্যাকেট দিদিকেই কাটতে হয় । দিদি বলে
-‘আমায় দে’
যে সামান্য অংশ দিদির মুখে যায় তাও স্থায়ী হয় না বেশিক্ষন ! দিদির মুখের এঁটো চকলেটের যে কি স্বাদ সে সেই বোঝে !

                              

-‘উফফ আবার এসেছে ! এতবড় বিছানা থাকতে আমার গায়ের উপরেই শুতে হয় তোকে?’
নিষ্ফল আবেদন । বরং আরো জাপটে জুপটে শোয় ।
রোজ সকালে ঘুম ভাঙলে টলতে টলতে এসে দিদির গায়ের উপর ঘন্টাখানেক তৃপ্তির ঘুম না দিলে শান্তিই হয়না তার ।

        রোজ দিদির হাতে গায়ে হিজিবিজি ট্যাটু তো আছেই । একদিন সকালে দিদি ঘুম থেকে উঠে আয়নায় দেখল তার গোঁফ হয়েছে ! দেখল বিছানায় বালিশের পাশে তার পার্মানেন্ট মার্কারটা পড়ে আছে ।অপরাধটা একটু বেশিই হয়েছিল । মায়ের বকুনি খাওয়ার সময় সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয় তার দিদিই ।
-‘ও এখন কেন ভিজে বেড়ালের মতো আসছিস কাছে ?’
হাতে দাঁত বসলো !
-‘উফফ ! আ্যই কামড়ালি কেন ?’
-‘তুই বেলাল বল্লি তেনো !’


        সেদিন মায়ের হাত ধরে ধিতাং ধিতাং করে নাচতে নাচতে উলঙ্গ রাজা দিদির ঘরে এসে ঢুকলেন । আড়চোখে দেখল বনানী।
-‘ওকে বলে দাও কাম্মা আমি ওকে স্নান করাতে পারবো না !’
দুটো ছোট্ট চোখ গোল গোল হয়ে গেল । বেশ রেগে মেগে বলল
-‘তেনো ?’
-‘অ্যাঁ কেন ! তুই আমার মাউথওয়াশে কুলকুচি করিসনি ?!’
-‘বেত তোলেতি ! তুই তকলেত দিন্নি তেনো ?’
-‘ওরে আমার কে রে ! ওর জন্য রোজ গাড়ি গাড়ি চকলেট যোগান দিতে হবে !’
চোখ পাকলো মা
-‘আ্যই বেশ করেছিস ? দেখবি মজা ?’
অমনি একলাফে বিছানায় উঠে দিদির নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গেল ।
-‘ও এখন দিদি কেন নেংটা রাজা ?’
দাঁত বসল !
-‘দেখেছ কান্ড ! আ্যই কামড়ালি কেন দিদিকে ?’
-‘ও আমাতে নেনতা বল্লো তেনো ?’
-‘তবেরে !’
মহারাজ একলাফে লাফ মেরে দিদির বাথরুমে
হাসতে হাসতে প্রতিমাদেবী বললেন
-‘নে মিঠু পোশাক পাল্টে নে , তোকে স্নান না করিয়ে তো ওনার স্নান হবে না !’
-‘যা বলেছ কাম্মা ! মাথায় জল ঢাললেই জড়িয়ে ধরে সে কি কান্ড করবে !’
হাসলেন প্রতিমাদেবী
-‘নেহাত আমি পেটে ধরেছি । কেন যে তোকে মা বলে না সেই আশ্চর্য লাগে আমার !'


        সেদিন মহারাজ রান্নাঘরে গিয়ে দেখলেন লুচি ভাজা চলছে ।
মানদা পিসি লুচি দিতে গেল । দুটো ডাবা ডাবা চোখ একটাই প্রশ্ন করল
-‘তিতি ?’
মা বললেন
-‘হ্যাঁ তোমার দিদিকেও দেওয়া হবে কোনো চিন্তা নেই !‘
জেঠিমা হাসতে হাসতে বললেন
-‘ওরে ওকে দিয়ে লাভ নেই মানদা । মিঠুকে দিয়ে আয় যদি বাবুর পেটে যায় !’
মানদা পিসির হাত ধরে নাচতে নাচতে গেল ।দিদির ঘরে ঢুকেই বিছানায় উঠে লাফাতে লাফাতে বলল
-‘তিতি ! তিতি ! নুচি ! নুচি !!’
লুচি অর্ধেকটা দিদির মুখে যায় । দিদির মুখ থেকে মুখ লাগিয়ে ছিঁড়ে না খেলে বাবুর শান্তিই হয়না তার । শুধু লুচি বিস্বাদ লাগলো ।অতএব দিদির মুখটা তরকারিতে মাখামাখি হলো ।
রবিবার অফিস নেই । বনানীর বাবা মুকুলবাবু ঘরেই ছিলেন । দেখে সে কি হাসি !
-‘তুমি হাসছ বাবা ?’
সব কান্ড দেখে মানদা পিসি হেসে বলতে গেল সবাইকে ।

        একদিন মানদা পিসি বলল এই যে বিল্টুবাবু অত দিদি দিদি করোনা ! দিদির বিয়ে হয়ে যাবে ব্যাস আর পাবে না !
অমনি দিদির ঘরে দৌড়
-‘তিতি পিয়ে তি?’
-‘বিয়ে? যার সাথে যার বিয়ে হয় তাকে অনেক দূরে নিয়ে চলে যায় । আর আসেনা ।‘
বিজ্ঞের মতো ভাবলো কিছুক্ষন বলল
-‘তল তুই আল আমি পিয়ে হয়ে দাই !’
শুনে দিদির কি হাসি।


        দিদির বিয়ের দিন গায়ে হলুদে সবচেয়ে বেশি হলুদ সেইই মাখলো । দিদির পাশে থাকার জন্য মাসিমার মেয়ে নিতকনে শ্রবনার সাথে প্রতিযোগিতা চললো । দিদিকে বিয়েটাও পিঁড়িতে ওকে কোলে নিয়ে বসেই করতে হলো । দিদির আঁচল ধরে সেও সাতপাক ঘুরল । খাবার টেবিলে ‘নুচি' episode পুনরাবৃত্ত হলো ।বাসর ঘরে দিদির কোলেই ঘুমালো ।

পরদিন যাওয়ার সময় বনানী ভীষণ দেখতে চাইছিল ভাইকে।প্রতিমা দেবী বললেন
-‘ওরে তাকে অনেক কষ্টে ঘুম পাড়িয়ে এসেছি।তোকে যেতে দেখলে রক্ষে থাকবেনা আর ! কি কান্ড করে বসবে !’

-‘বাগানে বসে album টা খুলে বনানীর ছবিগুলো দেখছিলেন দেবকুমারবাবু।বড় স্নেহ করতেন ভাইঝিকে ! তার দাদার থেকেও বেশি । প্রতিমাদেবী হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন ।
-‘ওগো তুমি একটিবার চলো ! ঘুম থেকে উঠে সে যে লঙ্কাকান্ড করছে ! কেঁদে আছাড়-কাছাড় ! হাতের সামনে যা পাচ্ছে ছুঁড়ছে ! কাউকে কাছে ঘেঁষতে দিচ্ছে না !’
-‘সেকি কথা ! চলোতো দেখি !’
-‘তুমি কিন্তু ওকে কিচ্ছুটি বলতে পারবে না বলে দিলাম ! আমার মাথা খাও ! দিদি যে ওর প্রাণ !’
-‘কিন্তু তাইবলে...

একটা দিন অতিকষ্টে ভুলিয়ে রাখা গেল । পরের দিন ঘটনার তীব্রতা বাড়ল ।


        Reception এর লোকজন ব্যস্ততার মধ্যেও মাঝে মাঝেই আনমনা হয়ে যাচ্ছিল বনানী । হু হু করছিল মনটা । অনুষ্ঠান শেষে ফুলশয্যার ঘরে দশ মিনিটও ঢোকেনি । পরিচিত তীব্র কণ্ঠস্বর শোনাগেল বাইরে
-‘তিতি ! তিতি !! তিতি !!!’
বনানী ছুটে গিয়ে দরজা খুলতেই ঝাঁপিয়ে পড়লো কোলে ! কি তৃপ্তি !!
কাকু বলল
-‘কিছুতেই রোখা যাচ্ছিল না ওকে মিঠু একবার না নিয়ে এলেই চলছিল না তাই….’
ইতস্তত কাকুকে থামিয়ে জামাই নিশীথ বলল
-‘বেশ করেছেন ।‘

-‘অ্যাই দিদিকে দেখেছো । এবার চলো আমার সাথে ।‘
আর কে ছাড়ায় তাকে ! এমন ভাবে দিদির কাপড়টা জাপটে ধরল যেন কেউ প্রাণ চেয়েছে !
নিশীথ বাবু হেসে বললেন
-‘ও আমাদের কাছেই থাক । এখন ওকে দিদির কাছ থেকে ছাড়ালে মারাত্মক অপরাধ হয়ে যাবে ।‘
-‘সে কি করে হয় …!’
-‘কোনো কিন্তু নয় আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন ।‘

এরপর একটা দুর্ঘটনা ঘটলো ! ছোট্ট পকেট থেকে দু-দুটো চকলেট নিশীথবাবুর হাতে চলে এলো !
-‘একিরে !! তুই আমাকে তো একদিনও পুরো চকলেট দিসনি ! আজকে দু খানা চকলেট দিয়ে দিলি !! গদাই কোথাকার !!!’
জোরে দাঁত বসল !
-‘মাগো !! উফফ ! আ্যই কামড়ালি কেন !?’
-‘তুই দদাই বল্লি তেনো ?’
সব্বার কি হাসি !!

ফুলশয্যার মাঝরাতে দিদির কোলে পরম নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে ছোট্ট প্রাণটি । নিশীথবাবু বললেন
-‘কিছু বলছনা যে !’
বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বনানী বলল
-‘তোমার ডাকে সাড়া দিতে বয়েই গেছে !! সাতরাজা ধন মানিক যখন পাওয়া আমার হয়েই গেছে !!’
হাসলেন নিশীথবাবু
-‘বটে!!’


Pintu Manna