রহস্য-রোমাঞ্চ গল্প লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
রহস্য-রোমাঞ্চ গল্প লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

দ্য গ্রেট ইটালিয়ন জাকুজি - বৈশাখী রায়

 দ্য গ্রেট ইটালিয়ন জাকুজি

বৈশাখী রায়

 


 


সুজনের গায়ের সাথে প্রায় লেপ্টে গিয়ে খানিকটা নাক টেনে বকুল বললো,
"আঁশটে গন্ধ পাচ্ছো গো তুমি; আঁশটে গন্ধ? কোনদিক থেকে আসছে বলো তো?" সুজন বিরক্তই হলো একটু। তবে দ্বিতীয়পক্ষের সদ্য-বিবাহিত এবং কচি বৌয়ের ওপর রাগ দেখানো বারণ। সুজন তাই একটু নড়েচড়ে, ওপাশে ফিরে, নিতান্তই কেজো 
 সুজনের আনা বাটা অথবা ফুলকপি দিয়ে চারাপোনার ঝোল নামানো, রুটি আর মাখা আলুর সবজি ইত্যাদির চাপে সকালটুকু কোথায় যেনো হারিয়ে যায়। অথচ সরষের তেলে মাছ সাঁতলানোর সময় অথবা পিতলের থালায় ডাল, একটু আলুমাখা বা কাঁচা লঙ্কা রাখতে রাখতে বকুল বেশ টের পায় তার বুকের খাঁজে, বগলের নীচে, ঘাড়ে , গলায় তিরতির করছে কুচি কুচি ঘামের বিন্দু, টাকরা শুকিয়ে যাচ্ছে, শ্বাস আটকে আসছে বারবার!

সুজন তাই আঁচিয়ে নিয়ে , একটু মৌরি-মিছরি গলায় ফেলে, আলগোছে তাকে একটা চুমু দিয়ে যেই দরজার বাইরে পা দেয়, আর এক মূহুর্তও সময় নষ্ট করে না বকুল। নইলে পাশের বাসার নিমাইয়ের মা বহুবার বলেছে,
"ও কি অলুক্ষুণে কান্ড করো বৌ? সোয়ামী বেরোনোর সময় একটু পথের দিকে তাকাতে হয়, ঠাকুর দ্যাবতার নাম নিতে হয়, কত হাটঘাট পেরিয়ে যাচ্ছে বাছারা বলো দিকি! তা না, ঘরে সেঁধিয়ে থাকবে! " তবুও রা কাড়ে না বকুল। বরং তাড়াতাড়ি করে রান্নাঘরে এসে একটা এনামেলের বাটিতে খানিকটা খাবার সোডা, একটু মধু, ফুলেল তেল একটু আর সস্তার জোরালু শ্যাম্পু ভালো করে গুলে নেয়। দরজা বন্ধ করে জানালার পর্দা টেনে দেয়। ঠাকুরের আসনের পাশে রাখা ধুপকাঠির প্যাকেট থেকে টেনে বের‌ করে অনেকগুলো ধুপকাঠি জ্বালায় রোজ। তারপর শাড়ি ব্লাউজ খুলে, সায়াটা বুকের ওপর টেনে , দাঁতে কামড়ে ঢুকে পড়ে স্নানঘরে। প্রতিবার ঢোকার সাথে সাথেই একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়ে বকুলের, চোখ জুড়িয়ে আসে আবেশে। স্নানঘরের অর্ধেক জায়গা জুড়ে একটা সাদা রঙের স্নান করার গামলা, বকুল শুনেছে, সাহেবসুবোরা নাকি একে জাকুজি না কি একটা বলে। বহুকালের পুরানো গামলাটার গা থেকে এখনো ঠিকরে পড়ে আলো, গায়ে সোনালী রঙের লতাপাতার কারুকাজে ঝলসে যায় চোখ। বাকি হতকুচ্ছিত জংধরা বালতি, শ্যাওলা জমা মেঝে অগ্রাহ্য করে গামলাটার মধ্যে বালতি ভরে জল ঢালে সে। আগে বোধহয় কল ছাড়লেই চলতো, এখন তাতে জং ধরে অকেজো দশা। তবে অসুবিধা হয় না বকুলের। একটু জল ভরে উঠলে তাতে ছড়িয়ে দেয় পুজোর জন্য তোলা দোপাটি, টগর বা বেলিফুলগুলো। এনামেলের বাটির মিশ্রণটা মেশায় জলে, একটু হাত দিয়ে নাড়লেই ফ্যানা ফ্যানা হয়ে যায় পুরো। আদুরে বাচ্চার মতো খিলখিল করে হেসে ওঠে বকুল। ধুপদানিটা পাশে রেখে দাঁত থেকে সায়াটা ছেড়ে দেয় সে, তারপর সম্পূর্ণ নগ্নদেহে প্রবেশ করে জলের মধ্যে। এই এতক্ষণে একটা বড়ো করে শ্বাস টানতে পারে বকুল। তারপর শুয়ে পড়ে ধীরে ধীরে, গোটা গায়ে একটু একটু করে মেখে নেয় জল অথবা ফ্যানা। বকুলের জগত সংসার মুছে যায়। রান্না করা ভাত-ডাল-তরকারি কখন যেন খাওয়ার অযুগ্যি হয়ে ভেপসে ওঠে। ঢেকে রাখা বাটি উলটে দুটো ভাজা মাছ নিয়ে হীরু বিড়ালটা পালায়, বকুল তবুও নির্বিকার। 

দিনশেষে যখন বেরিয়ে আসে জল থেকে তখন বকুল তরতাজা গোলাপের মতো, প্রসাধন করে হালকা, অল্প সিঁদুর ছোওয়ায় সিঁথিতে। ছাদে ভেজা কাপড় মেলতে গেলে নিমাইয়ের মা অবাক গলায় বলে,
"ওমা বৌ! এই অবেলায় স্নান করলে অসুক করবে লা! জলে ভিজে ভিজে হাত-পা কেমন কুঁচকে গ্যাছে দেখো! বলি সারা দিনমান‌ করোটা কি?"
বকুল মৃদু হাসে শুধু, উত্তর দেয় না কোনো। বরং ঘরে এসে কোনোমতে ফুল-,ধুপ ছাড়াই পুজো করে একটু। তারপর অল্প ভাত ডাল তরকারি নিয়ে খেতে বসে! যদিও প্রতিদিনই বমি ঠেলে আসে তার, পাতের বাকি ভাতটুকু থালা কাচিয়ে ফেলতে ফেলতে ভাবে;
"চাদ্দিকে এতো আঁশটে গন্ধ কেনো বাবা? আর কি কারো নাক নেই নাকি? উফ্! "
                               *****

ভাড়ার ঘরটা দেখতে এসে স্নানঘরেই চোখ আটকে গিয়েছিলো বকুলের। মোটামুটি সাধারণ কল-বালতি-মগ রাখা স্নানঘরটার খোলনলচে বদলে দিয়েছে একপাশে রাখা বিরাট বড়ো সাদা পাথরের গামলাটা! বকুলকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকতে দেখেই বোধহয় বাড়ির মালিক হালকা হেসে বলেছিলো,
"ওটাকে জাকুজি বলে মা। আসল ইতালির থেকে আনা সাদা পাতর দিয়ে বানানো। ওই সাহেবসুবো, মেমবউরা ওতে বসে ফষ্টিনষ্টি করতো। এই ঘরদোর তো সব কোম্পানির আমলেই বানানো। তবে এদিকে কল পায়খানা সব আছে, ওসবে আর আমাদের কি দরকার, বাঙ্গালী মানুষের বালতি-কলসীই ঢের! " বলে সামনের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসেছিলেন তিনি। বকুলের চোখ তখনো গেঁথে আছে সেই জাকুজিটাতে! সুজন অবশ্য দোনামনা করছিলো খুব, এই একটা ঘর-বারান্দা, একফালি রান্নাঘর আর বাথরুমের ভাড়া পাঁচহাজার টাকা! বকুল পাশে সরে এসে ফিসফিসিয়ে বলেছিলো, 

"নাও না গো, কেমন সুন্দর দক্ষিণখোলা, লাল সিমেন্টের মেঝে , আর আর চাদ্দিকে কেমন সবুজ, সামনে টানা রেলিংও আছে। আমি নয় একবছর শাড়িগয়না কিনবো না তেমন, খরচা বাঁচিয়ে দেবো। নাও না গো!" বকুলের একচোখে আকুতি আর একচোখে ভাসছিলো সাদা ধবধবে লতাপাতার কারুকাজ করা বিরাট একটা গামলা... নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিলো ওর; সেই প্রথম তীব্র আঁশটে গন্ধটা পায় বকুল।

 সুজন রাজি হয়ে গিয়েছিল ঘরটা ভাড়া নিতে। ওই, সদ্য বিবাহিত আর‌ দ্বিতীয় পক্ষের কচি বৌয়ের আবদার‌ ফেলতে পারেনি! আর তাছাড়া বকুলের দপ্ করে জ্বলে ওঠা চোখদুটো, হাপরের মতো ওঠানামা করতে থাকা ভারি বুকের কাঁপনটুকু বা কল্পনায় রাতের অধৈর্য্য সোহাগটুকু অগ্রাহ্য করতে পারেনি সে।‌ প্রথম যেদিন এখানে পাকাপোক্তভাবে থাকতে চলে আসে, সুজনের মনে আছে, একবার বকুল বলেছিলো,
"হ্যাঁ গা! চাদ্দিকে এতো গাছপালা, তাও বাতাস কম নাকি? কেমন বুক ধড়ফড় করচে দেখো!" 
সুজন অবাক হয়ে বকুলের দ্রুত ওঠানামা করতে থাকা ভরাট বুক, কন্ঠার হাড়, নিটোল খাঁজ, তিরতির করে কাঁপতে থাকা ঠোঁট....দেখছিলো, একমনে। সেদিন আর অফিস যাওয়া হয়নি তাঁর। সদ্য চুনকাম করা দেওয়ালের গন্ধ, খোলা সুটকেসে নতুন শাড়ির ভাঁজে রাখা ন্যাপথলিনের গন্ধ, বকুলের শ্যাম্পু করে ঘষা মাথার সুগন্ধ, খাটের পাশে তামার থালায় রাখা কটা যুঁইফুলের সুবাস, সবকিছুর সাথে মিশে গিয়েছিলো আরেকটা আদিম বুনো গন্ধ, নর-নারীর যৌথ সুখানুভূতি আশ্লেষ মিশে ছিলো সেই গন্ধে, অন্ততঃ সুজন তো সেটুকুই পাচ্ছিলো। আর হারিয়েও যাচ্ছিলো সেই গন্ধে, বারবার করে বকুলের জঙ্ঘা, তলপেট , ঊরুসন্ধিতে মুখ ডুবিয়ে আকন্ঠ পান করতে চাইছিলো সেই গন্ধটা। তখনি প্রথমবারের মতো বকুল বলে ওঠেছিলো,
"হ্যাঁ, তুমি গন্ধ পাচ্ছো কোনো? আঁশটে গন্ধ? কোত্থেকে আসছে বলো তো?"

                                *****

জানালার এই দিকটায় দাঁড়ালে গঙ্গার পাড়টা পরিস্কার দেখতে পাওয়া যায়। ভোর ভোর কথক ঠাকুর তিলক-চন্দনের রসকলি এঁকে নামাবলী জড়িয়ে পাড়ের দিকে এসে বসে , একে একে দুই-একজন করে প্রবীণা বা প্রৌঢ়া সিক্তবসন গায়ে জড়িয়ে কপালে , কন্ঠিতে বা বাহুমূলে ফোঁটা কেটে যায়, দূরে আজানের সুর ভেসে আসে, একটু পরেই বাজবে গির্জার ঘন্টাধ্বনি। 

             রোজ এইসময় অতিকষ্টে খাট থেকে নেমে জানালার পাল্লাটা অল্প খুলে একখানা কেদারা বা মোড়া টেনে বসে পড়ে বকুল। আজকাল‌ দাঁড়িয়ে থাকতেও বড়ো কষ্ট হয়, কোমরের নীচটা খুলে আসে যেনো, দিনদিন থাইদুটো এতো মাংসল হয়ে উঠছে, চামড়ায় ঘষা খেয়ে খেয়ে ঘা হয়ে যায় বকুলের।‌ বকুল তাই হাঁটে কম, চুপ করে শুয়ে থাকে, অথবা জানালা দিয়ে বাচ্চাদের খিলখিল হাসি, ডুবসাঁতার চিতসাঁতারের দৃশ্য বা ভেজা গামছা বুকে জড়িয়ে পাশের সাঁওতাল বস্তির মেয়েদের একে অপরের গায়ে ঢলে পড়াটুকু নিপাট দেখে নেয়। তারপর যখন বেলা বাড়ে , জানালা দিয়ে গরম রোদ সরু হয়ে বিছানায় পড়ে, আর সুজনের আড়মোড়া ভাঙ্গার শব্দ কানে আসে, তখন বকুল আস্তে আস্তে বিছানায় এসে, একটুখানি "আহ্" শব্দ করে বসে পড়ে বলে,

"আমরা আগের বাসাতেই ভালো ছিলাম নাগো? বলচি শোনো না, এই বাড়িটা বদল করলে হয় না?"

                            সদ্য ঘুম ভাঙ্গলে এমনিতেই সুজনের মেজাজ খিচড়ে থাকে, কাপ দুই লেবু-চা পেটে না পড়লে তাঁর বাহ্যি বেরোয় না, অথচ আজকাল রান্নাঘরের কৌটৌবাটা সব নিজেকেই নাড়াতে হয় সকালে, বকুল পারে না তেমন। দিনের দিকে জুলি বলে একটা মেয়ে এসে রান্না, ঘরমোছা, বাসনমাজার কাজটুকু করে দিয়ে যায়, বাদবাকি সব সুজনই সামলায়। চারিদিকে ধারদেনা, ওষুধ বিষুধের খরচ, ঘড়ভাড়া, দোকান বাজার সামলে পাগল হয়ে যাচ্ছে সুজন। খানিকটা কড়া গলাতেই তাই বলে...
"তিরিশ হাজার সেলামি দিয়ে ঘরখানা নেওয়ার বুদ্ধি তো তোমারি ছিলো; টাকা গাছে ফলে নাকি, রোজ রোজ ঝাড়া দেবো আর পড়বে....!"
বকুল চুপ করে যায়, কিই বা বলবে। সত্যিই তো, সেই তো বলেছিলো সেদিন, জেদ ধরেছিলো ঘরটা নেওয়ার। অথচ প্রতিদিন একটু একটু করে খেয়ে ফেলছে জাকুজিটা তাকে, পরিত্রাণের কি কোনো উপায় নেই? বকুলের চোখে জল আসে, কোনোমতে চেপে রান্নাঘরে আসে সে। গ্যাসে সসপ্যান চড়ায়, জল দেয় , চিনি চা-পাতা নামায়, লেবু কাটে। তারপর হঠাৎ করে অবশ অসাড় নিন্মাঙ্গ নিয়ে পড়ে যায় ধপ্ করে, পায়ে সাড় নেই তো কোনো; সে খালি চেয়ে চেয়ে দেখে জল ফুটছে, চাইলেই তাতে চা-চিনি মেশাতে পারছে না আগের মতো। নিষ্ফল হতাশায় হাতটা বাড়িয়ে দেয় বকুল, ওর পাতাবিহীন চোখের কোণা দিয়ে গড়িয়ে পড়ে মুক্তোকুচির মতো ঠিক দু'দানা জল। সুজন ছুটে আসে শব্দ শুনে, আলতো করে বকে একটু হয়তো,
"ছিঃ বকুল, একটু নয় রেগেই কথা বলেছি, তা বলে এভাবে একা রান্নাঘরে আসবে? কিছু হয়ে গেলে কি হতো বলো তো?"

সুজনের চেক চেক লুঙ্গি দিয়ে ঢাকা পায়ের ওপর ডানগালটা রেখে, খুউব আস্তে করে, খুউব ধরা গলায় বকুল বলে,
"আমার কি খুব কঠিন অসুক করেচে গো? খুব কঠিন? কোনোদিনো সারবো না?"

                             *****
. আজকাল বকুল খুব চেষ্টা করে সাদা মার্বেলের ওই বিরাট গামলাটার থেকে একটু দূরেই থাকতে। সকালটা তবু জুলির সাথে সাথে কেটে যায়, মেয়েটা ঘর মোছে, বাসন মাজে আর বকুল সমানে একটু গলাটা উঁচিয়ে বলে যায়; 
"আজ দাদাবাবুর জন্য একটু পোস্তোর বড়া করিস তো; কুঁচি কুঁচি লঙ্কা দিস আর একটু মুচমুচে করে নামাস। আর গতকালের সিম পাতুরি ওমন তিতকুটে কেনো ছিলো রে? পাতুরি হবে মাখনের মতো; মুখে দিলেই গলে যাবে...." 
জুলি কুটনো কুটতে কুটতে উত্তর দেয় কিছু, কিছু হয়তো শুনতে পায় না কাজের তালে, বকুল‌ তবুও বলেই যায়। বেলা বাড়ে, ঘন ঘন শ্বাস ওঠে ওর, বুক ধড়ফড় করে, টাকরা শুকিয়ে যায়, খটখটে জিভটা শুষ্ক ঠোঁটের ওপর একবার বুলিয়ে নিয়ে বকুল বলতেই থাকে,
"দাদাবাবুর বুঝলি খুব খাওয়ার শখ। যখন শরীরগতিক সুবিধার ছিলো, রোজ বায়না করতো; আমিও তেমনি, এটা সেটা করতেই থাকতুম; ওকি, ও মেয়ে, তোর হোলো নাকি? বলি এরমধ্যে সব কাজ হয়ে গেলো? ফাঁকি দিচ্চিস তো প্রাণভরে...."
অথচ বকুল দেখতে পাচ্ছে, ঘর-বারান্দা মোছা সারা, ঢাকা বাটিতে ডাল-তরকারি, উপুর দেওয়া ধোয়া বাসন; তাও দুটো কথা বলে আটকাতে চায় জুলিকে, চোখ নইলে বারবার স্নানঘরের‌ দিকে চলে যায় যে‌। তবুও একসময় জুলি বেরিয়ে যায়, আর একা ঘরে বকুলের প্রাণটা আবার আনচান করতে থাকে। একবার হয়তো না পেরে ঘষটে ঘষটে বাথরুমের দরজায় পৌঁছেই যায়, পরক্ষণেই নিজের প্রায় সাদাটে ত্বক, আঙ্গুলের ফাঁকফোকর ভর্তি হাজা, পাতাহীন চোখ, ভারী থাই আর ফুলতে থাকা শ্বাসের কথা মনে পড়ে যায়, মনে পড়ে কিছুদিন আগেই, বস্তির সেই একটেরে ঘরটায় কেমন সবুজ সতেজ লাউডগার মতো ছিলো সে; অথচ এখানে এতো আলো , এতো বাতাস, তবুও বকুল‌ প্রাণ পায় না কেনো? কেনো বারবার মনে হয়, ওই সাদাটে জাকুজিটা প্রবল আশ্লেষে জড়িয়ে ধরে শেষ প্রাণবায়ুটুকু নিংড়ে নিতে চায় তার। বকুল আঁতকে ওঠে, পিছিয়ে আসে, ঠিক করে, আঁশটে গন্ধে বা শ্বাসের টানে মরে গেলেও ওই স্নানঘরে ঢুকবে না সে। বরং একটু কষ্ট করে যদি গঙ্গায় যাওয়া যায়? পারবে না, নাকি? ওই তো সামনেই।

তখনি হয়তো কানাইয়ের মা হাতে একবাটি ক্যাস্টর অয়েল নিয়ে ঢোকে, বকুলের চোখের পাতা, ভ্রূ, সবেতে ঘষতে ঘষতে বলে,
"অমন পিতিমের মতো বন্ন ছিলো বৌ তোর, কি ছিরি করলি রে, দেখে আমারি বুকটা হুঁ হুঁ করে ওঠে। তবে সোয়ামী তুমি ভাগ্য করে পেয়েচো মা, এ আমি একশো বাক্যে বলতি পারি। কি সেবাটাই না করচে দেকো! " তারপর গলাটা একটু খাদে নামিয়ে আবার বলে,
"তুই আসার আগে যেই বৌটা ছিলো, তারও তো কি অসুক ম্যাগো! কি দূর্গন্ধ বেরুতো এই ঘর দিয়ে, য্যান জেলেপাড়া! তার সোয়ামী তো রেখেই পালালো! আমরাই নাকে কাপড় চাপা দিয়ে খাবার দাবার দিতুম কদিন। তাপ্পর সে মোলো, না না, মরে বাঁচলো অবাগী!" কানাইয়ের মা আঁচল চাপা দিলো চোখে, বকুল‌ পাতাবিহীন বড়ো বড়ো চোখ করে শুনছিলো সবটা, আচমকা কানাইয়ের মা কাপড় খিমচে ধরে বললো,
"তারও কি শ্বাস টানতে কষ্ট হতো কাকি, আর এমনি সাদাটে হয়ে যেতো নাকি?" 

কানাইয়ের মা নাক কোঁচকালো একটু, 
"তার ধারেপাশে গন্দে যাওয়া যেতনি বাপু, সাদা না কালো কি করে দেখবো। তবে সুজন কিন্তু আমাদের সোনার টুকরো ছেলে, রোগতাপের‌ বৌকে ক্যামুন টানছে দেকো; রা টি কাড়ছে না। শাঁখা-নোয়ার কদর করিস বৌ!"

কানাইয়ের‌ মা উঠে পড়ে, বকুল‌ চায় আরেকটু বসুক, তবে গেরস্ত সংসারে গিন্নি বসলে চলে না, নিজেও জানে সে, তাই জোর করে না। বরং কানাইয়ের মা চলে গেলে অনেকক্ষণ নিজের শাঁখা-নোয়া ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে, দেখতেই থাকে, তারপর একটু সিঁথিতে ছুঁইয়ে নিতান্তই নির্লিপ্ত গলায় বলে,
"ওনার অসুক কল্লে আমি যেনো দেকতাম না ? বাঃ! "                        

                             *****

"আচ্ছা, মৎস্যকন্যা কি সত্যিই মানুষ হয়ে যায় গো?"
আচমকা বকুলের এমন খাপছাড়া প্রশ্নে হতচকিত হয়ে গেলো সুজন। একগাদা রসিদ নিয়ে হিসাবে বসেছিলো সে। খেই হারিয়ে নিতান্তই বেকুবের মতো তাকিয়ে রইলো খানিক। তারপর খানিকটা রেগেই বললো, 
"ভর সন্ধেতে এসব কি অলুক্ষুণে কথা বলছো বকুল? কে আবার মৎস্যকন্যা থেকে মানুষ হলো?"

বকুল হাসলো একটু, মেঘ সরে গিয়ে চাঁদ উঠলে যেমন আলো ছড়ায়, তেমন আলো ছড়িয়ে হাসলো, তারপর বললো,
"আরে নিমাইয়ের মা রোজ কথক ঠাকুরের‌ পাঠ শুনতে যায় তো, কাল নাকি এক ছোকরা কথক এসে এসব বলছিলো। ওই যে গো, সত্যবতীর তো গায়ে খুব আঁশটে গন্ধ ছিলো, পরাশর মুনির বরে পদ্মগন্ধ পেলো। ওই বলছিলো, মুনি নাকি ওষুধ দিয়ে সারিয়ে দেয়! হ্যাঁ গা; সেই যুগে রোগ হলেও সেরে যেতো, এখন তো শুনি কত উন্নতি হয়েচে, আমি কি সারবো না গো?"

সুজন হাই তুলতে তুলতে মুখের সামনে দুই আঙ্গুল দিয়ে তুড়ি মারলো কয়েকটা, তারপর নিতান্তই কেজো গলায় বললে,
"সারবে না কেনো, ঠিক সারবে। এমন তো আহামরি কিছু হয়নি তোমার। ডাক্তার বললো ফুসফুসের কি একটা রোগ হয়েছে, আর একটু চর্মরোগ, ও কদিন পরেই সেরে যাবে। শুধু জলটা ঘেঁটো না! যাই; আমি একটু রান্নাঘরে গেলুম গো; রুটি বড়ো শক্ত হচ্ছে রোজদিন, দেখি একটু...."

উঠে গেলো সুজন। বকুল চুপ করে বসে থাকলো অনেকক্ষণ। তারমধ্যে একটু সময় অকাজের মনখারাপে বরাদ্দ করলো। একটু অভিমানের সাথে ভাবলো, সুজন তাকে আজকাল তাকিয়েই দেখে না, নইলে এই প্রায় জোড়া লাগা থাই, লম্বা হতে থাকা পায়ের পাতা আর পাতাবিহীন চোখ কি শুধুই চর্মরোগ। আর আর‌ সেদিন থেকে যে হাঁটুর নীচে একটু নীলচে সোনালী আঁশের মতো দেখছে, সেটাও কি কিছুই না? আর ওই তীব্র আঁশটে গন্ধ? আর জাকুজিটাই বা কেনো এমন আষ্টেপিষ্টে ধরছে তাকে?

ঘরে একটামাত্র হ্যারিকেনই জ্বালিয়ে গ্যাছে সুজন, তাও প্রায় নিভু নিভু সেটা, সেই আবছা অন্ধকারেই হঠাৎ চাপা গলায় ডুকরে ওঠে বকুল,
"ওগো আমি বাঁচতে চাই গো; এই বাড়িটা, ওই সাদা মার্বেলের পাত্তরটা, গিলে খাচ্ছে আমাকে, বুঝছো না কেনো; চলো না; চলে যাই এখান থেকে! কই গেলে গো?"

                                ******
আজ অনেকদিন পর বড়ো ভালো লাগছিলো বকুলের, সবকিছু নতুন লাগছিলো বেশ। আজ তাই পাটভাঙ্গা হলদে জমি, সবুজ কল্কাপেড়ে একটা শাড়ি পরেছে সে, সিঁথিতে অল্প সিঁদুর, একটা ছোট্ট টিপ আর অল্প কাজল। আয়নাটার সামনে কতদিন দাঁড়ায়নি এসে, আজ দেখছে গর্তে ঢোকা চোখ, তার নীচে একপোচ কালি, কন্ঠার হাড় জাগানো.... তবুও ভালো লাগছে সবকিছু। টানা এক সপ্তাহ স্নান করেনি বকুল, জলটুকুও গিলেছে কোনোমতে। একা ঘরে পাগলের মতো চুল ছিঁড়েছে, তবুও জাকুজির ধার মাড়ায়নি। তারপর আজ কানাইয়ের মা ধরে ধরে গঙ্গায় নিয়ে গেলো, কতদিন পর চার দেয়ালের বাইরে; অসুখ যেনো হাওয়াই হয়ে গেলো ফিরে। বকুল ঠিক করেছে, ওই স্নানঘরে ও পেল্লাই তালা বসাবেই বসাবে, দেখা যাক কত ক্ষ্যামতা ওটার। জুলি এসে গ্যাছে, এটা ওটা কাজ করছে রান্নাঘরে, সুজনও উঠেছে। গুণগুণ গান করতে করতে হঠাৎ বকুল ভাবলো, আজ সুজনের জন্য একটু লুচি-আলুর চচ্চড়ি বানালে কেমন হয়? অনেকদিন বাদে পায়ে সাড় পাচ্ছে একটু, কতদিন গরম গরম লুচি সুজনের পাতে দেয়নি তুলে.... ! জুলি নয় কেটেবেটে দেবে।একটু ভেজে নিতে ঠিক পারবে সে। রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালো বকুল। কাছে আসতেই শুনতে পেলো জুলির গলা,

---"দিয়েন না দাবাবু, ও ট্যাকা লাগবেনি, বৌদিদি কত ভক্তিছেদ্দা করে আপনাকে, ও আমি পারবুনি....;"
সুজন আক্রোশে ফেটে পড়লো যেনো; 
"সতীপনা দেখাস নে মাগী; বলবো সবাইকে তোর কুকীর্তি? রাতে দরজা খোলা থাকবে, চলে আসিস।"
তারপর একটু থেমে, খানিকটা হতাশা মেশানো গলায় বললো,
"রাতদিন তোর অসুস্থ বৌদিদির খিদমত খেটে খেটে আমি কি হয়ে গেছিস জানিস? একটা জীবন্ত মড়া রে, মড়া! আমার কি শখ-আহ্লাদ নেই কিছু....শরীর নেই নাকি?"

বকুল সরে এলো রান্নাঘর থেকে , বরং পায়ে পায়ে স্নানঘরে এসে দাঁড়ালো। কল খুলে বালতি বালতি জল ভরতে লাগলো জাকুজিটায়। একসপ্তাহের‌ অব্যবহৃত জাকুজিটা চকচক করছে আরো, সাদাটে মার্বেলটা আরো বেশি নিষ্ঠুর লাগছে আজ। বকুলের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিলো আবার, হাঁপরের মতো ওঠানামা করছিলো বুকটা আবার, চারিদিকে আবার সেই তীব্র আঁশটে গন্ধ। বকুল দাঁড়াতে পারছিলো না আর, বরং দ্রুত জাকুজিটায় গা এলিয়েই অসম্ভব নিশ্চিন্ত লাগছিলো তার। ভেজা ভেজা গলা থেকে কখন যেনো আলতো করে বেরিয়ে এলো....

"আহ্! শান্তি!"

                               ******
সপ্তাখানেক পর; সুজন অফিস থেকে ফিরে দেখে কোথাও বকুল নেই। ঘর, টানা বারান্দা, রান্নাঘর, স্নানঘর, ছাদ কোথাও না। আলনায় ঝুলছে বকুলের সবজে কল্কেপাড় শাড়ি, এদিকওদিক পাউডার, সিঁদুর, আলতার পাতা, আর একটা তীব্র আঁশটে গন্ধ, ঠিক যেমনটা বকুল বলতো, অথচ বকুল কোথাও নেই। নিমাইয়ের মা ডুকরে বললো,
"অবাগী নির্ঘাত গঙ্গায় ডুবে মরেচে...."
অথচ তিনদিন পরেও কোনো মরা ভেসে উঠলো না যে.....!

বকুলকে আসলে ভালো করে খুঁজে দেখলো কেউই। নইলে স্নানঘরের ওই ঝকঝকে গ্রেট ইটালিয়ান জাকুজিটার গায়ে লেগে থাকা গোলা সিঁদুর আর নীলচে সোনালী আঁশটুকুও নজরে পড়তো সবার।

..............................
 
Baisakhi Roy
 
অলঙ্করণ :-  সহিষ্ণু কুড়ি 
 

 

জোঁকা - পার্থপ্রতিম

 

জোঁকা
পার্থপ্রতিম
 
বিন্থটদের মানুষ ভয় পায়।
আবার বিন্থট ছাড়া মানুষের চলেও না।
দরকারে না পড়লে কেউ বিন্থটদের সংস্পর্শে আসতে চায় না। দরকার শেষ হলে তাড়ানোর জন্য ব্যাস্ত হয়ে পড়ে।
বিন্থটরা জানে মানুষের ভালবাসা পাওয়ার জন্য তাদের জন্ম হয়নি।তাদের জন্ম মানুষকে পিশাচ এবং রাক্ষসদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য।
পৃথিবীতে পিশাচ ও রাক্ষসদের সংখ্যা কিছু কম নয়।
কিন্তু বিন্থটরা ক্রমেই কমে আসছে। আশ্রমে নতুন বিন্থটের জোগান খুব কম। কোন মানুষ সাধ করে আর বিন্থট হতে চায় না। মৃত্যুর পর তারা চায় শান্তিতে ঘুমোতে, পিশাচের সাথে লড়তে নয়।
বাড়ির লোককে মৃত্যুশয্যায় তারা শেষ ইচ্ছের কথা বলে যায় - তা হল চিতার অগ্নি।
গত বছর মাত্র বারোজন নতুন বিন্থট তৈরী হয়েছিল। আর তাদের মধ্যে দশজনেরই কোন পূর্বপরিচয় পাওয়া যায়নি। বিন্থট আশ্রমের গুরুজি বলেন - পূর্বপরিচয় অজানা থাকলে সেই মানুষকে বিন্থট করা খুব বিপজ্জনক।
বিন্থটদের কাজ খুবই দায়িত্বশীল৷
অপরিমিত ক্ষমতার সাথে আসে পর্যাপ্ত দায়িত্ব।বিন্থটদের প্রত্যেককে সেই দায়িত্ব নিতে হয়।
সেই দায়িত্ব হল কোনভাবেই কোন মানুষের কোন ক্ষতি না করা। নিজের প্রাণ দিয়ে হলেও মানুষকে রক্ষা করা।
অবশ্য বিন্থটদের প্রাণ থাকে কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ আছে।
কারণ বিন্থটদের নিশ্বাস পড়ে না। আর বিন্থটদের খাদ্য হল পশুপাখির কাঁচা রক্ত৷ আর কিছু খায়না তারা। একদিন রক্তপান করলে তারা এক পক্ষ কাল না খেয়ে চলতে পারে। বিন্থটদের জল খাওয়ার প্রয়োজন হয় না।
তাই বেশির ভাগ মানুষ বিন্থটদের দানবের এক রকমফের বলে মনে করে এবং যতটা সম্ভব দূরত্ব বজায় রাখে।
তবে গুরুজী বলে অনেক আগে বিন্থটদের সম্মান দিত মানুষ, ভয় পেলেও প্রাণ বাঁচানোর জন্য তাদের শ্রদ্ধা করত।
বিন্থটদের নিয়ে গাথা লেখা হত। রাতের বেলায় বিন্থটদের বীরত্বের গল্প করত মায়েরা। শিশুরা সেই শুনে ঘুমতো।
ঙিন একবার জিজ্ঞাসা করেছিল - গুরুজি, এখন তাহলে এই অবস্থা কেন? বিন্থটদের দেখলে মানুষ সরে যায়। দরকারে না পড়লে দশ হাতের মধ্যে আসে না। কেন?
এর কারণ হল পূর্বজন্মের সংস্কার - গুরুজি শান্তসুরে বলেছিলেন। - পূর্বজন্মের সংস্কার ছাড়া এমন হয় না। আগে বিন্থট হতেন রাজপরিবারের বীরেরা। যুদ্ধে আহত হলে তাঁরা নিজে বিন্থট হয়ে মানুষকে রক্ষা করার ব্রত নিয়ে আশ্রমে আসতেন।
এখন আমরা কাদের বিন্থট করছি! রাস্তায়, সরাইখানায় পড়ে থাকা মরতে বসা ভিখিরি, চোর, ডাকাতদের। প্রায় কারোরই পূর্বপরিচয় আমরা জানি না।
ওদের মধ্যে খুনেরাও যে লুকিয়ে নেই কে বলবে!
সেই স্বভাব যাবে কোথায়। ওদের থেকে যে বিন্থটরা তৈরী হয় তারা রুক্ষ, কুটিল, ক্রুর হয়। স্বাভাবিকভাবেই মানুষরা তাদের পছন্দ করবে না। তাই মানুষদের দোষ দিয়ে লাভ নেই৷
মানুষের অনেক খারাপ স্বভাবের মধ্যে একটা হল অমূলক গুজব রটানো। এক কণা চালকে এক থালা ভাত বানিয়ে দেওয়া।
তাই বিন্থটদের নামে অনেক বিভৎস গল্প চালু হয়েছে সময়ের সাথে।
এতে আশ্রমের কিছু করার নেই।
প্রতি বছর অন্তত দশজন বিন্থট না তৈরী করতে পারলে শহর গ্রাম বাঁচান মুশকিল হবে।
সব খেয়ে ফেলবে পিশাচে।
ঙিন মাথা নাড়ল।
ঙিন একজন নতুন বিন্থট। জন্মসাল পাঁচশো বাইশ৷
গুরুজি বললেন - ঙীন, ডাক এসেছে। দেড়শো মাইল দূরে হড্ডর অঞ্চলে একটা পিশাচের উপদ্রপ শোনা গেছে। ইতিমধ্যেই পাঁচজনের মৃত্যু ঘটেছে। হড্ডর থেকে দুজন এসেছিল বিন্থটের খোঁজে, দু থলে স্বর্ণমুদ্রা অগ্রিম দিয়ে গেছে। এবার যাবার সময় হয়েছে। আশ্রমে তোমার অস্ত্রশিক্ষা সম্পূর্ণ। তুমি নিজে কি মনে করছ?
তুমি কি পিশাচের মুখোমুখি হতে প্রস্তুত।
ঙিন ঘাড় নাড়ল। বিন্থট হওয়ার পর প্রায় একবছর গুরুজি ও তাঁর দুই সহকারী নতুন বিন্থটদের অস্ত্রশিক্ষা দেন। ঙিনের সেই শিক্ষা শেষ হয়েছে।
অঘোরীবাবার মন্দিরে গিয়ে প্রণাম করে গুরুজির আশীর্বাদ নিয়ে ঙিন বেরিয়ে পড়ল। বিন্থটদের মনে আবেগ তেমন জন্মায় না। তবু, ঙিন নিজের মধ্যে একটা অন্যরকম উত্তেজনা অনুভব করছিল।
হড্ডর গ্রামে হেঁটে পৌছতে ঙিনের লাগল সাতদিন।
সে গ্রামে ঢুকতেই সেখানের লোকেরা তার উপস্থিতি বুঝতে পেরে সরে সরে যেতে লাগল। কেউ তার কাছে আসতে চায় না।
বিন্থটেরা নিজেদের পরিচয় লুকোয় না। তারা প্রত্যেকে ডান হাতে অঘোরীবাবার নামাঙ্কিত সোনালী বাজুবন্ধ পরে থাকে। তাছাড়াও বিন্থটদের চুল কটা হয়।
হড্ডর গ্রামের সভাপতির ঘরে সোজা গিয়ে উঠল ঙীন, নিজের পরিচয় দিল। যদিও সে বুঝতে পেরেছিল সভাপতি তাকে দেখামাত্র চিনতে পেরেছে।
মনের অস্বস্তি লুকিয়ে সে ঙিনকে যথাসাধ্য অভ্যর্থনা জানাল। বলল যে উপদ্রপ শুরু হয়েছে একটা জলপিশাচের।
মোট সাতজন গ্রামবাসীকে সেটা রাতের বেলায় ঘুমন্ত অবস্থায় পা ধরে টেনে নিয়ে গিয়ে জলে ডুবিয়ে মেরেছে। তাদের দেহ আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।
ঘর থেকে পুষ্করিণী পর্যন্ত ধুলোর ওপর ভারী কিছু টেনে নিয়ে যাওয়ার দাগগুলো শুধু পাওয়া গেছে।
সারা গ্রামের লোকজন আতঙ্কে সিঁটিয়ে রয়েছে৷
তারপর সভাপতি ঙিনকে বলল - তুমি যদি আমাদের রক্ষা কর আমরা সবাই তোমার কাছে কৃতজ্ঞ থাকব।
কৃতজ্ঞতার কথা শুনেই মাথা গরম হল ঙিনের। মানুষের অনেক কিছু থাকতে পারে, কৃতজ্ঞতা বোধটা তাদের একদমই নেই৷
সে ঘষা ঘষা গলায় বলল- সে ঠিক আছে। আমার পারিশ্রমিক তিনশো স্বর্ণমুদ্রা। পিশাচ টা যদি নতুন প্রজাতির কিছু হয় তাহলে আরো পাঁচশো। আপাতত আমার তিনটে বড়ো ছাগল চাই। আর একটা গামলা।
সাতদিন না খেয়ে আছি।
সভাপতি ব্যাস্তসমস্তভাবে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
ঙিনের থাকার ব্যাবস্থা করা হল একটা আধভাঙা গোয়ালঘরে। গোরুগুলোকে সদ্য সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সারা ঘরটায় পচা গোবরের বোঁটকা গন্ধ।
ঙিন কিছু মনে করল না। মানুষের কাছ থেকে বেশি কিছু বিন্থটেরা আশা করে না।
শুধু পারিশ্রমিকটা ঠিকঠাক বুঝে নেয়।
পারিশ্রমিক না নিলে গুরুজির আশ্রম চলবে না। অঘোরীবাবার মন্দিরে বিন্থট তৈরী হওয়াও বন্ধ হয়ে যাবে। তখন মানুষদের পিশাচের হাত থেকে বাঁচাবার কেউ থাকবে না।
তাই লোকেরাও পারিশ্রমিক ঠিকঠাক পৌছে দেয়।
বহুকাল আগে কোন একটা গ্রাম পিশাচমুক্তির পর বিন্থটের পারিশ্রমিক দিতে গোলযোগ করেছিল।
তার পরের এক মাসের মধ্যে বিভৎস সব পিশাচ আর রাক্ষসের উপদ্রপ শুরু হয়েছিল সেই গ্রামে। বহু অনুরোধেও গুরুজি আর কোন বিন্থট পাঠাননি সেখানে। শ্মশান হয়ে গেছিল পুরো অঞ্চল।
গুরুজি বলেন - সবই অঘোরীবাবার খেলা।
গোয়ালঘরের এককোণে চারটে মাঝারি আকারের ছাগল বাঁধা আছে। ঙিন তাদের কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই তারা ভয়ে লাফালাফি করা শুরু করল।
ওরা বোধহয় আসন্ন মৃত্যু বুঝতে পেরেছে।
বেশি সময় নিল না ঙিন। হাতের কাছে পোশাক টা কনুই পর্যন্ত তুলল। দুহাত মুঠো করে জোরে ঘোরাতেই চেটোর কাছ থেকে দুটো ধারালো চকচকে লোহার ফলা বেরিয়ে এল।
দু হাতের এই ফলাদুটো হল বিন্থটের অস্ত্র। অঘোরীবাবার দান। গুরুজির নিজের হাতে বসিয়ে দেওয়া।
সাঁৎ সাঁৎ করে বাতাসে একটা আওয়াজ হল। মুন্ডহীন ছাগল চারটে নেতিয়ে পড়ল গামলার ওপর।
কিছুক্ষণের মধ্যেই তাদের রক্তে গামলাটা ভরে উঠল।
ঙিন সেটা তুলে কয়েক চুমুকে শেষ করে দিল। হাতের চেটোয় করে মুছে নিল মুখের রক্ত।
এখন দিন পনেরোর জন্য নিশ্চিন্ত।
পুষ্করিণীটা দেখে প্রথমেই খটকা লাগল। এতো ছোট জলাশয়ে জলপিশাচ থাকে কেমন করে। জলপিশাচের প্রিয় থাকার জায়গা হল বিশাল জঙ্গলে ঢাকা গভীর হ্রদ - টদ।
আর এই পুষ্করিণী তো গ্রামের একদম মাঝখানে। তিনদিকে ঘরবাড়ি। পুষ্করিণীর একদিকে আবার একটা মন্দির রয়েছে। কয়েকটা পুরনো বট অশ্বত্থ গাছ। আর সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়টা হল পুষ্করিণীটা নতুন খোঁড়া। বছরখানেকের বেশি পুরনো নয়। ধারে ধারে এখনো কোদালের দাগ দেখা যাচ্ছে পরিষ্কার।
জলপিশাচ পুরনো জলাশয় ছাড়া থাকে না।
গ্রামের লোকেরা নিশ্চয়ই কিছু লুকোচ্ছে।
সে সভাপতিকে বলল - পিশাচটাকে কেউ দেখেছে?
-- না।
-- তা হলে বুঝলে কি করে যে জলপিশাচ?
---আজ্ঞে সবাইকে যে জলেই টেনে নিয়ে গেছে। জলে তো জলপিশাচই থাকবে।
ঙিন একবার লোকটার দিকে আগুনদৃষ্টিতে তাকাল৷ গুটিয়ে গেল লোকটা।
পিশাচ আর রাক্ষসের কতরকম ভাগ হয় তা ও কি করে জানবে। আশ্রমে পিশাচ আর রাক্ষসের ওপর একশো দশ খন্ডের বই আছে। প্রত্যেকটা পড়তে হয়েছে ঙিনকে। জানতে হয়েছে কোন রাক্ষসের কোন দূর্বলতা। কোন পিশাচ কি সহ্য করতে পারে না।
জলে থাকে এমন পিশাচ আর রাক্ষস আছে প্রায় তিনশো প্রজাতির। এসব অজ্ঞ আর অকৃতজ্ঞ দূর্বল মানুষকে সেসব বলে কি লাভ!
সে বলল - আজ রাত থেকে সে গোটা গ্রাম পাহারা দেবে। সারারাত।
সভাপতি গ্রামের সবাইকে কি যেন বলল।তারপর সবাই চলে গেল।
ঙিন নিশ্চিত গ্রামের লোকেরা তার কাছে কিছু লুকোচ্ছে। কিছু একটা বলছে না তাকে।
প্রথম দুরাতে কিছু ঘটল না।
তৃতীয় রাত্রে পুকুরের পুব কোনে কিছু একটা ভারি জিনিস টেনে নিয়ে যাওয়ার শব্দ হল।
তাড়াহুড়ো করল না ঙিন। নিঃসাড়ে পুকুর পাড়ে যেতেই বুঝে গেল কি হয়েছে! সে বিশ্বাস করতে পারল না গ্রামের লোকেদের এত দুঃসাহস হল কিভাবে!
পুকুরের জল থেকে যেটা উঠে আসছে সেটা যে সে পিশাচ নয়।
ছাইয়ের মতো সাদা মুখ আর হলুদ চকরাবকরা জামা পরা সেটা একটা জোঁকা।
জোঁকাটা দাঁত বের করে হাঁসতে হাঁসতে জল থেকে উঠে পাশের একটা ঘরে ঢুকল। একটু বাদে একটা নির্জীব মহিলাকে পা ধরে টানতে টানতে জলে নিয়ে গেল।
তারপর মাঝপুকুরে গিয়ে টপ করে ডুবে গেল। মহিলাটার আর কোন হদিশ রইল না।
ঙিন চুপচাপ অন্ধকারে বসে বসে পুরো ব্যাপারটা দেখল। রাতেরবেকায় জোঁকাদের চাইতে ভয়ংকর কিছু নেই৷ রাত্রেবেলায় জোঁকা অদম্য। এমনকি বিন্থটেরও সাধ্য নেই রাতে জোঁকার কিছু করে।
তাই ঙিনের দেখা ছাড়া কোন উপায় ছিল না।
তাছাড়া গ্রামের সভাপতির সাথে বোঝাপড়াও বাকি ছিল।
তার জন্য সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
সকাল হতে মুঠো ঘুরিয়ে হাতের ফলা বের করে সভাপতির ঘরে গেল ঙিন। তারপরে সোজা সভাপতির কাঁধ থেকে একটা হাত কেটে ফেলল। আশপাশের লোক আতঙ্কে চিৎকার করে উঠল। তারা ভাবল এই বিন্থট পাগল হয়ে গেছে, এবার সবাইকে মেরে ফেলবে। তারা এদিক ওদিক ছোটাছুটি শুরু করে দিল।
ঙিন শীতল গলায় সভাপতিকে বলল - জোঁকা মানুষে তৈরী করে। তারপর নিজের লুকোন ধনরত্ন পাহারা দেবার কাজে লাগায়। তবে কোন কারণে মন্ত্র পড়া ভুল হলে জোঁকা জেগে উঠে যারা তাকে বানায় তাদেরকেই তীব্র আক্রোশে খুন করে। আমি জানতে চাই নতুন পুষ্করিণীর জোঁকাটাকে কে বানিয়েছে আর কেনই বা বানিয়েছে?
সভাপতির কাটা কাঁধ থেকে দরদরিয়ে রক্তপাত হয়ে চলেছে। সে হাঁফাতে হাঁফাতে জড়িয়ে মড়িয়ে যা বলল তা থেকে ঙিনের পুরো ব্যাপারটা বুঝতে অসুবিধা হল না।
মানুষ যে আসলে অত্যন্ত লোভী শয়তান সে বিষয়ে তার ধারণা আরো পোক্ত হল।
এই গ্রামে কয়মাস আগে পঁয়ত্রিশ একদল ভ্রাম্যমাণ পথিক আসে। তারা টাকা পয়সা দিয়ে সভাপতির বাড়িতে আশ্রয় নেয় রাতটুকু থাকার জন্য৷ তারা জানত না এ গ্রামের লোকেদের লুকোন ব্যবসাটা কিসের।
সে রাতেই বিষাক্ত গ্যাস ছড়িয়ে সব লোকগুলিকে খুন করে সভাপতি সহ গ্রামের লোকেরা। পথিকদলের সঙ্গে ছিল প্রচুর সোনা দানা, ধন রত্ন। অত মূল্যবান জিনিস নিরাপদে লুকিয়ে রাখতে সভাপতি একটা জোঁকা বানানোর সিদ্ধান্ত নেয়। পুকুর খোঁড়া শুরু হয়। পাশে মন্দির। মন্দিরের নিচে একটি গোপন ঘর। পথিক দলের মধ্যে একটা পনেরো বছরের ছেলে ছিল। তাকে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছিল৷ পুকুর খোঁড়া শেষ হলে ওই মন্দিরের নীচে গুপ্তঘরে ছেলেটাকে মন্ত্র পড়িয়ে পুজো করে সোনাদানা ধনরত্নসহ রেখে আসা হয়।
তারপর সেই ঘরের দরজা এঁটে বন্ধ করে দেওয়া হয়।
এরপর ওই ধনরত্নে অজানা কেউ হাত দিলেই জোঁকার নজর পড়ত তার ওপর।
সে ওই ধনরত্ন পেলেও তা ভোগ করতে পারত না৷
তবে মন্ত্রে যদি গোলযোগ হয় তাহলে জোঁকা যারা তাকে মন্ত্র পড়ায় তাদেরকেই এক এক করে মারে। কাউকে ছাড়ে না।
হড্ডর গ্রামে ঠিক তাই হয়েছে।
এসব বলে সভাপতি কাতরাতে কাতরাতে ঙিনের পায়ে পড়ে গেল। বলল - আমাদের বাঁচাও বিন্থট। তুমি যা চাও তাই দেব আমরা। মন্দিরের সব ধনরত্ন তোমার। শুধু আমাদের প্রাণটা বাঁচাও৷
ঙিন বলল - ওই সম্পদ এখন অভিশপ্ত। জোঁকার সাথে লড়ার ক্ষমতা একজন বিন্থটের নেই। আর তোমাদের মতো মানুষকে বাঁচানোর কোন ইচ্ছে আমার নেই। আমার মনে হয়না গুরুজী এসব জানলে আমাকে তোমাদের রক্ষা করতে পাঠাতেন। জয় অঘোরী।
সব রকম পিশাচ আর রাক্ষসের মধ্যে সব থেকে নিষ্ঠুরতম হচ্ছে মানুষ৷ পিশাচরা নিজেদের খুন করে না। একমাত্র মানুষরাই নিজেদের একজনকে খুন করে একটা অভিশপ্ত, অতৃপ্ত জোঁকা তৈরী করতে পারে। আর সেই মানুষদের বাঁচানোটাই বিন্থটদের ভবিতব্য।
ঙিন আশ্রমের পথ ধরল। বিন্থটেরা নিশ্বাস নেয় না। নইলে এসময় ঙিন নিশ্চয়ই একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলত।
হড্ডর গ্রাম কিছুদিনের মধ্যেই শুনশান মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছিল। কেউ আর ওই গ্রামে কোন দিনও থাকেনি। শুধু বাদুড়, হায়েনা আর কিছু বুনো কুকুর ছাড়া।
...........
Partha Pratim
 

 

স্বপ্ন-সূত্র - মধুমিতা মুখার্জী

 

স্বপ্ন-সূত্র
মধুমিতা মুখার্জী
 

    আজকাল সকালে ঘুম থেকে উঠেও কেমন একটা ক্লান্তি সারা শরীরে ছেয়ে থাকে। মনে হয়, এর থেকে আমার আর নিস্তার নেই। ভালোই ছিলাম এতদিন। যেদিন থেকে নতুন উপসর্গগুলো দেখা দিয়েছে; আমার মনের শান্তি নষ্ট হয়ে গেছে। 
 
    নতুন উপসর্গ বলতে, আমার স্বপ্নের কথা বলছি। বিয়ের পর হিমাচল প্রদেশে চলে এসে ভালো ছিলাম। পুরনো সব স্মৃতি ধীরে ধীরে মন থেকে চলে গেছিল। স্বপ্নে আবার সেই স্মৃতিগুলো ফিরে আসছে। স্বপ্নের মধ‍্যে সেই পুরোনো স্মৃতির সূত্র এসে প্রতিরাতে আমাকে অস্হির করে তুলছে; ধরতে গিয়েও তাদের ঠিকমত ধরতে পারছিনা। সেই অধরা স্বপ্ন-সূত্র আমাকে সারাদিন তাড়া করে চলেছে।
এখানে আসার ঠিক তিন মাস পরেই এই সমস্যার সূত্রপাত। একরাতে গভীর ঘুমের মধ‍্যে প্রথম স্বপ্নটা দেখলাম। দেখলাম, আমাদের বাংলোর মধ‍্যে সর্বক্ষণ ‘মিউ মিউ’ করে পায়ে পায়ে ঘুরে বেড়ানো দুধ সাদা বিড়ালটাকে। কিন্তু, বিড়ালটার চোখদুটো অন‍্যরকমের ছিল। সেই চোখের দৃষ্টি আমি জীবনেও ভুলতে পারবনা। আমার স্বপ্নে বিড়ালটার সবুজ চোখ বদলে মণির রঙ ঘন নীল দেখেছিলাম। এইরকম ঘন নীল চোখ আমি বহু আগে একজনের দেখেছিলাম; সারা জীবনেও ভুলবনা। সেই চোখদুটো বহুদিন আমাকে জীবন্ত দগ্ধ করেছে, কাউকেই বলে উঠতে পারিনি। বাবার গুরুদেব সেই সুঠাম দেহের অধিকারী, নিত‍্যানন্দ বাবাজীর চোখদুটো আশ্চর্য রকমের ঘন নীল ছিল। সেইবার তিনি আমাদের বাড়িতে আসার পরে পা টিপে সেবা করার জন‍্য আমাকে পছন্দ করেছিলেন। দরজা বন্ধ করে সেদিন…। উফফ! সেই ভয়াবহ স্মৃতি আমি চেষ্টা করে ভুলে ছিলাম। স্বপ্নে বিড়ালটার চোখদুটো বদলে ওইরকম হয়ে যেতে আবার মনে পড়ে গেল। স্বপ্নে বিড়ালটা আমার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল, ঠিক সেই গুরুদেবের মত। আমি ভয় পেয়ে বিড়ালটাকে দরজার খিল খুলে মারতে গিয়েও ব‍্যর্থ হলাম। যেমন হঠাৎ করে উদয় হয়েছিল; তেমনভাবেই মিলিয়ে গেল বিড়ালটা। আমি আবার ঘুমিয়ে পড়লাম। সারাদিন কেমন একটা ক্লান্তি আমাকে ঘিরে রইল। আমার স্বামী মৃদুল সকালে আমার দিকে কেমনভাবে তাকিয়ে ছিল। আমার খুব ভয় করছিল, ঘুমের মধ‍্যে আবার নিত‍্যানন্দ বাবাজীর কথা বলে ফেলিনি তো? ও যেটা বলা হয়নি- সেই দুধসাদা বিড়ালটাকে আর আমাদের বাংলোতে দেখতে পেলাম না। বেড়ালটা মৃদুলের খুব প্রিয় ছিল, প্রতিদিন অফিস যাওয়ার আগে নিজের হাতে বেড়ালটাকে দুধ খাওয়াত। সেটাকে দেখতে না পেয়ে ও একবারও খোঁজ করলনা, এটাই আশ্চর্য ব‍্যাপার। যাইহোক, আমিও বিড়ালটাকে আর দেখতে চাইছিলাম না।
 
    ধীরে ধীরে সব স্বাভাবিক হয়ে আসছিল। আবার নতুন স্বপ্ন এসে সবকিছু তোলপাড় করে দিল। দিনটা ভালোভাবেই শুরু হয়েছিল। সকাল থেকে ঘন নীল আকাশে মেঘের খেলা দেখে মনটা ভালো ছিল। রাতে গভীর ঘুমের মধ‍্যে আবার একটা স্বপ্ন দেখলাম। সেই স্বপ্নে আমাদের ফাইফরমাস খাটা বাচ্চা ছেলে সঞ্জুকে দেখলাম। সঞ্জুর বয়স মাত্র বারো বছর, শিশু শ্রমিক। স্বপ্নে দেখলাম সঞ্জু আমার দিকে এগিয়ে আসছে। শুধুমাত্র এইটুকু দেখেই আমি অস্হির হইনি। দেখলাম, সঞ্জুর হাতদুটো অস্বাভাবিক দেখাচ্ছে। অস্বাভাবিক বলতে, ওর ফর্সা রঙের সাথে বেমানান মিশকালো হাত! শুধু তাই নয়, হাতদুটো লম্বা লম্বা…বড়দের মত। ঠিক এইরকম হাত আমি দেখেছিলাম। আমাদের পুরোনো পাড়ার মুদির দোকানদার তারকের এমন কালো-লোমশ হাত ছিল। দুপুরবেলায় আমাকে কেন যে মা তারকের দোকানে নুন কিনতে পাঠাল সেদিন! ফাঁকা দোকানে আমাকে একা পেয়ে…
 
    ভুলতে চেয়েও যে ভুলতে পারিনা সেকথা। সেদিন ফেরার সময় হাতের নুনের প‍্যাকেটের নুন - নাকি আমার গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়া জল কোনটা বেশি নোনতা ছিল বুঝে উঠতে পারিনি কোনোদিন। 
 
    আমি স্বপ্নে সঞ্জুকে আমার দিকে এগিয়ে আসতে দেখে, ভয় পেয়ে গেছিলাম। স্বপ্নেই দরজার খিলটা নিতে গিয়ে সেটা খুঁজে পেলাম না। তখন টেবিলে রাখা পেতলের ওজনদার ফুলদানিটা নিয়ে ওর দিকে ছুঁড়তে গিয়ে দেখলাম সঞ্জু হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। ঠিক বেড়ালটার মত। এমন অদ্ভুত স্বপ্ন পৃথিবীতে আর কেউ দেখে বলে মনে হয়না। জানেন, পরেরদিন সকালে আর সঞ্জুকে দেখতে পেলাম না, এমনকি সেই ফুলদানিটাও দেখলাম না। মৃদুল কেমনভাবে যেন আমার দিকে তাকিয়েছিল। একটা আস্ত মানুষ আর একটা বিড়ালের মধ‍্যে কিছু পার্থক্য আছে। সঞ্জুর ঘরে ওর জামা-কাপড় পড়েছিল অবহেলায়। শুধুমাত্র, বিছানার চাদরটা নিয়ে সঞ্জু কোথায় চলে গেছিল। মৃদুল কিন্তু সেই নিয়ে একটা কথাও বললনা, আমিও বললাম না। এমনিতেই আর সঞ্জুকে চোখের সামনে দেখতে চাইছিলাম না। মৃদুল অবশ্য সঞ্জুর বাড়িতে খবর দিয়েছিল। ওর হত দরিদ্র বাবা-মা পাশের পাহাড়ের গ্রাম থেকে এসে বেশ খানিকটা কান্নাকাটি করে মৃদুলের দেওয়া দশ হাজার টাকা নিয়ে, চোখের জল মুছে ফিরেও গেছিল। আবার সবকিছু স্বাভাবিকভাবেই চলতে থাকল। একটা হতদরিদ্র পাহাড়ি পরিবারের পাঁচ নম্বর সন্তান হারিয়ে গেলে অবশ্য তেমন কিছু হেলদোল দেখা যাওয়ার কথাও নয়। 
 
    সেই গুরুদেব আর পাড়ার মুদির দোকানদার তারকের সাথেও এমন আশ্চর্য কিছু ঘটনা ঘটেছিল। নাহ্, তারা হারিয়ে যায়নি। গুরুদেব আমাদের বাড়ির তিনতলার একমাত্র ঘরটায় অতিথি হিসাবে কিছুদিন ধরে ছিলেন। আমাদের পুরোনো দিনের বাড়ি বলে শৌচাগারগুলো একতলায় বাড়ির উঠোনের একপাশে ছিল। গুরুদেব স্নান করার জন‍্য সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে গড়িয়ে পড়ে গেছিলেন। শিরদাঁড়ায় এমন আঘাত লেগেছিল যে তিনি আর কখনোই উঠে দাঁড়াতে পারেননি। সিঁড়িতে নাকি তেল পড়েছিল, মনে হয় গুরুদেব স্নান করতে যাবেন বলে বেশি করে তেল মেখেছিলেন। হয়ত, সিঁড়ির সামনে দাঁড়িয়েই তেল মাখছিলেন! কিছুই বলা যায়না।
 
    তারকের সাথে আবার অন‍্যরকমের ঘটনা হয়েছিল। তারক রোজ দুপুরে দোকানে বসে, বাড়ি থেকে নিয়ে আসা টিফিন বক্স খুলে ভাত খেত। একদিন, ও দুপুরে খাওয়ার পরেই মুখ দিয়ে গ‍্যাঁজলা বেরিয়ে, অজ্ঞান হয়ে যায়। বেশ কিছুক্ষণ ওইভাবে একা দোকানে পড়ে ছিল। বিকেলে একজন খরিদ্দার এসে তারককে ভাতের থালার সামনে ওই অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে চিৎকার করে লোকজন জড়ো করে হাসপাতালে দেয়। সে যাত্রায় তারক আর বেঁচে ফিরতে পারেনি। তারকের পাকস্হলীতে ইঁদুর মারার বিষ পাওয়া গেছিল। কিন্তু, ওর মায়ের বানিয়ে দেওয়া ভাত, তরকারিতে সেই বিষ পাওয়া যায়নি। পাকস্হলীতে নাকি মিষ্টি পাওয়া গেছিল! অথচ, তারকের মা সেদিন টিফিনে মিষ্টি দেননি বলেই পুলিশের কাছে জানিয়েছিলেন। আশ্চর্য ব‍্যাপার…খুব আশ্চর্য ব‍্যাপার। এতদিন পরে আমার স্বপ্নে তাদের বিশেষত্বগুলো দেখাটাও অত‍্যন্ত বিস্ময়কর ঘটনা। 

    আসল সমস্যার সূত্রপাত এই দ্বিতীয় স্বপ্নের পরেই হল। মৃদুল বদলে গেল। অবশ্য মৃদুল বদলে গেল বলাটা ঠিক নয়…ওর আচার-আচরণ বদলে গেল। ও আমার সাথে স্বাভাবিক ব‍্যবহার করা বন্ধ করে দিল। আমি যদিও এমনিতেই কম কথার মানুষ; তাও মৃদুলের আমাকে ঘিরে পাগলামোগুলো খুব মনে পড়ত বিভিন্ন সময়ে। আমাদের তিনমাসের দাম্পত‍্য কিন্তু বেশ আবেগঘন ছিল। পরিবর্তিত মৃদুল যন্ত্রের মত নিজের কর্তব্য করে চলেছিল, আলাদাভাবে কোনো কথাবার্তা আর বলতনা। সে না বলুক, আমার সাথে ঘনিষ্ঠ হতে চাইতনা সেটাই খারাপ লাগত। মাঝেমধ‍্যে অফিস থেকে ফিরে কার সাথে যেন দেখা করতে যেতে শুরু করল। ফোনেও কারোর সাথে আড়ালে গিয়ে কথাবার্তা বলতে শুরু করল। বুঝতে পারছিলাম, আমার কপাল পুড়েছে। এরপরই একদিন মনে হল,  অফিসে যাওয়ার সময় আমার খাবারের সাথে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দিয়ে যায় মৃদুল। সারাদিন খুব ঘুম পেত। অফিসে যাওয়ার সময় জোর করে এক গ্লাস হরলিক্স নিয়ে এসে মুখের সামনে ধরে বলত, “এটা খেয়ে নাও, তমালিকা। তুমি খুব দুর্বল হয়ে পড়ছ।"
 
    প্রথম প্রথম সন্দেহ করিনি, মনে হয়েছিল সত‍্যিই আমার স্বাস্থ্য নিয়ে চিন্তা করছে। পরে বুঝতে পারি, ওসব লোকদেখানো ব‍্যাপার। আসলে মৃদুল চাইছিল যে, আমি সারাদিন ঘুমিয়ে থাকি। আমি বহু চেষ্টা করেছিলাম যাতে ও হরলিক্স রেখে চলে যায়। তাহলে সুবিধামতো ফেলে দেওয়া যাবে। কিন্তু, ও নিজের হাতে খাইয়ে তবেই অফিসে যেত। আমিও হরলিক্স খেয়েই গভীর ঘুমে ঢলে পড়তাম। জেগে থাকলেও খুব ক্লান্ত লাগত।
 
    সেদিন একটা অন‍্যরকমের স্বপ্ন দেখলাম। সেই স্বপ্নটা দেখার পর থেকে আমি মনেমনে খুব অস্হির হয়ে পড়লাম। দেখলাম, একটা বিশাল বড় সাপ ফনা তুলে আমাকে ছোবল মারতে আসছে। আমি আশেপাশে কিছু আঘাত করার মতো আছে নাকি খুঁজে দেখতে গিয়ে কিছু না পেয়ে ছোট তেপায়া টেবিলটা হাতে তুলে নিলাম। সাপটাকে আঘাত করতে গিয়ে যা দেখলাম, তাতে আমার সারা শরীর ভয়ে কেঁপে উঠল। দেখলাম, সাপটার মুখটা পুরো মৃদুলের মতো হয়ে গেছে। ওর হাঁ মুখের ভেতর থেকে চেরা জিভ বার করে আমাকে ছোবল মারার জন‍্য প্রস্তুত হয়ে আছে। আমি প্রাণপণে শক্তি সঞ্চয় করে সাপটার দিকে টেবিল ছুঁড়ে মারতে যাই। সাপটা আমাকে লেজের ডগা দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে। আর কিছুই মনে নেই। সকালে উঠে ভয়ে ভয়ে তেপায়া টেবিলটার দিকে তাকিয়ে দেখি সেটা যথাস্হানে আছে। আমি ধীরে ধীরে বিছানা ছেড়ে উঠে বাইরের ঘরে মৃদুলকে সংবাদপত্র হাতে বসে থাকতে দেখে স্বস্তির শ্বাস ফেলি। আগের দু’বার স্বপ্নে যাকেই দেখেছিলাম; ঘুম ভেঙে উঠে তাকে আর কোথাও দেখতে পাইনি। এবার ব‍্যতিক্রম। আমি মৃদুলকে দেখে স্বস্তি পেলেও ঠিক আনন্দ পেয়েছি নাকি বুঝতে পারছিলাম না। আমি ঠিক করলাম, সেদিন হরলিক্স কিছুতেই খাবনা। মৃদুল অফিসে যাওয়ার সময় হরলিক্স গুলে কাপে করে নিয়ে এসেছিল। আমি বললাম, “আজ আমি হরলিক্স খাবনা।“
মৃদুল কেমন যেন ঘাবড়ে গিয়ে বলল, “সরবত করে আনব?”
আমি মুখের ভাব করুণ করে বললাম, “আমি আজ কোনোরকমের পানীয় খেতে চাইছিনা। আজকের মতো আমাকে ছেড়ে দাও।“
 
    মৃদুল কিছুক্ষণ ভুরু কুঁচকে কিসব চিন্তা করে আমার কথা মেনে নিল। মনে হল, ও সেদিন আমাকে ঘুমের ওষুধ না খাওয়াতে পেরে একটু হতাশ হয়ে পড়েছে। 
বিকেলে বাড়ি ফিরেই অন‍্য ঘরে গিয়ে ফোন নিয়ে বসে পড়ল। সেদিন আমার সারাদিন ঘুম পায়নি, তাই সজাগ ছিলাম। ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে বহু কষ্টে কান পেতে শুনলাম, মৃদুল খাদের মধ‍্যে কাউকে ফেলে দেওয়ার কথা বলছে। ভালো করে শুনতে পাইনি। তবে মনে হল, খাদ, অবোধ, ফেলে দেওয়া এইসব শব্দ নিয়ে কিছু বলছে। মনে হচ্ছে কঠিন কোনো পরামর্শ করছে কারোর সাথে। খুব ভয় করছিল আমার, আসলে আমাদের বাংলোর ঠিক পেছনেই গভীর খাদ। সেই খাদের নিচের দিকটায় সর্বক্ষণ অন্ধকার জমাট বেঁধে থাকে…এতটাই গভীর সেই খাদ। একটু পরেই প্রতিদিনের মতো বেরিয়ে পড়ল মৃদুল। আমি একটু দূর থেকে ওকে অনুসরণ করলাম। পাহাড়ের একটা বাঁকে গিয়ে একজন সৌম‍্যদর্শন বৃদ্ধের সাথে মৃদুল হাত-পা নেড়ে কথা বলছিল। আমি ধীরে ধীরে সেদিকে এগিয়ে গেলাম। দুজনেই কথাবার্তায় এত মগ্ন ছিল যে, আমার উপস্হিতি প্রথমে বুঝতে পারেনি। আমাকে হঠাৎ সেই ভদ্রলোক দেখতে পেয়েই চিৎকার করে উঠলেন, “মৃদুল! আমি এই ভয়টাই পাচ্ছিলাম।“
মৃদুল অবশ্য ঘুরে দাঁড়িয়ে আমাকে দেখার সুযোগ পায়নি। ও কিভাবে যেন আমার সাথে ধাক্কা লেগে চোখের সামনে খাদে পড়ে গেল। ওর পড়ে যাওয়ার সময় সেই ভয়াবহ আর্ত চিৎকার আজও কানে বাজে।
 
    আমি এখন পাহাড়ের কোলে একটা লাল রঙের বিশাল বাড়িতে অনেকের সাথে থাকি। সেই সৌম‍্যদর্শন ভদ্রলোক বলেছেন, আমার নাকি মাথা খারাপ, তাই একটা প্রাণী আর দু’জন মানুষকে হত্যা করেছি। পাগলদের জেল হয়না বলে এখানে রেখেছে। সে রেখে ভালোই করেছে, আমি এমনিতে ঠিকই আছি। তবে গতরাতে স্বপ্নে এই বাড়িটার আর আমাদের মতো আবাসিকদের যিনি দেখাশোনা করেন…তাঁকে স্বপ্নে দেখেছি। স্বপ্নে সেই ওয়ার্ডেন দিদির চোখগুলো বেড়ালটার মতো সবুজ হয়ে গেছিল। আমি ওনাকে তাড়া করেছিলাম, উনি ছুটে পালাচ্ছিলেন। আমি প্রায় ধরে ফেলব এমন সময় হাওয়ায় মিলিয়ে গেলেন। ঘুম ভেঙে তাকিয়ে দেখি আমি লাল বাড়ির পেছনের জঙ্গলে যাওয়ার দরজার সামনে মেঝেতে ঘুমিয়ে আছি। যাইহোক, তাঁকে নাকি সকাল থেকে পাওয়া যাচ্ছেনা। আমাকেও জিজ্ঞাসা করছিল সবাই। আমি কিভাবে জানব? দেখুক খুঁজে সবাই মিলে। বলা যায়না, হয়ত কেউ যেখানে জন্মেও যায়না…এই বাড়ির পেছনের জঙ্গলের ধারের খাদে ভালো করে খুঁজলে পাওয়া যেতেও পারে। কিভাবে যে মানুষ উধাও হয়ে যায় বুঝতেই পারিনা।
 
 
*সমাপ্ত*
 
Madhumita Mukherjee
 

 

ছাতিমতলা - অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়

 

 ছাতিমতলা

অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়



    বসন্তের সকাল। শীতের গাড়ি স্টেশান ছেড়ে চলে গেছে । আর্সিয়ানাদের গাড়ি এসে থামল এক নির্জন পাথুরে জায়গায়। রোদ্দুরে উজ্জ্বল প্রচুর ছোটবড় গাছে ভরা । জায়গাটা শিমূলতলা... ও..ই লাট্টু পাহাড়ের কাছাকাছি। বালি কাঁকড়ে ভরা পথ আর একটুখানি হেঁটে যেতে হবে। গাড়ি আর যাবে না। আর্সিয়ানা , সৌমিনি আর বজ্র টাটা সুমো থেকে নেমে স্তে আস্তে হাঁটতে লাগল। চিরচিরে সব পাখির ডাকে ঝিরঝিরে হাওয়া কুটিপাটি হচ্ছে। শৌভিক, মানে শৌভিক চ্যাটার্জী খুব বড় সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে যুক্ত আছে। তুখোড় ছেলে। তরতর করে ওপরে উঠছে। শৌভিক কিন্তু আর্সিয়ানার গুনমুগ্ধ। শিমূলতলায় ছাতিমতলা বাংলা সেই ঠি ক করে দিয়েছে। ওখানকার পুলিশ স্টেশনের ও সি-র মোবাইল নাম্বারও মেসেজ করে পাঠিয়েছিল আর্সিয়ানাকে।
যে ছেলেটা গাড়ি চালাচ্ছিল সে বেশ স্মার্ট গোছের । পরনে নীল জিনস আর লাল টি শার্ট। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ গাঁয়ের রঙ। মুখের গড়ন অনেকটা আমির খানের মতো।কথা বলে খুব। বলল, ‘ এখানে এসেছেন খুব ভাল করেছেন। জায়গাটা খুব সুন্দর। আমাদের অমিত স্যারও খুব শরীফ আদমি। মগর একটু সামহালকে থাকবেন। বদমাশ লোক ভি বহুৎ আছে এখানে।’
—-‘ তাই নাকি ? ‘
আর্সিয়ানা নির্বিকারভাবে জিজ্ঞাসা করে।
—- ‘ হ্যাঁ ম্যাডাম। খুন খারাবা ভি আখছার হয় ।আমি অবশ্য বেশিদিন আসিনি এখানে। এই এক সালের মতো হবে।আগে দেওঘরে থাকতাম। এখানে শীতকালটা খুব ভাল লাগে আমার। এই গরম আসছে... বহুৎ পরেশান হবে এবার।যাই হোক আপনারা ভাল সিজনেই এসেছেন। এনজয় করতে পারবেন.... ।’ অনর্গল বকবক করতে লাগল ও। বাংলা বেশ পরিষ্কার, তবে দেহাতি টান আছে।সৌমিনি হাঁ করে তাকিয়ে রইল আমির খান মার্কা যুবকের দিকে।
আর্সিয়ানা ভোলাভালা সৌমিনির উরুতে একটা চিমটি কাটল।
সৌমিনি চমকে ওঠে....’আ...হ ! ‘
আর্সিয়ানার দিকে তাকায় ঝট করে। আর্সিয়ানা ঠোঁটে গূঢ় হাসি ঝুলিয়ে এক চোখ টেপে।
সৌমিনি অপ্রস্তুত স্বরে অস্ফুটে বলে , ‘ ধ্যাৎ ! ‘ হেসে গড়িয়ে পড়ে গাড়ির সিটে। বজ্র, মানে টাটা সুমোর ড্রাইভার কিন্তু একবারও মুখ ঘুরিয়ে পেছনে তাকাল না।
এখানে শশীভূষণ মিত্রের এক পেল্লায় বাগানবাড়ি আছে এক বিশাল পাথুরে প্রান্তরে। ওখান থেকে দূরে দূরে আবছা ছবির মতো ঝাড়খন্ড অঞ্চলের পাহাড়ের সারি দেখা যায়। শশীভূষণ তো আর এখন বেঁচে নেই। তার ছেলে মেয়েরাও সকলেই পরলোকগত। আছে দুই নাতি আর এক নাতনি। সকলেই ছেলের দিকের। তাদের বয়েস পঞ্চান্ন থেকে ষাটের মধ্যে। এদের মধ্যে বয়েসে সবচেয়ে বড় অমিতাংশু। তারপর সুপ্রভা।
 

    সবার ছোট অজিতাভ। তার পঞ্চান্ন হল। এদের মধ্যে শুধু অমিতাংশুবাবু শিমূলতলার এই খামারবাড়িতে থাকেন। তিনি অবিবাহিত। সঙ্গে থাকত মালি ঝগরু আর তার পরিবার। পরিবার মানে, ঝগরু আর তার বৌ। বৌ কমলার বয়েস তিরিশের বেশি নয়। ঝগরু বেঁচে নেই। মারা যাবার সময় ঝগরুর বয়েস ছিল পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই। বৃদ্ধস্য তরুণী ভার্যা বলা যায়। ওদের কোন ছেলেপুলে নেই। ঝগরু খুন হয়েছিল বছর দেড়েক আগে।
বাড়ির নাম ছাতিমছায়া। লোকে বলে ছাতিমতলা।বাড়িটা প্রায় দেড়শো বছরের পুরণো। চারদিক ঘেরা দেড় মানুষ সমান পাঁচিলে। পাঁচিল অবশ্য বারংবার মেরামত হয়েছে। তবু পাঁচিলের একপাশে বেশ বড়সড় ক্ষত। সেখান দিয়ে সেঁধিয়ে আসে শেয়াল, বুনো ভাম কিংবা বনবিড়াল ।আর বেজির আনাগোনার তো শেষ নেই।একসময়ে এখানে প্রচুর ছাতিম গাছ ছিল । এখনও বেশ কিছু আছে। সেজন্য ভিলার নাম ছাতিমতলা। বাড়ির চারপাশে জঙ্গুলে আবহ।অার ভেতরে তো নাম জানা ও নাম না জানা গাছগাছালির ইয়ত্তা নেই।
বজ্র আর কমলা হাতে হাতে মহাদেবদের মালপত্র বয়ে এনে ছাতিমতলার একতলার বারান্দায় এনে রাখল। বাড়িটা দোতলা । একতলায় আটখানা ঘর আছে ।দোতলাতে ছ খানা । অমিতাংশুবাবু দোতলার একটা ঘরে থাকেন। অমিতাংশুবাবুর ঘরের পাশের দুটো ঘরে
আর্সিয়ানা এবং সৌমিনির থাকবার ব্যবস্থা হয়েছে। আর্সিয়ানারা দুজনে অবশ্য একই ঘরে ঢুকল।পুরণো দিনের বাগানবাড়ি ।কোন ঘরের মধ্যেই সংশ্লিষ্ট গোসলখানা নেই। এয়ার কন্ডিশনারও নেই। বাথরুম ওপাশে একটু তফাতে । অমিতাংশুবাবুও অ্যাটাচড্ বাথ নির্মাণের আগ্রহ দেখাননি। কমলার থাকার ঘর মূল বাড়ির পেছন দিকে প্রায় পনের মিটার দূরে।ঢালাই ছাদের পাকা ঘর। টালি বা অ্যাসবেসটসের ছাদ নয়।
ঝগরুর বিধবা ঘরনি কমলা
আর্সিয়ানাকে সিগারেট টানতে দেখে বেশ মজা পেল। হাসিমাখা মুখে আঁচল চাপা দিয়ে কৌতুকি দৃষ্টিতে অার্সিয়ানা আর সৌমিনিকে  দেখতে লাগল।
বাড়ির হাতায় গাছগাছালির ইয়ত্তা নেই। আম লিচু সবেদা জাম আর অনেক কাঁঠাল গাছ আছে।পাঁচিল ঘেঁসে গোটা তিনেক বেশ ফলন্ত সজনে গাছও আছে।
সেই ভোর থেকে গাছের ডালে ডালে পাতার আড়ালে শ’য়ে শ’য়ে পাখির কলকাকলি। সারা দিনভর চঞ্চল চপল আনাগোনা। ওদের পারিবারিক ব্যস্ততার শেষ নেই।
 

    এখানে বিদ্যুতের আগমন বেশিদিন হয়নি। এই বছর পাঁচেক হবে। তার আগে সন্ধের পর হত ঘুরঘুট্টি অাঁধার। দেহাতিদের ঘরে জ্বলত ঢিমে আলো। ঝোপঝাড় থেকে শেয়ালের পাল তুলত এককাট্টা একটানা ডাক। জোনাকির আলো চুমকি ছড়াত রাতের শরীরে। এখন নরম সরম হলেও রাতের গায়ে পড়ে মৃদু ভোল্টের আভা ।
রাত্রে কমলার পাকানো দেশি মুরগির ঝোল, ফুলকপির তরকারি আর গরম ভাত
আর্সিয়ানা সৌমিনির যেন অমৃত মনে হল। অমিতাংশুবাবুও একসঙ্গে খেতে বসলেন। খাওয়াদাওয়া চলাকালীন কমলা সারাক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে পরিচর্যায় ব্যস্ত থাকল। ঘরে দুটো সিঙ্গল খাট আছে। দুটো চেয়ারও আছে । একটা বড় টেবিল আছে দেয়াল ঘেঁসে এবং টেবিলের ওপর একটা বড় আয়না দাঁড় করানো আছে দেয়ালে ঠেস দিয়ে। প্রায় পনের ফুট উঁচু সিলিং। ঘরের আকার কমপক্ষে পনের ফুট বাই বারো ফুট। কমলা নৈশভোজ তত্ত্বাবধানের ফাঁকে কৌতুকভরা চোখে শার্ট প্যান্ট পরা আর্সিয়ানা সৌমিনিকে দেখে চলেছে। খাওয়া শেষ হলে কমলা এঁটো বাসনপত্র তুলে নিয়ে চলে গেল।
এসব জায়গায় সকালবেলাটা যেন স্বর্গীয় সুষমা মাখান। একটা মোরগ ডাক ছাড়ল সনাতন ভৈরবী মায়ায়।অমল উদার আলোয় মাখামাখি শিথিল অলস হাওয়ায় ছড়িয়ে গেল সে তান। গাছের পাতায় নরম লাবন্যময় আলো পড়ে চিকচিক করতে লাগল একটু পরে। কমলা একটা বড় ঝুড়ি মাথায় চাপিয়ে কোথায় বেরিয়ে গেল হন্তদন্ত হয়ে। বোধহয় স্টেশনের পাশে হাটে বসে মুরগির ডিম বিক্রি করে। বাড়ির পুব দিকে একটা ছোটখাটো দেশি মুরগির খামার আছে। সকালবেলায় দরজা খুলে দেওয়া হয়েছে। রঙ বেরঙের মুরগির দল বাড়ির সামনে নিশ্চিন্তে ঘুরঘুর করছে। খুঁটে খুঁটে কি যেন খুঁজে বেড়াচ্ছে মাটিতে ঘাসে।
আর্সিয়ানার সকালবেলায় এক কাপ কফি খাওয়ার অভ্যেস। কিন্তু এখানে তা পাওয়া যাবে না। অগত্যা কমলার এনে দেওয়া এক কাপ চা নিয়ে বারান্দায় বসল।সৌমিনি এখনও ঘুমোচ্ছে বিছানা আঁকড়ে। সৌমিনিকে আর্সিয়ানার বন্ধুও বলা যায়, ভক্তও বলা যায়। আর্সিয়ানার হাত পাকড়ে এখানে চলে এসেছে শুধুমাত্র ভ্রমণবিলাসে। আর্সিয়ানার ডাকাবুকো জীবন ও ক্ষুরধার মানসিকতার সঙ্গে তার কোন দিক দিয়েই কোন মিল নেই। কিন্তু বিপরীত মেরুদ্বয়ই তো একে অপরকে টানে। আর্সিয়ানা সৌমিনির জোড় লাগা বোধহয় সেইভাবেই।দুজনেরই বয়েস সাতাশ অতিক্রান্ত।
একতলার বারান্দায় খান চারেক প্লাস্টিকের চেয়ার পাতা আছে। একটা ছোট টেবিলও আছে।
আর্সিয়ানা একটা চেয়ারে বসে চা খেতে লাগল। বারান্দাটা একটু উঁচু। উঠোনে পা দিতে গেলে তিনধাপ আধচাঁদা সিঁড়ি নামতে হবে। তিননম্বর সিঁড়িটার নীচে বসে আছে একটা কুকুর।চেহারা দেখে মনে হয় অ্যালসেসিয়ান আর দেশি কুকুরের সংকরজাতীয়। দু’পা সামনে রেখে বসে জিভ বার করে শ্বাস ফেলছে। সামনের দিকে চেয়ে বসে আছে যেন কিসের প্রতীক্ষায়।মাঝে মাঝে ঘাড় ঘুরিয়ে আর্সিয়ানার দিকে তাকিয়ে থাকছে কয়েক সেকেন্ড। কয়েকবার এরকম তাকাবার পর কুকুরটার চোখে চোখ পড়ল আর্সিয়ানার।
দূর দিগন্তে দেখা যাচ্ছে নীলাভ পাহাড়ের সারি। নি:শব্দ চারিধার।
সৌমিনির ঘুম ভেঙে গেছে। দেখল
আর্সিয়ানার বিছানা ফাঁকা। আড়ামোড়া ভাঙতে ভাঙতে বারান্দায় এল। এসে দেখল ও অলস ভঙ্গীতে বসে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে।
— ‘ হাই লিখা... গুড মর্নিং...’
— ‘ হাই ডার্লিং... গুড মর্নিং... ঘুম ভাঙল ? ‘
সৌমিনি
আর্সিয়ানার পাশে এসে বসল। সামনের আবছা নীল পাহাড়ের দিকে উদাস চোখ মেলে তাকিয়ে রইল খানিকক্ষণ।
— ‘ হোয়াট আ বিউটিফুল ল্যান্ডস্কেপ .... না লিখা ? ‘
— ‘ ইয়েস, রিয়েলি ...’
দুজনে আবার খানিকক্ষণ চুপচাপ।
কুকুরটা বারান্দার নীচে ঠায় বসে আছে। ঘাড় ঘুরিয়ে ওদের দুজনের দিকে তাকাল আবার। কেমন যেন আবেদনের বার্তা মাখা দৃষ্টি।
আর্সিয়ানা তাকিয়ে রইল নির্লিপ্তভাবে।
— ‘ আচ্ছা অমিতাংশুবাবুর সমস্যাটা কি সেটা তো বললি না !
কি জন্য তোকে ডেকেছেন এখানে ?’ সৌমিনি জিজ্ঞাসা করে।
— ‘ মূল সমস্যাটা হল কমলাকে নিয়ে। পরে বলব সব কথা।’ অার্সিয়ানা সংক্ষেপে জবাব দেয়।
খানিকক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে দুজনে। একটা বছর পঁচিশের সুঠাম চেহারার ছেলে সামনের টেবিলে আর এক কাপ চা এনে রাখল। সেই নীল রঙা জিন্স এবং লাল রঙের টিশার্ট পরা আমির খান মার্কা ড্রাইভার ছেলেটা। বেশ সপ্রতিভ ভঙ্গীতে সৌমিনির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ ম্যাডাম চা ... ‘। আদিবাসিসুলভ শক্তপোক্ত শরীরি কাঠামো, কিন্তু রঙ কালো নয়। বরং বেশ ফর্সা।
আর্সিয়ানা জিজ্ঞাসা করল ,
‘ তোমার নাম কি ?’
ছেলেটা বলল, ‘ বজ্র । আমি অমিতাংশু স্যারের গাড়ি চালাই।’
— ‘ ও আচ্ছা , ঠিক আছে । তুমিই তো কাল আমাদের গাড়ি ড্রাইভ করে নিয়ে এলে। ঠি ক আছে, দরকার হলে ডাকব....’
ছেলেটা চলে গেল।
দুপুর একটা নাগাদ কমলা হাট থেকে ফিরল। তারপর চটপট দুপুরের খাবার লাগিয়ে দিল ভেতরের তিন নম্বর ঘরে পাতা টেবিলে। মটর ডাল, পোস্ত মাখানো আলু ভাজা আর দেশি চিকেনের কারি। আর শেষে সাদা মিষ্টি দই। অপূর্ব স্বাদ ।

অমিতাংশুবাবু বললেন, ‘এই বাড়িটা বিক্রি করে দিতে পারলে সব দিক দিয়েই ভাল হয়। কিন্তু মন সাড়া দেয় না। কি মায়ায় যে জড়িয়ে আছি এই খামারবাড়িটার সঙ্গে। কমলা আর বজ্রই এ বাড়ির সব কিছু সামলায়। বজ্র অবশ্য বছর দেড়েক হল এখানে এসেছে।তার আগে কমলা একাই সব সামলাত।
অমিতাংশুবাবু
আর্সিয়ানাকে বললেন , ‘ কে বা কারা যেন ঝগরুকে মেরে ফেলেছিল। মার্ডার করেছিল। তারপর ওই দক্ষিনদিকে পাঁচিলের ধারে যে আমগাছটা রয়েছে তার ডালে ঝুলিয়ে দিয়েছিল। খুন করার কারণটা আজও পরিষ্কার হয়নি।পুলিশি তদন্ত এখনও চলছে। ঝগরুর বউ কমলার ছেলেপুলে হয়নি। প্রথমদিকে খুব কান্নাকাটি করত। তারপর সামলে নিল।ওর তো নিজের লোক বলতে তেমন কেউ নেই। মা বাবা দুজনেই মরে গেছে। কমলা আবার তার স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ফিরে গেল। শুধু স্বাভাবিক জীবনেই ফিরে গেল না। অসম্ভব প্রগলভ হয়ে উঠতে লাগল দিনকে দিন।কেমন একটা ব্যধি ওর ওপর চেপে বসল। একটু আকর্ষণীয় মহিলা দেখলেই তাকে পাবার জন্য ও ক্ষেপে ওঠে। ‘
অার্সিয়ানাকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকতে দেখে অমিতাংশুবাবু বলে উঠলেন, ‘ হ্যাঁ হ্যাঁ ম্যাডাম ঠিকই শুনছেন.... পুরুষে নয়, নারীতে তীব্র আকর্ষণ। অথচ ও একেবারেই এরকম ছিল না। একেবারেই সহজ সরল একটা দেহাতি মেয়ে..... ‘
একটু চুপ করলেন অমিতাংশু।
আর্সিয়ানাকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে বললেন, ‘ জানি কি ভাবছেন।আমি কমলাকে টলারেট করছি কেন।ওকে এখান থেকে তাড়িয়ে দিলেই তো ল্যাঠা চুকে যায়। হ্যাঁ তা দিতেই পারতাম। মুশ্কিল হল, আমি ওকে নিজের মেয়ের মতো ভালবাসি। আমার তো পুত্র কন্যা কেউ নেই। তাই.... । কিন্তু ব্যাপারটা দিন দিন ইনটলারেবল হয়ে উঠছে।....এই যে আপনারা দুজন মেয়ে এখানে এসেছেন আমি শিওর ও সুযোগ খুঁজছে আপনাদের ঘনিষ্ঠ হবার জন্য।আর একটা ব্যপার হল ফিজিক্যাল স্ট্রেংথ। সেটা মাঝে মাঝে কি করে বেড়ে যায় কে জানে।আবার অন্য সময়ে একদম নর্মাল। ভারি ওজন একদম বইতে পারে না। সেদিন ষাট কেজির একটা সিমেন্টের বস্তা অনায়াসে তুলে নিয়ে গোডাউনে ঢোকাল। .... আপনার কি মনে হয় এটা কোন সাডেন হর্মোনাল বা ক্রমোজোমিক মেটামরফোসিস ?
আমি খুব দুশ্চিন্তার মধ্যে আছি।’
— ‘ আমি তো এ ব্যাপারে এক্সপার্ট নই ....’ ,
আর্সিয়ানা বলে। ‘....তবে সো ফার অ্যাজ আই নো এরকম সাডেন মেটামরফোসিস ইজ কোয়াইট আনলাইকলি । দেয়ার মাস্ট বি সামথিং আনক্যানি বিহাইন্ড দা অকারেন্স ।
যাই হোক, আমি চেষ্টা করব টু দা বেস্ট অফ মাই ক্যাপাসিটি টু আনভেল দা মিস্ট্রি।’ তারপর ট্রেডমার্ক গোয়েন্দাসুলভ লব্জে জিজ্ঞাসা করল, ‘ এ ব্যাপারে আপনার কাউকে সন্দেহ হয় ? ‘
—- ‘ না: , কাকে সন্দেহ করব বলুন তো । সন্দেহ করার মধ্যে তো এক ওই বজ্র। কিন্তু কমলার কান্ডকারখানার জন্য তো সে রেসপনসিবল হতে পারে না। তাছাড়া ঝগরু যখন মার্ডারড হয় সে তো এখানে আসেইনি।’
— ‘হুমম্ ... আচ্ছা কুকুরটা কতদিন ধরে এখানে আছে ? ‘ অার্সিয়ানা আচমকা প্রশ্ন করে।
— ‘ কোন কুকুরটা বলুন তো ?’
— ‘ ওই যে অ্যালসেসিয়ানের মতো দেখতে ‘
— ‘ ও আচ্ছা ....টমি... ‘ একটু ভাবতে লাগলেন। ‘ ওটা .... ওটা যদ্দুর মনে পড়ছে এখানে এসেছে ঝগরু মারা যাবার মাসখানেক পর । এক শীতের রাতে হঠাৎ এল গেট দিয়ে ঢুকে। তারপর থেকে গেল এখানে। কমলাই খেতে দেয়। আমি আর তাড়াইনি ওটাকে।’
— ‘ও আচ্ছা । আচ্ছা ঠিক আছে । দেখা যাক হাউ ইট প্যানস্ আউট।’
—- ‘ হ্যাঁ থ্যাঙ্ক ইউ। দেখুন কি করতে পারেন। .... আর হ্যাঁ , একটা কথা । আপনারা কিন্তু রাত্রে দরজা জানলা ভাল করে আটকে শোবেন।’
— ‘ ওক্কে ‘

নিশুতি রাত। ফাঁকা জায়গা । নিস্তব্ধ পরিবেশ। বেশ বড় মাপের ঘরের দুপাশে দুটো সিঙ্গল বেড। প্রায় পনের ফুট উঁচুতে সিলিং।ঘরে ঢিমে বালব্ জ্বলছে।সাতফুট উচ্চতার সেগুন কাঠের দরজার ছিটকিনি এবং খিল বন্ধ।অমিতাংশুবাবুর কথামতো
আর্সিয়ানা যেদিকে শুয়েছে সেদিকের বড় বড় দুটো জানলা বন্ধ করা আছে। তেমন গরম এখনও পড়েনি এখানে।মাঝরাতের পর গায়ে কিছু টেনে নিতে হয়।নি:শব্দ তল্লাটে হঠাৎ একপাল শেয়াল সমবেত স্বরে ডাকতে আরম্ভ করল। আর্সিয়ানার চোখে ঘুম নেই।মাথায় নানা চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে।ওদিকের খাটে সৌমিনি বেশ খানিকক্ষণ আবোলতাবোল বকবক করার পর এখন ঘুমিয়ে কাদা।হাল্কা নাকও ডাকছে।অার্সিয়ানা ভাবে, সত্যি... সৌমিটা ছেলেমানুষই থেকে গেল।
মোবাইল খুলে সময় দেখল
আর্সিয়ানা । একটা বাহান্ন । এরপর আরও মিনিট পাঁচেক কাটল। চোখের পাতা একটু জুড়ে আসছে যেন।
একটা চাপা গোঙানিতে ঘুম ছুটে গেল তার। ধড়মড় করে উঠে বসল অার্সিয়ানা। তার বালিশের তলায় রিভলভার আছে। পাশে টর্চ। অবশ্য মৃদু বাতিতে সবই দেখা যাচ্ছে। চিৎ হয়ে শোয়া সৌমিনির দেহে উপুড় হয়ে দখল নিতে চাইছে কে একজন। আর সৌমিনি ছটফট করছে নিজেকে ছাড়াবার জন্য।দরজা জানলা সব ভেতর থেকে বন্ধ। ভয়ে বিষ্ময়ে কন্ঠরোধ হয়ে গেল তার।কিন্তু অার্সিয়ানার স্নায়ু অন্য ধাতুতে গড়া । কয়েক সেকেন্ড লাগল বুকের চাপটা কাটাতে। ঝট করে টর্চের আলো ফেলল সৌমিনির বিছানায়। সৌমিনির শরীরে ওপর অস্থির আকুলিবিকুলিরত এক নগ্ন নারীদেহ। দেখে বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে গেল
আর্সিয়ানা যে, নগ্ন নারীটি কমলা। আর্সিয়ানা তার আঠাশ বছরের বৈচিত্রময় এবং দু:সাহসী জীবনে এ ধরণের পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়নি কখনও। কিন্তু সে অন্য ধাতুতে তৈরি। এর মধ্যেই ভাবনা চিন্তা করে ফেলল। সে সিদ্ধান্তে পৌঁছল যে এটা একটা অ্যাকিউট কেস অফ পেরিফেরাল হ্যালুসিনেশান। সে তাড়াতাড়ি সুইচ বোর্ডের কাছে গেল এবং সুইচে চাপ দিল। আলোয় ভরা ঘরে অার্সিয়ানা কোথাও কাউকে দেখতে পেল না। সৌমিনি চিৎ হয়ে শুয়ে আছে তড়িতাহত এবং বিদ্ধস্ত ভঙ্গীতে। উদভ্রান্ত ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বিছানার পাশে দাঁড়ানো আর্সিয়ানার দিকে। আর্সিয়ানা কিংকর্ত্তব্যবিমূঢ় না হয়ে ঢাকা গ্লাস থেকে জল নিয়ে সৌমিনির চোখেমুখে জলের ছিটে দিতে লাগল। তারপর ওই রাতদুপুরেই মোবাইল কল দিল অমিতাংশুবাবুকে। দরজা বা জানলা কিছুই খুলল না।
মোবাইলে রিং হয়ে যেতে লাগল। কেউ ফোন ধরল না। স্লিপিং পিল খেয়ে বিছানায় যাওয়া অমিতাংশুবাবুর বোধহয় ঘুম ছুটল না।
পুব আকাশে সূর্য উঠে যথারীতি ভোর হল। অার্সিয়ানা দরজা খুলে বারান্দায় এল। দেখল, গাছকোমর করে শাড়ি বেঁধে নীচে চাতালে শুকনো পাতা ঝাঁট দিচ্ছে কমলা।
আর্সিয়ানার সব কিছু কেমন গুলিয়ে যেতে লাগল।সৌমিনি এখনও ট্রমায় আচ্ছন্ন।ঘরে শুয়ে আছে।
সকাল প্রায় নটা নাগাদ একজন ডাক্তারবাবু এলেন। কমলাই ডেকে নিয়ে এল। অার্সিয়ানার অবাক হওয়ার মাত্রা সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে । ডাক্তারবাবুর ঝাঁঝায় বাড়ি। শিমূলতলায় প্র্যাকটিস করেন।তিনি অবশ্য বিশেষ কিছু বুঝতে পারলেন না।একটা ট্র্যাঙ্কুইলাইজার প্রেসক্রাইব করে গেলেন। ডাক্তারবাবু যখন বেরিয়ে যাচ্ছেন অ্যালসিসিয়ান মার্কা কুকুরটা ব্যস্তভাবে ছোটাছুটি শুরু করল কমলার আশেপাশে।শান্তশিষ্ট কুকুরটা কেমন যেন অস্থির হয়ে উঠল।
আর্সিয়ানা দোতলার বারান্দায় বসে রইল দূরে আবছা নীল পাহাড়ের সারির দিকে চেয়ে। ভাবল, সৌমিনিকে কি আজ রাতে এখানে রাখা ঠি ক হবে ! বেচারা এমনিতেই ট্রমাটাইজড হয়ে আছে।সে কিন্তু আজ রাতে কি ঘটে দেখার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছে। কাল রাতের ঘটনাটা সত্যিই কি হ্যালুসিনেশান ছিল ? নানা চিন্তা ঘোরে আর্সিয়ানার মাথায়। একবার ভাবল, স্থানীয় পুলিশ ফাঁড়িতে ব্যাপারটা জানিয়ে রাখবে কিনা । ফাঁড়ির ফোন নম্বর আর্সিয়ানা যোগাড় করেই রেখেছে। তারপরই মনে হল, এরকম একটা ঘটনায় পুলিশের কি করার আছে। অনেকক্ষণ ধরে সাতপাঁচ ভাবার পর আর্সিয়ানা থানার বড়বাবুকে একটা কল দিল। ওদিকে একটা ঘড়ঘড় শব্দ হয়ে ফোন কেটে গেল। তারপর বেশ কয়েকবার ডায়াল করার পর হাল ছেড়ে দিল আর্সিয়ানা । প্রত্যেকবারই ঘুরে আসে একই কথা— ডায়াল করা নম্বর নাকি উপলব্ধ নেই ,পরিষেবা সীমার বাইরে। ও: ডিজগাস্টিং.... আর্সিয়ানা বিরক্তিতে খানখান হয়।বড়বাবু কি জবাব দিচ্ছেন
কিছু শোনা যাচ্ছে না। ঘড়ঘড় করে আওয়াজ হয়ে লাইন কেটে যাচ্ছে । ওফ্ , এই নেটওয়ার্কের সমস্যায় জীবন ঝালাপালা হয়ে গেল। বিরক্তির চিহ্ন ফুটে ওঠে
আর্সিয়ানার চোখেমুখে।
কুকুরটাকে দেখা যাচ্ছে না কোথাও। কোথায় ঘুরে বেড়াচ্ছে কে জানে। কাকে একটা দেখা গেল ওই দূরে একটা আমগাছের তলায় ঠি ক যেন আমগাছটার ছায়া হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হাল্কা ধোঁয়া উড়ছে মনে হচ্ছে এখান থেকে। কোন ব্যাটা বোধহয় ওখানে দাঁড়িয়ে বিড়ি খাচ্ছে।
টমিকে দেখা যাচ্ছে না অনেকক্ষণ ধরে। বিদ্যুৎতরঙ্গের মতো
আর্সিয়ানার মাথায় একটা চিন্তা ছিটকে উঠল। সে তাড়াতাড়ি দোতলা থেকে নীচে নেমে এল। কুঠির চারদিকের বিশাল কম্পাউন্ড ঘুরে কুকুরটাকে খুঁজতে লাগল। না:, কোথ্থাও নেই। আর্সিয়ানা আপনমনে বোকার মতো হাসে। তাই তো ! সে কুকুরটাকে খুঁজে মরছে কেন। দক্ষিনদিকের ওই আমগাছটার দিকে হাঁটতে লাগল শুকনো পাতা মাড়িয়ে মাড়িয়ে যেখানে কেউ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ধূমপান করছে । মশ্ মশ্ করে আওয়াজ হতে লাগল।নীরব আবহে ওইটুকু আওয়াজই বাতাসে ছলকে ছলকে উঠছে।আমগাছটার তলায় পৌঁছল আর্সিয়ানা ।কেমন নির্জন সিরসিরে পরিবেশ।কোন গাছের পাতার আড়ালে বসে একটা  পাখি ডাকছে । বাতাস কেটে ভেসে ভেসে চলে যাচ্ছে কুঁড়ুর কুঁড়...... কুঁড়ুর কুঁড় ..... অসীম নীরবতায় রহস্যময় শব্দের মতো।
অবাক কান্ড। ওখানে কাউকে দেখতে পেল না
আর্সিয়ানা । কেউ নেই ধারে কাছে। এ জায়গাটায় আম জাম কাঁঠাল লিচু গাছ যেমন আছে, তেমনি শাল গাছও আছে বেশ কিছু। বেশ ঘন জঙ্গল মতো হয়ে আছে এক জায়গায়। কেমন যেন ঝুঁঝকো অাঁধার ওখানে। অার্সিয়ানা ওই দিকেই তাকিয়ে রইল। হঠাৎ দেখে ওই শাল গাছগুলোর আড়াল থেকে অ্যালসেসিয়ানের মতো দেখতে টমি বেরিয়ে এল। ল্যাজ নাড়তে নাড়তে ধীরে সুস্থে হেঁটে আর্সিয়ানার সামনে এসে দাঁড়াল। মুখটা তুলে ঠি ক কালকের মতো করুণ আবেদনময় চোখে আর্সিয়ানার দিকে তাকিয়ে থাকল। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে অদ্ভুত একটা আবেশ জড়িয়ে ধরছে যেন তাকে । অার্সিয়ানার হঠাৎ সৌমিনির কথা মনে পড়ল। সে জোর পায়ে হাঁটা দিল ছাতিমতলা কুঠির দিকে। কুকুরটাও তার সঙ্গে সঙ্গে হাঁটতে লাগল। তার নিজের ওপর খুব রাগ হল। মনে হল, যদিও কমলাকে বলে এসেছে সৌমিনিকে দেখার জন্য, তবু একটা মানসিকভাবে বিধ্বস্ত মেয়েকে একা ফেলে আসা উচিৎ হয়নি। আর কমলা তো.... কাল রাত্রের কথা মনে করে শিউরে উঠল সে। তার কি বুদ্ধিসুদ্ধি লোপ পেয়ে গেল নাকি। অন্তত আজ রাতটা কাটাতে হবে এখানে। হাঁটতে হাঁটতেই ফাঁড়ির ও সি-র মোবাইল নম্বর ডায়াল করল। এটা মনে হচ্ছে একেবারেই পুলিশ টুলিশের মামলা নয়। তবু, আর্সিয়ানা পুলিশ ছাড়া আর কার সাহায্যই বা নিতে পারে এখানে।
তরতর করে দোতলায় উঠে ঘরে ঢুকে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল
আর্সিয়ানা । বিছানায় বালিশে ঠেস দিয়ে বসে সৌমিনি কমলার সঙ্গে কি সব গল্প করছে। অবশ্য কমলাকে দেখে সৌমিনির কোন প্রতিক্রিয়া হবার কথা নয়।সে তো কাল রাতে কমলাকে দেখতেই পায়নি। যা দেখেছে, তা শুধু অার্সিয়ানা । মাথার দিকে জানলার বিশাল পাল্লা দুটো খোলা। হু হু করে হাওয়া বইছে শালবনের মধ্যে দিয়ে।
দুপুরবেলায় দুজন দেহাতি মহিলা মাদুর বিক্রি করতে এল। এখানে গরমকালে এগুলোর খুব চাহিদা। দামও কম। রকমারি সব সেলাই ও বুনন। কমলা, বজ্র আর অমিতাংশুবাবু একতলার সামনের বারান্দায় বসে মাদুর পছন্দ করছে। অার্সিয়ানা সৌমিনিকে নিয়ে নীচে নেমে এল। হাওয়ায় কেমন যেন আতরের গন্ধ নাকে লাগল
আর্সিয়ানার।
সৌমিনি এখন অনেক স্বাভাবিক।কিন্তু আজ রাতে আবার কি ঘটে সেটা চিন্তা ক’রে
আর্সিয়ানার মতো মেয়েরও গা সিরসির করে উঠল। মোবাইলে তো এখনও থানার অফিসারের সঙ্গে একবারও কথা বলা গেল না। ওখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মাদুর কেনা বেচা দেখতে দেখতে থানার ও সি-কে একটা টেক্সট মেসেজ করল — আজ রাতে তার সাহায্যের দরকার হতে পারে। দু মিনিটের মধ্যে উত্তর এল— ওকে, জাস্ট গিভ মি আ মিস কল। টেক কেয়ার। এক চান্সেই কানেকশান হল। অথচ ভয়েস কানেকশান কিছুতেই হচ্ছিল না। নেটওয়ার্কের এত প্রবলেম যে বলার নয়। কিন্তু আর্সিয়ানার অনুসন্ধিৎসু মনে সবসময়ে সন্দেহের কাঁটা লটকেই থাকে। তার মনে হতে লাগল, কে যেন মোবাইল যোগাযোগে বাধা দিচ্ছিল। আর ওই ঘর্ঘর আওয়াজ .... ওটা কি যান্ত্রিক গন্ডগোল , নাকি .....! আবোলতাবোল চিন্তা আসছে আর্সিয়ানার মাথায়। সে ঠি ক করে ফেলে অাজ রাতটা কোনরকমে কাটিয়ে কালকেই সৌমিনিকে নিয়ে কলকাতায় রওয়ানা দেবে। তারপর দরকার হলে সে আবার একা ফিরে আসবে এখানে। রহস্যটা তো উন্মোচন করতেই হবে। কাল রাতের সেই সাঙ্ঘাতিক দৃশ্যটা মনে করে অার্সিয়ানার মতো ডাকাবুকো মেয়েও মনে মনে একটু যেন কেঁপে গেল। পেরিফেরাল হ্যালুসিনেশান ? কে জানে, হবে হয়তো । কিন্তু সৌমিনি তাহলে ট্রমাটাইজড হল কেন ? বড্ড ধাঁধার ব্যাপার হয়ে যাচ্ছে গোটা ব্যাপারটা।
মাদুর বাছাবাছি চলছে বারান্দায়।টমি বারান্দায় উঠে এল। কমলার একদম কাছ ঘেঁসে বসল।বসেই রইল। সেই একইরকম জিভ হ্যালহ্যাল করছে। মাঝে মাঝে মুখ তুলে কমলার দিকে তাকাচ্ছে।
আর্সিয়ানার মনে হল, কেমন যেন আসঙ্গলিপ্সু ধরণ। কমলার অবশ্য কোন হেলদোল নেই। সে মাদুরওয়ালিদের সঙ্গে দেহাতি ভাষায় নানা গল্পগাছায় ব্যস্ত।
অমিতাংশুবাবু
আর্সিয়ানাকে বললেন, ‘ বিকেলে আপনারা লাট্টু পাহাড়ে ঘুরে আসতে পারেন। ভাল লাগবে। সঙ্গে কমলা আর বজ্রও যাবে। আরও দুএকদিন থাকলে হলদি ঝর্ণা দেখে আসতে পারতেন। খুব ভাল পিকনিক স্পট।যাক, পরে আবার কখনও এলে..... ‘
কমলাও বলল, ‘ হাঁ দিদি চলেন, বিকেল বেলা ওখান থেকে সানসেট দেখবেন ....খুব সুন্দর ।’
সকাল গড়িয়ে চলল দুপুরবেলার দিকে। মাদুরওয়ালিরা গা তুলল। কমলাও কোমরে আঁচল জড়িয়ে রান্নাঘরের দিকে গেল। এখানে রান্নাঘরগুলো খানিক তফাতে। ওই কুয়োতলার পাশে। টমিও একেবারে কমলার গায়ে গা লাগিয়ে হাঁটতে লাগল রান্নাঘরের দিকে। কমলাকে যেন কাছছাড়া করতেই চাইছে না। আর হ্যাঁ, বজ্রকে ধারে কাছে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। ওই যে আমগাছের নীচে দাঁড়িয়ে বিড়ি খাচ্ছিল। ধোঁয়া বেরোতে দেখল।ওটা কি বজ্র তবে ? সেটাও কি তবে ভিসানারি অ্যাবারেশান !
আর্সিয়ানার মাথায় বিদ্যুতের মতো চিড়িক দিয়ে উঠল একটা ভাবনা। তবে কি ......
কিন্তু টমি তার দিকে করুন চোখে তাকিয়ে থাকে কেন ? ওর কি কিছু বক্তব্য আছে
আর্সিয়ানার কাছে ?
আর্সিয়ানা ঠিক করে নেয়, আজ রাত্রেই ফয়সালা করতে হবে।
বিকেলবেলা মনোরম বাসন্তী আবহে ভরে আছে।
আর্সিয়ানা আর সৌমিনি কমলাকে সঙ্গে নিয়ে লাট্টু পাহাড়ের নীচে গিয়ে দাঁড়াল। এটা কিছুই না, একটা ছোট টি লা। শীতকালে অনেক টুরিস্ট আসে শিমূলতলায়। এখন একদম ফাঁকা। নির্জন বিকেলে পড়ে আছে আশপাশ। তিনজনে মিলে উঠতে লাগল টি লার ওপর দিকে। অার্সিয়ানা দেখল বজ্রও যোগ দিয়েছে ওদের সঙ্গে।কমলা ঘুরে নীচের দিকে তাকিয়ে কি দেখছে। আর্সিয়ানা দেখল নীচের থেকে তীরবেগে ওপরে দৌড়ে আসছে টমি। এসে কমলার চারপাশে একবার ঘুরপাক খেয়ে নিল। তারপর তাদের সঙ্গে
টি লার ওপরে উঠতে লাগল।
আর্সিয়ানা ভাবল, কুকুররা খুব ফেথফুল হয়।কমলা টমিকে খেতে দেয়। তাই বোধহয় কমলার সঙ্গে এত দোস্তি। বজ্র তাদের সঙ্গেই হাঁটছিল। টমি আসার পর অনেকটা তফাৎ হয়ে গেল। ও নিশ্চয়ই কুকুরটাকে তেমন পছন্দ করে না।
এখন অফ সিজন। লাট্টু পাহাড়ে একটাও টুরিস্ট নেই। টিলার ওপর থেকে অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়।ঝোপঝাড়, পাথুরে মালভূমি, আবছা জনপদ নীরব ক্যানভাসের মতো এলিয়ে আছে। সন্ধে নেমে আসছে। পড়ন্ত আলোয় শত শত নীড়ে ফেরা পাখির কাকলিতে মুখর হতে লাগল চারপাশ। বজ্র বলল, ‘ ওই দেখুন ম্যাডাম .... ওইদিকে স্টেশান আছে।’ তারপর উল্টোদিকে ঘুরে বলল, ‘ ....আর ও..ই দিকে হলদি ঝর্ণা .... এখান থেকে খরিফ ছ কিলোমিটার হবে। ওই যে.... অনেক পেড় দেখা যাচ্ছে। ওটা একটা টুরিস্ট স্পট। কুছ দিন পহলে ওখানে নাকি অচানক শের দেখা গিয়েছিল।’
— সৌমিনি প্রবল উৎসাহে বলে, ‘ তাই নাকি ! ইশশ্ হাতে টাইম থাকলে যাওয়া যেত .....’
আর্সিয়ানা সৌমিনির পিঠে হাত দিয়ে সান্ত্বনা দেয় , ‘ কাম অন ডিয়ার, ডোন্ট ওয়ারি...... আবার আসব , চিন্তা নেই...’
বজ্রও সায় দেয়, ‘ হাঁ ম্যাডাম, জরুর আসবেন।’
এই সময়ে টমি বজ্রের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ প্রচন্ড গর্জন করতে লাগল। কমলা চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে । মোটেই থামাবার চেষ্টা করছে না কুকুরটাকে। বজ্র আবার তফাতে সরে গেল। পুঁচকে পাহাড়টার ধারে গিয়ে দাঁড়াল। আলো আরও মরে এসেছে। বিহঙ্গের কলকাকলিতে তিরতির করছে গোধূলি । কমলা একদিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, ‘ ওই ওদিকে, অনেক দূরে যেখানে ছোট ছোট ঘর দেখা যাচ্ছে ওইখানে আমাদের গাঁও ছিল।’
আর্সিয়ানা কমলার দিকে তাকিয়ে থাকে । বলে, ‘ কেন, এখন আর নেই ? আর যাও না ওখানে ?’ কমলা তার গাঁওয়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আনমনে বলল, ‘ হাঁ, গাঁও তো জরুর আছে, মগর আমি তো আর নেই .....’ কমলা আনমনে উদাস দৃষ্টি মেলে ওই দূর গাঁওয়ের দিকে তাকিয়ে রইল। আর্সিয়ানার মাথায় চিড়িক দিয়ে উঠল একটা ভাবনা। সে কমলার দিকে ঘুরে বলল, ‘ তার মানে ?’ টমি দুজনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে। একটানা লেজ নাড়াতে নাড়াতে একবার এর মুখের দিকে আর একবার ওর মুখের দিকে তাকাচ্ছে।যেন সব কথাই বুঝতে পারছে। কমলা কোন উত্তর দিল না। অানমনে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল নীচের ওই দূর গাঁয়ের দিকে।কোন ঘোরে যেন ডুবে আছে।এ জগতে নেই। আর্সিয়ানার চোখে পড়ল টমিও কমলার পাশে দাঁড়িয়ে ওই দূরের ঘরবাড়ি ক্ষেতখামারের দিকে তাকিয়ে আছে উন্মুখ হয়ে।ওই গাঁ যেন ওরও খুব চেনা।
পকেট থেকে মোবাইল বার করে ফের একটা টেক্সট করে ফাঁড়ির
ও সি-কে — ‘ প্লিজ মেক শিওর টু স্টে ক্লোজ বাই আফটার ইভনিং ....’। জবাব এল তক্ষুণি , ‘ ওকে ....ডোন্ট ওয়রি । জাস্ট গিভ আ মিস কল। স্টে সেফ।’
একসময়ে সন্ধে নেমে আসে। দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে অার্সিয়ানা আর সৌমিনি দূর পাহাড়ের আড়ালে লাল আবির ছড়িয়ে সূর্য ডুবে যাওয়ার ছবি দেখছিল। একদম ছবির মতো দৃশ্য। কমলাকে দেখা গেল একটা ঝাঁটা আর ঝুড়ি নিয়ে বাড়ির সামনের শুকনো পাতা পরিষ্কার করছে। মেয়েটা সবসময়ে কোন না কোন কাজে ব্যস্ত। অমিতাংশুবাবু কোথায় বেরিয়ে গেলেন। বোধহয় এখান থেকে মিনিট পাঁচেক দূরে এক উকিল বন্ধুর বাড়ি গেলেন আড্ডা মারতে। অার্সিয়ানার মনে হল, এই অমিতাংশুবাবু মানুষটিও বেশ সন্দেহজনক চরিত্র। বেশ দুর্বোধ্য ধরণের। সারাদিন কোথায় যে থাকেন বোঝা গেল না। কাল রাতে ওরকম অদ্ভুত ঘটনার পর ফোন করে কোন সাড়া পাওয়া গেল না। অবাক কান্ড।
এখানে বিদ্যুতের ভোল্টেজ খুব কম। জোলো পানসে আলো।
আর্সিয়ানাদের ঘরের দরজার পাশের দেওয়ালে একটা অংশে প্লাস্টার খসে গিয়ে ইঁটের পাঁজরা বেরিয়ে পড়ে দেয়ালের ওপর নগ্ন মানুষের আকার তৈরি হয়েছে। দরজার পাশে যেন দাঁড়িয়ে আছে কার প্রতীক্ষায়। ভর সন্ধেবেলায় চোখে পড়লে গা ছমছম করে।
এর ঠিক পাশেই অমিতাংশুবাবুর ঘর। দরজা আধখোলা।
আর্সিয়ানা বারান্দার এদিক থেকে ওদিক ধীর পায়ে পায়চারি শুরু করল। পায়চারি করতে করতেই অমিতাংশুবাবুর ঘরের ভেতর উঁকি দিল। ভেতরে অন্ধকার। যেটুকু দেখা যাচ্ছে মনে হচ্ছে ঘরে আসবাবপত্র খুব কম। সৌমিনির মোবাইলে থানার ও সি-র নম্বরটা সেভ করে দিয়ে বলল, ‘ শোন তুই এখানে দাঁড়া।কোন ভয় নেই। আমি একটু এ ঘরটায় ঢুকছি। যদি সাত মিনিটের ভেতর না বেরিয়ে আসি এই নাম্বারে একটা মিসকল দিবি শুধু। এখানে দাঁড়া। কোন ভয় নেই। কিচ্ছু হবে না।’ মোবাইলের টর্চ জ্বেলে আর্সিয়ানা অমিতাংশুর ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়ল। দুদিকে দুটো বড় বড় জানলা। জানলার পর্দাগুলো হাওয়ায় নাচানাচি করছে।একটা ঢাউস সাইজের ড্রেসিং টেবিল রয়েছে একপাশে। আর একটা দুজন শোবার মতো খাট। খাটে একটা মশারি টানানো রয়েছে। চারপাশ ওপর দিকে গোটানো। একটা টেবিলও রয়েছে মনে হচ্ছে খাটের মাথার দিকে। আর্সিয়ানা ঘরের চারদিকে আলো ফেলতে লাগল। একটা দেয়াল আলমারি রয়েছে দক্ষিণদিকের জানলার পাশে। জানলার একটা পাল্লা খোলা ।
আর্সিয়ানা ঘরের চারদিকে মোবাইলের আলো ঘোরাতে লাগল। ঘরের সিলিং-এ একটা পুরনো ঝুলমাখা পাখা ঝুলছে। অার্সিয়ানা দেখতে পেল সিলিং ফ্যান থেকে একটা মোটা নাইলনের দড়ি ঝুলছে। ঘরে কোন জামাকাপড়, তোয়ালে, চিরুনি বা অন্য কোন সরঞ্জাম দেখা গেল না। আর্সিয়ানা দেয়াল আলমারির দিকে এগিয়ে গেল। পাল্লাটা খুলে ফেলল। ভেতরটা একদম ফাঁকা।পাল্লা খুলতেই ভেতর থেকে যেন একটা মিস্টি আতরের গন্ধ মাখা দমকা হাওয়া এক ঝটকায় বেরিয়ে এসে আর্সিয়ানাকে ঝাপটা মারল।
সাত মিনিট পুরো হবার আগেই অার্সিয়ানা বেরিয়ে এল। সৌমিনি যেন ধড়ে প্রাণ ফিরে পেল ।

আর্সিয়ানা সৌমিনিকে বলল, ‘চল ঘরে যাই। প্যাক আপ করে রাখতে হবে । আজ রাতেই হয়ত এখান থেকে বেরিয়ে পড়তে হবে। হ্যাঁ, আজ রাতে আর ঘরে শোব না কিন্তু। বারান্দাতেই বসব।’
— ‘ কেন ? ঘরে কোন ডেঞ্জার আছে ?’ খুব স্বাভাবিকভাবে সৌমিনি জিজ্ঞেস করে।যেন আগে থেকেই জানা ছিল কথাটা ।
— ‘ কিছু জানি না। তবে সাবধানের মার নেই। তাছাড়া তোকে এখানে নিয়ে এসেছি।আমার একটা দায়িত্ব তো আছে...’
— ‘ কেন আমি কি ভয় পেয়েছি ? আমি কি একবারও কিছু বলেছি ?
আমি চাই মিস্ট্রিটা আনভেইলড হোক।’ সৌমিনি একটু যেন অভিমানী।
আর্সিয়ানা অবশ্য ড্যামেজ কন্ট্রোল করে নেয়— ‘ ও... কাম অন মাই চাম .... আমি কি একবারও সে কথা বলেছি ? আমি কি জানিনা তুই কি .... কাম অন।’ আর্সিয়ানা সৌমিনির অভিমান ভাঙাতে থাকে।
এইসময়ে দেখা গেল অমিতাংশু তার সান্ধ্যভ্রমণ সেরে গেট খুলে ভেতরে ঢুকছেন। অালো আরো ধূসর হয়ে গেছে এতক্ষণে। নীরব পরিবেশ।
খাবার টেবিলে
আর্সিয়ানাদের সঙ্গে অমিতাংশুবাবুও খেতে বসলেন।বজ্রও একপাশে এসে খেতে বসল। কমলা যথারীতি পরিবেশন করছে। টমি নাছোড়বান্দার মতো কমলার সঙ্গে লেগে আছে। এক মুহুর্ত কমলাকে কাছছাড়া করতে চাইছে না। আর্সিয়ানা খুব মন দিয়ে ঘরের সবাইকে লক্ষ্য করতে লাগল। মাঝে মাঝে একবার অমিতাংশুর দিকে, একবার বজ্রর সামনে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে । চোখে কেমন অদ্ভুত দৃষ্টি। ওদের যেন সামনাসামনি লড়াইয়ে আহ্বান জানাচ্ছে। কেমন যেন জিঘাংসাভরা চাউনি। আর্সিয়ানার দিকে মেলে ধরা সেই প্রার্থনার দৃষ্টি আদৌ নয়।

    পরিবেশন করা হয়েছে রুটি আর মুরগীর মাংস কষা।
আর্সিয়ানার খাওয়ায় মন নেই। সে একবার বজ্রের দিকে, একবার অমিতাংশুবাবুর দিকে গভীর মনোযোগে দেখতে লাগল। দেখল দুজন দুজনের দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। খাবার পড়ে আছে সামনে। কেউ ছুঁয়েও দেখছে না। দুজনের চোখের তারায় যেন আগুন ঝরছে। মনে হচ্ছে এক্ষুণি একজন আর একজনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। দুজনকেই সম্পূর্ণ অস্বাভাবিক লাগছে । কমলা এখানে নেই। বোধহয় রান্নাঘরে কিছু করছে । টমি হঠাৎ প্রচন্ড আওয়াজে ডাকতে আরম্ভ করল। তার শান্ত চোখ থেকেও যেন আগুন ছিটকোচ্ছে। সৌমিনি ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়ে আর্সিয়ানার হাতটা জড়িয়ে ধরল। আর্সিয়ানা কোনদিন এমন সমস্যার সম্মুখীন হয়নি। তার সব হিসেব গুলিয়ে যাচ্ছে । তবে সে একেবারে ভিন্ন উপাদানে গড়া বলেই মাথা ঠান্ডা রাখতে পারল। টেবিলের ওপরে রাখা মোবাইলে ঝট করে ও সি-র নম্বরটা ছুঁয়ে দিল। চারপাশে এখন ছেয়ে আছে আমাবস্যার নিকষ কালো আঁধার। মুহুর্তের মধ্যে ছাতিমতলার সব আলো ঝপ করে নিভে গেল। কেন কে জানে !
টমি উন্মত্তের মতো চেঁচাতে লাগল। একটা ছায়া অমিতাংশুর টেবিল থেকে উঠে এসে
আর্সিয়ানাকে জড়িয়ে ধরল। তীব্র আতরের গন্ধে ভরে গেল জায়গাটা । রিভলবারটা আর্সিয়ানার পকেটের মধ্যেই ঘুমিয়ে আছে ।

দুমিনিটের মধ্যে অন্ধকার ভাঙা হেডলাইটের আলো জ্বলা পুলিশের জিপ এসে দাঁড়াল ছাতিমতলার ভাঙাচোরা লোহার গেটের সামনে।

থানার ও সি সুদীপ্ত সেন প্রবাসী বাঙালী। জোরালো টর্চ জ্বেলে পাঁচজন কনস্টেবলসহ ছাতিমতলা বাংলোর রান্নাঘর থেকে অার্সিয়ানা আর সৌমিনির অচেতন দেহ যখন উদ্ধার করলেন ঘড়িতে তখন সাড়ে নটা বাজে। রাস্তার ল্যাম্পপোস্টে দু একটা নিভন্ত অাঁচের আলো জ্বলছে। ছড়ানো খামারে থেকে থেকে দমকা হাওয়া বইছে গাছগুলোর ডালপালার মধ্যে দিয়ে।
********* ******* *********

    
আর্সিয়ানার যখন ঘুম ভাঙল, পুলিশ গেস্টহাউসের দোতলার ঘরের জানলা দিয়ে ঢুকে আসছে আসছে বসন্তের হাওয়া মাখানো রোদ্দুর। এক ডাক্তারবাবু আর্সিয়ানার বিছানার পাশে বসে তার হাতে ব্লাডপ্রেসার মেশিনের প্যাড বাঁধছেন। সৌমিনির এখনও ঘুম ভাঙেনি।
সুদীপ্ত সেনের বছর বত্রিশ বয়েস। সুঠাম দীর্ঘ শরীর। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বলল, ‘ হাই, গুড মর্নিং ম্যাডাম।’
আর্সিয়ানা ধড়মড় করে উঠে বসে ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া দৃষ্টিতে সুদীপ্তর দিকে তাকিয়ে থাকে, যার মানে হল— এটা কি হল !! তারপর রিভলবারের খোঁজে পকেটে হাত দেয় অভ্যাসবশত: । সুদীপ্ত উত্তমকুমারি স্টাইলে হেসে বলে, ‘ ওটা আপাতত: আমার জিম্মায় আছে।একটু পরেই ফেরত পাবেন। আর এই নিন আপনার মোবাইল। আর এটা বোধহয় ওই ম্যাডামের।
সৌমিনির এতক্ষণে ঘোর কেটেছে। পিটপিট করে হতভম্বের মতো তাকিয়ে আছে তার পরম ভরসা
আর্সিয়ানার দিকে। ডাক্তারবাবু তার যন্ত্রপাতি গোটাতে গোটাতে বললেন বি পি বিলকুল নর্মাল, একশো চল্লিশ বাই আশি। কোন মেডিসিন প্রেসক্রাইব করলাম না।বলে, তিনি সৌমিনির বিছানার দিকে এগোলেন।
     

    প্রায় ঘন্টা দুই বাদে সুদীপ্ত সেন বলল, ‘ শৌভিক আমার স্কুল লাইফের বন্ধু ছিল। খুব ক্লোজ। ও আমাকে ফোন করে আপনার এখানে আসার কথা বলেছিল।আপনার ফোন নাম্বারও আমাকে দিয়েছিল। কিন্তু আপনি যে ছাতিমতলা বাংলোয় উঠেছেন সেটা আমি একদমই জানতাম না। জানলে , আমি প্রথমেই আপনাকে অ্যালার্ট করতাম।’
— ‘কেন তার কারনটা কি ?’
— ‘ কারণ আপনি দেহধারি মানুষের সঙ্গে হয়ত টক্কর নিতে সক্ষম। অশরীরিদের সঙ্গে তো নয়......’
— ‘ তার মানে ? 
আর্সিয়ানার ভুরু কুঁচকে যায়। তারপর বলে ,’ হ্যাঁ, ওই টমি বলে কুকুরটা.....আই ওয়াজ হ্যাভিং আ স্ট্রঙ্গ হানচ অ্যাবাউট ইট...... বাট....
— ‘ না না বাট টাট কিছু নেই। ওখানে কারোরই শরীর নেই। অর্থাৎ বেশ কিছুকাল আগেই সকলে পরলোকগত।’
শুনে সৌমিনির চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়।সে একদৃষ্টে কোন কথা না বলে সুদীপ্তর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।
আর্সিয়ানার ভুরু আবার একবার কুঁচকে ওঠে।
— ‘ আমার কাছে ছাতিমতলার পুরো কেস হিস্ট্রি আছে।এটা আসলে দুই সেক্স ম্যানিয়াকের গল্প। দুজনেরই সেক্সুয়াল টার্গেট ছিল কমলা। অবশ্য কমলাও কিছু কম যায়না। সে দুজনেরই তৃপ্তি মিটিয়ে চলছিল। অমিতাংশুবাবুকে শরীর দিচ্ছিল টাকার ধান্দায় আর বজ্রের কাছে যেত নিজেরও ক্ষুধা মেটানোর জন্য। অমিতাংশুবাবু আর বজ্র। ভূত হয়েও এরা নারী শরীরের নেশা ছাড়তে পারেনি । অদ্ভুত ব্যাপার হল, যৌনতা মেটাবার জন্য এরা কমলার শরীরে ঢোকে।ইরোটিক অ্যাবারেশান যে কত রকমের হয় ! অশরীরিদেরও অতৃপ্ত কামনা বাসনা থাকে। তারই পরিণতি হল পরশু রাত্রে সৌমিনি ম্যাডামের ওপর অ্যাটাক। এই দুই করাতের মাঝে পড়ে বেচারা ঝগরুকে জান দিতে হল। কে বা কারা গলার নলি কেটে মার্ডার করে, তারপর বাগানের আমগাছের ডালে ঝুলিয়ে দিয়েছিল। কে মেরেছিল সেই ইনভেস্টিগেশান এখনও চলছে। আপনার ওই টমি কুকুরটা হল ঝগরু। এখনও কমলাকে আগলে চলেছে দুই কামুকের গ্রাস থেকে। বেচারা কমলাকে প্রাণের চেয়েও বেশি ভাল বাসত। একফুল দো মালির গল্পে প্রায়ই এক মালিকে প্রাণ দিতে হয়। কম্পাউন্ডের মধ্যে একটা ছোট্ট ডোবা মত আছে, তার জলে মুখ থুবড়ে পড়ে ছিল বজ্র । অমিতাংশুবাবু স্লিপিং পিল খেয়ে আর কমলা অমিতাংশুর ঘরেই সিলিং ফ্যান থেকে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পৃথিবী থেকে নিজেদের সরিয়ে নিয়েছিল। কারণ, আমি যা বুঝেছি দুজনেই প্রচন্ড মেন্টাল স্ট্রেস অ্যান্ড গিল্ট কনসেন্সের শিকার হয়ে পড়েছিল।ওই যে কথায় বলে না পাপ বাপকেও ছাড়ে না। অবশ্য মৃত্যুর কারণগুলো আমার ব্যক্তিগত ধারণা এবং অনুমান। জুডিশিয়াল ইনভেস্টিগেশান ইজ স্টীল অন। ব্যাস ম্যাডাম, আমার কথাটি ফুরলো......এবার একটু ফ্রেশ হয়ে নিন।তারপর ব্রেকফাস্ট করবেন। এ দুদিন তো ভূতের হাতে দিব্যি খাওয়াদাওয়া করে এলেন।’
—-‘ আরে ... দাঁড়ান দাঁড়ান, কি সব বলছেন..... এই তো কাল দুপুরে দুজন মহিলা মাদুর বিক্রি করতে এসেছিল......’
— ‘ ইয়েস ইয়েস... বুঝতে পেরেছি.... ‘
আর্সিয়ানার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলে সুদীপ্ত , ‘ ওরা যে রক্তমাংসের মানুষ সে কথা কে বলল আপনাকে ?’
— ‘ তার মানে ! ! ‘
— ‘ মানেটা নিজেই বুঝে নিন ....’
অার্সিয়ানার ভুরু আবার কুঁচকে উঠল। সৌমিনি হাঁ করে তাকিয়ে রইল। দুজনেরই শিরদাঁড়া বেয়ে কোন হিমশীতল সরীসৃপ সিরসির করে নামতে লাগল পরশু রাতের কথা মনে করে। কপালে ঘাম দেখা দিল দুজনেরই।
সুদীপ্ত একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘ না:, আপনারা রেস্ট করুন। আধঘন্টা পরে ব্রেকফাস্ট লাগাচ্ছি। আর হ্যাঁ , আপনাদের ট্রেন পাঁচটা তেত্রিশে।আমি গিয়ে আপনাদের ট্রেনে তুলে দিয়ে আসব।ঘরের মেয়ে ঘরে ফিরে যান বাবা । আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচি। আর হ্যাঁ, আপনারা নিশ্চই ভাবছেন, আমি ছাতিমতলার এত কিস্যা জানলাম কি করে । এসব কথা তো পুলিশ ফাইলের কেস হিস্ট্রিতে থাকার কথা নয়।’
আর্সিয়ানার কানে কিছুই ঢুকছিল না। মাথায় নানা চিন্তা ভোঁ ভোঁ করছে। সৌমিনি পাশ বালিশ আঁকড়ে আবার শরীর ফেলে দিয়েছে বিছানায়। আর্সিয়ানা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে সুদীপ্তর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।
সুদীপ্ত উত্তমকুমারি হাসি হেসে আবার বলে, ‘ সেকথা এখন থাক ম্যাডাম। ক্রমশ: প্রকাশ্য ... ‘

পরদিন ভোরে বাড়ি পৌঁছল অার্সিয়ানারা। সকাল এগারোটা নাগাদ শৌভিক চ্যাটার্জীকে একটা কল দিল। শৌভিককে একবার ডায়ালেই পাওয়া গেল। হাই হ্যালোর পর শিমূলতলা বৃত্তান্ত আগাগোড়া বর্ণনা করে। অবিশ্বাস্য ব্যাপারটা পুরোটা রুদ্ধশ্বাসে শোনার পর বলে ওঠে, ‘ দাঁড়াও দাঁড়াও ....কি বললে ? অামার বন্ধু পুলিশ অফিসার সুদীপ্ত সেন ! ‘
— ‘হ্যাঁ হ্যাঁ সুদীপ্ত সেন... রিয়েলি এ গ্রেট গায় । হি ওয়াজ, ইন ফ্যাক্ট, আওয়ার সেভিয়ার দেয়ার । ও না থাকলে উই উড হ্যাভ বিন...... ‘ অার্সিয়ানা মুখর হয়।
— ‘ আরে দু..ৎ , কি সব গাঁজাখুরি গল্প শোনাচ্ছ ! সুদীপ্ত তো এক্সপায়ার করে গেছে মাস ছয়েক আগে কোন এক টেররিস্ট এনকাউন্টারে ওখানে কাছাকাছি কোন এলাকায় ..... ‘
— ‘ সেকি ! ....’ অার্সিয়ানা আকাশ থেকে পড়ে । ‘ ও তো বলল, তুমি ওকে কল করে আমাদের টেক কেয়ার করার কথা বলেছিলে..... আর ওর মোবাইল নাম্বারটা তো তুমিই আমাকে পাঠিয়েছিলে ......’
— ‘তাই নাকি ?’ শৌভিক সরস হয়। ‘ অার্সিয়ানা, এর থেকে প্রমাণ হল ভূতেরাও শিভালরাস হয় .... হা: হা: হা: .... আমি সুদীপ্তর মোবাইল নাম্বার কোথায় পাব ! পাগল নাকি ! আর অমিতাংশুবাবুই তো আমাকে মোবাইলে মেসেজ পাঠিয়েছিলেন একজন প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর অ্যারেঞ্জ করার জন্য। ওহ্ মাই গুডনেস.....কিছু ভূতের , তার মানে , স্বভাব যায় না ম’লেও.....’

ফোন নামিয়ে রেখে
আর্সিয়ানা সিদ্ধান্ত নিল ছাতিমতলায় তাকে আর একবার যেতেই হবে । টমি কাম ঝগরুর প্রতি নিশ্চিতভাবেই তার একটা কর্ত্তব্য রয়ে গেছে।

( সমাপ্ত )

 Anjan Banerjee