সামাজিক গল্প লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
সামাজিক গল্প লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

পিছুটান - বনবীথি পাত্র

 পিছুটান

বনবীথি পাত্র 
 

 
 

-তা ঠিকমত বাজাতে পারবে তো বাপু! ঢাকের বোল ছাড়া পুজোর পরিবেশ সম্পূর্ণ মাটি। আমাদের তো পাঁচ পুরুষের পুজো। আমার ঠাকুর্দার আমলেও দুর্গাপুজোতে ঢোল বাজত। ঢোল আর কাঁসি। ঢাকে কাঠি পড়ত তো চৈত্রমাসে গাজনের সময়।আমাদের গ্রামের গাজন যদি কোনদিনও দেখো তো বুঝবে, সে দুর্গাপুজোকেও হার মানায়।

-দুর্গাপুজো থেকে গাজনে পৌঁছে গেছো? বলি ছেলেটা সবে তো বাড়িতে এসেছে, এখন তো কটাদিন থাকছে এখানেই। তখন না হয় তোমার এইসব গালগপ্পো শুনিও ওকে। একবার চেয়ে দেখো দেখি, মুখখানা কেমন শুকিয়ে গেছে বাছার। কখন বাড়ি থেকে বেরিয়েছে কে জানে! পথে কিছু পেটে পড়েছে বলেও তো মনে হচ্ছে না।

দেবতোষবাবু আরও কিছু কথা বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু গিন্নির কথায় থামতেই হল তাঁকে। বিনু দালানের একপাশে তার ঢাকখানাকে একহাতে আঁকড়ে জড়োসড়ো হয়ে বসেছিল। বাপ মারা যাওয়ার পর বছর বারো-তেরো হল সে দুর্গাপুজোতে ঢাক বাজাতে শহরে আসছে। কিন্তু সে তো কোন ক্লাবের বারোয়ারি পুজোতে ঢাক বাজিয়েছে এতকাল। এই প্রথমবার কোন বনেদি বাড়ির পুজোতে ঢাক বাজাতে এসেছে। ক্লাবের বাবুরা দামদর করে একেবারে সঙ্গে করে ক্লাবে নিয়ে যাবে এই আশাতেই প্রতিবারের মত স্টেশনে বসে ঢাক বাজাচ্ছিল বিনু।  এঁদের বাঁধাধরা ঢাকি শেষমুহূর্তে আসতে পারবে না খবর দেওয়ায় বুড়ো ম্যানেজারের দায়িত্ব পড়েছিল বিকল্প ঢাকি ধরে আনার।স্টেশনে অতজন থাকতে বুড়ো ম্যানেজারের কেন যে তাকেই মনে ধরল তা শুধু মা দুর্গাই জানেন! বিনুর বুকের মধ্যে যেন গঙ্গাফড়িং ফড়ফড় করছে সবসময়। মানে মানে পুজোর দিনগুলো উতরে দিতে পারলে বাঁচে। গিন্নিমার কথা শুনে একটু যেন মনে ভরসা পাচ্ছিল, সত্যিই তার বড্ড খিদে পেয়েছে। আসার সময় চানুপিসি খানিক মুড়ি বাতাসা সঙ্গে দিয়েছিল বটে, কিন্তু সে আর খাবার অবকাশ হয়নি।

-ও মাখন, মাখন....
ছেলেটা কখন থেকে এখানে বসে আছে, ওকে ওর থাকবার ঘরখানা একটু দেখিয়ে দে না বাপু। যেদিকে খেয়াল রাখব না, সেদিকেই কোন কাজ হবে না। সবগুলো হয়েছে ফাঁকিবাজের শিরোমণি।

গিন্নিমার কথা শেষ হওয়ার আগেই হাঁটুর ওপর আধময়লা ধুতি পরা একজন মাঝবয়সী লোক হাজির হয় সামনে।

-মাখন মোটেই ফাঁকিবাজ নয় গিন্নিমা। মেজদাবাবু বাগান পরিষ্কার করার জন্য কাদের ধরে এনেছে জানি না বাপু, দশ মিনিট কাজ করে তো আধঘন্টা বসে জিরোচ্ছে আর বিড়ি খাচ্ছে।

ভবতোষবাবু চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়েন। 

-গিন্নিমা যা বলছে তুই সেটা কর, আমি বাগানে গিয়ে দেখছি। মেজো খোকা আর কবে যে মানুষ চিনতে শিখবে!

-চল তোমাকে ঘরখানা দেখিয়ে দিয়ে আমাকে একবার ছোড়দিমণির সঙ্গে দেখা করতে হবে।

ঢাক আর নিজের পোঁটলাটাকে সঙ্গে নিয়ে মাখনের পিছু পিছু সবে দুপা হেঁটেছে বিনু, তখনই পিছন থেকে গিন্নিমার গলা,

-ঢাকখানাকে সঙ্গে নিয়ে কোথায় চললে! ঢাক এই দালানেই থাক। আমি কাউকে দিয়ে চণ্ডীমণ্ডপে পাঠিয়ে দেব। তুমি চানটা সেরে এখানে চলে এসো। আমি তোমাকে জলখাবার দিতে বলছি। এই দেখো এত কথা বলছি, তোমার নামটাই তো জানা হয়নি এখনও। বলি তোমার নাম কী বাছা?

ঢাকখানাকে কাঁধ থেকে নামিয়ে রেখে বিনু প্রায় হাতজোড় করে বলে,

-আজ্ঞে বৃন্দাবন। সবাই আমাকে বিনু ডাকে।

-অত বড়সড় নামের থেকে বিনুই ভালো। আমিও তোমাকে বিনু বলেই ডাকব। যাও চটপট চান সেরে চলে এসো। জলখাবার খেয়ে নিয়ে তোমার গল্প শুনব।

বিনু সম্মতির ভঙ্গিতে ঘাড় নাড়ে। গিন্নিমা মানুষটাকে তার বড্ড ভালো লেগেছে। বেশ একটা মা মা ভাব আছে মানুষটার মধ্যে। কিন্তু গিন্নিমা যে ওর গল্প শুনবেন বললেন, কী গল্প বলবে বিনু! ওর নিজের আর কী গল্প আছে! আবার তখনই হঠাৎ তার উল্টো কথা মনে হয়। তার পুরো জীবনটাই তো গল্পের মত। জন্মে থেকে কোনদিনও তো নিজের মাকেই দেখেনি বিনু। চানুপিসির কোলে পিঠেই বড় হয়েছে ছোট থেকে। গাঁয়ের শেষ প্রান্তে একেবারে নদীর ধারে তাদের বায়েন পাড়া। অতবড় গ্রামে তারা মাত্র চার-পাঁচঘর বায়েন। জমিজমা বলতে কিছুই তাদের ছিল না। কচ্চিৎ কখনও বাবুদের জমিতে কাজের সুযোগ পেত। বিনু ছোটবেলায় কতদিন বাপ খুড়োদের ভাগার থেকে মরা পশুর চামড়া ছাড়িয়ে আনতে দেখেছে। নদীর জলে সে সব চামড়া ধুয়ে শুকিয়ে গঞ্জে মহাজনের কাছে বিক্রি করে যা পয়সা পেত, তাই দিয়ে কোনরকমে একবেলা একমুঠো নুন ভাত জুটত। বাবা তো ঢাকের চামড়াও সারা বছর ধরে নিজেই তৈরি করত। সারা বছরের মূল রোজগারটা হত দুর্গাপুজোর সময় শহরে ঢাক বাজাতে এসে। বাবার ঢাকের আওয়াজ শুনেই নাকি শহরের বড় বনেদি বাড়িতে বাবাকে একবারে বাঁধা ঢাকি করে নিয়েছিল। বিনুর এখন আফশোস হয় বাপের সঙ্গে শহরে এসে যদি সেই বনেদি বাড়িখানা চিনে রাখত,  তাহলে তাকে আর প্রতিবছর ঢাকের বায়নার জন্য হাপিত্তেশ করে ইস্টিশানে বসে থাকতে হত না। কিন্তু বিনুর বাজানো কি আর পছন্দ হত তাঁদের? বাবা সারা বছর কত যত্ন করে ঢাক ছাইত। আর এখন তো ঢাকে চামড়ার ব্যবহারই নেই, সব ফাইবার হয়ে গেছে। চামড়ার আওয়াজ আর ফাইবারের আওয়াজে আকাশ পাতাল তফাত। বিনুর কানেও সে তরিতফাৎ ভীষণ ধরা পড়ে।

-এ দেখো,  এই ঘরেই এ কদিন থাকবে তুমি। 

তারপর লম্বা ছাউনির শেষ প্রান্তে আঙুল তুলে মাখন বলে,

-ওইটা হল গিয়ে চানঘর। যাও জিনিসপত্র রেখে, চানটা সেরে নাও তো বাপু। আর ঘর থেকে যাওয়ার সময় ঘরে তালা দিয়ে যাবে। পঞ্চাশ লোকের আনাগোনা এখন বাড়িতে। কিছু হারিয়েছে, চুরি গেছে বললে কর্তামশাই কিন্তু খুব রাগ করবেন। যত্ন করে রাখো এই তালা চাবি। বাড়ি ফিরে যাওয়ার আগে মনে করে আমার হাতেই দিয়ে যাবে।

তালা চাবিটা বিনুর হাতে দিয়ে মাখন চলে গেল। বিনু আনমনে চারপাশটা দেখতে লাগল।

একটা বড় লোহার গেট আর তারপরেই বাগানের মধ্যে দিয়ে লাল মোরামের পথ। মোরামের পথ দিয়ে মোটরগাড়িও ঢুকে যায় সহজেই। মোটরগাড়ি রাখার বিশাল জায়গার পাশ দিয়ে বাড়িতে ঢোকার রাস্তা। বাড়ি তো নয় তিনতলা বিশাল প্রাসাদ! ঢুকেই বিশাল ফাঁকা উঠানের একধারে চণ্ডীমণ্ডপ। অন্য তিনধারে চওড়া বারান্দার কোলে সার সার বন্ধ ঘর। ওপর তলায় তাকালে বারান্দার কাঠের কারুকাজ করা রেলিং ছাড়া কিছুই চোখে পড়ে না। ফাঁকা উঠোন অনেক ওপরে সেই তিনতলা ছাদের সঙ্গে লোহার তারজালি দিয়ে ঘেরা। রোদ, হাওয়া আসার সুন্দর ব্যবস্থা; অথচ কাকপক্ষীটি ঢুকতে পারবে না। দরদালানের কোন এক ফাঁক দিয়েই মাখন যেন নিয়ে আসে বিনুকে। এটা বাড়ির পিছন দিক। এখানেও বিশাল বাগান। বাগানের পাঁচিলের কাছ ঘেঁষে টিনের ছাউনি দেওয়া পর পর তা প্রায় খান দশের ঘর। এর একটা ঘরেই বিনুর থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। কাছেই কলঘর। দু-চারজন অশপাশের ঘরগুলোয় ঢোকা বেরনো করছে। বিনু তাদের দেখলেও তাদের যেন বিনুকে দেখার বা দুদণ্ড দাঁড়িয়ে বিনুর সঙ্গে কথা বলার অবসর নেই। আড়চোখে বিনুকে একবার জরিপ করেই যে যার কাজে চলে যাচ্ছে। এখানে মনে হয় বাড়ির চাকর বাকর, কাজের লোকজনরা থাকে। বিনু ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে হাঁ করে চারপাশের সবকিছু দেখছিল। দোতলা তিনতলার ঘরের জানলাগুলো খোলা। কিন্তু কোন মানুষ চোখে পড়ে না। 

-এ কী তুমি এখনও নাইতেই যাওনি! ওদিকে তোমার দেরি দেখে গিন্নিমা আমাকে ডাকতে পাঠালেন। যাও যাও আর দাঁড়িয়ে থেকোনি তো, চান সেরে দুটো খেয়ে নেবে চলো দেখি।

চলে যেতে গিয়েও থমকে দাঁড়াল মাঝবয়সী মহিলাটি।

-এ বাড়ির হিরে থেকে জিরে সব আমাকেই সামলাতে হয়। এমন লাজুক, মুখচোরা হয়ে থাকলে পুজোবাড়িতে এত লোকের মাঝে দুবেলা খেতেও পাবে না। তাই খাওয়ার সময় সুযোগ বুঝে খেতে বসে যেও। আর যদি কোন দরকার পড়ে তো কাউকে দিয়ে এই সরলাদিদিকে একটা খবর পাঠিও। 

আঁচলের খুঁটে চোখ মুছে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সরলা বলে,

-দেশে তোমার মতই আমার একটা ভাই আছে। তোমার মুখটা দেখেই তার মুখটা মনে পড়ে গেল। কতবছর তাকে দেখিনি।

আর কোন কথা না বলে সরলা চলে যায়। বিনু মাখনের দেখিয়ে দেওয়া ঘরের দরজার শিকল খুলে ভেতরে ঢোকে। একখানা ছোট চৌকিতে পরিষ্কার চাদর পাতা। একটা বালিশ আর মশারি রাখা বিছানাতে। পাশে একটা টুলের ওপর জলের কুঁজো রাখা। কুঁজোর মুখে একটা স্টিলের গ্লাস উপুড় করা। বিনু পোঁটলা থেকে নিজের গামছাটা বের করে। কাশির সিরাপের পুরনো শিশি করে আনা নারকেল তেল এক খাবলা নিয়ে মাথায় ডলতে ডলতে কলঘরের দিকে চলেই যাচ্ছিল। মাখনের কথা মনে পড়তেই ফিরে এসে তালা দেয় ঘরে। পোঁটলায় দুটো পুরনো জামাপ্যান্ট আর চানুপিসির দেওয়া পঞ্চাশ টাকার নোটটা ছাড়া কিছুই নেই তার কাছে। কী আর চুরি যাবে তার! তবু বড়লোকের বাড়ির নিয়ম অগ্রাহ্য করতে সাহস হয় না বিনুর। তালা দিয়ে ছোট চাবিটা হাতে করে কলঘরের দিকে চলে যায়। জীবনে এই প্রথমবার কল ঘুরিয়ে পাইপ লাইনের জলে চান করে সে। চান সেরে একা একা ওই বাড়িতে যেতে কেমন যেন ভয় ভয় করছিল বিনুর। অচেনা কারও মুখোমুখি হলে কী পরিচয় দেবে! গিন্নিমা না থাকলে কার কাছেই বা খাবার চাইবে! এত বড় হল এখনও কোনদিনও কারও কাছে খাবার চেয়ে খেতে শেখেনি বিনু। এখানে তো সবাই তার অচেনা। ভাবতে ভাবতে উঠোনে এসে পৌঁছাতেই গিন্নিমার গলা,

-আমার কী আর কাজ নেই বাছা, সেই কোন কাল থেকে তোমার খাবার আগলে বসে আছি। নাও চটপট এসে খেয়ে নাও দেখি। 

চাওড়া বারান্দায় শালপাতায় খান দশেক লুচি, ডাল আর খানিকটা বোঁদে। ভীষণ খিদে পেয়ে গিয়েছিল বিনুর। আর তাছাড়া লুচি সে বড্ড ভালোবাসে। বিলম্ব না করে প্রায় গোগ্রাসে খেতে শুরু করে বিনু। ওর খাওয়ার ভঙ্গিমা দেখেই বোধহয় গিন্নিমা হাঁক দেন,

-আর কটা লুচি দিয়ে যা তো টেঁপি।

একটা মেয়ে এসে আরও পাঁচ'ছখানা লুচি দিয়ে যায় বিনুর পাতে। কিছুটা খাওয়া হলে গিন্নিমা শুধান,

-বাড়িতে তোমার কে কে আছে?

একটা লুচি মুখে ভরে ঘাড় নাড়ে বিনু।

গিন্নিমা অবাক গলায় বলেন,

-বাপ মা?

মাটির ভাঁড়ের সব জলটুকু একঢোকে খেয়ে নিয়ে বিনু বলে,

-কেউ নেই। মাকে কোনদিন চোখেও দেখিনি। বাপ কখনও মায়ের কথা বলেনি।  গাঁয়ের লোকে অবশ্যি অন্য কথা বলে, শহর থেকে বাপ নাকি আমাকে কুড়িয়ে নিয়ে গিয়ে চানুপিসির কোলে দিয়েছিল। চানুপিসিই আমাকে বড় করেছে।

-তোমার বাপের নাম কী?

হঠাৎ যেন গম্ভীর শোনায় গিন্নিমার গলাটা।

বিনু গলা নামিয়ে জবাব দেয়,

-জগন্নাথ বায়েন।

চমকে ওঠেন গিন্নিমা। কিছু যেন বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু তার আগেই মাখন ছুটে এসে বলে,

-বড়দিমণি কী করে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েছেন জানি না। সিঁড়ি দিয়ে নেমে নীচে চলে এসেছেন।

গোটা বাড়ি হুলুস্থূল, সবাই আতঙ্কিত। আলুথালু বেশে এক মহিলা প্রায় ছুটে দোতলা থেকে নেমে উঠোন পেরিয়ে সোজা গাড়ি বারান্দার দিকে চলে যায়।

-বাড়িতে এত লোক আর আমার খোকার শুধু জায়গা নেই! জগুঢাকি সেই যে ছেলেটাকে নিয়ে গেল....

শেষ কথাগুলো পরিষ্কার শুনতে পায় না বিনু। জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে বারান্দার এক কোণে। গিন্নিমা অনেক বুঝিয়ে মেয়েকে নিয়ে ওপরতলায় উঠে যান। সেবার পুজোয় মিত্তির বাড়িতে বিনু ঢাক বাজিয়েছিল বটে, কিন্তু গিন্নিমা আর কোনদিন কথা বলেননি বিনুর সঙ্গে....

.......................................



বডি - অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়

বডি
অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়





ছড়ানো ঝিল ভর ভরন্ত । ওপারে ঝোপঝাড় জঙ্গল। এপারে কাঁচা রাস্তা আবলা খাবলা । শুক্লা রাতে চাঁদের আলো খেলা করে ঝিলের জলে।ওপারের জঙ্গল থেকে শেয়ালের দল ডাকতে শুরু করে আচমকা।এপারে শিবমন্দিরের বাইরে ল্যাম্পপোস্টের আলোর ছটা মাখা আঁধারে বসে রাত বারোটা অব্দি চার পাঁচজনে মিলে এন্তার মদ খায়। মদ গিলতে গিলতেই যে যার ঘর সংসারের জমিয়ে রাখা বিষ বাষ্প উগরে দেয়। নেশা চড়ে গেলে কেউ কাঁদে কেউ হাসে। সুহাস আর তারক অশ্রাব্য গালাগালি করতে থাকে। বোধহয় ভগবান বা ভাগ্যের উদ্দেশ্যে।
বাইপাস এখান থেকে মাত্র আড়াই কিলোমিটার ফারাকে। লোকাল পুলিশ ফাঁড়ি মুকুন্দপুরে। ওখান থেকে রাতের ঝিঁঝি ডাকা আঁধারে
মাঝে মাঝে কড় কড় কড় কড় করতে করতে পুলিশের জিপ এসে দাঁড়ায় জলার ধারে।
বাইপাসের দিকে মুখ করে পাশাপাশি তিনটে বিশাল বিল্ডিং উঠছে।জমির পিছন দিকে পলিথিন ঘেরা টিনের শেডের নীচে সিমেন্ট বালি স্টোন চিপসের অস্থায়ী স্টোর রুম। বৃষ্টি হলে ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ে টি নের চালে। রকমারি মাপের জি অাই স্টীলের পাঁজা পাঁজা রড এনে ফেলে রেখে গেছে সাপ্লায়াররা। পেঙ্গুইন বিল্ডার তিন তিনটে কন্স্ট্রাকশানের কাজ চালাচ্ছে একসঙ্গে। এই সব জলা আগাছায় ভরা প্লটে ফ্ল্যাটগুলো জলের দরে ছাড়া হবে ফিলহাল। সামনের দিকে একটু দোকান বাজার মল টল বসে গেলে ব্যস্ ..... দাম চলে যাবে ছাপোষা লোকের আওতার বাইরে।
শিখর পাঁজি যতটা সম্ভব ঘরের বাইরেই থাকে। গলা পর্যন্ত চুল্লু খেয়ে রাত দুটো নাগাদ ঘরে ঢোকে। সকালে যখনই ঘুম ভাঙে তখনই বেরিয়ে যায়। ঘরে থাকতে পারে না। তার পরিবার যন্ত্রণার লৌহকপাটের ভিতরে বাস করে।
বাবা রাজমিস্ত্রির কাজ করে এক ঠিকাদারের অধীনে। মা ক্যানসার রুগী। অন্তিম অবস্থা। যন্ত্রনায় দুমড়ে যেতে যেতে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছে প্রায় বিনা চিকিৎসায়। কিন্তু মরণ কি অত সহজে আসে ! একটা বিনাপয়সার হাসপাতালে ছিল কিছুদিন । কিন্তু সেখানে ছুটি করে দিল। বলল, ‘ এখানে আর রেখে কি করবেন..... এ পেশেন্টের তো আর কিছু হওয়ার নেই.... আর যে কটা দিন থাকে বাড়িতেই রাখুন.... কত পেশেন্ট লাইনে রয়েছে, মিছিমিছি একটা বেড আটকে রাখা .....।’
না: ... বেড আটকে রাখা গেল না।
একটা ভাই কেরালা না কর্নাটক কোথায় যেন চলে গেছে। আর একটা ভাই কেপমারি করতে গিয়ে ধরা পড়ে বেদম মার খেয়ে আপাতত: জেলে আছে। কতদিন থাকতে হবে কেউ জানে না। উকিল দেবার পয়সা নেই, লোকও নেই। কোর্টে কেস ওঠেনা। ওটা নিয়ে চিন্তাভাবনা করার কেউ নেই।
শিখর একটা কাপড়ের দোকানে কাজ করে। বাজার খারাপ । বছরে দশ মাস ফাঁকা যায়। খদ্দের নেই। তিনমাস পরে পরে মাইনে পায়। চুল্লুর টাকা তারকরা জোগায়। তারক আর সুহাস মিনি বাসের কন্ডাক্টর। চুল্লুর সঙ্গে মাঝে মাঝে পিঁয়াজি কিংবা চর্বির বড়াও হয়। তারকের দিল আছে বলতে হবে। জমানো পয়সা খরচ করছে তাতে সন্দেহ নেই। কারণ মাস দুই হল মিনি বাস বসে আছে। তেলের যা দাম মালিকের পোষাচ্ছে না। বাস বার করছে না। সুতরাং সুহাস বা তারক কারোরই আমদানি নেই। তবু শিখরকে , দিশি হলেও মাল তো খাওয়াচ্ছে।দিল আছে বলতে হবে।
শিখরের মাঝে মাঝে মনে হয়
মা- টাকে যদি একটু করে খাওয়ানো যেত বোধহয় যন্তন্নাটা একটু চাপা পড়ত। কি জানি কতদিনে এ কষ্টের তারকাঁটা থেকে ছাড়ান পাবে বেচারি মা-টা। ‘মরে গেলে’ আর কোন কষ্ট নেই বোধহয়।
অন্ধকার বেশ ঝামরে ধরেছে। ওদিকের ল্যাম্পপোস্টে আলো বিগড়ে গেছে। কবে মেরামত হবে কে জানে । জলার ওপাশে ঝুঁঝকো ঝোপের আড়াল থেকে হঠাৎ একপাল শেয়াল উঁচু পর্দার কোরাসে নিজেদের উপস্থিতি জানান দিতে লাগল। একটা জিপ কড় কড় কড় কড় করে ওই কাঁচা রাস্তার একপাশে এসে দাঁড়াল। একজন জিপে বসে বসেই টর্চ ফেলল জি আই স্টীলের পাঁজার ওপর । পরষ্পরে জড়িত আবদ্ধ শীতঘুমে আচ্ছন্ন সরীসৃপপুঞ্জের মতো পড়ে থাকা ‘বিল্ডিং মেটিরিয়াল’-এর শরীর ঝিকমিক করতে লাগল।
একটা গলা শোনা গেল জিপের মধ্য থেকে- ‘ একটা কথা মনে রেখ বিপ্লব ....কেস দিতে না পারলে এখানে পোস্টিং ধরে রাখা মুশ্কিল হয়ে যাবে। চাপ শুধু ডিপার্টমেন্টের নয়, পেঙ্গুইন কোম্পানিরও আছে। তাদেরও তো খসছে নাকি ?’
বিপ্লববাবু বললেন, ‘ সে তো বটেই
..... ‘

শিখরের বাবা কার্ত্তিক কাল কাজ করতে করতে ভারা থেকে পড়ে গিয়ে পায়ে চোট খেয়েছে। কপাল ভাল তেমন গুরুতর চোট লাগেনি। বাড়ির মালিক সজ্জন ব্যক্তি । তিনিই সঙ্গে সঙ্গে যথাযথ চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। না, ভাঙেনি। তবে ভালোরকম মচকেছে হাঁটু আর পায়ের গোছ। ঠিকে দার নিজে এসে পৌঁছে দিয়ে গেল কার্ত্তিককে। এসব সমস্যা তেমন হয়নি। তবে মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হল যে, মাস দুই বসে থাকতে হবে এখন । পায়ের চোট না সারলে কাজে যাওয়া মুশ্কিল।
যাও বা গাড়ি চলছিল টাল খেতে খেতে, গাড্ডায় পড়ে থেমে গেল হ্যাঁচকা টানে।

সকাল দশটার সময় বাস রাস্তার মুখে তারকের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল শিখরের।তারক বলল, ‘রাতে আসিস কিন্তু । আজ দারুন চাট আনাব। বহুৎ মজা পাবি। তাছাড়া কিছু প্ল্যান প্রোগ্রামের কথাও আছে। আসিস কিন্তু। ‘
— ‘ কিরকম প্ল্যান ? ‘
— ‘ আয় না .... বলব অখন .... ‘

পেঙ্গুইন কন্স্ট্রাকশানের বোর্ড মিটিং চলছে । ডালহৌসি, নেতাজি সুভাষ রোডে সেঞ্চুরি প্লাজার আটতলায়।
পীযূষ কেডিয়া সাহেব বললেন, ‘ লাইসেন্স তো আমরা পেয়ে গেছি। সো উই শুড গেট দি ওয়ার্ক আন্ডার ওয়ে ইমিডিয়েটলি। মেটিরিয়াল পড়ে আছে আনগার্ডেড অবস্থায়। লোক্যাল পুলিশ স্টেশনে অবশ্য ইনফর্ম করা আছে। ফ্র্যাঙ্কলি স্পিকিং , আনঅফিসিয়ালি পে-ও করতে হচ্ছে টু টেক কেয়ার অফ।
স্টি ল উই শুড নট মেক এনি ফারদার ডিলে।নন পারফর্মিং অ্যাসেট মিনিমাইজ করতে হবে আমাদের। আদারওয়াইজ ইট ইজ ডিফিকাল্ট টু সারভাইভ। কম্পিটিশান ইজ সো স্কেদিং।’

মিটিং-এর পর কফি সেশান হল। স্ন্যাক্সের ভূরিভোজ আয়োজন। প্রদীপ্ত মিত্র সিভিল ইঞ্জীনিয়ার। তাকেও ডাকা হয়েছিল। কন্স্ট্রাকশানের ব্লু প্রিন্ট তার তৈরি। কোম্পানির দুই বড় কর্ত্তা আর একবার করে চোখ বুলিয়ে নিলেন। এই সাইটে মোট
পনের কোটি টাকার টার্ন ওভার। রাফ অ্যাসেমেন্ট অনুযায়ী আট কোটি টাকা প্রফিট আসা উচিৎ। ইনপুট মোটেই নন পারফর্মিং লে অফ- এ রাখা উচিৎ নয় , পীযূষ কেডিয়া এ কথা বারবার স্মরণ করান তার এক্সিকিউটিভদের। কেডিয়ার মূল ব্যবসা অবশ্য আয়রণ অ্যান্ড স্টীলের। বিল্ডিং ডেভেলপমেন্টে নেমেছেন অতি সম্প্রতি। অতটা মেটিরিয়াল পড়ে আছে সাইটে। যদিও স্থানীয় থানায় জানানো আছে, তবু চিন্তা একটা আছেই। পীযুষ কেডিয়াকে একেবারেই হৃদয়হীন ব্যবসায়ীর স্তরে ফেলা যায় না। গরীব মানুষের জন্য তিনি অনেক করেন। কারো দুর্দশার খবর পেলে নিজেই পৌঁছে যান সেখানে এবং তাদের সমস্যার মোকাবিলা করার জন্য উদ্যোগী হন। ওই বাইপাসের লাগোয়া সাইট ঘেঁসা এলাকাতেও, তিনি খবর পেয়েছেন দুরবস্থার যাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছে বেশ ক ঘর মানুষ। তার মধ্যে একজনের অবস্থা খুব ঘোরাল। পীযুষ কেডিয়া ঠি ক করেছেন পরশুদিন তিনি ওই এলাকায় যাবেন।

তারকের কোথা থেকে কিছু আমদানি হয়েছে। আজ রাতে চিলি চিকেন আনিয়েছে। বাংলার সঙ্গে জমবে ভাল। দু চার ঢোক মারবার পর ‘স্কিম’ টা বলে শিখরকে। নেশা চড়ার আগেই কথাবার্তা বলে নেওয়া ভাল। নক্শাটা অবশ্য সুহাসের।
সে বলে, ‘ এখানে দশ লাখ টাকার রড পড়ে আছে। চারটে সরে গেলে কোন শালা হিসেব পাবে না। খুব কমসম করে চারটে বেচতে পারলেও কমসে কম দু হাজার টাকা আসবে। মুকুন্দপুরে পার্টি আছে। মাল আমাদের ক্যারি করতে হবে । ওখানে তারিখ আলির লোক থাকবে, নামিয়ে নেবে। এটার সাকসেস হলে পরের বারের প্ল্যান ছকা যাবে। ‘
শিখর আর এক ঢোক মারে । জুলজুল করে সুহাসের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। চিলি চিকেনের টুকরো মুখে পুরে চিবোতে থাকে। টক ঝাল সস মেশানো নরম মাংসের স্বাদে গন্ধে মৌজে চোখ বুজে আসে শিখরের।
তার আচমকা মনে পড়ে যায় চাপচাপ যন্ত্রণার তলায় অসহায়ভাবে পড়ে থাকা তার মায়ের কথা।চোখ বুজে প্রবলভাবে চিলি চিকেন চিবোতে থাকে শিখর। আর এক ঢোক বাংলা মারে । জঙ্গলের ওদিক থেকে জমাট আঁধার ফালা ফালা করে একটা পেঁচা ডেকে উঠল হঠাৎ।
তারক বলল, ‘ আজ আর টানিস না শিখর। ধুমকি এসে গেলে কাজটা করতে পারবি না। একটা ঠেলাগাড়ি রেডি আছে। মাল তুলে বেরিয়ে পড়তে হবে। দুজন যাবে তোর সঙ্গে । তারাই ঠেলায় রড তুলে নেবে । তুই শুধু ওদের সঙ্গে যাবি। তারিখ আলি স্পটে থাকবে। মাল নামিয়ে নিয়ে পেমেন্ট দিয়ে দেবে তোর হাতে। এই খেপের পুরোটাই তোর । আমাদের কিছু দিতে হবে না। আমরা বুঝি .....
ওই যে দুজন .... ওখানে বসে আছে .... টাকা পাবার পর শুধু দুশো টাকা ওদের হাতে দিয়ে দিস।’
শিখরের কিছু বলার ছিল না। কি বলা উচিৎ তার মাথায় আসছিল না। সে মুখ ঘুরিয়ে দেখল ওদিকে অন্ধকারে একটা ভাঙা সিমেন্টের বেঞ্চে দুজন মানুষ বসে আছে। এখান থেকে যেটুকু ঠাওর করা যাচ্ছে .... দুটো সতের আঠেরো বছরের ছেলে। আগুনের দুটো ফুলকি দেখা যাচ্ছে। বিড়ি টানছে বোধহয়।

ঠেলায় চারটে টাটার জি আই রড তুলে ঝোপঝাড়ের মধ্যে কাঁচা রাস্তা ঠেলে বড় রাস্তায় এসে উঠল।ছেলে দুটোই ঠেলা টানতে লাগল। রাস্তাঘাট ল্যাম্পপোস্টের ঝলমলে আলো মেখে ঘুমোচ্ছে। চারপাশ শুনশান । হুস হাস করে মাঝে মাঝে দু একটা গাড়ি ছুটে যাচ্ছে বাইপাস ধরে। রাত প্রায় দেড়টা বাজে।

ছেলে দুটোর নাম হিল্টন আর পদা । পদা বলল, ‘ ওই সামনের গলতায় তো ? ‘
— ‘ কি জানি ঠিক বুঝতে পারছি না .... দাঁড়া তারিখকে ফোন করছি ..... ‘ , শিখর মোবাইলের কন্ট্যাক্ট লিস্ট গড়াতে থাকে আঙুল দিয়ে।
— ‘ পরেরটা হলে কিন্তু আড়াইশো টাকা লাগবে .... ‘ , হিল্টন আর একটা বিড়ি ধরিয়ে বলে।
শিখর ফোনে তারিখকে পেয়ে যায়। জানা গেল, পরেরটা না ওই সামনের মোড়টাই। ওখানে তারিখের লোক দাঁড়িয়ে আছে। তারাই মাল নামিয়ে পেমেন্ট দিয়ে দেবে।
— ‘ না: ... নে টান টান .... সামনেরটাই ..... তোরা চোষবার জন্য বসে আছিস শালারা.... নে চল চল ......’ শিখর ফুরফুরে মেজাজে বলল।

‘ .... আরে দাঁড়া দাঁড়া ..... অত তাড়াহুড়ো কিসের ! মালেরা মুখটা একটু দেখা ..... ‘
গলাটা কানে আসা মাত্র হিল্টন আর পদা ঠেলাটা ছেড়ে দিয়ে পলকের মধ্যে রাস্তার পাশের অন্ধকার ঝোপঝাড়ের মধ্যে দিয়ে কোথায় মিলিয়ে গেল নিমেষের মধ্যে ।
থানার দুজন স্টাফ অপ্রস্তুত হতচকিত শিখরের গায়ের কাছে এসে পড়ল।
— ‘ এই যে চাঁদু .... চ্যাম্পিয়ান লোক একেবারে .... ও: , এতদিনে জালে একটা মাছ পড়ল। তা মাল কোথায় খালাস করতে যাচ্ছিলি ?’ একজন বলল। আর একজন শিখরের কলারটা চেপে ধরল । ‘এরপর কি হবে জানিস ? ‘
আতঙ্কে দিশাহারা শিখরের মুখ দিয়ে কোন কথা বেরোল না। ঘেমে নেয়ে তোতলাতে তোতলাতে শুধু বলতে পারল, ‘ আমি তো ... আমি তো ....’।
— ‘ তুই তো .... কি ? কোন শাহেনশা তুই ? চল চল .... থানায় গিয়ে জামাই আদর খেতে খেতে যা বলবার বলবি ....’
কড় কড় কড় কড় করতে করতে থানার জিপ এসে থামল।যে লোকটা শিখরের কলার ধরে ছিল
সে জোরালো এক গুঁতো মেরে বলল, ‘ চল ওঠ ওঠ .... হাতে টাইম নেই .... ‘ বলে ঠেলা মেরে শিখরকে জিপে তুলল।
জিপের সামনের সিটে বোধহয় বড়বাবু বা মেজবাবু বসেছিলেন। তিনি মোবাইল কানে লাগিয়ে কাকে যেন বলছেন, ‘ মালটা ষষ্ঠীতলায় রাস্তার ধারে পড়ে আছে। কেডিয়ার কোম্পানিতে খবর দিয়ে মালটা তুলিয়ে নাও। আমরা একটাকে তুলেছি। এটার যা ব্যবস্থা করার করব ....’

পেঙ্গুইন কন্স্ট্রাকশানের পীযূষ কেডিয়া কথার নড়চড় করার লোক নন। ব্যবসায়ী মাত্রেই শোষক এবং হৃদয়হীন মুনাফাখোর এই ধারণার যারা বশবর্তী শ্রী কেডিয়া তাদের বিরুদ্ধে মূর্তিমান প্রতিবাদ ।
বেলা এগারোটা নাগাদ জোরালো রোদ্দুরে ঝলমল করছে ঝিলের জল। তিনজন সহচর নিয়ে কেডিয়াজি এসে দাঁড়ালেন কার্ত্তিক পাঁজির ইঁটের হাড় পাঁজরা সার ঘরখানার সামনে। সঙ্গের একজন শিখরের নাম ধরে ডাকতে লাগল। ভেতর থেকে অবসন্ন ক্ষীণ কন্ঠে জবাব এল, ‘ যাই ..... এই যাই .... ‘
ভাঙ্গা পায়ে শরীরটাকে কোনমতে ঠেলেঠুলে বার করে আনল কার্ত্তিক। চোখে একরাশ ভয়। চোখদুটো কেমন যেন ভিজে টইটুম্বুর।
বলল, ‘ বাবুরা .... থানা থেকে ? ‘
— ‘ আরে না না ..... থানা থেকে আসব কেন ? পীযূষ স্যার এসেছেন এই এরিয়া কভার করতে। আপনাদের কি দরকার স্যারকে বলুন । ‘
শ্রী কেডিয়া প্রসন্ন মুখে বললেন, ‘ তোমার পা ভেঙেছে খবর পেয়েছি। তোমার ছেলেকে পেলে সুবিধা হত। এখন কি নেই ? ‘
কার্ত্তিক খানিকটা আশ্বস্ত হয়ে জলকাটা কাকুতি ভরা চোখে কেডিয়াজির মুখের তাকিয়ে থেকে বলল, ‘ না .... বডিটা এখনও পাইনি । যদি বডিটা পাবার একটু ব্যবস্থা করে দেন স্যার ..... আর বিরক্ত করব না .... দয়া করুন স্যার ..... ‘
ভয়ঙ্কর বিস্ময়ে পীযূষ কেডিয়ার ভ্রু কুঁচকে গেল — ‘ মানে ! ‘
‘ আমার ছেলে তো কাল রাতে ধরা পড়েছিল স্যার। ও নাকি আপনাদের ওই রড নিয়ে ভাগছিল..... বডিটা পাওয়া গেছে ওই ষষ্ঠীতলার জলার ধারে। এখন মর্গে । সবাই বলল ও নাকি পালাতে যাচ্ছিল তাই .... থানার বন্ধ হাজত থেকে কি করে যে পালাল ......’
পীযূষ কেডিয়া এবং তার সঙ্গের তিনজন হিমশীতল নৈশব্দ্যে বাকরুদ্ধ, স্থানুবৎ দাঁড়িয়ে রইল কার্ত্তিক মাঝির মুখের দিকে তাকিয়ে ।

সিভিল ইঞ্জীনিয়ার প্রদীপ্ত মিত্র প্লিন্থ-এর ডেপথ্ অঙ্ক কষে বার করে ফেলেছেন , যাতে চোদ্দ তলা বিল্ডিং-এর ‘বডি’ নির্ভুল খাপ খেয়ে যায়। আপডেটটা দিয়ে রাখার জন্য তিনি মিস্টার পীযূষ কেডিয়াকে ডায়াল করলেন।

কেডিয়াজির বুক পকেটে মোবাইল একটানা বেজে যেতে লাগল নীরব অবহেলায়।প্রথম মধ্যাহ্নের প্রখর আলোয় ভেসে যাচ্ছে চারপাশ।


*****************************

 


 

প্রবাহমান - মঞ্জুলিকা রায়

 


প্রবাহমান 
মঞ্জুলিকা রায় 
 

 

ট্রেনটা আধ ঘন্টা লেট ছিল,  স্টেশনে পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় একটা বেজে গেল। ভোরের ফ্লাইটে দমদম তারপর সেখান থেকে শিয়ালদায় এসে ট্রেন ধরেছিল। টিকিট তো আজকাল অন লাইনেই কাটা হয় তাই অসুবিধা কিছু হয় নি তাছাড়া সাথে নীলেশও এসেছে, ওকে ট্রেনে বসিয়ে দিয়ে গেছে।  নীলেশের  মাসির বাড়ি যাদবপুরে সেখানেই  থাকবে ও,  ইন্দ্রাণী ফিরে এলে তখন দুজনে মিলে দিল্লি উড়ে যাবে   ।   নিজের ভারী ট্রলিটা টানতে টানতে স্টেশনের বাইরে এসে একটা রিক্সা নিয়েছে  ইন্দ্রাণী।   বহুদিন পরে সে এসেছে  নিজের শহরে,  যে শহরে সে  কাটিয়েছিল  জীবনের প্রথম একুশটা বছর।  রিকশা চলছে আর তাঁর চোখের সামনে  দৃশ্যমান হচ্ছে তাঁর চেনা রাস্তাঘাট।  মেন রোড থেকে বাঁদিকের রাস্তাটা গেছে তাঁর কলেজের দিকে,  স্কুল,  মেয়েবেলা,  বহু স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে এই শহরের  পথে ঘাটে, রাস্তার পাশের গাছপালায়,  পথের ধুলোবালিতে,  কতো সুখ দুঃখের স্মৃতি,  কতো লড়াই,  কতো অপমান ,  অভিমান   গল্প হয়ে মিশে আছে এখানে  ।  চোদ্দো বছর আগে এই শহরটাকে ছেড়ে সে পাকাপাকিভাবে রাজধানীতে  চলে 
গিয়েছিল কিন্তু  তাঁর বুকের মধ্যে সবসময়ই একটা দ্বীপের মতো ভেসে থাকতো এই মফস্বল শহরটা যেখানে থাকেন  তাঁর বাবা,  তাঁর ফেলে আসা জীবনের একমাত্র যোগসূত্র। 


বাবা নামক যোগসূত্রটাও ছিঁড়ে গেছে কয়েকদিন আগে,  চতুর্থীর কাজ ইন্দ্রাণী  করেছে তাঁর দিল্লির বাড়িতে  বসে,  আজ বাবার ঘাটকাজ,  সে যাচ্ছে বাড়ির লোকেদের জন্য কাপড়চোপড় আর যেসব সামগ্রী এইসময় দিতে হয় সেসব পৌঁছাতে।  ইন্দ্রাণীর শাশুড়ীমা খুব বুঝদার মহিলা,  তিনিই সব কেনাকাটা করেছেন,  ট্রলিতে  প্রত্যেকের  কাপড়চোপড়ে তিনিই নাম লিখে গুছিয়ে দিয়েছেন।  ইন্দ্রাণী জানে বাড়ির কাজের লোকেদের জন্যেও তিনি   ঠিক  কাপড় কিনেছেন।  এইসময় ইন্দ্রাণীকে  একটুও বিরক্ত করেন নি তিনি।  এমন নয় যে বাবার মৃত্যু খুব অপ্রত্যাশিত ছিল,  বাবার বেশ বয়েস হয়েছিল,  প্রেশার সুগার সবকিছুই ছিল তবু বাবা আছেন কোথাও, এই ভাবনাটা  ইন্দ্রাণীকে আশ্বস্ত করতো,  শান্তি দিতো,  তাঁর বিয়ের আগের জীবনে শুধু  দুটো লোকই তাঁর মনের মধ্যে আজ অবধি  বাস করেছে  বাবা আর তুলি।  তুলিকেও ইন্দ্রাণী ধীরেধীরে অনেকটা ভুলেছেন কিন্তু বাবা তো সবসময়ই বিরাজ করতেন মনের মধ্যে।  

বছরে এক দুইবার  কয়েক ঘন্টার জন্য ইন্দ্রাণী আসতো বাবাকে দেখতে কিন্তু কখনো রাত্রিবাস করে নি,  এছাড়া সপ্তাহে একবার অন্তত ভিডিও কলে সে বাবাকে দেখেতোই।  বাবার দেখাশোনা করে  বাচ্চু বলে যে ছেলেটি তাঁর মাইনে পত্তর, বাবার চিকিৎসার যাবতীয় খরচ চাকরি পাবার পর থেকে ইন্দ্রাণীই করে এসেছে। বাচ্চুকে সেই স্মার্ট ফোন কিনে দিয়ে, কিভাবে ভিডিও কল করা হয় সেটাও  শিখিয়েছিল  শুধু বাবাকে যাতে একবার চোখের দেখা দেখতে পারে, যাতে  দুটো  কথা বলতে পারে।  দাদারা   বিবাহিতা বোনের থেকে  বাবার খরচ নেবে না বলে  খুব আপত্তি জানিয়েছিল  কিন্তু ইন্দ্রাণী বলেছিল " কেন,  আমিও কি  বাবার সন্তান নই ,  বাবার জন্যেই  আজ আমি নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছি ,  সন্তান হিসাবে আমারও তো  কিছু  দায়িত্ব , কর্তব্য  আছে । 
 তখনও বাবাই তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে, দাদাদের বলেছিলেন " তুমরা বুইনরে বাঁধা দিও না,  ও তো তুমাগো  থিক্যা কহনো কিস্যু চায় নাই, আজ একইখ্যান আব্দার করতাসে, হেইডা তুমরা মাইন্যা লও। ", 

বাবার কথা ভাবতেই চোখ ভিজে এলো ইন্দ্রাণীর,  তাঁর জন্মাবধি বুড়ো, অসহায়,  কোলকুঁজো হয়ে থাকা,  নিড়বিড়ে স্বভাবের বাবাই তো  তাঁর শৈশব কৈশোরের একমাত্র আশ্রয় ছিলেন ,  বাবার যতটুকু ক্ষমতা ছিল তাই দিয়ে তিনি রক্ষা করতে চেয়েছিলেন তাঁর প্রায় বৃদ্ধ বয়েসে জন্মানো কন্যাটিকে।   সবসময় যে তিনি সফল হয়েছেন এমনটা নয় কিন্তু আজ যে ইন্দ্রাণী জীবনে  দাঁড়িয়েছে সেটির সমস্ত কৃতিত্ব তাঁর বাবার।  গ্রাজুয়েশনের পরে  বিয়ে দিয়ে  হাত ধুয়ে ফেলতে চেয়েছিলেন   ইন্দ্রাণীর মা আর দাদারা।  ইন্দ্রাণীর কান্না দেখে বাবাই তখন জিদ ধরেছিলেন,  সহজ ছিল না সেই পথ,  বাবা খাওয়াদাওয়া ত্যাগ করায় শেষ পর্যন্ত  মা  বাধ্য হয়ে দিল্লি স্কুল অফ ইকনমিক্স   থেকে  পোস্ট গ্রাজুয়েশন করার অনুমতি দিয়েছিলেন। রাজধানী  তাঁকে ফিরিয়ে দেয় নি,  পড়তে এসে সে এখানেই খুঁজে পেয়েছে  স্বনির্ভরতা, পেয়েছে সম্মান, ভালোবাসার ঘর  ,  জীবনসাথী নীলেশ   আর মায়ের মতো স্নেহশীলা শাশুড়ী মাকে । কলকাতায় আসার আগের জীবনটা ছিল বঞ্চনার, অপমানের, অসম্মানের,  বাবা ছাড়া তাকে কেউ আপনজন বলে ভাবেই নি,  আপনজনদের চূড়ান্ত খারাপ ব্যবহারে বারেবারে রক্তাক্ত হতো  ছোট্ট  ইন্দ্রাণীর হৃদয় ! 


----বাবা, ও বাবা তুমি আমারে  বুল্টির মতো কালা  ছিট ছিট দেওয়া সাদা ফ্রক কিইন্যা  দিবা ?  


------ তুমার মায়েরে কও সুনা,  মায় কিইন্যা দিবো নে। 


------ মা দিবে না,  মা কইছে সাদা জামায় আমারে  আরও কালা  লাগবো । তুমি দিবে  বাবা? 


পাঁচ বছরের মেয়ের চোখ মুছিয়ে তার বাবা বলেন ' নিশ্চয়ই দিমু মা,   তর মায়  একখান আবুদা,  আমার এমন সোন্দর মাইয়ারে কালী কয়! 


সাদার উপর পোলকা ডট ফ্রকের শখ বলাবাহুল্য মেটে নি মেয়েটার । বয়েস যখন বারো  তখন সরস্বতী পূজোয় মেয়েটার বন্ধুরা  সবাই শাড়ি পরবে বলে ঠিক করেছিল ,  মেয়েটা ভয়েভয়ে মাকে গিয়ে বলেছিল " তুমার  পুরানা  আলমারির নীচের তাহে   একখান লাল সিল্কের শাড়ি আসে  ,  ওই শাড়িটা আজ পরুম ? "


মায়ের ঠোঁটের বক্র হাসিটি কখনো ভুলতে পারবে না ইন্দ্রাণী,  " তয় আর তরে দ্যাখতে  হইবো না,   এক্কেরে টিকায়  আগুন লাগসের নাহান লাগবো। "


সেই পুজোয় আর ঠাকুর দেখতে বাইরে যাওয়া হয় নি ইন্দ্রাণীর, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বারো বছরের বাচ্চাটি শুধু  নিজেকেই দেখছিল,  নিজেকে তাঁর দেখতে খারাপ লাগে না কখনো ।  তার মা আর দুই দাদা ছাড়া আর তো কেউ তাকে এইসব বলেও  না!  ইন্দ্রাণীর পিসি থাকতেন পাশের পাড়ায়,  মায়ের সাথে পিসির ছিল আদায় কাঁচকলায় সম্পর্ক।  পিসি আর কারুর সামনে নিজের ক্ষোভ না উগরাতে পেরে তাকেই শোনাতো। " তর মায়ের ধলা  রঙ লইয়্যা বড়ই অহংকার  রে,  আমারে হে কইতো ভাগ্যিস ঠাহুরজামাই ধলা হইসেন তাই তুমার মাইয়াদের পার করতে  পারসো,  তুমার রঙ পাইলে আইবুড়া হইয়্যা ঘরেই পইচ্যা  মরতো। "


আরও  খানিকটা বড় হবার পরে পিসির থেকেই সে শুনেছিল " তুর মায়ের ধারণা আসিলো হ্যার কহনো মাইয়া হইবোই না,  আমারে কইতো  ঠাহুরঝি তুমার হইলো মাইয়া বিয়োইবার প্যাড আর আমার প্যাডে আমি চাইলেও  মাইয়া বিয়াইতে পারুম না।তর মায়ের সেই গুমোর ভাইঙ্গা গেলো যহন বুড়া কালে তুই জন্মাইলি,  হেই কারণে ও তুরে দ্যাখতে পারে না। "


ইন্দ্রাণী  যখন জন্মান তখন তার বাবার বয়েস পঞ্চাশ আর মায়ের বয়েস বিয়াল্লিশ,  মাসিক অনিয়মিত হওয়ায়   মা নাকি প্রথম দিকে বুঝতেই পারেন নি যে তিনি আবার অন্তঃসত্ত্বা হয়েছেন। যখন বুঝলেন তখন দেরি হয়ে গিয়েছিল,  মায়ের অ্যানিমিয়া ছিল,  ডাক্তার অ্যাবোর্ট করতে রাজি হন নি। বুড়ো বয়েসের মেয়ে তায় আবার গায়ের রঙ চাপা   মা নাকি তাকে  ছুঁয়েও দেখেন নি,  বাড়ির বুড়ি ঝি গোপালের মায়ের যত্নে ইন্দ্রাণী বেঁচে যায় । জ্ঞান হবার পর থেকেই ইন্দ্রাণী বুঝেছিল  আর পাঁচটা বাচ্চার মতো তার জীবন নয়।  তাঁর দুই দাদা যাদের একজনের বয়েস তাঁর জন্মের সময়েই ছিল   প্রায় বাইশ   আর একজনের আঠারো তাঁদের হাতেই ব্যবসা, রোজগারের চাবিকাঠি। বাবা বুড়ো মানুষ,    সংসারের কোনো কিছুর উপরেই বাবার কোনো জোর নেই। বড় হবার বুঝতে পেরেছিল  আসলে বাবা ততটা বুড়ো ছিলেন না কিন্তু  মেয়ে জন্মানোর  পরে  দুই সাবালক ছেলের রাগ ভাঙানোর জন্য ওদের হাতেই ব্যবসার রাশ ছেড়ে দিতে  বাবাকে বাধ্য করেছিলেন মা। মানুষটা বড়ই নিড়বিড়ে স্বভাবের ছিলেন বলে সেইভাবে  প্রতিবাদ বা প্রতিরোধ কিছুই করতে পারেন নি । অসময়ে ঘরবসত করার ফলে বাবা তাড়াতাড়ি বুড়ো হয়ে গিয়েছিলেন। 

ইন্দ্রাণীর মা তার বড় দুই ছেলেকেই সংসারের কর্তা বানিয়েছিলেন,  ছেলেদের ছোটো থেকেই  প্রশ্রয় আর আদর  দিয়ে তাদের মাথাটা এতটাই  খেয়েছিলেন যে তারা পড়াশোনাটা শেষ  করতে পারে  নি।  ছেলেদের বিয়েও তাড়াতাড়ি দেন,  ছেলে বউমাদের অসম্ভব মাথায় করে রাখতেন যাতে তিনি সংসারে গৃহিণীর  পদটা বজায় রাখতে পারেন। ক্রমাগত মেয়েকে বঞ্চিত করে গেছেন,  খাওয়া পরায়, এমনকি পড়াশোনার ব্যাপারেও। ইন্দ্রাণী সেই ছোটবেলার থেকে বুঝতে পেরেছিল যে তাকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে আর সেই দাঁড়ানোর জন্য  পড়াশোনাটা ভালো করে  করতেই হবে।


ইন্দ্রাণীর সাত বছর বয়েসে তুলি জন্মালো,  বড় দাদার প্রথম সন্তান,  পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের মতো ধপধপে গায়ের রঙ। তুলির একটু  জ্ঞান হতেই তুলিকে ইন্দ্রাণীর বিছানায় চালান করে দিয়েছিলেন ইন্দ্রাণীর মা। দু বছরের তুলি রাতের বেলা মাকে খুঁজতো,  নিজের জন্য যে মেয়েটি কখনো কিছু চাইতো না সেই নয় বছরের মেয়েটি গিয়েছিল তুলির হয়ে দরবার করতে। 
--" রাতে তুলি কান্দে, মনে লয় ওর মায়েরে  খুঁজে।  ওরে আমার সাইথ্যে শুইতে দিসো ক্যান? "
---- " বলদা মাইয়া, তুলির তো ভাই হইবো আর কিসুদিনের মইধ্যে,  ওরে  এহোন আলাদা শোওনের অভ্যাস করাইতে হইবো। 
--- কান্দে যে,  রাতে আমি ঘুমাইতে পারি না। 
----- পেরথম পেরথম কয়েক দিন কান্দবো, কাইন্দলে পরে তুর বুড়া আঙুলখান ওর মুহে ঢুকাইয়া দিবি, খানিক চুইষ্যা ও চুপ হইয়া যাইবো, এমনেও তো ওর মায়ের বুকে এহোন আর দুধ নাই। 

অবোধ বাচ্চাকে চুপ করাতে গিয়ে আর একটা নয় বছরের শিশুর বুড়ো আঙুলের ছাল চমড়া উঠে গিয়েছিল। 
তুলির পরে বিল্টু এলো,  ইন্দ্রাণী অবাক হয়ে দেখেছিল তাঁর সাথে যা যা অন্যায় হতো সেটি ওই দুধের বাচ্চা তুলির সাথেও হচ্ছে । ইন্দ্রাণীর ধারণা ছিল তাঁর মাজা মাজা রঙই তাঁর দুর্ভাগ্যের কারণ কিন্তু  তুলি তো ধপধপে ফরসা,  এতোটুকু বাচ্চার সাথে এইরকম অমানবিক আচরণের কারণ বুঝতে পারতো না বলে ও অনেকবার তুলির হয়ে ঝগড়া করেছে,  ধীরেধীরে বুঝতে পারলো যে কালো ফরসা নয় তাঁরা মেয়ে বলেই তাঁদের সাথে এইরকম  বিমাতৃসুলভ আচরণ করা হয় কিন্তু  তুলি দুধের বাচ্চা,   অতো শত বোঝার মতো বয়েস তখনও ওর হয় নি তাই বিল্টুর মুখে চকলেট দেখে গগনবিহারী  চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে তাঁর কাছে ছুটে ছুটে চলে আসতো,  " ও পিপি রে, আমারে  দেয় নাই  রে!  বিল্টুরে দিছে "!  প্রথম প্রথম ঝগড়া করলেও পরে বাবার থেকে যে দুই চার পয়সা পেতো তাই দিয়ে তুলির জন্য চকলেট কিনে আনতো,  তখন আবার অন্য বিপত্তির সৃষ্টি হতো।  বিল্টু  নাকি কান্না জুড়ে নালিশ জানাতো,  এক দুই বার  ভাইপোকে না দিয়ে  ভাইঝিকে দেবার জন্য ইন্দ্রাণী চড়চাপড়ও খেয়েছে কিন্তু বাবা জানতে পেরে হুলুস্থুল বাঁধিয়ে দিতেন। ক্ষেপে গিয়ে বলতেন " মাইয়া মানুষের গায়ে হাত তুইল্যা রাবণরাজা নির্বংশ হইসে,  মাইয়ার গায়ে হাত তুললে বংশলোপ পাইবো "।  তারপর থেকে ইন্দ্রাণীর মা আর ইন্দ্রাণীর গায়ে হাত তুলতেন না কিন্তু বড়বৌদির হাতে তুলি মার খেতো। 

অপমানিত, অবহেলিত ছোট্ট তুলির প্রায় মা হয়ে উঠেছিল ইন্দ্রাণী,  তুলিকে বোঝাতো  " তোর যা ইচ্ছা হইবো আমারে কইবি,  বাবারে কইয়া আমি আনাইয়া দিমু,  অগোরে কিসু কইস না। "  তুলি তবুও ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদতো " হক্কলরে দেয়, শুধু তোরে আর আমারেই দেয় না।  কাল কাকীরে মাছের মুড়া দিসিলো,  আমি কইলাম আমারেও দাও তো ঠাকুমা কইলো মাইয়া মানুষের অতো নোলা ভালা  না।  ক্যান রে পিপি,  কাকী কি ব্যাটাছেলে,  মাইয়া মানুষ নয় ? "   ততোদিনে ছোটদারও বিয়ে হয়ে বউ এসেছে,  ছোটদার যমজ ছেলেও হয়েছে,  ইন্দ্রাণীও বড় হয়ে উঠেছে,  বুঝতে পারতো ছেলের বউদের খাইয়ে দাইয়ে  আদর প্রশ্রয়ে   না রাখতে পারলে  ছেলেদের উপর  মায়ের কর্তৃত্ব রক্ষা করা কঠিন হয়ে যাবে। এতো স্বচ্ছল পরিবারে সমস্ত কিপটেমি কেন তাঁদের দুজনের উপরেই হতো সেটাও বুঝতে ওদের অনেক  সময় লেগেছিল। পরে বুঝেছিল আবহমানকাল থেকে চলে আসা মনোভাব যে  মেয়েসন্তানের জন্মই হয় পরের ঘরে চলে যাওয়ার জন্য,  যারা কোনো উপকারেই লাগবে না তাঁদেরকে খাইয়ে মাখিয়ে কি লাভ হবে? 
এছাড়া আরও একটা ধারণা ছিল যে মেয়েদের শ্বশুর বাড়ির থেকে  কিছু পাবার আশা করাটাই   দুরাশা তাই তাঁদেরকে ভালো ভালো জিনিসের  অভ্যাস করিয়ে দিলে ভবিষ্যতে  মেয়েদের প্রতি খারাপই করা হবে !  তাই শৈশব থেকেই তাঁদের প্রতি কঠোর আচরণ করে ভবিষ্যৎ যমালয় মতান্তরে শ্বশুর ঘর করতে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত করাতে  হবে। 

ইন্দ্রাণী সেই ছোট বয়েস থেকেই বুঝেছিল সম্মানের সাথে বাঁচতে হলে তাকে আত্মনির্ভরশীল হতে হবে।  তুলিকেও সেই শিক্ষাই দিতো,  কারুর সহায়তা ছাড়া পড়াশোনা করাটা অনেক কঠিন ছিল, ইন্দ্রাণীকে  ভালো রেজাল্টের জন্য অন্যদের প্রায় ডাবল পরিশ্রম করতে হতো।  তুলিকেও জোর করে পড়তে বসাতো,  বাবা অবশ্য বলতেন " রাঙ্গা মুলা, ওর হইবো না।  তোর যা মনের জোর আছে তা ওর নাই। মনের জোর ছাড়া কিসুই হয় না। " তারপর  ইন্দ্রাণী মাস্টার্স করতে দিল্লি  চলে গেলো ,  সেখানে গিয়ে ইন্দ্রাণীর যেন মেটামরফোসিস হয়েছিল, বাঙাল কথা বলা ছেড়ে দিয়ে পুরো আধুনিক মনের  মানুষ হয়েছিল,  তারপর চাকরি, নীলেশের   সাথে প্রণয় আর বিয়ে, শাশুড়ী মায়ের মধ্যে স্নেহমহী মাকে খুঁজে  পাওয়া, বুবলাইয়ের জন্ম,  সম্মান, আদরে উছলানো জীবন কাটছে তাঁর কিন্তু সবটাই এতো সহজে হয় নি। ইন্দ্রাণীর শাশুড়ী মা ডিভোর্সি , কলেজে পড়ান তার উপর নীলেশরা  কায়স্থ সব মিলিয়ে বিয়ের সময়ে তাঁদের প্রাচীন পন্থী বাড়িতে যেন  ঝড় উঠেছিল। 

ইন্দ্রাণীর মা বলেছিলেন " বরকে ছাইড়া দিছে যে মাইয়ামানুষ হের সাথে বেশ্যার কোনো ফারাক নাই! ' অথবা " কায়স্থ আমাগো ভিতরবাড়ির চৌকাঠ পার হইতে পারবো না "।  বলা বাহুল্য এইসব বলে মা আর দাদারা তাঁর বিয়েটা মেনে নেয়নি এবং বিয়েতে একটা পয়সাও খরচ করে নি। তাতে অবশ্য ইন্দ্রাণীর কিছু যায় আসে নি,  বাবাকে প্রণাম করে সে ঘর ছেড়ে চলে এসেছিল। বাবার খুব ইচ্ছা ছিল ঠাকুমার গলার সাত লহরী হারটা তাঁকে দেওয়া হোক কিন্তু  মা আর বউদিরা তাতেও বাধা দিয়েছিল।  বাবার চোখে জল দেখে  সে হেসে বলেছিল " থাক না বাবা,  ওটা নাহয় তুলির বিয়েতে দিও।  বাড়ির কোনো মেয়ে পেলেই তো হলো। "   বিয়ের পরে নীলেশকে  নিয়ে বাবাকে প্রণাম করতে গিয়েছিল।  বাবা নীলেশের  হাত জড়িয়ে ধরে  কেঁদেছিলেন আর বলেছিলেন " আমার এই মাইয়াডারে দেইখ্যো বাবা,  তুমার হাতে অরে তুইল্যা দিতাসি,  বড্ডো অভিমানী মাইয়া আমার, কহনো মুখ ফুইট্যা কিস্যু চায় না তবে খুব বুঝদার,  এমন মাইয়া ভূভারতে কমই আসে। " নীলেশ  বাবাকে আশ্বস্ত করেছিল। 

দশ বছরের বিবাহিত জীবন যেন সুখস্বপ্নে মোড়া, পঁচিশ বছরের বঞ্চনার ইতিহাস শাশুড়ী মায়ের ভালোবাসায় ধুয়েমুছে গেছিল কিন্তু একটা জিনিস তাঁর মনের মধ্যে খচখচ করতো, তাঁর বিয়ের এক বছরের  মধ্যে  উনিশ বছরের  তুলি বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে নিয়েছিল।  তুলি তো তাঁর ভাইঝি কম, মেয়ে বেশি,  তাই তুলি পড়াশোনা শেষ না করে বিয়ে করায়  বহুদিন  পর্যন্ত মন খারাপ করতো তাঁর । বাবা অবশ্য বলতেন " কইছিলাম না ও হইলো গিয়া রাঙ্গা মূলা, অর দ্বারা পড়াই লিখাই হইবো না। " তুলির শ্বশুর বাড়ির অবস্থা প্রথমে সাধারণ ছিল, পরে ওর বর রাজ্যের শাসক দলের একজন মাঝারি গোছের নেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে,  স্বনামে বেনামে প্রচুর সম্পত্তি বানিয়েছে,   দাদাদের ব্যবসায়  নাকি তুলির বর এখন  অনেক সাহায্য করছে , ফলে জামাইয়ের এখন ওই বাড়িতে স্পেশাল খাতির। বাবার আবার তাই নিয়ে  অনেক ক্ষোভ ছিল,  তুলিরা জাতে কৈবর্ত হয়েও বাড়িতে খাতির পাচ্ছে আর নীলেশকে একগ্লাস জলও কেউ সাধে নি। ইন্দ্রাণীর অবশ্য এইসব ব্যাপারে হেলদোল ছিল না,  নীলেশ মুখে কখনো কিছু না বললেও শ্বশুরবাড়ির রক্ষণশীলতা নিয়ে খুশি ছিল না। 


প্রতিবার  ইন্দ্রাণী  যখনই  বাপের বাড়ি আসে তখন  একটা কথাই মনে আসে,  বাড়িটার কোনো পরিবর্তন হয় না কেন ! 
জগদ্দল পাথরের মতো অপরিবর্তনশীল, দিন দিন যেন আরও কুশ্রী হচ্ছে অথচ বাবার কাছ থেকে ইন্দ্রাণী জেনেছে পারিবারিক ব্যবসায় আরও উন্নতি হয়েছে। বাড়ির বাসিন্দারা যেমন সময়ের থেকে অনেক পিছিয়ে সেটা  বাড়ির চেহারাতেও প্রকাশ পাচ্ছে। সঙ্গে করে আনা জিনিসগুলো মোটামুটি প্রায় সবাইকে দিয়ে ইন্দ্রাণী  এসে বাবার ঘরে বসলো। এই বাড়ির লোকেদের  হাতে পয়সা থাকলেও খরচ বলতে বোঝে  ছেলেদের জন্য সম্পত্তি আর মেয়েদের জন্য সোনার গয়না কেনা  কিন্তু পোশাকের ব্যাপারে এরা সস্তা কাপড় খোঁজে তাই ইন্দ্রাণীর আনা রুচিসম্মত কাপড়চোপড় পেয়ে সবাই খুব খুশি হলো। মায়ের সাথে দেখা হয় না,  মা ঠাকুর ঘরে ব্যস্ত আর ঠাকুর ঘরে কায়স্থকে বিয়ে করার জন্য ইন্দ্রাণীর প্রবেশের অধিকার নেই। দাদাদের সাথে অবশ্য দেখা হলো,   দুই দাদাকে মুন্ডিত মস্তক দেখে ইন্দ্রাণীর অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছিল।  বড়দা ভদ্রতা করে বললেন  " ক'টা দিন থাকবি তো?"  উত্তরে ইন্দ্রাণী ফ্যাকাসে হাসি হাসে যার অর্থ হ্যাঁও হতে পারে আবার নাও হতে পারে।  বড়দা অবশ্য বলেই চলে গেছেন, ইন্দ্রাণীর উত্তরের জন্য অপেক্ষা করে থাকেন নি। 


 উঠোনে প্যান্ডেল বেঁধে কাজ হবে, সেখানে তখনও ডেকরেটারের লোক কাজ করছে।   সামনের ঘরে টেবিলের উপর  বাবার একটা পুরনো সাদাকালো ছবিতে মালা আর চন্দন পরিয়ে রাখা আছে।  ইন্দ্রাণী চুপচাপ বাবা যে ঘরে থাকতেন সেই ঘরে এসে বসেছিলো।  খাটের বিছানা ফেলে দেওয়া হয়েছে, খাটের ওপর একটা সুজনিই শুধু পাতা,  দেওয়ালে বাবার হাসি মুখ।  খাটের উপর চুপ করে বসে থেকে ইন্দ্রাণী যেন বাবাকে অনুভব করতে  পারছিল , সারা ঘরটায় যেন  বাবার গায়ের গন্ধ মাখা। ধীরেধীরে ইন্দ্রাণীর চোখ ভিজে  আসতে থাকে,  হঠাৎ পিছন থেকে কেউ এসে  ওকে জড়িয়ে ধরায় সামান্য একটু কেঁপে ওঠে ইন্দ্রাণী। 

" আমি ঠিক জানতাম তোকে এখানেই পাবো,  সবাই বললো তুই এসে গেছিস কিন্তু  তোকে কোথাও দেখতে পেলাম না। গতকাল থেকে এখানেই ছিলাম, সকালে যেই একটু বাড়ি গেছি, অমনি তুই এসে হাজির ! 
কী সুন্দর দেখতে হয়েছিস রে পিপি !  কে বলবে তুই আমার পিপি,  আমার চেয়ে তোকে ছোট লাগছে অনেক! "

ইন্দ্রাণী সামান্য অবাক হয়ে বলে " তুলি,  তুই! "

----- " কেন রে চিনতেই পারছিস না নাকি !  তুই কিকরে এখনো এতো ছিপছিপে রয়েছিস রে পিপি?  আমাকে দেখ !  একদম কুমড়োপটাশ  হয়ে গেছি। 

সত্যিই একে  তুলি বলে বুঝতে সময় লাগে !  তুলি মানে রোগা রোগা, কাজল ল্যাপটানো, ধপধপে ফরসা, লাল ঠোঁটের খুকির কথাই মনে পড়ে। যদিও যখন বাড়ি ছেড়েছিল ইন্দ্রাণী তখন তুলির বয়েস ছিল চোদ্দ বছর,  তারপর  মাধ্যমিকটা পাশ করেছিল কোনোমতে।  টুয়েলভে ফেল করে ঘরে বসেছিল, পরে  পালিয়ে বিয়ে করে নেয় ,  সেই  তুলি এখন এতটাই  মুটিয়েছে যে  কোমরে দুই তিন থাক চর্বির স্তর,  মুখটাও গোল ফোলা তাতে দু'টাকার সাইজের সিঁদুরের টিপ লেপ্টে আছে,  সারা গায়ে প্রচুর সোনার গয়না,  একটা ঢাকাই জামদানী পরনে,  শীতের প্রথম দিকেও তুলি দরদর করে ঘামছে। তুলি তাঁর পিপির বর, ছেলের খবর নিলো,  তাঁদের এখন পর্যন্ত চোখে না দেখার জন্য দুঃখ করলো,  তারপর শুরু করলো  নিজের স্বামীর ঐশ্বর্য আর ক্ষমতার গুণকীর্তন ,  ওর বর যে ওকে চোখে হারায়, এক মিনিটও ছেড়ে থাকতে পারে না বলে ওর সাথে এই বাড়িতে এসেও  রয়েছে সেটাও সগর্বে ঘোষণা করলো। 


ইন্দ্রাণী অবাক হয়ে ভাবছিল তুলি তো আজকের মেয়ে কিন্তু  কথাবার্তা শুনে  মনে হচ্ছে যেন সত্তর বছরের প্রবীণা  কথা বলছে । ভাবছিল এই কি সেই  মিষ্টি  মেয়ে তুলি !  এর মুখ থেকে তো   খালি রকমারি আজব শাড়ি গয়না বা স্বামীর সোহাগের গল্প !  ইন্দ্রাণীর কষ্ট হচ্ছিল,  তুলি সাত বছরের ছোট হলেও সেই কোন শৈশবেই ওকে সে সন্তানের মতো মানুষ  করেছিল।  আজ এই আঠাশ বছরের প্রবীণাটিকে তাঁর অচেনা বলে মনে হচ্ছিল।  তুলি বড় বড় গল্প শুনিয়ে   পিসিকে টেনে নিয়ে চললো বরের সাথে আলাপ করিয়ে দিতে।  এক তলায় দুই দাদার সাথে তুলির বর কথা বলছিল বলে আর  বরকে ডাকতে  পারলো না।  ইন্দ্রাণী  দেখলো তুলির বরও তুলির মতোই আড়াই মণ,  গায়ের রঙটা অবশ্য বেশ কালো,  তুলি আর তুলির বর দুজনেই  দুপুরের ভাত খাবার পরে পান চিবিয়েছ,  পানের রস শুকিয়ে ঠোঁট কালো হয়ে রয়েছে,  পরণে সিল্কের পাঞ্জাবি,  গলায় মোটা শিকলের মতো সোনার চেন,  হাতে রিস্টলেট, দশ আঙুলের প্রত্যেকটায় পাথর বসানো আঙটি।  বয়েসে নীলেশের চেয়ে এক দুই বছরের বড় বই ছোট হবে না।  এই মফস্বলি রাজনৈতিক গুণ্ডার মতো দেখতে লোকটাকে তুলির স্বামী হিসাবে মানতে মন চাইছিল না। 

তুলি এরপর নিজের  ছেলে মেয়েকে পিপিকে দেখাবে বলে তাঁদের খোঁজে গেল, ইন্দ্রাণী আবারও  এসে বাবার ঘরে বসেছিল। খানিক বাদে তুলিও এসে হাজির,  ছেলেমেয়েদের দেখা পায় নি,  এতবড় বাগান নিয়ে বাড়ির কোথায় কোন প্রান্তে আছে কে জানে!  তুলি ওর ছেলেমেয়ের গল্প করছিল,  বিয়ের এক বছরের মধ্যে পারমিতা  বা পরি জন্মায়  আর পরির জন্মের এক বছরের মধ্যে ছেলে  ডুগগু  জন্মেছে।  তুলি বলছিল " তুই তো বেঁচে গেছিস পিপি,  তোর প্রথমেই ছেলে হয়েছে বলে আর তোকে বাচ্চা  নিতে হয় নি।  আমার প্রথমে মেয়ে হওয়াতে শ্বশুর শাশুড়ী এমনকি আমার বরের কী রাগ !  তাঁদের ছেলে চাই,  যাক বাবা !  পরের বছর ডুগগু হয়ে আমায় বাঁচিয়েছে নইলে আবার ট্রাই মারতে হতো।  অবশ্য ওদেরই বা দোষ দিই কি করে!  একটা ছেলে ছাড়া ব্যবসার হাল কে ধরবে?  মেয়ে তো বিয়ে হয়ে পরের ঘরে চলে যাবে,  বংশ রক্ষার জন্য একটা ছেলে তো অন্তত চাই। "


ইন্দ্রাণী বলতে যাচ্ছিল যে  দেশে কতো  সফল বিজনেস ওম্যান আছে   আর বংশ রক্ষা আবার কি !  মেয়ে কি সন্তান নয় কিন্তু কিছু বলার আগে একটা  চিল চিৎকার আর গগনবিদারী কান্নার আওয়াজে দুজনেই চমকে ওঠে, তারপরেই তুলি চেঁচিয়ে ওঠে " কি হয়েছে বাবু?  কে তোমাকে কি বলেছে? " বলতে বলতে  ঘর ছেড়ে দৌড়ে বেরিয়ে গেল।  তুলির দেখাদেখি ইন্দ্রাণীও ঘর ছেড়ে বাইরে গিয়ে দেখে একটা বাচ্চা ছেলে একটা মেয়ের হাত ধরে হিড়হিড় করে টেনে আনছে।  ছেলে আর মেয়ে যে তুলির সেটা বুঝতে পারলো যখন তুলি ছেলেকে নিজের কাছে টেনে আঁচল দিয়ে মুখ পুঁছিয়ে জিজ্ঞেস করলো " কি হয়েছে বাবাই,  পরি  তোমায় মেরেছে? " উত্তরে ছেলেটা অ্যাঁ অ্যাঁ করে কাঁদতে কাঁদতে বলে " পরি  আমায় না দিয়ে নিজেই আইসক্রিম খেয়ে নিয়েছে। " শুনেই তুলি একটা বিরাশি সিক্কার চড় বসিয়ে দেয় মেয়েকে,  " অ্যাতো বড় নোলা তোর, ভাইকে না দিয়ে নিজেই খেয়ে নিলি! " ইন্দ্রাণী অবাক হয়ে ভাবছিল ছেলেটা ছোট হয়েও দিদিকে  নাম ধরে বলছে, জোর করে টেনে নিয়ে আসছে !  বাবা মায়ের প্রশ্রয় ছাড়া এতটা অসভ্যতা করার সাহস বাচ্চাদের সাধারণত হয় না। 

মায়ের হাতে চড় খেয়ে মেয়েটা গোঁজ হয়ে মাটির দিকে তাকিয়ে ছিল , কাঁদে নি কিন্তু ধীরেধীরে বললো  " গুডডু ওর আইসক্রিম খেয়ে আমারটা খেতে এসেছিল, আমার তখন আধা খাওয়া হয়ে গেছে তাই এঁটোটা দিই নি। " তুলি মেয়ের চুলের ঝুঁটি ধরে নেড়ে ভেঙিয়ে বলে " এঁটো হয়ে গেছে বলে দিই নি !  ভাই একটু চেয়েছে, দিলে কি ক্ষতি হতো!  ছোট ভাইকে কি কেউ হিংসে করে?  তুমি কেঁদো না বাবু,  বাবা তোমাকে অনেক আইসক্রিম কিনে দেবে, পরিকে একটাও দেবে না, এখন চুপ করো সোনা। " মার খেয়ে পরি  ধীরেধীরে  ওই জায়গা থেকে চলে গেলো। ইন্দ্রাণী এতক্ষণ তুলির সন্তান শাসন চুপচাপ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল,  পরিকে দেখে সে এতটা অবাক হয়েছিল যে মুখ থেকে একটা শব্দও বের হয় নি।  পরি  যেন সেই ছোটবেলার তুলি, সেই ধপধপে ফরসা রঙ, রোগা, ভাসাভাসা ডাগর চোখ আর ডুগগুকে দেখতে তুলির বরের মতো, ওইরকম কালো মোটা চেহারা। তুলির তখনও ছেলে নিয়ে আদিখ্যেতা যায় নি, ছেলেকে ট্যাঁকে করে ঘরে নিয়ে গিয়ে  আদর করছিল।  ইন্দ্রাণীর সব ব্যাপারটা এতো অসহ্য লাগছিল যে সে আর তুলির সাথে না গিয়ে ধীরেধীরে ওই জায়গা থেকে সরে পড়ে। 

এদিক সেদিক ঘুরে পিছনের বারান্দায় গিয়ে দেখে  পরি একা-একা বারান্দার রেলিং ধরে পিছনের পুকুরের দিকে তাকিয়ে আছে। কাছে গিয়ে আদর করে মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করে যে সে কোন স্কুলে পড়ে, কোন ক্লাস। অপমানিত বাচ্চাটার গালে তুলির আঙুলের দাগ স্পষ্ট হয়ে বসেছে। মেয়েটার সাথে বেশ খানিকটা  কথা বলে ওকে আশ্বস্ত করে তারপর নিজের হ্যান্ডব্যাগের ভিতর থেকে একটা লাল গয়নার বাক্স বের করে তার থেকে একটা হার নিয়ে মেয়েটাকে পরিয়ে দিয়ে বলে " জানো তো আমি তোমার মায়ের পিসি,  এই হারটা আমি তোমাকে দিলাম।  চলো, তোমার মাকে গিয়ে দেখাই হার পরে তোমায় কতো সুন্দর লাগছে। " পরির হাত ধরে ইন্দ্রাণী আবার সেই ঘরে যায় যেখানে তুলি ওর ছেলে নিয়ে তখনও আদিখ্যেতা করছে,  পরিকে দেখিয়ে বলে " এই হারটা আমি পরিকে দিয়েছি, আমার তরফ থেকে তোর মেয়েকে উপহার "।

তুলি খুব অবাক হয়ে বলে " এটা তো সোনার,  বেশ বড়, ভরি তিনেক তো হবেই,  এটা তুই ওকে মুখ দেখানি হিসাবে দিলি? 
তোর কি কোনোদিন কাণ্ডজ্ঞান হবে না পিপি!  তুই মেয়েকে  সোনা দিয়ে মুখ দেখলি আর ছেলেকে কিছু না!  আমার শ্বশুর বাড়ি লোকেরা কী বলবে বলতো?  এতটা সোনা একজনকে না দিয়ে তুই এটা দিয়ে দুটো চেন বানাতেই পারতিস "।
ইন্দ্রাণী শুকনো হেসে বলে " পঁয়ত্রিশ বছরেও যখন আমার কাণ্ডজ্ঞান হয় নি তখন আর কখনোই হবে না,  গুড্ডুকে আমি টাকা দেব,  তুই ওর পছন্দমতো জিনিস কিনে দিস, আসলে আমার মনে হয়  গয়নায় আগে মেয়েদেরই  অধিকার , ছেলেদের পরলেও হয় না পরলেও কিছু না,  দেখ দেখি পরিকে কী সুন্দর লাগছে যেন একেবারে সেই ছোটবেলার তুই!  আমি আর থাকতে পারছি না রে , তুই মাকে বা দাদাদের কাউকে বলে দিস যে আমি চলে যাচ্ছি। বিকেলে একটা ট্রেন আছে, ওটাই ধরবো। " হারটা সে এনেছিল তুলির কথা ভেবে,  বিয়ের পরে তুলির সাথে প্রথমবার দেখা হবে তখন উপহার হিসাবে দেবে।  এই তুলিকে তাঁর অচেনা লাগছিল আর যার মধ্যে সে সেই ছোট্ট তুলির ছায়া দেখতে পেয়েছে তাঁকেই হারটা দিয়েছে। 

ফাঁকা ট্রলিটা নিয়ে অবাক তুলির সামনে দিয়ে বাইরে যাওয়ার রাস্তা ধরে ইন্দ্রাণী,  মনে মনে ভাবে " পঁয়ত্রিশ বছরেও  এই বাড়ির এতটুকু পরিবর্তন হলো না, সেই ট্রাডিশন সমানে চলছে,  সেদিন যে ছিল নির্যাতিতা আজ সেই নির্যাতনকারী হিসেবে ফিরে এসেছে।  এই বাড়ির  হাওয়া বাতাসে মান্ধাতার আমলের নারী নির্যাতনের বিষ মিশে আছে,  এখানে  নিঃশ্বাস নিতেও দম বন্ধ হয়ে যায়।  এরা জানতেই পারলো না  পৃথিবীতে কতো দ্রুত পরিবর্তন আসছে,    বাবা তাঁকে বাইরে পড়তে  পাঠিয়েছিলেন বলেই সে এতো সুন্দর একটা জীবনের স্বাদ নিতে পারছে । এটাই তাঁর শেষ আসা এই শহরে,  এই বাড়ি তাঁকে কখনো আপন করে নি, আজ সেও চিরতরে এই বাড়িটিকে পরিত্যাগ করে যাচ্ছে। তাঁর যা কর্তব্যকর্ম সে দূর থেকেই করবে কিন্তু এই বাড়িতে আর নয় !  ফাঁকা একটা রিক্সা পেয়ে ইন্দ্রাণী তাতে চড়ে বসে,  এতক্ষণ পর্যন্ত যে চোখের জলকে সে ধরে রেখেছিল, এইবার  সেই জল তাঁর গাল ভাসিয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় ঝরতে থাকে।   এখানে   একটি মৃত  মানুষেরই ঘাট শ্রাদ্ধ হয় নি, একটি জীবিত মানুষের স্মৃতিকেও  ইন্দ্রাণী  জলে ফেলে দিতে বাধ্য হয়েছে।  সে আর  কখনো পিছন ফিরে  দেখবে না,  সুন্দর সোনালী ভবিষ্যৎ  তাঁর জন্য অপেক্ষা করে রয়েছে ।
.........................

অলঙ্করণ :- সহিষ্ণু কুড়ি

 

অস্ফুট মঞ্জরী - বিদিশা মুখার্জি

 

অস্ফুট মঞ্জরী

বিদিশা মুখার্জি



  (১)

আজ ৩৫তম দিন,আমি মায়ের গর্ভে বাসা বেঁধেছি। এখনও মা আমার আগমনবার্তা সুনিশ্চিতভাবে জানেন না। তবে সকালে উঠে গা-গুলানো ভাব,সবসময় খাবার খেতে অনীহা দেখে আঁচ করেছেন শরীরের বেগতিক অবস্থা। আমি কিন্তু এই অন্ধকার গহ্বরেও বেশ নিশ্চিন্তবোধ করছি,মাতৃজঠর তো সবথেকে নিরাপদস্থান। দুনিয়ার আর কোথাও এমন সুন্দর নয় এই ঘন আঁধার। আজ মা যেন কাকে বললেন

 ''শুভ,মে বি সামথিং রঙ উইথ মি।"

 আমি এখনও জানিনা কে এই শুভ,তবে নিশ্চয় মায়ের খুব আপনজন কেউ হবে,তা না হলে মা নিজের শরীরের খবর ওনাকেই  বা কেন দিচ্ছেন? মনে হচ্ছে উনিই আমার বাবা। আমার এখন খুব ইচ্ছে করছে বাবার গলার আওয়াজ শুনতে।

 (২)

আজ এই ফ্ল‍্যাটের বউটি আমাকে নার্সারি থেকে এনে ওদের ব‍্যালকনিতে রাখা টবে বসিয়েছে। খুব মিষ্টি দেখতে বউটি,সবথেকে যা ওর বেশি আকর্ষণীয় তা হলো ওর গঠনসৌষ্ঠব,দেখলেই মায়ের প্রতিমূর্তি মনে হয়। আমাকে টবের মাটিতে রোপন করে যখন শিকড়ের গোঁড়ায় জল দিচ্ছিলো তার চোখে মুখে এক অপূর্ব স্নেহমাখা আলো খেলা করছিল ,এই আলো সন্তানকে প্রথম কোলে নেওয়ার পর মায়ের চোখেমুখে ফুটে ওঠে। আমি এই টবে আশ্রয় পেয়ে আর মেয়েটির সযত্নস্পর্শ পেয়ে বেশ নিশ্চিন্তবোধ করছি।আমার বুকে লুকিয়ে থাকা কুঁড়ি এবার তার পাপড়ি মেলতে পারবে বউটির সযত্ন লালনে। 

 

 (৩)

আজ মা জানতে পেরেছেন তাঁর শরীরে আমার আবির্ভাব। জানার পরেই আনন্দঘন সুরে সেই নামের ব‍্যক্তিকে ফোন করে বললেন,

 

"শুভ,আমাদের প্রথম সন্তান আসছে জানো!"

আমি এখন নিশ্চিত ওপারের ব‍্যক্তি আমার বাবা, কিন্তু মায়ের উদ্বিগ্ন গলার স্বর শুনে মনে হচ্ছে বাবা হয়তো আমার আসাটা পছন্দ করেননি। মাকে বলতে শুনলাম-

   "শুভ,আমাদের বিয়ে একবছর হয়ে গেছে। এখন তোমার উন্নতিও তো ভালোই হয়েছে । জীবনে এগিয়ে চলার শেষ নেই, তা'বলে প্রথম সন্তানকে বলি দেবো!"

    ওদিকের কথা শুনতে পেলাম না,তবে মায়ের ভাঙাগলায় শুনলাম-

"দিস ইজ নট ফেয়ার,শুভ। ঠিক আছে তুমি বাড়ি এসো,তারপর কথা হবে।"

তারপর দীর্ঘক্ষণ মায়ের কান্নার শব্দ পেলাম, মন খারাপ হয়ে গেলো। বুঝতে পারলাম না ,আমার এই আসাটা বাবার কেনো যে এত অপছন্দ, আমি নিজের ইচ্ছেয় তো আসিনি।

 (৪)

 

এই ক'দিনে এই ব‍্যালকনির টবে থেকেই এদের সংসারটা আমি মোটামুটি বুঝতে পারছি। যে মেয়েটি আমাকে এখানে এনেছে সে এবাড়ির বউ। মেয়েটি সংসারকে খুব ভালোবাসে,  তার সংসার যেন ভালোবাসায় মোড়া থাকে এই প্রচেষ্টা থাকে তার। শ্বশুর, শাশুড়ি, স্বামী আর চব্বিশ ঘন্টার কাজের লোক নিয়েই তার ঘরকন্না। প্রত‍্যেকের প্রতি এতটাই নজর তার যে কাজের মেয়েটিকেও দেখি তার প্রতি অনুরক্ত। ব‍্যালকনিতে রাখা প্রতিটি গাছকে সন্তান স্নেহে যেমন যত্ন করে ,তেমনই ব‍্যালকনিতে উড়ে এসে বসা পাখিদের জন্য জল বা খাবার ও সে তার বাঁধাধরা রুটিন করেছে। তবে গত কয়েকদিন ধরে বউটির চলাফেরায় যেন কেমন শ্লথ-ক্লান্তভাব। মনে হয় ওর মধ‍্যেও আমারই মত আগামীর কুঁড়ি বাসা বেঁধেছে। আমার কুঁড়ির মত সেই কুঁড়িও নিশ্চয় প্রস্ফুটিত হওয়ার আশায় উন্মুখ।

  (৫)

 আজ বাবা-মায়ের প্রচন্ড ঝগড়া শুনে ভয় পাচ্ছি। কাল বাবা ,মা'কে নিয়ে হাসপাতালে গিয়ে আমাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে চান। মা কান্নাকাটি করে শুধু ই অনুনয় করে বলছেন, তার জীবনের প্রথম কলিকে কিছুতেই নষ্ট হতে দেবেন না তিনি। হঠাৎ আমার প্রচন্ড ঝাঁকুনি লাগলো,টাল সামলাতে না পেরে পড়ে যাচ্ছি,আমার সমস্ত বাতাস কে যেন কেড়ে নিলো,আমি প্রবল জলের তোড়ে কোনো দরজা ভেঙে বেরিয়ে যাওয়ার প্রবল চেষ্টা করছি। মায়ের গোঙানি শোনার ক্ষমতা হারালাম আমি।

(৬)

 

কাল রাতের প্রবল ঝড়ে আমার ডালপালা ভেঙে আমাকে নিঃস্ব করেছে, আমার ছোট্ট কলিকে বুক থেকে ছিঁড়ে ঐ টবের নীচে ছুঁড়ে ফেলেছে। সকালের এই রৌদ্রকিরণে রাতের ঝড়ের তান্ডবকে দুঃস্বপ্নের মত মনে হচ্ছে।  আমার মতই বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে এদের বউটিকে, সবাই তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলো। পাশের বাড়ির মহিলাকে কাজের মেয়েটি দুঃখ করে বলছিলো শুনলাম-

 "বড়লোকদের ঘরের ব‍্যাপার গো,নইলে নিজের পোয়াতি বউকে ঠেলে ফেলে নিজের সন্তানকে নিজে মেরে ফেলে একথা কেউ শুনেছে কখনও!"

 কথাগুলো শুনে মনে হলো, শুধু প্রকৃতির বুকেই ঝড়ের তান্ডব হয় না,বন্ধ দরজার ভিতরেও ঝড়ের প্রতাপ প্রবল"।

 ...............................................

 

অলঙ্করণ :- সহিষ্ণু কুড়ি