অয়ন দাস লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
অয়ন দাস লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

ধারাবাহিক - মহাপ্রস্থানের পথে - -অয়ন দাস

 

ধারাবাহিক
 
 
 
 মহাপ্রস্থানের পথে
অয়ন দাস


 
|| ষষ্ঠ  পর্ব  ||

-৩০-

পাটনা থেকে দেরাদুন যাবার ফ্লাইটে বসেছিল শ্রীময়ী আর রাতুল। গতকাল মুকেশ কুমারের খুনের ব্যাপারে লোকাল থানার সাথে শ্রীময়ীর মধ্যস্থতায় কলকাতার পুলিশও জড়িয়ে গেছে। কারণ প্রফেসর নন্দীর হত্যা রহস্য আর মুকেশ কুমারের খুন, অনেকটা একই ছাঁচে মনে হওয়ায় দুটো তদন্ত আলাদা ভাবে না করে একসাথেই করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। গোটা ঘটনার মুখ্য ইনভেস্টিগেটিং অফিসার হিসেবে শ্রীময়ীকে নিযুক্ত করা হয়েছে। একটা খুন যে তাকে এতদূর এমন একটা জটিল রহস্যের সামনে এনে দাঁড় করাবে তাকে তা শ্রীময়ী স্বপ্নেও ভাবেনি।

দেরাদুন যাবার কারণ ডঃ বিধান শর্মার সাথে দেখা করা। ওখানেই ওঁর বসবাস। গতকাল রাতেই ওনার সাথে বিস্তারিত কথা হয়েছিলো এবং পুরো ঘটনা বলার পরই ওনাকে সাবধান করে দেওয়া হয়েছে যাতে কোনোভাবেই অচেনা কারো সাথে অন্তঃত বারো ঘন্টা দেখা না করে। তার মধ্যেই শ্রীময়ীরা ওনার ওখানে পৌঁছে যাবে। তখন সবিস্তারে ওনাকে সমস্ত কিছু ব্যাখ্যা করা যাবে। আর তাছাড়া ওনার কাছ থেকেও বেশ কিছু তথ্য দরকার। তাই যতক্ষণ না শ্রীময়ী এবং রাতুল ডঃ শর্মার বাড়ি পৌঁছচ্ছে, ওনাকে একপ্রকার ঘরবন্দী থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

শ্রীময়ীর পাশেই রাতুল বসে রয়েছে। আসনটাকে আনত করে মাথাটা একটু পিছনে হেলিয়ে দিয়েছে। ঘুমিয়ে পড়লো নাকি! সত্যি ও যে কি করে জড়িয়ে পড়লো এর মধ্যে সেটাই ভাবছিলো শ্রীময়ী। একটা সময় ওদের মধ্যে যে সম্পর্কটা গড়ে উঠতে গিয়েও মাঝপথে কোথায় যেন একটা তাল কেটে গিয়েছিলো, সেই আজ তার সাথে এতটা ওতপ্রোতভাবে এই তদন্তে জড়িয়ে সাহায্য করছে। এই কেসে যদি শ্রীময়ী একটুও এগিয়ে থাকে তাহলে সেখানে অনেকাংশেই রাতুলের একটা কৃতিত্ব রয়েছে।

আলতো করে ওর মাথায় হাত ছোঁয়ায় শ্রীময়ী। রাতুলের চুল গুলো একটু এলোমেলো করে দেয়। ওর কোনো সাড়া শব্দই নেই। অঘোরে ঘুমিয়ে পড়েছে। আজ এতদিন পর ওর জন্য কোথাও একটা মারাত্মক টান অনুভব করে। যেন মনে হয় রাতুলকে আঁকড়ে বোধহয় আবার স্বপ্ন দেখতে পারে সে। এবারে কিছুতেই সম্পর্কটাকে দূরে ঠেলে দিতে মন চায় না।

পরক্ষণেই কোনো এক অজানা ভয় এসে চেপে ধরে শ্রীময়ীকে। বাবার কথা মনে পড়ে যায়। কতদিন মানুষটাকে দেখেই নি সে। বছর খানেক আগে যখন হঠাৎ করেই হারিয়ে গিয়েছিলেন শুধু একটা চিঠি রেখে গিয়েছিলেন শ্রীময়ীর জন্য। বড় ভাষা ভাষা ছিল সে চিঠি-
" তোমার জন্য রেখে যাচ্ছি একটা সুন্দর ভবিষ্যত। এতগুলো দিন যে তোমায় আঁকড়ে রেখেছি, এবার খানিক নিশ্চিন্ত হতে পেরেছি যে তুমি নিজেই নিজের আত্মরক্ষা করতে সক্ষম। এবার আমি চললাম মহাপ্রস্থানের পথে, এক মহার্ঘ্য কে সঙ্গে নিয়ে। উদ্দেশ্য একটা পরম্পরাকে আজীবন সুরক্ষিত করে যাওয়া। জানিনা আর দেখা হবে কিনা, তবে এটুকু বলে যাই সৎপথে থেকো, দেশের স্বার্থে দশের জন্য নিজেকে সমর্পণ করো।"

এ লেখা সে অনেকবার পড়েছে। মাথামুন্ডু বোঝেনি। কী সেই বিশ্বাস যা তাঁকে সুরক্ষিত করতে এমন ভাবে চলে যেতে হলো। 'মহাপ্রস্থান'- শব্দটা খুব চেনা। মহাভারতে পাণ্ডবরা সমস্ত দায়িত্ব ভার তাদের উত্তর পুরুষের হাতে তুলে দিয়ে হিমালয়ের পথে চলে গিয়েছিল। কিন্তু তার বাবা কেন এরকমটা লিখলেন? আর মহার্ঘ্য বলতে ঠিক বোঝাতে চেয়েছেন, এসব বহু চেষ্টা করেও কোনো অর্থ খুঁজে পায়নি শ্রীময়ী।

-" কীরে কী এত ভাবছিস ?", রাতুলের প্রশ্নে চমকে ওঠে শ্রীময়ী। ওর এতক্ষণে ঘুম ভাঙলো।
-" না কিছুনা। তোর ঘুম হলো ?", মিষ্টি করে হেসে জিজ্ঞেস করলো শ্রীময়ী। ওর এই হাসিটা সত্যি মন কেড়ে নেয় যেন।
-" হ্যাঁ ভালোই হলো একচোট। আর বোধহয় বেশিক্ষণ নেই ল্যান্ড করতে ?", একটু আড়মোড়া ভেঙে বললো রাতুল।
-" আধঘন্টা মতো আছে।"
-" হুম, কি অদ্ভুত তাই না রে শ্রী ?"
-" কোনটা অদ্ভুত ?"
-" এই যে এমন একটা তদন্তে যাচ্ছি যেটার সাথে মহাভারত, ভগবদগীতা সব মিলে মিশে একাকার হয়ে আছে আর যে ফ্লাইটে এখন যাচ্ছি তার নম্বর খানাও কি অদ্ভুত ভাবে মিলে মিশে যাচ্ছে এসবের সাথে!", নিজের বোর্ডিং পাশ টা কোলের ওপরে রাখা ছিলো রাতুলের, সেদিকে তাকিয়েই কথা গুলো বললো রাতুল। "
-" মানে ? এর সাথে ফ্লাইট নম্বরের কি সম্পর্ক ?", জিজ্ঞেস করলো শ্রীময়ী।
রাতুল একটু ভেবে নিয়ে বললো, " 6E, 0108- এটাই নম্বর তো ?"
-" হ্যাঁ, কিন্তু...", শ্রীময়ী কে শেষ করতে না দিয়েই রাতুল বললো, " 1080 সংখ্যা টা খুব চেনা চেনা মনে হচ্ছে না ?"
-" মহাভারতের দিক থেকে দেখলে শ্রীকৃষ্ণের ১০৮ নাম মনে আসে।"
-" হ্যাঁ। ঠিক তাই। এই ১০৮ সংখ্যাটি খুব পবিত্র ধরা হয় বুঝলি। পৃথিবী আর সূর্যের মধ্যে যা দূরত্ব তা ঠিক সূর্যের ব্যাসের ১০৮ গুণ। আবার চাঁদ আর পৃথিবীর দূরত্ব হলো চাঁদের ব্যাসের ১০৮ গুণ। এবার এই ১ আর ৮ যোগ করলে দাঁড়ায় ৯ যা বৈদিক যুগে সর্বোত্তম সংখ্যা হিসেবে ধরা হতো। সে যুগে অনেক কিছুই ১ আর ৮ দিয়ে চিহ্নিত করা হতো। যেমন মহাভারতে ১৮ টি পর্ব। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ ১৮ দিন ধরে হয়েছিলো। এরকম কত হাজারো ব্যাখ্যা সংখ্যাতত্ত্ব দিয়ে নির্ণয় করা যায়। কাজেই এসব কে কি নিছক গল্প গুজব বলে ঠাওড়ানো যায় ?"

রাতুলের এই অসাধারণ বিশ্লেষণ শ্রীময়ীকে শুধু মুগ্ধই করলো না, ওর এই ব্যাখ্যা যেন এই কেসটাকে নতুন ভাবে চিনতে শেখাল শ্রীময়ীকে।

শ্রীময়ী চুপ করে শুনে গেলো কথাগুলো। হঠাৎই ওর একটা কথা মনে এলো। প্রফেসর নন্দীর বাড়ির ঠিকানাটার মধ্যেও কি অদ্ভুত সমাপতন। বাড়ির নাম 'পাঞ্চজন্য', মানে শ্রীকৃষ্ণের শঙ্খের নাম, আর সেটা অবস্থিত '১০/৮, আর ব্যানার্জি রোড'- ১০/৮ ; এখানেও সেই ১০৮ সংখ্যাটা কি কাকতলীয় ভাবেই না এসেছে।

এখন আর এটাকে শুধুই কোনো হত্যা রহস্য বলে ভাবতে পারা যাচ্ছে না। এর মধ্যে ঢুকে গেছে ইতিহাস, পুরাণ সব কিছু। নিছক সিরিয়াল কিলিং বলে ভাবতে শুরু করেও, রাতুলের এই কথাগুলো শুনে হোঁচট খেলো শ্রীময়ী।

-৩১-

দেরদুন এয়ারপোর্ট থেকে ডঃ বিধান শর্মার বাড়ি মাইল তিনেক মতো হবে। ওদের গাড়ি যখন ঢুকছে ডঃ শর্মার বাড়ি তখন বেলা পড়ে এসেছে অনেকটা। শ্রীময়ী গাড়ি থেকে নামতে না নামতেই ফোন করলো ডঃ শর্মাকে, যাতে উনি নির্দ্বিধায় দরজা খুলতে পারেন। উনি বোধহয় ফোনের জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। প্রায় একরকম ছুটে এসেই দরজা খুললেন। শ্রীময়ী পরিচয় পত্র দেখিয়ে যখন ভেতরে এলো, ওনার বাড়ির মিউজিক্যাল ঘড়িতে দুপুর তিনটে বাজছে।

দেরাদুনে এর আগে রাতুল বা শ্রীময়ীর কেউই আগে আসেনি। রাতুল একবার হরিদ্বার এসেছিল বটে, কিন্তু উত্তরাখণ্ড বলতে ওই শেষ আসা। তাছাড়া খুব একটা এ চত্বরে আসেনি কোনোদিন। এদিকটা ওয়েদার বড় মনোরম। গরমও নেই। আবার ঠিক ঠাণ্ডাও বলা যায় না।


-" আচ্ছা পঁচিশ বছর আগে গুজরাটের লোথালে ঠিক কি হয়েছিলো বলুন তো ডঃ শর্মা ? দয়া করে কোনো কথা গোপন করবেন না। এর আগে পরপর দুটো খুন হয়ে গেছে। ঈশ্বর না করুন তৃতীয় ভিকটিম হবার সম্ভাবনা কিন্তু আপনার ওপরেই প্রবল ভাবে বর্তায়। কাজেই কো- অপারেট করুন প্লিজ", শ্রীময়ী ডঃ শর্মার উদ্দেশ্যে কথাগুলো বললো।

সন্ধ্যায় ডঃ শর্মার বাড়িতে একটা গভীর আলোচনায় তিনজনেই মগ্ন ছিলো। বাইরের অজানা বিপদ কখন যে ওঁৎ পেতে বসে থাকবে কেউ জানে না। সময়মতো বিধান বাবুর বাড়িতে আসতে পেরেছে ওরা এটাই অনেকটা নিশ্চিন্তির বিষয়।

শ্রীময়ীর প্রশ্নের উত্তরে ডঃ শর্মা একটু থম মেরে বসে রইলেন খানিক। শ্রীময়ী আবারো জিজ্ঞেস করলো, " দয়া করে বলুন। এই কেসটা আর পাঁচটা সাধারণ কেসের মতো নয় কিন্তু। আপনার কাছ থেকে কথাগুলো জানা দরকার স্যার।"

ডঃ শর্মা একটু মনে করার চেষ্টা করলেন। তারপর বলতে লাগলেন-
" পঁচিশটা বছর বড় কম সময় নয়। কিন্তু সেসব ঘটনা বার বার মন থেকে দূর করতে চাইলেও ভুলতে পারিনি। লোথালে আমরা গিয়েছিলাম মোহেঞ্জোদারোর কিছু অবশেষ দেখতে। নতুন করে পারমিশন নিয়ে খোঁড়াখুঁড়ি শুরু হয়েছিলো। আমি, মুকেশ আর জনার্দন পুরোভাগে ছিলাম এই অভিযানে।"
-" তারপর ?", শ্রীময়ী জিজ্ঞেস করলো।
-" সেই কাজের সূত্রে আমাদের সাথে আলাপ হয় ভূদেব সিংয়ের সাথে। উনিও আমাদের কাজে সহায়তা করছিলেন। ব্যক্তিগতভাবে উনি জনার্দনের পূর্ব পরিচিত ছিলেন। আমার সাথে সেই আমার প্রথম দেখা।"
-" আচ্ছা আপনারা কি কোনো পোড়ামাটির ফলক নিয়ে গবেষণা করছিলেন, মানে এমন একটা ফলক যাতে কৃষ্ণার্জুনের রথচিত্র খোদাই করা?"

ডঃ শর্মা একটু অবাক হয়েই তাকালেন দুজনের দিকে।

-" আপনারা তাহলে জানেন যে ব্যাপারে। দেখুন প্রথমে আমি কিছুই জানতাম না। পরে ভূদেব সিং নিজেই দেখিয়েছিল সেটা। ওটা নাকি ওদের বংশের অভিজ্ঞান। ভূদেব সিং ও তার পরিবার বহু বছর ধরে রক্ষা করে এসেছে সেই ফলকটাকে।"
-" কিন্তু এটার এত গুরুত্বপূর্ণ হবার কারণ কি ?", রাতুল জানতে চাইলো।

ডঃ শর্মা বললেন, "তার আগে বলি মহাভারতের যুদ্ধের পর আর্যাবর্তে অর্জুন পৌত্র পরীক্ষিত এবং তার বংশধরেরা প্রধানত শাসন চালিয়ে যেতে থাকে এটা বোধহয় অনেকেই জানেন। কিন্তু এটা কি আপনাদের জানা আছে যে পরবর্তী কালে আরো একটি জনজাতি, পরীক্ষিত এবং তাঁর বংশধরদের সর্বোতভাবে সাহায্য করে যায় শাসনক্ষেত্রে এবং যুদ্ধক্ষেত্রে।
এঁরা হলেন মহান কর্ণের বংশধরেরা। হ্যাঁ মহানই বটে। মহাভারতের শ্ৰেষ্ঠ যোদ্ধা আমি মনে করি অর্জুন নয়, তিনি হলেন কর্ণ। শুধু ভাগ্যের পরিহাস আর রাজনৈতিক স্বজনপোষনের স্বীকার হয়ে যাঁর নায়ক হয়ে ওঠা হয়নি।
সেই কর্ণের বংশধরেরা যুগ যুগ ধরে একটা সত্য নিজেদের কাছে লুকিয়ে আসছে। সে এমন এক নিগূঢ় জ্ঞান, এক অসামান্য বীজমন্ত্র যা শুধু বংশ পরম্পরায় তাদের কাছেই গচ্ছিত রয়েছে। এর প্রয়োগে গোটা বিশ্ব করায়ত্ত হওয়া সম্ভব।"
-" আদপে সেটা কিসের বীজমন্ত্র ছিলো ?"
-" আপনারা ব্রহ্মশির অস্ত্রের নাম শুনেছেন, যা  মহাভারতে অশ্বথামা প্রয়োগ করে পাণ্ডবদের সমূলে ধ্বংস করতে চেয়েছিল। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ সেটা রুখে দিয়ে নতুন করে গোটা পৃথিবীর জীবনদান করেছিলেন। পরবর্তী কালে এই অস্ত্রের
জ্ঞান শ্রীকৃষ্ণ প্ৰদান করে যান কর্ণের পুত্র বৃষকেতুকে। তারপর থেকে সেই জ্ঞান বা বীজমন্ত্রটি অঙ্গরাজ কর্ণের প্রতিটি বংশধরেরা সযত্নে রক্ষা করে আসছে পারিবারিক একটি অভিজ্ঞানের দ্বারা। এই ফলকটা হলো সেই অভিজ্ঞান। এর মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে সেই বীজমন্ত্র যা ওই অমোঘ অস্ত্রের প্রয়োগ করতে ব্যবহৃত হয়। ওই সঙ্কেত আর ছবি সেটাই নির্দেশ করে। আর এই 'ঢিলোঁ' সম্প্রদায়ের লোকজন হলো অঙ্গরাজ কর্ণের বংশধর। একথা কিন্তু ঐতিহাসিক ভাবে সত্য।"
-" কিন্তু তা কী করে সম্ভব ? মানে সেযুগে কি ফলকে খোদাই করে রাখার চল ছিলো ? সবটাই তো হতো মুখে মুখে শুনে"।
-" না সেযুগে ছিলো না। কিন্তু পরবর্তী কালে খোদাই করা হয় যাতে কালের গর্ভে হারিয়ে না যায়। পরম্পরাকে অক্ষত রাখাই মুখ্য উদ্দেশ্য। হাজার হোক এ আমাদের এক সোনালী ইতিহাসের স্বাক্ষর। কোনো পশ্চিমী আরোপিত ধারণা নয়, সেটা প্রমাণ করবার জন্যই এই ফলকের নির্মাণ করা হয়েছিলো বলে আমি মনে করি।"

এবারে শ্রীময়ী প্রশ্ন করলো, " কিন্তু কর্ণর বংশধরেরাই কেন ? অন্য কেউ নয় কেন ?"

ডঃ শর্মা বললেন, " কারণ তিনিই তো জ্যেষ্ঠ পাণ্ডব। তাই তাঁর পুত্রদেরই এই জ্ঞান প্রদান করে যাওয়া হয়। পরবর্তী কালে কুরু পাণ্ডবদের বংশধরেরা কালের গর্ভে হারিয়ে গেলেও 'ঢিলোঁ' রা কিন্তু সগৌরবে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে। এরা যোদ্ধা হিসেবে ছিলো অতুলনীয়। এমনকী ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে এই 'ঢিলোঁ' সম্প্রদায়ের লোকজন যে বিদ্রোহ গড়ে তোলে তা বলতে গেলে ইংরেজদের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছিলো। কাজেই ইতিহাসে এদের গুরুত্ব অনেক। দিল্লী শহরের নামকরণ তো এঁরাই করেছিলেন।
'ঢিলোঁ' বংশের এক রাজা ঢিল্লু তৎকালীন ইন্দ্রপ্রস্থের কাছে 'ঢিল্লি' শহরের ব্যুৎপত্তি ঘটান যা আজকের দিল্লী নামে পরিচিত।
আর কি অদ্ভুত ব্যাপার, ভারতবর্ষের সর্বশেষ এবং বর্তমান রাজধানী সেই দিল্লীই হয়ে গেল শেষমেশ।"

-৩২-

রাতুল এতক্ষণ মন দিয়ে সবটা শুনছিলো। এবারে জিজ্ঞেস করলো, " সবই তো বুঝলাম, কিন্তু ভূদেব সিংয়ের কাছে এই ফলকটা এলো কীভাবে ?"
-" ভূদেব সিং এই বংশেরই লোক। কাজেই ওনার কাছে এরকম কোন ফলক থাকাটা মোটেই আশ্চর্যের না।"

শ্রীময়ী সবটা শুনে প্রশ্ন করলো, " আচ্ছা একটা নিউজ দেখেছিলাম লোথালে নাকি একটা ভয়াবহ অগ্নিকান্ড ঘটে, সেই ব্যাপারে একটু আলোকপাত করতে পারেন।"
-" দেখুন ওটা আমার মতে পুরোটাই ইচ্ছে করে ঘটানো হয়েছিলো। ওই ফলকটার ব্যাপারে একটু বেশি জানাজানি হয়ে যাওয়ার ফলেই ওটা ঘটানো হয়", বেশ স্পষ্ট করেই কথা গুলো জানালেন ডঃ শর্মা।
-" কে এরকম ঘটিয়েছিল বলে মনে হয় আপনার ?"
-" ওই ট্রিপ টায় একজন সাংবাদিক ছায়ার মতো লেগেছিলো আমাদের সাথে। মূল উদ্দেশ্য অবশ্য ছিলো একটা স্টোরি করবার। কিন্তু ফলকটার কথা জানতে পেরে, ওটার ঐতিহাসিক গুরুত্ব সম্বন্ধে জানতে পেরে সেটা হাতানোর জন্য সবরকম চেষ্টা করেছিল। সরাসরি প্রমাণ আমার কাছে নেই। কিন্তু আমি জানি ওটার প্রতি ওনার কী পরিমাণ লোভ ছিলো। সেই জন্যই আগুন লাগিয়ে একটা ম্যাসাকার করে ফাঁক তালে ফলকটা নিয়ে নেবার একটা প্ল্যান বানিয়েছিল। "
-" তাহলে ফলকটার কী হলো শেষ অব্দি?", প্রশ্ন করলো রাতুল।
-" সুশান্ত বাবু শেষ অবধি ওটার নাগাল পায়নি। সেই অগ্নিকুন্ড থেকে আমরা তিনজন কোনক্রমে রক্ষা পাই। জনার্দন প্রানের ঝুঁকি নিয়ে ফলকটিকে উদ্ধার করেছিলো। শুধু একটাই আক্ষেপ, ভূদেব সিং আর তার স্ত্রী দুজনেই সেখানে তখন উপস্থিত ছিলো। ওদের আমরা বাঁচাতে পারিনি। আর সুশান্ত বাবু ততক্ষণে গায়েব হয়ে গিয়েছিলেন কোনো কিছুই করতে না পেরে।"

শ্রীময়ী অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো, " কিন্তু সুশান্ত বাবু যে বললেন ওখানে আপনাদের মধ্যে কোনো অশান্তি হয়েছিলো, আপনারা নাকি জোর করে ফলকটা নেবার চেষ্টা করেছিলেন, বলে..."
-" মিথ্যে কথা, ওই লোকটা অত্যন্ত ঝানু। এসব কিছু বানিয়ে বলেছে। ওই এসবের পেছনে রয়েছে। কর মতো দুমুখো সাপ আর দুটি নেই। ওখান থেকে ফেরত আসার পরও বহুদিন ছিনে জোঁকের মতো লেগেছিলো আমাদের পেছনে, শেষমেশ কিছু উদ্ধার করতে না পেরে হাল ছেড়ে দেয়।"
-" বুঝলাম। তারপর কী হলো?"
-" জনার্দন বেশ কিছুদিন ওটা নিজের কাছেই রেখে দিয়েছিলো। ওটার নিরাপত্তা নিয়ে এতটাই চিন্তিত ছিলো যে কোনো এক জায়গায় বেশিদিন থাকতো না, পাছে ওটার ওপর কোনো বিপদ আসে। তার ওপর সুশান্ত যেভাবে পেছনে লাগে ওটা কাছে রাখা আর সেফ ছিলো না। শেষমেশ ও ওটার যোগ্য উত্তরাধিকারী কেই সমর্পণ করে দেয় ফলকটা।"
-" কার কাছে?", অধীর আগ্রহে জিজ্ঞেস করে শ্রীময়ী।
-" ভূদেব সিংয়ের বোন উমার কাছে। সে তখন কলকাতাতেই থাকতো।"
-" কী নাম বললেন উমা !" চমকে ওঠে শ্রীময়ী।
-" হ্যাঁ, উমা আর ওর স্বামী সযত্নে সেটাকে রক্ষা করে কিছু কাল, তারপর উমা মারা যাবার পর থেকে সেটা ওর স্বামীর কাছেই আছে।"

শ্রীময়ীকে হঠাৎ করে প্রচন্ড উত্তেজিত লাগছে যেন। চোখ দুটো স্থির ভাবে তাকিয়ে ডঃ শর্মার দিকে। রাতুল ওর মধ্যে এই পরিবর্তনটা দেখে বেশ অবাক হয়ে গেলো।

শ্রীময়ী জিজ্ঞেস করলো, " এই ভূদেব সিংয়ের নিজের বোন উমা, এনার স্বামীর নামটা কী ছিলো জানতে পারি ?"
-" কলকাতার একজন নাম করা সায়েন্টিস্ট ডঃ শঙ্কর ব্যানার্জি।"

-৩৩-

-" ওরা যে এখানে এসেছে সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত", বৃষকেতু কথা বলছিল ফোনে। ওপাশের গলাটা আজ স্বাভাবিকের থেকে একটু যেন বেশি উদ্বেগপূর্ন। চিন্তিত স্বরে বললেন বৃষকেতুর এই ধর্মযুদ্ধের নেপথ্যে থাকা সারথি, " তাহলে সেই সুযোগটা নিও তুমি। মনে রেখো ওরা এতদূর যখন আসতে পেরেছে ওদের অগ্রাহ্য করাটা কিন্তু মুর্খামি হবে।"
-" তাহলে ?"
-" আমি চাই এবারে তুমি পুরো বিষয়টা নিয়ে ভাবনা চিন্তা করো। আমার দেরাদুন পৌঁছতে মধ্যরাত হয়ে যাবে। তার মধ্যে ওদের প্রত্যেকটি মুভমেন্ট আমার জানা দরকার। সেই মতো আমি দেরদুন থেকে রওনা হবো। সময় মতো তোমার সাথে আমার মোলাকাত হবে। জেনে রেখো, এটাই অন্তিম সুযোগ। বিধান শর্মার কাছ থেকে যাবতীয় তথ্য নিয়ে সরাসরি যুদ্ধে নামতে হবে বৃষকেতু। তোমার পরিবারের ধ্বংসের কারণ হিসেবে শুধুমাত্র এই লোকটিই বাকি রয়েছে। বাকিদের কর্মফল তাদের নিজ গন্তব্যে নিয়ে গেছে। একমাত্র ডঃ শর্মাই বলতে পারবে ফলকটা এই মুহূর্তে কোথায় এবং কার কাছে রয়েছে। ওটা যেভাবে হোক হস্তগত করতেই হবে। সময় খুব বেশি আর আর হাতে নেই।"
-" ঠিক আছে। আমি সময়মতো সব আপনাকে জানাচ্ছি।"
-" ঈশ্বর তোমার সহায় হোন।"

ফোনটা রেখে এগিয়ে গেলেন সুশান্ত সেনগুপ্ত। দিল্লী এয়ারপোর্টে এসেই বৃষকেতুর সাথে কথা বলে নেওয়াটা জরুরী ছিলো, কারণ এরপরের পদক্ষেপটা হয়তো বৃষকেতুকে একাই নিতে হবে। যতক্ষণ বিধান শর্মা জীবিত আছেন কোনো ভাবেই তাঁর সামনে আসা চলবে না। তাহলে এতদিন তিল তিল করে গড়ে ওঠা এত পরিকল্পনা সবকিছু ভেস্তে যাবে। সেটা কিছুতেই হতে দিতে পারেন না সুশান্ত সেনগুপ্ত। পঁচিশ বছর আগে খালি হাতেই ফিরতে হয়েছিল। এবার আর কোনো ভুল করবেন না। কিছুতেই না। বৃষকেতুকে তুরুপ করে এতদিন ঘুঁটি সাজিয়েছেন তিনি। পন্ডশ্রম হতে দিতে পারেন না কিছুতেই।

ইতিমধ্যে তাঁর ফ্লাইটের ঘোষণা হয়ে গেছে। দেরাদুনগামী বিমান যে টার্মিনাল থেকে ছাড়বে সেদিকেই এগিয়ে গেলেন তিনি।

-৩৪-

-" হোয়াট! কী বলছেন আপনি ?", শ্রীময়ী মুহূর্তের মধ্যে উত্তেজিত হয়ে উঠলো ডঃ শর্মার কাছে নিজের বাবার নাম শুনে। ওর চোখদুটো লাল হবে গেছে সব কথা শুনে, " এ হতেই পারে না, আপনি মিথ্যে বলছেন।"

ডঃ শর্মাও অবাক হয়ে গেছেন। বললেন, " মিথ্যে বলবো কেন। শঙ্করকে আমি অনেক দিন ধরে চিনি। উমার সাথে ওর বিয়ের পর আমরা একসাথে কত আড্ডা মেরেছি, সেসব দিনগুলো আজ ভুলতে পারিনা। মেয়ের জন্ম দিতে গিয়ে উমা যেদিন মারা যায়, শঙ্করের সেই কান্না আজও আমায় বিহ্বল করে দেয়। এসব যে সত্যি কথা এর কী প্রমাণ আপনাকে দি বলুন তো, যদি আপনার বিশ্বাস না হয়।"

শ্রীময়ী তখনো স্বাভাবিক হয়নি। ওর মধ্যে আবেগের এমন বহিঃপ্রকাশ ডঃ শর্মাকে বিভ্রান্ত করে দেয়। উনি ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন খানিক।

খানিকটা পর ধাতস্থ হলো শ্রীময়ী। তারপর চোখের কোণ থেকে গড়িয়ে আসা অশ্রুবিন্দুটা নিজের হাতেই মুছে নিয়ে বললো, " সরি, আমি একটু এক্সাইটেড হয়ে পড়েছিলাম। আপনি বোধহয় জানেন না যে ডঃ শঙ্কর ব্যানার্জি আমার বাবা। আমার সবথেকে আপনজন। আর মায়ের নামটুকুই জানি খালি। উমা। ওই জন্যই তো বাবা আমার নাম রাখেন শ্রীময়ী।
কয়েকটা ছবি ছাড়া ওনার কোনো স্মৃতি আমার কাছে নেই।"
-" না না না সরি কিসের বেটি। তুমি বোধহয় আমায় চিনতেই পারো নি। চেনার কথাও নয় যদিও। শঙ্করের সাথে আমার পরিচয় অনেকদিনের। তোমাদের বাড়ি গেছি বেশ কয়েকবার। আমারই ভুল যে সেই ছোট্ট মেয়েটা আজ এতবড় হয়ে গেছে যে চিনতেই পারিনি", বলে সস্নেহে শ্রীময়ীর মাথায় হাত রাখলেন ডঃ শর্মা।

শ্রীময়ী আর ধরে রাখতে পারল না নিজেকে। ঝর ঝর করে কেঁদে ফেললো। একটাই কথা অস্ফুটে বলতে লাগলো বারবার, " বাবা যে আজ প্রায় বছর খানেক নিখোঁজ। কোন খোঁজ আমি পাইনি হাজার চেষ্টা করেও। কিন্তু স্বপ্নেও এটা ভাবিনি যে এই কেসের সমাধান করতে এসে আমায় শেষ পর্যন্ত বাবার সম্মুখীন হতে হবে। কে জানে কোথায় আছে মানুষটা।"

তারপর শ্রীময়ী এক এক করে ওর বাবার চলে যাওয়া, শেষ চিঠিটার কথা সব বললো। ডঃ শর্মা সব শুনে বললেন, " তার মানে যে মহার্ঘ্য টিকে নিয়ে গেছেন উনি, সেটা ওই দুর্মূল্য ফলকটাই। ওটার নিরাপত্তা নে সমস্ত ব্যক্তিগত স্বার্থের ঊর্ধে সেটা শঙ্কর ছাড়া কেই বা ভালো বুঝবে।"
-" কিন্তু কেন ? নিয়ে গেছেন কেন ? আর কোথায়ই গেছেন ? কিছুই তো জানি না আমি শর্মা আঙ্কেল। বাবার কোনো খবরই আমার কাছে যে নেই", সজল চোখে বললো শ্রীময়ী।
-" আমায় বেশ কিছুদিন আগে একটা লেটার পাঠিয়েছিল। ফোন নম্বর ছিলো না আমার কাছে, কাজেই সেভাবে যোগাযোগ আর হয়ে ওঠেনি শেষের দিকে। ওয়েট আমি চিঠিটা নিয়ে আসছি।"

রাতুল আর শ্রীময়ী কে বসতে বলে ডঃ শর্মা নিজের স্টাডিরুমের দিকে এগিয়ে গেলেন চিঠিটার খোঁজে...।




|| সপ্তম   পর্ব  ||


-৩৫-

একটু পরেই ডঃ শর্মা নিজের স্টাডিরুম থেকে শঙ্কর বাবুর পাঠানো চিঠিটা নিয়ে এসে দেখালেন ওদের। তেমন কিছু লেখা নেই। শুধুই কিছু খবরাখবর নেওয়ার কথা রয়েছে। আর ওঁর নিজের মেয়ের জন্য উদ্বেগ ধরা পড়েছে প্রতিটি ছত্রে। কেমন আছে সে, কী করছে এসব নিয়ে শঙ্কর বাবুর উদ্বেগের অন্ত ছিলো না।
আসলে ওনার ফিরে আসার কোনো উপায় ছিলো না। তার একটা বড় কারণ ওই ফলকটা সঙ্গে থাকলে ওনার এবং ওনার পরিবারের ওপরে সঙ্কট আসতে পারে। সেই জন্যই এই অজ্ঞাতবাস।

চিঠিটা পড়ে শ্রীময়ী কিছুক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। চোখের কোণে জলের রেখাটা দেখতে পেলো রাতুল। সে শ্রীময়ীর পাশে এসে দাঁড়ালো। বললো, " চিন্তা করিস না শ্রী। এতদূর যখন এসেছি এর শেষ দেখেই ছাড়বো। আর সম্ভব হলে সেই সাথে তোর বাবার খোঁজটুকুও অবশ্যই নিয়ে আসবো। কথা দিলাম।"

মুখটা তুলে একবার তাকালো শ্রীময়ী। ওর চোখ দুটো ভেজা। কাঁদছে না, কিন্তু গভীর এক দৃষ্টি সে চোখে। আজ ওর পাশে ওর বাবা না থাকলেও এমন মানুষেরা আছেন যারা ওকে ভরসা দিতে পারে, এগিয়ে যাবার প্রেরণা দিতে পারে। এটাই অনেক নয় কি !

-" আচ্ছা এই চিঠিটা যে ঠিকানা থেকে এসেছে, সেখানে একবার খোঁজ করলে হয় না ?", জিজ্ঞেস করলো রাতুল।
-" এড্রেসটা বলছে তালুকা গ্রাম উত্তরাখণ্ডে। এখান থেকে মোটামুটি একশো পঁচিশ মাইল হবে জায়গাটা।"
-" তাহলে তো কাল ভোর ভোর রওনা হলে সন্ধ্যের মধ্যে পৌঁছে যেতে পারি। কারণ এই হত্যালীলা বন্ধ করতে বা অপরাধীকে ধরতে হলে ওনার কাছে পৌঁছনো আবশ্যক। কী বলেন ডঃ শর্মা ?", জানতে চাইলো রাতুল।
-" গুড আইডিয়া। কালই বেরিয়ে পড়া যাক তাহলে", বলে উঠলেন ডঃ শর্মা।

শ্রীময়ীও ঘাড় নেড়ে সায় দিলো। কিছু বললো না মুখে। ওই একমাত্র জানে ওর মনের মধ্যে কী চলছে।

দেরাদুন শহরে রাত নেমেছে। এখনো অনেকটা পথ যেতে হবে। রহস্যময় উপত্যকা আজ বড় নিস্তব্ধ, চুপচাপ। কেউ জানে না কী হতে চলেছে। শুধু এক নতুন ভবিষ্যৎ যেন উঁকি মারে নক্ষত্র খচিত আকাশের কালো পর্দা সরিয়ে।

স্বপ্নেরা কখনো মরে না। জেগে থাকে নিদ্রাহীন ভাবে।

-৩৬-

ঠিক সকাল সাড়ে ছটা নাগাদ গাড়ি এসে পড়লো। ড্রাইভার মুকুন্দ রাঠোর আগের দিনই রাতুলদের দেরাদুন এয়ারপোর্ট থেকে ডঃ শর্মার বাড়ি নিয়ে এসেছিলো। রাতুল ওনার ফোন নম্বরটা নিয়ে রেখেছিলো। তাই আগেরদিন রাতেই ওকে বলে দেওয়ায় একদম সময়মতো এসে উপস্থিত হলো।
প্রত্যেকে তৈরি হয়েই ছিলো। বেশ খানিকটা খাবার দাবার সঙ্গে নিয়ে নিলো সবাই। এতটা দীর্ঘ পথ যেতে হবে, বলা যায় না পথে কখন কোথায় কী হয়।

শ্রীময়ী সকাল থেকেই মাঝে মাঝে উদাস হয়ে যাচ্ছে, আবার পরক্ষনেই চঞ্চল হয়ে পড়ছে। সেটা কি এতদিন পর বাবাকে খুঁজে পাওয়ার উত্তেজনা নাকি এই দুর্দান্ত কেসের পরিসমাপ্তির পথে যেতে পারার আনন্দ বোঝা যাচ্ছে না। সেই সাথে নিজের একটা অন্য পরিচয় পাবার মত অনন্য ব্যাপারও রয়েছে।

'ঢিলোঁ' সম্প্রদায়ের রক্ত তার গায়েও বইছে, যাদের আদপে মহান কর্ণের বংশধর বলা হয়ে থাকে। সূর্যদেবের বংশধর বলেই কি ভোরের ওই রক্তবর্ণ দিবাকর অত প্রিয় তার ? সূর্যপ্রণামে খুঁজে পায় এক নিবিড় সান্ত্বনা। কি আশ্চর্য এই কালচক্র যা মহাভারত আর বর্তমান সময়কে মিলিয়ে দিচ্ছে নির্বিশেষে!

হঠাৎ মোবাইলটা বেজে উঠতেই ভাবনায় ছেদ পড়লো শ্রীময়ীর। বাংলায় কথোপকথন হচ্ছে দেখে রাতুল বুঝতে পারলো সম্ভবত কলকাতার অফিস থেকে কোনো ইনফরমেশন আছে। কিছুক্ষণ কথাবার্তা হবার পর শ্রীময়ীর চোয়ালদুটো শক্ত হয়ে হয়ে এলো। মিনিটখানেক পর, " ঠিক আছে দেখছি আমি", বলে ফোনটা কেটে দিয়ে বাইরের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।

-" কী ব্যাপার রে, এনি প্রবলেম ?", রাতুল জিজ্ঞেস করলো।
ডঃ শর্মাও উদগ্রীব হয়ে তাকিয়ে আছে শ্রীময়ীর দিকে।

খানিকক্ষণ পর শ্রীময়ী বলে উঠলো, " ওই স্কাউন্দ্রেল সুশান্ত পুরোপুরি মিথ্যে বলেছিলো। ওর ওসব অসুস্থতা একটা ভণিতা মাত্র। আমার সোর্স বলছে ও ফ্লাইটের টিকিট কেটে দেরাদুন এসেছে। ডঃ শর্মা মিথ্যে বলছেন না।
শুধু তাই নয়, ও নাকি গত কয়েক বছরে মাঝে মাঝেই গুজরাট গেছে। এয়ারপোর্টের রেকর্ড তাই বলছে।
আমাদের সব মুভমেন্ট ও ফলো করে যাচ্ছে। খারাপ উদ্দেশ্য না থাকলে কেউ এরকম ফলো করবে না, অন্তঃত মিথ্যে বলে তো নয়ই। কিন্তু খবর পাচ্ছে কি করে ? কে ওর হয়ে কাজ করছে ?"
-" নান আদার দ্যান বৃষকেতু সিং ওরফে বিকাশ যে দু দুটো খুন করে এখন হয়তো ডঃ শর্মার উদ্দেশ্যে ধাওয়া করেছে। আমি নিশ্চিত ও আর ভূদেব সিংয়ের ছেলে একই লোক। এখন বুঝতে পারছি ওই শ্লোক গুলো লেখার তাৎপর্য কী ?", চিবিয়ে চিবিয়ে কথা গুলো বললো রাতুল।
-" কী তাৎপর্য ?"
-" এখানে বৃষকেতু হলো পার্থ আর সুশান্ত হলো তার সারথি। পুরোনো ঘটনার বদলা নিচ্ছে বৃষকেতু। সম্ভবত ওকে দিয়ে একাজ করাচ্ছে সুশান্ত সেনগুপ্ত শুধুমাত্র ওই ফলকটার লোভে। সেটা পেলে বৃষকেতু কে ছুঁড়ে ফেলে দেবে। আর বোকার মতো বৃষকেতু ওর কথায় বিশ্বাস করে এই হত্যালীলা কে একটা ধর্মযুদ্ধ মনে করে নিজেকে সঁপে দিয়েছে। বেচারা জানেও না আসল সত্যি টা কী ?"
-" তার মানে ও অজান্তেই ওই শ্লোক লিখে রেখে আমাদের ক্লু দিয়ে গেছে, যে ও একা নয়, ওকে পরিচালনা করা হচ্ছে।"
-" ঠিক তাই রে শ্রী। এবার ও আমাদের পেছনে ধাওয়া করবে শিওর।"
-" উঁহু এইবারে ও সফল হবে না। আমি হতে দেবো না", দৃঢ়চিত্তে বলে ওঠে শ্রীময়ী।

-৩৭-

গাড়িতে দেরাদুন থেকে তালুকা আসতে প্রায় ঘন্টা দশেক সময় লাগে। রাস্তা খুব যে মসৃণ তা মোটেও না। দুর্গম পাহাড়ি রাস্তা এবড়ো থেবড়ো ভাবে সর্পিল গতিতে পাকদন্ডির মতো এঁকেবেঁকে চলেছে। দুপাশে বিরাটাকায় মহীরুহের দল নিশ্চুপ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে অভ্যর্থনা জানাচ্ছে। এ পথ হিমালয়ের আপন ক্রীড়াঙ্গন। এখানে জীবন ও মৃত্যু দুইই হলো পায়ের ভৃত্য। ভয়ংকর সুন্দরী পাহাড়ি উপত্যকা দু হাত ছড়িয়ে বিস্তৃত।

বিকেল চারটের দিকে শ্রীময়ীরা সাঁকরি গ্রামে এসে পৌঁছলো। হিমালয়ের কোলে ছোট একটা জনপদ। খানিক চা বিরতি সেরে আবার গাড়ি রওনা দিলো তালুকার উদ্দেশ্যে। সাঁকরি থেকে তালুকা চোদ্দ কিলোমিটার রাস্তা আরো বেশি খাড়াই। সেখানে পৌঁছতে সন্ধ্যে হয়ে গেলো। এখানেই শঙ্কর বাবুর সর্বশেষ ঠিকানা পাওয়া গেছে। খোঁজ করতে হবে। কিন্তু তারও আগে যেটা দরকার সেটা হলো মাথা গোঁজার একটা ঠাঁই। বেশ শীত করছে এবার। পাহাড়ের ঢালে দ্রুত অন্ধকার নেমে আসছে। এখুনি একটা থাকার ব্যবস্থা না করতে পারলে মুশকিল।

শেষ মেশ একটা হোম স্টে জুটে গেলো। ব্যবস্থা মন্দ নয়। একটাই ঘর পাওয়া গেলো। সে যা হোক, কিছু একটা হলেই হলো। রাত টুকু কাটানো নিয়ে কথা। ড্রাইভারকে ছেড়ে দেওয়া হলো। কারণ এরপর কোথাও যেতে হলে পায়ে হেঁটে যাওয়া ছাড়া গতি নেই কারণ, গাড়ি যাবার রাস্তা এখানেই শেষ হয়েছে।

-৩৮-

পরদিন ভোরেই শঙ্কর বাবুর ঠিকানাটার উদ্দেশ্যে তিনজন মিলে বের হলো। শ্রীময়ী তার আগে লোকাল থানার সাথে একটা যোগাযোগ সেরে রাখলো। থানা বেশ দূর যদিও। ফোনেই প্রাথমিক আলাপ সেরে ওসির সাথে কয়েকটা দরকারি আলোচনা করে নিলো। বলা যায় না কখন কোথা থেকে বিপদ আসতে পারে। এখনো অব্দি সেভাবে সমস্যা হয়নি। এখন ভালোয় ভালোয় শঙ্কর বাবুর খোঁজ পেলেই হলো।

খোঁজ অবশ্য পাওয়া গেলো, কিন্তু সেক্ষেত্রে হতাশই হতে হলো ওদের। যে ঠিকানা থেকে চিঠিটা লিখেছিলেন সেখান থেকে সামান্য দূরেই সোমেশ্বরের মন্দির। এখানেই বেশ কিছুদিন পূজারী হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন শঙ্কর বাবু। অবশ্য শঙ্করনাথ নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন তিনি। একটু পাশেই ভগবান ঠাকুরের আস্তানা। উনিও মন্দিরের একজন পূজারী স্থানীয় মানুষ। তাঁর সাথেই শঙ্করনাথ থাকতেন। কিন্তু জানা গেলো, কয়েকমাস আগে তিনি আরো ওপরের দিকে চলে যান। কাজেই এখানে খোঁজ করে। বিশেষ লাভ আর হবে না।

শ্রীময়ী অনেক আশা নিয়ে এসেছিলো। স্বভাবতই বেশ ভেঙে পড়লো। হতাশ ভাবে বললো, " এবারে কী ভাবে খুঁজবো আমি ?"
রাতুল বললো, " শোন, আমার একটা কথা মনে হচ্ছে, তোকে উনি চিঠিতে লিখেছিলেন যে মহাপ্রস্থানের পথে চললেন। তাই তো?"
-" হ্যাঁ, কিন্তু সেটা তো..."
-" সেটার মানে এই পথেই উনি গিয়েছেন। গন্তব্য সম্ভবত স্বর্গারোহিনীর দিকে। কারণ মহাভারতে মহাপ্রস্তানিকা পর্বে এই অঞ্চলেরই উল্লেখ আছে কিন্তু। আমাদের মনে হয় সেই পথ বরাবর এগোতে হবে।"

-" রাতুলবাবু একদম ঠিক কথা বলেছেন। এরপর আরো ওপরে উঠলে ওসলা। তারপরে আসবে হর কি দুন। শঙ্কর যদি সত্যি কোথাও গিয়ে আত্মগোপন করতে চায় তো আমার মনে হয় ওর গন্তব্য হর কি দুন হয়ে স্বর্গরোহিনী হওয়াই বাঞ্ছনীয়। সেটাই মহাপ্রস্থানের পথে সঠিক মার্গ হবে।"

-" আজ হাতে যা সময় রয়েছে তাতে ওসলা অব্দি পৌঁছনো যাবে কিন্তু রাত হয়ে যাবে। সেক্ষেত্রে...", রাতুলের কথাটা শেষ করতে দেয় না শ্রীময়ী।
বললো, " সময় নষ্ট করা যাবে না। জানিনা সুশান্ত আর বৃষকেতু কি প্ল্যান করছে। কাজেই যতটা সম্ভব এগিয়ে থাকায় উচিত। যতই রাত হোক। আমি আজই যেতে চাই। "

-৩৯-

কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনজনে তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়ল। অবশ্য এবারে ওদের সঙ্গী হলো আরো একজন, খোঁজ খবর নিতে গিয়েই এক শিখ ছোকরার সাথে দেখা হলো। বয়স বেশি না। মধ্য তিরিশের কোঠায়। একমুখ দাড়ি গোঁফ, মাথায় পাগড়ি। সে নাকি এ অঞ্চলে অনেকদিন গাইডের কাজ করে। একপ্রকার জোর করেই যেন সঙ্গে জুটে গেল ছেলেটি। মালপত্র সব হোম স্টে তেই রেখে দেওয়া হলো। মালিক ভদ্রলোকটি বেশ উপকারী মানুষ। উনিই বললেন ফিরতে যখন এই পথেই হবে, তখন সব মালপত্র নিয়ে যাবার মানে হয় না। দরকারি কিছু জিনিসপত্র নিয়ে গাইড ছেলেটির সাথে তিনজনেই বেরিয়ে পড়লো।


ওসলা যাবার পথ বেশ দুর্গম হলেও এক অনির্বচনীয় সৌন্দর্য যেন প্রকৃতি উজাড় করে রেখেছে চারপাশে। একদিকে হিমালয় অপার মহিমান্বিত হয়ে গর্বের সাথে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে, অপর দিকে খাদের অতলে খরস্রোতা সুপিন নদী লুকোচুরি খেলে যাচ্ছে সমানে। হু হু করে ঠান্ডা বাতাস বইছে। মাঝে মাঝেই ভেড়ার পাল দেখা যাচ্ছে, তাদের পালক যে মানুষ গুলো তারা তাদের ভেড়াগুলোকে চড়তে দিয়ে পাহাড়ের খাঁজে বসে খাবার দাবার আয়োজন করে আগুন জ্বালিয়ে বসে রয়েছে। বেশ একটা মনোমুগ্ধকর পরিবেশ।

রাতুল আর ডঃ শর্মা বিষ্ময়াবিষ্ট হয়ে ইতিউতি চেয়ে দেখছে। সত্যি প্রকৃতির এই অপার রূপের কাছে সব কিছুই যেন তুচ্ছ হয়ে যায়। উদ্ধত হিমালয়ের কাছে সব কেমন গৌণ লাগে যেন। হঠাৎ একটা শকুন মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গেলো। ডঃ শর্মা বললেন, "এ জায়গায় যে অনেক শকুন দেখা যায় পড়েছিলাম কোথাও, আজ চাক্ষুষ করলাম। শুনেছি এদের দেখা পাওয়া নাকি খুব শুভ।"

রাতুলও সেদিকে তাকিয়ে ছিল। কথাটা শুনে মৃদু হাসলো খালি। কিন্তু শ্রীময়ীর মুখটা গম্ভীর হয়ে রয়েছে। কেন যে তার একটা অস্বস্তি হচ্ছে কিছুতেই বুঝতে পারছে না। পর পর চারজন এগিয়ে চলেছে সারিবদ্ধ ভাবে। পেছন থেকে এক এক করে ডঃ শর্মা, রাতুল আর শ্রীময়ী। একদম সামনে গাইড ছেলেটি। ওরা তিনজন বেশ হাঁফিয়ে উঠলেও গাইড ছেলেটি এত চনমন করছে, যে বাকিদের ওর সাথে তাল রাখতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। এই পাহাড়ি চড়াইয়েও গাইড ছেলেটা গুন গুন করে গান গাইতে গাইতে এগোচ্ছে-

" জব রাত কে গ্যাহরে সন্নাটে
গ্যাহিরি সি নিন্দ মে শোতে হে
এক মেলা য্যয়সা লাগতা হ্যায়
বিখরা বিখরা ইয়ে শুনাপন
ইয়াদো কে সায়ে এয়সে মে
করনে লাগতে হে আলিঙ্গন"

ক্রমশ..... ( আগামী পর্বে সমাপ্য)
 



Ayan Das
 

 
 

ধারাবাহিক - মহাপ্রস্থানের পথে - অয়ন দাস

 

ধারাবাহিক
 
 
 
 মহাপ্রস্থানের পথে
অয়ন দাস


 
|| চতুর্থ   পর্ব  ||


১৮.

-" এবারে তোমায় দ্বিতীয় লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। এখানে তোমার কাজ শেষ হয়েছে। মনে রেখো কেউ কোনো সূত্রই খুঁজে পাবে না আর তোমার", গম্ভীর গলায় একজন আদেশ করলেন তাঁর একান্ত অনুগত সৈনিক বৃষকেতুর প্রতি।
-" ঠিক আছে। আপনি যা চাইছেন তাই হবে", বললো বৃষকেতু।
-" তোমার কোনো খবর থাকবে না। বাইরের দুনিয়াতে সবাই জানবে তুমি চলে গেছো কোথাও কিংবা কেউ তোমায় সরিয়ে দিয়েছে। সময়মত আবার আমি তোমায় ফোন করে নেবো।"
-" আপনার আদেশ শিরোধার্য।"
-" তুমি ধর্মযুদ্ধের সৈনিক জানবে নিজেকে। একবার যখন কুরুক্ষেত্রে নেমেছো সামনে জয়ের লক্ষ্যই হবে একমাত্র অভীষ্ট। এ যুদ্ধ সর্বকালীন। তুমি তো শুধুই একজন সেনানী। কাউকে না কাউকে লড়তে হতোই। ঈশ্বরের অসীম কৃপা যে তোমাকেই সেই ভার দেওয়া হয়েছে।"
-" আপনি যেমন চাইছেন তেমনই হবে।"

ফোনটা কেটে যেতেই বৃষকেতু তৈরি হয়ে নিলো। এরপর তার গন্তব্য পাটনা। জিনিসপত্র সব গুছিয়ে নিলো। দু একটা জরুরী ফোন সেরে নিতে হবে। তারপর পুরোপুরি বেপাত্তা হয়ে যেতে হবে।

বেরোবার আগে একবার শুধু নটরাজের মুর্তিটাকে ভালো করে পুজো করলো। তারপর মনে মনে আওড়ালো-
" মৃত্যুঞ্জয়ায় রুদ্রায়ে নীলকান্তায়ে সম্ভাবে
অমৃত্যেষ্যায়ে সর্বায়ে মহাদেবায়ে নমঃ...
|| ওঁ নমঃ শিবায়, ওঁ নমঃ শিবায়, ওঁ নমঃ শিবায় ||

১৯.

প্রতিদিন সকালে যোগব্যায়াম করা অভ্যেস শ্রীময়ীর। এতে সারাটা দিন শরীর বেশ ঝরঝরে লাগে। কাল রাতে রাতুলকে ছেড়ে দিয়ে বাড়ি ফিরতে বেশ রাত হয়ে গিয়েছিলো। তার ওপর প্রফেসর নন্দীর ডাইরি গুলো সবকটা শেষ করেছে রাতভর পড়াশুনা করে। তাই আজ একটু উঠতে দেরিই হয়ে গেছে শ্রীময়ীর। অবশ্য ডাইরি থেকে সুরাহা কিছু হয়নি। মুকেশ কুমার আর বিধান শর্মা এই দুটো নাম ঘুরে ফিরে এসেছে। সুশান্ত সেনগুপ্তর কথাও আছে বেশ কয়েক জায়গায়। আর লোথালে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা নিয়ে প্রায়শই উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। কোথাও যেন বার বার নিজেকে দায়ী করেছেন তিনি। এছাড়া সে অর্থে কোনো সূত্রই পাওয়া যায়নি যা তাঁর খুনের সাথে জড়িয়ে থাকতে পারে।

যোগব্যায়াম সেরে সবে ফ্রেশ হয়ে বসেছে, হঠাৎ ফোনটা ভাইব্রেট করে উঠলো। রাতুল মেসেজ করছে।

শ্রীময়ীও তার প্রত্যুত্তর দিলো, " গুড মর্নিং"

ওদের সম্পর্কটা কলেজের পর হঠাৎ করেই যেন বড্ড কেঠো হয়ে পড়েছিলো। দূরত্ব এসে পড়ে মাঝে অনেকটা ব্যবধান সৃষ্টি করে দিয়েছিলো। তাই হয়তো মাঝে সাঝে দু একটা মামুলী 'হাই', 'হ্যালো' ছাড়া তেমন কোনো কথাবার্তা হতো না। শুধু দুজনেই দুজনের খবরাখবর রাখতো এই যা।

ফেসবুকটা খুলে রাতুল সকাল সকাল শ্রীময়ীর প্রোফাইলটা দেখছিলো। কতদিন হয়ে গেলো, তবু শ্রীর ওই অমায়িক হাসিটা পুরোনো হয়নি। ওটাই রাতুলের বড় দুর্বলতার জায়গা। কলেজে থাকতে সাধে কি আর প্রেমে পড়েছিলো।

প্রোফাইলে ওর বাবার সাথে একটা ছবি দেওয়া। বেশ সৌম্যদর্শন চেহারা ভদ্রলোকের। শঙ্কর ব্যানার্জি। এক মুখ গোঁফ দাড়ি, তারওপর সর্বক্ষণ গেরুয়া বস্ত্র ধারণ করে থাকতেন। অমন উদাস করা চেহারা হলেও ওনার চোখদুটো এতটাই গভীর, অতলস্পর্শী যে মনে একটা সম্ভ্রম জাগিয়ে তোলে।

কলেজে পড়বার সময় রাতুলের ওনার সাথে বার দুয়েক আলাপ হয়েছিলো। তারপর হঠাৎই একদিন এই মানুষটা নিরুদ্দেশ হয়ে যান। শ্রী ততদিনে একজন আই.পি.এস অফিসার হয়ে গেছে। তা সত্ত্বেও বহু খোঁজ করেও ওনাকে পাওয়া যায়নি। মায়ের কথা সেভাবে শ্রীময়ীর মুখ থেকে কখনোই শোনে নি রাতুল। অনেক আগেই তিনি গত হয়েছিলেন। বাবাই ছিলেন সব। কাজেই এই আকস্মিক অন্তর্ধান ওর মনে যথেষ্ট প্রভাব ফেলেছিলো। হয়তো সেই কারণেই গত কয়েক বছর যাবৎ শ্রী আরো যেন নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলো। সমস্ত সত্ত্বা দিয়ে নিজের কাজটাকেই শুধু আঁকড়ে ধরেছিল। রাতুল ব্যাপারটা জানলেও সেভাবে শ্রী র সাথে কখনো আলোচনা করেনি। হয়তো সেই সুযোগটাই পায় নি কখনো।

-" কি ব্যাপার, নিশাচর আজ এত সকালে উঠেছে যে?", আবার মেসেজ এলো শ্রী র।

মেসেজটা দেখে হাসি পেয়ে গেল রাতুলের। লিখলো, " তোর পাল্লায় পড়ে ঘুম টুম উবে গেছে। এমন এক কেসে জড়িয়ে দিলি।"
-" তা না জড়ালেই পারতিস। ঘুমের ব্যাঘাত হতো না।"
-" তুই বললে আমি আর না করি কি করে বল !"

শ্রীময়ী মনে মনে হাসলো। তারপর দুটো হাসির স্মাইলি পাঠিয়ে লিখলো, " সকালের মধ্যেই আমি সুশান্ত সেনগুপ্তের ঠিকুজি জোগাড় করছি। ফোন করলে চলে আসিস কিন্তু।"

রাতুল সঙ্গে সঙ্গে রিপ্লাই দিলো, " ওকে জনাব।"

শ্রীময়ী আর কথা বাড়ালো না। ফোনটা রেখে দিয়ে প্রাত্যহিক পুজোর কাজে মন দিলো। অন্যদিন আরো সকালেই এই পুজো করে সে। সূর্য্য দেবের আরাধনা। আজ একটু দেরিই হয়ে গেলো। এই পুজোর পর মনটা এক অনাবিল প্রশান্তিতে ভরে যায় যেন।

চোখ বন্ধ করে মনোনিবেশ করলো খানিকক্ষন। তারপর হাতজোড় করে মন্ত্রপাঠ শুরু করলো-
" ওঁ জবাকুসুমসঙ্কাশং কাশ্যপেয়ং মহাদ্যুতিং । ধন্তারীং সর্বপাপঘ্নং প্রণহতোস্মি দিবাকরম্ ..."

১৯.

সুশান্ত সেনগুপ্ত। গাড়িতে থানার উদ্দেশ্যে যেতে যেতেই নামটা এবং তার সাথে রাতুলের কাছ থেকে পাওয়া নিউজের লিঙ্কটা ফরয়ার্ড করে দিলো শ্রীময়ী। ইন্টারনেট থেকে ওভাবে ঠিকানা খুঁজে বার করা যাবে না। বিধাননগর সাইবার সেলের বক্সীদা কে পুরো ডিটেইলস পাঠিয়ে রাখলে আশা করা যায় কিছু একটা তথ্য ঠিক জোগাড় করে আনবেন উনি। এর আগেও উনি শ্রীময়ী কে অনেক সাহায্য করেছেন। দেখা যাক এবারে কতদূর খোঁজ লাগাতে পারেন উনি।

ফোনটা ভাইব্রেট করছে দেখে বার করতেই শ্রীময়ী দেখলো অনির্বাণ ফোন করছে। রিসিভ করতেই অনির্বাণ উত্তেজিত ভাবে বলে উঠলো, " হ্যালো ম্যাডাম"
-" কী খবর অনির্বাণ বাবু ?"
-" খবর খুব একটা ভালো নয়। প্রফেসর নন্দীর সেক্রেটারি বিকাশ বাবু আগে যে কোম্পানিতে কাজ করতেন বলছিলেন, ওই নামে ওই ঠিকানায় কোনো কোম্পানি নেই। একটা ফ্যাক্টরি রয়েছে। ওখানের কোনো কর্মীরা ওনার নাম মনে করতে পারছে না। এমনকি ছবি দেখিয়েও বলতে পারলো না।"
-" সেকি! তার মানে মিথ্যে কথা বলছে ও। শুনুন এখুনি ওর বাড়িতে একবার গিয়ে দেখুন তো। এলিবাই গুলো চেক করতে হবে।"
-" ইয়েস ম্যাম। আমরা ওর বাড়ির দিকেই এগোচ্ছি এখন। তবে মনে হচ্ছে এটাও হয়তো ভুয়ো হতে পারে।"
-" ওকে আমায় টাইমলি রিপোর্ট করুন। মোস্ট ফিসি ব্যাপার লাগছে এখন।"
-" অবশ্যই ম্যাডাম।"

ফোনটা ছেড়ে দিয়ে শ্রীময়ী কিছুক্ষণ ভাবলো। বিকাশের মোটিভটা কী হতে পারে ? ও হঠাৎ মিথ্যে কথা বললো কেন ? ভালো করে একবার পুরো বিষয়টা ভাবার চেষ্টা করলো শ্রীময়ী। একটা লোক একা বাড়িতে থাকেন। অধ্যাপনা, ইতিহাস চর্চা এসব ব্যতীত অন্য কোনো নেশা সে অর্থে নেই বললেই চলে। অন্তত প্রাথমিক তদন্ত তাই বলছে। যখন খুন হলেন, আততায়ী বাইরে থেকে অনায়াসে ভেতরে প্রবেশ করেছিলো। তার মানে তার কাছে চাবি থাকাটা খুব স্বাভাবিক। সেটা সে পেলো কীভাবে? এক যদি না খুব কাছের লোক হয়। সেক্ষেত্রে একজন সেক্রেটারির কাছে চাবি থাকাটা বা না থাকলেও ডুপ্লিকেট চাবি বানিয়ে নেওয়াটা খুবই সহজ কাজ।
আর যদি ধরেও নেওয়া যায় যে অপরাধীকে প্রফেসর নিজেই ডেকে আনেন, তাহলেও তাকে চেনেন বলেই ডেকে নিয়েছিলেন অত রাতে। তা হলেও বিকাশের দিকেই পাল্লাটা ভারী লাগছে অপরাধী হবার কারণ হিসেবে। কিন্তু কেন ? বিকাশ যদি খুনই করবে, ছমাস অপেক্ষা করলো কেন ? কীসের প্রস্তুতি নিচ্ছিলো সে ? প্রফেসরের আস্থা অর্জনের চেষ্টা করছিলো কি, যাতে সহজেই তাকে হত্যা করা যেতে পারে ?
এদিকে রাতুলের কালকের বলা থিওরী গুলোও মোটেই এড়িয়ে যাওয়া যায় না। কিন্তু কোথাও যে একটা হিসেব মিলছে না। বিকাশের মিথ্যে বলা আর গুজরাটের লোথালে ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনা- এ দুটোর কি কোনো যোগসূত্র রয়েছে ?

শ্রীময়ীর মাথায় এমন অজস্র প্রশ্ন ঘুরতে থাকে। 'উত্তর চাই শ্রীময়ী, উত্তর চাই', নিজেই নিজের মনকে বলে ওঠে শ্রীময়ী।
২০.

ব্যারাকপুর থেকে পাটনা অনেকখানি রাস্তা। একদম সকাল করেই বেরিয়ে এসেছে বৃষকেতু। প্রায় সাড়ে তিনশো মাইল রাস্তা গাড়িতেই যাবে বলে ঠিক করেছে। সেই ভোর পাঁচটা নাগাদ বেড়িয়েছে। পৌঁছতে হয়তো রাত হয়ে যাবে। তার মানে কাল সকালেই কাজটা মেটাতে হবে। ফোনটা একবার বাজতে গিয়েও থেমে গেলো। মিসড কল করছে কেউ।

বৃষকেতু বুঝতে পারলো। পাল্টা ফোন করতেই ওদিক থেকে উত্তর এলো, " আপনার বাড়ি সার্চ করছে পুলিশ।"
-" করতে দাও। ওটাই ওদের ডিউটি", হাসি মুখে বললো বৃষকেতু। সে জানে পুলিশ আর কোনো সূত্রই পাবে না।
-" কিন্তু বস, বাড়িতে অনেক রংয়ের মিস্ত্রি এসেছে। ব্যাপার কী ?"
-" বাড়িওয়ালা বাড়ি রং করাচ্ছে এতে আবার ব্যাপারের কি আছে ? তুমি নজর রেখে যাও খালি।"
-" ওকে বস।"

গাড়ি ছুটতে লাগলো হাইওয়ের ওপর দিয়ে। বৃষকেতু পেছনের সিটে মাথাটা এলিয়ে দিলো। এখনো দীর্ঘ রাস্তা যেতে হবে। কানে হেডফোন লাগিয়ে গান চালিয়ে দিলো মোবাইলে-
" ... আখির ইয়ে ক্যায়সা বন্ধন হ্যায়
                          আখির ইয়ে ক্যায়সা নাতা হ্যায়
  জো জুড় গ্যায়া তো আনজানে মে
                          পর টুট নাহি অব পাতা হ্যায় .... "


দুপুরের দিকে বিধাননগর সাইবার সেলের বক্সী বাবু ফোন করলেন শ্রীময়ীকে।

-" তুমি যার কথা বলেছিলে, সুশান্ত সেনগুপ্ত। এখন তো আর ইনি সাংবাদিকতা করেন না। অনেক দিন এ কাজ ছেড়ে দিয়েছেন। ভাগ্যিস নিউজ পেপারের নামটা দিয়েছিলে, নইলে তো খুঁজেই পেতাম না।"
-" অনেক উপকার করলেন বক্সী দা। এঁকেই আমাদের খুব দরকার।"
-" আচ্ছা তুমি ঠিকানা টা লেখ- ১৭/২, রোল্যান্ড রোড, কলকাতা ২০। বয়স এখন প্রায় ষাট পঁয়ষট্টি হবে। বহু কষ্টে ডেটাবেস থেকে বার করেছি বুঝলে।"
-" অনেক ধন্যবাদ স্যার।"
-" মাই প্লেজার। কিন্তু ব্যাপার কী ? কোনো কেস কি ?"
-" কেস তো বটেই। তবে এখন পুরো জন্ডিস। দেখা করে সব বলবো বক্সী দা। "
-" ওকে ম্যাডাম মার্পল।"

ঠিকানাটা সঙ্গে সঙ্গে রাতুলকে হোয়্যাটসএপ করে দিলো শ্রীময়ী। বিকেলের দিকে একবার ঢুঁ মারতে হবে সুশান্ত বাবুর ওখানে। দেখা যাক পুরোনো ইতিহাস খুঁজে কিছু বের করা যায় কিনা !!

২১.

সত্যি বলতে কী পুলিশ প্রফেসর নন্দীর সেক্রেটারি বিকাশ বাবুর বাড়ি থেকে কিছুই পেলো না তেমন। উনি নাকি দিন দুই আগেই বাড়িওয়ালা কে বলেছিলেন বেশ কয়েক জায়গায় রং উঠে গেছে। তাই রং করাতে হবে। বিকাশবাবু চলে যেতে না যেতেই এ কাজে হাত লাগিয়েছেন বাড়িওয়ালা এবং গোটা ব্যাপারটা তদারকি করছেন তিনি স্বয়ং।

অনির্বাণ পুলিশ ফোর্স নিয়ে এ বাড়িতে ঢুকতেই অবাক হয়ে গেলেন বাড়িওয়ালা মাখন মিত্র। জিজ্ঞেস করলেন, " কী ব্যাপার স্যার ? কিছু হয়েছে ?"
-" ব্যাপার তো আপনি বলবেন এসব কী হচ্ছে ?", পাল্টা জিজ্ঞেস করলেন অনির্বাণ।
-" আসলে স্যার আগে যিনি থাকতেন উনি বললেন চারদিকে রং চটে গেছে। তা উনি চলে যেতেই একটু রং করিয়ে নিচ্ছি।", একগাল হাসি নিয়ে কথা গুলো বললেন মাখন বাবু।

অনির্বাণ বিরক্তির সুরে বললেন, " দেখে দেখে আজকেই রং করতে হলো। হোপলেস! "
-" ইয়ে মানে কোনো গন্ডগোল নাকি স্যার ?"
-" আপনি যাকে ভাড়া দিয়েছিলেন, গতকাল ঘটে যাওয়া একটা খুনের মামলার সাথে যুক্ত তিনি।"
-" খু..উ..উ.উ..ন", বলে রীতিমতো চোখ কপালে তুলে আর একটু হলেই পড়ে যাচ্ছিলেন ভদ্রলোক। নেহাৎ অনির্বাণ সময়মতো ধরে ফেললো তাই রক্ষে।

তারপর একটু ধাতস্থ হয়ে আমতা আমতা করে বললেন, " আ.....আমি কিছু জানিনা। বিশ্বাস করুন।"
অনির্বাণ এবার ধমক দিয়ে বললেন, "উফ, কী শুরু করলেন আপনি ? আমাকে আপনার এই ভাড়াটের পুরো ডিটেইলস দিন তো।"

যা জানা গেলো তা হলো এই ছেলেটি মাস ছয়েক আগে ঘর ভাড়া নেয়। কিন্তু এতটাই তাড়াহুড়ো করে থাকতে শুরু করে দেয় যে মাখন বাবু তার কোনো নথিপত্র ভালো করে দেখার সুযোগ পান নি। এমনিতে সময়মতো ভাড়া দিতো। কোনো ঝামেলা ছিলো না। পাড়া পড়শীও কখনো অভিযোগ করে নি। কিছুদিন আগে ছেড়ে যাবার কথা বলে এবং ও আশ্বাস দেয় ওর এক বন্ধু এখানে এসে এরপর ভাড়া থাকবে। ওর নাকি এখানকার কাজ হয়ে গেছে। সেই উদ্দেশ্যে রং করবার কথা বলে। গতকাল রাত্রে এ নিয়ে কথা হয়। আজ সকালে কোনো এক সময় বিকাশ চলে গেছে। সেই সুযোগে মাখন বাবু এসে রঙের কাজ শুরু করে দিয়েছেন। কাজেই ফিঙ্গারপ্রিন্ট পাবার আশা খুবই ক্ষীণ কারণ এত গুলো লোক তারপর এসেছে, জিনিসপত্র এদিক ওদিক করেছে।

তবে দুটো ব্যাপারে অনির্বাণের খটকা লাগলো। মাখন বাবুর কাছে 'বিকাশ' নামটা সম্পূর্ণ অচেনা। শুধুমাত্র ছবি দেখেই ছেলেটাকে চিনতে পেরেছিলেন। বললেন, " উনি তো বাঙালি বলে মনে হয় না। মাঝে মাঝেই হিন্দিতে কথা বলতেন। যে নাম বলছেন ও নামে কেউ থাকতো না। কি যেন একটা নাম ছিলো, দাঁড়ান, আমি রশিদ গুলো নিয়ে আসি।" এই বলে উনি একবার ভেতরে গিয়ে মিনিট খানেকের মধ্যেই ভাড়ার রশিদ গুলো এনে দেখালেন।

অনির্বাণ দেখলো সবকটা রশিদেই বিকাশ বাবু যে নাম সই করেছেন তা হলো- 'বৃষকেতু সিং'।

২২.

সুশান্ত সেনগুপ্তের বাড়ি খুঁজে পেতে প্রথমে একটু সমস্যা হলো। মেইন রাস্তা থেকে বেশ খানিকটা ভেতরে ওনার বাড়িখানা। লোকে যাতে বুঝতে পারে সেই কারণেই বড় রাস্তার ঠিকানা দেওয়া।

বাড়িতে মাত্র দুটি প্রাণীর বসবাস। সুশান্ত বাবু এবং ওনার স্ত্রী। কোনো সন্তান সন্ততি নেই। সুশান্ত বাবুকে দেখে বেশ অসুস্থও লাগছিলো। কাজেই হঠাৎ করে রাতুল আর শ্রীময়ীর এরকম এসে পড়াতে ওনারা একটু অস্বস্তিতেই পড়লেন মনে হলো।

-" বসুন আপনারা। আসলে তেমন বড় একটা কেউ দেখা করতে আসেন না তো, তাই চারদিক অগোছালো ভাবে রয়েছে", বলে একটা দুটো চেয়ার দেখিয়ে দিলেন সুশান্ত বাবু।

কথা বলতে যে বেশ কষ্ট হচ্ছে মনে হলো। তাও অনেক কথাই বললেন। এত পুরোনো একটা ব্যপার নিয়ে কেন রাতুলরা জিজ্ঞেস করছে, সে ব্যপারে স্বভাবতই উনি বেশ কৌতুহলী হয়ে পড়লেন। তারপর যখন শুনলেন এর সাথে প্রফেসর নন্দীর খুনের একটা যোগাযোগ থাকতে পারে, একটু গম্ভীর স্বরেই বললেন, " আমি জানতাম কোনো এক দিন এরকম কিছু হবেই।"
-" কেন ? এরকম হওয়ার কি কারণ থাকতে পারে ?", প্রশ্ন করলো শ্রীময়ী।
-" লোথালে যখন আমি এক্সক্যাভেশন কভার করতে গিয়েছিলাম, একটা ব্যাপার ঘটেছিলো", অদ্ভুত রহস্যময় কণ্ঠে কথাগুলো বলে চলেছেন সুশান্ত বাবু। বয়সের ভারেই হোক কিংবা রোগগ্রস্ত থাকার কারণে উনি সামান্য কথা বললেই হাঁপিয়ে উঠছিলেন। তবু এতদিন আগের কথা গুলো বলতে বলতে ওনার চোখ দুটো চকচক করছিলো। যেন এই মাত্র সেই সব ঘটনাগুলো ঘটছে চোখের সামনে।

সুশান্ত বাবু বলে যেতে লাগলেন, " আমার বয়স তখন অনেকটাই কম। চল্লিশখানেক হবে। তিনজন ভদ্রলোক এই গোটা প্রজেক্টের অগ্রনী ভূমিকায় ছিলেন। প্রফেসর নন্দী, প্রফেসর মুকেশ কুমার আর একজন ডঃ বিধান শর্মা। এঁরা প্রত্যেকেই ইতিহাস আর আর্কিওলজির লোক বলেই বোধহয় এই কাজের সাথে জড়িত ছিলেন।"
এক নিঃশ্বাসে কথা গুলো বলে একটু দম নিলেন সুশান্ত বাবু।

তারপর আবার বলতে শুরু করলেন,
" ওঁরা একটা ফলক নিয়ে অনেকদিন গবেষণা করেছিল। পোড়ামাটির একটা ফলক। আমিও দেখেছিলাম সেটা। একটা রথের চিত্র খোদাই করা, এক মহারথীকে নিয়ে সারথি ও তার রথ এগিয়ে চলেছে। মাথায় একটা ধ্বজা উড়ছে। রথের সাথে চারটি ঘোড়া রয়েছে। এরকম একটা চিত্র খোদাই করা।"
-" শৈব, সুগ্রীভ, মেঘপুস্প, বলাকা" এতক্ষণ তন্ময় হয়ে শুনতে শুনতে বিড়বিড় করে নিজের মনেই বলে উঠলো রাতুল।

শ্রীময়ী একটু অবাক হয়েই তাকালো রাতুলের দিকে।
-" কৃষ্ণার্জুনের রথ। চারটে ঘোড়ার নাম হলো ওই, যা যা বললাম", বললো রাতুল।
-" হ্যাঁ ঠিক বলেছেন", রাতুলের কথাটা শুনতে পেয়ে বলে উঠলেন সুশান্ত বাবু।
-" কিন্তু এর সাথে আপনার সেই অগ্নিকাণ্ডের যে স্টোরিটা দেখেছিলাম তার কি সম্পর্ক ?", প্রশ্ন করলো রাতুল।
-" সম্পর্ক আছে। ওটা কোনো সাধারণ ফলক ছিলো না। ওটার একটা গুপ্ত রহস্য ছিলো বলতে পারেন। ওর মধ্যে এমন কিছু একটা খোদাই করা ছিলো যেটার মানে ওঁরা কেউই উদ্ধার করতে পারেনি। ওটা আদপে একটা পরিবারের সম্পত্তি ছিলো, প্রফেসররা বলতে পারেন একপ্রকার প্রভাব খাটিয়েই ওটা দেখতে গিয়েছিলেন। ওদের মতে ফলকটা ছিলো একটা দুর্মূল্য সম্পদ। কোনো এক দুর্ভেদ্য সঙ্কেত লুকিয়ে রয়েছে নাকি তার মধ্যে, যা আসলে মহাভারত কালের কোনো এক সত্যের ধারক। প্রফেসররা এটা নিয়ে একটু গবেষণা করতে বদ্ধপরিকর ছিলেন। গোল টা বাঁধলো তারপরই।"
-" কীরকম গোলমাল ?"
-" প্রফেসর নন্দী বলতে পারেন খানিকটা জোর করেই ভূদেব সিংয়ের থেকে কিছুদিনের জন্য নেন। নচেৎ পারিবারিক কোনো অভিজ্ঞান সচরাচর কেউ বাইরের লোককে দেখায় না কেউ। সে যাই হোক, প্রথম কদিন সব ঠিকঠাকই ছিলো। একদিন ওই পরিবারের তরফে কারো মনে হয়েছিলো প্রফেসররা হয়তো ওটা নিয়ে পালাবার মতলব করছে। সেই নিয়ে সাংঘাতিক অশান্তি হলো। আর তারপরই....", এই পর্যন্ত বলে চুপ করে গেলেন সুশান্ত বাবু।

শ্রীময়ী জিজ্ঞেস করলো, " তারপর কী হলো ?"

সুশান্ত বাবু কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, " প্রফেসর নন্দী আর বাকিরা সবাই ভূদেব সিংকে সাথে নিয়ে একসাথে নিজেদের তাঁবুতে এসে ঢুকলেন। ভেতরে কথা কাটাকাটি হচ্ছিল। হঠাৎই দেখি দাউ দাউ করে আগুন লেগে গেলো। গোটা তাঁবু পুড়ে ছাই। প্রফেসররা তিনজন কোনক্রমে বেঁচে গিয়েছিলেন। কিন্তু ভূদেব সিং এর ওনার স্ত্রী সেই আগুনে পুড়ে মারা গিয়েছিল।"
-" আর সেই ফলকটার কি হলো ?", রাতুল প্রশ্ন করলো।
-" জানিনা সেটার কোনো খোঁজ আর পাওয়া যায়নি। বোধহয় আগুনে পুড়ে সেটাও চিরতরে নষ্ট হয়ে গেছে, আর নইলে...", হতাশ সুরে বললেন সুশান্ত বাবু।
-" নইলে কী সুশান্ত বাবু ?"
-" ওনাদের কারো কাছেই হয়তো ওটা আছে।"

শ্রীময়ী এতক্ষণ চুপচাপ শুনে যাচ্ছিলো। এবারে সে একটা প্রশ্ন করলো, " আচ্ছা, আপনি এটা নিয়ে আর খতিয়ে দেখেননি কেন ? মানে হঠাৎ এরকম আগুন লাগলো কি করে ? ফলকটাই বা গেলো কোথায় ? আফটার অল সেটা যেমন বলছেন, ঐতিহাসিক ভাবে তার তো গুরুত্ব তো অনেক। আপনি একজন রিপোর্টার হয়ে আর কিছু খোঁজ করলেন না ! "

সুশান্ত বাবু খানিকক্ষণ চোখ বুজে ভাবলেন। তারপর আস্তে আস্তে বললেন, " আসলে আমার কোথাও একটা গন্ডগোল লেগেছিলো। কিন্তু সেটা বেশি ভাবতে গিয়েও পারিনি। কারণ প্রফেসর নন্দী আর প্রফেসর মুকেশ কুমার দুজনে মিলেই আমার ওপর জোর খাটিয়ে সেখান থেকে নিয়ে চলে আসেন। পরে এ নিয়ে আর কখনও সেভাবে ভেবে ওঠা হয়নি।"

-" আচ্ছা এই ভূদেব সিংয়ের আর কেউ ছিলো না ? মানে এরকম একটা মৃত্যু তাই নিয়ে কোনো তদন্তই হলো না ?", শ্রীময়ী জিজ্ঞেস করলো।
-" শুনেছিলাম ভূদেব সিংয়ের এক ছেলে ছিলো। সে পরবর্তী কালে কোনো স্টেপ নিয়েছিলো কিনা জানা নেই", বললেন সুশান্ত বাবু।
-" সেই ছেলের এখন বয়স কত হতে পারে ?"
-" তা ধরুন তিরিশের ওপর তো হবেই। কেন বলুন তো ?"
-" নাঃ একটা হিসেব মেলানোর চেষ্টা করছিলাম। ঠিক আছে অনেক ধন্যবাদ। দরকার হলে আবার হয়তো বিরক্ত করতে পারি।"
-" না না ঠিক আছে। নিশ্চই করবেন।"

সুশান্ত বাবুর বাড়ি থেকে বিদায় নিয়ে রাতুল আর শ্রীময়ী দুজনেই গাড়িতে বসে চুপচাপ ভাবছিল। কোথাও একটা খটকা লাগছে। হিসেব যেন কিছুতেই মিলতে চাইছে না। এতক্ষণ যা শোনা গেল সেগুলোর মধ্যে কি কোথাও একটা ফাঁক থেকে যাচ্ছে ? ভাবনাগুলো এলোমেলোভাবে ঘোরাফেরা করছে, উত্তরগুলো ধরা দিতে চাইছে না কিছুতেই.....।



|| পঞ্চম   পর্ব  ||

২৩.

বড় গোলমেলে ঘটনাক্রম হয়ে চলেছে। একদিকে জট ছাড়তে না ছাড়তেই অন্য দিকে আরো নানা তথ্যের গাম্ভীর্যে কেসটা ক্রমশ জটিল থেকে জটিলতর হয়ে উঠছে। কিছুতেই কোনো হদিশ পাওয়া যাচ্ছে না। এমনিতেই সকালে অনির্বাণ ফোন করে বিকাশ বাবুর ব্যপারে বিস্তারিত বলেছিল। তাতে শ্রীময়ী বেশ উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলো। এখন সুশান্ত বাবুর মুখে এতসব খবর শুনে দুটো ঘটনাকে মেলানোর চেষ্টা করছিল।

রাতুল একটু বেশিই চুপচাপ রয়েছে দেখে শ্রীময়ী প্রশ্ন করলো, " তুই এরকম থম মেরে আছিস যে। কী ব্যাপার ?"
-" ভাবছি বুঝলি", বললো রাতুল।
-" কী সেটা শুনি ?"
-" একজন রিপোর্টার খামোকা কিছু স্টোরি না করেই চলে এলো কেন ? কিসের জন্য ? যেখানে এত বড় একটা ঘটনা ঘটতে যাচ্ছিলো, সেটা কভার না করেই ফিরে আসাটা বেশ রহস্যজনক।"
-" হতেও তো পারে যে উনি ব্যাপারটা নিয়ে ইন্টারেস্ট হারিয়ে ফেলেছিলেন অথবা..."
-" অথবা..? অথবা কী শ্রী ?"
-" ওনাকে কেউ ভয় দেখিয়ে চুপ করিয়ে দেয় নি তো ?"
-" আমার ঠিক এরকমই কিছু মনে হচ্ছিলো। তাই আমার মনে হয় একবার পাটনা যাওয়া দরকার। প্রফেসর মুকেশ কুমারের সাথে কথা বলতে হবে।"
-" তবে সুশান্ত সেনগুপ্ত কিন্তু পুরোপুরি ঝেড়ে কাশেনি। ওও কোথাও যেন কিছু চেপে যাচ্ছে। সবটাই ধোঁয়াশা বুঝলি।"
-" হুম। বিশেষ করে আগুন লাগার ব্যাপারটা উনি খোলসা করে বললেন না কিন্তু।"
-" আমি সুশান্তর পেছনেও লোক লাগাচ্ছি। ওর হোয়েরএবাউটস টাও জানতে হবে, বুঝলি রাতুল।"
-" ভেরি গুড।"
-" যাই হোক, শোন আমি ব্যবস্থা করে নিচ্ছি। কাল সকাল সকাল গাড়িতেই বেরিয়ে পড়ি। আশা করি সকালে বেরোলে সন্ধ্যের আগে পৌঁছে যাবো। আর অনির্বাণ বাবুকেও সাথে নিয়ে নিচ্ছি।"
-" ওকে ম্যাডাম। এজ ইউ উইশ। তবে একটা ব্যাপার। লোথালের ঘটনা গুলো ভেরিফাই করা দরকার। এতদিন আগের হলেও কিছু একটা নিশ্চই জানা যাবে। তুই গুজরাট পুলিশের সাথে যোগাযোগ কর। এই কেসে লোথাল একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে চলেছে, এ ব্যাপারে আমি শিওর", বেশ চিন্তিত মুখেই বললো রাতুল।

-" তোর কি সন্দেহ হচ্ছে কারো ওপর ?", শ্রীময়ী প্রশ্ন করলো।

রাতুল একটু চুপ করে থেকে বললো, " এই বিকাশ লোকটার বয়স আর ভূদেব সিংয়ের ছেলের বয়সটা মনে হচ্ছে কাছাকাছি। দুয়ে দুয়ে চার করবার একটা চেষ্টা চালাচ্ছি মাত্র।"

২৪.

প্রফেসর মুকেশ কুমার পাটনার একজন গণ্যমান্য ব্যক্তি বললেও কম বলা হয়। এ অঞ্চলে ওনার খ্যাতি সর্বজনবিদিত। বিশেষত বেশ কয়েক বছর আগে প্রাচীন সিন্ধু সভ্যতা নিয়ে তাঁর গবেষণা বেশ শোরগোল ফেলে দিয়েছিলো। উনি প্রায় প্রতিটি তথ্য প্রমাণ সহকারে নিজের গবেষণা পত্রে পেশ করেছিলেন যা প্রমাণ করে সিন্ধু সভ্যতার আগেও একটা বলিষ্ঠ জনপদ গড়ে উঠেছিল সরস্বতী নদীর ধারে। যেটাকে উনি সরস্বতী সভ্যতা বলে উল্লেখ করেছেন। সেসময় সরস্বতী নদীর বাণিজ্যিক এবং ঐতিহাসিক গুরুত্ব ছিলো অপরিসীম। এক্ষেত্রে তাঁকে যথাযত সাহায্য করেছেন প্রফেসর জনার্দন নন্দী। শতদ্রু বা আজকের এই সুতলেজ নদী যেদিন থেকে অভিমুখ বদলে সিন্ধু নদীর উদ্দেশ্য গতিপথ পাল্টালো, সরস্বতী নদীও শুকিয়ে যেতে থাকলো এবং সেই সাথে জনপদটি দুভাগে ভাগ হয়ে গেলো- একদল সিন্ধু নদের দিকে চলে এলো আর ওপর দলটি রওনা হলো টাইগ্রিস আর ইউফ্রেটিস নদীর দিকে।

তারপর এলো ধর্ম যা সুবিধামতো আপন গতিপথ পাল্টে নেয় বহু ধারায়, জন্ম নেয় একের পর এক অদ্বৈতবাদ ধর্ম, যেমন- ইসলাম, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, জৈন ইত্যাদি। সনাতন ধর্মে তো ঋগ্বেদের অমোঘ বাণী এ তত্ত্ব কে সমর্থন করে না-
" একম সদ্ বিপ্র বহুধা বদন্তি ",
যার অর্থ সত্য এক, পন্ডিতেরা ভিন্ন অর্থ করেছেন মাত্র।

নইলে কেনই বা ইসলামী মক্কা কাবাস্থানে বিরাজ করবেন স্বয়ং শিব শম্ভু ? কেন হজ পালনের সময় মাথা কামিয়ে ধুতি পরিধান করে শিবলিঙ্গের চারিপাশে প্রদক্ষিণ করা হবে ? যে শুক্রবার কে ইসলামে পবিত্র মানা হয়, সেই শুক্র যে আদপে গরু শুক্রাচার্জের নাম থেকে হয়েছে সে প্রমাণ বহুলাংশে উপলব্ধ। ইসলামের 'আমিন' এবং খ্রিষ্টানের 'আমেন' কোথাও গিয়ে যেন সনাতনী 'অউম' বা 'ওম' -এর মতো শুনতে লাগে। বিষ্ণুর নবম অবতার স্বয়ং গৌতম বুদ্ধ কে ধরা হয়। জৈন ধর্মের প্রথম তীর্থঙ্কর ঋষভনাথ মোক্ষ লাভ করেছিলেন অষ্টধাপী পর্বতে, যা আসলে পিরামিডাকার কৈলাশ পর্বতের অপর নাম; সেটাই আবার দেবাদিদেবের বাসভূমি। সব কেমন মিলে মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। আদপে তো সবটাই হলো সনাতন ধর্মের কতগুলো ভাগ মাত্র। এই যে একের পর এক প্রচারক এসে বিভিন্ন ধর্মের উপস্থাপনা করেছেন, তারজন্য তো সেটির উৎসকে অগ্রাহ্য করা যায় না।

পাশ্চাত্যের হাওয়া লেগে মহান এই অধ্যায়টি কালক্রমে একটি পৌরাণিক গল্পগাথায় পরিণত হয়েছে।

২৫.

প্রফেসর মুকেশ কুমারের এই গবেষণা পত্র ইন্টারনেটে খুঁজলে অনায়াসেই পাওয়া যায়। পড়লে সত্যি বিস্ময় লাগে যে ইতিহাসের এমন সোনালী অধ্যায় গুলো কিভাবে ধূসর হয়ে পড়েছে কালক্রমে। সনাতন ধর্মের ব্যুৎপত্তি ভুলে মানুষ মেতে উঠেছে রক্তের নেশায়। এতে যে তার নিজের আত্মা, যা একমেবাদ্বিতীয়ম সেটাকেই যে বারংবার অগ্রাহ্য করে আসছে, সে বোধ টুকু সম্বন্ধে সচেতন হতে পারে না।

পাটনায় প্রবেশ করবার আগে এ সম্বন্ধে বেশ খানিক পড়াশুনা করে তবেই এসেছিলো বৃষকেতু। এখন গাড়িতে যেতে যেতে সেইসব কথাই ভাবছিলো সে। এমন একটা লোক যিনি এতটা ইতিহাস সম্বন্ধে সচেতন তার জন্য বেশ মায়াই লাগছিলো বৃষকেতুর। কিন্তু সে যে নিরুপায়। পঁচিশ বছর আগের সেই দৃশ্য আজও যে তার চোখের সামনে ভাসে প্রতিদিন। কত নিদ্রাহীন রাতে যে এই দুঃস্বপ্ন বয়ে বেড়িয়েছে সে তার ইয়ত্তা নেই। সেদিন যে অন্যায় হতে দেখেছিলো সে, তার তো কোনো ক্ষমা নেই। সেই অন্যায়ের কোনো ওজর তো নিছক জ্ঞান দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। তাই এ ব্যাপারে পিছিয়ে আসতে নিতান্তই অপারগ সে।

প্রফেসর মুকেশ কুমারের সাথে দেখা করবার কথা আগেই জানিয়েছিলো বৃষকেতু। প্রফেসর জানতেন একজন ছাত্র পাটনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসের অনুরাগী হয়েই দেখা করতে আসছে। তাই না করেননি তিনি। এবং যখন দেখলেন ছেলেটি তাঁর গবেষণা নিয়ে বিশদে পড়াশুনা করে এসেছে, তখন কোন প্রকারর দ্বিধাই তাঁর মধ্যে কাজ করেনি।


দরজা খুলতেই প্রফেসর দেখতে পেলেন একজন যুবক দাঁড়িয়ে রয়েছে।
-" তুমিই ফোন করেছিলে?", জিজ্ঞেস করলেন প্রফেসর।
-" হ্যাঁ স্যার, ভেতরে আসতে পারি ?", জিজ্ঞেস করলো বৃষকেতু।
-" হ্যাঁ এসো", বলে বৃষকেতুকে ডেকে নিয়ে এসে ভেতরে বসালেন। তারপর মোবাইল ফোনটি চার্জে বসাতে যেতেই টের পেলেন সেটি পুরোপুরি ডেড হয়ে গেছে। কখন যে সুইচ অফ হয়েছে খেয়ালই করেননি। নইলে হয়তো দেখতে পেতেন বেশ কয়েকটি মিসড কল হয়ে গেছে।

রাতুল এবং শ্রীময়ী তখনও অনেকটাই দূরে। বহুবার চেষ্টা করেও তারা যোগাযোগ করতে পারেনি প্রফেসর মুকেশ কুমারের সাথে। শ্রীময়ী বেশ কিছুক্ষণ ধরে প্রফেসর মুকেশ কুমারের ফোনে বারকয়েক কল করেও ব্যর্থ হলো, শেষমেশ হাল ছেড়ে দিলো। একেবারে গিয়েই দেখা হবে'খন।

অনির্বাণ সামনের সিটে চুপচাপ বসে ছিলো এতক্ষণ। এবার শ্রীময়ীকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো, " ম্যাডাম আমি খোঁজ খবর যা নিয়েছিলাম তাতে বিকাশ বা বৃষকেতু এই নামে কোনো পুরোনো রেকর্ড কিন্তু নেই। ওর পুরোনো অফিসের ঠিকানাটা যদিও ভুল ছিলো।"
-" হ্যাঁ কিন্তু সেটারই বা কারণ কি ? শুধু শুধু মিথ্যে বলবে কেন ?", বললো শ্রীময়ী।

রাতুল বললো, " উদ্দেশ্য একটা ছিলোই। সেটা খুঁজে বার করতে হলে ওর ঠিকুজি দরকার। তবে কোথাও যেন ভূদেব সিং নামটা আমার মাথায় বার বার খচখচ করছে।"

-" এনি আইডিয়া, কি উদ্দেশ্য হতে পারে। ওই শ্লোকটা যেটা প্রফেসর নন্দীর ডেডবডির পাশ থেকে পাওয়া গেছে, সেটারই বা কী কারণ থাকতে পারে ?", জিজ্ঞেস করলো শ্রীময়ী।
-" দেখ শ্রী, গুজরাট পুলিশের সাথে যোগাযোগ করে যতক্ষণ না লোথালের ঘটনা গুলো পুরোপুরি যাচাই করা যাচ্ছে বলা মুশকিল। প্রফেসর মুকেশ কুমার যদি কোনো আলোকপাত করতে পারেন তো একটা সূত্র পাওয়া গেলেও যেতে পারে।"
-" হুম, কিন্তু মুকেশ কুমারের ফোনটা অনেকক্ষণ ধরেই অফ দেখাচ্ছে। ওনাকে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না কিছুতেই।"


রাতুলদের গাড়ি ততক্ষণে পাটনার তেজ প্রতাপ নগরে ঢুকে গেছে। সন্ধ্যা হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। পথে বার তিনেক থামতে হয়েছিলো। সেই ভোর পাঁচটায় বেরিয়ে এই সাড়ে পাঁচশো কিলোমিটার রাস্তা আসতে প্রায় চোদ্দ ঘন্টার ওপর সময় লেগেছে। প্রফেসর মুকেশ কুমারের বাড়ি ভিখাচক মার্গের ওপরে। খুঁজতে বিশেষ অসুবিধা হলো না। কিন্তু ওনার বাড়ি পৌঁছে মনে হলো না যে কোনো প্রাণী এই মুহূর্তে বাড়িতে রয়েছে। গোটা বাড়িটা অন্ধকারে ঢেকে রয়েছে। বিয়ে থা করলেও বর্তমানে একাই থাকেন উনি। স্ত্রী গত হয়েছেন প্রায় বছর পাঁচেক। একমাত্র মেয়ে কানপুরে থাকে। কিন্তু এতটা থমথমে পরিবেশ থাকারও তো কথা নয়!

গাড়ি থেকে নেমেই শ্রীময়ী আগে গিয়ে কলিং বেল বাজালো। নাঃ কেউ এলো না দরজা খুলতে। অনির্বাণ একবার বাড়িটা এক চক্কর কেটে এসে বললো, " পুরো জায়গাটা অন্ধকার ম্যাম। উনি বোধহয় বাড়িতেই নেই।"

দু তিনবার বেল বাজিয়েও যখন কেউ দরজা খুললো না, শ্রীময়ী চলেই আসতে যাচ্ছিল। কিন্তু হঠাৎ কি একটা দেখে দাঁড়িয়ে গেল।
-" কী হলো ?", জিজ্ঞেস করলো রাতুল।

ব্যাপার খুব একটা সুবিধার নয়। অন্ধকারে এতক্ষণ কেউই খেয়াল করেনি যে, আদপে দরজা লক করা নয়, বরং তা খোলাই রয়েছে। শুধু কেউ যেন ভেজিয়ে দিয়ে গেছে।
-" রাতুল তুই আমার পেছনে থাক। অনির্বাণ বাবু গতিক সুবিধার নয়, টর্চ নিয়ে আসুন আর মুভ ভেরি কেয়ারফুলী", বলেই কোমরের কাছ থেকে নাইন এম এম পিস্তলটা বার করে একবার ঘোড়াটা টেনে নিলো।

রাতুলের বুঝতে বাকি রইলো না নিশ্চই সাংঘাতিক একটা কিছু ঘটে গেছে। শ্রীময়ী ধীরে ধীরে পিস্তলের নল টা দিয়ে দরজাটা ফাঁক করলো, আর অন্য হাতে টর্চটা বাগিয়ে ধরলো। তারপর সামান্য এগোতেই টর্চের আলো টা সরাসরি গিয়ে পড়লো সামনের ওয়ার্কিং ডেস্ক আর চেয়ারের ওপর। দেখে মনে হচ্ছে এটাই মুকেশ কুমারের স্টাডি। কিন্তু যা দৃশ্য সামনে দেখতে পাচ্ছে, তাতে তিনজনেই হতবাক হয়ে কয়েক পা পিছিয়ে এলো।

মুকেশ কুমার চেয়ারে বসে রয়েছেন, মাথাটা পেছন দিকে অস্বাভাবিক ভাবে হেলে পড়েছে। ঠিকরে বেরিয়ে আসা চোখ দুটো দেখেই মনে হচ্ছে দেহে প্রাণ নেই।

অনেক হাতড়ে সুইচ বোর্ড টা পাওয়া যেতেই লাইট জ্বলে উঠলো। বৈদ্যতিন আলোয় প্রফেসর মুকেশ কুমারের নিথর দেহটা আরো প্রকট ভাবে ওদের তিনজনকে স্বাগত জানালো এই মৃত্যুপুরীতে।

গুলি করে হত্যা করা হয়েছে ওনাকে। গোটা ঘর, বিশেষ করে ডেস্কের ওপরটা রক্তে ভেসে যাচ্ছে। আর সেই রুধিরাক্ত ডেস্কে প্রফেসরের বাম হাতখানা আলগোছে রয়েছে এবং তার নিচে কিছু একটা রয়েছে মনে হচ্ছে।

তৎক্ষণাৎ গিয়ে হাতের কব্জিটা তুলে নাড়ি খোঁজার ব্যর্থ চেষ্টা করতে গিয়েই শ্রীময়ী দেখলো হাতের নিচেই একটা টুকরো কাগজ। আর তাতে দেবনাগরী হরফে একটা সংস্কৃত শ্লোক লেখা রয়েছে-

" अहिंसा परमो धर्मः | धर्म हिंसा तथीव च "

২৭.

-" বার বার এই ব্যর্থতা তোমাকে তোমার লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করে দিচ্ছে বৃষকেতু।"
-" কিন্তু জিনিসটা যে মুকেশ কুমারের কাছে নেই সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত।"
-" কি করে এতটা নিশ্চিত হলে তুমি ?"
-" একজন লোক মৃত্যুর আগে কখনও মিথ্যে কথা বলতে পারে না। তাছাড়া আমি গত দুদিন ধরে ওনার সমস্ত ব্যাপারে নজর রেখেছিলাম এমনকি ওঁর ব্যাঙ্ক একাউন্টও আমি হ্যাক করেছি। কোথাও এমন কোনো লকার বা কিছুর হদিশ পাইনি যে উনি ফলকটাকে লুকিয়ে রাখতে পারেন। ওনার বাড়িতেও কোথাও কিছুই নেই।"
-" তাহলে তো বলতে হয় এবার তোমার সর্বশেষ নিশানাটিকেই অমোঘ লক্ষ্য করে এগোতে হবে। তাছাড়া জিনিসটা পাবার সম্ভাবনা একেবারেই ক্ষীণ। "
-" কিন্তু একটা কথা আমার বড় বার মনে হয়। এ শুধুই প্রতিশোধস্পৃহা নয় কি? আমি জানিনা আমি ঠিক করছি কিনা। মাঝে মাঝে মন বড় অশান্ত হয়ে ওঠে। একটা ফলকের জন্য এই হত্যা কি আদৌ সমীচিন ? কিছুতেই বুঝতে পারি না আমি, সব কেমন গুলিয়ে যায় আমার ।"

'হা হা হা হা' করে হেসে ওঠেন অপর প্রান্তের আদেশ কারী। তারপর বলেন, " বৃষকেতু, তুমি অবোধ বালকের মতো কথা বলছো। ওটা শুধু তোমার পারিবারিক অভিজ্ঞান নয়। ওই ফলকের মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে এক দুর্নিবার সত্য। যা এনে দিতে পারে এমন এক শক্তি যার বলে বলীয়ান হলে এ পৃথিবীকে করায়ত্ত করা যেতে পারে ?"
-" কিন্তু তাতে লাভ ? কার হিতসাধন হবে এই শক্তি দ্বারা ?"
-" মনে রেখো বৃষকেতু,
' কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন।
মা কর্মফলহেতুর্ভূমা তে সঙ্গোহস্ত্বকর্মণি'
অর্থাৎ কর্ম করে যাওয়াই তোমার ধর্ম। ফলের প্রতি আসক্ত হয়ো না। জানবে যা হচ্ছে তা হবারই ছিলো। তোমাকে তিল তিল করে গড়ে তুলেছি এই তুচ্ছ প্রশ্নগুলো শোনবার জন্য নয় বৃষকেতু।"
-" আমি দুঃখিত। তবে আজ সত্যি আমি ওটা পাই নি। হয়তো আগামী লক্ষ্যে সফলতা আসবেই।"
-" সেই আশাই করি আমিও। খুব শীঘ্রই আমাদের দেখা হবে।"

ফোনের কথোপকথন শেষ হলে বৃষকেতু খানিকটা চুপ করে বসে ভাবলো। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার সামনে দাঁড়িয়ে বোঝার চেষ্টা করলো আদপে যা করছে তা সঠিক তো ? পরমুহূর্তেই মনের মধ্যে ভিড় করে এলো পঁচিশ বছর আগের ভয়ানক সেই দিনটা।

স্কুল থেকে বাড়ি ফিরছিল বছর সাতেকের ছোট্ট বৃষকেতু। বাড়ির কাছাকাছি আসতেই দেখতে পেলো চারদিক কেমন কালো ধোঁয়ায় ভরে উঠেছে। লোকজন বালতি করে জল ঢালবার ব্যর্থ চেষ্টা করছে। আগুনের লেলিহান শিখা একটা তাঁবুকে গ্রাস করে ফেলেছে। এই তাঁবুতে কিছু লোকজন এসে অনেকদিনই রয়েছে। তার বাবারও সেখানে যাতায়াত আছে। হঠাৎ দেখলো দুটো জ্বলন্ত দেহ আর্ত চিৎকার করতে করতে চোখের সামনে ঝলসে যাচ্ছে। সর্বনাশ এ যে তার নিজের বাবা মা। তাদের গলার স্বর তো তার চিনতে ভুল হবে না। ওরা ওখানে কী করছিলো ?

বৃষকেতু চিৎকার করে পাগলের মতো ছুটে গেলো। কিন্তু ধোঁয়ার দমকে ছিটকে এলো। পারলো না নিজের বাবা আর মা কে বাঁচাতে। আতঙ্কে, ভয়ে, কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দিশাহারা হয়ে গেল বৃষকেতু।

পারেনি সে। কাউকে বাঁচাতে পারেনি সেদিন। তারপর প্রতি মুহূর্তে সে একটা জীবন্ত লাশের মতো বেঁচে থেকেছে। যতদিন না এই মানুষটা যিনি আজ তাকে প্রতি মুহূর্তে পার্থসারথীর মত চালনা করছে, এসে তাকে প্রতিদিনের মরে যাওয়া থেকে বাঁচতে শিখিয়েছে। তার পারিবারিক ইতিহাস ঘেঁটে পুরাতন গৌরবময় অধ্যায় গুলো মনে করিয়ে তাকে সংগ্রাম করতে অনুপ্রাণিত করেছে। তাঁর কথায় সন্দেহ করা কিংবা তাঁকে প্রশ্ন করার অধিকার বোধহয় তার নিতান্তই অনুচিত। তবুও আজ সে বড়ই দ্বিধাগ্রস্ত, চিন্তিত। লক্ষ্য যেন বার বার অধরা থেকে যাচ্ছে আজ।

মোবাইল বের করে গান শুনতে থাকে বৃষকেতু। তার প্রিয় গান খানা-
      " ....হম উলঝে ইস বন্ধন মে
                            দিন রাত ইয়ে ন্যয়ন ভিগোতে  হ্যয়
       কুছ এয়সে ভি   পল হোতে হ্যায়..... "

২৮.

মুকেশ কুমারের এমন অকস্মাৎ মৃত্যু শ্রীময়ী আর রাতুলকে সম্পূর্ণ রূপে বিভ্রান্ত করে দিলো। ঠিক সেই একই রকমের প্যাটার্ন মেনে এই হত্যাটি সংগঠিত হয়েছে। ভিকটিমের বুকে আর পেটে দু দুটো বুলেটের দাগ। আর সেই সাথে সংস্কৃত শ্লোক।

শ্রীময়ী নিজেই ফোন করে লোকাল থানায় খবর পাঠিয়েছিল। ওসির আসতে যে আধঘন্টাটাক দেরি হলো শ্রীময়ী নিজেই একটু প্রাথমিক অনুসন্ধান সেরে নিলো। বিশেষ কিছু আলাদাভাবে বলা গেলো না। প্রফেসর নন্দী আর এনার মৃত্যুর ধরণ এতটাই সদৃশ যে দুটি খুনই যে একই ব্যক্তির কাজ সেটা সুস্পষ্ট ভাবে বোঝা যাচ্ছে।

রাতুলের এই দৃশ্য বেশিক্ষণ ভালো লাগলো না। বাইরে গিয়ে গাড়িতে এসে বসলো সে। এতক্ষণ যা যা ভেবে আসছিলো এখন যেন আরো বেশি জটিলতর লাগছে সবটা।

দুজনেরই হত্যার ধরণ সম্পূর্ণ এক। বেছে বেছে যারা লোথালের সেই ঘটনার সাথে জড়িত ছিলো তাদের খুন করা হচ্ছে ? একই ভাবে খুনের পর এলোপাথাড়ি ভাবে গোটা বাড়ি কিছু খোঁজার চেষ্টা করেছে আততায়ী। টাকা পয়সা কোনো কিছুই খোয়া যায়নি। এমনকি প্রফেসর মুকেশ কুমারের হাতের দামী রোলেক্স ঘড়িটা পর্যন্ত মৃত্যুর সময় হাতে পরা অবস্থায় ছিলো। বেশ নির্লোভ আততায়ী বলতে হবে। কিন্তু সত্যি কি তাই ? কিসের উদ্দেশ্যে এই খুন গুলো করছে সে ? প্রথমে প্রফেসর নন্দী, এখন মুকেশ কুমার। এর পর কি তাহলে...? আর ওই শ্লোকটা কিসের তাৎপর্যবাহী ?

" অহিংসা পরম ধর্ম, ধর্ম হিংসা তথীব চ"

অর্থাৎ অহিংসা পরম ধর্ম হলেও কখনো কখনো ধর্ম রক্ষার স্বার্থে হিংসাত্মক হওয়া টাও ধর্ম।

খুনের পর এইভাবে শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা থেকে শ্লোক লিখে রাখার কারণই বা কি ? সব যেন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে রাতুলের।

২৯.

-" কী হচ্ছে বলতো, এখন তো সিরিয়াল কিলিংয়ের মতো লাগছে?", রাতুলের পিঠে আলতো একটা চাপড় দিয়ে শ্রীময়ী এসে তার পাশে বসে বললো, " কিছু সন্দেহ করছিস নাকি ?"
-" সেটা তোর কাজ। আমি শুধু সূত্র খুঁজছি", গম্ভীর ভাবে উত্তর দিলো রাতুল।
-" হুম, এদিকটা লোকাল থানা সামলে নেবে। কিন্তু এরপর ? এতদূর আসাটা বৃথা হয়ে গেল শেষে ?"
-" একদমই নয়। যদি ভেবে থাকিস আমাদের জার্নি শেষ হয়ে গেছে তাহলে ভুল করবি। কারণ আমার মনে হয় খুব শিগগিরই তৃতীয় খুনটা হতে চলেছে।"
-" হোয়াট! আই মিন কী বলছিস ? কে ??"
-" ডঃ বিধান শর্মা। "
-" এতটা শিওর কি করে হচ্ছিস তুই ?"
-" ভালো করে ভেবে দেখ শ্রী। প্রফেসর নন্দী, মুকেশ কুমার এবং ডঃ বিধান শর্মা এরা তিনজনই গুজরাট গেলেন একটা এক্সক্যাভেশনে। তারপর সেখানে এমন একটা কিছু হলো যেটা যেভাবেই হোক চেপে গেলেন সবাই। আজ এত বছর পর কেউ একজন ফিরে এসে খুন গুলো তাদেরকেই করছে যারা সেদিনের সেই ঘটনায় প্রত্যক্ষ ভাবে জড়িত ছিলো- এমন ভাবা কি ভুল ?"
-" কিন্তু মোটিভ ? বদলা নেওয়া ???"
-" হতেও পারে। আর নইলে সেই ফলকটা যেটা দুর্মূল্য, যেটার জন্য ওঁরা তিনজন এই ঘটনায় জড়িয়ে পড়েছিলেন।"
-" লজিক রয়েছে এর মধ্যে কিন্তু কে এমনটা করবে ? এক যদি না ভূদেব সিংয়ের ছেলে এত বছর পর বদলা নিতে ফিরে আসে।"
-" একজন দশ বছরের বাচ্চা ছেলের কি এতটা বোঝদার হওয়া সম্ভব যে এতদিন পর এত পুরোনো একটা ঘটনার বদলা নিতে ফিরে আসবে। সে সময় তো ভূদেব সিংয়ের ছেলের ওরকমই বয়স বলেছিলো সুশান্ত বাবু। তার ফিরে আসার হলে এতদিন পর কেন ? না না শ্রী এটা খুব প্ল্যান করে ঘটছে। নেপথ্যে অবশ্যই কেউ আছে। ওই শ্লোক গুলোই তার প্রমাণ। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অর্জুন যুদ্ধ করলেও শ্রীকৃষ্ণই ছিলেন আসল হোতা। সেটারই কি সূত্র আততায়ী বার বার ছেড়ে যাচ্ছে ? কী প্রমাণ করতে চাইছে সে ? আততায়ী কি একা নাকি অনেকে ?"
-" খুনের ধরন দেখে একজনই আততায়ী মনে হয়, একাধিক নয়। সেটা কে হতে পারে ? বৃষকেতু ?"
-" নিঃসন্দেহে ওর ওপর সন্দেহ সবচেয়ে বেশি। ভুয়ো পরিচয়ে প্রফেসর নন্দীকে খুন করেছে। কিন্তু এখানে কেন ? লোথালের ঘটনাটা খুব ইম্পরট্যান্ট মনে হচ্ছে আমার। এমন কেউ রয়েছে যে ওই ঘটনার সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত।"
-" তাহলে ডঃ শর্মাও তো হতে পারেন ?"
-" অবশ্যই। কিন্তু উনি সম্ভাব্য ভিকটিমও হতে পারেন। খুনী হয়তো অন্য কেউ। সেই জন্যই ওনার কাছে পৌঁছনো খুব জরুরী এই মুহূর্তে। তবে উনি ছাড়াও আরো একজনের ওপর আমার সন্দেহ রয়েছে।"
-" কে বলতো ?"
-" সুশান্ত সেনগুপ্ত"
-" কিন্তু উনি, মানে কেন বলছিস একথা ?"
-" উনি সেদিন অনেক কথা গোপন করে গিয়েছিলেন বলে আমার মনে হয়েছিল রে শ্রী। অনেক কথাই বলেননি। ওঁর খবর নেওয়াটা জরুরী। তুই কলকাতায় খোঁজ নিয়েছিলি তারপরে ? ওনার মুভমেন্ট টা জানা দরকার।"
-" হুম, সেটা পেয়ে যাবো। তাহলে আমাদের নেক্সট গন্তব্য কি ডঃ বিধান শর্মা?"
-" ইয়েস ম্যাডাম। তুই বরং অনির্বাণ বাবু কে এখানে সামলাতে বল। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ডঃ শর্মার ওখানে পৌঁছতে হবে আমাদের। হাতে কিন্তু একদমই সময় নেই।"

ক্রমশ...
 



Ayan Das